ভেবে দেখতে গেলে উভয়েরই মুখ্য উদ্দেশ্য কিন্তু এক। সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশ। লেখক লেখিকা ও পাঠককুলের সংযোগ সাধন।
যেকোন প্রকার ম্যাগাজিন--তা ছাপাই হোক আর ওয়েবজিনই হোক, এই আলোচনায় প্রধানত তিনটি দিক থেকে বিষয়টি আলোচিত হবে।
তিন দিক থেকে একে আমরা দেখতে চেষ্টা করব।
১) পাঠকের দিক থেকে
২) লেখকের দিক থেকে
৩) প্রকাশকের দিক থেকে
(উল্লেখ্য, এখানে আমি জেন্ডার পার্থক্যের মধ্যে না গিয়ে, প্রথাগত শব্দ, শুধুমাত্র লেখার সুবিধার জন্যে ব্যবহার করছি।) পাঠকের দিক থেকে বাংলা ওয়েবজিন বা প্রিন্টেড ম্যগাজিন, কোনটি বেশি আকর্ষণীয়? গ্রাহ্য? কোন ফর্মটি বেশি আকর্ষণীয় এবং উভয়ের সুবিধা অসুবিধাগুলিই বা কী ইত্যাদি প্রভৃতি এই অংশের আলোচ্য বিষয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ে লেখকের সুবিধা-অসুবিধা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত আবেগ, তাঁদের অর্থকরী দিক ইত্যাদির আলোচনা দরকার।
তৃতীয় আরো একটি দিকে নজর দেওয়া অতি আবশ্যক, এবং সেটি হচ্ছে প্রকাশকের দিক। কারণ গুটিকতক মাত্র সাহিত্যসেবী প্রকাশক ছাড়া প্রকাশনা তাঁদের রুজিরুটি সংস্থানের উপায়ও বটে। সুতরাং প্রিন্টেড ম্যাগাজিন ও ওয়েবজিনের আলোচনায় সেদিকটাও বাদ দেওয়া চলে না।
এ আলোচনার উপসংহার কী হবে, বা আদৌ কোন সর্বজনমান্য সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যাবে কি না, তাতো আলোচনার পরেই বোঝা যাবে।
তবে বর্তমান সময়ে এই আলোচনাটি যে খুবই জরুরি, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ বা দ্বিধা নেই।
পাঠকের দিক থেকে প্রিন্টেড ম্যাগাজিন ও ওয়েবজিনের আলোচনার ক্ষেত্রে ‘পাঠক’, এই ছাতার নীচে পাঠক সমুদয়কে এনে ফেলাটা অতিসামান্যীকরণ দোষে দুষ্ট হয়ে যেতে পারে। যিনি পড়ছেন তিনিই পাঠক, এটা যেমন সত্যি তেমনই পাঠক বয়স, রুচি, সামর্থ্য ভেদে আবার বিশেষিতও হয়ে থাকেন। একজন বাচ্চার যা ভালো লাগে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের তা হয়তো ভালো লাগে না। কেউ বা আবার ভ্রমণের খবরাখবর জানতে আগ্রহী। রাজনৈতিক আলোচনা, বিশ্বের অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা, নতুন বইএর আলোচনা এসবও যারা ম্যাগাজিন বা ওয়েবজিনের পাঠক তাদের আকর্ষণ করে। আর কবিতা, বড় গল্প, ছোট গল্প, ধারাবাহিক উপন্যাসের পাঠক সবথেকে বেশি, এ কথা বোধহয় নির্দ্বিধায় বলা যায়। প্রিন্টেড ম্যাগাজিনে আজকাল বেশিরভাগ সময়েই এর সবগুলিই, অথবা অনেকগুলিই একই মলাটের ভেতর পাওয়া যায়।
ওয়েবজিনের ক্ষেত্রেও অনেকাংশে তাই। তবে ওয়েবজিন প্রিন্টেড ম্যাগাজিনের থেকে এ বিষয়ে নিজেকে আলাদা করে নিতে পারে। সবকিছু একটি মলাটের মধ্যে না দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ের জন্য বিভিন্ন ওয়েবজিন থাকাটা পাঠকের পক্ষে অনেক সুবিধাজনক হবে বলে মনে হয়।
ওয়েবজিনের ক্ষেত্রে পাঠকের, অন্তত কিছু পাঠকের যারা একটু বয়স্ক বা মোবাইল ব্যবহারে খুব একটা সড়গড় নন তাঁদের পক্ষে ওয়েবজিন পড়া একটু অসুবিধাজনক হয়ে যায়। অনেক সময়েই লেখা দুপাশ থেকে কেটে কেটে যায়, হঠাৎ কোথায় যেন হাত লেগে সব ব্যাপারটা উলোটপালোট হয়ে যায়। আর বড় গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস হলে তো কথাই নেই। কী করে যে হুড়হুড় করে উঠে গিয়ে প্রথম পাতাটা বারেবারে চলে আসে, সে এক আশ্চর্য রহস্য! আর এভাবে পড়াটা এতই বিরক্তিকর যে এতে পড়ার ইচ্ছেটাই নষ্ট হয়ে যায়। তবে এটি এখনকার কথা। আজ যে সব বাচ্চারা মোবাইল হাতে বড় হচ্ছে, তাদের এ অসুবিধা বোধহয় থাকবে না। তাই ওয়েবজিনের একচ্ছত্র সাম্রাজ্য হয়তো শুধুই সময়ের অপেক্ষা।
প্রিন্টেড ম্যাগাজিনে অবশ্য বর্তমানকালীন যে অসুবিধাগুলির কথা বলা হল সে সব ঝামেলা নেই।
কিন্তু বেশ কিছু অসুবিধা প্রিন্টেড ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রেও আছে।
প্রিন্টেড ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে নিজের প্রিয় বা প্রয়োজনীয় লেখাগুলি দীর্ঘদিন নিজের সংগ্রহে রাখা খুবই অসুবিধাজনক। জায়গার অভাব, পোকামাকড়ের উপদ্রব, কাগজ ছিঁড়ে যাওয়া, নষ্ট হয়ে যাওয়া--ঝামেলা অনেক।
ওয়েবজিনের ক্ষেত্রে এসব ঝামেলা নেই। নিজের পছন্দের বা প্রয়োজনের লেখাটি যখন ইচ্ছে পড়ে নিলেই হলো। ট্রাম, বাস, ট্রেন প্লেন, দাঁড়িয়ে, বসে যেকোন অবস্থাতেই ওয়েবজিন পড়া যায়। তাই প্রয়োজনে সহজলভ্যতা ওয়েবজিনের একটি বিরাট সুবিধার দিক।
পাঠকের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে তো কিছু কথা হলো, এবার আসা যাক লেখকের দিকে।
প্রথমেই বলি, মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে নিজের নাম ও লেখা কাগজের উপর ছাপার অক্ষরে দেখা লেখককে আনন্দ ও আবেগের চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে যায়। তাই, অন্তত এখন পর্যন্ত প্রিন্টেড ম্যাগাজিনে নিজের লেখা দেখা ওয়েবজিনে দেখার থেকে অনেক বেশি সুখদায়ক। তাই অনেক লেখকই তাঁর সেরাটি প্রিন্টেড ম্যাগাজিনের জন্য রেখে দেন। আমি অবশ্যই আমাদের দেশের লোকেদের কথা বলছি। বিদেশী লেখকরা এই আলোচনায় আসছেন না।
তবে লেখকদের এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি সাম্প্রতিক কালে পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে বলে মনে হয়। এর অন্যতম প্রধান কারণ তো কোভিড অতিমারী বটেই, কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়। অতিমারীর পরিস্থিতি না এলেও, লেখকরা বুঝতে শুরু করেছেন যে যতো লোক লিখতে চান, পারেন, ভালো লেখেন তার তুলনায় প্রিন্টেড ম্যাগাজিনের সংখ্যা অতি নগণ্য। কাগজের বর্ধিত দাম অনেক সময় প্রিন্টেড ম্যাগাজিনের কলেবর বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে। দুঃখের সঙ্গে না বলে পারছি না, বিভিন্ন ম্যাগাজিন হাউসের কিছু বাছা পেটোয়া লেখককে অগ্রাধিকার দেওয়া, নতুন লেখকদের প্রতি উদাসীন থাকা, তাদের উৎসাহিত করার অনাগ্রহ বর্তমান। বহু অবহেলিত লেখকের প্রতিভা ওয়েবজিনের হাত ধরে শুধু যে প্রকাশিত হচ্ছে তাই নয়, ওয়েবজিন আন্তর্জাতিক ভাবে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা রাখায়, ওয়েবজিন লেখকদের লেখা অনেক বেশি সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। প্রিন্টেড ম্যাগাজিনের এ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা যে রয়েছে, তা অস্বীকার করা যায় না।
ওয়েবজিনের দৌলতে আমরা অনেক প্রতিভাবান সুলেখকের লেখা পড়ার সুযোগ পাচ্ছি। লেখকরাও নিজেদের সৃষ্টি জনসমক্ষে আনার সুযোগ পাচ্ছেন এবং এর দ্বারা বাংলা সাহিত্য যে আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে তা বলাই বাহুল্য।
ওয়েবজিনের আরেকটি সুবিধা হচ্ছে, পাঠকের পাঠ প্রতিক্রিয়া, মতামত লেখক অনেক তাড়াতাড়ি জানতে পারছেন। এমনকি কোনো একটি লেখা নিয়ে লেখক ও পাঠকদের সরাসরি মত বিনিময়, আলাপ-আলোচনা ওয়েবজিনে খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যেতে পারে এবং এর দ্বারা লেখক পাঠক উভয় পক্ষই লাভবান হবেন নিঃসন্দেহে। প্রিন্টেড ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে যা অতি সময়সাপেক্ষই শুধু নয়, এতটা আকর্ষণীয় হওয়াও সম্ভব নয়।
এবার প্রকাশকদের সুবিধা-অসুবিধার দিকটা দেখা যাক।
প্রকাশকের দিক থেকে প্রথম এবং সম্ভবত সব থেকে বড় সুবিধা হচ্ছে ব্যয় হ্রাস। সফটওয়্যার ইত্যাদিতে প্রাথমিকভাবে খরচাপাতি আছে বটে, তবে একবার চালু হয়ে গেলে, প্রিন্টেড ম্যাগাজিনের তুলনায় এর ঝামেলা ও খরচ দুইই কম।
প্রিন্টেড ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে ছাপার সুবিপুল খরচ ছাড়াও ডিসট্রিবিউটার বা নিউজ এজেন্টের মাধ্যমে বিক্রির একটা খরচ রয়েছে। অবিক্রিত ম্যাগাজিনগুলিও আর এক চিন্তার বিষয়। আর্থিক ক্ষতিও এর সঙ্গে জড়িত। ওয়েবজিনের এ ঝামেলা নেই। মুদ্রণ, সংরক্ষণ সব দিক থেকেই ওয়েবজিন এগিয়ে রয়েছে।
প্রকাশক চাইলে বেশ কিছু আকর্ষণীয় আ্যডভ্যারটাইসমেন্ট, ছোটদের পত্রিকা হলে তাতে আকর্ষণীয় ছোট ছোট ভিডিও দিয়ে ওয়েবজিনকে আরো বেশি আকর্ষক করে তুলতে পারেন।
মূল্য সমেত অথবা আর্থিক মূল্য অর্থাৎ দাম ছাড়াই ওয়েবজিনের সাবস্ক্রিপশনের ব্যবস্থা থাকতে পারে। যাতে কতজন সেই পত্রিকাটি পড়ছেন তার একটা ধারণা পাওয়া যায়। ওয়েবজিনের প্রচার যেহেতু মুখে মুখে বেশি ছড়ায়, তাই দশজনকে সাবসক্রাইব করতে দেখে ওয়েব পত্রিকাটির বিষয়ে আরও দশজনের কৌতূহল হতে পারে এবং তারা পড়ে, পছন্দ হলে সাবস্ক্রাইব করলে আরও পঞ্চাশ জন হয়তো পড়তে উৎসাহী হবেন। আসলে আমি যেটা বলতে চাইছি, ওয়েবজিনের ক্ষেত্রে সাবস্ক্রিপশনের একটি অপশন থাকা খুব দরকার। এতে প্রকাশক, লেখক, পাঠক সকলেই লাভবান হবেন। সাবস্ক্রিপশনের পরিমাণ আরো সাবস্ক্রিপশন ডেকে এনে ওয়েবপত্রিকাটিকে অধিকতর জনপ্রিয় করে তুলবে, এমনটি ভাবা যেতেই পারে।
প্রিন্টেড ম্যাগাজিন ও ডিজিটাল ম্যাগাজিনের মধ্যে বর্তমান কালে কোনটি অধিক গ্রহণীয় হচ্ছে তা বুঝতে হলে এই তুলনামূলক বিচারের ক্ষেত্রে ফিল্ড ওয়ার্কের মাধ্যমে পরিসংখ্যান জোগাড় করাটা খুব জরুরি। ভারতবর্ষে এ ধরনের কাজ খুব বেশি হয়েছে বলে, আমার অন্তত জানা নেই। ভারতের অধিকাংশ লোকের কাছেই, ডিজিটাল সাহিত্য বা ওয়েবজিনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপযোগী স্মার্ট ফোন, ট্যাবলেট ইত্যাদির যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তবে অতিমারীর সময় এই চিত্রটি কতটা পরিবর্তিত হয়েছে বা আদৌ হয়েছে কিনা তার একটি পরিসংখ্যান এই বিষয়ে নেওয়া প্রয়োজন বলেই মনে হয়।
তবে আন্তর্জালে প্রদত্ত একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৯ এর তুলনায় ২০২২এ ডিজিটাল মিডিয়াতে প্রিন্টেড মিডিয়ার তুলনায় আ্যডভার্টাইজমেন্ট-এ অনেক বেশি টাকা খরচ করা হয়েছে। এবং এর কারণ ডিজিটাল মিডিয়া, ওয়েবজিন যার অন্তর্গত, তার চাহিদা বৃদ্ধি। আমেরিকাতেও, বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী ডিজিটাল জগৎকেই ক্রমবর্ধমান বা গ্রোথ এরিয়া বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে এ বিষয়ে পৃথিবীর প্রত্যকটি দেশে বিস্তারিত গবেষণা হলে তবেই যথার্থ চিত্রটি পাওয়া যাবে। আর এ জন্য দরকার লেখক, পাঠক, প্রকাশক সমন্বয়ে যৌথ আলোচনা ও মতবিনিময়।
তবে একটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে আজও প্রিন্টেড ম্যাগাজিন, বিশেষত তা যদি সদ্য প্রকাশিত হয়, তার আনন্দই আলাদা। তবে এই আনন্দ যতটা না বাস্তবের জমিতে দাঁড়িয়ে আছে, তার থেকে অনেক বেশি মনস্তাত্ত্বিক অভ্যাস নির্ভর।
আজ থেকে কুড়ি বছর বাদে, আজকের শিশুরা যারা মোবাইল ঘেঁটেই বড় হচ্ছে, তাদের কাছে প্রিন্টেড ম্যাগাজিন সংক্রান্ত এই নস্টালজিয়া অর্থহীন লাগবে কি না কে বলতে পারে! কিন্ডল তো কাগজে ছাপা বইয়ের বিকল্প হয়েই উঠেছে।
(তথ্যসূত্র- অন্তর্জাল)