• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৭ | জুলাই ২০২২ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • ছবিমুড়া রহস্য : রূপা মণ্ডল



    (১)

    অর্কর দিন চারেক স্কুলে যাওয়া হয় নি। তিন দিন ধরে ভাইরাল ফিভারে শরীর বড় দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই আজ দুপুরে বিছানায় বসে ড্রয়িং খাতায় আঁকিবুকি কাটছিল। একটা ল্যান্ডস্কেপের স্কেচ করছিল সে। হঠাৎ মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল—বাবা কলিং। অর্ক ফোন ধরল।

    —হ্যালো।

    —এখন কেমন আছিস?

    —ভালো। জ্বর আর আসে নি। তবে খুব দুর্বল লাগছে।

    —ও ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না। জানিস আমার ক্রেডিট কার্ডে অনেক পয়েন্ট উঠেছে। ফ্লাইটের টিকিটে ছাড় পাব!

    —তাই? কোথায় যাব আমরা?

    —তোর মাকে এখন কিন্তু কিছু বলবি না। সারপ্রাইজ দেব। আগে তাই তোর সাথে আলোচনা করে নিচ্ছি।

    অর্ক এখন ইলেভেনে পড়লেও ওর বাবা সব বিষয়ে স্ত্রীর পাশাপাশি ছেলের সাথেও আলোচনা করেন। তবে এবার সারপ্রাইজের ব্যাপার আছে কিনা, তাই আগে অর্কর সাথে আলোচনাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।

    আলাপ আলোচনায় ঠিক হয়েছে ত্রিপুরা ঘুরতে যাওয়া হবে। ১৫ই আগস্ট বৃহস্পতিবার পড়েছে স্বাধীনতা দিবসের ছুটি। শুক্রবার আর শনিবার ছুটি নিয়ে ত্রিপুরা ভ্রমণ করে রবিবার বিকেলে আবার কলকাতায় ফিরে আসা হবে—এটাই ঠিক করা হলো। অর্কর বাবা আগরতলার জন্য অনলাইনে প্লেনের টিকিট বুকিং করে নিয়েছিলেন। আর গেস্ট-হাউস বুকিং-এর দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাঁর মাসতুতো ভাই বিমলকে। কোন ট্রাভেল এজেন্টের সাথে নয়, নিজেরা সম্পূর্ণ নিজেদের মতো করে ঘুরতে যাওয়া। শুধু ত্রিপুরা পৌঁছে গাড়ি ভাড়া ও সাইট সিন দেখার জন্য অর্কর বিমলকাকুর সাহায্য নেওয়া হবে।

    অর্ক বিমলকাকুকে আগে কখনো দেখেনি, তবে বাবার মুখে অনেক বার শুনেছে তিনি কর্মসূত্রে সপরিবারে দীর্ঘদিন ত্রিপুরায় আছেন এবং সেখানেই ‘রোজমেরী’ অ্যাপার্টমেন্টে ফ্ল্যাট কিনেছেন।

    (২)

    অর্কর বাবা অফিসের কাজে অনেকবার প্লেনে চড়লেও ওর মা আর অর্ক এই প্রথমবার ফ্লাইটে উঠবে। তাই ওদের মধ্যে একটা আলাদা রকমের ভালো লাগার উত্তেজনা আছে। ট্রলিব্যাগে কতটা জিনিস নেওয়া যাবে, হ্যান্ডব্যাগে কি কি নেওয়া যেতে পারে, কিভাবে সিকিউরিটি চেকিং হবে অর্কর মা বার বার ওর বাবার কাছ থেকে তা জেনে নিচ্ছেন। পর পর তিনটি সিট্ — একটা আইল, একটা মিডল আর একটা উইন্ডো। ঠিক হয়েছে আগরতলা যাওয়ার সময় অর্ক বসবে উইন্ডো সিটে আর ফেরার সময় ওর মা বসবে জানালার পাশে।

    যাওয়ার দিন যত এগিয়ে আসছে অর্কর আর ওর মায়ের তত আনন্দ হচ্ছে। ফাইনালি দমদম এয়ারপোর্টে পৌঁছে ব্যাগ ও সিকিউরিটি চেকিং-এর পরে অর্কর মা নিজেদের সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে নিজের আনন্দ শেয়ার করে সবাইকে জানিয়ে দিল যে এবারে তারা ফ্লাইটে উঠবে। বাস থেকে নেমে ফ্লাইটে উঠে নিজেদের সিটে বসে অর্ক মোবাইল ফোনটাকে সুইচ অফ করল না, নরমালেই রেখে দিল। সে মেঘের উপর ভেসে যেতে যেতে ভিডিও তুলতে চায়।

    সিট বেল্ট বেঁধে নিয়েছে সবাই। ঘড়িতে এখন সকাল সাতটা কুড়ি। মেঘবালিকাদের ঘোষণা শুরু হয়ে গেছে। প্লেন রানওয়ে ধরে ছুটছে। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে এবারে উপরে উঠল।

    আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। সারা কলকাতাটা ছোট্ট হতে হতে একেবারে মিলিয়ে গেল। এবারে শুধু মেঘ আর মেঘ। অর্ক মোবাইল রেডি করল।

    (৩)

    সাড়ে আটটা নাগাদ ওরা আগরতলায় পৌঁছে গেল। এয়ারপোর্টের সামনে লেখা আছে 'মহারাজা বীর বিক্রম এয়ারপোর্ট'। খুব বেশি বড় নয়, ছোট এয়ারপোর্ট, কিন্তু স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে খুব সাজানো হয়েছে। একটাই বেল্ট। ট্রলি ব্যাগের জন্য ওরা বেল্টের সামনে দাঁড়াল।

    —আর ইয়ু কামিং ফ্রম কলকাতা?

    অর্ক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল দু'জন লোক ওর দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। ওরাও ব্যাগ নেওয়ার জন্য বেল্টের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

    —ইয়েস।

    —আমরাও কলকাতা থেকেই এসেছি। এখানে বেড়াতে এসেছি। তোমরাও তাই?

    অর্ক ঘাড় নাড়ল — হ্যাঁ।

    — আয়, আয়, ব্যাগ পেয়ে গেছি।

    অর্কর বাবা ডাকল ওকে।

    আকাশ মেঘলাই ছিল। বাইরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।

    —বিমল গাড়ি নিয়ে আসছে। এখানে একটু বসি আমরা।

    এয়ারপোর্টের মধ্যেই চেয়ারে বসল ওরা।

    এখন বৃষ্টিটা একটু জোরে হচ্ছে।

    অর্ক লক্ষ্য করল লোক দুটো ওদের ট্রলি ব্যাগ নিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে গেছে।

    (৪)

    এয়ারপোর্টের লাগোয়া টানা লম্বা বারান্দার একপাশে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান হছে। অনেক লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ক গলাটা লম্বা করে একটু দেখার চেষ্টা করল। একটি মেয়ে খুব সুন্দর নাচ করছে। এয়ারপোর্টের কর্মীরা আজ বেশ সেজেগুজে ঘুরছে।

    কিছুক্ষণের মধ্যে বিমলকাকুর গাড়ি এসে দাঁড়াল এয়ারপোর্টের সামনে। বহুদিন বাদে দুই ভাইয়ের দেখা। বিমলকাকু গাড়ি থেকে নেমেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল তার সমবয়সী ভাই অর্কর বাবাকে। তারপর সবাই মিলে অর্করা বিমলকাকুর ফ্ল্যাটে গেল। এই প্রথম অর্ক তার কাকিমা আর খুড়তুতো ভাই সৌগতকে দেখল। সুন্দর এপার্টমেন্টের ভিতরে চমৎকার বাগান আর সুইমিং পুল। বিমলকাকুদের ফ্ল্যাটটাও খুব সাজানো-গোছানো। আর কাকিমার হাতের রান্নার তুলনা নেই। ওরা আসবে জেনে তিনি জলখাবারে গরম গরম লুচি, আলুচচ্চড়ি আর রসগোল্লার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন।

    আলাপচারিতা আর খাওয়াদাওয়ার পর অর্করা ওদের গেস্ট-হাউসে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলে কাকিমা কিছুতেই ছাড়তে চাইছিলেন না। কিন্তু গেস্ট-হাউস বুক করা আছে আগে থেকেই, তাই সেখানে যাওয়া দরকার বুঝিয়ে ওরা চলে এল গেস্ট-হাউসে। সেখানে দোতলায় গেস্ট-হাউসের সামনের দিকে বেশ বড়সড় একটা ঘরে ওদের থাকার ব্যবস্থা। ঘরের একদিকের পুরো দেওয়াল জুড়ে কাঁচের জানালা। পর্দা সরাতেই অর্কর মনটা খুশিতে ভরে গেল। সামনে সবুজ মাঠ, তার চারিপাশে নানা ধরনের গাছগাছালি। মাঠের মাঝখানে একটা লম্বাটে বাঁশের গায়ে পত পত করে উড়ছে জাতীয় পতাকা। এরকম সুন্দর সবুজ মাঠ শুধু কলকাতা শহরে কেন, শহরতলিতেও এখন বিরল হয়ে গেছে।

    ঠাসা জলখাবার খেয়ে ক্ষিদে ছিল না কারও। কিন্তু বেলা হয়ে যাচ্ছে দেখে অর্কর বাবা সকলকে স্নান করার জন্য তাড়া দিতে লাগলেন। স্নানের পর ভাত, ডাল, মিক্স ভেজ, আর চিকেন কষা খেয়ে একটু শুয়ে নিল সবাই। ঠিক তখনই অর্কর বিমলকাকু ফোন করে জানালেন তিনটে থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে তিনি গাড়ি পাঠাবেন। ড্রাইভার ওদের আখাউরা চেক পোস্টে নিয়ে যাবে। আজ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে ওখানে বিশেষ অনুষ্ঠান ও কুচকাওয়াজের ব্যবস্থা আছে। দেখলে ভালো লাগবে সবার।

    (৫)

    ত্রিপুরা-বাংলাদেশ বর্ডারে আখাউরা চেকপোস্ট। প্রতিদিন দু'দেশের বহু নাগরিক তাদের পাসপোর্ট নিয়ে এদিক থেকে ওদিক বা ওদেশ থেকে এদেশে যাতায়াত করে। এখানে বিশেষত্ব হ'ল — এই চেকপোস্টে প্রতিদিন সন্ধ্যায় পতাকা অবনমন করা হয় কুচকাওয়াজের সঙ্গে এবং সেটি করার সময়ে বিশেষ দিনে বিশেষ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাও থাকে। অর্করা গিয়ে দেখল কোন একটি অর্গানাইজেশনের উদ্যোগে সেখানে জওয়ানদের হাতে রাখিবন্ধন করা হচ্ছে এবং সেই অনুষ্ঠানটি বড়ই হৃদয়গ্রাহী ও আনন্দদায়ক। ওখানে জওয়ানদের ব্যান্ডের সাথে অর্কেস্ট্রা ও বিউগলের সুর মিলেমিশে সুন্দর মনোজ্ঞ পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। একপাশে নানাধরনের অস্ত্রশস্ত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। অর্ক এই প্রথম এত কাছ থেকে রিভলভার, পিস্তলসহ ওয়ান শটার, মর্টার, হ্যান্ড গ্রেনেড, রাইফেল, এ কে ফরটি সেভেন ইত্যাদি দেখার সুযোগ পেল।

    আগের কিছু ঘটনায় তার পিস্তল বা রিভলভার দেখার সুযোগ হয়েছে বটে, তবে এত সমস্ত আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র পূর্বে কক্ষনো সে দেখে নি।

    অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে সন্ধ্যার অন্ধকার বেশ ঘন হয়ে গেল। অন্য কিছু সেদিন আর দেখার সুযোগ ছিল না। তাই গেস্ট-হাউসে ফিরে এল ওরা। ফেরার সময়ে আলোকিত রাজপ্রাসাদ দেখে মন ভরে গেল। রাজপ্রাসাদের সামনে সুন্দর বাগান ও জলাশয়। পাশের রাস্তার ধারে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ছিল আস্তাবল, এখন সেখানে সকালবেলায় বাজার বসে। ওদের গাড়ি রাজপ্রাসাদ এলাকার উত্তর গেট দিয়ে বেড়িয়ে গেস্ট-হাউস অভিমুখে রওনা দিল।

    (৬)

    বিমলকাকু একটু পরেই ওদের সাথে দেখা করার জন্য গেস্ট-হাউসে এলেন এবং ঘরে ঢোকার আগেই একতলায় রেস্টুরেন্টে গিয়ে চার কাপ কফি আর এক প্লেট পকোড়ার অর্ডার দিয়ে এলেন। সোফায় বসে বিমলকাকু অর্ককে প্রশ্ন করলেন, "আজকের অনুষ্ঠান কেমন লেগেছে বলো?"

    —দুর্দান্ত।

    কালকে তোমাদের জন্য ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির, নীরমহল আর কসবা কালীবাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। সকাল ন'টার সময়ে গাড়ি চলে আসবে। তোমরা রেডি থেকো। একটু সকাল সকাল বেরোতে পারলেই ভাল। অনেকটা রাস্তা তো।

    গেস্ট-হাউসের খাবারদাবার খুব ভাল। পকোড়া এত ভাল ছিল যে, আর এক প্লেটের অর্ডার করতে হ'ল।

    একটু পরেই বিমলকাকুর স্ত্রী আর ওঁর ছেলে সৌগতও এসে হাজির হ'ল। সবাই মিলে একসাথে ডিনার করে নিল। বিমলকাকুরা চলে যাওয়ার সময়ে সৌগত বার বার বলছিল ওর সামনে পরীক্ষা না থাকলে ও যোগ দিত অর্কদের টিমে। ওর জন্য কাকিমাও অর্কদের সাথে কোথাও যেতে পারছেন না।

    (৭)

    সকালে জলখাবার খেতে খেতে অর্কর বাবা বললেন, "বুঝলি অর্ক, সেই যে লোক দুটোর সাথে এয়ারপোর্টে নেমেই তোর আলাপ হয়েছিল, ওরা এই গেস্ট-হাউসেই উঠেছে। আজ সকাল বেলা তোর মা আর আমি যখন নীচে মর্নিং ওয়াক করছিলাম, ওরাও হাঁটছিল।"

    অর্ক কিছু না বলে চুপ করে খেতে লাগল। লোকগুলোর ব্যাপারে ওর কোন ইন্টারেস্ট নেই। বড্ড গায়ে পড়া, এয়ারপোর্টে হঠাৎ যেচে কথা বলতে এসেছিল কেন কে জানে।

    অর্কর মা কোথায় খাবারে একটা চুল পেয়েছেন, তাই নিয়ে খুঁতখুঁত করতে লাগলেন।

    ইতিমধ্যে গেস্টহাউসের বাইরে গাড়ি এসে উপস্থিত হয়েছে, অর্কর বাবার ফোনে ড্রাইভার ফোন করেছে, তাই সবাই তাড়াতাড়ি খেতে লাগল।

    (৮)

    ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির বা মাতাবাড়ি যাওয়ার পথে ওরা একটা চা বাগান দেখতে পেল। তাই গাড়ি থেকে নেমে প্রচুর ছবি তুলল। অনেকদূর যাওয়ার পরে এল সিপাহিজলা অরণ্য। সময় থাকলে এখানে জঙ্গলভ্রমণ করা যেত। কিন্তু বেশ কয়েক দিন এখানে থাকতে না পারলে সব দেখে শেষ করা সম্ভব নয় — সেকথা গতকালই বিমল কাকু বলেছেন।

    আকাশ সকাল থেকেই বেশ মেঘলা ছিল। ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরে পৌঁছানোর আগেই অল্প অল্প বৃষ্টি শুরু হ'ল। ওখানে অনেক পেঁড়ার দোকান আছে। সেখান থেকে পূজার সরঞ্জাম কিনে ওরা মন্দিরে পূজা দিতে গেল। এই মন্দির একটি শক্তিপীঠ।

    একটা ছোট ছাগল বাঁধা ছিল মন্দিরের সিঁড়িতে। সেটা নাকি বলি দেওয়া হবে। অর্ক চোখ সরিয়ে নিল, ওর দেখলে খুব কষ্ট হয়।

    মন্দিরের সামনেই একটা বিশাল লম্বা আকৃতি দীঘি আছে, তার নাম কল্যাণ সাগর। দীঘিতে প্রচুর বড় বড় মাছ আর কচ্ছপ আছে। সেগুলোও নাকি কারো মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হওয়ার কারণে ঠাকুরকে নিবেদন করা। মাছ আর কচ্ছপদের মুড়ি দিলে কাছে চলে আসে। কিন্তু কেউ তাদের ধরতে সাহস পায় না। স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস ওদের ধরে খাবার চেষ্টা করলে তার ভয়ানক ক্ষতি হবে।

    (৯)

    মাতাবাড়ি দর্শনের পরে নীরমহলের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার সময় অর্ক হঠাৎ খেয়াল করল সেই লোক দুটো যাদের সাথে এয়ারপোর্টে দেখা হয়েছিল তারাও একটা গাড়ি নিয়ে ওদের পিছু পিছু আসছে। লোকগুলোকে এর আগে মাত্র একবার দেখলেও অর্কর চিনতে ভুল হলো না।

    অর্ক ড্রাইভারের কান বাঁচিয়ে কথাটা ওর বাবাকে বলতেই তিনি বললেন, “হতে পারে আমাদের মতই টুরিস্ট। শুধু শুধু কাউকে সন্দেহ করা উচিত নয়।”

    কিন্তু অর্কর মন বলছে এর মধ্যে কোন একটা উদ্দেশ্য বা রহস্য রয়েছে।

    নীরমহল দেখতে গিয়ে আর লোক দুটোর দেখা পেল না অর্ক। টিকিট কেটে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর নৌকা এল। প্রচুর যাত্রী উঠল তাতে। অনেকটা জলপথ পার হয়ে নীরমহলে পৌঁছাল ওরা। জলের মাঝে শ্বেতশুভ্র নীরমহলের রূপ যেন আরো বেড়ে গেছে। নৌকা থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আবার টিকিট কাউন্টার। তারপর ভেতরে প্রবেশ। মহারাজা বিক্রম কিশোর মানিক্য দেববর্মা এই মহলটি তৈরি করিয়ে ছিলেন গ্রীষ্মকালীন বাসস্থান হিসেবে। সুন্দর প্রাসাদে অনেকগুলি কক্ষ। কোথাও ঘোরানো সিঁড়ি ছাদে পৌঁছেছে, আবার কোথাও দুটি ভাগে বিভক্ত সিঁড়ি ধাপে ধাপে নেমে গেছে রুদ্রসাগরের জলে, কথিত আছে এই সিঁড়িপথেই রানীমা নৌকাবিহারে যেতেন।

    (১০)

    অর্ক হঠাৎ খেয়াল করল ও ঘুরতে ঘুরতে কখন আলাদা হয়ে পড়েছে বাবা-মায়ের কাছ থেকে। তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই সেই লোক দুটো কোথা থেকে কর্পূরের মত সামনে এসে দাঁড়াল। ওদের হাতে যদিও কোন অস্ত্রশস্ত্র নেই, ওদের চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ওদের উদ্দেশ্য সৎ নয়। ওরা সিঁড়ির উপর থেকে ক্রমশ অর্কর দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। অর্ক দেখল আশপাশে কোন টুরিস্ট নেই, সে এক পা করে পিছু হঠে পরের সিঁড়িতে নামতে লাগল। অর্থাৎ জলের কাছাকাছি পৌঁছাতে আর দেরি নেই। অর্ক জোরে চাপ দিল ওর বাঁহাতের হাতঘড়িতে, আর অমনি সাইরেন বেজে উঠল এবং মুহূর্তে মেসেজ পৌঁছে গেল অর্কর বাবা ও মায়ের মোবাইল ফোনে—“Arka is in danger. Please help him immediately.”

    মুহূর্তে জায়গাটা লোকজনে ভরে গেল। সাইরেন বেজে উঠতেই সবাই অবাক হয়ে শব্দের সন্ধান করে ছুটে এসেছে। ছুটে এসেছেন অর্কর বাবা ও মা। নীরমহলের কেয়ারটেকার বা দারোয়ানেরা ছুটে এসে লোক দুটোকে জাপটে ধরে টেনে নিয়ে গেল। তারপর দড়ি দিয়ে হাত-পা বেঁধে খবর পাঠাল স্থানীয় থানায়। থানায় গিয়ে অভিযোগ দায়ের করে ওদের বেরোতে অনেকটা দেরী হয়ে গেল।

    ঘটনার আচম্বিতে পুরো ট্যুরটাই মাটি হয়ে যেতে বসেছিল আর একটু হলেই। লোক দুটোকে লক-আপে ভরার পর পুলিশ তো অর্কদের এমনভাবে জেরা করতে শুরু করেছিল যে মনে হচ্ছিল বুঝি ওরা কলকাতায় কোন অপরাধ করে পালিয়ে এসেছে এখানে। শেষে লালবাজারের অরূপ সরকারের সাথে ফোনে ও.সি.-র কথা বলিয়ে দেওয়ার পরে তাঁর কথা বলার ধরন আমূল বদলে গেল।

    (১১)

    অরূপ সরকারই অর্ককে ওই বিশেষ ধরনের ঘড়িটা উপহার দিয়েছিলেন ‘সম্রাটের ছোরা’ কেসের পরে। আর উপহার দিয়ে বলেছিলেন, “আপদে-বিপদে পড়লে এটার স্মরণ নিও। এখন তো ক্রিমিনাল জগতে তুমিও বেশ পরিচিত।”

    কিন্তু লোক দুটো কারা? অর্ক ভাবছিল। অরূপ সরকার কোন একটা বিশেষ কাজে ব্যস্ত থাকায় আজ বেশি কথা বলতে পারলেন না। শুধু ঘটনাটা শুনে বললেন, “খুব সাবধানে থাকো। চোখ কান খোলা রাখো। অসুবিধা বুঝলে গেস্ট-হাউসে ফিরে যাও। আমি পুলিশ প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”

    কিন্তু অর্কর মনটা খারাপ হয়ে গেল। পুলিশ প্রোটেকশন নিয়ে ঘুরতে হবে কেন তাকে? তাহলে তো ঘোরার মজাটাই মাটি। গেস্ট-হাউসে বন্দি হয়ে থাকার জন্যও তারা আসে নি।

    —কি করা যায় বলো তো? গেস্ট-হাউসে ফিরে যাব কি?

    অর্কর বাবার প্রশ্ন শুনে অর্কর মা বললেন, “অবশ্যই। আর কোথাও নয়। কালকেও আমি আর কোথাও যেতে চাই না। পরশু গেস্ট-হাউস থেকে সোজা বাড়ি চলে যাব আমরা।”

    —বাবা, কসবা কালীবাড়ি তো আমাদের দেখা হলো না।

    —দরকার নেই বাবা। আগে গেস্ট-হাউসে ফিরে চলো। অর্কর মা বললেন।

    এতক্ষণ গাড়ির চালক চুপচাপ শুনছিল ওদের কথা। এতক্ষণে সে মুখ খুলল। পরিষ্কার বাংলাতে বলল, “আপনারা এত ভয় পাবেন না। আমি বলছি এরকম কিছু আর ঘটবে না। যারা অর্কবাবুকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করেছিল তারা এখন লকআপে, কাজেই তাদের দলের লোকজন এখন সাবধানে থাকবে। তাছাড়া আমি সঙ্গে থাকতে আপনাদের কোন ভয় নেই।”

    এই বিদেশ বিভুঁইয়ে একজন অচেনা মানুষের উপর কতটা ভরসা করা চলে সেটাও বুঝতে পারছিল না অর্কর বাবা-মা। তবে অর্কর বেশ মজা লাগল ড্রাইভারের মুখে "অর্কবাবু" শুনে।

    তাঁরা একটু নিমরাজি হওয়া সত্ত্বেও গাড়ির চালক ওদের কসবা কালীমন্দিরের দিকে নিয়ে চলল। সে চুক্তিমতই টাকা নেবে। কম ঘুরিয়ে বেশি টাকা নেবে না।

    কসবা কালীমন্দির একটা উঁচু টিলার উপর এবং তার আশপাশের এলাকা বেশ সুন্দর, পরিচ্ছন্ন। মন্দিরের খুব কাছেই বাংলাদেশ বর্ডার। কাঁটাতারের বেড়া দেখতে পাওয়া যায়। মন্দিরে যাওয়ার জন্য সমতল থেকে ক্রমশ উঁচুতে উঠতে হয়। রাস্তার একধারে সারি সারি পেঁড়ার দোকান। রাস্তার বাঁ-দিক ঘেঁষে একদিকে উঁচু ঢিবির মত, তার গায়ে নানা ধরনের মূর্তি খোদাই করা। সিমেন্টের উপর খোদিত বলেই মনে হলো অর্কর। মন্দির ও তার আশপাশের পরিবেশ দেখে বেশ ভালোই লাগল তাদের।

    (১২)

    গেস্ট-হাউসে ফিরে সব ঘটনা বলার পর বিমলকাকুও ভীষণ উতলা হয়ে পড়লেন। জিজ্ঞেস করলেন, “আগামীকালের প্রোগ্রাম কি তবে ক্যানসেল করবে? আমি একটা খুব ভালো ট্যুর প্রোগ্রাম ঠিক করে রেখেছিলাম তোমাদের জন্য।”

    —কালকে আমরা কোথায় যাব কাকু?

    অর্ক জিজ্ঞেস করল।

    অর্কর মা হাঁ হাঁ করে উঠলেন, “না না, আর কোন প্রোগ্রাম নয়। আমি অর্ককে নিয়ে আর কোথাও যেতে চাই না।”

    —আরে শোন তো বিমল কি বলছে। অর্কর মাকে থামিয়ে দিলেন ওর বাবা।

    বিমল বললেন, “তোমরা যদি ছবিমুড়া যাও, তাহলে অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পাবে। পাহাড়, নদী, গুহা—কি নেই? আর ওই গুহা নিয়ে নানা ধরনের মিথও আছে।”

    —কি মিথ আছে কাকু?

    অর্ক শোনবার জন্য উৎসুক হয়ে উঠল।

    —আগে ডিনারের অর্ডার করি, তারপর একসাথে খেতে খেতে গল্প করা যাবে?

    সবাই সম্মত হলেন।

    রাতের মেনু ছিল ভাত, নবরত্ন ডাল, ঝুরঝুরে আলুভাজা, ভেজ পকোড়া, খাসির মাংস, চাটনি, পাঁপড়। সবাই পরিতৃপ্তি সহকারে খাচ্ছিল। বিমল বলতে শুরু করলেন, “ত্রিপুরা রাজ্যের একটি ঐতিহাসিক স্থান হলো ছবিমুড়া। এটা গোমতী জেলার অন্তর্গত অমরপুর মহকুমার রাজখাং এডিসি ভিলেজে অবস্থিত এক পর্যটনস্থলও বটে। আগরতলা থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার পর অমরপুর শহর এবং সেই শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার পরই রাজখাং এলাকার গোমতী নদীতে ‘ছবিমুড়া’ নৌকা ঘাট। সেখান থেকে নৌকায় যেতে হয় ছবিমুড়া এলাকায়। নদীর দু’দিকে ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কিছুক্ষণ নৌকায় ভেসে গেলে বেলে পাথরের তৈরি খাড়া পাহাড়ের গায়ে দেখা মিলবে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তির।

    প্রাচীনকাল থেকে এখানে জামাতিয়া উপজাতিদের বসবাস। তাদের লোককথা অনুসারে ছবিমুড়া হলো রুদ্রভৈরবী দেবীর স্থান। জামাতিয়াদের রাজা চিচিংফার প্রপিতামহর রাজত্বকালে তৈরি হয় দেবতামুড়া পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা গোমতী নদীর তীরের গায়ে খোদাই করা শিল্পকর্ম।”

    বিমলের বাচনভঙ্গি খুবই সুন্দর। সবাই খাওয়া থামিয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনছিল, এমন সময় অর্ক বলে উঠল, “কাকু, তুমিও চলো না আমাদের সাথে!”

    —আমি? আচ্ছা দাঁড়া, তাহলে কাল একটা সিক-লিভ নিতে হবে।

    অর্কর মা বলল, “আমার তো বাপু যেতে সাহস হচ্ছে না একদম। আবার কোথায় কি বিপদ হয়!”

    —বৌদি, এরকম করলে তো তোমরা কোনদিন কোথাও বেড়াতে যেতেই পারবে না। আমার মনে হয়, ওটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। একটা সচ্ছল ফ্যামিলির ছেলেকে কিডন্যাপ করে কিছু মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা। এর সাথে আগের কোন ঘটনার সম্পর্ক নেই। তবে আমাদের সাবধান থাকতে হবে। অর্ককে একা কোথাও ছাড়া যাবে না।”

    —আমার মনে হচ্ছে বিমল ঠিকই বলেছে।

    এতক্ষণে অর্কর বাবা মুখ খুললেন।

    —তাহলে ওই ড্রাইভারকে কাল সকালে আটটা নাগাদ আসতে বলি?

    —ঠিক আছে বল। ও কি তোর মাহিনা করা ড্রাইভার?

    — না দাদা, ওকে হায়ার করেছি এই চার দিনের জন্যে। এমনিতে গাড়ি আমি নিজেই চালাই। কিন্তু তোমাদের সাথে যেতে পারছি না তাই ওকে নিতে হয়েছে।

    —কাকু, গল্পটা শেষ করো না!

    —দাঁড়া, আগে হাতমুখ ধুয়ে নিই। তারপর রুমে গিয়ে বলব।

    সবার খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। একে একে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই।

    দোতলায় ঘরের বিছানায় বসে আবার শুরু হলো গল্প। বিমল একবার হাতঘড়িটা দেখে নিল। রাত্রি ন’টা পাঁচ। পরিচিতির সুবাদে সে নিচের পার্কিং-এ তার গাড়িটা রেখে এসেছে। তাই আর একটু পরে বেরোলেও অসুবিধা নেই। বিমল আবার বলতে শুরু করলেন,

    “গোমতী নদীতীরে পাথরগাত্রের মূর্তিগুলোর সাথে দক্ষিণ ভারতের মন্দিরগাত্রে খোদাই করা মূর্তির মিল পাওয়া যায়। ঊনকোটির মূর্তিগুলোর সাথে এর কোন মিল নেই। কিন্তু এই গহন অরণ্যের ভিতরে দক্ষিণ ভারতীয় ধাঁচের মূর্তি কিভাবে এল—তা রহস্য সৃষ্টি করে।

    “আর একটা ব্যাপার হলো—নদীর ধারে একটা দুর্গম গুহা আছে। কথিত আছে, জামাতিয়া উপজাতিদের রাজা চিচিংফা তাঁর সমস্ত ধনসম্পত্তি ওই গুহার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন এবং সেগুলো পাহারা দেয় একটা বিশাল বড় অজগর সাপ। আজ পর্যন্ত কেউ নাকি ওই গুহায় প্রবেশ করতে পারে নি।”

    —কাকু, আমরা যদি ওই গুহার মধ্যে ঢুকতে পারি?

    —তাহলে সেটাই হবে ওই গুহায় জামাতিয়া উপজাতি ভিন্ন অন্য কোন জাতির অনুপ্রবেশ এবং ইতিহাসের পাতায় তা লেখা থাকবে।

    —নাঃ চলো, অনেক রাত হয়ে গেছে। এবারে আসি। তোমরা বিশ্রাম নাও। কাল সকালে তাহলে দেখা হচ্ছে আমাদের।

    (১৩)

    বিমল চলে যাওয়ার পর অর্করা শুয়ে পড়ল। অর্কর মোবাইল ফোন সারা রাত খোলা থাকে। তবে সাউন্ড সব সময় কমানো থাকে। আজ সে শুয়ে শুয়ে সারা দিনের ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন করছিল।

    সে মনে মনে ভাবছিল, আচ্ছা, সকালে লোক দুটো কেন তাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করল? তাও দিনে দুপুরে? অবশ্য ঐ সময় ছাড়া তারা আর অন্য সময় অর্ককে একা পাবেই বা কি করে? কিন্তু কি উদ্দেশ্যে তারা এ কাজ করতে চাইছিল? শুধু কি টাকার লোভে? না কি এর পিছনে অন্য কোন কারণ আছে?

    খুব মৃদু সুরে ফোন বেজে উঠল। অরূপ সরকারের ফোন।

    —কি অর্ক? ঘুমিয়ে পড়োনি তো?

    —না না, বলুন।

    —আমি জানি, তুমি এত তাড়াতাড়ি ঘুমোও না। তবে একটা কথা বলি শোন। যারা আজ তোমাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করেছে, তার মধ্যে একজন হচ্ছে বিজয় ওরফে পবনের ভাই সুশীল। হঠাৎ তোমাকে এয়ারপোর্টে দেখার পর থেকেই ওর মাথায় একটা প্ল্যান ঘুরছিল। সোনার গোপাল কেসটার পরে কাগজে তোমার ছবি বেরোনোর সময় থেকেই তুমি ওর পরিচিত। হঠাৎ কোন কাজে সুশীলও এসেছিল আগরতলায়। তোমাদের সাথে আগরতলা এয়ারপোর্টে প্রথম আলাপ জমানোর চেষ্টা করে এবং তোমরা কোন হোটেল বা গেস্ট-হাউসে উঠেছ সে বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়। তারপর তোমাদের উপর নজরদারি শুরু করে। তোমাদের ফলো করতে করতে নীরমহলে পৌঁছে ওখানে একজন মাঝিকে ঠিক করে যার নৌকায় তোমাকে জোর করে তুলে কিডন্যাপ করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু মাঝপথেই গন্ডগোল বাধে ওই ঘড়িটার জন্য। তুমি যে বুদ্ধি করে অ্যালার্ম বাজিয়ে দিয়ে সকলকে সতর্ক করে দেবে—তা ভাবতে পারে নি ওরা। যাহোক তুমি প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থেকো। এখন ফোন রাখছি। গুড নাইট।”

    অর্কর চোখটা ঘুমে জড়িয়ে আসছে। সকাল থেকে ধকল গেছে খুব।

    (১৪)

    ভোরবেলা অর্কর ঘুম ভেঙ্গে গেল। একটা অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিল সে। ঘুম থেকে উঠে দেখল মা বাথরুমে। একটু বাদেই তিনি স্নান সেরে বেরিয়ে এলেন আর অর্ককে দেখে বললেন, “ও, তুই ঘুম থেকে উঠে পড়েছিস? তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে, স্নান সেরে রেডি হয়ে নে।”

    অর্কর বাবা জানলার পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। চারদিকে কি সুন্দর সবুজের সমারোহ!

    জলখাবারে গরম গরম পরোটা, কাবুলি ছোলার ঘুগনি আর একটা করে সেদ্ধ ডিম খেয়ে চায়ের অর্ডার দেওয়া হলো। ততক্ষণে বিমলকাকুও গাড়ি নিয়ে চলে এসেছেন। সবাই মিলে হইহই করতে করতে চলল ছবিমুড়া অভিমুখে।

    অর্কর বাবা বিমলকে বললেন, "গতকাল তোর মুখে ছবিমুড়ার গল্প শুনে ওখানে যাওয়ার ইচ্ছাটা আরও বেড়ে গেছে।”

    —গল্প নয় দাদা, সত্যি ঘটনা। আমিও এসমস্ত জেনেছি আমাদের এপার্টমেন্টের একজন বাসিন্দা চারুবাবুর কাছ থেকে। উনি অগাধ জ্ঞানী ব্যক্তি। ওঁর লেখা বইটইও আছে। আমাদের এপার্টমেন্টের ম্যাগাজিনে উনি নিয়মিত লেখেন। কালকে সকালে ওঁর সাথে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেব।

    পথ যেন আর শেষ হয় না। সমতল শেষ হয়ে পাহাড়ি রাস্তার পাকদণ্ডী শুরু হয়েছে অনেক আগেই। কখনও নীল পাহাড়ের হাতছানি আর কখনও গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে এক পশলা বৃষ্টিও হলো। মাঝে মাঝে দু’একটি মাটি বা ইঁটের ছোট ছোট ঘর। অমরপুর পৌঁছতে দুপুর হয়ে গেল। ওখানে পথের ধারে ছোট্ট একটা বাজার বসেছে। সেখানে কিছু স্থানীয় মানুষ শাকসবজি বিক্রি করছে। বাজার এলাকা ছাড়িয়ে আবার পাহাড়ি এবড়োখেবড়ো পথ সরু হয়ে এগিয়ে চলল ছবিমুড়ার দিকে।

    মাটির সরু রাস্তা দিয়ে গাড়ি যেখানে গিয়ে থামল সেখানে শুধু ধু-ধু সবুজের মাঝে দু-একটা রিসর্ট, গোটা তিনেক দোকান, নৌকার টিকিট বুকিং সেন্টার আর প্রায় নিশ্ছিদ্র নীরবতা।

    গাড়ির চালক ওদের একটা দোকানের সামনে নিয়ে গেল। বলল, “নৌকায় উঠার আগে এখানে দুপুরের খাবারের অর্ডার দিয়ে দিন।” সেইমত খাবারের অর্ডার দিয়ে ওরা নদীর ঘাটের দিকে চলল। এক একটা নৌকায় ছ’জনের বেশি নেবে না। অর্করা চারজন আর দু’জন ট্যুরিস্ট আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল যাতে নৌকার ভাড়া শেয়ার করা যায়, তারা দু’জন মিলিয়ে মোট ছ’জনকে নিয়ে নৌকা ছাড়ল। নদীর দু’দিকে ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলতে লাগল মোটর চালিত নৌকা। মেঘলা আকাশ পাহাড়ের গায়ে ছায়ার পরশ সৃষ্টি করেছে। কোথাও বা ফাঁকে ফাঁকে রৌদ্র এসে পড়েছে নদীর জলে। রৌদ্র-ছায়ার এক অপরূপ সমন্বয় সৃষ্টি হয়েছে নদীর তরঙ্গায়িত জলে। একটা ছোট্ট মাছরাঙা মোটরবোট আর মানুষের গলা পেয়ে গাছের ডাল থেকে উড়ে পালালো।

    সবাই নিজের নিজের মোবাইল ফোন-ক্যামেরায় প্রকৃতির অকৃপণ শোভা বন্দী করতে উদ্যোগী, শুধু পিছনের অচেনা লোক দুটো বাদে। তারা নিজেদের মধ্যে অজানা ভাষায় ফিসফিস করে কি যেন আলোচনা করে চলেছে।

    (১৫)

    নদীবক্ষে মোটর চালিত নৌকা চলেছে স্বচ্ছন্দ গতিতে, ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে গাছের ছায়া, কোথাও কোথাও সরু ঝর্ণাধারা এসে মিশেছে নদীতে। মাঝি হঠাৎ নৌকা ঘোরালো। বলল, “ওই দেখুন।”

    সবাই তাড়াতাড়ি নৌকার বাঁদিকে তাকিয়ে দেখল পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা সুবিশাল দুর্গামূর্তি। বিমলকাকু ফিসফিস করে অর্ককে বললেন, “দুর্গার মত দশহাত, তাই অনেকে দুর্গামূর্তি ভাবে। আসলে উপজাতিদের কাছে ইনি চাকরাখমা। মাথায় রয়েছে অসংখ্য সাপ।”

    একজনকে মূর্তির পাদদেশে দেখা গেল। লাল বসনপরিহিত। উপজাতিদের পুরোহিত বলেই মনে হলো। তিনি বোধহয় পূজো করছিলেন। মূর্তির পায়ের কাছে টাটকা লাল জবা ফুলের মালা। মাঝি দু’জন বলল, “আপনারা নেমে দেখে আসতে পারেন।”

    কিন্তু কাদায় পা ডুবে যাবে। আর খালি পায়ে খাড়াই পাহাড়ে উঠতে হবে শুনে কেউ রাজি হলো না। নৌকা আবার ফিরে চলল। এবারে তারা গুহা দেখাতে নিয়ে যাবে সেকথা বিমলকাকুই বললেন অর্ককে।

    —কাকু, এর আগে তুমি কখনও গেছো গুহা দেখতে?

    —একবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু বেশি দূর এগোতে পারি নি।

    —কিঁউ? ক্যা প্রবলেম থা?

    পিছনের লোক দুটো কখন তাদের পিছনের সিটে এসে বসেছে খেয়াল করে নি অর্করা।

    —রাস্তা কা হাল বহুত খারাব থা।

    লোক দুটো আর কোন কথা বলল না।

    (১৬)

    নৌকা গিয়ে ডানদিকের তীরে ভিড়লো। এবড়োখেবড়ো মাটির সরু পথ জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেছে দেখে অর্কর মা নামতে রাজি হলেন না কিছুতেই। তার উপরে আবার খালি পায়ে হেঁটে যেতে হবে। খালি নৌকায় যাতে অর্কর মাকে একা থাকতে না হয় সেজন্য বাধ্য হয়ে অর্কর বাবা থেকে গেলেন। অর্ক বিমলকাকুর সঙ্গে গেল। অবশ্য অর্কর মা বার বার বারণ করেছিলেন দুজনকে না যাবার জন্য। অর্কর মনে অদম্য কৌতুহল গুহাতে কি আছে তা দেখার জন্য। বালি মিশ্রিত মাটিতে সরু পথে পা ফেলে ধীরে ধীরে চলছে সবাই। একেবারে সামনে মাঝিদ্বয় গাইডরূপে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের পিছনে সেই অপরিচিত লোক দুটো এবং তার পরে অর্ক, আর অর্কর পিছনে বিমলকাকু—এইভাবে চলছে দলটি।

    হঠাৎ একটা সরু সাপ অর্কর সামনে দিয়ে দ্রুত রাস্তা পার হয়ে গেল। ওরা মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে মাঝিসহ চারজন একটু এগিয়ে গেছে। বিমলকাকু ফিসফিস করে অর্ককে বললেন, “সাবধানে যেতে হবে। এখানে প্রতি পদে পদে বিপদ। শুনেছি যারা এখানে গুপ্তধনের খোঁজে এসেছে কেউ আর বেঁচে ফেরে নি। অবশ্য আমাদের উদ্দেশ্য আলাদা....”

    সামনে থেকে দু’একটা কথার আওয়াজ আসছে লক্ষ্য করে ওরা এগিয়ে চলল।

    নুয়ে পড়া গাছগাছালির ডালপালায় ছায়াচ্ছন্ন পথ কোথাও ঝর্ণার জলে পিচ্ছিল, আবার কোথাও ভীষণ সংকুচিত।

    ব্যালেন্স করে পা ফেলে এগিয়ে যেতে যেতে অর্কর মনে হচ্ছিল যেকোন সময় গড়িয়ে পড়ে যেতে পারে নদীর জলে। কিন্তু নীচে তাকিয়ে তার লোম খাড়া হয়ে গেল। বর্শার ফলার মত শক্ত জংলী গাছের মাথা জেগে রয়েছে জল ভেদ করে। পড়ে যাওয়া মানে সাক্ষাৎ মৃত্যু।

    নৌকা থেকে তারা অনেকটাই এগিয়ে এসেছে। এবারে পথ আরো সরু, আরো পিচ্ছিল। সেই পথ সাঁকোর মত চলে গেছে নদীর খাঁড়ি বেয়ে অপর পাড়ে। সেখানেই আছে গুহা। লতানো গাছে ঢাকা তার মুখ। সবাই এসে জড়ো হয়েছে ওই সরু পথের সম্মুখে। কিভাবে এগোবে সেটাই ভাবছে বোধহয়। মাঝিরাও কিছুটা ইতস্ততঃ। এতদূর পর্যন্ত আসতে পারে না বেশিরভাগ মানুষই। কিন্তু এই টিমের সকলেই প্রায় চলে এসেছে। তারা বলল, “চলুন, ফিরে যাই।”

    সামনের লোক দুটো কিছুতেই ফিরে যাবে না। তারা গুহা দেখে তবেই যাবে।

    মাঝিরা বলল, “সামনে বিপদ আছে। আজ পর্যন্ত গুহায় কেউ ঢুকতে পারে নি। ঢুকলে সে আর বেঁচে ফেরে না। চলুন ফিরে যাই।”

    কিন্তু লোক দুটো গোঁ ধরে আছে। তারা যাবেই। মাঝিরা কিছুটা ইতস্ততঃ করে বলল, “আমরা কিন্তু ভিতরে যাব না। আপনারাও ঢুকবেন না—এটাই আমাদের অনুরোধ। এই গুহা অভিশপ্ত।”

    লোক দুটো মাঝিদের কথা পাত্তা না দিয়ে বলল, “ঠিক আছে। তোমরা বাইরে দাঁড়াবে। প্রথমে আমরা দু’জন ভেতরে যাব। তারপর ওঁরা দুজন।”

    এই বলে তারা অর্কদের দেখিয়ে দিল।

    মাঝিরা খাঁড়ির উপরের সরু পথ ধরে এগিয়ে চলল। দুধারে কোন সাপোর্ট নেই, তাই গাছের ডাল ধরে ধরে তারা এগোতে লাগল। ওদের দেখাদেখি বাকিরাও সেইভাবে এগোচ্ছে। খুব সাবধানে। এতটুকু এদিক-ওদিক হলে আর বেঁচে ফিরতে হবে না।

    লতানো গাছ গুহার মুখ আড়াল করে রেখেছে। কাছাকাছি এগোনোর চেষ্টা করতেই ফোঁস করে একটা আওয়াজ হতেই সামনের লোকটা ছিটকে সরে এসে ওদের ঘাড়ের উপর পড়ল প্রায়। একটা তিনফুট সাইজের বিষাক্ত সাপ ঝুলে রয়েছে লতানো গাছের থেকে। কেউ আর এগোতে সাহস পেল না। সবাই ফেরার পথ ধরল।

    নৌকা পর্যন্ত পথটা যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর বলে মনে হচ্ছিল। ওই অসমান, পিচ্ছিল পথে যত দ্রুত সম্ভব হাঁটছিল ওরা। বিমল অর্কর কানে কানে ফিসফিস করে বললেন, "এই গুহায় ঢোকার আর একটা পথ আছে। ওই যে পাহাড় থেকে ঘুরে ঘুরে নেমেছে পথটা....ওটা গুহার পিছনের দিকে চলে গেছে। সেখানে একটা টানেলের ভিতর দিয়ে সোজা পৌঁছে যাওয়া যায় ওই গুহায়। কিন্তু সে পথের সন্ধান সবাই জানে না। শুধু স্থানীয় কিছু লোক আর জামাতিয়া উপজাতিদের রাজপরিবারের লোকজনরা ছাড়া। প্রতিবছর শীতকালে জামাতিয়া উপজাতিদের একটা অনুষ্ঠান হয়। এখনো নিয়মমাফিক রাজপরিবারের বংশধরদের একটা উপঢৌকন দিয়ে সম্মান জানানোর প্রথা আছে ওদের মধ্যে। আর তখনই ওরা ওই গুহায় প্রবেশ করে একবার করে যেখানে ওদের রাজপরিবারের সঞ্চিত সম্পদ লুকানো আছে। ওরা দেবী রুদ্রভৈরবীর পুজো দিয়ে গুহায় তাঁর বাহনদের জন্যে খাবারদাবার রেখে যায়। এছাড়া আরও কিছু রীতিনীতি পালন করে।”

    —তাহলে আমরা সেপথে গেলাম না কেন?

    বিমল হাসলেন, "সেই গুপ্ত পথের সন্ধান বিশেষ কেউ জানে না। তাছাড়া, পৃথিবীর সকলের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার আরো একটা কারণ আছে .... সেকথা তোমায় আগেও বলেছি, গুপ্তধন!"

    দূর থেকে ডাক শোনা যাচ্ছে “অ..র...র্ক, অ..র...র্ক।” বাবা ও মায়ের যুগপৎ কন্ঠস্বর ক্রমশ ক্ষীণ থেকে জোরালো হয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পাহাড়ের গায়ে।

    একটু এগোতেই ওরা দেখল অর্কর বাবা হাঁফাতে হাঁফাতে এগিয়ে আসছেন।

    ওদের দেখে বললেন, "উফফ, তোরা এসে গেছিস? আমাদের যে কি চিন্তা হচ্ছিল!"

    (১৭)

    ছবিমুড়া থেকে ফেরার পথে একটা অভাবনীয় ঘটনা ঘটল। দুপুরে খাওয়ার পর গাড়িতে উঠে সবাই খোশ মেজাজে গল্প করতে করতে ফিরছিল। হঠাৎ একটা নির্জন জায়গায় কয়েকজন লোক হাত দেখিয়ে গাড়ি থামালো। প্রথমে ড্রাইভার গাড়ি থামাতে চায় নি। কিন্তু লোকগুলো এমনভাবে গাড়ির সামনে এসে পথ আটকে দিল যে গাড়ি না থামিয়ে কোনো উপায় ছিল না। গাড়ির কাঁচ নামাতে একজন বলল, "আমাদের একজন একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সামনে ডাক্তারখানা আছে, একটু পৌঁছে দিন।” পোশাকআশাক দেখে মনে হলো, তারা সবাই টুরিস্ট এবং সত্যি কথা বলছে।

    —কিন্তু আমাদের গাড়িতে তো আর জায়গা নেই।

    —একদম সামনেই দাদা, একটু কষ্ট করে আপনারা বসুন। আমরা ওকে নিয়ে ঠিক উঠে যাব। অর্ক ওর বাবার কোলে বসে পড়ল। পাশে অর্কর মা। তারপর একটা ছেলে উঠল, তার কোলে আর একজন। সামনে বিমল ও ড্রাইভার। ছেলে দুটি একটু এগিয়েই বলল, "গাড়ি থামান"।

    অর্কর বাবা জানতে চাইলেন, "এখানে কোথায় ডাক্তারখানা?"

    —এখানেই ডাক্তারখানা আছে।

    সামনে দু'-একটা মাটির ঘর দেখা যাচ্ছে বটে।

    ছেলে দুটি নিচে নামল। অসুস্থ ছেলেটি হাঁটতে পারছে না দেখে অন্য ছেলেটি বিমলের দিকে তাকিয়ে বলল, "দাদা, একটু হেল্প করবেন? ওই সামনের ঘরটা পর্যন্ত এগিয়ে দেবেন?"

    বিমল গাড়ি থেকে নামলেন। ঈষৎ আড়মোড়া ভেঙে বললেন, "চলুন।”

    বিমল আর ছেলে দুটি মাটির ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল কিন্তু বিমল আর ফেরেন না। অর্কর বাবা ও মা চিন্তা করতে শুরু করলেন। ড্রাইভার মহেশ বলল, "দাঁড়ান, আমি দেখছি।”

    কিছুক্ষণ পরে সেও ফিরছে না দেখে অর্কদের দুশ্চিন্তা আরও বাড়ল। সবচেয়ে মুশকিলের কথা হলো বিমল বা ড্রাইভার কেউ ফোন ধরছে না।

    অর্ক ওর মোবাইল ফোন বের করে অরূপ সরকারকে ফোন করতে যাবে এমন সময়ে দুটি ছেলে জোরে হাঁটতে হাঁটতে এসে বলল, "আপনাদের একজন ওখানে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই আপনাদের ড্রাইভার আসতে পারছেন না। আপনাদের যেতে বললেন ওখানে।”

    কথাগুলো ঠিকমতো বিশ্বাস হচ্ছে না অর্কদের। কিন্তু উপায় নেই। অর্কর বাবা গাড়ি থেকে নামতে যাচ্ছেন দেখে অর্কর মা তাঁর হাত চেপে ধরলেন, "না, না, তুমি নামবে না। কিছুতেই না।”

    —এছাড়া আর উপায় কি? আমায় যেতে তো হবেই। কিন্তু তোমরা নামবে না কিছুতেই। আমি না ফেরা পর্যন্ত।

    অর্ক আর কালবিলম্ব না করে ওর মোবাইলে দ্রুত মেসেজ টাইপ করে ফেলল, "We are in danger. Please help us." — আর পাঠিয়ে দিল অরূপ সরকারের মোবাইলে।

    গাড়িতে শুধু অর্ক আর ওর মায়ের থাকাটাও নিরাপদ নয়। কিন্তু অর্কর বাবা ওদের নিয়ে যেতেও সাহস পাচ্ছেন না। ঠিক সেই সময়ে অর্ক বলল, "বাবা, আমিও তোমার সাথেই যাব।"

    — না অর্ক, না।

    ওর মা চিৎকার করে উঠলেন। কিন্তু অর্ক শুনল না। বাধ্য হয়ে ওর মাকেও নামতে হলো গাড়ি থেকে।"

    অর্ক সবার পিছনে যেতে যেতে তাড়াতাড়ি মোবাইল থেকে ওর লাস্ট মেসেজ ডিলিট করে দিল।

    (১৮)

    চারিপাশে গাছপালা। একপাশে কিছু সবজি ফলেছে। উঠান ঘিরে তিনটি মাটির ঘর। মাটির উঠান পেরিয়ে একটা ঘরে গিয়ে ঢুকলো ওরা। একটা খুঁটির সাথে বিমল দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা, মুখে রুমাল গোঁজা। মহেশ মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। মনে হয় জ্ঞান হারিয়েছে। ছেলে দুটি ওদের ওই ঘরে নিয়ে যেতেই আরো তিনজন যেন মাটি ফুঁড়ে উঠল। দুজনের হাতে আগ্নেয় অস্ত্র। কড়া নির্দেশ এল, "চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন। নড়াচড়া করলে ভালো হবে না। আর মোবাইল ফোনগুলো আমাদের দিয়ে দিন।"

    অর্কর মা সরু গলায় বললেন, "আমাদের এখানে ধরে এনেছেন কেন?"

    —একদম চুপ। কোনো কথা বললে একেবারে শেষ করে দেব।

    ওদের তিনজনকেও দড়ি দিয়ে খুঁটির সাথে বাঁধা হলো। মুখে রুমাল বেঁধে দেওয়া হ'ল।

    ওদের বেঁধে রেখে ঘরের দরজা বন্ধ করে পাঁচজন চলে গেল। যাওয়ার আগে মহেশের পকেট থেকে গাড়ির চাবিটা বের করে নিল। কতক্ষণ এভাবে থাকতে হবে ভগবান জানেন। অর্কর মায়ের চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।

    এক একটা মুহূর্ত যেন এক এক ঘন্টা বলে মনে হচ্ছে। ঘরের একটি মাত্র জানালা শক্ত করে বন্ধ করা থাকলেও বোঝা যাচ্ছে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে বাইরে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ধীরে ধীরে বাড়ছে। মাঝে মাঝে শিয়াল ডেকে উঠছে একটু দূরে।

    সকলেই ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়ছে। একমাত্র অর্ক ছাড়া। সে ক্লান্ত হলেও তার চোখ আর কান দুটোকে সজাগ রেখেছে। অবশ্য ঘরের ঘোর অন্ধকারে যতটা দৃষ্টি যায় সেটা দিয়ে সে মাপবার চেষ্টা করছে ঘরের দরজা থেকে তার অবস্থান কতটা দূরে। ইতিমধ্যে মহেশের যেন জ্ঞান ফিরছে বলে মনে হচ্ছে।”উঁহ, উঁহ" আওয়াজ হচ্ছে। অবশ্য তাকেও একটা খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে বসানো অবস্থায় দড়ি দিয়ে বাঁধা।

    ঘড়ি নেই। মোবাইলগুলোও নেই। ক'টা বাজছে বোঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ অর্ক কান খাড়া করল। বাইরে মানুষের গলা পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। কেউ যেন চাপা গলায় বলছে, "পুলিশ জানল কি করে? নদীর ঘাটে এসে খোঁজ নিচ্ছিল? তাহলে তো খুব মুশকিল। আজ রাতেই তাহলে যা করার করে ফেলতে হবে!"

    আজ রাতে ওরা কি করতে চায়? অর্ক কান খাড়া করে রইল।

    — যা, ওদের জন্য খাবার নিয়ে আয়। আমাদেরও আনবি।

    (১৯)

    ঘরের দরজা হঠাৎ একটু ফাঁক হয়ে তারপরে খুলল। দু'জন ঘরে ঢুকেছে। তারা সোজা বিমলের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। একজনের হাতে একটা বড়ো মোমবাতি। মোমবাতির আলোয় অর্ক চিনতে পারল লোক দুটোকে। ওরা আজ দুপুরে নৌকায় করে ছবিমুড়ার গুহা দেখতে গিয়েছিল। তাহলে তখন থেকেই ওরা ফলো করছে ওদের? কিন্তু কি উদ্দেশ্যে?

    একটা লোক বিমলকে বলল, "অরিজিনাল ম্যাপটা কোথায়? যেটা চারুবাবুর কাছ থেকে তুমি চুরি করেছিলে?"

    বিমল ভীষণরকম চমকে গিয়ে বললেন, "আমি জানি না। আমি কিছু চুরি করি নি।"

    —একদম বাজে কথা বলবে না। তুমি চারুবাবুর কাছে নিয়মিত যেতে সে খবর আমরা পেয়েছি। ওঁর কাছে আসল ম্যাপটা নেই। তুমি ছাড়া অন্য কেউ ওঁর কাছে যায় না। কাজেই ওটা তোমার কীর্তি সেটা আমরা বুঝতে পেরেছি। এখন ভালো ছেলের মতো বলে দাও কোথায় রেখেছো অরিজিনাল ম্যাপটা, নাহলে তোমাদের সবাইকে একসাথে শেষ করে দেব।

    — বিশ্বাস করো আমার কাছে অরিজিনাল ম্যাপটা নেই। চারুবাবুর কাছে আমি যেতাম ঠিকই ; কিন্তু আমি ম্যাপ নিই নি। সেটা আর একজন করে থাকতে পারে ..... সে হলো ....যোগেশ।

    —মিথ্যে কথা। যোগেশ সেটা নেয় নি। তাকেও আমরা জিজ্ঞেস করেছি।

    —তাহলে চারুবাবুর বাড়ি আর কে যেত জানতে হবে।

    —তুমি সব থেকে বেশি যেতে আর চারুবাবু তোমার সাথেই সব থেকে ক্লোজ ছিল। ভালো চাও তো অরিজিনাল ম্যাপটা বের করে দাও।

    —বিশ্বাস করো আমি অরিজিনাল ম্যাপ কোথায় জানি না। আমার কাছে শুধু একটা ডুপ্লিকেট আছে। তবে সেটা অরিজিনাল থেকে কিছু কম নয়। আমার বাম পকেটে আছে। চারুবাবু আমাকে এইটা রাখতে দিয়ে বলেছিলেন, "যদি আমার কিছু হয়ে যায়... বিমল তুমি এইটা তোমার কাছে রাখো।”

    —ঠিক আছে, আপাতত ওটাই দাও। এখন তোমাদের খাবার এসে গেছে। চটপট খেয়ে নাও। এখন তোমাদের হাতের দড়ি খুলে দিচ্ছি। তবে পালাবার কোনোরকম চেষ্টা করবে না। আমাদের লোকেরা চারিদিকে ঘিরে আছে।

    বাইরে থেকে তিনটি ছেলে ভিতরে ঢুকে খাবারের থালাগুলো মেঝেতে রেখে ওদের হাতপায়ের দড়ি আর মুখের রুমাল খুলে দিল। মহেশ এতক্ষণে একটু উঠে দাঁড়াতে পারছে। বলল, "জল....জল।"

    লোকগুলো বাইরে বেরিয়ে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকল। ঘরের ভিতরে অর্করা কেউ প্রায় খেতেই পারছে না। কোনোরকমে খেয়ে হাত ধুয়ে নিল। বাইরে একজন বলছে, "যোগেশ আর চারুবাবুকেও নিয়ে আসতে হবে। তবে এই ম্যাপটা নিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখতে হবে।"

    অন্য একজন বলল, "পুলিশ যেভাবে পিছনে লেগেছে তাতে করে অত সময় পাওয়া যাবে না। যা করবার আজই করতে হবে।"

    —ঠিক আছে। ওদের খাওয়া হলেই বেরিয়ে পড়।

    অর্করা ওদের সব কথা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে না। ওরা গলা নামিয়ে কথা বলছে। তবে কান খাড়া করে অর্ক যেটুকু শুনতে পাচ্ছে সেটা নিয়েই সে মনে মনে অন্য চিন্তার জাল বুনছে।

    (২০)

    চাঁদনী রাতে পাহাড়ের গায়ে একটা মায়াবী ওড়না জড়ানো। চারিদিকে ঝুপ ঝুপে অন্ধকারের মাঝে ঝিঁ ঝিঁ পোকার কনসার্ট আর মাঝে মাঝে শেয়ালের হাঁক। কোথাও আবার হায়নার হাঁকও শোনা যায়। কথিত আছে রাতের বেলা বাঘমামাও জল খেতে আসে নদীর ধারে। অবশ্য চাক্ষুষ দেখার চেষ্টা করে নি কেউ। রিসোর্ট ছাড়া স্থানীয় দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যায় সন্ধ্যের আগেই। দোকানদাররা বিকেল থাকতে থাকতেই ফিরে যায় নিজেদের গ্রামে। সব রিসোর্টের আলো নিভে গেছে। এখানে বিদ্যুৎ নেই। কেবল জেনারেটরের মাধ্যমে আলো, পাখা চলে। তাই বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে সন্ধ্যে হলেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়তে হয়। কাজেই নদীর ধার জনমানবহীন।

    পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে কয়েকটা ছায়ামূর্তি হাতের টর্চ জ্বেলে এগিয়ে চলেছে। দলটির মাঝখানে একজন দড়ি দিয়ে হাত-বাঁধা মানুষ, মুখে তার রুমাল বাঁধা। নদীর ঘাটে একজন পাহাড়ি লোক একটা নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। সে ওদের দেখে একটু এগিয়ে এল। একে একে সবাই নৌকায় উঠল। নৌকা ধীরে ধীরে চলল একটু দূরে একটা বালির চরের দিকে। ওখানে জঙ্গল নেই। তবে বালির চরে অনেক সাপের গর্ত আছে। তবে যে উদ্দেশ্যে লোকগুলো যাচ্ছে তাতে এরকম রিস্ক নিতেই হয়।

    ধীরে ধীরে নৌকা নদীর বালুচরে গিয়ে দাঁড়াল। সবাই নেমে হাতবাঁধা লোকটাকে টেনে নামালো এবং মুখের রুমাল খুলে দিয়ে হাতে একটা ম্যাপ ধরিয়ে দিয়ে বলল, "এবার আমাদের গাইড করো।" টর্চের আলোয় ম্যাপের্ নকশা দেখে লোকটি দিকনির্ণয় করতে লাগল। সরু পথে এগিয়ে চলল সবাই।

    পথটা সর্পিল ভঙ্গিতে ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেছে একটা সুড়ঙ্গের দিকে। সুড়ঙ্গের পরেই একটা গুহা। সুড়ঙ্গের ভিতরে অসংখ্য চামচিকা। মাঝে মাঝে ঝোপের মাঝে সরসরিয়ে কি যেন চলে যাচ্ছে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলেও বন্দি মানুষটার কোনো উপায় নেই। জন্তু জানোয়ার, সাপখোপের হাত থেকে যদি বা রেহাই পাওয়া যায় এদের হাত থেকে তো নয়ই।

    চারুবাবু বলেছিলেন, "বিমল, মনে হচ্ছে আমার দিন ফুরিয়ে আসছে। তোমাকে একটা জরুরি কথা বলা দরকার। আমি একটা ম্যাপ তৈরি করেছি। সেটা ওই চিচিংফার গুহায় যাওয়ার পথনির্দেশ। আর মন দিয়ে যদি কেউ ম্যাপটা দেখে তাহলে সে বুঝতে পারবে কোথায় আছে চিচিংফার গুপ্তধন। তবে খুব ভয়ংকর সে পথ। না যাওয়াই ভালো। কিন্তু কেউ মনে হয় আমার এই ম্যাপের কথা বাইরে প্রচার করেছে। যোগেশকে আমি খুব বিশ্বাস করতাম, জানো। ওর সামনেই আমি ম্যাপ আঁকতাম। খাবার রেখে যাওয়ার সময় আমায় প্রশ্ন করলে মজা করে বলতাম, গুপ্তধন রে গুপ্তধন! পেলে তোর কপাল ফিরে যাবে। ও হাসতো। মনে হয় ওর সেই হাসিটাই কাল হলো আমার। কবে কার কাছে গল্পের ছলে বলে ফেলেছিল হয়তো। ওর তো পেটে কোনো কথা থাকে না। ব্যাস, কেউ হয়তো সেটা জেনে গিয়ে প্রথমে ওর উপর এবং পরে আমার উপর চাপ সৃষ্টি করছে। প্রতিদিন আমার ডাকবাক্সে কেউ নানারকমের চিঠি রেখে যাচ্ছে। তার কোনোটায় লেখা আছে অরিজিনাল ম্যাপটা না দিয়ে দিলে নাকি আমার প্রাণ কেড়ে নেবে ইত্যাদি। তাই আমি এটা আমার কাছে রাখতে সাহস পাচ্ছি না। তাই তোমাকে ডেকেছি।"

    (২১)

    এদিকে অর্ক খেয়াল করল বিমলকে নিয়ে লোকগুলো অনেক্ষণ হলো বেরিয়ে গেছে। আর কতজন আছে সামনের ঘরগুলোতে জানা দরকার। কিন্তু কি উপায়? হঠাৎ করে সে "জল, জল, খুব তেষ্টা পেয়েছে!" বলে চেঁচাতে লাগল। ঘরের দরজাটা একটু ফাঁক করে কেউ উঁকি দিল। লোকটা খেঁকিয়ে উঠে জানতে চাইলো, "কি হয়েছে?"

    — একটু জল খাব। জল দিন না !

    — দাঁড়াও দিচ্ছি। চেঁচামিচি করবে না একদম।

    লোকটা বোধহয় জল আনতে গেল। একটা বোতল নিয়ে ফিরে এল কয়েক মিনিট বাদে।

    — এই নাও জল।

    ইতিমধ্যে অর্ক ওর হাতের বাঁধনটা একটু আলগা করে ফেলেছিল খুঁটির গায়ে ঘষে ঘষে। লোকটা কাছে আসতেই দুম করে একটা ঘুঁষি মারল তার নাকে। লোকটা একটা "আঁক" শব্ধ করে নিচে বসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে অর্ক ওর মুখে একটা রুমাল ভরে দিল আর যথাসম্ভব দ্রুত তার হাত দুটো বেঁধে ফেলল দড়ি দিয়ে। তারপর বাঁধল তার পা দুটো।

    বাইরে থেকে কে যেন জিজ্ঞেস করল, "এই, জল দিয়ে আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন?"

    অর্ক দরজার পাশে লুকিয়ে পড়ল। লোকটা রোয়াকে উঠে ঘরের সামনে এল। তারপরে যে জল দিতে এসেছিল তার নাম ধরে ডাকল। কোনো আওয়াজ না পেয়ে ঘরে ঢুকতেই অর্ক তার মাথায় একটা আঘাত করল। সেও কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেল ঘরের মেঝেতে। অর্ক আগেই মহেশের হাতের বাঁধন খুলে দিয়েছিল। সে আর মহেশ দুজনে মিলে লোকটাকে ভালো করে দড়ি দিয়ে খুঁটির সাথে বেঁধে ফেলল। তারপর অর্কর বাবা আর মায়ের বাঁধন খুলে দিল এবং খুব সাবধানে দরজার সামনে এসে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল বাইরে। নাহ, আর কেউ আসছে না। চারিদিকে জমাট অন্ধকার। চারজনে খুব সাবধানে বেরিয়ে এসে পা টিপে টিপে উঠান পার হয়ে বাইরে চলে এল। কোন দিকে যাবে জানে না। তবে সাবধানে এগোতেই হবে। পালাতে হবে এখান থেকে।

    কিন্তু মোবাইল ফোনগুলো আর ঘড়িটা উদ্ধার করা দরকার। অর্ক একবার অন্য ঘরগুলোর দিকে তাকাল। সবগুলোই বাইরে থেকে বন্ধ করা বলে মনে হচ্ছে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগে তীব্র গতিতে ছুটে গেল একটা ঘরের দিকে। শিকল তোলা। হ্যাঁ, এই ঘরটাতেই লোকগুলো ছিল, বন্দি হওয়ার সময়ে দেখেছে। তাহলে এখানেই থাকতে পারে মোবাইল ফোনগুলো।

    খুব সাবধানে শিকল খুলল। তবু একটু আওয়াজ হলো। কিন্তু সেই আওয়াজে কারো গলা শোনা গেল না। অর্থাৎ আর কেউ নেই। ঘরে ঢুকে একটা বিশ্রী পচা গন্ধ পেল। মহেশ অর্কর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে একটা দেশলাই বের করল। ফস করে জ্বলল কাঠি। সেই সামান্য আলোয় দেখতে পেল ঘরের ভিতরে অনেক ব্যারেল, বস্তা এবং পেটি রাখা আছে। হয়তো সেগুলোতে কোনো মাদক থাকতে পারে। অর্ক দ্রুত খুঁজতে লাগল তাদের মোবাইল ফোন এবং তার সেই বিপদনাশক ঘড়ি। দেশলাইয়ের আলোয় একটা টর্চ পাওয়া গেল আর সেটা জ্বালতেই ঘর আলোকিত হয়ে উঠল। একটা প্যাকিং বাক্সের উপরে রাখা আছে জিনিসগুলো। মুহূর্তে সেগুলো পকেটে ভরে দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল।

    বাইরে ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় চারিদিক ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু এখন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সময় নয়। ঘরগুলোর পিছন দিকে ঘন জঙ্গল, তাই সামনের দিকে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রতি পদে পদে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তবু বাঁচার চেষ্টা, পালানোর চেষ্টা করতেই হবে — যেভাবে হোক। বিমল কাকুকে ওরা কোথায় ধরে নিয়ে গেছে কে জানে?

    (২২)

    একটা গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে মনে হচ্ছে। অর্করা সবাই বসে পড়ল ঝোপের আড়ালে। হ্যাঁ, একটা গাড়িই আসছে — রিসর্টের দিক থেকে। অর্ক ভালো করে লক্ষ্য করে বলল — "পুলিশ, পুলিশের গাড়ি। হাত দেখাও, থামাও।" মহেশ আর অর্ক দৌড়ে গিয়ে রাস্তার মধ্যে হাত দেখিয়ে থামানোর চেষ্টা করতে লাগল। গাড়িটা পাশে এসে ব্রেক কষল।

    — তোমরা কারা? এত রাতে এই জঙ্গলের মধ্যে কি করছ?

    — আমাদের বাঁচান। গাড়িতে উঠে সব বলছি।

    — চটপট উঠে এসো।

    সবাই গাদাগাদি করে উঠে বসল।

    — আপনারা এখানে কিভাবে এলেন?

    — আমাদের ধরে আনা হয়েছে। অনেক কষ্টে পালিয়ে এসেছি।

    — আপনারা কি ওই সরকারি গেস্টহাউস থেকে নিখোঁজ হওয়া টুরিস্ট?

    — হ্যাঁ। ঠিকই বলেছেন।

    — আপনাদের খোঁজেই তো আমরা আজ দু'বার এসেছি এখানে। অরূপ সরকার বাবু আমাদের বলেছিলেন আপনাদের খুঁজে বের করতে। তাঁর কাছে মোবাইল ফোনে একটা মেসেজ এসেছিল যে আপনারা বিপদগ্রস্ত। কিন্তু আপনাদের মোবাইল বন্ধ থাকায় আমরা টাওয়ার লোকেশান ট্রেস করতে পারছিলাম না। এইমাত্র খবর এসেছে যে, অরূপবাবু আপনাদের জন্য থানায় অপেক্ষা করছেন। অর্ক নিজের মোবাইল ফোন অন্ করতে গিয়ে বুঝল সিম খুলে নেওয়া হয়েছে।

    — স্যার, অরূপবাবুর সাথে একটু কথা বলা যাবে?

    অর্কর কথা শুনে অফিসার বললেন, "হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। এই নিন।" এই বলে তাঁর মোবাইল ফোনটা অর্কর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। বিপরীত দিক থেকে অরূপ সরকার বললেন, "অর্ক, তোমরা ঠিক আছো তো? কোনো চিন্তা নেই। আমি আগরতলায় এসে গেছি। থানায় চলে এসো।"

    — স্যার, আগে আমাদের বিমলকাকুর ফ্ল্যাটে যাওয়া দরকার। ভীষণ জরুরি। আর আপনি পুলিশ ফোর্স রেডি করুন স্যার — ওরা কাকুকে ধরে নিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে সেই গুহায়।

    — ঠিক আছে। আমি দেখছি।

    (২৩)

    সুড়ঙ্গ শেষ হয়ে আসছে। ফুটতে শুরু করেছে ভোরের আলোও। গুহার সামনে এসে লম্বা লোকটা একজনকে নির্দেশ দিল "এর মুখ থেকে রুমাল আর হাতের বাঁধন খুলে দাও।"

    সঙ্গে সঙ্গে লোকটা বিমলের মুখের থেকে রুমাল আর হাতের বাঁধন খুলে দিল। হাতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়ে গেছে। বিমল দু'হাত মেলে আড়মোড়া ভাঙার চেষ্টা করল। অর্ক যতক্ষণ না পুলিশ নিয়ে আসছে ততক্ষণ এদের কথামতো চলতেই হবে। অর্কর উপর বিমলের ভরসা আছে। ও নিশ্চয়ই কিছু একটা করবে। আর অর্কই হয়তো উদ্ধার করতে পারবে আসল ম্যাপটা কোথায় আছে। ওটা না পাওয়া গেলে গুপ্তধনের হদিশ কেউ পাবে না।

    — এই তো গুহার মুখ। চলো, ভেতরে চলো। আমাদের দেখাও সেই বেদি, যার উপরে সিন্দুক আছে।

    লোকগুলো দেখল বিমল বিড়বিড় করে বলছেন, “চিচিংফার গুহা। মা রুদ্রভৈরবীর বাহনেরা পাহারা দেয়। বিপজ্জনক, খুব রেগে যায়....।”

    — সে যাই হোক। গুহায় আমাদের ঢুকতেই হবে। চারিদিকে কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে দাও, কুইক।

    লম্বা লোকটার কথায় বাকি লোকগুলো তাই করল। একটা বিষধর সাপ গুহার সামনে দিয়ে চলে গেল।

    বিমল ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনারা ঢুকেই সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসবেন। এখানে অনেক বিষধর সাপ আছে।”

    — সে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। নাও তোমরা গুহার মুখের জঙ্গল সাফ করো, কুইক।

    বাকি লোকগুলো কোদাল, কুড়ুল নিয়ে জঙ্গল সাফ করতে শুরু করল।

    — এত দেরি করলে হবে না। তাড়াতাড়ি করো। খুব তাড়াতাড়ি।

    বিমল একমনে মাতা রুদ্র ভৈরবীকে ডাকতে লাগল। ঈশ্বরকে ডাকা ছাড়া তার আর কিছু করার নেই। চারুবাবু বিমলকেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন সে যেন আসল ম্যাপটা লুকিয়ে রাখে। কিন্তু সে কথা আর কেউ জানে না। বিমল প্রাণ থাকতে কাউকে বলবেন না। তাছাড়া, এরা হয়তো সেটা পেলেও বিমল আর চারুবাবুকে ছাড়বে না। নিজেদের অপকর্মের সাক্ষীকে বাঁচিয়ে রাখবে না। বিমলের চোখে জল এল — আর কোনোদিন হয়তো নিজের ছেলে আর স্ত্রীর সাথে দেখা হবে না।

    (২৪)

    সাতসকালে এত পুলিশ দেখে 'রোজমেরি এপার্টমেন্টের' সবাই ভীষণ অবাক হয়ে গেছেন। বিমলের স্ত্রী অঝোরে কেঁদে চলেছেন। সৌগত মুখ নামিয়ে চোখের জল গোপন করার চেষ্টা করছে। বিমল যে ছবিমুড়া বেড়াতে গিয়ে কোনো কারণে ফিরে আসেন নি সে খবর সবাই জেনে গেছেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে যারা গিয়েছিল যেমন অর্ক — তাকে পুলিশের সাথে দেখে সবাই নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করলেও কারণটা ঠিকঠাক বুঝতে পারছেন না। তাই নিজেদের মধ্যে যে যার মতো কল্পনা বসিয়ে একটা মুখরোচক গল্প তৈরি করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বিমলের ঘনিষ্ঠরা তাঁদের থামিয়ে দিচ্ছেন। কারণ বিমলের মতো সজ্জন মানুষ যে কোনো খারাপ কিছু করতে পারেন না সে বিশ্বাস তাঁদের আছে।

    পুলিশ প্রথমে বিমলের ফ্ল্যাটে না ঢুকে চারুবাবুর ফ্ল্যাটে গেল দেখে সবাই অবাক হলো। আর ঐটুকুনি ছেলে অর্ক সে পুলিশের বড়ো অফিসারের সাথে সমান তালে পা ফেলে এগোচ্ছে সবাই আরো অবাক হলো। তাহলে কি ছেলেটা পুলিশে চাকরি করে? কিন্তু বয়স তো বেশি নয়?

    চারুবাবুর ফ্ল্যাটে অনেকবার কলিংবেল বাজিয়ে, দরজা পিটিয়ে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না দেখে দরজা ভাঙাই মনস্থ করলেন অরূপবাবু। দরজা ভেঙে দেখা গেল চারুবাবু তাঁর বেডরুমে মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন। শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে তাঁকে।

    মৃতদেহ ভালোভাবে পরীক্ষা করার পর মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করে অরিজিনাল ম্যাপ খুঁজতে লাগলেন সবাই মিলে। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও সন্ধান পাওয়া গেল না। অরূপ সরকার বললেন, "মনে হচ্ছে, খুনি অরিজিনাল ম্যাপটা সরাতেই এঁকে খুন করেছে। আর সেটা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে।"

    কিন্তু বিমল যে ওই দুষ্কৃতিদের হাতে বন্দি অবস্থায় ফিসফিস করে অর্ককে বলেছিলেন, "আমি ছাড়া আর কেউ সেই ম্যাপ খুঁজে পাবে না। যদি আমার কিছু হয়ে যায় ...তুমি দেখো..."

    সবাই বেরিয়ে আসছিল চারুবাবুর ফ্ল্যাট থেকে। হঠাৎ অর্ক বলল, "স্যার একটু দাঁড়ান।" এই বলে সে ছুটে গেল বারান্দার দিকে। টবের গাছগুলো সব ক'টা সতেজ। শুধু একটা ঝাঁকড়া বেলফুলের গাছ—এর পাতাগুলো কেমন যেন নুইয়ে গেছে। অর্ক খুঁজল একটা ধারালো কিছু। মুহূর্তে নজরে এল একটা খুরপি। জানালায় রাখা। সেই দিয়ে গাছের গোড়াটা একটু খুঁড়তেই বেরিয়ে পড়ল একটা স্টিলের টিফিনকৌটোর সামান্য অংশ। গাছটা টেনে তুলতেই মাটি সরে গিয়ে পুরো কৌটোটা বেরিয়ে পড়ল। সেটার ঢাকনা টেনে খুলতেই বেরিয়ে পড়ল আসল ম্যাপটা।

    অরূপ সরকার ভীষণ উত্তেজিত।

    —তুমি কি করে জানলে যে এই টবে গাছের নিচে অরিজিনাল ম্যাপটা আছে?

    — সব গাছের পাতা সতেজ; শুধু এটা ছাড়া। যিনি গাছ এত ভালোবাসতেন, নিজে হাতে জল দিতেন। তাঁর কাছে কোনো গাছের অযত্ন হওয়া বা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া মনে হচ্ছিল গাছটাকে কেউ টব থেকে তুলে আবার বসিয়ে দিয়েছে।

    — তোমার অবজারভেশন চমৎকার।

    (২৫)

    গুহামুখের জঙ্গল অনেকটা সাফ হয়ে গেছে। চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কার্বলিক এসিডও। কিন্তু তবু বিমলের পা যেন আর চলতে চাইছে না। একটু একটু করে পিচ্ছিল পথ ধরে এগোচ্ছে সবাই। গুহার পথটা সোজা নয় — এঁকে বেঁকে এগিয়ে গেছে আসল সুড়ঙ্গের দিকে। গুহার ভিতরে ঘন অন্ধকার। লোকগুলো রেডি হয়েই এসেছে। একটা মশাল জ্বালিয়েছে। মশালের আলোয় গুহার ভিতর আলোকিত হয়ে উঠেছে। গুহার লাগোয়া আর একটা সুড়ঙ্গ, যার মুখ লতানো গাছে প্রায় সিল হয়ে আছে। লোকগুলো হাতের তলোয়ার দিয়ে লতানো গাছগুলো ঝটপট কেটে ফেলল। সুড়ঙ্গের ভিতরটা নিকষ অন্ধকার। মশালের আলোয় দেখা গেল একটা বিশাল কালো পাথরের উপরে আরেকটা পাথর। তার গায়ে মস ধরে আছে। ঠিক সেই মস-ধরা বেদির উপরে রয়েছে একটা সিন্দুক। সুড়ঙ্গের সারা গায়ে মস ও অন্যান্য উদ্ভিদ জমাট বেঁধে আছে। ভিতরের স্যাঁতসেঁতে জোলো ভিজে আবহাওয়াতেও অদ্ভুত একটা গন্ধ। বিমলের দম নিতে কষ্ট হচ্ছিল। লোকগুলো হাতের টর্চের আলো ফেলল সিন্দুকের উপর। সিন্দুকের মুখটা আটকানো রয়েছে একটা বাঁকানো লোহার বালা দিয়ে। দলপতি লম্বা লোকটা বলল, "সিন্দুকটা নামিয়ে আনো।"

    বলতেই দু'জন সিন্দুকের কাছে পৌঁছে গেল। শাবল দিয়ে খোঁচা মারল সিন্দুকের আশপাশে। সিন্দুকটা বিন্দুমাত্র স্থানচ্যূত হলো না। কিন্তু সারা সুড়ঙ্গ যেন কেঁপে উঠল একবার। বিমল তো টলে পড়েই যাচ্ছিল। আবার শাবল দিয়ে সিন্দুকের নিচে ঘা মারল ওরা। এবারে দুলে উঠল সিন্দুকের নিচের বড় পাথরটা। বিমলের যেন মাথা ঘুরছে — সব কিছু এত দুলছে কেন?

    বড় পাথরটা যেন একটু একটু করে সরছে। কেউ খেয়াল করছে না। সবাই সিন্দুকটা নামাতে ব্যস্ত। কিন্তু সেটা এত ভারী যে কেউ টেনে নামাতে পারছে না। সকলে একবার নিজের পায়ের দিকে তাকাচ্ছে। বিরাট পাথরটা এবারে বেশ নড়ছে। যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। কিন্তু একি! হঠাৎ হুড়মুড় করে পাথরের বেদি নিচে পড়ে গেল। গড়িয়ে পড়ল সিন্দুকটাও। কিন্তু সেটা খুলল না। বড় পাথরটা এবারে অন্য চেহারা নিচ্ছে। মস্তবড় একটা হাঁ করে এগিয়ে আসছে সুড়ঙ্গের ঠিক মাঝখানে ! তাহলে শ্যাওলা ধরা বড় গোল পাথরটা আসলে একটা মস্ত বড় পাইথন? কি সর্বনাশ। সবাই সুড়ঙ্গের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বিমল সবার আগেই সরে এসেছে সুড়ঙ্গের মুখের দিকে। যারা সিন্দুকের কাছে গিয়েছিল তারা এখনো বেরোতে পারে নি। পাইথনের প্যাঁচে আটকে গেছে চার-পাঁচজন। দীর্ঘদিন অভুক্ত থাকা পাইথনের হাঁয়ের ভিতরে একে একে ঢুকে যাচ্ছে। লম্বা লোকটা বিমলকে ধাক্কা দিয়ে পালাতে চাইছিল — কিন্তু মুখ দিয়ে অদ্ভুত একটা আওয়াজ করে মেঝেতে বসে পড়ে পা চেপে ধরল। বিমলের বুকটা ধড়াস করে উঠল। মেঝেতে কিলবিল করছে অসংখ্য সাপ।

    বিমলকাকু ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বলছেন, “জয় মা রুদ্রভৈরবীর জয়।”

    লম্বা লোকটা মেঝেতে শুয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর মুখ দিয়ে গাঁজলা বেরোচ্ছে। বিমল সুড়ঙ্গের বাইরে বেরিয়ে আসবার চেষ্টা করতে লাগল। ভয়ে, আতঙ্কে তার যেন দম বন্ধ হয়ে হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে। তিনি প্রাণপণে ছুটে চলেছেন বাইরের দিকে। পা কেটে গেছে, রক্ত ঝরছে। তবু হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে চলেছেন বিমল।

    কোন একটা পাথরের খাঁজে একফালি সূর্যের আলো দেখা যাচ্ছে। তার মানে বাইরে এখন সকাল বেলা। বিমলের মনে হলো কারা যেন হইহই করে এগিয়ে আসছে গুহার দিকে। স্থানীয় উপজাতির লোকজনদের নিয়ে এগিয়ে আসছে অর্ক এবং অরূপ সরকার। অর্কর হাতে অরিজিনাল ম্যাপ। উপজাতির লোকজনদের সাহায্য ছাড়া এই গুহায় প্রবেশ অসম্ভব। তারা নিজেদের দেবতার গুহা ও তাঁর সম্পত্তি রক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর। যখন তারা জানতে পেরেছে যে ওই গুহায় তাদের পূর্বপুরুষের লুকিয়ে রাখা গুপ্তধন চুরি করতে বেশ কিছু লোক ঢুকেছে; তখনই তারা লাঠি, সড়কি, মশাল, বল্লম ইত্যাদি নিয়ে অগ্রসর হয়েছে।

    অর্ক গুহার কাছাকাছি গিয়ে প্রাণপণে একটা হাঁক দিল—“বিমল…কা…কু!”

    ভিতর থেকে ক্ষীণ আওয়াজ পাওয়া গেল—“অ…র…ক।”

    - বেঁচে আছে! বেঁচে আছে!

    - যে করেই হোক ওঁকে বের করে আনতেই হবে।

    সবাই মিলে আরও দ্রুত এগোতে লাগল গুহার দিকে। উপজাতিদের মোড়ল সবার আগে এগিয়ে যেতে লাগল বল্লম হাতে। তার গলায় অসংখ্য পাথরের মালা, হাতের বাজুতে বহু রকমের তাবিজ-কবজ। লোকটা গুহার মুখে গিয়ে কিসব মন্ত্রপাঠ করতে লাগল। গুহার ভিতরে বিমল লক্ষ্য করলেন সাপগুলো আস্তে আস্তে নিজেদের গর্তের দিকে চলে যাচ্ছে। প্রচণ্ড ক্লান্ত বিমল টলতে টলতে অগ্রসর হতে লাগলেন গুহা অভিমুখে।

    বিমলকে ধরে ধরে বাইরে নিয়ে এল উপজাতি লোকরাই। তাঁকে হাঁ করিয়ে কাঁচের বোতল থেকে কি এক গাছগাছালির সবুজ রস খাইয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি অনেকটা সুস্থবোধ করতে লাগলেন। মোড়ল একটু হেসে বলল, “সাপে কামড়ালেও আমরা এই ওষুধ খাইয়ে থাকি। এটা মহামৃত্যুঞ্জয় ঔষধ।”

    (২৬)

    অরিজিনাল ম্যাপটা মিউজিয়ামে সযত্নে রাখা হয়েছে অরূপ সরকারের তত্ত্বাবধানে। উপজাতিদের মোড়লের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে একটা জেরক্স কপি। সেও সেটিকে সযত্নে ও সুরক্ষিতভাবে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। চারুবাবুর একটি আবক্ষ মূর্তি বসানো হয়েছে 'রোজমেরি এপার্টমেন্টের' বাগানে। যোগেশ রোজ চারুবাবুর গাছগুলোর পরিচর্যা করে, ফ্ল্যাট সাফসুতরো রাখে, আর চারুবাবুর মূর্তিতে টাটকা ফুলের মালা পরিয়ে জামার হাতায় চোখ মুছতে মুছতে আবাসনের গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। ত্রিপুরা ও কলকাতার প্রায় সমস্ত সংবাদপত্রে অর্ক, মহেশ আর বিমলবাবুর সাহসিকতার কাহিনী ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা সরকার ওদের পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা করেছে।

    কলকাতায় ফিরে এসেই অর্ক অরূপ সকারের পরামর্শে নিয়মিত ক্যারাটে ও বিভিন্ন ধরনের শারীরিক প্রশিক্ষণের ক্লাস করছে। পড়াশোনা শেষ করেই যাতে সে পরীক্ষা দিয়ে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চে যোগ দিতে পারে সেজন্যও গাইড করে চলেছেন অরূপ বাবু। তাঁর মতে অর্ক একটি রত্ন, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে আরও অনেক জটিল কেসের সমাধান হতে পারে।

    (সমাপ্ত)



    অলংকরণ (Artwork) : রূপা মণ্ডল
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments