বুড়িদের হেব্বি বায়নাক্কা জানো না বৌদি!--সে বলে। --সোমা মিষ্টি দই এনে দে, সোমা আইসক্রীম এনে দে। এদিকে দেখো সুগারের ওষুধ চলছে।
--পয়সা থাকে ওদের হাতে?
--থাকে না আবার? সাহেব বুড়ি তো মাথার তলা থেকে পুঁটলি সরায় না। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা।
সেদিন সোমা কাজে এসে বলে-- সাহেব বুড়ি মরে গেল বৌদি!
--সে কি? রমা বলে।--ওর পয়সা এবার কী হবে রে?
-- পল্টু হাতিয়েছে ক’টা। বেশি পারে নি। আমাকেও দিল দুটো। সোমা শায়ার কোমর থেকে সন্তর্পণে হাতানো নোট বার করতে করতে বলে।
--বলিস কি রে, ডলার নাকি? দুটো হলেও আমাদের টাকায় অনেক।
গোল্লা পাকানো নোট দু’খানা রমার হাতে দেয় সোমা। হলদেটে রঙ চটে যাওয়া পুরনো পোস্টকার্ড বলেও ভুল হতে পারে । গায়ে শিমুল তুলোর আঁশ লেগে আছে। নোটের ভাষা বোধহয় ফরাসী। যা পড়া যাচ্ছে তার মধ্য থেকে পন্ডিচেরী কথাটা রমা উদ্ধার করতে পারে। উনিশশো একত্রিশ সালটাও বোঝা যাচ্ছে। নোটের মূল্য এক অথবা দশ যা কিছু হতে পারে। ফরাসী কারেন্সির নাম তো ফ্রাঁ। সেটা টাকা না ডলার না ফ্রাঁ তা অবশ্য বোঝার মত অবস্থায় নেই সে নোটগুলো।
--এ তো নকল নোট রে সোমা। সত্যি সত্যি বুড়ির সাহেব বর ছিল? না কি বুড়ি ফালতু বলত রে? রমা নোটগুলো ওকে ফিরিয়ে দিতে চায়।
সোমা দমে গেছে। বলে-- তাই তো শুনেছিলাম। সাহেব নাকি এখানে কোথায় সাধু হয়ে চলে যায়। ফালতু কতগুলো নকল নোট আঁকড়ে ধরে আমাদের বোকা বানিয়ে গেল। কেমন ঢ্যামনা বোঝ!
--ও তুমি রেখে দাও বৌদি। যদি কাজে লাগে আমি তোমার কাছ থেকে চেয়ে নেবো’খন।
সন্ধ্যাবেলায় চা জলখাবারের পর অতীনকে নোটগুলো দেখায় রমা। সাহেববুড়ি, তার বালিশ-বিছানা, ওয়াড়ের ভিতরে নোট সব কিছু সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল অতীন। আপাত নির্লিপ্ততাও তার ঔৎসুক্য চাপা দিতে পারে নি কোনদিন।
--ও, এই তাহলে সে নোটের গল্প! তাকে কিছুটা আশাহতই শোনায়।
-- কোন কাজে লাগবে না, তাই না?
অতীন আশাহত হলেও অনিশ্চিত। রেখে দাও, মাঝে মাঝে অ্যান্টিক নোট, স্ট্যাম্প এসব চেয়ে কাগজে বিজ্ঞাপন দেয় লোকে। জানি না এই আধখাওয়া নোটের কোন অ্যান্টিক ভ্যালু আছে কি না!
রাত্রে শুয়ে পড়ার কতক্ষণ পরে জানে না রমা, হয়ত অতীনের নাক ডাকার শব্দেই হবে, তার ঘুম ভেঙে যায়। তার মনে হয় ঘরের ভিতরে যেন প্রার্থনাধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ‘হিম’ বলে যাকে ইংরেজিতে। ভালো করে কান পাতলে প্রার্থনার মধ্য থেকে ‘ওম’ ধ্বনিটিকেও বিচ্ছিন্ন করা যায়। রমা ভাবে আলো জ্বালিয়ে ডাকবে অতীনকে, কিন্তু প্রার্থনার সুরটাকে ভেঙে দিতেও মন চায় না। অন্ধকার সয়ে গেছে চোখে। এখন সে দেখতেও পাচ্ছে সবকিছু যা এই চার দেওয়ালের মধ্যে মশারির আড়ালে। বেতের দুটো ছোট চেয়ার, সেন্টার টেবল, দেওয়ালে টিভি, বইয়ের তাকে বাঁকুড়ার ঘোড়া, এমনকি দাঁড় করিয়ে রাখা বইগুলোর স্পাইনের লেখা সব কিছু পড়তেও পারছে সে। সবচেয়ে মোটা বইটা অতীন অনেক টাকায় কিনেছিল গতবছর, তার স্পাইনে লেখা MYTHOLOGY স্পষ্ট পড়তে পারছে রমা। সে তার বালিশের তলা থেকে নোট দু’খানা বার করে চোখের সামনে মেলে ধরে। পন্ডিচেরি সরকার, ১৯৩১--এসব আগের মতই পড়তে পারে সে, কিন্তু অন্য কোন তথ্য সেই অতিমলিন কারেন্সি থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয় না সে। ঘুম আসে না আর। এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যেন টের পায় নি প্রার্থনাগীতি থেমে গেছে। আলো ফুটে উঠছে সকালের।
সোমা কাজে এল এগারোটা নাগাদ। তাকে দরজা খুলে দিয়ে বসার ঘরের সোফায় হেলান দিয়ে বসে রমা।
--কি গো, তোমার শরীর খারাপ না কি?
--কই, না তো!
-- চেহারাটা এরম লাগছে কেন? রাতে ঘুমোও নি? ঝগড়া করেছ দাদার সাথে, নাকি দাদা ঘুমোতে দেয় নি! এমন আদিরসের পাশ ঘেঁষা ডায়লগ মাঝে মাঝে সোমা মারে এবং রমা তা যে খুব কম রমণীয় মনে করে এমনও নয়। এখন অবশ্য সে লাইনে কথা বাড়াতে চাইলো না রমা।
--বাকি নোটগুলোর কী হল রে? সে জিগ্যেস করে আলগাভাবেই।
--পল্টু নিয়েছে ক’টা, বললামই তো!
--অনেক ছিল বলেছিলি যে?
-- বালিশ তো ছিল এই মোটা, তার ভিতরে আর কী কী ছিল কি করে জানবো বল? হোমের মালিকের লোকজন সব সরিয়ে নিয়েছে। বলে বুড়ির ছেলে নাকি আসবে সব নিতে।
সোমা কাজ করে চলে যাবার পরে রমা স্নানে যায়। এ সময়টা তার আলস্য আসে, চান খাওয়ার পরিশ্রমও করতে যেন চায় না মন। মাঝে মাঝে শুয়ে এটা ওটা ওল্টাতে ওল্টাতে অথবা মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে ঘুম এসে যায় তার। ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠতে গিয়ে হয়ত সে দেখে ঘড়িতে পাঁচটা বেজে গিয়েছে। তখন মন খারাপ হয়ে যায়, মনে হয় কেউ তাকে কোনদিন থালা সাজিয়ে ডেকে বলবে না-- খেতে এসো!
রান্নাঘরে রাখা মাইক্রোওয়েভে গরম করা দুপুরের খাবার নিয়ে খাবার টেবিলে আসতে আসতে রমা দেখতে পেল তাঁকে। গৌরবর্ণ সুন্দর পুরুষ। মধ্যবয়স্ক, চুল পাতলা হয়ে এসেছে। দু’পাট করে জড়ানো ধুতি, গায়ে জড়ানো সাদা চাদর, অঙ্গবস্ত্র বলতে ওইটুকুই, বসে আছেন খাবার টেবিলে। রমাকে দেখে হাসলেন স্মিত, বললেন-- খেতে দাও। রমা ভাতের থালা তাঁর সামনে রাখলো। -- যাক, তবু আজ নিজে থেকেই খেতে চাইলেন। আবার চলে যাবেন তাই তো?
-- আমি তো সন্ন্যাসী নই। গৃহীও নই। থেকেও যেতে পারি যদি চাও।
-- যেতে চাইলে ফিরে আসেন কেন?
-- আবার চলে যাবো বলে।
-- যান কী রিক্ত হাতে? কিছুই কি নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না?
-- নিয়ে যাই তো। এই সম্পর্কটাকে যত্ন করে বয়ে নিয়ে যাই এই ঝোলায়।
-- আর কি দিয়ে যান?
-- ওই সম্পর্ক ছাড়া আর কী? যা তোমাকে জড়িয়ে থাকে সব সময়।
-- আর স্মৃতি।
-- হ্যাঁ, স্মৃতি। শুধু স্মৃতি কেন, বলতে পারো সময়, সময়কাল বললে আরও ভালো শোনায়।
-- যেখানে গিয়েছেন সেখানে কী পান?
-- কিছু পাবার জন্য সব ছাড়ি নি তো!
-- মুক্তি?
-- হ্যাঁ, মুক্তি। বন্ধনমুক্তি।
-- সেও তো চাওয়াই হল। হল না কি?
-- চাওয়ার কি শেষ আছে মানুষের?
-- দু’মুঠো গরম ভাত বেড়ে দিক কেউ দিনান্তে থালায়-- মনে হয় নি কখনও?
-- কেউ না কেউ তো দেন! যিনি দেন তিনিই ঈশ্বর। তাঁকে সম্পর্কে বাঁধা যায় না।
-- যাকে সম্পর্কে বাঁধা যায় তাকে কোন মুক্তি দিয়ে গেলেন ভাবেন নি কোনদিন?
-- ভাবি তো! ভাবি বলেই ফিরে ফিরে আসি। এইরকম। আজকে যেমন।
-- আসলে মুক্তি সবাই চায়ও না, কি বলুন?
-- চাইলে তো ফিরতে হত না বার বার।
হঠাৎ মোবাইল বেজে ওঠে। কথোপকথনে ছেদ পড়ে।
--আরে তুমি কোথায়? ওপাশে অতীন।
--কেন, ফ্ল্যাটেই তো, আর কোথায়?
--তোমার দরজায় বেল বাজিয়ে পাচ্ছে না কেন?
--কে বাজাচ্ছে বেল? কই, কিছু বাজে নি তো!
অতীন বিরক্ত। সে বলতে চায় সোমা অনেকবার দরজায় বেল বাজিয়ে সাড়া না পেয়ে নাকি তাকে ফোন করেছে।
-- সোমা তো ভয় পেয়ে গেছে। বলছে দাদা, বৌদি সাড়া দিচ্ছে না কেন?
দরজা খুলে সোমাকে দেখতে পায় সে। সোমার পিছনে এক গৌরবর্ণ পুরুষ। লম্বা এবং সুদর্শন, দেখে এদেশীয় বলে মনে হয় না।
--সাহেব বুড়ির ছেলে, সোমা ফিসফিস করে বলে। দুহাত জোড় করে তিনি পরিষ্কার বাংলায় বলেন-- নমস্কার।
--উনি সব নিয়ে যেতে এসেছেন বৌদি! সোমা বলে।
উনি বলেন-- হ্যাঁ, মা যা যা যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছিলেন এবার নিয়ে যাই সব। আর তো কোন কাজে লাগবে না! সোমা আবার ফিসফিস করে বলে-- তোমার কাছে রাখা নোটগুলো নিতে এসেছেন।
রমা বলে-- আপনি ভিতরে আসবেন না?
--না না, আমি একটু ব্যস্ততার ভিতরে আছি। আর সব কিছু হয়ে গেছে, আপনার কাছ থেকে কেবল ওগুলো নিয়ে চলে যাবো।
বালিশের তলা থেকে নোট দুটো নিয়ে আসে রমা। বিবর্ণ। স্বাধীন পন্ডিচেরি সরকারের ছাপ বোঝা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে ১৯৩১ সালটাও। আর ভাল করে কিছু বোঝা যাচ্ছে না তবে শোয়ার ঘর থেকে সদর দরজায় আসতে আসতেই রমা বোঝে আগে সে লক্ষ করে নি বটে কিন্তু খুব হালকা পেনসিলে নোটের এক কোণায় বাংলায় লেখা আছে – লক্ষ্মী।
সোমা ভদ্রলোককে নিয়ে চলে যাবার পরে রমা দরজা বন্ধ করে। খাবার টেবিলে ফিরে এসে দেখে কেউ কোথাও নেই, শূন্য আসন, থালাও শূন্য। বেড়ে আনা ভাত আর একটুও পড়ে নেই থালায়।