একটা খবর পরিমলের নজর টানল। এখন ছুটির মরশুম, পাহাড় আর সমুদ্রতীরের শহরগুলোতে প্রচুর ভ্রমণবিলাসীর ভীড়। কাগজটা সমুদ্রতীরে তাদের ভীড়ের একটা ছবিও দিয়েছে। বাবা, মা, তাদের ছেলেমেয়েরা, ঝাঁক বাঁধা অল্পবয়েসী ছেলেমেয়ের দল। অনেকে প্রাতরাশ সঙ্গে করে নিয়ে এসে সমুদ্রতীরে বসে খাচ্ছে – ডিমসেদ্ধ, স্যান্ডউইচ, কলা, সেই সঙ্গে ফ্লাস্কে করে নিয়ে আসা চা বা কফি – এসব খবরও খুব রসিয়ে ছেপেছে কাগজটা। এরা খুব বিশদ করে এসব খবর ছাপে, সেজন্যে এদের কাটতি প্রচুর।
পরিমল কাগজটার শেষ পাতা অবধি চোখ বোলানো শেষ করলেন, তারপর সেটাকে ভাঁজ করে টেবিলের ওপর রাখলেন। তাও টেবিলের সামনের জানালাটা খোলা, তিনি বাইরের দিকে তাকালেন।
শহরতলির একটা বড় ফ্ল্যাটবাড়ির দোতলার একটা ফ্ল্যাটে পরিমল থাকেন। তার এই ফ্ল্যাটের ঠিক নিচে বিল্ডিংটার কম্পাউন্ড একচিলতে ঢুকে এসেছে। কম্পাউন্ডের লম্বা টানা দেয়ালের পরেই ছোট কিন্তু গাড়ি চলার পিচের রাস্তা, সে রাস্তার গা বেয়ে চলে গেছে একটা আধবোজা খাল। খালের ওপাশের জমিতে অনেকগুলো গাছ এলোমেলোভাবে গজিয়ে উঠেছে। পরিমলের ঘরের জানালার সোজাসুজি রয়েছে একটা খিরিশ গাছ, গাছটা অতি প্রকাণ্ড, সে প্রচুর ছোটবড় ডাল এদিক-ওদিক মেলে দিয়েছে, সবুজ পাতায় ভরে আছে গাছটা আর ডালগুলো। অল্প অল্প হাওয়া দিচ্ছে, পাতার ঝাঁক এদিক-ওদিক মাথা নাড়িয়ে দুলছে, পাতার গায়ে, ফাঁকে ফাঁকে হাওয়া লেগে সোঁ সোঁ শন শন আওয়াজ, সেই আওয়াজ নিজের ঘরে বসেও শুনতে পাচ্ছেন পরিমল। এই আওয়াজ শুনতে শুনতে তিনি সদ্য কাগজে পড়া বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাওয়া ঐ লোকগুলোর কথা ভাবলেন। বেশ আছে, ভাল আছে ঐ লোকগুলো।
কিন্তু পরিমল বেশ নেই, ভাল নেই। একটা বিশ্রী ঝামেলায় তিনি এখন জড়িয়ে আছেন।
পরিমলের এক সন্তান, একটি ছেলে। ছেলে থাকলে লোকে তার বিয়ে দেয়, অন্তত পরিমল তার চেনাজানা লোকজন, যাদের ছেলে আছে, সবাইকে দেখেছেন ছেলের বিয়ে দিতে। পরিমলও দিয়েছিলেন। আর যেহেতু এক সন্তান, পরিমল তার বিয়ের জাঁকজমক নিজের ক্ষমতার তুলনায় একটু বেশিই করেছিলেন। তবে একথাও ঠিক, পরিমল যা খরচা করবেন ভেবেছিলেন গৃহিণীর তাড়নায় তাকে তার অনেক বেশি করতে হয়েছিল। পরিমল গৃহিণীর কথার বিশেষ কোনো প্রতিবাদ করেন নি। তার কারণ নিয়তি এবং গৃহিণী, এই দুই-এর বিধান অলঙ্ঘনীয়, সেটা তার জানা ছিল।
অবশ্য এর ফলে পরিমল কাজ থেকে অবসর নেয়ার সময় যা টাকাপয়সা পেয়েছিলেন তার পরিমাণ বেশ কিছু কমে গিয়েছিল। তবে তা নিয়ে পরিমল মনে দুঃখ পুষে রাখেন নি। এই খরচা নিশ্চয়ই তার নিয়তির বিধানও ছিল।
ছেলের বৌ ঘরে এল। হাস্যমুখী সুশ্রী একটি তরুণী। বৌয়ের ব্যবহারে পরিমল খুশি, গৃহি্ণী আরও খুশি, সবচেয়ে বেশি খুশি তাদের ছেলে। পরিমল নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের পছন্দের কাজে মন দিলেন, অর্থাৎ বই-এর পাতায় মুখ ডুবিয়ে দিলেন।
সাত দিন, পনেরো দিন, এক মাস কাটল। ছেলের বৌ একদিন বাপের বাড়ি গেল। তা ছেলের বৌ থাকলে তার একটা বাপের বাড়ি থাকে, সেখানে ছেলের বৌ মাঝে মাঝে গেলে তার ভেতর অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। দূরে তো কিছু নয়, এই কলকাতা শহরেই বাপের বাড়ি। কিন্তু দিন, সপ্তাহ, মাস গড়িয়ে যায়, মেয়েটির ফিরে আসবার কোনো লক্ষণ নেই। পরিমল এবং তার গিন্নী, দুজনেই নিজেদের ছেলেকে প্রশ্ন করলেন, কিরে বৌমা ফিরবে কবে কিছু জানিস নাকি?
ও বোধ হয় এখানে আর আসবে না, তারা ছেলের নিশ্চিন্ত উত্তর পেলেন।
প্রৌঢ় দম্পতি তো আকাশ থেকে পড়লেন। বলিস কি রে?
তারপর শুরু হল নানা প্রশ্ন – কি হয়েছে তোদের ভেতর? ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে? মারপিট করেছিস?
আরে না না, ওসব কিছু হয় নি।
তবে? মেয়েটা কি মিছিমিছি শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে গেল? ঠিক করে বল কি গোলমাল হয়েছে তোদের ভেতর।
গোলমাল কিছুই নয়। আসলে আমাদের দুজনের বনিবনা হচ্ছিল না। বলতে বলতেই ছেলে মুখ তুলে সামনের দেয়ালে ঝোলানো বড় ঘড়িটার দিকে তাকাল। তারপরই লাফিয়ে উঠল, অ্যাঁ, আটটা বেজে গেছে? তোমরা দুজনে বকবক করে আমার অফিসের দেরি করিয়ে দিলে। ছেলে দৌড় মারল বাথরুমের দিকে। তার পরেই জোরে বাথরুমের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ পেলেন পরস্পরের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা স্বামী স্ত্রী।
পরিমলের গিন্নী মেয়েটিকে ফোন করলেন। খুব ভদ্রভাবে কথা বলল মেয়েটি। কিন্তু সেই কথাই জানিয়ে দিল – বনিবনার অভাব।
এবার ফোন করলেন পরিমল নিজে। পেলেন খুব ভদ্র কিন্তু একই উত্তর – কি করে ফিরে যাব বলুন বাবা, আমাদের মধ্যে যে একেবারেই বনিবনা হচ্ছে না।
পরিমল আর তার গিন্নী, দুজনেই এবার ছেলেকে বললেন, শ্বশুরবাড়ি যা, বউকে ফেরত নিয়ে আয়।
দেখা গেল ছেলে তাতে একেবারেই রাজী নয়। বৌ চলে গেছে ঠিক আছে, ভালোই তো হয়েছে।
পরিমল এবার চটলেন – নিজের ছেলে আর ছেলের বৌ দুজনেরই ওপর। কিন্তু রাগটা নিজের মনেই রাখতে হল, সেটা ফলাবেন আর কার ওপর? এই নিষ্ফল রাগটা গিয়ে পড়ল সব অল্পবয়েসী ছেলেমেয়েদের ওপর। এই আজকালকার ছেলেমেয়েরা ছোটো বয়েস থেকে কখনো কোনোকিছুর সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে শেখে না। এর বিয়ে করা সঙ্গীকে নিজের মোবাইল ফোনের মত দ্যাখে। একটা পছন্দ না হলে সেটা ফেলে দাও, নতুন একটা কিনে নাও। পরিমল নিজের লম্বা দাম্পত্য জীবনের কথা ভাবলেন। মনে মনেই ছেলেকে বললেন, তোরা বলছিস বনিবনার অভাব। আমার আর তোর মায়ের তো কতবার ঝগড়া হয়েছে, তুমুল ঝগড়া। তা আবার মিটেও গিয়েছে। আমরা কি দুজন দুদিকে হেঁটে চলে গিয়েছি? আরে বাবা, একসঙ্গে থাকতে গেলে এরকম তো হবেই, মাঝে মাঝেই হবে। আর এরা, এখনকার ছেলেমেয়েগুলো? এদের কাছে বিয়েটা যেন একটা খেলা। যখন ইচ্ছে খেলা থামিয়ে দিয়ে বাড়িতে বাপ মায়ের কাছে চলে গেলেই হল।
মাস খানেক এভাবে কেটে গেল। তারপর একটা চিঠি এল। রেজিস্ট্রি করা চিঠি, জনৈক উকিলের কাছ থেকে এসেছে পরিমলের ছেলের নামে। মেয়েটি বিবাহবিচ্ছেদ চায়। পরিমলের ছেলে তাতে এক কথায় রাজী। কিন্তু চিঠিতে আর একটি মারাত্মক দাবী রয়েছে। মেয়েকে খোরপোষ হিসেবে এককালীন বিশ লাখ টাকা দিতে হবে। ছেলে তো একসঙ্গে এত টাকা বার করতে পারবে না, দিতে হলে ওই টাকা পরিমলকেই দিতে হবে।
ছেলের মন বুঝবার চেষ্টা করলেন পরিমল। ছেলের হাবেভাবে বোঝা গেল সে চায় তার বাপ ঐ টাকাটা ফেলে দিক, তাহলে চটপট বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যাবে, ছেলেও ভারমুক্ত হবে। বিয়ে দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয়ার জন্যে ছেলে এখন আভাসে ইঙ্গিতে তার মা বাবাকেই দোষ দিচ্ছে। এখন তার বাপেরই তো কর্তব্য ছেলেকে এই দায়মুক্ত করা।
অবশ্য এমন নয় যে পরিমল এই টাকাটা দিতে পারেন না। ছেলের বিয়ে দিতে প্রচুর খরচা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনও হাত একেবারে খালি নয়। কিন্তু এই টাকাটা দিয়ে দিলে পরিমলের আর বিশেষ কিছুই থাকবে না। যা থাকবে তা হল মাসে মাসে পাওয়া পেনশনের নুনভাত। ছেলে রোজগার করে খাওয়াবে এমন ভরসা পরিমলের নেই।
মানুষের দুর্দশার খবর হাওয়ায় ছড়ায়। পরিমল, তার গিন্নীর আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই খবরটা শুনলেন। তারা যা ঘটেছে তা শুনলেন, যা ঘটেনি তাও শুনলেন। সবাই জানলেন পরিমলের ছেলের বৌ তার বরের সঙ্গে ঝগড়া মারামারি করে বাপের বাড়ি চলে গেছে। অনেকের কাছে খবর গেল পরিমল আর তার স্ত্রী তাদের ছেলের বৌ-এর ওপর অমানুষিক অত্যাচার করত, মারধরও বাদ যেত না। সে সব আর সইতে না পেরে বৌটি বাপের বাড়ি চলে গেছে। সকলের কানে এটাও পৌঁছল যে বৌ ডিভোর্স চেয়েছে আর প্রচুর টাকা খোরপোষ হিসেবে দাবী করেছে।
চেনাশোনা কেউ কাদায় পড়েছে একথা শুনলে লোকে সাধারণত খুশি হয়, কেউ অল্প, কেউ বেশি। পরিমলের বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়বর্গের ব্যাপারেও এই নিয়মটির ব্যতিক্রম হল না। অনেকে আবার ঘটনাটা আরও ভালো করে জানবার জন্যে পরিমলের বাড়িতে দর্শন দিলেন। পরিমল তাদের সবাইকেই চা জলখাবার খাওয়ালেন এবং বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে ব্যাপারটা স্রেফ তার ছেলে আর ছেলের বৌ এর ভেতর অ-বনিবনার ফল। চা জলখাবার সবাই খেলেন কিন্তু কেউই একথা বিশ্বাস করলেন না। এক বন্ধু দর্শন দিলেন তার স্ত্রীকে নিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিমল বুঝলেন যে আগন্তুক মহিলাটির তদন্ত করার ক্ষমতা অতীব বিস্ময়কর এবং গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষতার সঙ্গে তুলনীয়। নানা প্রশ্নের পরে তিনি পরিমলকে জিগ্যেস করলেন, আপনার ছেলের বৌ-এর কি বিয়ের আগে কোন ছেলের সঙ্গে লাভ অ্যাফেয়ার ছিল? পরিমল এবং তার গিন্নী এই কূট প্রশ্নের উত্তরে সত্যি কথাই বললেন – তারা ঐ মেয়েটির সম্পর্কে এরকম কোনো কথা কারোর কাছেই শোনেন নি।
আগন্তুক মহিলাটি এর উত্তরে খুব গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন এবং নিশ্চিতভাবে বললেন, নিশ্চয়ই ছিল, আপনারা ভালো করে খোঁজ করেন নি।
এরকম একটি অকাট্য এবং সুদৃঢ় মতের বিরোধিতা করা যায় না। পরিমল অন্য কথা পাড়লেন। তার গিন্নী একটি বুদ্ধির কাজ করলেন – অতিথিদের সামনে চায়ের কাপ এবং জলখাবারের থানা সাজিয়ে দিলেন। অতিথি মহিলাটি খাদ্য এবং পানীয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, পরিমলের ছেলের বৌ-এর অতীত ইতিহাসের চর্চা ধামাচাপা পড়ে গেল।
উকিলের খোঁজ শুরু করলেন পরিমল। মেয়ের পক্ষের টাকার দাবীটা প্রকাণ্ড, কাজেই আইনি লড়াই দিতেই হবে। পরিমলের ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করেন একজন উকিল, তিনি একজনকে ঠিক করে দিলেন। জনৈকা মহিলা, পরিমলের উকিল তার যথেষ্ট প্রশংসা করলেন। বললেন, মেয়েটির বয়েস কম, কিন্তু কাজেকর্মে খুব চটপটে।
মেয়েটির সঙ্গে পরিমলের কথাবার্তা হল। মেয়েটি সত্যিই চটপটে আর চালাকচতুর। কিন্তু তাকে দিয়ে কাজ হবে এমন ভরসা পরিমল পেলেন না। সে পরিমলকে বার বার ভয় দেখাতে লাগল বিশেষ একটি আইনের ধারার, সব মেয়ের পক্ষের হাতেই যা এখন মারাত্মক একটি অস্ত্র। আরে বাবা, লড়াই যখন করতেই হবে তখন প্রতিপক্ষের হাতে চারশো আটানব্বই এ নামের পরমাণু অস্ত্রটি রয়েছে সে কথা ভেবে তো লাভ নেই। পরিমল বেশ বুঝলেন মেয়েটির আসল কাজ হচ্ছে যে সব হতভাগ্য ঐ মারাত্মক ধারাটির পাল্লায় পড়ে যায় কোনমতে তাদের জামিন পাইয়ে দেওয়া। পরিমলের যা দরকার তা এই নারী উকিলটি মেটাতে পারবে সেরকম পরিমলের মনে হয় না।
পরিমলের গিন্নীর দিকের এক আত্মীয় পয়সাওয়ালা লোক, বেশ কয়েকটা অভিজাত ক্লাবের মেম্বার। তিনি ঐ ক্লাবের চেনাজানার সুবাদে একজন উকিলের খোঁজ দিলেন। খুব নামকরা সিনিয়র উকিল, সবাই একডাকে চেনে, রাজনৈতিক আর উচ্চপদস্থ পুলিশ মহলে খুব খাতির। জজ সাহেবরাও অনেকেই ক্লাবের লনে পাতা টেবিলে বসে ওনার সঙ্গে খানাপিনা ইত্যাদি করে থাকেন। পরিমল তাকে ফোন করলেন। তাকে ফোনে পাওয়াই মুস্কিল, অবশেষে পরিমল গৃহিণীর সেই আত্মীয় উকিল সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরিমলের জন্যে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করে দিলেন।
নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে পরিমল উকিল ভদ্রলোকের চেম্বারে গিয়ে হাজির হলেন। একা যেতে সাহস হয় নি, গিন্নীর সেই আত্মীয়কে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। উকিল সাহেব বয়স্ক, রাশভারি চেহারা, প্রকাণ্ড টেবিলের ওপাশে বসে আছেন, সামনে ফিতেয় বাঁধা ফাইলবন্দী কাগজের পাহাড়। কত লোকের সুখ দুঃখ (বেশির ভাগই হয়তো দুঃখ) ওসব কাগজের ভেতর চাপা পড়ে আছে কে জানে। সিনিয়র উকিল সাহেবের পেছনে সাইজে ছোট চার পাঁচটা টেবিল, তাতে সব জুনিয়ররা বসে আছে। তাদের সামনে টেবিলের ওপর মামলার কাগজ, কম্পিউটার, এসব রয়েছে। উকিল সাহেব পরিমলের দিকে এক ঝলক তাকিয়েই মুখ ঘুরিয়ে নিলেন, তার ক্লাবের বন্ধুকে বললেন, আরে এসো এসো। আর তার পরেই তার সঙ্গে খোশগল্পে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাদের কথাবার্তার থেকে পরিমল বুঝলেন শীগগীরই ক্লাবের নতুন সভাপতির নির্বাচন হবে, উকিল ভদ্রলোক ঐ পদের জন্যে নির্বাচনে দাঁড়াবেন। বিরোধীপক্ষে যে দাঁড়াবে বেশ কিছুক্ষণ তার কেচ্ছা কীর্তন চলল। তারপর ঐ কথাবার্তার মধ্যে একটা ফাঁক পেয়ে পরিমলের সঙ্গী পরিমলকে দেখিয়ে উকিল সাহেবকে বললেন, এই যে, এর কথাই আপনাকে বলেছিলাম। বড় মুশকিলে আছেন আমার এই আত্মীয়।
স্বনামধন্য উকিল সাহেব এবার পরিমলকে নজর করে দেখলেন। তারপর তাকে বললেন, হ্যাঁ বলুন, কি ব্যাপার হয়েছে।
পরিমল নিজের দুঃখের কাহিনী বলা শুরু করলেন। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বুঝলেন যে উকিল তার কথা বিশেষ মন দিয়ে শুনছেন না। উনি সামনে রাখা এই কাগজের দিকে একবার তাকাচ্ছেন, ওই কাগজটা সরিয়ে দিচ্ছেন, ফিতের ফাঁস খুলে একবার দেখে নিচ্ছেন কোন একটা কাগজ, তারপরেই আবার সেটাকে ফিতে দিয়ে বেঁধে ফেলছেন। পরিমল নিজের গল্প বলা থামালেন, সঙ্গে সঙ্গেই উকিল সাহেব নিজের কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতেই পরিমলের দিকে চোখ না তুলে বললেন, বলুন, বলুন, আমি শুনছি।
আবার নিজের কথার খেই ধরলেন পরিমল। কিন্তু এবারে মিনিটখানেক পরে উকিল সাহেব নিজের থেকেই পরিমলকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, দেখুন, এখন এসব ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকবে না। আমি একজনের খোঁজ দিচ্ছি, আপনি ওর কাছে যান। ওর নাম প্রবাল চ্যাটার্জি, আমার জুনিয়র, ভাল ল-ইয়ার। আমি ওর ফোন নম্বর দিয়ে দিচ্ছি, আপনি ওর সঙ্গে যোগাযোগ করে নেবেন। আমিও ওকে ফোন করে বলে দিচ্ছি।
একটা চিরকুটে তার জুনিয়রের নাম আর ফোন নম্বর লিখে সেটা পরিমলের দিকে এগিয়ে দিলেন উকিল সাহেব। পরিমল চিরকুটে লেখা নামটা পড়লেন, তারপর গিন্নীর আত্মীয়ের একটি ছোট খোঁচা খেয়ে বুঝলেন এবার তাদের উঠে পড়বার সময় হয়ে গিয়েছে। চটপট চিরকুটটা ভাঁজ করে নিজের মানিব্যাগে ঢুকিয়ে নিলেন পরিমল। ফোন নম্বরটা দেখা হল না। তা না হোক, ওটা তো পরে দেখতেই হবে। এখন উকিল সাহেবের চেম্বার থেকে পত্রপাঠ প্রস্থান করাটা বেশি জরুরি।
পরিমল ফোনে প্রবাল চ্যাটার্জির সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। সিনিয়র উকিল সাহেব তার কথা রেখেছেন, উনি প্রবালবাবুকে পরিমলের কথা বলে দিয়েছেন। প্রবালবাবুর সঙ্গে পরিমলের দেখা করা ঠিক হল সিনিয়র উকিলেরই একটি বাড়িতে। সেখানে প্রবালবাবুর একটি চেম্বার আছে, উনি সেখানে সপ্তাহে দু-দিন বসেন। বাড়িটা সিনিয়র উকিলের হলেও তিনি সেখানে থাকেন না, সন্ধেবেলা ওখানে এক-দু ঘন্টার জন্যে চেম্বার করেন। থাকেন তার অন্য একটি বাড়িতে। প্রবালবাবুর কাছ থেকেই পরিমল এসব খবর পেলেন। সাধারণত উকিলেরা মক্কেলকে কেসের সঙ্গে সম্বন্ধ নেই সেরকম কোনো তথ্য দেন না। তবে প্রবালবাবু দিয়েছিলেন, হয়তো পরিমলের জন্যে সিনিয়রের কাছ থেকে যে ফোনটা পেয়েছিলেন সেটারই খাতিরে।
সিনিয়র সাহেবের বাড়িটা বিশাল। ঢুকেই প্রকাণ্ড একটা হলঘর। সেটার এক কোণে একটা খুপরি মতো পার্টিশন করে প্রবাল চ্যাটার্জির চেম্বারটা তৈরি করা হয়েছে। হলঘরটার ভেতর দিকে একপাশে একটা বড় ঘর, সেটা সিনিয়র সাহেবের চেম্বার। হলঘরটায় প্রায় দশ বারোজন পুরুষ এবং নারী ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের কথাবার্তা হাসিঠাট্টা চলছে, গমগম করছে জায়গাটা। পরিমলের কানে এদের কথাবার্তার যা টুকরোটাকরা গেল তার থেকে তিনি আন্দাজ করলেন এরা সবাই উকিল এবং সিনিয়র সাহেবের জুনিয়র। আর একটি লোকও ঘুরে বেড়াচ্ছে, ষণ্ডা গুণ্ডা, লম্বা চওড়া চেহারা, নাকের নিচে যথেষ্ট ভারী এবং পুরুষ্টু একজোড়া গোঁফ। ঠিক যেন একজন জমির দালাল। একে সবাই খুব খাতির করছে, পোদিপদা (প্রদীপদা), পোদিপদা বলে ডাকছে। একটি ছোকরাকে জিগ্যেস করে পরিমল জানতে পারলেন সিনিয়র সাহেব এবং প্রবাল চ্যাটার্জি দুজনেই যে যার চেম্বারে আছেন। কিন্তু পরিমল ছেলেটিকে আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ পেলেন না। সে, এই, এই, শোন্ শোন্, বলে কাকে একটা ডাকতে ডাকতে দূরে চলে গেল, তারপর দাঁড়িয়ে পড়ে আর একজনের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
পরিমল সমস্যায় পড়লেন। প্রবাল চ্যাটার্জিকে কি করে খবর দেবেন যে তিনি এসেছেন? ফোন করাটা উচিত হবে না, প্রবালবাবু ভেতরে মক্কেলের সঙ্গে কথা বলছেন, নিশ্চয়ই ব্যস্ত আছেন। কিন্তু ভেতরে স্লিপ পাঠাবার কোনো ব্যবস্থা পরিমলের চোখে পড়ল না। কাকে জিগ্যেস করা যায়? পরিমল ঐ প্রদীপ নামের লম্বা চওড়া লোকটির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন, সে লোকটি পরিমলকে কোনো পাত্তা না দিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে পরিমলের চোখে পড়ল এই সব ছোকরা বয়েসী ছেলেমেয়েদের থেকে অপেক্ষাকৃত বয়স্কা, গালে এবং ঠোঁটে রঙ মাখা একটি নারীর ওপর। ইনি সবেমাত্র তার কোনো দূরবর্তী পরিচিত বা পরিচিতার সঙ্গে ফোনে আলাপচারিতা শেষ করে নিজের মোবাইলটি কান থেকে নামিয়েছেন। এই ভীড়ের ভেতর এই মুহূর্তে একমাত্র ইনিই আর কারোর সঙ্গে কথা বলছেন না বা মোবাইল কানে লাগিয়ে তাতে ব্যস্ত নন। এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটিকে কাজে লাগিয়ে পরিমল তাকেই জিগ্যেস করলেন, আচ্ছা, আমি প্রবাল চ্যাটার্জির সঙ্গে দেখা করব, ভেতরে খবর পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা আছে কি?
সুন্দরী পরিমলের দিকে একটি দৃষ্টিপাত করলেন এবং কৃত্রিম ভদ্রতায় মুখে একটু হাসির ভঙ্গী করে বললেন, আপনি বসুন।
বসবেন তো বটে, কিন্তু প্রবাল চ্যাটার্জির কাছে খবরটা পাঠাবেন কি করে? পরিমল আবারও ঐ প্রশ্নটাই ঘুরিয়ে করলেন, এখানে তো ভেতরে স্লিপ পাঠাবার কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না। সুন্দরী একইভাবে একই উত্তর দিলেন, আপনি বসুন। তারপরেই তিনি তার মোবাইলে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, তাকে আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ পরিমল পেলেন না।
পরিমল বসলেন। সময় কাটতে লাগল জলের মতো, হাতঘড়ির কাঁটা একঘন্টা পেরিয়ে দুঘন্টার দিকে ছুটল। ভদ্রতার গণ্ডী পেরিয়ে পরিমল প্রবাল চ্যাটার্জীকে ফোন করলেন। একবার, দুবার। পরিমলের কপাল খারাপ। দু-বারই যান্ত্রিক উত্তর পাওয়া গেল, এই নম্বরটি বর্তমানে ব্যস্ত আছে।
আটটা বেজে গেল। সিনিয়র সাহেব তার লোকলস্কর, দলিল দস্তাবেজের বোঝা ইত্যাদি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। নিমেষের মধ্যে ঐ প্রকাণ্ড হলঘর খালি হয়ে গেল, জুনিয়রের দল পড়ি মরি করে সিনিয়র সাহেবের বিরাট গাড়ির বিভিন্ন কোণে আশ্রয় নিল। গাড়ি বেরিয়ে গেল, যে কজন জুনিয়র কপালদোষে গাড়িতে জায়গা পেল না তারা মুখ চুন করে যে যার রাস্তায় চলে গেল।
প্রবাল চ্যাটার্জি তখনো তার চেম্বারেই আছেন। পরিমল ঠিক করলেন ঐ চেম্বারের দরজার দিকে নজর রাখবেন, দরজা ঠেলে ভেতর থেকে মক্কেল বেরিয়ে এলেই ঐ দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়বেন। সেজন্যে সেদিকে তাকিয়ে পরিমল শিকারী বেড়ালের মতো ওৎ পেতে রইলেন।
জমির দালালটি পরিমলের সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, আম্নি (আপনি) তাড়াতাড়ি করুন, তাড়াতাড়ি করুন। আমি বাড়ি বন্ধ করে দেব।
পরিমল বুঝলেন লোকটি এ বাড়ির দারোয়ান, ভদ্র ভাষায় যাকে বলে কেয়ার টেকার। মৃদু প্রতিবাদ করে তিনি বললেন, কিন্তু আমার তো প্রবালবাবুর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট রয়েছে, আমার সঙ্গে ওনার এখনও কথা হয়নি।
জমির দালালটি এসব যুক্তির কথা শুনতে রাজী নয়। সে পরিমলকে উঠে পড়ার জন্যে হাতের একটা অসহিষ্ণু ভঙ্গী করে বলল, আম্নি উঠে পড়ুন, আমার অনেক কাজ রয়েছে, আম্নার (আপনার) জন্যে দেরি করলে আমার চলবে না।
পরিমল উঠে পড়লেন। এই বিপজ্জনক চেহারার লোকটির সঙ্গে কোনোরকম বিতর্কে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। প্রবাল চ্যাটার্জি তার সময়মতো বেরোবেন, তার ঢোকার বেরোনোর জন্যে নিশ্চয়ই পেছনের দিকে কোনো আলাদা দরজা আছে।
পরের দিন পরিমল প্রবাল চ্যাটার্জিকে ফোন করলেন। তিনি আগের দিন কেন ওনার সঙ্গে দেখা করতে পারেন নি সে কথা বিশদ করে বললেন। প্রবালবাবু চুপ করে সব কথা শুনলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, আপনি কাল আসুন, আমি ওদের বলে রাখব। আপনি এসে আমাকে শুধু একটা ফোন করে দেবেন।
পরিমল কিন্তু সে জায়গায় যেতে আর রাজী নন। তিনি উকিলকে বললেন, দেখুন, ওটা একটা মাছের বাজারের মতো জায়গা। ওখানে আমি আর যেতে চাই না। আপনার অন্য কোনো চেম্বার থাকলে আমি সেখানে গিয়ে একটু নিরিবিলিতে আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারি।
প্রবাল চ্যাটার্জি বুদ্ধিমান লোক, উনি পরিমলের কথা বুঝলেন। উনি পরিমলকে ওনার নিজের বাড়িতে যেতে বললেন – সপ্তাহে কয়েকটা দিন তিনি সেখানেও চেম্বার করেন।
তারপর পরিমল বেশ কয়েকবার প্রবাল চ্যাটার্জির বাড়িতে তার সঙ্গে দেখা করেছেন। কাজ কিছু এগিয়েছে। উকিল এখন দুটো আইনি কাগজের খসড়া করে পরিমলকে সে দুটো দেখতে দিয়েছেন – দুটোই আদালতে দরকার হবে। পরিমল সে দুটো পড়ে উকিলকে ফেরত দিলে উকিল সে সব কাগজ পাকা করে ফেলবেন।
বিকেলবেলা পরিমল নিজের টেবিলে কাগজদুটো নিয়ে বসেছিলেন। কাগজের লেখার ভাষা ইংরেজি, কিন্তু আইনের ব্যাপার লেখা আছে বলে জটিল, কঠিন এবং সেকারণে দুর্বোধ্য। একটু পরেই পরিমল হাঁপিয়ে উঠলেন, কাগজ দুটো একটা কাগজচাপার নিচে রেখে দিলেন। তিনি তাদের বিল্ডিং কমপ্লেক্সের কম্পাউন্ডে সন্ধে বেলা একটু হাঁটাহহাঁটি করেন। আজ সন্ধেয় হেঁটে এসে উনি কাগজদুটো পড়ে ফেলবেন।
খোলা জানালা দিয়ে বেশ হাওয়া আসছে। পরিমল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। টেবিল ঘুরে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকালেন। নিচের কম্পাউন্ডে একটা মৃদু আওয়াজ শুনে নিচের দিকে তার চোখ পড়ল।
একটা মোটা কেঁদো হুলো বেড়াল সামনের দিকে দুই থাবা পেতে বসে আছে। তার কাছে এদিক ওদিক ঘুরঘুর করছে একটি কৃশাঙ্গী মেনি। মেনিটা মাঝে মাঝেই মাটিতে মুখ ঠেকাচ্ছে, মনে হয় সেখানে পোকাটোকা খুঁজছে।
হঠাৎ হুলোটা খ্যাঁক করে একটা ছোট গোছের গর্জন মেরে লাফিয়ে গিয়ে মেনিটার ঘাড় কামড়ে ধরল। আক্রান্ত স্ত্রী প্রাণীটির তরফ থেকে কোনো প্রতিবাদ পরিমল দেখতে পেলেন না। ঘাড় কামড়ে ধরে থেকেই হুলোটা অতিদ্রুত মেনিটার পিঠে উঠে চেপে বসল, মেনিটা শান্তভাবে পিঠের ওপরের এই উপদ্রব মেনে নিল।
একটা নিঃশ্বাস ফেলে পরিমল জানালা থেকে সরে এলেন। হুলোটা এখন মেনিটার ওপর যা করছে মানুষের সমাজে তার নাম ধর্ষণ। কিন্তু হুলোটার এর জন্য কোনোরকম শাস্তি পেতে হবে না, এই কাজের ফলে সে হয়তো অনেক সন্তানের সঙ্গে পুত্রসন্তানেরও বাবা হবে, সেই ছেলেদের বিয়ে দিতে হবে না, সেজন্যে তাকে কখনো কোনো মহারথী উকিলের বাড়ি গিয়ে কোনো জমির দালালের রক্তচক্ষুর সামনে পড়তে হবে না। বরঞ্চ এই সম্ভাবনা প্রবল যে তার এই বর্তমান কীর্তির ফলে মেনিটি যে সব সন্তানের জন্ম দেবে তাদের সবাই না হলেও অনেকেই তাদের জন্মদাতাটির ভক্ষ্যে পরিণত হবে। আহারের প্রশ্নেও হুলো বা মেনিটির চিন্তার কোনো কারণ নেই। পরিমলের বিল্ডিং-এর বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাটে পশুপ্রেমিক মহিলারা থাকেন। তারা কানা উঁচু বাসনে এই সব ঘুরে বেড়ানো বেড়ালদের জন্যে দুধ ভাতের খাবার দিয়ে থাকেন। কোনো ফ্ল্যাটের কোনো লোক বেওয়ারিশ ভবঘুরে বেড়ালকে এভাবে খাওয়ানো নিয়ে আপত্তি করলে তারা ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যালস-এর ধারাতে পুলিশ থানায় এফ আই আর করবেন, এরকম ভয় দেখিয়ে থাকেন। বলা যায় না, এর পরে হয়তো এইসব পথে ঘাটে ঘুরে বেড়ানো বেড়ালদের সকালের নাস্তার জন্যে এই সব মহিলারা ডিমসেদ্ধ, মাখন লাগানো টোস্ট, দুধ কর্ণফ্লেক্স ইত্যাদিরও ব্যবস্থা করবেন – টিভি চ্যানেল ট্যানেলেও সে খবর দেখানো হবে।
সন্ধের সময় তাদের বিল্ডিং এর কম্পাউন্ডে হাঁটাহাঁটি করছিলেন পরিমল। মাথায় অনেক চিন্তা। সবই তার আসন্ন আইনি যুদ্ধের সম্পর্কে। লড়াই তো বাধবে, কিন্তু কতদিন চলবে? এক বছর, দু বছর, পাঁচ বছর? দশ বছরও টেনে দিতে পারে। ততদিন পরিমল বাঁচবেন তো? বাঁচলেও এই লড়াই-এর ধাক্কা সামলে সুস্থ থাকতে পারবেন তো? কেউ জানে না। বোধ হয় খোদ ভগবানও নয়। তাছাড়া মামলায় হার-জিত আছে। দশ বছর পরে যদি মামলায় হেরে যান তাহলে আবার আপীলে যেতে হবে। তবে হেরে গেলেও পরিমল প্রবাল চ্যাটার্জিকে বদলাবেন না। উকিল হিসেবে এই ভদ্রলোক যথেষ্ট দক্ষ। এরকম আর একজন ল-ইয়ার খুঁজে বার করা সহজ কাজ হবে না –
একটা ছোট্ট হাসির আওয়াজে পরিমলের চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল। এতক্ষণ তিনি নিচের দিকে মুখ নামিয়ে নিজের ভাবনা ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলেন। এবার দাঁড়িয়ে পড়ে মুখ তুলে সামনে তাকালেন।
বাচ্চা একটা মেয়ে। সবে হাঁটতে শিখেছে। ছোট ছোট দু পায়ে দুটো ছোট ছোট জুতো, চোখে কাজল, কপালেও একটা কাজলের টিপ, টলমল করে পা ফেলে হাঁটছে, মাঝে মাঝে দৌড়চ্ছে, হাঁটা আর ছোটার আনন্দে হি হি, হি হি করে হাসছে। বাচ্চাটার একটু পেছনে একটি অল্পবয়েসী আয়া, বাচ্চাটার পেছনে নির্জীবের মতো হেঁটে হেঁটে আসছে। টলমল করতে করতে বাচ্চাটা পরিমলের দিকেই দৌড়ে এল, পরিমলের একেবারে কাছে এসে টাল সামলাতে না পেরে পরিমলের পা দুটো জড়িয়ে ধরল।
একটা অপূর্ব আনন্দে পরিমলের মন ভরে গেল। তিনি নিচু হয়ে শিশুটিকে জড়িয়ে ধরলেন, তারপর তাকে কোলে তুলে নিলেন।
বাচ্চাটা তখনও হাসছে। কিন্তু সে মাটিতে ছুটে বেড়ানো ছেড়ে কারোর কোলে উঠে বসে থাকতে রাজী নয়। সে হাঁচোড় পাচোড় করে পরিমলের কোল থেকে নেমে পড়ল, টলমল করতে করতে অন্য একদিকে ছুট দিল। একইভাবে সে তার সেই আনন্দের হাসি হেসে যাচ্ছে। একমাত্র নিষ্পাপ শিশুই ওই হাসি হাসতে পারে।
যতক্ষণ বাচ্চাটাকে দেখা গেল পরিমল মুগ্ধ চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। শিশুটি পৃথিবীতে তার যাত্রা শুরু করেছে, তার এই যাত্রাপথে কোন রাগ দ্বেষ, হিংসা দ্বন্দ্ব নেই, কোনো দুঃখ কষ্টের কালো ছায়া নেই। সে এখন কারোর সাহায্য ছাড়াই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে উঠতে পেরেছে, নিজের এই নতুন শক্তিকে অনুভব করেছে, ঘরের বাইরে বেরিয়ে পড়ে এই আনন্দের পথে সে তার টলমলে পায়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, প্রতি পদক্ষেপে এই বাইরের দুনিয়ার খানিকটা করে জমি সে তার পায়ের তলায় জয় করছে। এই জয়ে তার বিরাট আনন্দ, সেজন্যে সে আরও বেশিক্ষণ বাইরে ছুটে বেড়াতে চায়, সেই আনন্দের ভেতর ডুবে থাকতে চায়।
পরিমল নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এলেন। এখন তার মনের ওপর আর কোনো চাপ নেই। টেবিলের ওপর উকিলের দেয়া কাগজ দুটো পাতা খোলা অবস্থায় কাগজচাপার নিচে রয়েছে, ওগুলোর ধারগুলো হাওয়া লেগে ফরফর করে ওড়বার চেষ্টা করছে। পরিমল ওদুটোকে মুড়ে বাজে কাগজের বান্ডিলের ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন। তারপর নিজের মোবাইল ফোনটা তুলে নিয়ে উকিলের নম্বরের বোতাম টিপলেন।
প্রবাল চ্যাটার্জি তার কাজে বসে গিয়েছিলেন। তার মোবাইল বাজল। উনি ফোন চালু করে বললেন, হ্যাঁ পরিমলবাবু, বলুন।
এদিক থেকে পরিমল বললেন – বুঝলেন অ্যাডভোকেট সাহেব, আমি ভেবে দেখলাম এই ব্যাপারটা নিয়ে মামলা মোকদ্দমার ভেতর না যাওয়াই ভাল। আপনি মেয়ে পক্ষের ল-ইয়ারের সঙ্গে কথা বলে একটা বোঝাপড়ার ব্যবস্থা করে ফেলুন। - কি বলছেন? অনেক টাকা দণ্ড যাবে? তা অবশ্যি যাবে, কিন্তু জীবনে শান্তির চাইতে তো টাকাটা বড় নয়। আমরা কোনোরকমে ব্যবস্থা করে মেয়েপক্ষকে টাকাটা দিয়ে দেব, ও নিয়ে আর চিন্তা ভাবনার দরকার নেই –।