দোকানদার নিজে কিছু বল্লে না, শুধু অনুরোধ করলে রাস্তায়, সমুদ্রের মুখে যে বুড়ি ঠাকুমা বসে নারকেল বিক্রি করছে তার কাছে যেতে। কৌতূহলে বাঁ-দিকে দু পা এগিয়ে দেখলাম এক অশীতিপর বৃদ্ধা মোটা ছালার (বস্তা) উপর বসে গোটা দশেক নারকেল আর কাঁচা সুপারি বিক্রি করছে। কাল থেকে এখানে এসে ইস্তক হাফপ্যান্ট পরা সাদা-কালো সাহেব-মেম দেখলাম প্রচুর কিন্তু আটপৌরে বাঙালি শাড়ি এই প্রথম। ভাব জমানোর তাগিদে নারকেলের দাম জিজ্ঞেস করলাম, বল্লে দশ টাকা করে। আমি বল্লাম চারটে নেব। উত্তর - তবে আট টাকা করে। ওকে প্রফুল্ল দেখে পায়ে ভর রেখে উবু হলাম ওর পাশে। উনি ছালার খানিকটা জায়গা ফাঁকা করে হাত টেনে বসালেন, বসে গেলাম রাস্তার উপর। জিজ্ঞাসা করলাম – বাঙালি তো? গম্ভীর মুখে উত্তর, হুম্।
ততক্ষণে অভিনব দৃশ্য দেখে এপাশ-ওপাশ থেকে কিছু লোক জড় হল। সমুদ্রদর্শন আর স্নান সেরে ফেরা মহিলা পুরুষ, বাঙালি অথবা অবাঙালি দক্ষিণ ভারতীয়। কেউ কেউ আমাকে নারকেলের দর জিজ্ঞেস করায় বল্লাম দশ টাকা। নিমেষে ছ’টা নারকেল বিক্রি হলেও নারকেলের চাহিদা রয়েছে। ঠাকমা তখন আমার নারকেল থেকে দুটো নিয়ে পনেরো টাকা করে বেচে দিলে। আমি শেষ নারকেল দুটো ঠাকুমার অমতেই বেচে ত্রিশ টাকা ঠাকমাকে দিলাম। ঠাকমাও নাছোড়বান্দা, বলে তুমি এখানে দাঁড়াও আমি বাসায় গিয়ে চারটা নারকেল পাঠাই তোমায়। বিপদগ্রস্ত আমি ঠাকমাকে প্রবোধ দিতে চেষ্টা করি, নারকেলে আমার প্রয়োজন নেই বলে। ঠাকমা শুনবে না। শেষ কটা কাঁচা গুয়া (সুপারি) কিনেছি এক টাকা করে। ঠাকমা তার পয়সা গুনে জানাল তার বিক্রি হয়েছে দেড়শ টাকার, ভারি খুশি তিনি।
ছালা ভাঁজ করে পিছনে দোকানে রেখে এবার বাড়ি যাবে ঠাকমা। ইতিমধ্যে তার কাছে শুনেছি ওপার বাংলার খুলনায় ছিল তার শ্বশুরবাড়ি, এখানে আসা বাহান্নতে। চারিদিকে তখন বড় বড় পেটারি, গামার, কাঠ বাদাম, তেতুঁল, বনরিঠা, শিরীষ, মুচকুন্দ, সাদা বাবলা, খয়ের, ভান্দা, রঞ্জন, সোনাঝূরি আর বাওবাব(??) গাছ, তার নীচে মাটি ঢাকা বনঢেঁকি, হদু, জঙলি জিরা, জঙলা ঘাস আর আগাছা। সেই ছবি মনের আয়নায় চাক্ষুষ হচ্ছে। হঠাৎই হাতে টান। ঠাকমা বুড়ি আমার হাত ধরে বল্লে, আজ তুই আমায় বাসায় দিয়ে আয়। ঘড়িতে সাড়ে নয়, আকাশে হাল্কা মেঘ, রোদের গুমর কমেছে। জানতে চাইলাম কদ্দুর, বল্লে আধা ঘন্টা লাগবে। ভাবলাম আধা ঘন্টা যাব, আধা ঘণ্টা আসব, এগারোটার মধ্যে ফিরে আসব, তারপরেও সময় থাকবে পড়ে মধ্যাহ্ন ভোজের আগে। অগত্যা বুড়ির পিছু নিলাম।
মিনিট পনেরো কুড়ি ডান দিকে পিচের রাস্তা ধরে হাঁটছি। ভাঙা কোমরে ঠাকমা হাঁটায় পাল্লা দিলে আমায়। আমার মনের চোখে তখনও সেই চারিদিক অন্ধকার করা উঁচু গাছগুলো – যাদের পাতা ঝরে না, মিশ্ কালচে সবুজ রঙ বদলায় না। নীচে মাটি ঢাকা আগাছাগুলোর কোন কোনটা নিবিড় বেষ্টনে জড়িয়েছে বড় গাছগুলিকে, মাথা চাড়া দিয়েছে আলোর খোঁজে। বড় গাছের শিকড়গুলি মাটির উপরেই বিস্তার করেছে তাদের পরিধি, মৃত্তিকা কন্দরের লবণে তাদের অরুচি।
চলতে চলতে পিচরাস্তা ছেড়ে ঠাকমা নামল আগাছাভরা মাটিতে – কেমন যেন স্যাঁতস্যাতে জায়গা, আকাশঢাকা গাছ, কিছু নারকেল সুপারি, মাটিটাও সবুজ, শ্যাওলা ফার্নে ভরা, ভিজে গন্ধ। বেশ কিছু সময় চলার পর প্রায় পৌনে এগারোটা নাগাদ দেখলাম সামনের মাটিতে আর আগাছা নেই; কটা বাঁশের খুটি পোঁতা। একটা উঠান, উঠান পেরিয়ে বারান্দা ছুঁয়ে টিনের চালা। ঠাকমার চিৎকারে বেরিয়ে এল একটি বঊ, চাউনিতে কৌতূহলী সন্দেহ। ভাবছিলাম এবার বিদায় নেব। ঠাকমা হাত ছাড়েনি। পাকড়ে নিয়ে গেলে ভিতরে, সোজা ঘরের তক্তপোশে বসিয়ে নিজে বসলেন পাশে। ছটা নারকেল ধরাতে গেলেন আমার হাতে, বল্লেন দাম দিবে না। বৌটিকে কর্তৃত্বের সুরে জানালেন মেয়ে এখানে ভাত খাবে। বউ ঘাড় নাড়লে নিঃশব্দে। আমি হতবাক।
বাংলাদেশ থেকে সুদূরে দক্ষিণের এই দ্বীপে বাংলাদেশী গ্রাম্য আতিথ্য – রক্তে মজ্জায় মিশে থাকা অভ্যাস ষাট বছরেও ম্লান হয়নি। শুধু চোখের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে। কে বলবে বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে এপার বাংলায় হল না সংকুলান তাদের, ভারতের প্রধান ভূমণ্ডলের বাইরে, জাহাজে সাগর পাড়ি দিয়ে তিনশ যোজন দূরে তাদের পাঠানো হয়েছিল এক অচেনা জগতে। যেখানে নীল সমুদ্রের বেড়িতে আটক থাকত তারা, ঘন সবুজ রং হতাশা জাগাত- খাওয়ার সংস্থান নেই, গাছ আছে ফল নেই, সমুদ্র ভরা জল, পানের অযোগ্য। রুটি-রুজির খোঁজে নয়, সরকারি নীতিতে ঠাঁই-নাড়া তারা, ইতিহাস তৈরি হল। সরকারি দাক্ষিণ্যের মাপা পুরনো কর্কশ চাল আর হিসাবের জলে তাদের দিন গুজরান। পরিবার প্রতি পনেরো কাঠা জমি। বাংলার সোনা ফলানো আলো ঝলমলে সবুজ ক্ষেত স্মৃতি হতে লাগল। আর বাস্তব তখন বন্য প্রাণী অধ্যুষিত বড় বড় গাছের জঙ্গল, অন্ধকার আগাছায় ভরা জলা জমি। নতুন জীবন সংগ্রাম, অমানুষিক পরিশ্রম – গাছ কাটা, জঙলা পরিষ্কার। বিষাক্ত সর্পসঙ্কুল ভূমিতে অকাল মৃত্যু দৈনন্দিন অভ্যাস হয়ে উঠল। পরিষ্কার করা মাটিও তখন চাষের অযোগ্য, লোনা জলে ধোওয়া জমিতে কেবল নারকেল, সুপারি গাছ বাঁচে, ধানচাল কেবল স্বপ্ন। জীবন যুদ্ধ অসাধ্যসাধনে সময় নিল অনেক। সত্তর সালের মধ্যেই ধান ফলল, হয়তো গুণেমানে উচ্চ নয় তবু ক্ষুধা নিবারণ হয়। গাছ-ভরা ডাব-নারকেল ক্ষতময় পূর্বস্মৃতি আর মানসিক গ্লানিতে অল্প প্রলেপ দিল। সমুদ্রের মাছ তখন পুকুরের মিঠে মাছের জায়গা নিয়েছে। এই-ই স্মৃতি ওই বৃদ্ধার, এ জন্মের সঞ্চয়। তিনি তাঁর তক্তপোষের আড়াল থেকে বার করা প্লাস্টিক কৌটো, পোঁটলা খুলে আমায় নাড়ু, মোয়া দিচ্ছেন। আমি অত খেতে না পারায় একটা প্লাস্টিকের পোঁটলা ভরে আমার হাতে ধরালেন, অনুরোধ, তোর মেয়েকে দিস। এর মাঝে আমার বাড়ির খোঁজ নিয়েছেন তিনি। আমায় দেখালেন তাঁর ঘর ভরা দামি ওষুধ টনিক--অন্য ছেলে, নাতি নাতনির আনা।
কিছু পরে তাঁর পুত্রবধূটি আমার দ্বিপ্রাহরিক আহারের বন্দোবস্ত করে ফেলল। কাঠের টেবিলে ঝকঝকে স্টিলের থালায় ধোঁয়া ওঠা রাঙা চালের ভাত, মসুর ডাল, গরম আলুভাজা, কাচকি (চুনো) মাছের ঝাল আর কাতলার ঝোল। রান্নার স্বাদে অভিভূত আমি। পাখা কেবল ঠাকমার ঘরে চলে, সূর্যের তাপে। পর্যাপ্ত নয়। তৃপ্তি সহকারে খাওয়া শেষ করলাম। খাওয়ার জল দিতে গিয়ে বউটি বল্লে, আমরা বৃষ্টির জল খাই, আপনার তো অভ্যাস নেই। দেখলাম বাড়ির পিছনে বড় প্লাস্টিকের ড্রামের উপর পাতলা কাপড় চাপা, ওতেই জমা হয় বৃষ্টির জল। সেটাই তাদের পানীয়। মহার্ঘ্য সেই জল সে ঢেলে দিলে আমার হাতে – পূনর্আচমনীয় (??)।
অপ্রত্যাশিত সেই আপ্যায়নে আমি মুগ্ধ। “সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ।” আমি সেকন্দর নই, তবুও সেদিন জয় আমার, সুদূর দক্ষিণের মহাসাগর মাঝে আত্মগোপন করে থাকা আমার শিকড় জড়ানো বাংলাকে দেখেছি, আমার পিতা পিতামহর বাংলা, শ্বশুর-দাদাশ্বশুরের বাংলা। ঠাকমা আর তার পরিবারের মত বহু পরিবারের উদ্বাস্তু জীবনে এই দূরদেশে আবাসলাভ হয়েছে। নিজেদের ক্ষমতায় জন্ম দিয়েছে বাংলার গুণে ভরা এক নতুন দেশের। রক্তাক্ত স্মৃতিকে বেশি নাড়াচাড়া করার ধৃষ্টতা ত্যাগ করাই সমীচীন। মুঠোফোনে আমাকে আমার পরিবার জানালে এবার ফিরে এসো, ছোটবেলা থেকে শুনে আসা গল্পগুলো যাদের অতীত, তাদের ব্যথা তোমার কল্পনা, কাহিনীর রূপ মাত্র। সে অতীত নাই বা কথা কইলে, তুমি ফিরে এসো।
বিদায় নিয়ে ফিরছি, হাতে দুটো নারকেল, নাড়ুমোয়ার ছোট পুঁটুলি, কিছুতেই এড়ানো যায়নি, যন্ত্র পক্ষীযানের উল্লেখে সংখ্যায় কমেছে মাত্র। সনির্বন্ধ দানের সাথে আন্তরিক উদ্বেগে বললেন, নারকেলটা তবে আন্দামানেই খেয়ে নিস। জামাই-নাতনিকে তাঁর কথা বলতে বললেন। বললেন তিনি বিলাসীবালা, এখানে সবাই তাঁর চেনা, তাঁর এই বাসায় সেজ ছেলে-বউ নিয়ে থাকা। বড় ছেলে জেটির কাছে মায়ের নামে মস্ত লজ বানিয়েছে।
ফেরার পথে বৃষ্টি ভেজা বুনো গন্ধমাখা হাওয়ায় হাঁটছি একা। মনে হল, নাই বা হলো “মা, তোর ধানে ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে”, তাদের অন্তরের আকুতি “ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে” সত্য হয়ে মূর্ত আজ। আমার বাঙালি মনে মা দুর্গার পূজা উঁকি দিলে, আর মাত্র কদিন বাকি। ঠাকমা আর তার বউয়ের জন্য সেই সুদূরে তাঁতের শাড়ি মিলে গেল। কটেজের উল্টো দিকের সেই দোকানিকে অনুরোধ করলাম ঠাকমাকে পৌছে দিতে, কারণ আমার হ্যাভলক বাসের মেয়াদ শেষ। পরদিন কাকডাকা ভোরে রওনা হলাম রঙত্।
কলকাতায় ফিরেছি, পুজো কেটে গেছে, এক কর্মব্যস্ত দিনে একটা ফোন এল। অচেনা নম্বর জানালে সে ঠাকমার সেজবউ অর্চনা, শাড়িগুলো তারা পূজায় পরেছে, কলকাতায় আসলে আসবে আমার বাড়ি।
তারা আজ আমার স্মৃতিতে, তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সেই অনাবিল আনন্দ আজও আমার মনের কোণের মণিমানিক্য। সে আমার পরম পাওয়া, নীলসিন্ধু জলধৌত চরণতলে মাতৃরূপ দর্শন।
“যেথায় থাকি যে যেখানে, বাঁধন আছে প্রাণে প্রাণে, সেই প্রাণের টানে টেনে আনে- সেই প্রাণের বেদন জানে না কে।”