বুঝলাম, সুযোগ পেয়ে শষু একটু ঠুকে দিল। হ্যাঁ, কাজের চাপে আসা হয় না। শষুর দ্বিতীয় বিয়েতেও ছুটি না-পাওয়ার কারণে আসা হয়নি। তাছাড়া শ্রীরামপুর থেকে আমাদের গ্রামের বাড়ির পথও কম নয়। তাই বছরে এক-আধ বার আসি কি আসি না। এলেও রাত থাকা হয় না। সকালে এসে বিকেলে ব্যাক করি। কিন্তু এখন ছেলে বড় হয়েছে। বাদাম চাষের গল্প সে অনেক শুনেছে। দেখলে ও খুশিই হবে।
গ্রামের বাড়িতে এসেছি সকাল দশটায়। বিশ্রাম নিয়ে, দুপুরের খাবার খেয়ে বিকেলে বেরুলাম। যাচ্ছি শষুর বাড়ি। সেখান থেকে যাব শষুর জমিতে। বাদাম কীভাবে মাটির নীচে হয় সেটা শষু ছেলেকে হাতে-কলমে দেখাবে। আজকের রাতটা এখানে থেকে কাল সকালে শ্রীরামপুরে ফিরব—এমনি প্ল্যান করা আছে।
একটা প্যাডেল-ভ্যানে এক বুড়িকে চাপিয়ে নিয়ে চলেছে কয়জন কিশোর। ভ্যানে বুড়িটা বসে আছে ভাবলেশহীন মুখে। ছেলের দল হাঁকছে, ‘এই বুড়িটি হারিয়ে গেছে। এর নাম মনে নাই, ঠিকানা জানা নাই। কারও বাড়ির বুড়ি হলে ঘরে নিয়ে যাও।’
থমকে দাঁড়ালাম। পাড়ার লোকজন জমে গেছে তখন। সকলেরই প্রশ্ন, ‘এই কারা রে তোরা? ব্যাপার কী? বুড়িটাকে কোত্থেকে পেলি? এমনি করে বুড়িটাকে ফিরি করে বেড়াচ্ছিস কেন?’
জানা গেল--এই বুড়িটি হরিপুর বাজারে বসে কাঁদছিল আর তার ছেলেকে খুঁজছিল। নিজের নাম-ঠিকানা কিছুই বলতে পারছে না। কেবল এইটুকু মনে আছে, কোনও এক মুড়ি ভাজার কারখানার পাশেই তার গ্রাম। বাড়িও সেখানেই। তার ছেলে সেই মুড়ি ভাজার কোম্পানিতেই কাজ করে। ছেলে তাকে ডাক্তার দেখাবে বলে হরিপুরে এনেছিল। তারপর এখানে রাস্তার ধারে বসিয়ে বলে, ‘তুই এখানে বস মা, আমি ডাক্তারখানায় নাম লিখিয়ে আসি।’ এই বলে ছেলে ধাঁ। এদিকে সাত দিন কেটে গেল। হরিপুর বাজারের দোকানদাররা পালা করে বুড়িকে খেতে দেয়। শোবার জন্য মাদুর পেতে দেয়। একখানা বালিশ জোগাড় করে দেয়। এখন গ্রামের ছেলেরা তাকে ভ্যানে চাপিয়ে বেরিয়েছে যদি বুড়িটাকে বাড়ি ফেরানো যায়।
মাধানী বুড়ি বলে, ‘কিন্তু এদিকে মুড়ি কারখানা কোথা?’
‘নেই।’ তারা মাথা নাড়ে।
মাধাই খুড়ো বলে, ‘তাহলে এদিকে নিয়ে ঘুরছিস যে বড়ো?’
ছেলেরা বলে, ‘দেখো কাকা, আমরা চেষ্টা করছি। এই নিয়ে তিন দিন হল বুড়িকে ভ্যানে করে ঘুরছি। যদি কিছু গতি হয় বুড়ির। না হলে ও বাজারে যেমন থাকছে তেমনি থাকবে। আজ এলাম তোমাদের গ্রামে।’
এই বলে ছেলের দল যেমন হাঁকছিল তেমনি হাঁকতে হাঁকতে যায়। লোকে দেখে, নানা প্রশ্ন করে। হাসে। কেউ বলে, ‘ও বাতিল বুড়িকে কে নেবে? না হোমে না যজ্ঞে লাগে। ওকে নিয়ে গিয়ে গাবায় ফেলে দে!’ আবার কেউ বলে, ‘বুড়িটাকে ভ্যানে চাপিয়ে বেচতে বেরিয়েছিস নাকি? দাম কত বুড়ির?’
ছেলের দল কিন্তু এই আওয়াজে হতোদ্যম হয় না। তারা হাঁকতে হাঁকতে বেরিয়ে যায়। সে রাস্তা আমাদের ছোটবেলায় ছিল মাটির। বর্ষায় এক হাঁটু কাদা পেরিয়ে যাতায়াত করতে হত। গরমের দিনে ছাতারে পাখিদের ধুলোস্নান করতে দেখেছি। এখন তা হয়েছে ঢালাই।
শষু বলেছিল, ‘এবারে বাদাম উঠলে কেজি খানেক তোর বাড়িতে দিয়ে আসব’খন। তোর ছেলেকে খাওয়াস।’
আমরা শষুর বাড়ি যাই। কিন্তু শষু এখন বাড়িতে নেই। ওর বউ নীভা বললে, ‘সে তো বেরোয় সেই ভোর পাঁচটায়; ফিরতে ফিরতে সেই বিকেল তিনটে-চারটে। বাঘাটির ভূপেন সিংহরায়দের জমির বাঁধা কিষেন ও। মুড়ি-আলুসেদ্ধ গামছায় বেঁধে দি। আর দুউরের ভাত ওখানে পায়। ফিরে স্নান সেরে খেয়ে ঘুমায়।’
বুঝলাম, এই হল শষুর দৈনিক রুটিন। কিন্তু ও যে নিজের জমিতে চাষ করা ছাড়াও অন্যর জমির বাঁধা কিষেন—সেটা বলেনি একবারও। এদিকে ছেলে যে বাদাম চাষ দেখতে চায়, তার কী হবে?
নীভা বললে, ‘আমাদের জমিটা আপনি চেনেন?’
না। মাথা নাড়ি। নীভা হাসে। বলে, ‘অসুবিধে নেই। এদিকে অনেকেই বাদাম ফলায়। মাঠের ভেতর যান না, দেখতে পাবেন।’
নীভাকে আমি এই প্রথম বার দেখছি। নীভার বাঁ-চোখ সামান্য টেরা। একটা পা টেনে হাঁটে। গলার স্বরে হালকা খোনা ভাব আছে। এটি তারও দ্বিতীয় বিয়ে। নীভাকে ওর আগের স্বামী বাচ্চা না হবার কারণে তাড়িয়ে দিয়েছে, আর শষুকে বিয়ের পর ওর কোলে এখন দুটি বাচ্চা। মেয়েটি পাঁচ বছরের, ছেলেটির বয়স এক বছর। শষুর প্রথম বিয়েতে আমি উপস্থিত ছিলাম। শষুর প্রথম বউ প্রিয়া বিয়ের ছয় মাসের মধ্যে ওর প্রেমিকের সঙ্গে পালায়।
নীভাকে বলা যায় না, কেবল বাদাম চাষ নয়, জমির মধ্যে একটা মাটির হাঁড়িতে শষু সরা চাপা দিয়ে রেখেছে একাকী এক শিঙি মাছকে, যা নাকি ঐ হাঁড়িতেই মাঠের মধ্যে, বাদাম জমির ভেতর বেঁচে আছে একাদিক্রমে তিন-তিনটি বছর ধরে কিন্তু কীভাবে? আট মাস আগে যখন আমি গ্রামে এসেছিলাম একটি কাজে, শষু দেখিয়েছিল মাছটি। শিঙি মাছের তিন বছর এভাবে বেঁচে থাকা নিয়ে আমি সন্দেহ প্রকাশ করলে সে মুচকি হেসে বলেছিল, ‘মাঠের মধ্যে এমনি হয়। যারা জমির সঙ্গে, মাটির সঙ্গে মিশে থাকে—তারা এসব জানে।’
শষু তখন সরা সরিয়ে হাঁড়ির ভেতর দেখায়। আলো ও নাড়া পেয়ে শিঙি মাছটি ছলাত করে ওঠে। শষুর মুখে একগাল হাসি। বলে, ‘নীভার আগে বাচ্চা হয়নি, তখন সবাই ওকে বাঁজা বলেছিল, ওর বিয়ে ভেঙেছিল—সেটা যেমন নীভা তখন বিশ্বাস করেছিল; আর এখন ওর কোলে দুটি বাচ্চা—সেটাকেও নীভা বিশ্বাস করে। দুটিই যদি সত্যি তবে এর মধ্যে মিথ্যে কোনটা?’
সেদিন শষুর এই যুক্তির কাছে আমি হাঁ হয়ে গেছিলাম।
শষুদের বাড়ি ডিঙিয়ে মাঠে নামি। আলপথে যাই। যদি অন্য কারো বাদাম-জমি দেখানো যায়। খানিক গিয়ে দেখি মাঠের মাঝে একটি বকুল গাছ। তার নীচে আছে একখানা বাড়ি। বাড়িটার কোমর অবদি ইঁটের, বাকিটা মাটির। মাথায় টালি চাপানো। সামনে খানিকটা উঠোন। বাঁশের বেড়া ঘেরা। সেখানে দুখানা মুরগি চরে বেড়ায়। ছোট্ট উঠোনের ধারে ধারে নানা দেশি ফুলের গাছ যেন আগলে রেখেছে বাড়িটাকে। ফুলের একটা মৃদু সুবাস ভাসছে বাতাসে।
বুঝলাম, সুবাসটা কেবল ফুলের নয়, একটা ধ্বনিরও। সে মৃদু ধ্বনি আসছে খোল থেকে। দুয়ারে বসে খোল বাজায় একটা লোক। আমাদের দেখে ডাকলে, ‘কে-গা তোমরা? ভেতরে এসো দিকিনি, দুটি কথা কই!’
বাড়িটার ভেতরে ঢুকি। মাথার উপরে কেবল নীল আকাশ, আর কিছু নেই। বাতাসে এখন ফসলের গন্ধ, গাছপালা, পাতাদের গন্ধ। লোকটা খোল বাজানো থামিয়ে দিয়েছে। একটা চ্যাটাই পেতে বসে আছে দুয়ারে। আমাদের ঢুকতে দেখে খোলটা নামিয়ে পাশে রাখলে। বললে, ‘এসো দিকিনি, ভিত্রি এসো, দুটি প্রাণের কথা কই।’
বসে পড়ি। দুয়ারের কিনারেই। ছেলেও বসে। ইঁটপাতা দুয়ার। অচেনা লোক দেখে মুরগি দুটি কাছে এসেছিল, এখন আবার চলে যাচ্ছে উঠোনের ওদিকে।
লোকটা নাম নিশিকান্ত মান্না। সে একজন সাধারণ চাষি। যখন আমরা গ্রাম ছেড়েছিলাম তখন ওর চেহারা বেশ পোক্ত ছিল। দোলের সময় গ্রামে যখন অষ্টপ্রহর হরিনাম সংকীর্তন হয়, সভা জাগিয়ে রাখা তার কাজ। এছাড়া শ্রাদ্ধবাড়ি, নানা পুজো-আচ্চায় খোল বাজিয়ে হরিনাম করে থাকে। আমাদের গ্রাম ছাড়াও বাদেশোলার নগেন সহ মোট আটজনের একটা টিম আছে ওদের। নানা গ্রামে ডাক পড়ে হরিনাম সংকীর্তন করতে, আসর জাগাতে। খোরাকি ও সামান্য কিছু টাকা দক্ষিণা হিসেবে পায়। ও যে মাঠের ধারে বাড়ি করেছে শষু ফোনে বলেছিল আমায়। সে অনেকদিন আগের কথা। মনে পড়ে গেল। শষু বলেছিল, ‘আমাদের পাড়ার নিশিকাকাই সুখে আছে বুঝলি। একটেরে হয়ে বাস করে, মানুষের সাথে নাই, ফলে কোনও ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটে নাই।’
সাতান্ন-আটান্ন বছর বয়স হবে নিশিকান্তর। ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। নাতি-নাতনিও হয়ে গেছে। বউ মারা গেছে অনেকদিন আগেই। বিয়ের পর ছেলেরা একা হয়ে যেতে সে কেমন যেন বিপন্ন বোধ করতে থাকে। দুধকুমরা গ্রামের এক বিধবাকে সে বিয়ে করে। এই পক্ষের একটি ছেলে হয়েছে তার। ছেলের বয়স পাঁচ। বুড়ো বয়সে আবার বিয়ে করাতে ছেলেরা ওকে ভিটেছাড়া করেছে। তাই সে মাঠের মধ্যে এক-কামরা একটা ঘর করে রয়ে গেছে।
এবার নিশিকান্ত চিনতে পারে আমায়। বলে, ‘সুভাষের ভাইপো তো তুমি, চিনতেই পারিনি! এটি কে, ছেলে বুঝি? ছেলেকে নিয়ে গ্রাম ঘুরতে বেইয়েছ বুঝি? বেশ বেশ। ইদিকে তো চাষিলোক ছাড়া মানুষজন আসে না, কথা কইবার লোক পাই না।’
ছেলে দুয়ার থেকে নেমে মুরগির সঙ্গে খেলতে থাকে। সেদিকে তাকিয়ে নিশিকান্ত বলে, ‘শেয়ালের বড় উৎপাত ভাইপো। মুরগিগুলোকে চোখে চোখে রাখতে হয়। নইলে এই মাঠের ধার, কখন তুলে নিয়ে যায়, এই দিনেও—কোনো হিসেব নাই। তা ভাইপো, শষুর কাছে শুনেছিলাম কোনো এক হাসপাতালে চাকরি করো এখন? কোথায় করো? মেডিকেলে?’
‘না। ওয়ালস-এ।’
‘ওয়ালস-এ? সেদিন যে দেখাতে গেনু, তোমাকে যে দেখলুম না?’
‘অনেক বড় হাসপাতাল। অনেক স্টাফ, অনেকগুলি বিভাগ, না জানা থাকলে কোথায় খুঁজবে তুমি?’
‘হুম!’ মাথা নাড়ে সে।
ওই দেখা যায় সেই ভ্যান, কটি ছেলে সে ভ্যান টানছে, বুড়িটা ভ্যানের উপর তেমনি করে থেবড়ে বসে আছে। হ্যাঁ, অনেকটা দূরে চলে গেছে তারা। ফলে দেখা যায়, শোনা যায় না। সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে নিশিকান্ত বলে, ‘ওরে নিয়ে কিছু করতে পারো না? হাসপাতালে ভর্তি করে দিলে। যদি কিছু চিকিৎসা পায়, ছেলেকে খুঁজে পায়।’
বলি, ‘বুড়িটার ব্যাপারটা কী?’
‘বেশ কদিন ধরেই এমনি চলছে শুনছি। আজ এখেনে দেখছি। কিন্তু অচল বুড়িটার বাড়ির কোনও হদিশ মেলেনি এখনও। যার বোঝা সে ফেলে পালায়, অচিন লোক খেটে মরে। এই হয়। হয়তো এরই নাম দুনিয়া! আসলে ও যে তেমনি করে কথা বলতে পারে না। ভ্যানে কেবল থেবড়ে বসে থাকে আর জুলজুল করে এদিক-ওদিক চায়। অনেকে ওকে বলে, হুঁকোমুখো হ্যাঙলা বুড়ি।’
‘তা তোমার শরীর কেমন? ওয়ালসএ যেতে হল কেন?’
‘ভালো না-রে ভাইপো, শরীর আর সাথ দেয় না। মাঠে গিয়ে আর তেমন করে খাটতে পারি না। এট্টুতেই এখন হাঁফ ধরে। উঠতে-হাঁটতে কষ্ট! ওই তোমার কাকিমাই যা করার করে। এখন ও জমিতেই আছে, ছেলেটাও গেছে। সন্ধে হবার আগেই ফিরে আসবে। ওদের জন্য আমি এখানে বসে থাকি, এই বিকেলটায়, বসে বসে খোল বাজাই। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগে। আমি আবার বিয়ে-থা করে নতুন করে সংসারী হইছি, শষুর কাছে নিশ্চয় তুমি শুনেছ ভাইপো। ছেলেরা আমার এমনিতে দেখে না, বিয়ের পর সব বউ নিয়ে আলাদা হয়ে গেল। এই বয়সে রেঁধে খেতে ভালো লাগে? এক গেলাস জল দেবার লোক নেই। ঠিক করি বিয়ে করব। মেয়েও জুটে যায়। পাড়ার লোকে বলে, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’। ছেলেরা আমাকে আমারই বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এখন মাঠের মাঝে কোনক্রমে এই ঘরখানা গড়ে বাস করছি। বন্যজন্তুর উপদ্রব প্রচুর। সন্ধ্যার পর দুয়ার এঁটে থাকি। তুমি যদি ওয়ালসএ আমাকে এট্টু ব্যবস্থা করে দিতে।’
‘বেশ তো। শষুর কাছে আমার নাম্বার আছে, যেদিন যাবে আগের দিন ফোন করে নিয়ো। শষুর জমিটা কোথায় জানো? যেখানে বাদাম চাষ হয়?’
‘শষুর ফেরার টাইম হয়ে এল। ঘরে ফেরার আগে আমার সঙ্গে দেখা করে, কথা কয়ে তবে যায়। আর বাদাম চাষ তো আমিও করি। এই তো জষ্টিমাস পড়ল। এই মাসেরই শেষা করে বাদাম তোলা হবে। রথের মেলাতে এই বাদামই তো যায়।’
ছেলে মুরগির পিছন ছেড়ে চলে এসেছে। আমার হাঁটু ধরে নাড়াচ্ছে। বাবা, চলো।
‘ছেলেকে বাদাম চাষ দেখাবে বুঝি?’
‘হ্যাঁ। ওই জন্যে শষুর বাড়ি এসেছিলাম। কিন্তু শষু নেই।’
‘হ্যাঁ। ও এখন সিংহরায়দের জমিতে মুনিষ খাটে। এখন ওর টাকার দরকার খুব। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে খামারে ঘর করেছে। একখানা ঘর, ঢালাই দেবার ইচ্ছে থাকলেও পয়সার জন্য পারেনি। নিজের জমি কতটুকুই বা ভাগে পেয়েছে। তিন ভাই, তিন জনেই আলাদা। ওদিকে ওদের বিধমা মা এর বাড়ি ওর বাড়ি কাজ করে নিজের পেট চালায়। এবারে শুনলুম একশো দিনের কাজে নাম লিখিয়েছে। আচ্ছা, রাস্তা বলে দিচ্ছি, কটা জমির পর কোন আলের বাঁকে বাদামের জমিগুলি দেখতে পাবে। ওখানে যেমন আমার জমি আছে, শষুরও আছে। আলু তুলে সেই জমিতে আমরা বাদাম বুনি। সার তেমন দিতে হয় না। খরচ কম। আলুতে যা সার দেওয়া হয়, সেই সার বাদাম খায়। বাদাম মোটা হয়।’
‘চলো, বাবা।’
বেরোই। আলো কম। মাঠের মাঝে গিয়ে দাঁড়াই। লোকজন নেই। কয়েকটি ছাগল নিয়ে এক বউ ঘরে ফিরছে। দু-একটি কুকুরও লেজ নেড়ে নেড়ে গ্রামের ভেতর ঢুকছে। সন্ধে আসছে। এবার শেয়ালরা বেরুবে। জমির চারিদিকে বাদাম গাছ হয়ে আছে। ছেলে বলে, ‘তুলি বাবা?’
চুপ করে থাকি। কার জমি জানি না। চারিদিকে তাকাই। না, কাউকেই আর তেমন চোখ পড়ে না। তবে যে বউটি ছাগল নিয়ে গ্রামে ফিরছে সে পিছু ফিরে তাকাচ্ছে বার বার। জমির মাঝে ইতিউতি পোঁতা আছে বাঁশ-ডগালি। রাতে এসে বসে প্যাঁচা। শষু বলে, ‘মাঝরাতে ইঁদুরের দল যখন বাদাম খেতে হুটোপাটি লাগাবে তখন তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে প্যাঁচারা।’
ছেলে নীচু হয়ে বাদাম গাছ ধরে হ্যাঁচকা টান মারে। শষু বলছিল, ‘বাদামের ভালো দাম মেলে চাঁপাডাঙা গেলে। ওদিকে দামোদরের চরে ভালো বাদাম চাষ হয়। বাদামের আড়ত সব ওদিকে।’
ছেলের হাতে বাদাম গাছ উঠে আসে, বাদাম রয়ে যায় মাটির নীচে। বুঝি, সব জিনিসেরই একটা কায়দা থাকে। যেমন কায়দা থাকে শিঙি মাছের, এক হাঁড়ির ভেতর তিন বছর ধরে বেঁচে থাকার। যেমন কায়দা থাকে নিশিকান্তর, শষুর—মাঠের ধারে একাকী বেঁচে থাকায়।
নিস্তব্ধ, নীরব মাঠের মধ্যে দেখি অদ্ভুত এক দৃশ্য। মাঠের মধ্যে এক ডোবাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক ফাঁকা স্থান। সেখানে কিছু গাছ, ঝোপঝাড় আছে। সেখানে সেই ভ্যানটি দাঁড় করানো। বুড়িটি ভ্যানে বসে আছে। ছেলের দল তুলে দিচ্ছে কাঁচা, মাটিমাখা বাদাম। বুড়ি তাই মুখে পুরে দিচ্ছে। বুড়িটি মহাখুশি। ছেলেরা বলছে, ‘খেয়ে নাও ঠাকুমা, আর দু’দিন বইতো নয়। কোনদিন দেখবে এখানেও এট্টা মুড়ি ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে।’ তখন মনে পড়ল শষু একদিন ফোনে বলছিল, ‘গ্রামের ভেতরও ছোটখাট নানান কারখানা হচ্ছে বুঝলি। জমিজমা আর রাখতে পারলে হয়...’