[ওভারকোট ঠান্ডায় পরার আরামদায়ক পোশাকমাত্র নয়। ওভারকোট সত্যকে আড়াল করে, অস্তিত্বের সংকটকে ঢেকে রাখে। ওভারকোট সরে গেলে উপমহাদেশের উত্তর-ঔপনিবেশিক জাগতিক ও মানসিক সংকটও কি আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়? নিজের ভাষা, আদব-কায়দা ভুলে গিয়ে পশ্চিমি সভ্যতার অন্ধ অনুকরণের প্রয়োজন অনুভব করার মধ্য দিয়ে যে সংকটের সূত্রপাত?
ভেতরের ফোঁপরা কাঠামোটা কি তখন বেরিয়ে আসে? গন্তব্যহীন, লক্ষ্যহীন সান্ধ্য ভ্রমণের মতই যা অন্তঃসারশূন্য?
গুলাম আব্বাস (১৯০৯-৮২) রচিত গল্পটির অনুবাদের জন্য নাদিম আহমদ সম্পাদিত ‘কুল্লিয়াত-এ গুলাম আব্বাস’-এ মুদ্রিত সংস্করণটি ব্যবহার করেছি।
—অনুবাদক]
জানুয়ারির সন্ধ্যা। কেতাদুরস্ত সুবেশ এক যুবা ডেভিস রোড ধরে চলতে চলতে ম্যাল রোডে পৌঁছে চেয়ারিং ক্রসের দিকে ঘুরল। ফুটপাতের ওপর দিয়ে শ্লথগতির পদচারণা। তার লম্বা চুলগুলো আলোয় উজ্জ্বল। সরু গোঁফটি যেন পেন্সিলে আঁকা। গায়ে বাদামি রঙের ওভারকোট। কোটের বোতামঘরে হালকা কমলা রঙের গোলাপ গোঁজা। মাথায় সবুজ ফেল্ট টুপিটি একটু তেরছাভাবে পরা। সাদা রেশমের গলাবন্ধ গলায় জড়ানো। নওজোয়ানের একটা হাত কোটের পকেটে। আরেক হাতে বেতের একটা ছোট ছড়ি। সেটাকে মাঝে মাঝে মনের আনন্দে ঘোরাতে ঘোরাতে সে চলেছে।
শনিবার। ভরপুর শীতের মরসুম। কনকনে তেজি বাতাস যেন ধারালো ছুরির ফলার মত বুকে এসে বিঁধছে। অন্য অনেকে শরীর গরম করার জন্য জোর কদমে চলেছে। যুবকের অবশ্য কোনও হেলদোল নেই। কড়া শীতের মধ্যে হেঁটে সে যেন মজাই পাচ্ছে। তার চলাফেরার ভঙ্গি এমনই যে টাঙাওয়ালারা দূর থেকে তাকে দেখেই ঘোড়দৌড় করিয়ে কাছে হাজির হয়ে যাচ্ছে। তরুণ ছেলেটি অবশ্য ছড়ির ইশারায় তাদের না বলে দিচ্ছে। একটা খালি ট্যাক্সিও একবার দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু যুবক তাকেও ‘নো, থ্যাংক ইউ’ বলে এগিয়ে গেল।
যতক্ষণে সেই নবযুবা ম্যালের ঝলমলে পরিবেশে এসে পৌঁছোল, ততক্ষণে তার চনমনে ভাব যেন আরও বেড়ে গেল। কোনও একটা ইংরেজি গানের সুর শিস্ দিতে দিতে সে যাচ্ছে। গানের তালের সঙ্গে যেন পা মিলিয়ে চলেছে। একবার আশপাশে কেউ নেই দেখে আবেগের বশে কিছুটা দৌড়ে গিয়ে বল ছোঁড়ার ভঙ্গি করল। যেন কোনও অদৃশ্য ক্রিকেট খেলার খেলোয়াড়। এতক্ষণে সেই রাস্তায় পৌঁছেছে যেটা লরেন্স গার্ডেন্সের দিকে গেছে। কিন্তু সন্ধ্যের অস্পষ্টতায় আর শীতের কুয়াশায় বাগানটা যেন বিষণ্ণতায় ছেয়ে আছে। তাই সে ওদিকে না গিয়ে চেয়ারিং ক্রসের দিকে সোজা পথ ধরল। রানির স্ট্যাচুর নিচে পৌঁছে সে একটু গম্ভীর হয়ে গেল। পকেটের বদলে কোটের বাঁ আস্তিন থেকে রুমাল বার করে মুখটা পুঁছে নিল। পাশেই এক টুকরো ঘাসের ওপর কয়েকটা ইংরেজ বাচ্চা একটা বড় বল নিয়ে খেলছে। যুবক দাঁড়িয়ে পড়ে সোৎসাহে তাদের খেলা দেখতে লাগল। বাচ্চারা কিছুক্ষণ তো তার উপস্থিতি অগ্রাহ্য করেই খেলা চালিয়ে গেল। কিন্তু তাকে টানা তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু পরে লজ্জা পেল। হঠাৎই বলটা কুড়িয়ে নিয়ে হাসতে-হাসতে একে অপরকে তাড়া করতে করতে লনটা ছেড়ে পালিয়ে গেল।
সিমেন্টের একটা খালি বেঞ্চি চোখে পড়ায় তরুণ তার ওপর বসল। সন্ধ্যের অন্ধকার নামতেই ঠান্ডাটাও যেন বেশ জাঁকিয়ে পড়ছে। কড়া ঠান্ডা খুব যে অস্বস্তির কারণ হচ্ছিল তা নয়। বরং তাতে আরামের হাতছানিই ছিল। যারা আরাম-আয়েশের জীবন কাটায় তাদের কথা তো বলাই বাহুল্য। তারা তো ঠান্ডার আমেজ উপভোগ করবেই। কিন্তু যারা নিঃসঙ্গ এমনকী তারাও নিজেদের সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে এসময় মেহফিল-সম্মেলনের অংশীদার হতে প্রলুব্ধ হয়। অন্য অনেকের শারীরিক উষ্ণতায় নিজেদের সেঁকে নেয়। এই আনন্দ কত মানুষকে ম্যালের ভিড়ে টেনে আনে। যার যেমন সাধ্য রেস্টুরেন্ট, কফি হাউস, নাচঘর, সিনেমা ইত্যাদি উপভোগের কোনও না কোনও মোকামে মানুষ সেঁধিয়ে যায়। ম্যাল রোডে মোটরগাড়ি, টাঙা আর সাইকেলের শোভাযাত্রা লেগেছে যেন। আর ফুটপাতের ওপর পথচারীদের সে কী ভিড়! সড়কের ওপরে দোকানপাটে বেচাকেনার বাজারও সরগরম। আর যে দুর্ভাগাদের হোটেল-রেস্টুরেন্টে ঢোকা বা কেনাকাটার সাধ্য নেই, তারাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দোকানের আলো ঝলমলে জানলাগুলোর দিকে তাকিয়ে সময় কাটাচ্ছে।
যুবক সিমেন্টের বেঞ্চে বসে উৎসাহভরে সামনের ফুটপাতের ওপর মানুষের এই শোভাযাত্রা দেখতে থাকে। মুখাবয়বের তুলনায় পথচারীদের বেশভূষার বাহার দেখতেই সে বেশি উৎসাহী। সব শ্রেণির, সব ধরনের মানুষ আছে এখানে: বড় ব্যবসায়ী, সরকারি অফিসার, নেতা, শিল্পী, কলেজের ছাত্রছাত্রী, নার্স, খবরের কাগজের প্রতিনিধি, অফিসের বাবুরা। অধিকাংশই ওভারকোট পরে আছে। সব কিসিমের ওভারকোট। চামড়ার তৈরি দামী ওভারকোট থেকে শুরু করে ফৌজিদের পরিত্যক্ত ওভারকোট, নিলামে সস্তায় কেনা।