• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৭ | জুলাই ২০২২ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • গ্রন্থ-সমালোচনা : ভবভূতি ভট্টাচার্য

    || শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে? ||

    গল্প একান্ন—সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়; মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স; কলকাতা; জানুয়ারি ২০১৭; ISBN: 978-93-5020-237-1

    সম্প্রতি তাদের শতবার্ষিকী উপলক্ষে আনন্দবাজার পত্রিকা ইয়াহ্‌ ঢাউজ ঢাউজ দুইটি সংকলন বের করেছে—উপন্যাস ও ছোটগল্পের। যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছে সংকলন দু’টি। শীঘ্রই আউট-অব্‌-প্রিন্ট হয়ে গেছে!

    গল্প-সংকলনটিতে ছোটগল্প রয়েছে একশত পঁচিশটি। গল্প-সংকলনটি প্রসঙ্গে আলাপচারিতায় একটা প্রশ্ন ঘুরে ফিরে এসেছে—১৯৬০-৭০এর দশক থেকে সুনীল-শীর্ষেন্দু-বিমল-দিব্যেন্দু-মতি যেভাবে বাংলা ছোটগল্পের জগৎটাকে ছেয়ে রেখে দিয়েছিলেন, গত বিশ-পঁচিশ বছরে তেমন আইকনিক লেখক আর কে কে হয়েছেন, পাঠকের মনে যাঁরা পাকা আসন গ্রহণ করে আছেন? (পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশের লেখকদের খুব কম পড়তে পেয়েছি বলে এই আলোচনাতে তাঁদের উহ্য রাখলাম।) আনন্দবাজারের এই সংকলনটি সাহায্য করল এমন এমন উল্লেখযোগ্য কিছু নামকে এক স্থানে পেয়ে যেতে—আবুল বাশার/তিলোত্তমা মজুমদার থেকে উল্লাস-স্মরণজিৎ।

    এমনই সংযোগ, এই সংকলনটি হাতে পাবার ঠিক আগেই পড়ছিলাম স্বনামধন্য সুমন্ত ব্যানার্জী সম্পাদিত ‘Homes in Emptiness—Anthology of Bangla stories’— (ISBN 81-87075-46-5)—যেখানে ‘ঘর’-থীমের উপরে জীবনানন্দ-সতীনাথ-ঋত্বিক থেকে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ/জয়া মিত্রের অনবদ্য দশখানি গল্পের ইঙ্গ-অনুবাদ করেছেন উনি। প্রতিনিধিস্থানীয় সংকলন কেমন হওয়া উচিত—এটিকে দেখে শেখা যায় সেটা। ভেবে কষ্ট হয়, অসীম রায়ের মতো গল্পকারকে বাঙালি ভুলে গেছে আজ! আর, জগদীশ গুপ্তকে তো সেভাবে পড়াই হয়নি! আক্ষেপ! আক্ষেপ!!

    না, বর্তমান এই নিবন্ধটি না ঐ আনন্দ-সংকলনের না সুমন্তের বইটির গ্রন্থ-সমালোচনা।

    ***

    সদ্য ষাটে পড়া এক মফস্বলী লেখক, যিনি বিগত সিকি-শতাব্দী ধরে অবিরল লিখে চলেছেন, বহুবিধ পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁর একটি গল্প আলোচ্য আনন্দ-সংকলনটিতে রয়েছে। ‘বাতিল’। লেখক সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়। উৎসাহী পাঠক পড়ে নিতে পারেন গল্পটি। হতাশ হবেন না, অনুপ্রাণিত হবেন। কথা দিচ্ছি। ‘বিকেলের আলো’, ‘তিস্তা যাবেই’, ‘প্রাপকের খোঁজে’….. প্রভৃতি অনেক অনেক গল্প-উপন্যাস লিখেছেন সুকান্ত গত আড়াই দশকে, যার বেশ কয়েকটি উচ্চ প্রশংসিত ও পুরস্কৃত।

    (তবু) না, ‘সুনীল-শীর্ষেন্দু’ হননি সুকান্ত।

    তাতে কী? সে তো অভিজিৎ তরফদার-উল্লাস ঘোষেরাও হননি, যদিও হঠাৎ হঠাৎ ঝলকে বারংবার মুগ্ধ করেছেন তাঁরা।

    খ্যাতি-স্বীকৃতি-বাণিজ্যিক সাফল্য—এইগুলো ঠুনকো ও বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন মানদণ্ড, এ’সবে কিছুই প্রমাণিত বা অপ্রমাণিত হয় না। এ’তো জানা কথা।

    ***

    এ’তো গেল ‘শিবের গীত’! (বাব্বাঃ! এত বড়?)

    এবার ধান ভানতে বসে বর্তমান সংকলনটির যে গল্পটির কথা প্রথমেই মনে আসছে, সেটার নাম ‘ধাওয়া’ (পৃ. ১৫৫ )! এক মধ্যবিত্ত প্রৌঢ় কোনো একটা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হঠাৎ সাহস সঞ্চয় করে এক পুরনো খুচরো পাপের অপনোদন করতে সচেষ্ট হলেন। এই সামান্য থীমের উপরে ছোট্ট গল্পটি যেভাবে গড়ে উঠেছে, যেমন চলন তার এবং অসাধারণ যার অন্ত্‌—অবলীলায় এক বিশ্বমানের গল্প হয়ে উঠেছে সেটি। মেরি রোরবার্জারের মতো বিশ্বখ্যাত সাহিত্য-সমালোচক সূচনা-জটিলতা-সমস্যা-ক্লাইম্যাক্স ও সমাধানের মতো ছোটগল্পের যে যে বৈশিষ্টাবলী ধরে ধরে আলোচনা করেন, সুকান্তের বর্তমান গল্পটিতে সেই সেই উপাদান তুখোড় মুন্সিয়ানায় মিশে রয়েছে। হয়ত লেখক অজান্তেই করেছেন সেটা। সেটাই এক বড় লেখকের স্টাইল—অবলীলাক্রমে করা। এই ‘ধাওয়া’ গল্পে ঐ যে শেষে বালিকাটির আবির্ভাব, মার্গসঙ্গীতে রাগের বিস্তার করে করে সঠিক মুহূর্তে সমে এসে ভেড়ার মতো আকর্ষক। সুকান্তের গল্পে এই ‘ক্লাইম্যাক্স’ বিষয়টা আসে এক ক্লাসিক স্টাইলে। এবারের ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার (বর্ষ ৭, সংখ্যা ৫) উনি যে ‘মানুষের সার্কাস’ গল্পটি লিখেছেন—ক্লাইম্যাক্সের ক্লাসিকাল এক উদাহরণ সেটি। ক্লাইম্যাক্সের এক জাদুকর ইনি! মোপাসিঁয়!!

    অবশ্য সব গল্পেই কি এমন ক্লাইম্যাক্সের উদাহরণ রয়েছে? তাহলে সেটা তো একঘেয়েমি হয়ে যেত। যেমন, ‘একটি অবাস্তব প্রেমের গল্প’ (পৃ. ৪৯৬)। এটি একটি চমৎকার ‘ওপেন এন্ডেড স্টোরি’—যার শেষটি শেষ হয়েও শেষ হয়ে যায় না, পাঠকের মনের জিজ্ঞাসার দরোজাখানি খুলে রেখে দেয়। ছোটগল্পকারকে স্পুনফীড করিয়ে দিতে হবে পাঠককে—এ'হেন দিব্যি কে দিয়েছে?

    এমন উন্মুক্ত সমাপ্তির ছোটগল্প এক অতীব উচ্চস্তরের আর্ট!

    একান্নখানি গল্প আছে সংকলনটিতে। সব কয়টির অঙ্গ ছুঁয়ে ছুঁয়ে আলোচনা অসম্ভব ও অপ্রয়োজনীয়। এটি সুকান্তের চতুর্থ এমন সংকলন, জানা গেল।

    নামী প্রকাশনালয়ের করা গ্রন্থসজ্জা-প্রচ্ছদ-বাঁধাই আকর্ষক, যদিও প্রভূত মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়েছে।

    শেষে, অবশ্য, প্রথম গল্পখানির কথা না বলে পারছি না: ‘প্রতীক্ষার দিন’ (পৃ. ৩ )। এত দুর্বল প্লট, অযৌক্তিক চলন ও হাস্যকর পরিসমাপ্তি—অবাক করে পাঠককে। এ’গল্পটিকে সর্বপ্রথম রাখবার পিছনে সংকলন-সম্পাদকের অ-মুন্সিয়ানা প্রতিষ্ঠিত হয়। মনেই হয় না যে এটি এক কৃতবিদ্য লেখকের কলম থেকে বেরিয়েছে।

    নাইজেরীয় ‘জাতির জনক’ বেন আজিকুইয়ে একবার বলেছিলেন, ‘পর্বতশিখরটা সাধারণত শূন্যই থাকে কারণ আমরা বেশিরভাগই পথিমধ্যে তুষ্ট হয়ে পড়ি।’

    না, ঐ সুনীল-শীর্ষেন্দু ‘আইকনিক’ প্রসঙ্গটার নিরসন হলো না।

    || দোল দিয়ে যায় পাতায় পাতায় ঘটায় পরমাদ ||

    পরমাদ—কৌশিক সেন; আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা; জানুয়ারি ২০২২; ISBN: 978-93-5425-315-7

    একটা সত্যি কথা বলব?

    এমনিতে আম-বাঙালি পাঠকের মনে এই ‘পরবাস’-পত্রিকার একটা নাক-উঁচু স্থান হয়ে রয়েছে। এম্যাহ্‌রিকা থেকে বেরোনো বাংলা পত্রিকা বলে ক্যানিং বা জলপাইগুড়ির পাঠক একটু awe-মিশ্রিত চোখে একে দেখে—এটা স্বীয় অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। তার ওপর, পরবাসের তাবড় তাবড় ডাক্তার-অধ্যাপক-বিজ্ঞানী লেখককুলের নাম দেখলে বেশ ভয় ভয় পাই মনে, একটু যেন সমঝে থাকি।

    এই awe থেকেই ডাঃ কৌশিক সেনের একটির বেশি গল্প আগে পড়িনি। সেই গল্পটি ‘কবরখানার চাবি’, যেটি নিয়ে ‘দেশ’ পত্রিকার সঙ্গে একট ইস্যু হয়েছিল। অতি চমৎকার একটি গল্প ছিল সেটি, বর্তমানে অন্য এক সংকলনে ঠাঁই পেয়েছে। এর আগে-পরে যদিও উনি ‘পরবাস’-এর পৃষ্ঠায় অনেকানেক গল্প-কবিতা-নাটক-ভ্র. কা. লিখেছেন, লিখে চলেছেন—সে-সবগুলি নিয়মিত কেন পড়িনি ভেবে এখন আফশোষ হচ্ছে; কারণটা আর কিছু নয়, অতি সম্প্রতি (জানুয়ারি ২০২২) কলকাতার ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ থেকে বেরোনো ওঁর ‘পরমাদ’ উপন্যাসটির ক্রয় ও পাঠ। এবং লেখকের প্রতি অনাবিল এক শ্রদ্ধা।

    এ’ উপন্যাসের ঠিক ঠিক সমালোচনা লিখি এমন এলেম আমার নাই, তবু ভালো লাগাটুকু তো পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারি? তাতে তো আপত্তি নেই কোন?

    কেন এলেম নেই?

    এটি এমন একটি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস যেটির সঠিক অনুধাবন করতে বারংবার এটির কাছে ফিরে ফিরে আসতে হয় (আমি তো মোটে একবার পড়লাম)। এর নায়িকা এক ধরনের ‘অডিটারি হ্যালুশিনেশনে’ আক্রান্ত, যা বারে বারে ফিরে আসে উপন্যাসের পর্বে পর্বে—নতুন নতুন রূপ নিয়ে। এ’ উপন্যাস পড়তে পড়তে বারংবার আমার তাই The Brothers Karamazov মনে পড়েছে—অবয়বে নয়, মূল সুরে। এ’উপন্যাসের উপমা-শ্রেয়া-ভাস্কর-ধীরাজের মতো চরিত্রগুলি দমিত্রি ফিয়োডোরোভিচ বা আলেক্সান্দ্রোভা শ্বেতলোভার সঙ্গে মিশে গেছে,—ঐ যে বললাম, অবয়বে নয়, মূলসুরে।

    এ’কাহিনীর নায়িকা এক অভিশাপের ডরে আক্রান্ত। সে ডর শুধু যে এ’কাহিনীর শুরুয়াৎ তা-ই নয়, পরতে পরতে খুলতে থাকে তা, বা রূপ বদল করে করে যায় গল্পের অগ্রগতির সাথে সাথে। উপন্যসের রিভিউ লেখার এ-ই এক অসুবিধা যে লিখতে গেলেই যেন বারে বারে গল্পটা নিরাবরণ হয়ে পড়তে চায়; কিন্তু সেটা করা তো স্পয়লার হয়ে যাবে। তাই পাঠকের কাছে নিবেদন, ধৈর্য ধরে এ’উপন্যাসের অন্দরে একবার প্রবেশ করে যান, এর রসাস্বাদনের শর্টকাট নেই আর কোনো।

    ***

    উপন্যাসের অঙ্গে অঙ্গে রবীন্দ্রগানের সুপ্রযুক্ত উপস্থিতি এর এক আকর্ষক আভরণ!

    ‘এই সুদূরে পরবাসে/ ওর বাঁশি আজ প্রাণে আসে’ বা ‘প্রাচীন রজনী নাশো/ নূতন ঊষালোকে’ বা, ‘সে মোর অগম অন্তর পারাবারে/রক্তকমল তরঙ্গে টলোমলো…’ ইত্যাদি ইত্যাদি লাইন যে কী অদ্ভুত মু্নসিয়ানায় মিশিয়ে মিশিয়ে গেছেন কৌশিক—সমালোচকের কলমে বর্ণনা করা কঠিন; এটা অনুভবের বিষয়।

    একটা জায়গা থেকে এখানে একটু পাঠ করবার লোভ সামলাতে পারছি না। (পৃ. ১৩৬)

    “এখন মধ্যরাত। ওঁরা দু’জনে সময় সফর শেষ করে ফিরেছেন। টেবিলের উপর ওঁদের হাত দুটো অনেকক্ষণ হল একসঙ্গে, আঙুলে আঙুল জড়িয়ে রয়েছে। অনেক কথা, অনেক বেদনা, যা কিছু এতদিন ধরে জমাট বেঁধে ছিল, আজকে তা একই সঙ্গে ক্ষরিত এবং অসঞ্চালিত। এখন শুধু নিবিড় শান্তি আর ক্ষমা।

    ‘আঁধারে যাহারা চলে, সেই তারাদের দলে, এসে ফিরে গেল বিরহের ধারে ধারে’…”।

    অপূর্ব! সাধে কি আর কারামাজভ উপন্যাসের গ্রুশেঙ্কাকে মনে পড়ে যাচ্ছিল?

    ***

    ব্লার্বে কোনো ‘ঘটনা’-র কথা উল্লেখিত হয়েছে দু’বার—যেটা কিনা নায়িকাকে হ্যালুশিনেশন কেটে বেরোতে সাহায্য করে (অবশ্য, এ’গল্পের নায়িকা আসলে কে, সেটা পাঠকের বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়)। ঘটনা কিন্তু একটা নয়, ঘটনার একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে এখানে। সেটার ক্রম-উন্মোচন এই উপন্যাস পাঠের বড় প্রাপ্তি একটা। পাঠক পড়ে রসাস্বাদন করে নেবেন, তাই এখানেই কলম গোটালাম।

    ***

    লেখকের অন্তত সাত-আটটা উপন্যাস-কবিতা-গল্পসংকলনাদি আনন্দ ও প্রতিভাসের মতো প্রকাশনালয় থেকে বেরিয়েছে ইতোমধ্যেই। গত বিশ বছর ধরে উনি ‘পরবাস’ পত্রিকার নিয়মিত লেখক। পেশায় আমেরিকার টপ মেডিক্যাল স্কুলের ডাক্তার। ওঁকে যে আমরা কম পড়েছি এটা আমাদের অকৃতিত্ব, ওঁর নয়।

    নিভৃতচারিতা যে আসলে এক আভরণ, সেটা অনেক সময়ে ভুলে যাই আমরা।

    পুনঃ—এ’ নিবন্ধের শীর্ষনামটা ভুল দেওয়া হয়ে গেল, কারণ কোনো ‘পরমাদ’ তো ঘটায়নি এ’বই। তবু পড়তে পড়তে নানান রবীন্দ্রগানের অনুষঙ্গে ‘ওই ভাঙল হাসির বাঁধ’ গানটা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল কিনা…

    || দ্বীন্‌ দ্বীন্‌ ও হর হর যেখানে মিলে যায় ||

    তিতুমীর—আফতাব হোসেন; 24x7 publishing, কলকাতা; অগাস্ট ২০২১; ISBN: 978-93-91488-28-4

    ইং সন ১৮৩১।

    বছর শেষ হয়ে আসছে। শীতকাল। সে বছর ঠান্ডাটা পড়েওছিল জব্বর।

    এই সেই বছর যখন ডিরোজিও বহিষ্কৃত হন হিন্দু কালেজ থেকে। সে অবিশ্যি গ্রীষ্মকালের কথা, এপ্রিল।

    তা নভেম্বরের এই শীতকালে শহর কলিকাতার উপকণ্ঠে নারকেলডাঙার বাগানবাড়িতে বাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুর যে সন্ধ্যায় ‘হিন্দু থিয়েটার’ গড়ে ‘জুলিয়াস সীজার’ নাটক নামাচ্ছেন, সেদিনই তার থেকে মাত্র ১৫ মাইল দূরে বারাসতের নারকেলবেড়িয়াতে এক টগবগে বাঙালি যুবক পাঁচ হাজার ধর্মযোদ্ধার বাহিনী নিয়ে বাঁশের কেল্লা গড়ে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন ব্রিটিশ রাজশক্তিকে! এমনই সমাপতন, বিজয়ী সেই সেনানায়কের নামটাও ছিল শেক্সপীয়র, যাঁর বেয়নেট এ’ফোঁড়-ও’ফোঁড় করে দিয়েছিল বিদ্রোহী নেতা মীর নিশার আলির মস্ত দেহখানাকে (আবাল্য জব্বর কুস্তিগীর ছিলেন নিসার!)

    মা তাঁকে আদর করে তিতু নামে ডাকতেন। চব্বিশ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিপীড়িত কৃষককুলের নয়নের মণি যখন তিনি সেই ‘তিতু’-ই ‘তিতুমীর’ হয়ে উঠলেন, আধুনিক ভারতের এক শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে যিনি অবলীলাক্রমে স্থান করে নেবেন।

    তিতুমীরের সংগ্রাম সংকীর্ণ এক ধর্মান্দোলন ছিল কিনা, সেটা কোনো পশ্চাদপর লড়াই ছিল কি?—এই সব হলো গিয়ে বেকার কথাবার্তা কারণ ইতিহাসে কোনো আন্দোলনকেই সকল পক্ষ সমভাবে সমর্থন করে না, করেনি। উইনস্টন চার্চিল তাই না বলেছিলেন, ‘হিস্ট্রি ইজ রিটন বাই দ্য ভিক্টর্স!’ তবে, বাঁশের লাঠি আর বল্লম সম্বল করে ইংরেজ কামানের গোলার যে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়—সেটা জেনেও যে বাঙালি অসীম বীরত্বে কৃষ্ণদেব রায়ের মতো জমিদারদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পিছপা হন না তিনি আম-বাঙালির নয়নের মণি হয়ে উঠবেন আশ্চর্য কি আর এতে? কৃষ্ণদেবের দোসর ছিলেন বারাসতের ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট থেকে শেষাবধি বড়লাট উইলিয়ম বেন্টিঙ্কও, কারণ শ্রেণীস্বার্থ ছিল তাঁদের কাছাকাছিই। অন্যদিকে পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের হিন্দু-মুসলিম চাষা-জোলা-জেলের স্বার্থ উচ্চে তুলে ধরতে পেরেছিলেন বলেই তিতুমীর তাঁদের সর্বগ্রাহ্য নায়ক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন, তারা সে-বিচার করেনি যে তিতু বরেলভী-সাহেবের ‘তারিকা-ই-মুহম্মদিয়া’-র কার্যক্রমকে আগে বাড়াচ্ছেন কি না।

    ***

    ১৯৫৪-তে ২৮ বছরের তরুণী মহাশ্বেতা দেবী উপন্যাস লিখেছিলেন বিপ্লবী-বীর তিতুমীরকে নিয়ে, বৃহত্তর গ্লোবাল পাঠকের জন্যে রিমি চ্যাটার্জি যার এক অসাধারণ ইং-অনুবাদ করেছিলেন পঁয়তাল্লিশ বছর পরে (Seagull books, 2000). মহাশ্বেতার ‘তিতুমীর’ বালাকোটের যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন বারাসতের, যেটা মানতে একটু কষ্ট হয়, কারণ তিতু তো কোনো দেশীয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়েননি, তাঁর লড়াই ছিল বিদেশী শোষকের বিরুদ্ধে।

    এই জায়গাটা থেকেই তিতুকে ধরে নিয়েছেন বর্তমান লেখক, যিনি কিন্তু কোনো ইতিহাসগ্রন্থ লেখেননি, লিখেছেন তিতুর জীবনীভিত্তিক এক উপন্যাস। পাঠককে সেইটে মাথায় রেখেই পড়তে বসতে হবে এই কাহিনী। উপন্যাসের চারিত্রিক চলন মোতাবেক এখানে কাল্পনিক চরিত্র/কথোপকথন আসবে, এসেছে, যদিও লেখক বিশেষ সচেষ্ট থেকেছেন ইতিহাস-বিচ্যুতি এড়াতে। এবং তাতে সফল। তাঁর এই উপন্যাসে তিতু আদতে এক বঙ্গভাষী গ্রাম্য যুবক, টান যার বাংলার মাটির সঙ্গে। সে মায়ের আদরে, বন্ধুদের সাহচর্যে কুস্তি লড়ে বাইচ খেলে বড় হয়ে উঠছে এই বাংলার বুকেই, এখানেই তার মন অত্যাচারী জমিদারের অযৌক্তিক করের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। মাঝের কয়েক বৎসরের মক্কাশরীফ ভ্রমণ অগ্নিদীক্ষা দেয় তিতুকে, বাংলায় ফিরে এসে সে হয়ে ওঠে ‘তিতুমীর’!

    লেখক আসলে যে খুলনার মানুষ, যতই লন্ডনে ডাক্তারি করুন না কেন, তাঁর কলমের বাঙালিসুলভ মিষ্টি স্বাদ যাবে কোথায়, যতই ‘তিতা’ মীরের গল্প লিখুন? এই উপন্যাস তাই আদ্যন্ত মাঠের ভাষাতেই লিখিত, যদিও পাঠ শুরুর আগে ভীত ছিলাম, অতি-আঞ্চলিক ভাষায় দীর্ণ হবে না তো এ’ (লেখক যে এই অঞ্চলের আশেপাশেরই মানুষ!)? তা হয়নি; বড়ই সুখপাঠ্য এ’পেলব ভাষায় বাঙালির বীরত্বগাথা।

    তিতুমীরের বীরত্বগাথা কেন আজও বাঙালি হৃদয়কে এতটা মথিত করে? পাঁচশ’ বছর আগে যশোহরের প্রতাপাদিত্যের দিল্লীশ্বর-বিরোধিতা যেমন এক বাঙালি আইকনের জন্ম দিয়েছিল, দু’শো বছর আগে তিতুর ইং-বিরোধিতাও তেমনি। অধ্যা. গোলাম মুরশিদ যেমন লিখেছেন, ‘বাঙালি সংস্কৃতি কোনো অখণ্ড অথবা অভিন্ন সংস্কৃতি নয়। এ সমাজ যেমন বহু ভাগে বিভক্ত, এ সংস্কৃতিও তেমনি বহু রঙে রাঙানো… এবং সে কারণে এ সংস্কৃতির অবয়ব আদৌ শাদামাটা অথবা একমাত্রিক নয়।’ (“হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি”) এই বহুবর্ণীয় বাঙালি সংস্কৃতি-ও-ইতিহাসের এক নবতম সংযোজন বর্তমান বইটি, যেটি ভাষায়, মুডে, ইতিহাসাশ্রয়ে এক অনাবিল সুখপাঠের নজির রাখে।

    কলকাতার নব্য এই প্রকাশনালয়ের কাজ মন্দ লাগল না; মুদ্রণপ্রমাদ কিছু নজরে আসেনি। কেবল পৃষ্ঠপ্রচ্ছদের ব্লার্বখানি অতিদীর্ঘ হয়ে গেছে, এটির তন্বী রূপ বাঞ্ছনীয়।

    || আসা যাওয়ার পথের ধারে কেটেছে দিন ||

    ময়ূরাক্ষী (চিত্রনাট্য)—অতনু ঘোষ; প্রকাশকঃ ফেডারেশন অফ ফিল্ম সোসাইটিজ অফ ইন্ডিয়া, পূর্বাঞ্চল, কলকাতা-৭২; নভেম্বর ২০১৯; ISBN: নেই

    চিত্রনাট্য কি পড়বার জিনিস? না, ‘করবার’?

    মানে, চিত্রনাট্য থেকে সিনেমা করা হয় কিনা! শুধু পাঠসুখের জন্যে চিত্রনাট্যের একটা ছাপা বই হাতে নিয়ে পড়ে ফেলা যায়?

    কেন, ইবসেনের ‘আ ডল’স হাউজ’ হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টে উল্টে পড়ি না? বা, গিরীশ ঘোষের ‘প্রফুল্ল’? নাটকও তো ‘করবার’ বিষয়, কেবল ‘পড়বার’ নয়। তবু, নাটক যতটা ‘পাঠ্য’, কোনো চিত্রনাট্য আজও ততটা পাঠযোগ্যতা অর্জন করে ফেলেনি বোধহয়, যদিও, মনে পড়ে, কেবল সত্যজিৎ-মৃণালের নানান চিত্রনাট্য পড়বার জন্য সেকালে আমরা ‘এক্ষণ’ বা ‘বিভাব’-এর বিশেষ বিশেষ সংখ্যা কিনে আনতুম।

    সেই ভেবে চিত্রনাট্যের এই ‘বই’-টি হাতে তুলে নেওয়া, যার আরেক প্রধান কারণ এর প্রকাশক হলো ‘ফেড. অফ ফিল্ম সোসাইটিস অফ ইন্ডিয়া’, যাঁদের ‘একাডেমিক এক্টিভিটিস’-এর অঙ্গ হিসেবে বইখানি প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা গেল। অর্ধ-শতাব্দী পেরোনো সত্যজিৎ-চিদানন্দীয় এই সংস্থাটি এক মাসিক মুখপত্র বের করে থাকে জানতাম, কিন্তু তাঁরা যে পুস্তক প্রকাশও করেন, জানা ছিল না।

    সেই উৎসাহ থেকেই বইটি পড়ি।

    ***

    ‘দ্য মেকিং অব্‌ পথের পাঁচালী’-র উপরে নির্মিত ‘অপরাজিত’ সিনেমাটি তো সম্প্রতি তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে, কিন্তু তারও পাঁচ বছর আগে সত্যজিতীয় আরেকটা থীমের উপরে আধারিত ‘ময়ূরাক্ষী’ ছবিটা শ্রেষ্ঠ জাতীয় পুরস্কার জিতে নিয়েছিল, মনে পড়ে?

    থীমটা কী?

    ‘অপুর সংসার’-এর শেষ দৃশ্য মনে আছে?

    সেই যে কড়া দাদুর কাছ থেকে পালিয়ে এসে পরম ভরোসায় অচেনা বা অর্ধচেনা বাবার কাঁধে নিজেকে সঁপে দিল শিশু কাজল?!

    পিতাপুত্রের নিবিড় সম্পর্কের প্রকাশ তো সত্যজিতীয় চলচ্চিত্রের অঙ্গে অঙ্গে আরও কোথাও কোথাও চমৎকার প্রকাশ পেয়েছে (পাঁচালীর ‘ঐ ভূত, বাপ রে!’ ভুলে যাব? বা, ‘জন অরণ্য’ বা, ‘শাখাপ্রশাখা’?), অতনুর এই ছবিতে বাবা-ছেলের প্রিয় সম্পর্কের যে বহিঃপ্রকাশ, বাংলা সিনেমার এক মাইলফলক হয়ে থাকবে সেটা (২০১৭-এ’ শ্রেষ্ঠ বাংলা ফিচার ফিল্মের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত); যদিও ছবি হিসেবে ‘ময়ূরাক্ষী’ কত সফল, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কেরিয়ার-বেস্ট অভিনয় এটি কি না—এ’সব আমাদের বর্তমান নিবন্ধের পরিধির বাইরে। এখানে আমরা ছবিটির চিত্রনাট্য নিয়েই দু’কথা বলব।

    ***

    এ’ছবির কিন্তু আগাগোড়া বেশ একঘেয়ে হবার কথা ছিল, কারণ এর বারো আনা, বা তার বেশি, বাবা-ছেলের সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়েই; বাকি ঘটনাবলী (যদি কিছু থাকে) সেটা গৌণ ও এসেছে ঐ প্রসঙ্গেই। সুশোভন (সৌমিত্র চট্টো.) ও আর্যনীলের (প্রসেনজিৎ) রোল-ই তাই প্রধান। ওঁদের অভিনয়গুণই তাই টেনে নিয়ে যায় ছবিটিকে, তবু সেটা কি দাঁড়াতে পারত পা-রাখার জায়গাটা যদি না হতো এক গতিশীল চিত্রনাট্য?

    এখানেই এক সুসংবদ্ধ চিত্রনাট্যের প্রয়োজনীয়তা, যেখানে এই বইটির পুনঃ পুনঃ পাঠ কোনো নতুন ছাত্রকে শেখাবে কী করে লিখতে হয় এক সফল চিত্রনাট্য।

    যেমন, এ’বইয়ের শেষে আছে এক অনৃতভাষণ, যেটার ওপরে অনেকটা দাঁড়িয়ে আছে ছবিটা। সেইখানটা পড়িঃ

    সুশোভনঃ দেখ…একটা পিওর সোল খুঁজে পাওয়া খুব শক্ত। ময়ূরাক্ষী তোকে আঁকড়ে ধরে থাকবে…ও’ তোকে সারিয়ে তুলবে।

    আর্যনীলঃ ময়ূরাক্ষী আর নেই বাবা….*। আজ বিকেলে মারা গেছে।

    *অতনু এখানে কয়েকটি বিন্দু দিয়ে যেন কত কথা বলতে চেয়েছেন, যেন কত মিথ্যে ঢাকতে চেয়েছেন। যেটা সত্যি না মিথ্যে তার ওপরে পুরো ‘ময়ূরাক্ষী’ সিনেমাটার অনেক কিছু নির্ভর করে। স্বল্পকথন অতনুর লিখন স্টাইলের একটা ফলক।

    যেভাবে ১, ২, ৩, ৪ করে করে স্তরে স্তরে লিখে গেছেন উনি সারা চিত্রনাট্যটা, মনে হয় যেন জেমস মনাকো পড়ছি।

    অনবদ্য একখানি মুখবন্ধ লিখে দিয়েছেন সুরকার দেবজ্যোতি মিশ্র; সত্যি বলছি আঙুল থেকে মীরজাব খুলে কলম তুলে নিলে উনি যে এত সুখপাঠ্য রচনা লেখেন, আগে জানতাম না।

    ‘পরবাস’-এর এই কলামে চিত্রনাট্য নিয়ে আগে লিখিনি। এবার থেকে লিখব। খুঁজে খুঁজে।

    হ্যাঁ, এ’বইখানি অতনু ‘বাবা-কে’ উৎসর্গ করেছেন, যাঁকে ছাড়া আর কাকেই বা করা যেত?

    পুনঃ ছবিটা কিন্তু দেখলাম চিত্রনাট্যটি পড়বার পরে। এবং, এমনই সমাপতন, ‘ফাদার্স ডে’-র দিনে!

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments