কমলিনীদেবী কোনোকালে ডায়েরি লেখেননি। কোন ছোটবেলায় তাঁর মা তাঁকে বুঝিয়েছিলেন যে ডায়েরি লেখে বিশেষ জ্ঞানী বা খুব বোকারা। বয়স কম হ’লেও কমলিনীদেবী বুঝতেন যে তিনি কোনো মতেই এই দুই শ্রেণীর মধ্যে পড়েন না। অতএব, ঐ ব্যাপারে উৎসাহী হবার ঠিক কোনো কারণ তাঁর ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজ তিনি ডায়েরি লিখতে বসেছেন। কমলিনীদেবীর মা পইপই করে এও বলেছিলেন, ‘আমি যখন থাকবো না, তখনো আমার শিক্ষা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে’ আর এই পঁয়ষট্টি বছর বয়স অবধি তিনি সত্যিই সেইভাবে চলে এসেছেন কিন্তু বলা যায় পরিস্থিতির চাপে এই একটি ব্যাপারে কমলিনীদেবী আজ মায়ের অবাধ্য হতে চলেছেন।
মাস আষ্টেক আগে তাঁর দেওরপো নয়ন চাকরি পাবার পর দেখা করতে এসে কমলিনীদেবীকে একটি বাহারি ডায়েরি ও দামী পেন উপহার দিয়ে বলেছিল, ‘তোমার যখন যা মনে হবে এতে লিখো, জেম্মা।’ নিজের উপহারের মোড়ক খুলতে খুলতে মৃদু হেসে বিনম্রবাবু বলেছিলেন, ‘দেখো, কবিতা-টবিতাও লিখে ফেলতে পারো!’ স্বামীর এই ধরনের রসিকতা কমলিনীদেবীর গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে বলে উনি আর দেওরপোর সামনে কথা বাড়াননি কিন্তু নয়নের বলা কথাটা ওঁর বেশ পছন্দ হয়েছিল। তারপর এল দ্বিতীয় কারণটি যার নাম ‘লকডাউন’। জীবনের স্বাভাবিক ছন্দকে দমকা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে জায়গা করে নিল নতুন এক পরিস্থিতি যাকে বলা হচ্ছে ‘নিউ নরম্যাল’; সেই ‘নব্য স্বাভাবিকতা’ কমলিনীদেবীর জীবনে যে পরিবর্তন আনলো তার খুঁটিনাটি তো সবাইকে বলা যায় না। কয়েক বার ভেবেছেন ছোটবেলার বন্ধু মানসীকে বা বন্ধুসমা পুত্রবধূ রঞ্জাকে বলবেন কিন্তু সংকোচের কারণে তা হয়ে ওঠেনি। অবশেষে আজ নয়নের উপহার দু’টি আলমারি থেকে বের করে নিয়ে কমলিনীদেবী লিখতেই শুরু করলেন। যথাবিধি প্রথম পাতায় নিজের নাম ইত্যাদি লেখবার পর তিনি ঝরঝরিয়ে লিখতে থাকেন তাঁর মনের কথা।
“এই চল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবনে আমাকে কোনোমতেই ‘অসুখী’ বলা যাবে না। ঠিক কোনো ক্ষোভ না হ’লেও আমার জীবনে এক অপূর্ণ বাসনা ছিল। আমার স্বামী উচ্চপদে চাকরী করেছেন, ছেলে শুভ ও আমার সমস্ত প্রয়োজনের দিকে নজর রেখেছেন বা রাখেন ও সেইসঙ্গে নিজের নানারকম শখের চর্চাও করেন। সমস্যা আমার সেইখানেই। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে অধিকাংশ দম্পতি সব্জি-বাজার থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একসঙ্গে যায়, রান্নাঘরেও তাদের কিছু কিছু সম্মিলিত অবদান থাকে। আমরা ঠিক তেমন নই। বিনম্রর শখগুলো আমার সঙ্গে মেলে না। অল্পবয়সে ওঁর কলেজের ও অফিসের কয়েকজন বন্ধু মিলে এক দল করে নানা পাহাড়ি জায়গায় ওঁরা ট্রেকিং-এ যেতো। তারপর বিনম্রর শুরু হ’ল এক ফটোগ্রাফি দলের সঙ্গে জলে-জঙ্গলে যাওয়া। আমি ও শুভ একবার অমন এক ‘ট্রিপ’-এ বিনম্রর সঙ্গী হয়েছিলাম কিন্তু সেখানে সর্বক্ষণ ‘শাটার স্পীড’, ‘অ্যাপারচার’ আর ‘ISO’-র এমন আলোচনা চলছিল যে নিজেকে আমার বড় বেমানান লাগছিলো। সন্ধ্যে বেলায় যে বসে একটু গল্প হবে তারও জো নেই কারণ তখন সকলে সারাদিনের তোলা ছবি নিয়ে নিন্দা-প্রশংসা-আলোচনায় মুখর, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাবার তাদের ফুরসত কই!
“শুভর ছোটবেলায় ওর ও আমার স্কুল ছুটি হলে দিল্লিতে মা-এর কাছে কিছুদিন কাটানোর রেওয়াজ ছিল বলে স্বামীর সঙ্গে বিশেষ কোথাও বেড়াতে যাওয়া হতো না। এছাড়া ছিল শাশুড়ি-মায়ের দায়িত্ব। উনি যখন চলে গেলেন শুভ ততদিনে বড় হওয়ায় ওর পড়াশুনোর চাপ বাড়ল বলে আমারও পায়ে বেড়ি পড়ল। ছুটিছাটা মানেই শ্রীমানের থাকতো ‘এক্সট্রা ক্লাস’। বিনম্র কিন্তু দুই বন্ধুকে সঙ্গী করে বেরিয়ে পড়তো – কোনো সপ্তাহান্তে সুন্দরবন, কখনো বা দীঘা। সিনেমা-থিয়েটারের ঝোঁক মানুষটার কোনোদিন ছিল না তবে আমি যে মানসী বা সহকর্মীদের সঙ্গে আমার পছন্দের সিনেমা-নাচ-গান-নাটকে যাই, তা নিয়ে ও কখনো কোনো অসন্তোষ প্রকাশ করে না। ছেলের চাকরি-বিয়ে হতে হতে আমাদেরও অবসর জীবন শুরু হয়ে গিয়েছে। শুভ-রঞ্জা থাকে পুণেতে; তাই, গত দু’বছর ধরে আমাদের শুধু দু’জনের সংসার।
“অবসর-জীবনে বিনম্র তাঁর বাইরে বেড়াতে যাবার নেশাকে বদলে ফেলেছে অন্য নানা নেশায়; ভোর বেলা উঠে সোজা ক্লাবে গিয়ে টেনিস খেলা ও সেখান থেকেই প্রাতরাশ সেরে আসা। দুপুরের খাবারের পর খানিকক্ষণ টিভি ও খবরের কাগজ আর তারপর এক কাপ চা খেয়ে প্রতিবেশী বন্ধু মোহিতদার বাড়িতে কয়েকজন মিলে ব্রিজ খেলা। বিনম্র চিরকাল স্বল্পবাক, ফলে সে বাড়িতে থাকলেও অকারণে বাক্যব্যয় করা তার স্বভাববিরুদ্ধ। চাকরি-জীবনে যেমন, অবসর নেওয়ার পরও আমি বিনম্রকে বলেছি যে পরস্পরের সঙ্গে রোজ কিছুটা সময় কাটালে আমার ভাল লাগবে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। কোনো ভাল বই পড়ে ওর সঙ্গে যে আলোচনা করবো, তাও পারি না কারণ বই-এর ব্যাপারেও আমাদের রুচির পার্থক্য আছে। অন্যদিকে, বিনম্র বেড়াতে গেলে আমার জন্য সেই জায়গার কোনো হস্তশিল্প বা ফুলগাছের চারা নিয়ে আসে ও তাতে আমি খুশি হই। আবার, আমি যখন ওর জন্য কোনো ‘puzzle’ সংগ্রহ করে আনি বা ওর পছন্দের নানা ধরনের রান্নার পদ পরিবেশন করি, তখন দেখতে পাই বিনম্রর তৃপ্ত মুখ। এক কথায়, আমাদের কোনো বিবাদ-বিসম্বাদ নেই কিন্তু নিজের নিজের কক্ষপথে ঘুরে বৃহত্তর এক সংসার-বৃত্তে আমরা দিনযাপন করে চলেছি। আর সেখানেই আমার অপূর্ণতা-বোধ।
“করোনার ভয়ে আর সকলের মতো আমরাও মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সম্পূর্ণ ভাবে গৃহবন্দী হয়ে রয়েছি। বিনম্র অবশ্য মাঝে মাঝে বাজার বা ব্যাঙ্কে যাবার চেষ্টা করেনি যে তা নয় কিন্তু শুভ-রঞ্জার কড়া শাসনে আজকাল আর সেই ছেলেমানুষিটা করে না। লকডাউনের শুরু থেকে আমরা দু’জন তাই একসঙ্গে বারান্দায় বসে সকাল-বিকেল চা খাচ্ছি আর তখন কথাবার্তাও হচ্ছে নানা বিষয়ে। আমাদের সাহায্যকারিণীটিকে আসতে দিতে পারছি না বলে বাড়ির সব কাজ নিজেদেরই করতে হচ্ছে। ইদানিং দেখছি বিনম্র নিজের থেকে ঘর ঝাঁট দিচ্ছে বা খানিকটা বাসন ধুচ্ছে। অন্যদিকে, শুভ-রঞ্জার উৎসাহে শুরু হয়েছে আমাদের ‘নেটফ্লিক্স’ ও ‘অ্যামাজন প্রাইম’-এ নানারকম ফিল্ম বা ‘ডিস্কভারি চ্যানেল’-এর অনুষ্ঠান দেখা। ফিল্মের ব্যাপারে চেষ্টা করি যাতে দু’জনের পছন্দের মধ্যে একটা রফা হয়। এছাড়া, শুভ-রঞ্জাও তো আজকাল বাড়ি থেকে ‘কাজ’ করে। তাই প্রায় রোজই ভিডিও কল-এ কিছুক্ষণ ক’রে ওদের সঙ্গে কথাবার্তা হ’চ্ছে। আর আমাদের আছে বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে গল্প করা – কখনো কোনো একজনের সঙ্গে, কখনো বা দেশ ও বিদেশের বন্ধুরা ‘অনলাইনে’ একসঙ্গে হয়ে রীতিমতো আড্ডা।
“একটা প্রায়-গোপন কথা লিখি। ছোটবেলায় আমার সামান্য পরিচয় ছিল দাবা খেলার সঙ্গে কিন্তু কিছুই প্রায় মনে ছিল না। রঞ্জা বার বার বলায় আমি অনলাইনে দাবা খেলা শিখতে শুরু করেছি। গত আড়াই মাসের চর্চায় মনে হচ্ছে বেশ কিছুটা এগিয়েছি। বিনম্রকে বলিনি তবে আশা করছি আরো একটু অভ্যাস করলে ওকে অবাক করে দিয়ে একদিন ওর সঙ্গে খেলতে বসতে পারবো।
“এবার আসল কথায় আসি। রোগভোগ ভাল জিনিস নয় আর তার ওপর এই করোনার মতো মারাত্মক অসুখ যা সারা পৃথিবীকে এমন নাস্তানাবুদ করছে ও এত মানুষের প্রাণ নিয়েছে, সে বিদেয় হলে আমরা সবাই বাঁচি। কিন্তু আমার মনে কেবল এই কথাটা বুদবুদের মতো ভেসে উঠছে যে এই অসুখের কারণেই আমি বিনম্রর সঙ্গ পাচ্ছি। জগৎ-সংসার যখন নতুন শব্দ-বন্ধ ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং’-এ অভ্যস্ত হতে চেষ্টা করছে, আমাদের দু’জনের মধ্যে যেন দূরত্ব কমেছে! বিনম্র তো বারমুখো মানুষ তাই ওর এই ‘নব্য স্বাভাবিকতা’ কেমন লাগছে জানি না। ওর জন্য আমার একটু যে খারাপ লাগে না তা নয়। অসুখের আতঙ্ক ও বাইরে বেরোতে না পারার অস্বস্তি আছে বটে কিন্তু একরকম ভাবে এই নতুন রুটিন আমার মন্দ লাগছে না। আমার এমন সৃষ্টিছাড়া চিন্তাভাবনা কি কাউকে বলা যায়! লোকে শুনলে বলবে ‘বুড়ো বয়সের আদিখ্যেতা’! এত স্বার্থপরের মতো চিন্তা মাথায় এসেছে ভেবেও আমার লজ্জা লাগছে কিন্তু নিজের কাছে সেই ভাল লাগাটাকে তো লুকোতেও পারছি না। অগত্যা, ডায়েরির কাছেই নিজের এই দুর্বলতাটি জানিয়ে একটু হালকা হবার চেষ্টা করলাম।”
ডায়েরি ও কলম গুছিয়ে রাখতে রাখতে মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে কমলিনীদেবী ঠিক করলেন এবার থেকে তিনি নিয়মিত ডায়েরিতে তাঁর মনের কথা লিখবেন।