১৯৩ পাতার একখানি গ্রন্থ। কমবেশি চল্লিশটি প্রবন্ধে ধরা হয়েছে দীর্ঘ ছত্রিশ বছরের কর্মবহুল প্রশাসক জীবনকে। বাংলা ভাষার প্রথিতযশা কবি, গদ্যকার অনিতা অগ্নিহোত্রীর ‘রোদ বাতাসের পথ’। কর্ম জীবন থেকে অবসরের পর তিনি রচনা করেছেন স্মৃতিকথা। ১৯৮০ সালে ভারতীয় প্রশাসনিক সেবায় যোগদান করে ২০১৬ সালে সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের সচিব রূপে দেশের রাজধানী শহরে অবসর গ্রহণ। মধ্যবর্তী সময়ের পথ চলার নির্যাসটুকু ধরা পড়েছে ‘রোদবাতাসের পথ’ গ্রন্থে। বিন্দুতে সিন্ধু প্রতিবিম্বিত করার অনায়াস দক্ষতায় লেখিকা মেলে ধরেছেন স্বদেশের প্রকৃত মুখচ্ছবি।
১৯৮১তে তৎকালীন বিহারের হাজারিবাগ থেকে ত্রিশ মাইল দূরে ঘন অরণ্য সমাকীর্ণ বড়কাগাঁও ব্লকের বিডিও কাম সার্কল অফিসার রূপে তাঁর প্রথম ফিল্ড পোস্টিং। ক্যাডার রাজ্য ছিল ওড়িশা। সেই রাজ্যের বহু প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রশাসনিক দায়িত্বভার পালন করেছেন। মহিলা হিসাবে পোস্টিং-এর ক্ষেত্রে আলাদা কোন রকম সুবিধা প্রত্যাশা করেন নি, পানও নি। তাঁর সময়ে সিভিল সার্ভিস ছিল ‘বয়েজ ক্লাব’। পুরুষপ্রধান বৃত্তিতে নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। বুঝে নিয়েছেন এদেশে পুরুষের ‘সমকক্ষ হতে গেলে…. দ্বিগুণ হতে হয়।’ (‘দ্বন্দ্ব সংহিতা’)
বিশল্যকরণীর মতো প্রকৃতি অনিতা অগ্নিহোত্রীকে বাঁচার নতুন মন্ত্র দিয়েছে। হাজরা রোডের বাসা বাড়িতে থাকা যে কিশোরীটি সূর্যডোবা আকাশের রং দেখতে চাইত, দারোয়ানকে কাকুতিমিনতি করে ছাদের দরজা খোলাত, তার চোখের সামনে অবারিত হয়েছে প্রকৃতির সৌন্দর্যদ্বার। সেখানে “চাঁদ উজাগর হলে রাত পাখিরা ভোর মনে করে স্বপ্নে ডেকে ওঠে কখনো, বনপুষ্পের আমের মঞ্জরীর মাতাল করা গন্ধ রক্তে নেশা ধরায়, তাতে বসন্ত রাত্রে এসে মেশে শালফুলের গন্ধ, মহুয়ার ঘ্রাণ।” (‘সেই রমণীরা’) বিজন বনপথে দেখা যায় মা লেপার্ড ছানাদের নিয়ে বসে আছে। অন্যত্র তিনি লিখেছেন “পর্বতের ঢেউ, শাল অরণ্য, সাদা ফুলে ছাওয়া যোজন যোজন বনঝোপ, মহুয়া ও আমের মঞ্জরীর গন্ধে উতল সন্ধ্যার বাতাস, জগৎপুরের কাঠের পোল পেরিয়ে মহানদীর বিপুল বিস্তারের কাছে আসা, এসবই আমার আত্মার গভীরে চিহ্ন রেখে যায়, কখনও কবিতায় গদ্যে ফিরে আসবে বলে। যাত্রার কষ্ট টের পাই না।” (‘ধবল টগর’)
শুধু যাত্রার কষ্ট কেন, বৃত্তির প্রয়োজনে কত সময় আত্মজন, পুত্রকন্যা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়েছে। সেই বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি করতে পারেনি। জনকজননীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কখন সন্তানও কপালে মেখে নিয়েছে ধুলোর তিলক। পাঁচমাস বয়সী মেয়েকে তার বাবার কাছে রেখে সুদূর পাহাড়-জঙ্গলের জেলায় চলে যেতে হয়। মেয়ে একটু বড়ো হয়ে আসে মায়ের কাছে। ফুলবনীর কন্ধ যুবক ভাগীরথী কনহর তার সব দুষ্টুমির সাথি। দুজনে মিলে মেলার দলছুট হাতিকে চাল খাওয়ায়। পথভোলা গোখরো সাপকে ধরাধরি করে জঙ্গলে ছেড়ে আসে। কিন্তু বর্তমানে দাঁড়িয়ে যখন পিছন পানে ফিরে তাকান, মনের মধ্যে জেগে ওঠে সংশয়জড়িত প্রশ্ন, সন্তানদের কি প্রাপ্য ছিল না আরো নিশ্চিন্ত শৈশব? ‘আরও শান্ত, বিপন্মুক্ত জীবন?’ (‘ধুলোর তিলক’)
প্রশাসক অনিতা অগ্নিহোত্রীর অভিজ্ঞতার জগৎ সুবিশাল। লেখকসত্তা তাঁকে দিয়েছে গভীর অন্তর্দৃষ্টি। কর্মজীবনের বিভিন্ন পর্বের সঙ্গে তিনি লিখে চলেছেন কর্মসূত্রে তাঁর সঙ্গে জড়িত মানুষদের কথা। তাঁর আক্ষেপ, নৈর্ব্যক্তিকতা তাঁর স্বভাবে নেই, তিনি বড় বেশি সাবজেক্টিভ। হয়তো সে জন্যই মানুষগুলি রক্তমাংসের অবয়ব নিয়ে উঠে আসে তাঁর রচনা থেকে। কূটনীতির সূক্ষ্ম কলাকৌশল তাঁর আয়ত্ত নয়, বারে বারে বদলি হতে হয়েছে। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাই নিজেরই কর্মযজ্ঞ থেকে অসময়ে অপসারিত হয়েছেন। উচ্চপদস্থ আধিকারিক রূপে কোনো দপ্তরের বাইরের চেহারা দেখে ভোলেননি। অন্দরে উঁকি দিয়েছেন। ১৯৭৫। আইসিডিএস প্রকল্পের জন্মসাল। লেখিকা ওড়িশা রাজ্যে এই প্রকল্পের উপসচিব নিযুক্ত হলেন। প্রকল্পের কাজে আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিকে সঙ্গে নিয়ে দূর জেলায় গেছেন। উচ্চমার্গের মধ্যাহ্নভোজনের পর সকলে যখন বসার ঘরে, লেখিকা চলে গেছেন খিড়কি দুয়ারে। দেখেন, “হাপুস নয়নে কাঁদছে অনেকগুলি মেয়ে, সবাই অঙ্গন বাড়ি কর্মী। তারা দুমাস ভাতা পায়নি, তার ওপর আজকের খাওয়াদাওয়া হয়েছে তাদেরই চাঁদার টাকায়, মাথাপিছু দুশো টাকা। লজ্জায় মাথা হেঁট হল।” অঙ্গনবাড়ি কর্মীরা বেতন পান না, প্রাপ্য বলতে অনিয়মিত একটি সাম্মানিক ভাতা। কিন্তু সামাজিক দায়বদ্ধতায় এঁদের কোনো ঘাটতি নেই। কোরাপুটের দুর্গম অঞ্চলে এক সন্ধ্যার প্রাক্কালে বিরল অভিজ্ঞতা হয় লেখিকার, “এক রমণীকে দেখি পিঠে করে বস্তা নিয়ে যাচ্ছে নুয়ে পড়ে। জিপ-ট্রেলারে খাবার পৌঁছে দেওয়া হতো অঙ্গন বাড়ি কেন্দ্রে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, সে অঙ্গন বাড়ি কর্মী। খাদ্য ফুরিয়েছে কদিন হল, শিশুরা ক্ষুধার্ত ফিরে যাচ্ছে অথচ জিপ পায়নি, তাই নিজেই পৌঁছতে চলেছে। এদের কীভাবে সেলাম করি?” (‘সেই রমণীরা’)
ভারতের এক বিপুল জনগোষ্ঠী তাদের শ্রম দিয়ে, সেবা দিয়ে উন্নয়নের চাকাটি নীরবে গড়িয়ে নিয়ে চলেছে। চাকার তলাতে কখনো পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শাসনযন্ত্র তাদের ভুলে থাকতে চায়। অবমানিত, উপেক্ষিত সেই মানুষদের হয়ে লেখিকা কলম ধরেছেন। রাঁচির প্রশাসনিক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের হস্টেলে জল ভরে দিতেন আদিবাসী প্রৌঢ় খালকো। মহিলা অফিসারদের সঙ্গে ছিল তাঁর সহজ সম্পর্ক। ঘর সংসারের কত কথা বলতেন তিনি। হাতের কর গুনে দেখাতেন তিন ছেলেকে। বিপজ্জনক সাফাইয়ে নেমে একবেলার মধ্যে তিনজনই মারা পড়ে। “চাতালের উপর তাদের সবচেয়ে ভালো টি শার্ট আর প্যান্টে সাজানো, সদ্যস্নাত, তিনটি যুবক শরীর, শেষযাত্রার জন্য প্রস্তুত।” (‘ম্যানহোল’) খালকোর সেই উদ্ভ্রান্ত শোকহীন বিমূঢ় মুখখানি সাড়ে তিনদশক পার হয়েও তাঁর পিছু ছাড়ে না।
গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে রোদবাতাসের পথচলায় সহযাত্রী, লেখিকার জীবনসঙ্গী প্রযুক্তিবিদ, শক্তি বিশারদ ডক্টর সতীশ অগ্নিহোত্রীকে। ‘আলো-গ্রাম’ প্রবন্ধে রয়েছে ডক্টর অগ্নিহোত্রীর বিকল্প শক্তি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার দিনগুলির কথা। এমনই কোনো একটি দিনে তাঁদের বাড়িতে সৌর কুকারে ভাত-ডাল রান্না হচ্ছে। সূর্যের তেজ তো রোজ একরকম থাকে না, সেদিন কম, তাই রান্নার গতিও ধীর। প্রশাসক দম্পতির দুবছরের শিশুপুত্র ক্ষুধার্ত, অভুক্ত। মা উদ্বিগ্ন, বাবা নিরুত্তাপ। তারপর এক রাতে দূরপাল্লার যাত্রাপথে দূরে আলোর বিন্দুর সমাহার দেখে আশ্চর্য হন। ক্রমে চোখে পড়ে গ্রামে সারি সারি পাতার কুটিরে জ্বলছে সৌরবাতি, পথের ধারে সৌর বাতিদান। সে আলোর কাছে মলিন হয়ে যায় মধ্যরাতের টাইম স্কোয়ার, ফুজিয়ামার আকাশের আলোর রোশনাই। অনিতা অগ্নিহোত্রী লিখছেন, “বিপুল অন্ধকারের মধ্যে জেগে থাকা আলোর মধ্যে ছিল ভাতের জন্য ক্ষুধার্ত শিশুর আকিঞ্চন আর ছিল বিদ্যুতের খুঁটির জন্য বহু নির্বাচন পার হওয়া মানুষের আলোর পিপাসা। আমরা কেবল সঙ্গে ছিলাম।” (‘আলো-গ্রাম’) ফুলবনী জেলার গান্ধীবাদী কর্মী পারসভাই তাঁকে বলেছিলেন, পরিবর্তন তো অনেক বড়ো কথা। “হাম কেবল সাথ চল সকতে হৈ।”
মানুষের পাশে থাকার চিহ্ন বুকে নিয়েই কিছু পোস্টকার্ড এখনো বেরিয়ে আসে লেখিকার বাড়ির পুরোনো কাগজপত্র, বইখাতার ফাঁক থেকে। তাঁর নিজের হাতে নাম ঠিকানা লেখা। আঁকাবাঁকা হাতের অক্ষরে চিঠির অপর পিঠখানি ভরা। নবসাক্ষরদের হস্তাক্ষর। নয়ের দশকের শুরুতে অনিতা অগ্নিহোত্রী ওড়িশা রাজ্যে গণশিক্ষার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক ছিলেন। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষ গ্রামের কোনো বারোয়ারি জায়গায় বসে অচেনা অক্ষর চেনে, অঙ্ক কষে, হাতের লেখা করে। ‘যেন অচেনা দুনিয়ার চাবিকাঠিটি তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।’ (‘তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল’) সাক্ষরতা তাদের আত্মবিশ্বাস জাগায়। এর আগে সুন্দরগড়ের জেলাশাসক থাকার সময়ে তিনি দেখেছিলেন মানুষ কেবল নিজের নাম সই করা নয়, পড়তে চায়, লিখতে চায়, হিসেব শিখতে চায় যাতে নিজের লড়াই নিজেই লড়ার অস্ত্র খুঁজে পায়। সেই বিশ্বাস বুকে নিয়ে তেতরী বুধবারী শনিচরী নামের সেই মেয়েরা “কেরোসিনের টেমি জ্বেলে দিনের শেষে অক্ষর শিখবে বলে মুঠো মুঠো করে শাল করঞ্জ মহুয়ার বীজ জমাত সংসারের প্রয়োজন বাঁচিয়ে।” (‘সুন্দর কাণ্ড’-তৃতীয় পর্ব) নবসাক্ষরদের খোঁজে, তাদের পড়াশোনার গুণমান দেখতে লেখিকা চলে গেছেন কালাহান্ডি, মালকানগিরি। গেরুয়া উত্তাল নদীর মধ্যে ঘুরেছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। নবসাক্ষরদের কাছ থেকে আদায় করে নিতেন প্রতিশ্রুতি, সাক্ষর হবার পর তাঁকেই লিখবে প্রথম চিঠিটি।
কর্মজীবনে লাল ফিতের ফাইল আর নিয়ম-কানুনের কঠোরতার থেকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন মানুষকে, তাদের ন্যায্য অধিকারকে। প্রান্তিক, দলিত মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন প্রশাসনিক সুবিধা। দেশের নদী, পাহাড়, মানুষের সঙ্গে তাঁর এই সখ্যের প্রসঙ্গ অবধারিত ভাবেই তাঁর লেখায় ফিরে ফিরে এসেছে। ‘নির্বাসিত লেখক-শিল্পীকে গড়ে নিতে হয় তাঁর নিজস্ব পৃথিবী’। সুন্দরগড়ের ব্রাহ্মণী নদী বা বিজন অরণ্য তাঁর সেই বিস্তীর্ণ ক্যানভাস, যার উপর আঁকা হয় জীবনের ছবি। ‘ভেজা শাড়ি, পায়ে জলের স্পর্শ, ঢেউ-এর মৃদু গান এখনও প্রাণে লেগে আছে।’ (‘সুন্দর কান্ড’-প্রথম পর্ব) আর কলস্বনা নদীকে যখন বাঁধে আটকে ফেলা হয়? বিশাল জলাধার ডুবিয়ে দেয় প্রাচীন জনপদ? মানুষের বাস ওঠে। জেলে জমি পায় না নদীর ধারে, তাঁতির নতুন ভিটে হয় জঙ্গলের কাছ ঘেঁষে। ‘ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় গ্রামজীবনের বন্ধন। মানুষ টুকরো হয়ে যায়, একা এবং শেষ পর্যন্ত নীরব।’ (‘নদীর সঙ্গে কথা’) সরকারি কাজে যখন জমি অধিগৃহীত হয়, তখন ন্যূনতম জমি নেবার কথা। অথচ লেখিকা দেখেন উন্নয়নের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে ঘর ছাড়ে অজস্র মানুষ, সেখানে তৈরি হয় বড় বাংলো, সুইমিংপুল, ফোয়ারা।
অনিতা অগ্নিহোত্রী দেখেছেন, আমাদের দেশের শ্রমজীবী দরিদ্র জনসাধারণ নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে সংকুচিত, অধিকার সম্পর্কে ধারণাহীন। সাড়ে তিন দশকের মধ্যে এ অবস্থার বিশেষ হেরফের হয়নি। মুম্বইয়ের আন্ধেরি অঞ্চলে স্পেশাল ইকোনমিক জোনের দায়িত্বভার নেবার পর তিনি ঘোষণা করেন, এসইজেড এ কর্মরত শ্রমিক মায়েদের একজন যদি, বছরে একদিনও, তাঁর শিশুকে নিয়ে আসেন, ক্রেশ চালাতে হবে। এই সময়ে আসেন মরাঠি লেখিকা, নাট্যকার ও সমাজকর্মী জ্যোতি মহাপসেকর। জ্যোতির স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের মেয়েরা ক্রেশ তৈরির ভার নেন। খেলনা, বই, ভালো খাবার, দুধ, শিশুর প্রতি যত্নে ক্রেশ ক্রমে জমে ওঠে। জ্যোতির উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবীরা মহিলা কর্মীদের ‘নিজের অধিকার জানুন’ শীর্ষক বই বড় অক্ষরের হিন্দি ও মরাঠিতে ছাপিয়ে বিলি করতে থাকেন। উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন শিল্পপতিরা।
ছত্রিশ বছরের কর্মজীবনের দশটি বছর কেটেছে কলকাতায়, নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। বৈদেশিক বাণিজ্য অফিসের কাজ শেষ হবার পর রূপকলা কেন্দ্রের দায়িত্বভার সামলেছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ফিল্মল্যাব রূপায়নের কাছ ঘেঁষে পাঁচ একর জমিতে নতুন সমাজ সংযোগ শিল্পকেন্দ্র। সত্যজিৎ রায়ের বাসভবন তৈরির জন্য নির্দিষ্ট ছিল এই জমি, তাঁর ইচ্ছাতেই এই চলচ্চিত্রকেন্দ্র গঠনের পরিকল্পনা। ‘রূপকলা কেন্দ্র’ ছিল লেখিকার ‘কর্মজীবনের শ্রেষ্ঠতম পর্ব’। সেখানকার ‘আনন্দের স্মৃতিগুলি যেন জোনাকিদলের মতো কাল ব্যবধানের অন্ধকারে ভেসে বেড়ায়।’ (‘সুখের দিন’)
একই সঙ্গে তাঁকে ঘিরে থাকতো মাতৃভাষার কলস্বরের মধ্যে জেগে ওঠা ও ঘুমিয়ে পড়ার অপরূপ আনন্দময় অনুভূতি। সেসব দিনে “মনের মধ্যে হু-হু করে কবিতা আসে যায়, একটি লিখে ফেলে দেখি আরও একটি না লেখা কবিতা আমার মুখের দিকে ঘুম-ভাঙা শিশুর মত চেয়ে আছে।” (‘কলকাতার কোল’)
মিতায়তন প্রবন্ধগুলি যেন এক একটি ছোট গল্প। জীবনের চকিত উদ্ভাস। সে জীবন শুধুই বিষাদময় নয়, ভালোবাসা আর প্রাণরসে ভরপুর, কখনো বা হাস্যোজ্জল। ‘মজার মানুষ’ প্রবন্ধে এমনভাবেই জলছবির মতো ছাপ রেখে যান কিছু মানুষ। তাঁদেরই একজন লখনপুরের বিডিও মার্শাল। অবশ্যই এটি প্রকৃত নাম নয়, সুরসিক মানুষটির স্বকৃত নামকরণ। বাইক-আরোহী মার্শাল একদিন জঙ্গলের নির্জন পথে দুই খুদে ভালুকছানাকে পেয়ে বাইক বেঁকিয়ে চুরিয়ে তাদের ভয় দেখাতে চান। তখনই জঙ্গল থেকে সদাসতর্ক মা-ভালুক বেরিয়ে এসে মার্শালের হেলমেট পরা মাথায় শুধু থাবাটি রাখে। কোনোক্রমে জঙ্গল পার হয়ে এসডিওর বাড়ির সামনে এসে মার্শাল অজ্ঞান। জ্ঞান আসার পর শপথ করেন, আর কখনো বাঘ ভালুক বা নেকড়ে ছানাদের একা পেয়ে ভয় দেখাবেন না।
দোর্দণ্ডপ্রতাপ জনপ্রতিনিধি বংশী মাহাতো যুক্তিতর্কের ধার ধারতেন না। মিটিংয়ে এসে বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে যেতেন। অথচ তাঁর গ্রামে গিয়ে যখন নদীর বালিতে লেখিকার গাড়ির চাকা বসে যায়, এই বংশী মাহাতোই হাঁকডাক করে সকলকে নিয়ে এসে চাকা ঠেলে তোলেন। হাত নাড়িয়ে বিদায় জানান। তাঁর হাতের এমন ‘সখ্যমূলক ভঙ্গিমা’ কেউ এর আগে দেখেনি। বহু বছর বাদে এই প্রথম জেলা থেকে কোনো অফিসার এই অঞ্চলে এলেন যে!
প্রশাসনিক দায়িত্বে যাঁরা থাকেন, তাঁরা জানেন উপরতলার বিভিন্ন বিভাগের সংযোগহীনতায় কতরকম অভাবনীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। রাজ্যের কৃষিবিভাগকে হরিয়ানা সরকার কথা দিয়েছিলেন, রোওয়ার মরশুমের আগেই পাঠাবেন উচ্চ ফলনশীল বীজ। কিন্তু ট্রাকভরা আলু নিয়ে হরিয়ানভি ট্রাকড্রাইভার বড়কাগাঁওতে এসে পৌঁছয় কনকনে ঠান্ডা পৌষের রাতে। রাজ্যের নন-গেজেটেড কর্মচারীরা সেসময় ধর্মঘট করছেন। কম্পমান প্রভুরাম চৌকিদার ঘুম ভাঙ্গায় তরুণী বিডিওর। “হুজুর, আলু আ গয়া, ইসলিয়ে রৌরাকো জাগানা পড়া- রৌরা হল আদরার্থে প্রথম পুরুষ বহুবচন। তেনারা কথাটির দেশজ মূর্তি। প্রথমে মনে হল, গভীর ঘুমে আছি। স্বপ্ন দেখছি। প্রভুরাম আমাকে ভেবেছে আলুর আড়তদার।” (‘একটি শীতের রাত’)
ড্রাইভারের কাকুতি মিনতিতে আলু আনলোড করতে হয়। ধর্মঘটী কর্মচারীরা মাংকিক্যাপ, মাফলারে নিজেদের মুড়ে আলু গোছান। সময় পার করে আসা আলু কয়েক মাস ধরে সেদ্ধ, পোড়া, ভাজা খায় বড়কাগাঁও।
অনিতা অগ্নিহোত্রীর সমস্ত সত্তাকে ঘিরে রয়েছে মানবতার স্নিগ্ধ, উজ্জ্বল শিখা। সেই বোধ তাঁকে মানুষের বেদনার পাশে দাঁড়াতে শেখায়। কর্মজীবনের সূচনা থেকেই তিনি অন্যরকম করে ভাবেন, তাঁর চিন্তা স্বাধীন, চেতনা জাগ্রত। তখন তিনি বড়কাগাঁও ব্লকের বিডিও। টিনের চাল ছাওয়া ব্লক অফিসে প্রায় নিয়মিত আসে আদিবাসী যুবক ইগনিয়াস। বাইশ কিলোমিটার দূরের চরডিহা গ্রাম থেকে দৌড়ে আসে সে, দৌড়েই ফিরে যায় আবার। মুন্ডা, ওঁরাও আদিবাসীবহুল এই অঞ্চলে পঁচিশটার মতো কুয়ো মঞ্জুর হয়েছে বিশেষ কোনো প্রকল্পে, কিন্তু নিয়ম-কানুনের জটিলতার জন্য সেগুলি আধা কী সিকি খোঁড়া হয়ে পড়ে আছে। তাদের হয়ে দরবার করতে আসে ইগনিয়াস। প্রশাসনিক বিধি লঙ্ঘন না করেও লেখিকা গ্রামে গ্রামে ঘুরে জলহীন, অসম্পূর্ণ কূপগুলির কাজ আবার শুরু করান। জ্যোৎস্নামাখা বনপথ ধরে রাস্তা দেখিয়ে ছুটে চলে ইগনিয়াস। তার খালি পা, ছেঁড়া জামা, আতেলা চুল। ‘বড় বড় গাছের ম্লান ছায়ায় ধাবমান ইগনিয়াসকে মনে হয় শাপগ্রস্ত অরণ্যদেবতা।’ (‘ইগনিয়াস’) পরের মরশুমের প্রথম বর্ষায় টলটল করে পঁচিশটি কূপ।
অনিতা অগ্নিহোত্রীর সাহিত্যিক জীবনের পশ্চাৎপট ও বিবর্তনের ইঙ্গিত ধরে রাখে এই গ্রন্থ। লেখিকার একমাত্র ডিস্ট্রিক্ট পোস্টিং ওড়িশার সুন্দরগড় জেলা, সেই অভিজ্ঞতার আধারে রচিত তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘মহুলডিহার দিন’। একদিকে মানুষের অস্তিত্বের লড়াই তাঁকে বাঁচার রসদ দেয়, অন্যদিকে লেখা তাঁকে প্রতিকূলতা জয়ের শক্তি জোগায়। কলকাতার অফিসে ফোনে তাঁকে সহায়তা করতেন কৈশোরে দৃষ্টিশক্তি হারানো শিবানী। ‘অলীক জীবন’ উপন্যাসের রানি চরিত্র তাঁর আদলে নির্মিত। কবিতার বই ‘ব্রেল’ এই শিবানীকে উৎসর্গ করা হয়েছে। কেওনঝর জেলার জুয়াংগ উপজাতির বাস। তাদের মধ্যে কোন সাক্ষর বয়স্ক মানুষের অভাবে একটি স্কুলছাত্র বড়দের পড়াতো। বাবা-মা দুজনেই তার ছাত্র। তাকে নিয়ে লেখা হয়ে যায় মজার গল্প ‘রতন পণ্ডিতের পাঠশালা’। লেখিকার সর্বাধিক বিক্রীত বই।
চারপাশের প্রতিবেশ কখনো তাঁকে লেখার অনুপ্রেরণা দেয়। যেমন তাঁর মনে হয় কলকাতা বাসকালে সাহিত্যিক রূপে তাঁর ‘সবচেয়ে বড় রূপান্তর… অন্যমনস্ক কবি থেকে সচেতন গদ্যকারে উত্তরণ।’ (‘আমার শহর’) এ কালপর্বে মেট্রোতে শোভাবাজারে নেমে পায়ে হেঁটে ঘুরে শনি-রবিবার কেটেছে। রচিত হয়েছে ‘কলকাতার প্রতিমা শিল্পীরা’। ‘কলকাতার বৃহত্তম লোকশিল্পের মানুষদের জীবন ও জীবিকার অনুসন্ধান।’ (‘আমার শহর’) ‘আগুনের ভিতর’ ও ‘আত্মজন’ গল্প দুটিতেও বাস্তব অভিজ্ঞতাপ্রসূত অনুভূতির প্রকাশ। কলকাতা থেকে ওড়িশায় ফেরার পর দায়িত্ব পান বয়ন ও হস্তশিল্প বিভাগের। তারপর মহানদীর গতিপথ ধরে ওড়িশার বুনাকারদের সন্ধানে যাত্রা শুরু হয়। ‘মহানদী’ উপন্যাসের বীজ এ সময় থেকেই, খুব অস্পষ্টভাবে হলেও, তাঁর মনে বোনা হয়ে যায়। মুম্বই এসইজেড এর কমিশনার রূপে অর্জিত অভিজ্ঞতার প্রতিফলন উপন্যাস ‘আয়নায় মানুষ নাই’। জাতীয় মহিলা কমিশনের মাত্র ছয় মাসের সদস্য জীবন ‘নারীর বিরুদ্ধে হিংসার বিষয়ে [তাঁর] সংবেদনা ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলেছিল অনেকগুণ।’ (‘মেয়েদের পাশে’) সাম্প্রতিক অতীতে লেখা তাঁর বেশ কিছু ছোট গল্প এই বক্তব্যের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়।
এই বইয়ের প্রথম লেখার আত্মপ্রকাশ একটি সংবাদপত্রের রবিবারের পাতায়। সাহিত্যিক অনিতা অগ্নিহোত্রীর প্রথম কলাম রচনা। কুড়িটি পর্ব সংবাদপত্রে প্রকাশ পায়। পরবর্তী গদ্যগুলি প্রকাশিত হয় ‘দ্য ওয়াল ইন’ নামক ওয়েব ম্যাগাজিনে। কলামগুলি গ্রন্থশরীর পায় ফেব্রুয়ারি ২০২১ এ ‘রোদবাতাসের পথ’ নাম নিয়ে। রচনাগুলিতে হৃদয়ের উত্তাপ আছে, স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ আছে, স্মৃতিমেদুরতা, স্বজনবিয়োগের বেদনা, অসহায়তার আক্ষেপ আছে কিন্তু প্রকাশভঙ্গি সংযত, নিয়ন্ত্রিত। শিল্পী প্রণবেশ মাইতির অলংকরণেও সেই পরিমিতি, সংযম ও সুচিন্তিত ভাবনার প্রকাশ। এমন একটি সুন্দর ও প্রয়োজনীয় গ্রন্থ প্রকাশ করার জন্য দে’জ পাবলিশিং পাঠকদের সাধুবাদ পাবেন।
শুধু দুটি মৃদু অনুযোগ রয়ে গেল। প্রথমত, বইটিতে প্রবন্ধসূচি না থাকায় পাঠক অসুবিধায় পড়বেন। কারণ, একবার পাঠ সাঙ্গ হলেই এই বইয়ের প্রয়োজন শেষ হয় না। নিজে পড়ার জন্য বা কোনো রেফারেন্স এর সন্ধানে প্রবন্ধগুলির কাছে বারবার ফিরে আসতে হয়। দ্বিতীয়ত, বইয়ের উভয় পৃষ্ঠার শীর্ষেই গ্রন্থ নাম লিখিত রয়েছে। বামদিকে গ্রন্থনাম ও ডান দিকে প্রবন্ধের নাম উল্লিখিত থাকলে তা কার্যকরী ও দৃষ্টিনন্দন হত।
তারাপদ রায়ের একটি কবিতার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে আমি এই লেখা শেষ করতে চাই।
“একদিন তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে[‘ভারতমেলা’- ‘দুর্ভিক্ষের কবিতা’। বানান অপরিবর্তিত।]
ভারত বর্ষ।
একদিন হালুইকরের দোকানে, নড়বড়ে বেঞ্চিতে বসে
রঙীন জিলিপি খেতে খেতে,
একদিন পড়োশিনীদের সঙ্গে মনিহারি দোকানে ঘুরে
কাঁচের মালা খুঁজতে খুঁজতে
একদিন তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যাবে।
একদিন সব গাছে ফুল ফুটবে,
একদিন সব ঘরে জানালা হবে,
একদিন সব জানালায় আলো হবে,
একদিন সব নদী স্রোতস্বিনী হবে,
একদিন সব স্রোতস্বিনী স্বচ্ছসলিলা হবে।
একদিন পাকা ফসলের গন্ধে ভরে উঠবে সংসার,
একদিন তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে,
ভারতবর্ষ।
বহু ভাষা, বহু স্বরের আমার স্বদেশকে চেনাল ‘রোদবাতাসের পথ’।