• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৬ | এপ্রিল ২০২২ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • নতুন জীবন : অনন্যা দাশ



    মাঝরাতে ব্যাটমানের ডাকে রাজুর ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। এত রাতে কেন চেঁচাচ্ছে রে বাবা? অন্য কোনদিন তো এই রকম করেনি। বিছানায় উঠে বসল রাজু। ঘুমটা চলে গেছে। এমনিতেও এখন গরমের ছুটি চলছে তাই কাল সকাল নটা পর্যন্ত ঘুমোলেও কেউ কিছু বলবে না। সেই ভেবেই রাজু বিছানা থেকে নেমে পড়ল। গলাটাও শুকিয়ে গেছে। জল খেতে হবে।

    গরমের ছুটিতে রাজু মামার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। মামা থাকেন গ্রামের বাড়িতে। চারিদিকে প্রচুর সবুজ, ফলের গাছ, সব্জির গাছ, বাড়ির পিছনে পুকুর, সেই পুকুরে মাছ, তা ছাড়া গরু, বাছুর, মুর্গি সবকিছু রয়েছে। বেশ মজাই হচ্ছে রাজুর, ওদের শহরের জীবনের থেকে একদম আলাদা এখানকার জীবন। একটা গরুর বাচ্চা হয়েছে। সেই বাছুরটারই নাম ব্যাটম্যান দিয়েছে রাজু, কুচকুচে কালো তার রং বলে। সারা দিন মামা-মামিমার পিছন পিছন ঘুরে সব পোষ্যদের দেখতে দেখতেই রাজুর সময় কেটে যায়। শনি-রবিবার মামাতো দাদা টিটুদা বাড়ি ফেরে। দাদা শহরে চাকরি করে কিন্তু উইকেন্ড করে বাড়ি আসা চাইই চাই তার। বলে ওই অক্সিজেনটুকু না হলে বাঁচবে না। তখন দাদার সঙ্গে হইচই খাওয়াদাওয়া গল্পও হয় জমিয়ে। তবে এখানে রাতে সবাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে পরদিন ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠতে হয় বলে। রাজুদের শহুরে জীবনের থেকে বেশ অন্যরকম, কিন্তু মন্দ লাগে না রাজুর।

    জল খেয়ে টর্চটা তুলে নিয়ে গোয়ালের দিকে চলল রাজু। অন্ধকারে বাথরুম ইত্যাদি যাওয়ার সুবিধার জন্যে মামা ওকে টর্চটা সঙ্গে রাখতে দিয়েছেন। সেটা নিয়েই বেরিয়ে পড়ল রাজু। ভয় পেলে চলবে না, ব্যাটম্যান কেন চেঁচাচ্ছে সেটা দেখতে হবে।

    বাড়ি থেকে বেরিয়ে গোয়ালের দিকে যেতে যেতে অন্ধকারে চোখ সয়ে গেল রাজুর, টর্চ আর জ্বালাতে হল না। হঠাৎ লোকটাকে দেখতে পেল সে! পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে ছিল, এবার বসে পড়ল। কী করছে লোকটা? জলে হাত দিয়ে কিছু গুলছে নাকি জলে? রাজু চমকে উঠল। সে বুঝতে পারল লোকটা কী করছে। মামাদের পুকুরে বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে লোকটা! মামার কাছে গল্প শুনেছে রাজু যে আগেও ওই রকম হয়েছে। হিংসে আর শত্রুতার জেরে লোকে ওইসব করে; মামা বলছিলেন। পুকুরের সব মাছ মরে যায় তাতে, প্রচুর লোকসান হয়। খুব বিশ্রী ব্যাপার। এদিকে লোকটাও রাজুকে দেখতে পেয়েছে।

    বিদ্যুতের বেগে সে রাজুর কাছে চলে এল। ওকে জাপটে ধরে বলল, “খবরদার কাউকে কিছু বলবি না কী দেখেছিস! যদি বলেছিস তাহলে কাল রাতের বেলা এসে তোদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবো! তোর মামার পেয়ারের গরুগুলোকেও শেষ করে দেবো। ক্ষতি করা খুব সহজ, বুঝেছিস? তুই চিন্তাও করতে পারবি না এমন ক্ষতি করব তোদের, বুঝেছিস? তুই শহর থেকে এসেছিস চুপচাপ মুখ বন্ধ করে শহরে ফিরে যাবি, মুখ খুললেই সর্বনাশ!” ফ্যাসফ্যাসে গলায় লোকটা বলল। ওর গায়ে কেমন একটা আঁশটে গন্ধ। রাজুর গা গুলিয়ে উঠছিল, ভয়ও লাগছিল খুব।

    তবে ওর গলা শুনে রাজু এবার বুঝতে পারল লোকটা কে। কয়েকদিন আগে ঝড়ে আউটহাউসের দেওয়ালের ক্ষতি হয়েছিল সেটা ঠিক করার জন্যে দুজন এসেছিল, এই লোকটা তাদেরই একজন। মামা বলেছিলেন ওরা টাকার বিনিময়ে ছোটখাট কাজ করে। ওর ওই ফ্যাসফ্যাসে গলার স্বরের জন্যেই রাজু চিনতে পারল ওকে।

    রাজু কিছু বলছে না দেখে লোকটা আবার বলল, “কি রে? কিছু বলছিস না কেন? দেবো নাকি গলাটা কেটে?” রাজু ভয়ে ভয়ে দেখল রাতের অন্ধকারেও ওর হাতের ছোরাটা ঝলসে উঠছে!

    ওর হাত-পা ভয়ে কাঁপছিল, কোনমতে অস্ফুট স্বরে রাজু বলল, “বলব না, কাউকে কিছু বলব না।”

    “মনে থাকে যেন!” বলে লোকটা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

    সেদিন রাতে আর ঘুম হল না রাজুর। পরদিন সকালে উঠে মামা-মামিমা দেখতে পেলেন যে পুকুরের সব মাছ মরে গিয়ে ভেসে উঠেছে। সবারই খুব মন খারাপ তাই রাজুর মন খারাপ আলাদা করে কারো চোখে পড়ল না। আশপাশের অনেক গরিব মানুষরা এসে সেই মাছই নিয়ে গেল।

    মামা দুঃখ করে বললেন, “রাজু, তোকে বাজার থেকে কিনে এনে মাছ খাওয়াতে হবে রে, পুকুরের মাছ আর খাওয়াতে পারব না! কেন যে এরা এই রকম করে।”

    মামিমা জিজ্ঞেস করলেন, “কে করিয়েছে বলে মনে হয়?”

    মামা বললেন, “বীরেনের কাজ বলেই তো মনে হচ্ছে।”

    তাই শুনে রাজু খুব আশ্চর্য হয়ে বলল, “বীরেন? মানে বীরেন ভট্টাচার্য? যাঁর নাতির পৈতেতে সেদিন গিয়েছিলাম? তিনি তো বিশাল বড়োলোক, তিনি এসে ওই সব করবেন?”

    মামা অত মনখারাপের মধ্যেও হেসে ফেললেন, “না, না বীরেনকে আসতে হয় না। এখানকার মানুষজন খুব গরিব। খুব অল্প পয়সার জন্যেই ওই ঘৃণ্য কাজটা করতে রাজি হয়ে গেছে নিশ্চয়ই কেউ মনে হয়। বীরেনের বরাবরই আমার ওপর খুব হিংসে। ওর ছেলেটা তো মানুষ হল না, বাড়িতেই বসে থাকে। তার মধ্যেই তার বিয়েও দিয়ে দিয়েছেন। এদিকে টিটু ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ভালো চাকরি করছে সেটা শুনলেই হিংসেতে জ্বলে-পুড়ে মরে বীরেন। তবে এটা আমার অনুমান মাত্র। অন্য কেউও হতে পারে। যাক ও নিয়ে ভেবে আর কাজ নেই। যা হওয়ার হয়ে গেছে।”

    ওই ঘটনাটার পর দুয়েকবার রাস্তা ঘাটে লোকটাকে দেখতে পেয়েছিল রাজু। দেখেই দে ছুট! যদিও কাউকেই কিছু বলেনি সে তাও ওর সামনেই আর পড়তে চায়নি।

    রাজু কলকাতা ফিরে যাওয়ার তিন দিন আগে ঘটনাটা ঘটল। দুপুর বেলা খাওয়াদাওয়া সেরে টিটুদার একটা বই নিয়ে পড়ছিল রাজু। মামা-মামিমা টিভি দেখছিলেন এমন সময় কাজের লোক শম্ভু এসে বলল, “বাবু, ওই রঘু এসেছে। আপনাকে ডাকছে। খুব কাঁদছে।”

    “সেকি কাঁদছে কেন?” মামা জিজ্ঞেস করলেন।

    “আমাকে তো কিছু বলল না, আপনাকে ডাকছে,” শম্ভু বলল।

    মামার পিছন পিছন রাজুও গেল কে এসেছে দেখতে। সামনের দাওয়ায় গিয়েই চমকে উঠল! আরে এটা তো সেই লোকটা, যে মামাদের পুকুরে বিষ মিশিয়েছিল! ওর নাম বুঝি রঘু! মামাকে দেখেই হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠল লোকটা।

    যা বলল তাতে বোঝা গেল ওর ছেলেটা সাইকেল নিয়ে কোথাও যাচ্ছিল এমন সময় রাস্তায় একটা গাড়ির সঙ্গে তার ধাক্কা লেগেছে। খুব চোট পেয়েছে সে। অনেক রক্ত ক্ষয় হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে তাকে কিন্তু ডাক্তার বলেছেন যে তার রক্ত লাগবে। রক্ত না দিলে সে বাঁচবে না। এদিকে হাসপাতালের স্টকে ওই গ্রুপের রক্ত নেই, দু’ঘন্টা দূরের বড়ো হাসপাতাল থেকে রক্ত নিয়ে আসতে হবে। রঘুর কাছে সেই পয়সাও নেই যে গাড়ি ভাড়া করে সেখান থেকে রক্ত আনবে তাই সে মামার কাছে এসেছে কিছু টাকা চাইতে।

    শম্ভু দাঁড়িয়ে সব শুনছিল, সে এবার বলল, “কেন ওই বীরেন ভট্টর হয়ে তো কাজ করো বাপু! অনেক খারাপ কাজও করো আমি জানি! তাহলে তাকেই বলো না টাকা দিতে!”

    রঘু তাই শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলল, “গিয়েছিলাম, তাড়িয়ে দিলো ওরা! ছেলেটার বয়স মোটে আঠেরো বছর, রক্ত না পেলে সে মরে যাবে বাবু!”

    রাজুর এক লহমার জন্যে মনে হয়েছিল বলবে, “তোমার পাপের ফল হবে সেটা!” কিন্তু নিজেকে সামলে নিল সে। একজন লোককে ওই ভাবে কাঁদতে দেখে কেমন একটা লাগছিল। একটু ভেবে নিয়েই সে ঠিক করে ফেলল কী করবে। এক ছুটে ঘরে গিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে যা টাকা ছিল বার করে নিয়ে এল। নেহাত কম টাকা নয়। বাবা এখানে এসে খরচ করার জন্যে টাকা দিয়েছিলেন, তাছাড়া মাসি আর অন্য আত্মীয়রাও জামা কেনার জন্যে, মিষ্টি খাওয়ার জন্যে যা টাকা দিয়েছিলেন সব কিছু নিয়ে এসে লোকটার হাতে দিয়ে বলল, “এই নাও। এটা তুমি নাও, তোমার ছেলেটাকে বাঁচাও। তবে চেষ্টা কোরো আর কখনও বাজে কাজ না করতে!”

    ওর দেখাদেখি মামাও কিছু টাকা দিলেন। লোকটা ওদের দুজনকে প্রণাম করে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।

    ##

    কলকাতা ফিরে যাওয়ার কয়েকদিন পরে মামা ফোন করে রাজুকে বললেন, “জানিস রাজু, রঘুবীরের ছেলেটা বেঁচে গেছে। আজ সকালে রঘু এসেছিল মিষ্টি নিয়ে। তোকে খুঁজছিল। আমি তো বললাম তুই কলকাতা ফিরে গেছিস। তাই শুনে বলল, ‘রাজুদাদাকে আমার প্রণাম দেবেন।’ সেটা শুনে টিটো তো হেসেই খুন। তবে তুই টাকাটা দিয়ে খুব ভালো কাজ করেছিলি জানিস। তুই আগ বাড়িয়ে টাকা না দিলে আমি কী করতাম কে জানে! রঘুই বলছিল সেদিন ওই হাসপাতালে আরেকটা অ্যাক্সিডেন্টের কেস ভর্তি হয়েছিল। তারও রক্তের দরকার ছিল। তার বাড়ির লোকজন আর টাকা জোগাড় করে উঠতে পারেনি তাই সেই ছেলেটা মারা গেছে! সেটা বলতে বলতে কেঁদে ফেলছিল রে। যাই হোক রঘু বলেছে সে আর বীরেন ভট্টাচার্যের হয়ে কাজ করে না। মানে বলতে চাইছিল যে বাজে কাজ করে না মনে হয়, তুই বলেছিলি না? সে এখন ঘোষ ময়রাদের দোকানে কাজ নিয়েছে।”

    মামার সঙ্গে কথা বলে রাজুর মনটা খুশিতে ভরে গেল। কথা বলা শেষ হতে রাজু মাকে গিয়ে বলল, “মা, মিলিমাসিকে বোলো মাসির দেওয়া টাকাটা আমার জন্যে জামাকাপড় বা মিষ্টির চেয়ে অনেক বেশি ভালো কাজে লেগেছে এবার!”



    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments