সেই অতি পরিচিত চেহারা – টানটান পিঠ, মাথা ভরা টাক, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা...
বাবা!
এই ভর দুপুরবেলা বাবা স্পেন্সারে কি করছে?
হাতে একটা বাস্কেট নিয়ে বাবা এদিক-ওদিক ঘুরছে। এখনো অনন্যাকে দেখতে পায় নি। অনন্যা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে একটা আইলের পেছনে লুকিয়ে পড়ল। তারপর শেল্ফের আড়াল থেকে দেখতে লাগল।
বাবা মশলার তাকের সামনে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর কিছু একটা বাস্কেটে ভরে চেক আউটের দিকে এগিয়ে গেল। বাস্কেটে আর কি আছে অনন্যা উঁকিঝুঁকি মেরেও বুঝতে পারল না।
বাবা কি একাই এসেছে? মা আসেনি কেন? ব্যস্ত আছে? না শরীর খারাপ?
অবশ্য চিন্তার কিছু হলে দেবু জানাত। অনন্যা বাবার সঙ্গে বেশ খানিকটা তফাত রেখে এগিয়ে গেল। চেক আউটে এই মুহূর্তে ভিড় নেই। অল্প সময়ের মধ্যেই দাম মিটিয়ে দিয়ে বাবা ধীর পায়ে স্পেন্সার থেকে বেরিয়ে গেল।
অনন্যার সারা গা থরথর করে কাঁপছে। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। স্পেন্সারে কি করতে এসেছে সেটাও মুহূর্তের জন্য বেমালুম ভুলে গেছে। পাশে দাঁড় করানো ট্রলিটার দিকে হঠাৎ চোখ পড়ে গেল। বেশ কয়েকটা বিয়ারের বোতল আর চিপসের প্যাকেট সেখানে ঝকমক করছে।
ওঃ, তাইতো। আজ তো রবিবার। বাড়িতে পার্টি আছে...
মল থেকে বেরিয়ে উবারে উঠে অনন্যার মনে হল সোজা বাড়ি চলে যায়। শরীর আর মন দুটোই অবসন্ন লাগছে। কিন্তু সে উপায় নেই। দীনেশের বাড়ি থেকে র' মেটিরিয়াল তুলতে হবে। বঙ্কু তাল ধরেছে, মেটিরিয়াল কাল সকালের মধ্যে তার হাতে দিলে তবেই সে সময়মতো গয়না তৈরি করে দিতে পারবে।
অনলাইন বিজনেসের ঝক্কি কম নয়। আর কম্পিটিশনও খুব বেশি। প্রায়ই পুরনো স্টক বিক্রি না হয়ে পড়ে থাকে। আর সত্যি বলতে বঙ্কুর হাতের কাজও তেমন ভালো না। কিন্তু কি আর করা যাবে? বঙ্কুর টাকা জোগাড় করতেই অনন্যা হিমসিম খায়। আরো ভালো কারিগর আ্যাফোর্ড করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু এভাবে স্টক পড়ে থাকলেই বা অনন্যা আর কতদিন চালাতে পারবে? হাতের পুঁজি শেষ হয়ে আসছে। হয়তো আর এক দু'বারের বেশি মেটিরিয়াল কেনারও সামর্থ্য থাকবে না। তখন কি হবে?
অনন্যা দু'হাত দিয়ে মাথার রগ টিপে ধরল। এদিকে বিল আসার তো কোন শেষ নেই। এ মাসের ইলেকট্রিসিটি বিলই এসেছে তিন হাজারের ওপর। তার ওপর ব্রডব্যান্ড বিল, খাওয়ার খরচ, বাড়ি ভাড়া...
সময় মতো বাড়ি ভাড়া না দিতে পারলে সাংঘাতিক কেস হবে। তিন বছর আগে সুজয়ের নামে বাড়িটা ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। এখনকার অবস্থায় আরেকটা বাড়ি পাওয়ার প্রশ্নই নেই। একা একটা মেয়ে, তার ওপর কোন বাঁধা চাকরি নেই – কে রাখবে এরকম ভাড়াটে?
চাকরি পাওয়া সোজা কথাও নয়। এমএ পাশ করার পর প্রায় তিন বছরের গ্যাপ পড়ে গেছে। যত জায়গায় অ্যাপ্লাই করেছে, এই কথা বলেই নাকোচ করে দিয়েছে।
অনন্যা যে কোন চাকরি পায়নি সেটা আবশ্য পুরোপুরি সত্যি নয়। বাবলিদি মাঝে একটা এনজিও-তে কাজ জোগাড় করে দিয়েছিল। প্রথম একমাস বিনা মাইনের ইন্টারনশিপ, পরে কাজ পছন্দ হলে মাইনে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রোজ দুপুরে ডেস্কে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ায় পনেরো দিনের মাথাতেই ওরা তাড়িয়ে দিয়েছিল।
যদি সিনেমা হত, ঠিক এই সময়টাতেই অনন্যার জীবনে নায়কের আবির্ভাব ঘটত। জাদুর ছড়ি ঘুরিয়ে সে এক নিমেষের মধ্যে নায়িকার জীবনের সব সমস্যার সমাধান করে দিত। কিন্তু জীবনটা তো সিনেমা নয়। এখানে কেউ ট্রেন থেকে ঈষৎ ঝুঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় না।
অনন্যার বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল। নিজের এলোমেলো জীবনটা সে কিভাবে গোছাবে বুঝে উঠতে পারে না। ট্র্যাফিকের আলো হঠাৎ করে লাল হয়ে গেছে। গাড়িটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। বিয়ারের বোতলগুলো টুংটাং করে প্রতিবাদ করে উঠল।
অনন্যা দেখে ড্রাইভারটা আয়না দিয়ে বোতলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। নিশ্চয়ই অনন্যাকে কটাক্ষ করছে।
ইঃ! হাতে এক পয়সা নেই – খেতে পায় না, বিল দিতে পারে না, অথচ মদ গেলার শখ আছে!
অনন্যা মুখ ঘুরিয়ে নিল। ড্রাইভার কি করে বুঝবে রোজ বাড়ি ফিরে অনন্যার কেমন লাগে? প্রায় ছ'মাস হল সুজয় চলে গেছে। দাম্পত্যের চিহ্ন ছড়ানো সংসারে এখন অনন্যা একা একা ভূতের মতো ঘুরে বেড়ায়। সন্ধের ছায়া নামলেই দুশ্চিন্তারা চার দিক থেকে গিলে খেতে আসে।
ওই জন্যেই তো চাকরি করতে গিয়ে ও ঘুমিয়ে পড়ত। সারা রাত একা বাড়িতে জেগে কাটানোর পর মানুষের গলার আওয়াজ, সান্নিধ্য যে কি আরামদায়ক – চোখ দুটো আপনিই বুজে আসত।
মাঝে মাঝে নিজের অসহায়তার ওপর ওর নিজেরই রাগ হয়। তখন মনকে বোঝায়, যার চলে যাওয়ার সে চলে যাবেই। তাকে বেঁধে রাখার সাধ্য কারুর নেই। অদৃষ্টের সামনে মানুষের জোর কতটুকু?
এইভাবে নিজেই অবসাদে ভোগে, নিজেই সামলায়। আর কেউ তো নেই যার সঙ্গে দুটো মনের কথা বলতে পারে।
ব্যতিক্রম শুধু এই রবিবারের সন্ধেগুলো।
প্রত্যেক রবিবার কারুর না কারুর বাড়িতে পার্টি হয় – এক দেবুর ছাড়া। দেবু মানে দেবরূপা, অনন্যার পাড়ার বন্ধু। ওর বাপের বাড়ির ঠিক দুটো বাড়ি পরেই থাকে। বাপের বাড়ি... নামটা ছোটবেলায় শুনতে কেমন হাস্যকর লাগত। বাপ আবার কি, ওটা তো অনন্যার নিজেরই বাড়ি।
তারপর ভুলটা একদিন ভাঙল, আর বেশ রূঢ়ভাবেই ভাঙল। সেই থেকে অনন্যা আর ও পাড়ায় যায় না। বরং দেবু অনন্যার বাড়িতে আসে। সুমন, ঈশান আর মারুফও আসে। সবাই স্কুলের বন্ধু, পরস্পরকে কুড়ি বছর ধরে চেনে। সুজয় চলে যাওয়ার পরের দিনগুলোয় ওরাই অনন্যাকে সামলেছিল।
আর সেই সময় থেকেই চিরকালের অন্তর্মুখ অনন্যা রবিবারগুলোর দিকে তাকিয়ে বাঁচতে শুরু করেছিল...
চেনা সবুজ রঙের পাঁচিলটা চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। গাড়ি দীনেশের বাড়ির সামনে এসে গেছে। ড্রাইভার ফোন দেখে হাঁকল, “আড়াইশ টাকা।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনন্যা টাকা গুনতে লাগল...
দীনেশের সঙ্গে কাজ মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তিনটে বেজে গেল। আসবাবের ধুলো ঝেড়ে ঘর গুছিয়ে সবে অনন্যা ভাবছে একটু শোবে এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল।
নির্ঘাত দেবু এসেছে। ও পারলে চারটের সময়েই পার্টি করতে চলে আসে।
দরজা খুলে দেখে – না, দেবু নয়। অনন্যার ফ্ল্যাটের সিকিউরিটি গার্ড... নামটা যেন কি? ও হ্যাঁ, নিতাই। বিগলিত হাসি হেসে দাঁড়িয়ে আছে।
“বিলাস বলছিল আপনি সোফা বিক্রি করবেন?”
অনন্যার মনটা নেচে উঠল।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, কোন খদ্দের পেয়েছ?”
সোফাটা অনন্যার কোন কাজে লাগছে না। বিক্রি করে ভালো দাম পেলে ক'দিনের খরচ চলে যাবে।
“খদ্দের আর পাব কোথায়?” নিতাইয়ের হাসি আরও গভীর হয়ে ওঠে। “এখানে কেউ পুরনো জিনিস কিনতে চায় না। আমাকে যদি দ্যান পাঁচশো টাকায় নিয়ে যেতে পারি।”
“পাঁচশো?” অনন্যার চোখ কপালে উঠে গেল। “এগারো হাজার টাকার সোফা পাঁচশো টাকায় বিক্রি করব?”
“ও সোফার জন্যে ওর বেশি আর পাবেন না,” নিতাই ঘাড় চুলকে জানায়।
“না আমার ওই দাম পোষাবে না,” বলে অনন্যা দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল।
ভেবেছেটা কি ওরা? একা মহিলা পেয়ে ইচ্ছেমতো ঠকিয়ে নেবে? একটা কাগজে খস খস করে লিখে ফেলল-
“সোফা ফর সেল। এক্সিলেন্ট কন্ডিশন। প্রাইস সেভেন থাউজ্যান্ড। কনট্যাক্ট ফ্ল্যাট এইট জি।”
তারপর নীচে নেমে দারোয়ানের গুমটির দেওয়ালেই সেটা সেলোটেপ দিয়ে সেঁটে দিল।
ভালোয় ভালোয় সোফাটা বিক্রি হলে কোণের টেবিল আর চেয়ার দুটোও সে ঝেড়ে দেবে। বাইরের ঘরে পাতার জন্য মাদুরই যথেষ্ট।
টাকা আয়ের আর কি ব্যবস্থা হতে পারে ভাবতে ভাবতে অনন্যা ফ্ল্যাটে ফিরে এল। একটু পরেই আবার ঘণ্টি বেজে উঠল। অনন্যা অবাক। এখন তো কারুর আসার কথা না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাড়ে ছ'টা বেজে গেছে। দেড় ঘণ্টা কোথা দিয়ে কেটে গেছে ও টেরই পায়নি।
“আসছি!”
দরজা খুলে দেখে দেবু রুমাল দিয়ে মুখ মুছছে। হাতে একটা টিফিন বক্স।
“তোর জন্যে কেক বানিয়ে এনেছি,” দেবু টিফিন বক্সটা বাড়িয়ে ধরল, “এক্ষুনি ফ্রিজে তুলে রাখ। ঈশানরা দেখতে পেলে একটুও বাঁচবে না।”
“ওমা, ওদের দেব না?”
“না, এটা তুই একা খাবি। আদ্ধেক দিন তো না খেয়ে থাকিস।”
“উফফ, আবার শুরু করলি!” অনন্যা কেক নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। “আজ বাবাকে দেখলাম।”
দেবু মুহূর্তের জন্য চুপ।
“কথা হল?”
অনন্যা মাথা নেড়ে 'না' বলল।
“বাবা আমাকে দেখতে পায়নি।”
দেবু হয়তো কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু সে সুযোগ না দিয়ে আবার কলিং বেল বেজে উঠল। আলোচনা স্থগিত রইল।
এবারের আগন্তুক সুমন। দেবুর স্কুলের 'ক্রাশ'।
“ঈশানরা আসেনি?” সুমন এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল।
“সাতটায় আসবে বলেছে।”
“তার মানে দশটার আগে ঢুকবে না।”
অনন্যা আগেই মৃদু আ্যমবিয়েন্ট লাইট জ্বালিয়ে আর ঝর্ণার শব্দ চালিয়ে একটা 'পরিবেশ' তৈরী করে রেখেছিল। এবার হাল্কা করে এসি চালিয়ে দিল। ওর এই ফ্ল্যাটটা বন্ধুদের খুব পছন্দ, সবাই প্রশংসা করে।
“তুই হায়দ্রাবাদে কবে যাচ্ছিস?” টেবিলের ওপর বিয়ার আর চিপস, চানাচুর সাজাতে সাজাতে অনন্যা সুমনকে জিজ্ঞেস করল। “অফিস জয়নিং দিয়েছে?”
“নেক্সট উইক। বাবা মাকে নিয়ে সলিড চাপ হচ্ছে রে। কত করে বলছি আমার সঙ্গে চলো, কিন্তু কিছুতেই যাবে না। দু’জনেরই বয়েস হচ্ছে। যদি কোন এমারজেন্সি হয়?”
“কিচ্ছু হবে না,” দেবু সুমনকে আশ্বস্ত করে। “আর তাছাড়া আমরা তো আছিই।”
“আবার কবে তোদের সঙ্গে দেখা হবে কে জানে,” সুমন কাঁচুমাচু মুখে বলল, “পরের গেট টুগেদারে আমায় ভিডিও কল করবি কিন্তু।”
করা হবে প্রথম প্রথম, অনন্যা মনে মনে ভাবে। কিন্তু তারপর সুমনের জীবন একটা আলাদা ট্র্যাকে বেরিয়ে যাবে। নতুন জায়গায় নতুন বন্ধু হবে। ধীরে ধীরে যোগাযোগ কমে আসবে।
এভাবেই পুরনো সম্পর্কগুলো শেষ হয়ে যায়।
“ঈশানকে একটা ফোন কর না,” সুমন অধৈর্য হয়ে বলে, “সাড়ে সাতটা তো বেজে গেল, আছে কোথায়?”
শেষ অবধি ঈশান আর মারুফের ঢুকতে ঢুকতে প্রায় আটটা হল। অনন্যা জানে, দেরীটা ঈশানের তরফ থেকেই হয়েছে।
“সরি, সরি, রাস্তায় সাংঘাতিক জ্যাম ছিল,” ঈশান ধপ করে সোফায় বসে পড়ল, “তার ওপর মারুফটা প্রচণ্ড বোর করেছে।”
মারুফ খুব শান্ত, লাজুক প্রকৃতির ছেলে। একেবারে ঈশানের উল্টো। অথচ দুজনে স্কুল থেকেই বেস্ট ফ্রেন্ড।
ওদের হাতে বিয়ার দিয়ে অনন্যা স্যালাড কাটতে রান্নাঘরে চলে গেল। দেবুও পেছন পেছন এল।
“সুজয় আর তোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল?”
“নাঃ। ডিভোর্সের কথা বলতে যে ফোন করেছিল ওটাই লাস্ট।”
দেবুর ভুরু কুঁচকে গেল।
“সুজয়কে এত তাড়াতাড়ি ডিভোর্স দিতে রাজি হলি কেন? ঘোরাতে পারতিস একটু।”
“না বাবা,” আনন্যা এক টুকরো শশা মুখে পুরে দিল, “উকিলকে টাকা দেওয়ার থেকে নিজে সেই টাকায় খাওয়া ভালো। সুজয়ের উকিল সবটা করে দিচ্ছে, দিক না। এমনিও সুজয় আমাকে এক পয়সাও দেবে না।”
“তোর টাকার খুব টানাটানি যাচ্ছে, না রে?”
অনন্যা জোর করে হাসল।
“বিজনেসটা একবার দাঁড়িয়ে গেলে আর কোন প্রব্লেম থাকবে না।”
দেবু অনন্যার কাঁধে হাত রাখল।
“দ্যাখ্ অনু, তুই বাড়ি ফিরে যা। একবার কাকু কাকিমার সামনে গিয়ে দাঁড়া। মা বাবারা এখনো আমাদের লাথিটা মারতে পারে না। তুই গেলে ওরা তোর একটা ব্যবস্থা করবেই।”
অনন্যার বুকের ভেতর কে যেন একটা সাঁড়াশি চেপে ধরল।
“ও বাড়িতে আমি আর কোনদিন যাব না!”
“বাবু, জেদ করিস না। আ্যট লীস্ট কাকিমাকে তোর ডিভোর্সের কথাটা জানাতে দে?”
“খবরদার না।”
দেবু ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাতে অনন্যার রাগ দ্বিগুণ হয়ে উঠল।
“সিরিয়াসলি তুই আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলছিস? ভুলে গেছিস, একটা ডিভোর্সি ছেলের সঙ্গে প্রেম করেছি বলে ওরা কি তুলকালাম করেছিল?”
“দু'বার ডিভোর্সি। তার ওপর তোর থেকে প্রায় দশ বছরের বড়।”
“দু'বার ডিভোর্সি হোক আর সাতবার ডিভোর্সি হোক, তাতে ওদের কি?”
কুট্টিমাসী কথাটা লাগানো মাত্রই যেন বাড়িতে একটা ছোটখাটো বোমা পড়েছিল। মা তৎক্ষণাৎ অনন্যাকে ঘরে বন্ধ করার প্রস্তাব এনেছিল। বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার সপক্ষে। অনন্যার নিজের বাড়ি – সরি, ওটা তো ওর বাপের বাড়ি। তাই যখন তখন ওকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া যায়। শেষ অবধি অন্যান্য সব বিষয়ের মতো এক্ষেত্রেও মা বাবা কোন কনসেনসাসে পৌঁছতে পারে নি। একটা ব্যাপারেই একমত হতে পেরেছিল – অনন্যার ফোনটা বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হবে।
বাড়তে বাড়তে টিনটিন পর্যন্ত ওকে দু'কথা শুনিয়েছিল।
“কি করছিস দিদি? সবার সামনে আমাদের ফ্যামিলির নাকটা কাটাবি নাকি?”
মুখে যতই বড় বড় কথা বলুক, আসলে অনন্যার সুজয়কে তখনি বিয়ে করার কোন ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু বাড়িতে এমন কুরুক্ষেত্র বাধল যে পালিয়ে বিয়ে করা ছাড়া পথ রইল না।
দেবু অনন্যাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে।
“আসলে তোর জন্যে চিন্তা হয়েছিল বলেই ওরা ওভাবে রিয়াক্ট করেছিল--”
“চিন্তা হলে একবারও আমার খোঁজ নিত না? ওদের শুধু চিন্তা ছিল আমি ডিভোর্সি ছেলেকে বিয়ে করলে ওদের স্টুপিড জ্ঞাতিগুষ্টি কি বলবে!”
“মা বাবারা ওরকমই হয় রে। সারাক্ষণই আমাদের অপমান করে। অত ধরতে গেলে চলে নাকি?”
“কাকু কাকিমা কোনদিন তোকে এভাবে অপমান করেনি। তাই তুই এরকম বলতে পারছিস।”
“করেনি বুঝি?” দেবু গলা নামিয়ে আনল, “আমি যখন সুধীরকাকুর কথাটা বলেছিলাম ওরা বিশ্বাস করেছিল?”
“কাকু আবার কিসের? আস্ত শয়তান একটা।”
“কেউ ঘরে না থাকলেই অসভ্যতা শুরু করত। তারপর থেকে ও এলে আমি তোদের বাড়ি পালিয়ে যেতাম। আই হ্যাড নো চয়েস! যাই হোক, আমার কথাটা বিশ্বাস না করে মা বাবা আমাকে অপমান করেছিল কি না? কিন্তু তার মানে তো এটা নয় যে ওরা আমাকে ভালোবাসত না। কাকু কাকিমাও তোকে যথেষ্ট ভালোবাসে। তুই একবার বাড়ি যা, সব ঝামেলা মিটে যাবে।”
স্যালাড তৈরী হয়ে গেছে। অনন্যা প্লেট তুলে ঘরের দিকে রওনা দিল।
“কিচ্ছু মিটবে না। আমি বাড়ি গেলে ওরা আমাকে আরও অপমান করবে। তারপর বলবে, আমার জন্যে টিনটিনের ভালো সম্বন্ধ এল না।”
“ধুর, এখন আর কেউ সম্বন্ধ করে বিয়ে করে নাকি? টিনটিনের নির্ঘাত বর ঠিক করা আছে।”
'না' বলতে গিয়েও অনন্যা থেমে গেল। সে কি করে জানবে টিনটিনের বয়ফ্রেন্ড আছে কি না? তিন বছর হল একটা কথাও তো হয় নি। অথচ এক সময়ে দু'জনকে টেনে আলাদা করা যেত না। স্কুল থেকে ফিরেই টিনটিন ছুটে এসে দিদিকে জড়িয়ে ধরত। তারপর কত খেলা, কত আদর।
অনন্যার গলায় কি একটা দলা পাকিয়ে যায়। আওয়াজ আটকে আসে।
“জানিস দেবু, টাকা পয়সা আজ নেই কাল হয়তো আসবে। কিন্তু আমার মনে যে এত্তো এত্তো ভালোবাসা আছে – বাবা মার জন্য, টিনটিনের জন্য – সেটা কাকে দেব বুঝতে পারি না। ভেবেছিলাম সুজয়কে দিয়ে সবটা কমপেনসেট করব কিন্তু তাও তো হল না। এত ভালোবাসা নিয়ে আমি কি করব বলত?”
দেবু অনন্যাকে জড়িয়ে ধরে।
“আর কাউকে না পেলে আমায় দিস।”
ঈশান, সুমন আর অপেক্ষা করতে পারে না।
“স্যালাড কাটতে বছর গড়িয়ে দিলি তো! আমরা আরেকটু হলে জোমাটোতে অর্ডার দিতে যাচ্ছিলাম!”
“খবর শুনেছিস? আজ রাতের ডিনার সুমন স্পনসর করছে।”
ঈশান এসে অনন্যার হাত থেকে স্যালাডের প্লেট কেড়ে নেয়।
“ঠিক আছে,” অনন্যা দেবুর দিকে ঘুরল, “মাকে সুজয়ের কথাটা বলতে পারিস। বাবাকে কিছু বলবি না কিন্তু!”
মারুফ বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে আছে। অনন্যা তাই দেখে এগিয়ে গেল। আট তলার ফ্ল্যাট, তার ওপর চারদিক ফাঁকা। হু হু করে হাওয়া এসে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যায়। বারান্দার আলোটা অনেক দিন আগে কেটে গেছে। অনন্যা ইচ্ছে করেই চেঞ্জ করে নি। সন্ধেবেলা এখানে আলো আঁধারিতে বসে থাকতে ওর দারুণ লাগে। দূরে আকাশের গায়ে বিদ্যুৎ ঝলকে গেল।
“কিরে, এখানে একা একা কি করছিস?”
অনন্যার গলা শুনে মারুফ ফিরে তাকাল। শুকনো গলায় বলল,
“ঋষি বিকেলে ফোন করেছিল। বাড়ি থেকে ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে।”
“ওঃ...”
অনন্যা থমকে যায়। কি বলবে বুঝতে পারে না।
“দ্যাখ্, আমাদের দেশে তো এটাই এক্সপেক্টেড...আর তুই নিজেই বলেছিস ঋষির ফ্যামিলি খুব কনজার্ভেটিভ।”
“ওগুলো সব ছুতো, বুঝলি তো? আমি ওকে বলেছিলাম, চলো আমরা বিদেশে জব নিয়ে চলে যাই। ওখানে গিয়ে এ্যপার্টমেন্ট শেয়ার করে থাকব। কিন্তু ওর সাহসই হল না।”
অনন্যা কাঁধ ঝাঁকায়।
“তা আমার মতো পাগল কি আর ঘরে ঘরে পাওয়া যায়?”
মারুফ হেসে ফেলল। ঘন চুলের মধ্যে দিয়ে হাত চালাল।
“জানি না আমি কাল অফিসে যাব কি করে। ঋষির সঙ্গে এক টীমে কাজ করব কি করে?”
“ওয়ার্ক ফ্রম হোম কর। এখন তো সুবিধা আছে।”
“আমাকে বোধহয় রিজাইন করতে হবে রে।”
“আবার মারুফটা প্যানপ্যানানি জুড়েছে?” এক হাতে বিয়ারের বোতল আর অন্য হাতে সিগারেট নিয়ে ঈশান বারান্দায় ঢুকে এল। “সারা রাস্তা গাড়িতে আমার মাথা খেয়েছে!”
“শাট আপ!” মারুফ হাসতে হাসতে ঈশানের সিগারেটটা কেড়ে নিল। ঈশান পকেট থেকে আরেকটা বের করে ধরাল।
“অনেস্টলি! যেন তোর একলার জীবনেই চাপ...অনুর লাইফে চাপ নেই? দেবুর লাইফে চাপ নেই? এখানে এমন কে আছে যার লাইফে চাপ নেই?”
“তুই।”
“এটা ভালো বলেছিস হে হে...আমি একদম কুল! বিন্দাস!”
“বেশি ডায়লগ দিস না!”
দেবু, সুমনও বারান্দায় চলে এসেছে।
“কি রে কি গল্প হচ্ছে এখানে?”
“আমাদের থেকে লুকিয়ে সিগারেট খাচ্ছিস!”
“ওরে তোরা আস্তে কথা বল্,” অনন্যা সশঙ্কিত হয়ে ওঠে, “আগের বার সিকিউরিটি গার্ড পর্যন্ত চলে এসেছিল! বাড়ি থেকে বের করে দিলে আমাকে গাছতলায় দাঁড়াতে হবে!”
কিন্তু কথা শোনে না কেউই। ওরা একসঙ্গে বসলেই পার্টি জমে ওঠে। স্টুডেন্ট লাইফে কত জায়গা থেকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। তবু কারুর ভ্রূক্ষেপ নেই।
“সলিড বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে! বৃষ্টি এলে কিন্তু দারুণ হবে!”
“ভালো একটা গান চালা, না! হিন্দী গান কোন।”
“ধুর! পিঙ্ক ফ্লয়েডের কামিং ব্যাক টু লাইফ শুনব।”
“আমি বিরিয়ানি আর চিকেন চাপ অর্ডার করে দিলাম।”
“হাজি আলী থেকে করিস কিন্তু!”
“মারুফ আজ এত চুপুচাপ কেন রে?”
“ওর ঋষি অন্য মন্ত্র নিয়েছে।”
পার্টি শেষ হতে রাত দুটো বেজে গেল। ঘর গুছিয়ে, বাসন মেজে অনন্যা যখন শুতে গেল তখন প্রায় তিনটে। রাস্তাঘাট রাতের কমফোর্টার জড়িয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন। অনন্যারও দু'চোখ বন্ধ হয়ে এল। আজ আর দুঃস্বপ্নরা তাকে তাড়া করে বেড়াবে না...
জীবনটা সিনেমা নয়। এখানে নায়ক জাদুর ছড়ি হাতে ঘুরে বেড়ায় না। গল্পের শেষেও সমাধান হয় না কিছুই।
কিন্তু তার মাঝেই রবিবারগুলো এসে পড়ে, ছোট ছোট আনন্দের টুকরো ছুঁড়ে দেয়। চলার পথের রসদ জুগিয়ে দিয়ে যায়।