উপস্থাপন বৈচিত্রে কাহিনী নির্মাণের চেনা ছককে ছিঁড়ে খুঁড়ে বহু ঔপন্যাসিকই কিছু কিছু উপন্যাসে অচেনা পথে হাঁটতে চেয়েছেন। বিশ্ব সাহিত্যে 'ক্লাসিক' অভিধায় তারা ভূষিতও হয়েছে। কিন্তু সাধারণ ভাবে উপন্যাসে পাঠকের কাঙ্ক্ষিত, শেষ পর্যন্ত একটি নিটোল কাহিনী সৌধ । অবশ্যই সেই সৌধ স্থাপত্যের নানা সরল জ্যামিতিক সৌন্দর্যে উজ্জ্বল। নানা চরিত্রের রঙমিলন্তি খেলায়, শাখা ও উপকাহিনীর জটিল বর্ণময়তায় তা বিষ্ময়াহত পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেয় হিমালয়ের মত অনন্ত জীবন রহস্যের সামনে। 'ভাষ' উপন্যাসে অবশ্য লেখক পাঠককে শাখা ও উপকাহিনীর জটিল কাহিনী জালে আবিষ্ট করতে চাননি। এ উপন্যাসের আদ্যন্ত, ভাষ ও তার প্রায় সরলরৈখিক জীবনই কাহিনীর এক এবং একমাত্র অবলম্বন। আত্ম-জৈবনিক উপন্যাসের মত এই উপন্যাসের সরল নির্মাণ ও কাহিনী বৃত্ত পাঠককে এক ধরণের নির্ভার সহজিয়া ভালো লাগা উপহার দেয়। খুব স্বাভাবিক ভাবেই কাহিনীর চলনে দ্রুত গতির অ্যাডভেঞ্চার নেই। না থাকাটাই বাস্তব, জীবনানুগ। আসলে লেখকের লক্ষ্য তো ভাষ নামের একজন সাধারণ অ-বিশেষের জীবন কথা।
উপন্যাসের শুরু ভাষের আধো আধো কথার শৈশবে। তার জন্ম দক্ষিণ শহরতলির এক নিম্নমধ্যবিত্ত একান্নবর্তী পরিবারে। নিজস্ব নয়, বাগান ঘেরা ভাড়াটে বাড়িতে। ব্যক্তি বড় হয় আর তার চারপাশে ঘিরে থাকা সামাজিক, পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত জীবনের বৃত্তান্তর ঘটে। ভাষের জীবনও সেই নিয়মেই ক্রমশ পৌঁছে গেছে ছোট বৃত্ত থেকে বড় বৃত্তে। শৈশব থেকে কৈশোর, প্রাইমারি থেকে হাইস্কুল, কলেজ - বিশ্ববিদ্যালয়। প্রেম, স্কুলের চাকরি সেখান থেকে অধ্যাপনা ও গবেষণার বৃহত্তর জীবন। জন্ম হয় কবি ভাষের। মাঝে তারা সপরিবারে একান্নবর্তী সম্পর্ক ছিন্ন করে দক্ষিণ কলকাতা থেকে বাসা বদল করে চলে এসেছে উত্তর শহরতলীতে বাবার তৈরি নিজস্ব বাড়িতে। একসময় বিয়েও করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠিনী নিজের প্রথম প্রেম স্রোতস্বতীকে । এরপরই কাহিনী পৌঁছে যায় ভিন্ন এক নির্জন পথে। সে পথে একলা পথিক ভাষ। বিয়ের পরেই শাশুড়ি-পুত্রবধুর ইগোর টানাপোড়েনের উপসংহার টানার জন্য ভাষ বৌকে নিয়ে আলাদা সংসার বসাতে বাধ্য হয়। বাবা, মা, ভাই থেকে বিচ্ছিন্ন নতুন সংসারে আসার পর ভালোবেসে বিয়ে করা স্ত্রী ও আদরের পুত্র ঋকের থেকেও সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে । ক্রমশ দায়িত্ব-কর্তব্যের বাইরে তাদের দাম্পত্যে সে প্রেম খুঁজে পায় না। প্রেমতৃষ্ণ ভাষ অন্য সম্পর্কে ভালোবাসার আশ্রয় খুঁজে চলে। জড়িয়ে পড়ে একাধিক সম্পর্কে। অসমবয়সী ছাত্রীরা তার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। কলঙ্ক রটে। ভাষের কাছে সমস্ত অপবাদ অর্থহীন। ভালোবাসার কাঙালপনায় সে বেপরোয়া। সে নিজেও নিজের এই অভিসারী মনস্তত্ত্বের কারণ কখনও কখনও খুঁজে পায় না। স্রোতস্বতীর থেকে দূরে অসমবয়সী পরকীয়া তার মনে কবিতার বন্ধ দরজা খুলে দেয়। ভাষ ব্যক্তিজীবনের সঙ্কটকে কবিতায় রূপান্তরিত করে। কাহিনী চলমান সময়ের রাজপথ থেকে ধীরে ধীরে নিখোঁজ হয়ে যায় তার মনোজগতের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে।
ছোটবেলায় সাপের স্বপ্ন ( পৃ ৬১) ভাষকে তাড়া করে বেড়াত। তখন সে সেই স্বপ্নের অর্থ বুঝতে পারত না। প্রায় সমবয়সী পিসতুতো বোন কুসুম কৈশোরে তাকে যে অসম্পূর্ণ শরীরীপাঠ দিয়েছিল তার অতৃপ্তিই বোধহয় স্বপ্নে সাপ হয়ে কিশোর ভাষকে ছুঁয়ে যেত। আজ প্রাপ্ত বয়সের স্বাধীনতায় তাই-ই ভাষকে নৈতিক সম্পর্কের শিকড় থেকে ছিন্ন করে ভাসিয়ে নিয়ে গেল একাধিক বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কূহক জগতে। যেখানে আধুনিক সমাজের পরিশীলিত বাহ্যরূপের আড়ালে ধূসর অবচেতনের বৃশ্চিক দংশন। দায়িত্ববোধের পলকা বাঁধনে জড়ানো প্রেমহীন দীর্ণ দাম্পত্য আর অন্যদিকে অসমবয়সী পরকিয়ার তীব্র আকর্ষণে বিপর্যস্ত পঞ্চাশোর্দ্ধ ভাষ তার জটিল জীবনকে বয়ে নিয়ে হাঁটতে থাকে আগামীর রাজপথে।
নায়ক বা নায়িকা ছাড়াও নানা চরিত্রের বর্ণিল তোড়ায় সাজানো হয় উপন্যাসের অন্তঃপুর। "ভাষ"-এও তার অন্যথা হয়নি। কিন্তু তিনটি চরিত্র - ভাষের মা দীপ্তি, স্ত্রী স্রোতস্বতী ও তার পরকীয়া জীবনের শেষ সম্পর্ক তিথি ছাড়া আর কোন চরিত্রই মূল কাহিনীতে স্থায়ী প্রভাব রাখেনি। প্রয়োজনও পড়েনি। অনেকটা নদীর মত লক্ষ্যহীন অনির্দিষ্ট পথে বয়ে গেছে ভাষের জীবন। আর সময়ান্তরে সাক্ষী থেকেছে নানা দৃশ্যের, নানা চরিত্রের। উদাসীন নদীর মতই ভাষ শুধুই দ্রষ্টা।
"ভাষদের পরিবারে বিভিন্ন মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছে নানা সময়ে। তাদের কাউকে ওর ভালো লেগেছে, কাউকে লেগেছে অদ্ভুত। তবে সকলেই ওর বোকাভাঁড়ে জমা পড়েছে নানা দামের টাকাপয়সার মতো।" (পৃ-২৮)। মন্তব্যটি যার প্রসঙ্গে সে নহুষ, ভাষের নহুষদা। মাত্র এক পাতায় যার উপস্থিতি সীমাবদ্ধ। এই অতি সীমিত অস্তিত্বেই আত্মভোলা, বারবার বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া নহুষ পাঠকের স্মৃতিতে চিরস্থায়ী হয়ে থেকে যাবে। এরকম বহু ছোটো ছোটো চরিত্র ভাষের জীবনে এসেছে। যাদের অস্তিত্ব কাহিনীতে অতি গৌণ কিন্তু তাদের তাৎক্ষণিক উপস্থিতি উপন্যাসে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। কয়েকটি চরিত্র দেবদূতের মত ছোট-বড় নানা বিপদের মুহূর্তে আকস্মিকভাবে হাজির হয়ে ভাষকে বাঁচিয়েছে। ভাষের কথায় এরা তার 'বডিগার্ড'। ভাষের জীবনে কোন তাৎক্ষণিক মুহূর্তে 'বডিগার্ড' হয়ে ওঠা মাস্তান বিভু, কুট্টিদার মত চরিত্রগুলো উপন্যাসে তৈরি করেছে সার্থক অনুগল্পের আবহ। পাঠকও এই চরিত্রগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ঘটনার আবহে নিজেদের জীবন অভিজ্ঞতার স্মৃতি রোমন্থনের সুখ অনুভব করতে পারেন। কেননা জীবন পথের নানা হোঁচট খাওয়া মুহূর্তে ত্রাতার মত হয়তো বা তাঁরাও কোন বিভু বা কুট্টিদার সাক্ষাৎ পেয়েছেন।
শুধু এই ধরণের ছোট ছোট চরিত্রের মধ্যে দিয়েই নয়, আরেকরকম ভাবেও লেখক পার্থপ্রিয় বসু কাহিনীর স্বতঃস্ফূর্ত গতিকে ব্যাহত না করে কিছু সামাজিক অনুষঙ্গে একটি নির্দিষ্ট বয়সের পাঠককে বাধ্য করেছেন স্মৃতি মেদুরতায় আবিষ্ট হতে। অন্যদিকে এই বয়সসীমার বাইরে থাকা সাধারণ পাঠকের মনে এই অনুষঙ্গগুলো অবশ্যই ক্যালাইডোস্কোপিক অতীত চিত্র দর্শনের আনন্দ বয়ে আনবে। লেখক তাঁর কাহিনীতে ভাষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছেন সমসময়ের বৃহত্তর সমাজজীবনের নানা ঘটনাবলী।
ভাষের থেকে বছর পাঁচেকের ছোট, ভাই টিপুর জন্ম '১৯৫৬ সালের বসন্তে' (পৃ ১৭)। অর্থাৎ ভাষ ১৯৫০ বা ৫১র জাতক। ভাষ ক্রমশ বড় হয়েছে আর তার জীবন পথের দু'পাশে ঘটে চলা সমাজ জীবনের নানা বিষয়ের অনুষঙ্গের সুগ্রন্থিত মালায় লেখক সাজিয়ে তুলেছেন কাহিনীকে। একান্নবর্তী পরিবারের সুখ-দুঃখ, মণিমেলা, ঘুড়ি ওড়ানো ও তাকে কেন্দ্র করে গলির বিবাদ, হারিয়ে যাওয়া সিঙ্গেল স্ক্রিনে লুকিয়ে সিনেমা দেখার অনুভূতি, পাড়ার মঞ্চে স্বর্ণ যুগের শিল্পীদের আধুনিক গান শোনা, রাতভর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান, এমনকী গুলি খেলা, মৌরি লজেন্স --পঞ্চাশ, ষাট বা সত্তর দশকের সামাজিক চালচিত্র এভাবেই ফুটে উঠেছে 'ভাষ'-এর পাতায় পাতায়। ষাটের শেষ ও সত্তর দশকের শুরুতে নকশাল দমনে কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় সরকারি সন্ত্রাসের ভয়াবহ ছবিও আছে এ- উপন্যাসে। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে ভাষের জীবনে। নকশাল সন্দেহে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন ভাষকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ শুধুমাত্র এই কারণে যে সে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। একরাত লক আপে কাটিয়ে মুক্তি হয় তার। তাই 'ভাষ' উপন্যাস হিসেবে শুধু জীবনের গল্প নয়, সময়ের বিচিত্রদৃক।
পার্থপ্রিয় বসু বর্তমান সময়ের একজন পরিচিত কবি। 'ভাষ' তাঁর লেখা দ্বিতীয় উপন্যাস। বইয়ে প্রথামত লেখক পরিচিতি থাকলে কবি পার্থপ্রিয় বসুর গদ্য চর্চার একটা বিস্তৃত রূপরেখা পাওয়া যেত। কিন্তু তা রাখা হয়নি । তবে উপন্যাস পড়তে পড়তে কখনও মনে হয় না যে এটি লেখকের দ্বিতীয় সৃষ্টি। কাহিনী বয়ন বা ভাষা চয়নের পরতে পরতে স্পষ্ট লেখকের গদ্য ও কাহিনী নির্ভর সাহিত্য চর্চার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ছাপ।
কবির গদ্যে একধরনের নির্জন মায়াময় স্পর্শকাতরতা থাকে। থাকে শব্দের কারুশিল্প। 'ভাষ'-এর পাঠক অনায়াসে চিনে নিতে পারবেন অলক্ষ্যে কলম নিয়ে বসে থাকা কবিকে। তবে স্রষ্টা কবি পার্থপ্রিয় বসু নয়, তাঁর সৃষ্ট কবি ভাষ সম্পর্কে একটা অতৃপ্তির অনুযোগ পাঠান্তে মনের মধ্যে তৈরি হয়। কবি শুধু কবিতা লেখেন না, তিনি অহর্নিশ কবিতা-যাপন করেন। তাঁর দৈনন্দিন জীবনেও সেই যাপনের স্পষ্ট প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ভাষের চরিত্রে কবির সেই জীবন-যাপনের কোন লক্ষণ চোখে পড়ে না। তবে এই অতৃপ্তিটুকু অগ্রাহ্য করলে 'ভাষ' অবশ্যই একটি ভিন্ন স্বাদের পাঠ অভিজ্ঞতা, যাতে মূর্ত হয়ে রয়েছে অনন্ত রহস্যময় জীবনের অনন্য পাণ্ডুলিপি।