সদ্য বিগত বিংশ শতকের ‘মুক্তির দশক’ নামে চিহ্নিত দশকটি নিঃসন্দেহে সত্তরের দশক। সারা পৃথিবী জুড়েই অনেক পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছিল শিল্প, বিজ্ঞান, রাজনীতির জগতে। মানুষ তখন চাঁদে পাড়ি দিয়ে ফিরেছে, বিটলসের গানে পৃথিবী উত্তাল, সদ্য সদ্য জন্ম হয়েছে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের, নকশাল আন্দোলন স্তিমিত হয়ে এলেও তার আঁচ পাওয়া যাচ্ছে।
সেই সময় এক ব্রিটিশ সাংবাদিক তাঁর সাংবাদিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লিখে ফেললেন এক উপন্যাস। থ্রিলারধর্মী এই উপন্যাসটি আগের ঐতিহাসিক উপন্যাসের থেকে বেশ অন্যরকম। তার কাহিনি একেবারেই আধুনিক। এক ভাড়াটে খুনিকে ফরাসী রাষ্ট্রপতি চার্লস দ্য গলকে নিধনের উদ্দেশ্যে নিয়োগ করা হয়েছে। নিয়োগ করেছে একটি সন্ত্রাসবাদী দল। শেষপর্যন্ত অবশ্য ফ্রান্স পুলিশের অসামান্য কৃতিত্বে তা ব্যর্থ হবে। কিন্তু এই ‘চোর পুলিশ’ খেলার মধ্যেই বিধৃত থাকবে এক অসামান্য কাহিনি।
১৯৭১ সালে লিখিত ১,৪০,০০০ শব্দের এই উপন্যাসটি ছাপতে আগ্রহী হচ্ছিলেন না প্রকাশকরা। প্রকাশকদের দ্বিধার কারণটিও সম্পূর্ণ অমূলক নয়। প্রাক্তন ফরাসি রাষ্ট্রপ্রধান চার্লস দ্য গল তখনো জীবিত, তাঁর নিধন যে সম্পূর্ণ অসম্ভব সেটা তো সবাই জানবে। তাহলে এমন অবাস্তব থ্রিলার পড়তে পাঠকের কী দায় পড়বে? তাই যে প্রকাশক রাজি হন তিনিও দ্বিধাভরে অল্পসংখ্যক উপন্যাসই ছাপেন।
প্রথম উপন্যাসের সাফল্যের পর যখন দ্বিতীয় উপন্যাসের বিষয় নিয়ে ভাবছিলেন তখন তাঁর প্রকাশকের সঙ্গে কথা হয়। দুটি বিষয় লেখকের মাথায় ঘুরছিল –পলাতক, যুদ্ধাপরাধী এক নাৎসি অফিসারের খোঁজ আর আফ্রিকার যুদ্ধে ভাড়াটে সৈন্যদের কথা। প্রকাশক তাঁকে পরামর্শ দেন প্রথমে ঐ নাৎসি অফিসারের খোঁজ হোক, অন্য বিষয়টি পরে ভাবা যাবে।
১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় সেই দ্বিতীয় উপন্যাসটি। আগের বইটির মতই তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। সেইসঙ্গে পর পর দুটি আধুনিক ইতিহাসভিত্তিক কাহিনি লিখে জনমানসে বরাবরের মতই চিরস্থায়ী আসন লাভ করে ফেলেন লেখক ফ্রেডরিক ফরসিথ।
১৯৭৪ সালে এই কাহিনি অবলম্বনে যে সিনেমাটি হয় তা অবশ্য ছিল খুবই সরলীকৃত। তার আগের কাহিনি ‘ডে অব দ্য জ্যাকেল’ (১৯৭১) অবলম্বনে তৈরি কাহিনিচিত্রের (১৯৭৩) মত আদৌ হয়নি। না হলেও, এই কাহিনিচিত্রের এক ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল। সেটা যথাস্থানে বলা যাবে। বস্তুত এই প্রবন্ধ লেখার পিছনে সেই ঐতিহাসিক ঘটনারও বড় ভূমিকা আছে।
তার আগে একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক ‘ওডেসা ফাইল’ উপন্যাসের পটভূমি ও ঘটনাগুলিকে।
ওডেসা ফাইলের কাহিনি –
আলোচনার সুবিধার্থে কাহিনির সংক্ষিপ্তসার একটু বলে নেওয়া যাক। কাহিনির শুরু একটি ঐতিহাসিক ঘটনার রাতে – তারিখটি হল বাইশে নভেম্বর, ১৯৬৩। এইদিন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জন কেনেডি আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। পিটার মিলার নামক এক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক সেই রাতেই জানতে পারেন এক আত্মহত্যার কথা। হামবুর্গের এক বয়স্ক ইহুদি একটি ফ্ল্যাটে আত্মহত্যা করেন, ঘটনাচক্রে তাঁর ডায়রিটি এসে পড়ে মিলারের হাতে।
মিলার যুদ্ধপরবর্তী জার্মানিতে বড় হওয়া এক তরুণ। জার্মানির যুদ্ধের ইতিহাস সে স্কুলে পড়েছে, কিন্তু ভাসা-ভাসা। তাদের জানানো হয়েছিল, জার্মানি যুদ্ধে হেরেছে, যে যুদ্ধ তারাই শুরু করেছিল এবং সেজন্য জার্মানি সারা বিশ্বের কাছে লজ্জিত। মিলারের বাবাও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, মিলারের মা ও তাকে সেই সময়কার কথা বিশেষ বলতে চাননা। বরং পরবর্তীকালে সে কিছু সিনেমা দেখে বা খবরের কাগজ পড়ে ‘পাশবিক ইহুদি অত্যাচার ও নিধন’, আধুনিক পরিভাষায় যার সবথেকে বিখ্যাত নাম হল ‘হলোকস্ট’, তার সম্পর্কে জেনেছে। সে পেশাতে সাংবাদিক, কাজেই অনেক তথ্যই তার কাছে আছে। তবে সেই তথ্যগুলির কোনটাই প্রাথমিক তথ্য ছিল না। এই ডাইরিতে মিলার কিন্তু ‘রিগা’ কনসেন্ট্রেসন ক্যাম্পে অত্যাচারের কথা শুনে শিউরে ওঠে। এডুয়ার্ড রসম্যান নামক এক ঘাতকের নির্মম কাহিনি তাকে ভীষণ উত্তেজিত করে। মানুষ এত নিষ্ঠুর হতে পারে? তার নিজস্ব দেশবাসীরা? কী লজ্জা! আরো বেশি তার রাগ বেড়ে যায় যখন মিলার জানতে পারে এই ঘাতক বেঁচে আছেন এবং ঐ ইহুদি তাকে হামবুর্গ শহরেই দেখেছেন। অর্থাৎ জার্মানিতেই ছদ্মনামে আরামের জীবন কাটাচ্ছেন। সে প্রতিজ্ঞা করে, এই ঘাতককে যে করেই হোক শাস্তি দিতেই হবে।
শুরু হয় অনুসন্ধান। দুর্ভাগ্যজনকভাবে জার্মানিতে মিলার কোন সাহায্যই পায় না। বরং অনেকেই তাকে নিরস্ত করার বিস্তর চেষ্টা করেন। এমনকি প্রাণে মেরে ফেলার ভয়ও দেখানো হয়। কারণ একটাই। যুদ্ধ বিধ্বস্ত জার্মানিতেও নাৎসি সহানুভূতিসম্পন্ন লোকের সংখ্যা অপ্রতুল নয়। তারা সরকারি বিভিন্ন উচ্চপদে আসীন। বিভিন্ন লাইব্রেরি, সরকারি নথীদপ্তরের লোকজনের খোঁজ করে, কথা বলে সে যখন ক্লান্ত, তখন মিলারের দেখা হয় প্রখ্যাত নাৎসি শিকারি – সাইমন উইজেনথালের সঙ্গে।
সাইমন উইজেনথাল ছিলেন একজন ইহুদি, বহু কনসেন্ট্রেসন ক্যাম্প ঘুরে শেষে তিনি ছাড়া পান। ১৯৪৮ সাল থেকে তিনি এই কাজ করছেন। তাঁর শিকারীদের মধ্যে একজন হলেন কুখ্যাত এডলফ আইকম্যান গত বছরেই (অর্থাৎ ১৯৬২) যাঁকে ইজরায়েলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ভিয়েনাতে তাঁর অফিসে বসে মিলার বিস্তারিত জানতে পারেন ‘ওডেসা’র কথা।
“ODESSA” - "Organization Der Ehemaligen SS-Angehörigen"! অর্থাৎ প্রাক্তন নাৎসিদের সবচেয়ে ঘৃণ্য যে সংগঠন – SS এর (abbreviation of Schutzstaffel (German: “Protective Echelon”) তাদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব যাদের ওপর। ওডেসার বেশ কিছু মূল দায়িত্ব আছে,- যেমন প্রাক্তন নাৎসি যাদের যুদ্ধাপরাধী হওয়ার সম্ভাবনা খুব প্রবল তাদের নিরাপদ জায়গাতে পাঠানো। তাদের জন্য এক নতুন পরিচয় তৈরি করা, তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। সর্বোপরি আবার গুপ্তভাবে নাৎসি কাজকর্মের প্রচার করা। এই ওডেসাই আইখম্যানকে লুকিয়ে রেখেছিল আর্জেন্টিনাতে। কিন্তু মোসাদের লোকজন তাঁকে সেখান থেকে ধরে আনতে সক্ষম হয়। তারপর তাঁর বিচার হয় তেল আভিভে। বিচারে সাজা হয় মৃত্যুদণ্ড, তা কার্যকর হয় তার আগের বছর – ১৯৬২র পয়লা জুন। উইজেনথালের কাছে রাখা ফাইলে এডুয়ার্ড রসম্যান সংক্রান্ত বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। সেই নিয়ে মিলার শুরু করে তার অভিযান।
অভিযানের খবর কিন্তু গোপন থাকেনা। ওডেসার লোকেরাও যেমন খবর রাখছিল মিলারের ওপরে, ইহুদি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ (MOSSAD) এর লোকজনরেও নজর এড়ায়নি মিলারের কাজকর্মের কথা। ঘটনাচক্রে মোসাদের লোকজনের সঙ্গেই মিলারের প্রথম মোলাকাৎ হয়। তারা মিলারকে বলে তাদেরও ওডেসা’র খোঁজখবর প্রয়োজন। তারাও আইখম্যানের মত অন্যান্য কুখ্যাত অফিসারদের ধরতে চায়। মিলার রাজি হলে তারা একসঙ্গে কাজ করতে পারে। মিলার যেহেতু ইহুদি নয়, সে জার্মান, তাই ওডেসার নিরাপত্তা ব্যূহ ভেদ করে প্রবেশ করার সম্ভাবনা খুব উজ্জ্বল। তার চেহারা, হাবভাব অনুযায়ী তাকে নাৎসি বলে চালানো বেশ সহজ হবে। মিলার রাজি হয়। একজন প্রাক্তন নাৎসি অফিসার মিলারকে বেশ কঠোর প্রশিক্ষণও দেয়।
তাদের সাহায্যে প্রাপ্ত ছদ্ম পরিচয়ে মিলার শুরু করে অনুসন্ধান। যেমন সাইমন উইসেনথাল বলেছিলেন নাৎসিদের নতুন পরিচয়ের কথা, মিলারও প্রাক্তন নাৎসি পরিচয় নিয়ে নতুন পরিচয়ের উদ্দেশ্যে দেখা করে এক উঁচু পদমর্যাদার নাৎসি অফিসারের সঙ্গে। অফিসারটি নিজেও ছদ্ম পরিচয়ে একেবারে খোদ হামবুর্গেই আত্মগোপন করে আছেন। কালক্রমে মিলার খোঁজ পায় এক ছাপাখানার মালিকের। এই মালিকের কাজ ছিল পুরনো নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের জাল পাসপোর্ট তৈরি করে দেওয়া। সেখানেই মিলারের হাতে আসে একটি গুপ্ত ফাইল – অত্যন্ত গোপন তথ্যপূর্ণ এই ফাইলটিতে আত্মগোপনকারী উচ্চপদমর্যাদা সম্পন্ন নাৎসি অফিসারদের পুরনো এবং নতুন পরিচয় তাদের ফটোগ্রাফ সহ সুন্দর ভাবে লিপিবদ্ধ করা আছে। সেই ফাইল থেকেই সে খুঁজে বার করে রসম্যানের পরিচয় এবং তার বর্তমান ঠিকানা।
ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে, টনিউস পাহাড়ের মধ্যে, এক নিরালা বাড়িতে সে রসম্যানকে খুঁজে পায় এবং তাকে আক্রমণ করে। সেখানেই জানা যায় মিলারের এই অনুসন্ধানের আসল উদ্দেশ্য। রসম্যান শুধু হাজার হাজার ইহুদিকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হননি। তাঁর অন্যায় নির্দেশ অমান্য করার শাস্তি স্বরূপ এক বীর জার্মান অফিসারও তাঁর হাতে বলি হন। ঘটনাচক্রে তিনিই ছিলেন পিটার মিলারের বাবা। সেই ডাইরি পড়ে মিলার সেই ঘটনা জানে এবং তখনই তার প্রতিশোধস্পৃহা জেগে ওঠে। কিন্তু রসম্যানকে বন্দি করে নিয়ে আসার সময় রসম্যানের অনুচরের হাতে পিটার ধরা পড়ে এবং অত্যাচারে জ্ঞান হারায়। তাকে অনুসরণ করে আসা সেই মোসাদের এক এজেন্ট তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে বাড়িতে মিলারের মা ও প্রেমিকাকে খবর দেয়। ইতিমধ্যে রসম্যান পালিয়ে যান আর্জেন্টিনাতে, ওডেসার নিরাপদ আশ্রয়ে।
আপাতভাবে ব্যর্থ হলেও নিজের অজান্তেই এক বড় কাজ করে ফেলে পিটার মিলার। রসম্যান হামবুর্গে একটি ইলেক্ট্রনিকস কারখানার দায়িত্বে ছিলেন। কারখানাটি বাইরের পরিচয়, সেটি বিখ্যাত ট্রানসিস্টর রেডিও তৈরি করে বিক্রি করে। কিন্তু তার ভেতরে, সকলের অজান্তে, খুব গোপনে, তৈরি হচ্ছিল ক্ষেপণাস্ত্রের টেলি-সিগন্যালিং ব্যবস্থা। এই জিনিষটি এমন এক ধরণের ক্ষেপনাস্ত্রের সঙ্গে লাগানো হবে যা মিশরে জার্মান বৈজ্ঞানিকরা তৈরি করছেন। এই মারাত্মক শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইজরায়েলকে ধ্বংস করাই মূল উদ্দেশ্য। এই কাজে মিশর ও ওডেসা, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। মিশরে জার্মান বৈজ্ঞানিকেরা ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কাজ সম্পন্ন করে ফেলেছে, এবার এই সিগন্যালিং ব্যবস্থা পেলেই তাদের উদ্দেশ্য সাধিত হবে। বরাবরের জন্য পৃথিবী থেকে ধ্বংস হবে নাৎসি ও মিশরের চরম শত্রু ইহুদিদের দেশ – ইজরায়েল। রসম্যানের এই অকস্মাৎ অন্তর্ধানে পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যায়। ইজরায়েল তাই আজও সশরীরে, সসম্মানে বর্তমান।
তবে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই কাহিনি নিয়ে যে চলচ্চিত্রটি তৈরি হয় তা খুবই সরলীকৃত। ফলে ‘ডে অফ দ্য জ্যাকেল’ চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তার ধারে কাছেও তা আসেনি। এই কাহিনি এবং কাহিনিচিত্র – দুটির পিছনে যে মানুষটির বড় ভূমিকা ছিল তিনি নিঃসন্দেহে সাইমন উইসেনথাল। আর তার থেকেই জন্ম নেয় বেশ কিছু বিতর্ক।
ঐতিহাসিক বিতর্ক
ইতিহাস ও ঐতিহাসিক কাহিনি নিয়ে বিতর্ক চিরকালীন। মানুষ যতই কল্পনার আশ্রয় নিয়ে উপন্যাস রচনা করুক না কেন, বাস্তব অনেক সময় কল্পনাকেও হার মানায়। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এমন এক কঠোর বাস্তব তার ভিত্তিতে যে প্রচুর কাহিনি নির্মিত হবে এ তো জানা কথাই। কিন্তু ঐতিহাসিক কাহিনি তে ঐ দুধ আর জলের মত মেশাতে হয় Fact আর Fiction। সবচেয়ে সমস্যা তো সেখানেই। ঠিকঠাক মিশ খাবে তো? সাধে খোদ রবিঠাকুর অবধি বলে বসেছিলেন –
প্রতিবাদী বলিবেন, সেইজন্যই বলি, উপন্যাস যত ইচ্ছা লেখো, কিন্তু ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখিয়ো না। এমন কথা আজিও এ দেশে কেহ তোলেন নাই বটে, কিন্তু ইংরাজি সাহিত্যে এ আভাস সম্প্রতি পাওয়া গেছে। সার ফ্রান্সিস প্যাল্গ্রেভ বলেন, ঐতিহাসিক উপন্যাস যেমন এক দিকে ইতিহাসের শত্রু তেমনি অন্য দিকে গল্পেরও মস্ত রিপু। অর্থাৎ উপন্যাসলেখক গল্পের খাতিরে ইতিহাসকে আঘাত করেন, আবার সেই আহত ইতিহাস তাঁহার গল্পকেই নষ্ট করিয়া দেয়; ইহাতে গল্প-বেচারার শ্বশুরকুল পিতৃকুল দুই কুলই মাটি।(১)
বড়ই সমস্যার কথা! কুলমর্যাদা বাঁচিয়ে তার ইতিহাসের প্রতি বিশ্বস্ততা রেখে তাকে আকর্ষণীয় ভাবে পাঠকের দরবারে পেশ করা। বাংলার দুই জনপ্রিয় কাহিনিকার শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আরো অনেকের মত ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বনে উপন্যাস লিখেছেন। তাঁদের মধ্যে সুনীল অপেক্ষাকৃত আধুনিক ইতিহাস নিয়ে লিখেছিলেন বলে তাঁর উপন্যাসের তথ্যভ্রান্তির কথা বেশি আলোচিত। সেজন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কে বহু নির্মম সমালোচনারও শিকার হতে হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেছেন যে সুনীল কল্পনার আশ্রয় নিতে গিয়ে তথ্যগত ভ্রান্তি ঘটিয়েছেন যা বড়মাপের অনধিকার চর্চা। শরদিন্দুর ক্ষেত্রে এই সমস্যা অতটা প্রকট ছিল না কারণ তাঁর সময়কাল বেশ কিছু পূর্বের। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে ফ্রেডেরিক ফরসিথ এমন বিষয় নিয়ে উপন্যাস ফেঁদেছিলেন যা শুধু অতি আধুনিক নয়, বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়গুলির অন্যতম। কাজেই তার কাজে ঝুঁকি অনেক বেশিই ছিল।
তবে উপন্যাসটি জনপ্রিয় হয়েছিল তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। শুধু কাহিনির নিটোল বুননই নয়, পাঠককে মুগ্ধ করেছিল কাহিনির অনুপুঙ্খ বিবরণ। প্রত্যেক ঘটনা ও চরিত্রের অসাধারণ বিস্তারিত বিবরণ এই কাল্পনিক কাহিনিকেও অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিল। সাধারণ পাঠক এই প্রথম জানতে পারল ‘ওডেসা’ নামক এক সংস্থার অস্তিত্ব যার মূল কাজই হল যুদ্ধাপরাধী নাৎসি অফিসারদের পুনর্জীবন দান।
এর বেশ কিছুকাল পরে শুরু হয় ওডেসা ফাইলের ইতিহাস নিয়ে চর্চা। এই চর্চা বিগত শতাব্দীর শেষভাগ থেকে শুরু করে এখনো চলছে। এখনো বহু পুরনো ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি করে বহু নতুন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সেই নতুন আলোয় এই কাহিনিটিকে নিয়ে আবার শুরু হয়েছে চর্চা। এখন যে প্রশ্নগুলি সামনে আসে তা এরকম?
1. ‘ওডেসা’ নামক কোন সংস্থা কি সত্যিই ছিল?
2. এডুয়ার্ড রসম্যান – তিনি কি সত্যিই ‘রিগা’ ক্যাম্পের সবচেয়ে নির্মম ঘাতক?
3. যদি তিনি তা না হন, রিগার আসল নির্মম ঘাতক কে?
4. রসম্যান কোথায় ছিলেন? কাহিনি অনুসারে ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে সেই নিরালা বাড়িতে? না অন্য কোথাও?
5. সাইমন উইজেনথাল – যাঁর কথা “ওডেসা ফাইল” কাহিনিতে আছে, তিনি কি বাস্তব চরিত্র? ঠিক কী তাঁর ভূমিকা?
এই বিতর্ক নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমাদের জানতেই হবে সাইমন উইজেননথালের সম্পর্কে। অর্থাৎ আমাদের শুরু করতে হবে একেবারে শেষের প্রশ্নটি দিয়ে। তার কারণ হল, কাহিনি অনুযায়ী তিনিই ওডেসার অস্তিত্বের কথা পিটার মিলারকে জানান।
বিভ্রান্তির সৃষ্টি ও সাইমন উইজেনথাল
হ্যাঁ, সাইমন উইজেনথাল একটি বাস্তব চরিত্র যেমন ফরসিথ তাঁর কাহিনির শেষে জানিয়েছেন। তাঁর জন্ম ৩১শে ডিসেম্বর ১৯০৮ সালে, অধুনা ইউক্রেনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বাবার মৃত্যুর পর মা তাঁকে নিয়ে ভিয়েনায় পাড়ি দেন। তিনি বেশ অনেকগুলি কুখ্যাত ইহুদি কনসেন্ট্রেসন ক্যাম্পে ছিলেন। যুদ্ধের শেষে তিনি যখন সেখান থেকে মুক্তি পান, তাঁর জীবনের স্বপ্ন ছিল একটাই – তাঁর এবং তাঁর মত বহু মানুষকে যারা চরম নির্যাতন করেছে সেই ঘৃণ্য নাৎসি অফিসারদের বিচারের আওতায় আনা। শুধু সেই কারণেই তিনি জেরুজালেমে না গিয়ে থেকে যান ভিয়েনাতে। তিনি জানতেন ইউরোপের এই জায়গায় থাকলে তাঁর কাজের সুবিধে হবে।
এক সময়ে জানা ছিল যে সবচেয়ে কুখ্যাত নাৎসি এডলফ আইখম্যানকে যে ইজরায়েলের এজেন্সি মোসাদ ধরতে পারে এবং তাকে অপহরণ করে জেরুজালেমে নিয়ে বিচার করা যায়, তার কারণ সাইমন উইজেনথালই মোসাদকে তথ্য দিয়ে আইখম্যানের খবর জানান। এমনকি ফ্রেডরিক ফরসিথ বা পিটার মিলার তাঁরাও এমন কথাই জানতেন। পরবর্তীকালে অবশ্য মোসাদের তৎকালীন সদস্যদের বয়ানে জানা যায় যে তাঁর এই দাবি অসত্য। কিন্তু তা হলেও তাঁর ভূমিকা এই ব্যাপারে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবীর ইতিহাসে তিনি সবচেয়ে বিখ্যাত নাৎসি শিকারি। ষাটের এমনকি সত্তরের দশকের প্রথম দিকে তিনি যখন ভিয়েনাতে তাঁর ছোট্ট অফিসে ছিলেন তাঁর পরিচিতি তেমন ছিল না। ক্রমে তিনি আরো বেশি পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর কাজকর্ম নিয়ে এবং তাঁর স্মরণে গড়ে উঠেছে সাইমন উইজেনথাল সেন্টার যাদের শাখা আছে ক্যালিফোর্নিয়া এবং জেরুজালেমে। সেখানে ‘হলোকস্ট’ সংক্রান্ত মিউজিয়ামও আছে।
যখন প্রথম ফ্রেডরিক ফরসিথ একজন কাল্পনিক পলাতক নাৎসি অফিসারের খোঁজ করছিলেন, তখন তিনি উইজেনথালের কাছেই যান। একেবারে ‘ওডেসা ফাইল’ বইটিতে যেমন আছে, ঠিক সেভাবেই পিটার মিলারের মতই ফরসিথকেও ‘ওডেসা’ এবং ‘এডুয়ার্ড রসম্যান সম্পর্কে অবহিত করেন সাইমন।
যদিও কাহিনিটি লেখা হয়েছে ১৯৭২ সালে, কাহিনির বর্ণিত সময়কাল ১৯৬৩ সালের নভেম্বর মাস। সেইসময় ‘ওডেসা’ নিয়ে কিছু গুজব ছড়িয়ে ছিল। একথা ঠিক যে পলাতক নাৎসিরা অনেকেই দক্ষিণ আমেরিকাতে আশ্রয় নেন। এডলফ আইখম্যানকে তো আর্জেন্টিনা থেকেই পাকড়াও করা হয়। এমনকি খোদ হিটলার আত্মহনন করেননি, তিনিও আর্জেন্টিনাতে আত্মগোপন করে আছেন এমন কথাও প্রচারিত হয়েছিল। এর ওপর ভিত্তি করেও কাহিনি লেখা হয়।
রিগার ঘাতক – পলাতক অপরাধী - এডুয়ার্ড রসম্যান
যদিও ‘ওডেসা ফাইল’ বইটিতে তাঁকেই বর্ণনা করা হয়েছে, রিগার সবচেয়ে নির্মম ঘাতকের নাম কিন্তু এডুয়ার্ড রসম্যান নয়। তাঁর নাম হারবার্ট সুকুরস (Cukurs)(২)। নির্মম এই ল্যাটভিয়ান নাৎসি অফিসার রিগা ক্যাম্পে প্রায় তিরিশ হাজার ইহুদি বন্দিকে খুনের জন্য দায়ি ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনিও দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলের সাও পাওলোতে দিব্যি আরামের জীবন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু ভাগ্য বিরূপ, চোখে পড়ে গেলেন মোসাদের। অনেক পরিকল্পনা করে তাকে মোসাদ এজেন্টরা উরুগুয়ের মন্টিভিডিওতে তাঁর প্রাপ্য শাস্তি দিতে সমর্থ হন। তাঁর মৃতদেহের ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁর অপরাধ এবং বিচার ও প্রাপ্ত শাস্তির বয়ান সম্বলিত একটি চিঠি। চিঠির প্রেরকের জায়গায় নাম ছিল – ফ্রম দোজ হু নেভার ফরগেট। তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৬৫ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি। সেই বিবরণ বিস্তারিত ভাবে পাওয়া যায় মোসাদকে নিয়ে লেখা বিখ্যাত বই – মোসাদ – দ্য গ্রেটেস্ট মিশন অব ইজরায়েলি সিক্রেট সারভিস বইটিতে। যে বিখ্যাত মোসাদ এজেন্ট ছিলেন এই কাজের মূল দায়িত্বে, জেরুজালেমে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছিল উপরোক্ত বইটির অন্যতম লেখকের। (৩)
আরো ছিলেন রুডলফ ল্যাঞ্জ। মাত্র দু’দিনে তিনি ৩৫০০০ ইহুদি হত্যা করেছিলেন এমন তথ্যও পাওয়া যায়। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ অবধি তাঁর নির্দেশে মৃত্যু হয়েছিল আনুমানি ২,৫০,০০ ইহুদি বন্দীর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। সম্ভবতঃ তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। (৪)
তুলনায় এডুয়ার্ড রসম্যান ছিলেন কিছু কম নৃশংস। ‘ওডেসা ফাইল’ বইটিতে বর্ণিত ঘটনাগুলির অধিকাংশ তাঁর অবর্তমানেই ঘটেছিল। তিনিও বেশ কিছু অপরাধের জন্য দায়ি ছিলেন নিশ্চয়ই। কিন্তু অন্য দু’জনকে ছেড়ে তাঁকে এই কাহিনির নায়ক করার কী উদ্দেশ্য? সেকথায় আসার আগে ভাবা যাক ‘ওডেসা’ নিয়ে।
‘ওডেসা’ - বাস্তব না কল্পনা? নাকি সংমিশ্রণ?
‘ওডেসা ফাইল’ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই ‘ওডেসা’র অস্তিত্ব নিয়ে কৌতূহল জাগ্রত হয়। চলে প্রচুর গবেষণা ও অনুসন্ধান। বিভিন্ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংক্রান্ত বহু তথ্য এখন খুব সহজেই পাওয়া যায়। নির্ধারিত সময়সীমার পর অনেক গোপন ফাইলও সাধারণের জন্য উন্মুক্ত (Declassified) হয়ে গেছে। আরো অনেক নতুন গোপন ফাইলেরও হদিশ পাওয়া গেছে। ফলে অনেক সুবিধেও হয়েছে। আর ডিজিটাল প্রযুক্তির ফলে ফাইল সংরক্ষণ ও তাদের নিয়ে আলোচনা করাও এখন অনেক সহজ।
বিগত তিরিশ-চল্লিশ বছরের গবেষণাতে দেখা যাচ্ছে যে “ওডেসা” বলে সত্যকার কোন সংস্থার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেকেই সাহায্য করেছেন নাৎসিদের, যাদের মধ্যে চার্চের যাজকরাও অন্যতম। দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশের সরকারের সাহায্যও ছিল। ইটালি, জার্মানি প্রভৃতি ইউরোপিয় দেশের বিভিন্ন সংস্থা আলাদাভাবে সাহায্য করেছে নাৎসিদের নবজীবন লাভ করতে। কিন্তু যেভাবে বর্ণিত হয়েছে কাহিনিতে, তেমন কোন কেন্দ্রীয় সংস্থার অস্তিত্ব খুব সম্ভবতঃ নেই। আধুনিক ঐতিহাসিকরা বেশ জোরের সঙ্গেই সেটা দাবি করেছেন। যেমন, ‘Hunting Evil’ - ২০০৯ এর বই এর লেখক গায় ওয়াল্টার্স (Guy Walters)।
এই বইটিও নাৎসি শিকারের ইতিহাসের ওপরে লেখা। এই বইয়ের লেখক গায় ওয়াল্টার্স এই নিয়েও বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন। তাঁর মতে উইলহেল্ম হোয়েটল (Willhelm Hoettl) নামক একজন এই বিষয়টি সাইমন উইজেনথালের মাথায় ঢোকায়। সেখান থেকেই শুরু হয় এর যাত্রা। তারপর তাতে বিভিন্ন রঙ চড়ানো হতে থাকে। ওয়াল্টার্সের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এই কথা স্বীকারও করেছেন লেখক ফ্রেডরিক ফরসিথ। ‘ওডেসা ফাইল’ বইটি সম্পর্কে ওয়াল্টার্সের মন্তব্য – ‘But it is a great book with a lot of accuracy and it’s a perfect depiction of post-war Germany.” (৫) অর্থাৎ - “কিন্তু বইটি দুর্দান্ত। প্রচুর শুদ্ধ এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্যে পরিপূর্ণ। তাছাড়াও যুদ্ধ পরবর্তী জার্মানির একটি নিখুঁত ছবি পাওয়া যায়।” তাই তাঁর মতে ‘হলোকস্ট’নিয়ে জানতে হলে এই বইটি পড়া আবশ্যক।
নয়ের দশকে ‘ওডেসা’ কে নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে উকি গোনি নামক এক আর্জেন্টনার ঐতিহাসিক একটি বিখ্যাত বই লেখেন। বইটির নাম – ‘The Real Odessa: How Perón Brought the Nazi War Criminals to Argentina।’ এই বইটিতে সবিস্তারে বর্ণনা করা হয় যে যদিও ‘ওডেসা’ একটি কাল্পনিক সংস্থা, তাহলেও আর্জেন্টিনাতে নাৎসিদের আশ্রয় লাভ করা খুবই বাস্তব। এই বইতে লেখক বর্ণনা করেছেন কীভাবে তিনি এই বিভিন্ন সাহায্যকারীদের সন্ধান পেয়েছেন। তিনি নিজে আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরসের অধিবাসী। সেখানকার বিভিন্ন সরকারি নথিপত্র ঘেঁটে তিনি জানতে পেরেছেন সেসব কথা। আর তাঁর এই বইয়ের অনুপ্রেরণাও যে ফ্রেডরিক ফরসিথ তা তিনি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন। বইটির ভূমিকাতে তিনি লিখছেন,
“Yet none of these far-fetched accounts has gripped the collective imagination as strongly as one novel, The Odessa File, by the best-selling British author Frederick Forsyth. The book portrays a group of former SS men linked in a secret organization named Odessa (Organisation der ehemaligen SS-Angehörigen), whose aim is not only to rescue their comrades from postwar justice but also to establish a Fourth Reich capable of fulfilling Hitler’s unrealized dreams. Thanks to extensive research and his own experience as a Reuters correspondent in the early 1960s, Forsyth wrote a novel that was not only believable but also contained many elements of truth. Ever since its publication 30 years ago, the existence of a ‘real’ Odessa has been hotly contended by journalists, though frequently denied by serious scholars.”(কিন্তু ব্রিটিশ লেখক ফ্রেডেরিক ফরসিথ রচিত ‘ওডেসা ফাইল’ উপন্যাসটির মত এমনভাবে পাঠকের কল্পনাকে কোন কাহিনিই উদ্দীপ্ত করতে পারেনি। এই বইটিতে ওডেসা নামক এক গুপ্ত সংস্থার কথা বলা আছে যাদের সদস্যদের কাজই হল যুদ্ধ পরবর্তী নাৎসি অফিসারদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা আর হিটলারের চতুর্থ রাইখের অসমাপ্ত স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করা। ষাটের দশকে তাঁর নিজের রয়টারের সাংবাদিক পেশার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আর প্রচুর গবেষণা করে ফরসিথ এমন উপন্যাস ফেঁদেছিলেন যা শুধু বিশ্বাসযোগ্যই নয়, এমনকি তার মধ্যে অনেক বাস্তব উপাদানও ছিল। তবে বইটির প্রকাশের পর থেকেই গবেষকরা এর অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান থেকেছেন, সাংবাদিকরাও অনেক সময় এই দাবি নাকচ করেছেন।) (৬)
অর্থাৎ গবেষক-লেখক স্বীকার করে নিচ্ছেন যে যে উপন্যাসটি শুধু ‘বিশ্বাসযোগ্য’ তাই নয়, লেখক ফ্রেডরিক ফরসিথ তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বহু বাস্তব তথ্যের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। যদিও পরবর্তী কালে বিভিন্ন গবেষক ঐতিহাসিকরা ‘ওডেসা’র অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন, তাহলেও উপরোক্ত বইটি তাঁর গ্রন্থ রচনার অনুপ্রেরণা। বইটির নামকরণের মধ্যেই তিনি ঋণ স্বীকার করে রেখেছেন।
অন্য প্রশ্নটি, অর্থাৎ ‘রসম্যান কোথায় ছিলেন? কাহিনি অনুসারে ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে সেই নিরালা বাড়িতে? না অন্য কোথাও?’ এর উত্তর খোঁজার পালা। আমরা আগেই দেখেছি, ফ্রেডরিক ফরসিথের মাথায় কাহিনির নায়কের প্রবেশ হয় সাইমনের মাধ্যমে। সাইমনের কথা বইতেও আছে, এই সিনেমাতে সাইমনের ভূমিকাতে অভিনয় করেন স্মুয়েল রডেন্সকি। ১৯৭২ সালে যখন ফরসিথ উইজেনথালের সঙ্গে আলোচনা করছেন, উপরোক্ত তিনজন ঘাতকের একজন মৃত, অন্যজন নিখোঁজ। বাকি রইলেন – রসম্যান। উইজেনথাল খবর পেয়েছিলেন তিনি নয় ইউরোপে নয় দক্ষিণ আমেরিকার কোথাও লুকিয়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্যই ছিল, রসম্যান যেখানেই থাকুন, এই কাহিনি এবং সিনেমার মাধ্যমে সেখানকার কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে রসম্যান কে জার্মানি বা জেরুজালেমে বিচারের জন্য নিয়ে আসা।
‘রসম্যান’ সম্পর্কে তিনি ফ্রেডরিক ফরসিথকে যা জানিয়েছিলেন তার অনেকটাই সত্যি। এমনকি রসম্যানের দক্ষিণ আমেরিকার বাসস্থানের ব্যাপারটিরও সম্ভাবনা খুব বেশি ছিল। পরবর্তী কালে জানা যায়, তিনি সম্ভবত ১৯৪৮ সালে ইটালি হয়েই আর্জেন্টিনা পৌঁছে যান। উইজেনথালের বিবরণ অনুযায়ী রসম্যান ১৯৫৫ সালে আবার জার্মানিতে এসেছিলেন কিনা তা জানা যায় না। তাঁর স্ত্রীর তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা বা রসম্যানের বিরুদ্ধে একাধিক বিবাহের মামলা যে জার্মানিতে রুজু হওয়ার ঘটনা অবশ্য সত্যি। তবে রসম্যানের ইউরোপে লুকিয়ে থাকা বা হামবুর্গের কারখানাতে কাজ করার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।
বই ও সিনেমার প্রভাব
সাইমন উইজেনথালের অভীষ্ট কিন্তু পুরোপুরি সিদ্ধ হয়েছিল। জীবিত রসম্যানের ওপর এর প্রভাব পড়ে। সিনেমাটি দক্ষিণ আমেরিকাতে মুক্তি পাওয়ার পর অনেকেই জানান তাঁরা রসম্যানকে দেখেছেন। অবশ্য কেউ কেউ ভুল করে অভিনেতার চেহারার কারুকে দেখেছেন বলে জানান। এই ভাবেই, কোন সূত্র থেকে খবর পেয়ে, ১৯৭৭ সালে রসম্যান আর্জেন্টিনার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। সঙ্গে সঙ্গেই জার্মানি তাঁকে দাবি করে বসে। (৭) আর্জেন্টিনা প্রথমে রাজি হয়েও পরে বেঁকে বসে। তারা জানায় বিশদে তদন্ত করে জানা গেছে, যিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন তিনি রসম্যান নন। রসম্যান মুক্তি পেয়ে প্যারাগুয়েতে রওনা হন। তখন অবশ্য তাঁর অন্য নাম ছিল। সেখানে সম্ভবত এই বিপদের আশঙ্কায় তাঁর হার্ট এটাক হয়। ৮ই আগস্ট, ১৯৭৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। পরে রিগা ক্যাম্পের এক প্রাক্তন বন্দি তাঁকেই রসম্যান বলে সন্দেহ করেন। পরে বিস্তারিত অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হওয়া যায়। (৮)
শেষ বিচারে ফিরে দেখা
১৯৭২ সালে ফ্রেডরিক ফরসিথ যখন কাহিনিটি রচনা করছেন তখন তাঁর কাছে তেমন ঐতিহাসিক তথ্যের সম্ভার ছিল না। সে কাজ শুরু হয়েছে বিগত তিন দশক ধরে। এছাড়া ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং উন্নত সংযোগ ব্যবস্থা এখনকার গবেষণাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। গাই ওয়াল্টার্স বা উকি গোনি বা অন্যান্য ঐতিহাসিকরা যখন এই ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে বই লিখছেন তাঁদের কাছে বহু তথ্য রয়েছে যা ১৯৭০ – ৭১ সালে ফ্রেডরিক ফরসিথের কাছে ছিল না। তাও সেই সীমিত তথ্যের সঙ্গে নিজের কল্পনা ও সাংবাদিক অনুসন্ধান পদ্ধতির মাধুরী মিশিয়ে রচনা করেছেন ‘দ্য ওডেসা ফাইল’।
কাহিনিটি আজও ঐতিহাসিক গবেষণাতে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে চলেছে। কাহিনির প্রকাশের প্রায় অর্ধশতাব্দী পরেও গবেষক – ঐতিহাসিককে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় যে “ওডেসা”র অস্তিত্ব কী বাস্তব না কাল্পনিক তখন আমরা বুঝতে পারি কাহিনির মাহাত্ম্য। কবির মনোভূমিতে রচিত ‘সেই সত্য’ এখনো বাস্তবের সত্যের চাইতে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়। এক কাহিনিকারের কাছে এর চাইতে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে? তাই আজকের যুগে দাঁড়িয়েও একথা বলা অনুচিত হবে না যে আধুনিক কোন লেখক যদি বর্তমানের ইতিহাসের ভিত্তিতে কোন রোমাঞ্চকর কাহিনি লিখতে চান, আজও এই বইটি তাঁর কাছে প্রেরণাস্বরূপ হয়ে থাকবে।
এছাড়াও অবশ্য আমার কাছে আজকের যুগেও এই বইয়ের আলাদা মূল্য রয়েছে। কেন? তা জানতে গেলে আমাদের উলটে দেখতে হবে এই কাহিনির কয়েকটি পাতা – যেখানে পিটার মিলারের প্রকাশক হান্স হফম্যান তাঁকে হিটলারের ইহুদি-বিদ্বেষ সম্পর্কে বোঝাচ্ছিলেন –
“জান, হিটলারের আগে কিন্তু জার্মানিতে ইহুদি বিদ্বেষ ছিল না। গোটা ইউরোপে আমাদের ইহুদিদের প্রতি মনোভাব ছিল সবচাইতে ভাল। পোল্যান্ড, রাশিয়ার চাইতে তো বটেই, এমনকি স্পেন, ফ্রান্সের থেকেও। এরপর হিটলার শুরু করলো। সকলকে বোঝাতে থাকলো যে প্রথম মহাযুদ্ধ, জার্মানির বেকারসমস্যা, দারিদ্র্য – সব কিছুর জন্য ইহুদিরাই দায়ি। লোকে বুঝতে পারল না কাকে বিশ্বাস করবে। এর আগে অবধি সবাইয়ের ইহুদি বন্ধু ছিল। কেউ ইহুদি মালিকের কারখানাতে কাজ করব, কারুর ইহুদি কর্মচারি ছিল। সকলেই জানত এরা বেশ ভাল মানুষ। এবং নিরীহ। আর হিটলার কিনা বলছে এরাই সবকিছুর জন্য দায়ি?আজকের পৃথিবীর দিকে তাকিয়েও এই পরিস্থিতির সম্ভাবনার কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আর তা যদি হয়, পিটার মিলারের মত পরবর্তী প্রজন্মকেও হয়তো তার জন্যে অপরাধবোধে ভুগতে হবে।“তাই যখন ভ্যান এসে বেছে বেছে তাদের নিয়ে যেতে শুরু করল, কেউ কিছু করল না। তারা চুপ করেছিল। আস্তে আস্তে তারা সেটাই বিশ্বাস করতে শুরু করলো যা তাদের জোরে জোরে চেঁচিয়ে বলা হচ্ছিল। -- এভাবেই আস্তে আস্তে ইহুদিরা হারিয়ে গেল। লোকে প্রশ্ন করার সাহসও আর পেল না যে তারা গেল কোথায়”
কাহিনিতে বর্ণিত একটি ছোট্ট ঘটনা দিয়ে উপসংহার টানি। ছাত্রাবস্থায় মিলার একবার ফ্রান্সে যায় বন্ধুদের সঙ্গে। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে তারা একটা চার্চে যায়। সেই চার্চে, ‘জাঁ মুলিন’ নামক একজন ফরাসি ইহুদির শেষকৃত্য সম্পন্ন হচ্ছিল। সেখানে একটি ফরাসি ছেলে পিটারের গায়ে থুতু দিয়েছিল। পিটার অবাক হয়েছিল, পরে জেনেছিল ফরাসি ছেলেরা জার্মান পিটার ও তার বন্ধুদের ভেবেছিল সেই ভয়ংকর, ক্রুর জার্মানদের প্রতিনিধি যারা ‘জাঁ মুলিন’ এর ওপর নৃশংস অত্যাচার করেছিল।
এটাই বোধহয় ইতিহাসের শিক্ষা। আজকের মানুষের তাৎক্ষণিক বিদ্বেষপূর্ণ আচরণের ফল শুধু তাদের নয়, পেতে হতে পারের তাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও। আমরা কি শিক্ষা নেব?
তথ্যসূত্র
(১) https://www.tagoreweb.in/Essays/sahityo-51/oitihasik-upanyas-866
(২) https://www.timesofisrael.com/how-the-mossad-hunted-the-butcher-of-riga-who-murdered-up-to-30000-jews/
(৩) Mossad: The Greatest Missions of the Israeli Secret Service - Michael Bar-Zohar and Nissim Mishal – Jaico Publishing House – 24th Jaico Impression -2020 – pp – 171 - 185
(৪) https://www.jewishvirtuallibrary.org/rudolf-lange
(৫) https://fivebooks.com/best-books/guy-walters-on-nazi-hunters/
(৬) The Real Odessa: How Peron Brought The Nazi War Criminals To Argentina – Kindle Edition – pp - 15
(৭) http://foia.state.gov/documents/Argentina/0000A26C.pdf
(৮) https://news.google.com/newspapers?nid=1298&dat=19770812&id=c-oQAAAAIBAJ&sjid=-ooDAAAAIBAJ&pg=3764,1408981