সেদিন ছেলেবেলার এক বন্ধুকে এরকম একটা ঘটনার কথা বলেছিলাম। সে তো শুনে অবাক। বলল – “শোন, তুই ঘটনাটা লিখে ফেল। নিজের মধ্যে রেখে দিস না।”
- “আমি জীবনে কখনো কিছু লিখিনি। ওসব আমাকে দিয়ে হবে না রে …”
- “খুব হবে। নিজের স্মৃতি নিজের ভাষায় লিখবি, ব্যাস। তুই তো আর বিরাট সাহিত্যিক হতে যাচ্ছিস না। খাতা কলম নিয়ে বসে দেখ না কি হয়”।
আমি শেষমেশ লিখেই ফেললাম, বুঝলে। তোমাদের পড়ার জন্য পাঠিয়েও দিলাম। যদি ভালো লাগে আমাকে একটু খবর দিও। তাহলে আরও চোখে দেখা অভিজ্ঞতার কথা শোনাবো তোমাদের।
****
তখন আমার বয়স একুশ-বাইশ হবে। এক ঠিকেদার কোম্পানীতে কাজ করি। এদের কাজ ছিল নলকূপ বা টিউব-ওয়েল খোঁড়া। সে যেখানে বরাত পেতো সেখানেই যেতে হতো। আমি ছিলাম কোম্পানীর সুপারভাইজার সুবোধদার সহকারী, সুবোধদা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। সব জায়গাতেই আমাকে নিয়ে যাওয়া চাই।
সেবার বরাত এলো গুজরাট থেকে। রাজস্থানের গায়ে লাগা এই অঞ্চলে বৃষ্টি কমই হয়। আর একটু এগোলেই যে মরুভূমি তা বেশ বোঝা যায়। শুকনো জমি, বালি আর পাথরে ভরা। বাবলা জাতীয় বেঁটে-বেঁটে গাছ এদিকে ওদিকে। ঘাস তেমন নেই, আগাছা অবশ্য আছে। মাইল পাঁচেক দূরে একটা নদী আছে, তাতে গরমের দিনে জল থাকে না বললেই চলে। গ্রামের লোকেদের জলের কষ্ট খুব। সরকার থেকে তাই এখানে নলকূপ খোঁড়ার আদেশ এসেছে।
তা ভালো কথা। কিন্তু সেখানে পৌঁছে যা শুনলাম তাতে আমি ঘাবড়ে গেলাম। সেখানে নাকি এর আগে আরও দুটো কোম্পানী এসে চেষ্টা করে গেছে, অনেক গভীর অবধি খুঁড়েও জল বার করতে পারেনি।
মাটির নিচে জল থাকে। কিন্তু ঠিক কোথায়, কত নিচে তা পাওয়া যাবে তা বলার সেরকম কোনো উপায় সেই অতদিন আগে জানা ছিল না। এখন অবশ্য কিছু কিছু বৈজ্ঞানিক উপায় বার হয়েছে। তখনকার দিনে কিছু লোক ছিল যাদের কাজ ছিল জলের সন্ধান করা। এখনও গ্রামের দিকে তাদের দেখা যায়। এদের জল খোঁজার উপায়গুলো অদ্ভুত রকমের। যেমন কিছু জল-সন্ধানী ‘ওয়াই’ আকারের একটা গাছের ডাল মাটিতে বুলিয়ে তার কাঁপুনি বুঝতে চেষ্টা করে। মাটির নিচে যেখানে জল আছে সেখানে নাকি কাঁপুনি অন্যরকম হয়। কেউ আবার কিছু পাথর, নারকেল, চুম্বক এসব নিয়ে তুকতাক করে। যাইহোক এসব যে সবসময় সফল হবে এমন কথা আগেও ছিল না, এখনো নেই। এর থেকে আর একটু ভালো উপায়, অন্তত আমার মনে হয়েছিল, আশপাশের আগাছা, ঘাস এসব ভালো করে লক্ষ্য করা। নিচে জল থাকলে পাতা বেশি সজীব আর সবুজ হতে পারে। তবু ঠিক কোনখানটা খুঁড়তে হবে তা বলা কঠিন। বিশেষ করে শুকনো মরুভূমির মতো জায়গায়।
সবকিছু শুনে এবং জায়গাটা ঘুরে দেখে সুবোধদার কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়ল। ঘরের ভেতর যখন পায়চারি করছিলেন তখন সুবোধদাকে ব্যোমকেশ কিংবা ফেলুদার মতো মনে হচ্ছিল। কী করে বোঝা যাবে কোথায় মাটির নিচে কম গভীরতায় জল আছে? বেশি গভীরে বা দুতিনটে জায়গায় খুঁড়তে হলে তো বিরাট লোকসান হয়ে যাবে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে চায়ের কাপটা শেষ করে সুবোধদা বললেন – “এখনই কাজ শুরু করা যাবে না। মনে রাখতে হবে এটা বড় শুকনো জায়গা, এখানে অন্য জায়গার মতো খুঁড়লেই জল পাওয়া যাবে না।”
- “তাহলে?”
- “চল, একটু ঘুরে আসা যাক। পাকা একজন জল-সন্ধানীর সন্ধান করতে হবে রে।”
সুবোধদার ‘একটু ঘোরা’-তে আমার পা টনটন করতে লাগল। তা অন্তত মাইল দশেক হাঁটিয়েছে আমাকে। আশপাশের তিন-চারটে গাঁ খুঁজে তেমন কিছু না পেয়ে আমরা একটা দোকানে বসে রুটি আর ডাল খাচ্ছিলাম। দোকানের মালিকের কাছে জল খোঁজা নিয়ে সুবোধদা কিছু খবর যোগাড় করলেন বলে মনে হলো। লোকটার সঙ্গে সুবোধদার ঠিক কী যে কথা হলো কে জানে – তবে আবার হাঁটা শুরু হলো আমাদের! বেশ খানিকটা হেঁটে আমরা এবার বিচিত্র একটা জায়গায় এসে পড়লাম। এ ধরনের আয়োজন মেলাটেলায় দেখা যায়। কটা জন্তু জানোয়ার নিয়ে তাঁবু খাটিয়ে ছোট সার্কাসের মতো ব্যাপার। সার্কাস কদিনের ভেতর শুরু হবে, যোগাড়-যন্ত্র হচ্ছে। এখানে কী করতে এসেছে সুবোধদা? আমার পা আর চলতে চাইছে না, যে কোনো সময় ‘ব্রেক-ডাউন’ হয়ে যেতে পারে। বুনো হাঁসের পেছনে মিছিমিছি আর কত যে ছুটতে হবে কে জানে।
সুবোধদা মালিকের সঙ্গে কীসব কথা বললেন। মালিক গলা তুলে ডাকলেন – “এ নীলো, নীলোমাধাব …”
ছেলেটা মোটামুটি আমার বয়সীই হবে। রোগা, লম্বা চেহারা। খালি গা, কোমরে একটা ধূতি আঁটসাঁট করে জড়িয়েছে, হাতে লাঠি। সার্কাসের খেলা অভ্যাস করছিল মনে হলো। মালিক বললেন –“এই ছেলেটা যাবে। রাস্তা বুঝিয়ে দাও একে। নীলো .. তোর কিছু লাগবে তো বলে দে …”
নীলো দুটো আঙ্গুল দেখালো শুধু। পরে দেখেছিলাম ছেলেটা বোবা, যদিও শুনতে পায়।
মালিক বুঝিয়ে দিলেন – “দুটো জ্যান্ত মুরগি লাগবে।”
সুবোধদা বললেন – “আর পারিশ্রমিক?”
দূরের দিকে চেয়ে মালিক বললেন –“না, ওসব লাগবে না। জল খোঁজা তো মানুষের ভালোর জন্যে, ও কাজে পয়সা নিতে নেই।”
ফেরার সময় সুবোধদা বলছিলেন যে একটা বড় ঝুঁকি নিতে হলো। এছাড়া তো উপায়ও দেখলাম না। তুই ওই পোস্ট-অফিস থেকে ফোন করে দে, খোঁড়াখুঁড়ির সব মালপত্তর, যেমন কথা হয়েছে, শহর থেকে যেন ট্রাকে পাঠিয়ে দেয়।
***
আজ ‘নীলোমাধাব’-এর আসার কথা। গাঁ থেকে দুটো মুরগি জোগাড় করা হয়েছে। সে বেচারিরা কক কক করে হয় প্রতিবাদ নয় মিনতি করছে - আমাদের ছেড়ে দাও। কাল শহর থেকে ট্রাক এসে সব পাইপ, বাঁশ, প্লাঞ্জার .. মানে যা যা লাগে নলকূপ খুঁড়তে – সব নামিয়ে রেখে গেছে। আমি সব গুণে বুঝে নিয়েছি। কাজ যে শুরু হবেই তা বলা হয়নি, কিন্তু কিছু মজুর চলে এসেছে। তাদের সবাইকে একধারে গাছের ছায়ায় বসতে বলেছি।
কটা বাজে তখন? এই সকাল আটটার কাছাকছি হবে, কিন্তু এসব জায়গায় মনে হয় দুপুর বেলা। এত রোদ্দুর। আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে প্রথমে আলো তারপর শব্দ শোনা যায়। কিন্ত এখানে তার উল্টো হলো। ওদিকের রাস্তায় একটা ঘটর ঘটর আওয়াজ শুনলাম। রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো, পাথরে ভর্তি। কিছুক্ষণ আওয়াজ হওয়ার পর নীলমাধবকে দেখা গেল। একটা চাকা লাগানো চৌকো জিনিস টেনে নিয়ে আসছে। ওতে নিশ্চয় ওর জল-সন্ধানের জিনিসপত্র রয়েছে। কাছে আসতে দেখলাম বাক্সটা চটের বস্তা দিয়ে ঢাকা।
এসেই সে কাজে লেগে গেল। চটের থলিতে মোড়া একটা শাবল বার করল। তারপর চারপাশটা খুব মন দিয়ে জরিপ করতে লাগলো। বেশ খানিক্ষণ দেখার পর শাবল দিয়ে একটু দূরে দূরে তিনটে কড়াইএর মতো গর্ত করল। কড়াই মানে ধর বিয়ে বাড়ির রান্নার কড়াই এর মত বড়।
এবার যা হলো তা আমার সেই দিন থেকে আজ অবধি শুধু নয়, সারা জীবন মনে থাকবে।
ছেলেটা ইশারায় একটা মুরগি চেয়ে নিল। তখনই বুঝলাম ছেলেটা বোবা। মুরগিটা হাতে নিয়ে সে চটের ঢাকাটা খুলল। শুধু আমি নয়, সকলে সভয় দেখল বাক্সটা আসলে একটা লোহার গরাদ দেওয়া খাঁচা। ভেতরে কালোর ওপরে সবজেটে ছাপছাপ ডিজাইনওয়ালা একটা বিরাট মোটা জ্যান্ত সাপ। অজগর। আমরা দু-তিন পা পেছিয়ে এলাম। সুবোধদাও। বসে থাকা মজুররা ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়াল।
ছেলেটার অবশ্য আমাদের দিকে কোনো মনোযোগ নেই। সে নিজের কাজ করে যাচ্ছে। গরাদের ফাঁক দিয়ে মুরগিটাকে খাঁচার ভেতরে ফেলে দিল।
বেচারি মুরগি একটু পাখা ঝটপট করল বটে কিন্তু সামনে সাক্ষাৎ যমরাজকে দেখে শান্ত হয়ে এককোণে জড়সড় হয়ে বসে থাকল। সর্পরাজ তার পুঁতির মতো চোখ দিয়ে খাবারটা দেখল। পরের মুহূর্তে দেখলাম তার বিরাট হাঁ-এর ভেতর মুরগি ঢুকে গেছে … কয়েকটা পালক পড়ে থাকল খাঁচায় … তাছাড়া মুরগিটার আর কোনো চিহ্ন রইল না।
এক প্রাণী আরেক প্রাণীকে খায়, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু একেবারে চোখের সামনে দৃশ্যটা দেখে মনে হলো প্রকৃতি বড় নিষ্ঠুর। সাপটার ওপর বড় রাগ হচ্ছিল।
অবশ্য তখনো আরো অবাক করা ঘটনা ঘটা বাকি।
নীলমাধব খাঁচাটা খুলে দিল। সর্পরাজ আড়ামোড়া ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বেরিয়ে আসলেন। প্রথম বার শুধু দুতিন পা পেছিয়েছিলাম, এবার একটা পেছন দিকে উল্টো লাফ লাগালাম। বাপ রে! বেরিয়ে আসাতে পুরো চেহারাটা দেখা যাচ্ছে, উফ্, একটা সাপ এত বড় হতে পারে!
বাইরে গরম। তাই বোধহয় সাপ বাবাজি খাঁচাতেই ফিরতে চাইছিলেন, কিন্তু ছেলেটা ততক্ষণে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে। একটা ছোট কঞ্চি দিয়ে সাপটাকে সে থামতে দিচ্ছিল না। যেন গোরু চরাচ্ছে!
এই তো খেয়েছে, পেট ভর্তি। সাপটা নড়তেচড়তে চাইছিল না। কুণ্ডলি পাকিয়ে আরামের জায়গা খুঁজছিল। তাড়া খেয়ে বাধ্য হয়ে ওকে এদিক-ওদিক চলতে হচ্ছিল। একটা কড়াইএর মতো গর্তের কাছে এসে মাথাটা নামিয়ে দেখল, কিন্তু জায়গাটা কুণ্ডলি পাকিয়ে থাকার জন্য ভালো হলেও সর্পরাজের ভালো লাগলো না। উঠে এল। নীলমাধব এবার তাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে আর একটা কড়াই-গর্তের কাছে নিয়ে এল।
কৌতুহলী জনতা পেছন পেছন এল মজা দেখতে তবে নিরাপদ দূরত্ব থেকে। আমার আর সুবোধদার কাছে এরা কাজ করবে, আমাদের সাহস যে একটু বেশি তা তো এদের দেখাতে হবে। নইলে আমাদের কথা যদি এরা না শুনতে চায়! আমরা তাই বীরের মতো ভিড় থেকে দু-তিন পা এগিয়ে দাঁড়ালাম। আমার অবশ্য দু-পা তফাতে থাকতেও ভয় করছিল, কে না জানে যে ছাগল দল থেকে বার হয় তাকেই বাঘে খায়। বর্ণ পরিচয়ের সেই ছবিটাও মনে পড়ছিল –‘অ এ অজগর আসছে তেড়ে!’
দু-নম্বর গর্তটা কিন্তু সর্পরাজের পছন্দ হলো। তবে গর্তটা একটু ছোট হওয়াতে তার পুরো শরীরটার জায়গা হলো না। পেট থেকে ল্যাজ অবধি বেশ খানিকটা আংশ সোজা হয়ে বাইরে থাকলেও বাকিটা বেশ পাকিয়ে নিয়ে সাপ বাবাজি গর্তের ভেতরে রয়ে গেলেন।
সাপ আর নড়াচড়ার নাম করে না। নীলমাধব পাশে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে সাপটার হাবভাব লক্ষ করল। যখন বুঝল যে সাপটা এ জায়গায় সত্যিই আরামে আছে তখন সে শাবলটা চটের থলিতে মুড়ে খাঁচা-গাড়িতে গুছিয়ে রাখল।
এই রে! এ তো ফিরে যাবার যোগাড় করছে! তার মানে জলটল বোধহয় এ অঞ্চলে নেই। আর নয়তো এ কিছুই খুঁজে পায়নি। সে নয় যা হবার হবে, কিন্তু নীলমাধব তার পোষ্যটিকে রেখে যাবে নাকি? মুরগি তো আর একটাই আছে, সেটা খাওয়া হয়ে গেলে সাপের খিদে কে মেটাবে। অজগর যদি তখন আমাদের হাত-পা ধরে টানাটানি করে কিংবা আমাদের পেঁচিয়ে ধরে … উফ, কেন যে সুবোধদা বারবার আমাকেই সব জায়গায় নিয়ে আসে। অন্য অনেকে তো ছিল…
নীলমাধব দু-নম্বর মুরগিটা চাইল। সাপ বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই কুম্ভকর্ণ সর্পরাজের মুখের সামনে মুরগিটা দোলাতেই তিনি নড়েচড়ে উঠলেন। এবার ‘আবোল-তাবোল’এর খুড়োর কলের মত মুরগি ঝুলিয়ে নীলমাধব সাপটাকে দিব্যি খাঁচা অবধি নিয়ে এল। মুরগিটা খাঁচার ভেতরে ফেলতেই সাপ বাবাজি নিজে নিজেই খাঁচায় ঢুকে গেল। স্বাধীনতার থেকে এ প্রাণীটি খাবারই বেশি পছন্দ করে তাহলে।
খাঁচার ছিটকিনি লাগিয়ে নীলমাধব আমাদের কাছে এসে দাঁড়ালো। কথা সে বলতে পারে না। তাই কিছু অঙ্গভঙ্গী আর খানিকটা অ অ ব ব এরকম শব্দ করে সে আমাদের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল। সারমর্ম হলো:
এই সাপ ভরপেট খাওয়ার পরে যেখানে মাটির নিচে জল আছে সেখানেই বিশ্রাম নিতে চায়। এদের গোটা শরীর সবসময় মাটি ছুঁয়ে থাকে, তাই এরা নাকি মাটির সব কথা শুনতে পায়। মাটির নিচে কোথায় জল আছে বুঝতে পারে। এরা কখনো কোনোদিন ভুল করে না। এই জায়গাটাই খুঁড়তে হবে তোমাদের। একটু নিচেই জল আছে। নিশ্চয় আছে।
নীলমাধব চলে গেল।
মনে হলো এর কথা সুবোধদার বিশ্বাস হয়েছে, তাই একটু নিশ্চিন্ত হয়েছেন। আমিও নিশ্চিন্ত, তবে কারণ হলো পেটমোটা সাপটা বিদায় হয়েছে।
****
বেলার দিকে কাজে নামলাম। তিনটা লম্বা লম্বা বাঁশ পুঁতে ফুট কুড়ি উঁচুতে মাচা বসানো হলো। কপিকল, দড়িদড়া, কেসিং টিউব, প্লাঞ্জার সব লাগিয়ে দুর্গাদুর্গা বলে শুরু হলো কাজ।
প্লাঞ্জারের ভেতরটা ফাঁপা আর মুখটা খুব শক্ত ইষ্পাতের তৈরি। প্লাঞ্জারটা ঘা মেরে মেরে মাটিতে ঢোকানো হয়। কিছুক্ষণ পরে পরে সেটা তুলে ভেতরের মাটি বার করে দেওয়ার নিয়ম। সে মাটির চেহারা দেখে বোঝা যায় জল পেতে আর কত দূর খুড়তে হবে।
সারাদিন ধরে খোঁড়ার কাজ চলল। জল পাওয়া যায় নি। তাই আবার পরের দিন ভোর থেকে কাজ শুরু। যখন সূর্য হেলে পড়েছে, তখন সুবোধদা প্লাঞ্জারের মাটির নমুনা দেখে হইহই করে উঠলেন। জল আছে জল আছে .. দেখ মাটি কেমন নরম …।
আর কিছুক্ষণের মধ্যেই জল পাওয়া গেল। পাইপ লাগাতেই পাইপ বেয়ে জল উঠে এলো। প্রথম দিকের জলে কাদামাটি থাকে বলে নিয়মমত ওটা পাম্প লাগিয়ে বার করে দিতে হয়। ডিজেল-চালিত পাম্প লাগাতেই নল দিয়ে ফোয়ারার মত জল বেরোতে লাগলো।
আমার খালি ওই অজগর সাপটার কথা মনে হচ্ছিল। কীভাবে নিরীহ মুরগিটাকে গিলে ফেলল …। কিন্তু সেই সাপটাই তো জল খুঁজে দিল, এতোগুলো লোকের কত ভালো হলো। প্রকৃতি একদিকে নিষ্ঠুর আর একদিকে কল্যাণময়।
সে কী দৃশ্য। জল পাওয়া গেছে খবর পেয়ে গাঁ থেকে মেয়ে-পুরুষ-শিশু সবাই ছুটে আসছে। ফোয়ারার নিচে সকলে জলে ভিজছে আর নাচছে। একটা লোক আবার গানও ধরল! সুবোধদা আমাকে জলের মধ্যে টেনে নিয়ে গেলেন।
- “আরে, জামাপ্যান্ট সব ভিজে যাবে যে …”
- “ছাড় তোর জামা-কাপড়। গুপ্তধনের ভাগ নিবি না?”
- “গুপ্তধন?”
-“আরে জলই হলো মরুভূমির গুপ্তধন। দ্যখ জলের ফোঁটাগুলো অস্তসূর্যের আলোতে কী দারুণ দেখাচ্ছে!”
জলের ফোয়ারায় ভিজে যেতে যেতে দেখলাম, জলের ছোটবড় কণাগুলো শেষবেলার আলোতে লক্ষকোটি মণিমুক্তো হিরে-জহরতের মতোই ঝকমক করছে। মাটির নিচে থেকে আকাশের দিকে উঠে আবার মাটিতে নামছে। জলের নাম জীবন। এই তো আসল গুপ্তধন। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম জলের কাছে মণিমুক্ত হিরে-জহরতের দাম কানাকড়িও নয়।