সাধুরা তাদের আগের জীবনকে বলে পূর্বাশ্রম। এই পূর্বাশ্রমের নাম তারা ভুলে যেতেই চায়। নতুন জীবনে গালভরা নাম নিয়ে বাঁচে। এই সাধুটির ওসব ব্যাপার নেই। আগের নামটাই ওর এখনো বিদ্যমান। ঠিক তাও নয়। ঐ নামেই বা কে তাকে ডাকছে এই ঘোর বনজঙ্গলে। সে যে কোনোকালে বাসুদেব ছিল সেটাই কিছুদিন আগে ভুলতে বসেছিল। ইদানিং আপ্লার আগমনের পরে কথাবার্তায় বাসুদেব নামটা এসে পড়ে।
বাসুদেব সাধু তার ছোটো ছেলে আপ্লাকে শেষবার দেখে তা প্রায় দশ-বারো বছর আগে। তখন তার বয়েস ছিল চোদ্দ। এখন তার বয়েস চব্বিশ-পঁচিশ হওয়ার কথা। কিন্তু এতো বছর পরে আপ্লা এসে হাজির হয়েছে তার একেবারে শিশুকাল নিয়ে। বয়েস তার দশ পেরোবে না কোনোমতেই। পা ও হাতের অবস্থা পূর্ববৎ। বাসুদেব স্থির করেছে আগের ভুল আর করবে না। একে ডাক্তার দেখাবে ভালো করে। টাকা-পয়সা তার নেই বটে, কিন্তু অনেকরকম সরকারি সুযোগ-টুযোগ আজকাল হয়েছে। এই বন ছেড়ে তাকে এবার মাঝে মাঝে বেরোতে হবে হয়ত বা। নাঃ, সাধু-জীবন বুঝি আর রাখা গেল না।
এই বন তার গাঁ থেকে তিন কিমি মাত্র দূরে। কিন্তু গ্রামের সঙ্গে সংস্রব নেই আজ বহুদিন হয়ে গেল। বাপের ভিটেটি জবর-দখল হয়েছে। মাঝে মাঝে দু-একজন খাপছাড়া লোক, চোর-ডাকাত এসে ঢুকে থাকে এখানে। তাদের মারফৎ খরব পাওয়া যায়। শুধু খবর নয়। জিনিসপত্রও তারা কিছু কিছু এনে দেয় দরকার মতো। একটি পয়সা নেয় না তার বিনিময়ে।
আপ্লা আসার পরে এই ছন্নছাড়া জীবন আবার সংসার ধর্মের স্পর্শ পেয়েছে। বাসুদেবের বাৎসল্য বেড়ে গিয়েছে বহুগুণ। সাংঘাতিক সব স্বপ্ন আপলাকে নিয়ে তার। আগেরবার এই নুলো-ল্যাংড়া ছেলেটার জন্যো কিছুই করতে পারেনি। চোখের সামনে বেপরোয়া বিপথগামী হয়েছিল সে। আর সেই ভুল নয়। এবার একে বেশ করে লেখাপড়াও করাবে এই ভেবে রেখেছে বাসু।
বেলা আন্দাজ বারোটা নাগাদ ভিক্ষে করে বনে ফিরে এলো বাসু। ইতিমধ্যেই সে বন থেকে বাহির হতে শুরু করেছে। প্রথমেই প্রতিষ্ঠিত ও উন্নাসিক কোনো লোকালয়ে না গিয়ে, গিয়েছে তুলনায় নিষ্প্রভ এক জনপদে। একেবারে গন্ডগ্রাম। নাম বাঘমানমি। তা ফিরে এসে দেখল আপলা ঘরে নেই। ঘর মানে একখানি মাটির নিচু চালা। আশেপাশের ঝোপঝাড়গুলিই তার দেওয়াল। আর -সব দেওয়ালে টিকটিকি থাকে, এখানে থাকে সাপ।
চারিদিক খুঁজেও বাসু আপ্লার দেখা পেল না। সামনে একটা মস্ত ইঁদারা। আপলা সেখান থেকে জল নিয়ে আসে। বড় অস্বাস্থ্যকর জল। কিন্তু এ ছাড়া উপায়ই বা কী! এই বনে কে আর নলকূপ খুঁড়ে দিচ্ছে!
উঁচু একটা মাটির বেদী। তার চারপাশে শ্যাওড়া ঝোপ। বেদীর ওপর একটা তরুণ অশ্বত্থ গাছ। এটা নেপাল সাধুর কবর। অন্য সাধুদের কবর সম্পর্কে নেপাল সাধু বলতো, কবর বলতে নেই রে ব্যাটা, বলবি যে অমুক বাবার আরাম করার জায়গা।
তা নেপাল বাবার ইদানিং আর আরাম হয়ে উঠছে কিনা জানা নেই। যা শেয়ালের উপদ্রব! দ্যাখো গিয়ে তলে তলে সব বড়ো বড়ো গর্ত খুঁড়ে বসে আছে।
নেপাল বাবার কবর পর্যন্তও গিয়ে দেখে এলো বাসু আপ্লাকে। নেই। তার মানে আর খুঁজেও লাভ নেই বিশেষ। সে মাঝে মাঝে এরকম অদৃশ্য হয়ে যায়। কোথাও যে পালায়-টালায় না, তাও অবিশ্যি অনুভব করা যায় কী রকম একটা অনুভূতি দিয়ে। আবার একসময় চোখের সামনে যেন কোনো পর্দা ভেদ করে হঠাৎ এসে হাজির হবে।
আপ্লাকে না পেয়ে বাসু ভিক্ষে করা চাল-ডাল দিয়ে রান্নার জোগাড়ে বসে গেল। জ্বালানি এখানে ফুরোয় না। শুকনো ঝরা পাতাদের গরুর বাগালের মতো তাড়িয়ে এনে কপাটহীন ঘরে এনে জড়ো করে দমকা হাওয়া।
রান্না তো ভারী! একটু পরেই নেমে গেল খিচুড়ি। আপ্লা এখনো এলো না।
বাসু আবার গেল নেপাল বাবার আরামের জায়গায়।
এবার আপ্লা ও নেপালবাবাকে যুগপৎ দেখা গেল। নেপালবাবাকে এরকম প্রকাশ্যে বড়ো একটা দেখা যায় না। তবে মাঝেমাঝেই বাসু ঘুমের মধ্যেও তার হাঁকডাক শুনতে পায় বটে।
কবরের মাটিতে ঘর কেটে দাদু-নাতির মতো তারা বাঘবন্দি খেলছে।
নেপাল বাবা একটা চাল দিয়ে বিস্ময়ে ও আনন্দে একবার বলে বলল, আমার শ্বাস-প্রশ্বাস একেবারে নিভিয়ে দিলি! হারিয়ে দিলি আমায়, অ্যাঁ!
আপলার শরীরে গোটা দিন বড়ো কষ্ট। এখন সেটা একেবারে নেই। সে বেশ তৃপ্ত হয়েছে বোঝা যায়।
আপলা যে ইতিমধ্যেই বুদ্ধিমান হয়েছে এতে বাসু খুব খুশি। এবার তাকে কোমর বাঁধতে হবে। আপলাকে করতে হবে মানুষের মতো মানুষ। এর প্রতি তার মায়ার শেষ নেই।
আগে বুঝি এতোটা ছিল না! হয়ত ছিল, বাসু তখন মনেপ্রাণে টের পায়নি এমন করে। চিরকাল বাসে কান্ডাক্টটরি করে এসেছে। বাস ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। সকালে চাপতো বাসে গাঁয়ের বাসস্ট্যান্ডে। বিকেলে এসে নামতো এখানেই। বাসটা চলে যেতো আরো দূর। সোনাথলি নামের একটা গজ্ঞে। বাসুর গাঁ অব্দি আসতে খালাসি দু-জন কনডাক্টরের ভূমিকায় কাজ চালিয়ে দিতো। বরাবর ছিল এই ব্যবস্থা। এর মাঝে ছেলেপিলেদের দিকে নজর দেওয়ার বা বাৎসল্য উপভোগ করার গরজ বাসু দেখায়নি কস্মিনকালেও। পাঁচটি ছেলে-মেয়ে শরীরে এবং মন্দ অভিপ্রায়ে বেড়ে উঠছে যেন তারই অজানায় আগাছার মতো।
খেলাও শেষ হলো, ইতিমধ্যে বাপকেও দেখতে পেলো আপলা। ছুটে এসে সে বলল, বাপ হে বাপ, দাদুর আজ কালঘাম ছুটে গেছে!
বছর দশেকের আপ্লার কথা বেশ মুরুব্বির মতো। কিন্তু বাবার প্রতি সম্বোধনটা বড়ো কুশ্রাব্য। এর শিক্ষা আরো দরকার। বুদ্ধি আছে শুধু তাকে সৎপথে ও সুসংস্কারে চালিত করার একটা ব্যবস্থা চাই।
নেপাল বাবা বাসুর বিষয়ে দারুণ অন্তর্যামী। সে বাসুর মনের কথা টের পেয়ে একটু গম্ভীর ভাবে বলল, ওকে আর কি ইস্কুলে দেয়া সম্ভব রে ব্যাটা! তোর কপাল বড়ো খারাপ। সময় তোকে মেরে রেখে গিয়েছে। এই বাঘবন্দিতে আমার যেমন দশা হোলো আজ তেমনি।
বাসু তখন নেপাল বাবার কথাটা ভালো বুঝতে পারলো না যে দশ বছরের ছেলের পক্ষে ইস্কুলে ভর্তি হওয়া এমন কী দেরি! কিন্তু খেয়ে উঠে ভাত ঘুম দিতে গিয়ে সে কথাটা নিয়ে যখন নাড়াচাড়া করতে শুরু করলো তখন তার সর্বাঙ্গ অনির্দিষ্ট আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো।
তার হঠাৎ কেন জানি মনে হলো, এই সাধু-জীবন সত্যি নয়। সে কনডাক্টটারই আছে। দুপুর একটা কুড়িতে ছাড়ছে বাস পুরুলিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে। মাকড়াসার জালের মতো এখান থেকে ছড়িয়ে গেছে মানুষের গন্তব্য। অন্য কনডাক্টরদের মতো সে-ও এক ঊর্ণনাভ। তারও কিছু রসদ চাই এখান থেকে। মানুষ নিজেই যে কত গভীর ব্যাপার – মাত্র একটা জেলার দূরত্বের ব্যাপ্তিতেই তাদের গন্তব্যের কথা ভাবলে বিস্ময়ের সীমা থাকে না – আরো বড়ো করে ভাবা তো পরের কথা!
এই ব্যস্ত জীবন শ্রান্ত হয়ে জুড়িয়ে এসেছে কত কাল! আজকাল কোলাহল জিনিসটাই তার অচেনা ঠেকে। আপ্লা আসার আগে এই সেদিন পর্যন্ত বাসুর মাঝে মাঝেই মনে হতো সে বুঝি বধির হয়ে গেছে। জঙ্গলে পর্যন্ত বহুদূর অব্দি কোনো আওয়াজ নেই; যেন অগাধ প্রাগৈতিহাসিক গুম্ফার কায়াহীন অনঙ্গ অন্ধকার হরণ করে রেখেছে শ্রুতির সকল সম্ভাবনাকে। এমন কত দিন কেটেছে বাসুর এমন শব্দহীন আশঙ্কায়। বিশেষ করে দাউ দাউ বিকেল পুড়ে গিয়ে আসন্ন সন্ধ্যাবেলাটা যখন তার অঙ্গার মাত্র হয়ে পড়ে থেকেছে সেই সময়টা।
বাসু পিতার কর্তব্য কোনোদিন যথার্থ পালন করেনি। ছেলেমেয়েদের যখন উচ্ছনে যাওয়া শুরু হয়েছে – ইতিমধ্যেই একটি-দুটি গেছে এবং বাকিগুলিও সেই পথেই পা রেখেছে, সংসারে চরম কষ্ট, তখন বাসু আর চাপ নেবে না ঠিক করে নিজের বাকি জীবনের শান্তিকেই প্রাধান্য দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
বাসুর বাস ভোর চারটেয় হর্ন দিয়ে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতো বাসুর অপেক্ষায়। বাসু লুঙ্গির গিঁট বাঁধতে বাঁধতে ছুটতো তাকে ধরতে। বাসে তার অন্য কাপড়চোপড় থাকতা – লুঙ্গি ছেড়ে সেগুলি পরে নিতো। বিকেলে একই রকম হর্ন দিয়ে বাস বাসুকে ফিরিয়ে দিতো পরিবারে। সেদিন সকালের হর্ন বাসুকে আহ্বান জানালেও বিকেলে আর প্রত্যাবর্তন ঘটালো না। বাসু নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।
এখানে ওখানে বহু জায়গায় ঘুরলো, শান্তি দেখলো কোথাও নেই। কী একটা সে চিরতরে বিসর্জন দিতে চায় আর কে একজন সেটাকে বঁড়শি গেঁথে তুলে আবার যেন অর্জন করতে চায়। এরকম হলো তার উন্মাদের দশা। শেষে একেবারে গাঁয়ের এলাকার মধ্যেই শান্তি লাভ ও শ্রান্তি নিবারণের এই নিভৃত বনে তাকে টেনে আনলো নেপাল বাবা। বাসু দেশের মধ্যেই নিরুদ্দেশ হয়ে রইলো।
নেপাল বাবা আগে থেকেই এই বনে অধিষ্ঠিত। দূর দেশে প্রবেশ করেছে ভেবে ক্ষুধা-কবলিত শ্রান্ত আছন্ন বাসু তার অদৃষ্টপূর্ব একটা রাস্তা দিয়ে এই বনে ঢোকে। এটা তারই এলাকা সে সম্পর্কে তখনো পর্যন্ত সে আপাদমস্তক অজ্ঞাত। পরে বাসুর গ্রামজাত চোর-ডাকাত আদি অনুপ্রবেশকারীরা তার অবস্থান সম্পর্কে তাকে নিশ্চিত করে।
তাদের একজনের নাম, শরাবন – অর্থাৎ শ্রাবণ। তার ধারণা যে বাসু আর নেপাল বাবা দোঁহে খুব সাধনা-টাধনা করায়
দূরদর্শনের মতো কিছু বিদ্যা তাদের অধীত হয়ে থাকবে। সুতরাং এই সাধক দ্বয়ের দৃষ্টির এলাকা যে কোনো সীমাবাঁধা ক্ষেত্র নয়, বেশ খানিকটা অধিক দূর প্রসারিত, তা বলাই বাহুল্য। যা তারা আগে থেকেই জানে তেমন কথা শরাবন মুখে বললেই বা দোষ কী! সেই ভরসাতেই একদিন বেলা ডুবু-ডুবু বসন্তের বিকেলে কথায় কথায় সে প্রায় অকুণ্ঠ ও নির্ভয় হয়েই বলে বসল, তোমার ভিটের আবস্থা বড়ো খারাপ হয়েছে দাদা। একদিন ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরের মধ্যিখান দিয়ে বৌদিদি নাকি উপরকুলি পেরিয়ে ভট্চাজ কুলি তারপর আর সাতআনা পাড়া – তোমার নিশ্চয় মনে আছে আমাদের গাঁয়ে দুটো বেভাগ (বিভাগ)। একটা হলো ঐ সাতআনা আর আরেকটা নয়আনা। নয়-সাতে ষোলো। গ্রামের পুরোটা ষোলোআনা। তা ষোলো আনার পরে ত আর কিছু নেই। হা হা করে বেড়াচ্ছে রোদ্দুর। রক্ত চুষছে লোকের। এমন ফাঁকা যেন একটা আকাশের তলে আরেকখানা আকাশ। তার ভেতর দিয়ে ভাসতে ভাসতে বৌদিদি আমাদের কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
নেপাল সাধু কাঁচা পলাশ পাতায় দোক্তা মুড়ে সেটাকে বিড়িতে পরিণত করেছে – এই স্বহস্ত রচিত প্রাকৃতিক বিড়ির সাহায্যেই সে মৌতাতের ভগ্নাংশ আহরণের চেষ্টা করে থাকে। এ জিনিসের নাম চুটি।
শরাবনের কথার মাঝে একখানি চুটি দগ্ধ হয়ে নিঃশেষ হয়েছে আগেই। এখন দ্বিতীয় আরেকটি ধরিয়ে নেপাল বাবা বলল, এতো হেঁয়ালি করে বন্ননা (বর্ণনা) করছিস কেনে রে শরাবনা? বাসু নাকি কলকেতার লোক অ্যাঁ! ওর গাঁ নয় এটা? ও চেনে না?
শরাবন একটু অপ্রীত হলো বটে কিন্তু তার বিনীত ভাব গেল না বা নেপাল বাবার প্রতি শ্রদ্ধাও কণামাত্র বিনষ্ট হলো না। সে বলল, আইজ্ঞা তা লয়। দশ-বারো বরষ আগেও সাতআনার পরে ছিল ঘোর বনজঙ্গল। এখন সেখানে খাঁ খাঁ করছে বত্রিশ বিঘের ফাঁকা ডাঙ্গা জমি। গাছের বনের জায়গায় ধুলোর বন, হে হে!
শরাবনের প্রগলভতায় নেপাল বাবা তিতিবিরক্ত হয়ে বলল, আঃ, কী শুরু করেছিস রে বাঞ্চোৎ –
শরাবন বিন্দুমাত্র বিচিলিত না হয়ে বলল, বাসুদাদা গ্রামেরই লোক ছিল বটে একদিন, কিন্তু বনকে ফাঁকা মাঠ হিসেবে চিনতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়।
নেপাল বাবা বিরক্তি পরিহার না করেই বলল, আর যে বললি বৌদিদি ভাসতে ভাসতে হারিয়ে গেছে – গাঁজা খেয়েছিস নাকি?
– ও হলো একটা কথার কথা। আজকাল নীলবরণী কালীর মন্দিরে সন্ধ্যের সময়টা হেমন্ত পাগলার সঙ্গে কাটাই। বেশ কথাবার্তা হয়। কোথা দিয়ে সময় কেটে যায় বোঝাই যায় না। বৌদিদিকে ত ও-ই শেষবার দেখেছিল। তাই ওর কাছে শোনা কথা ওর মতন করেই বললাম। তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে ডান হাত প্রসারিত করে হাতের রেখাঙ্কিত মানচিত্র নেপাল বাবার সম্মুখে মেলে ধরে শরাবন বলল, বাবা, আমার যে সন্দেহ হয় বড়ো হে, হেমন্ত আমায় আবার ওর দলে টানেনি ত আমাকেও খ্যাপা বানিয়ে? হাতটা দেখে বলো দেখিনি, আমি খেপেছি কিনা!
এই সব কথাবার্তা চলে; তার মাঝে বাসুদেব চুপ করে বসে থাকে। বাক্যালাপ প্রায় করেই না। নেপাল বাবাকে মনের কথা কিছু খুলে বলতে হয় না। সে সবই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বুঝে যায়। বাসু অন্যত্র মৃদুভাষী শুধু নয় – ক্ষেত্র বিশেষে মৌনী।
সেদিন হেমন্ত পাগলার আরেকটি দর্শনেরও কথা শোনা গেল শরাবনের মুখের বাণীতে; খানিক এলোমেলো এবং হেমন্ত পাগলার কাব্যের অক্ষম ও বিকৃত প্রয়োগে ভরা। কিন্তু মূল ব্যাপারটি হল এইঃ বছর সাত-আষ্টেক আগের এক চৈত্র মাস। সুপবন বইছে। অচেনা পুষ্প সকল লুকিয়ে আছে বটে – কোথাও গাছের গুঁড়ির এক হাঁটু জঙ্গলে; কোনো আস্তাকুড়ের পাশে; জল শুকিয়ে আসছে এমন জলার ভেতর কলমি লতার দামে যেখানে কোনো বান্ধবহীন জলচর পক্ষী নিতান্ত নিরুপায় বাঁচার সাধনায় মগ্ন হয়ে আছে – কিন্তু সেই সকল পুষ্পও যে অনিবার্য, জীবনের কোনো বৃহত্তর অর্থের চেয়েই যে তাদের এই থাকাটা খাটো নয় তাই তারা সবিনয়ে ও সানন্দে ঘোষণা করছে। কোকিলের ছানাপোনা ইতিমধ্যেই হয়েছে এবং আরো হবে; তাদের অপ্রতিরোধ্য সুর – একযোগে যতোটা দেখা যায় সেই আপাত শেষ নির্দেশ সূচক দিগন্ত রেখাটাকে পর্যন্ত কাঁপিয়ে উল্লসিত করে আসছে।
এমনই এক অপরাহ্নে বাসুর ছোটো ছেলে আপ্লাকে দেখে এলো হেমন্ত খ্যাপা। এক্কেবারে অদৃষ্টপূর্ব দেখা।
সোনার গুঁড়োর মতন হিরন্ময় ধুলো মেখে শুয়ে আছে আপ্লা। সোনালি সুতোর মতো বিকেলের আলো তার চতুষ্পার্শ্বে নিভৃত মশারির মতন অটুট রেখেছে তার ঘুম। বুকের কাছে রক্তপ্রবালের মতো একটা মণি পর্যন্ত ধারণ করেছে সে। লোকে লোকারণ্য। পুলিশের একটা গাড়ি এলো প্রচুর ধুলো ও ধোঁয়া সমন্বিত হয়ে। কিন্তু সেদিন থেকে কী মায়াঞ্জন যে হেমন্ত খ্যাপার চোখে লেগে রইল, আপ্লাকে সে দেখতে লাগল ঠিক ওরকম অনিন্দ্য রূপে; এবং মাঝে মাঝে, মধ্যরজনীতেও সে একটি জিজ্ঞাসায় প্রায়শই পীড়িত হতে লাগল; জীবনে প্রথমবার অমন অপরূপ রূপে সেজেও আপ্লার মুখে কেন রয়ে গেল অকথ্য বেদনা ও বিষণ্ণতার প্রগাঢ় ছায়া? এই প্রশ্নের আকরিক মাত্র উত্তরও সে বহু বিনিদ্র রাত্রি খুঁড়ে পায় না। নীলবরনী কালীর মন্দিরটি বহু প্রাচীন। হাতির পায়ের মতো থাম, মোটা মোটা প্রাচীর। সন্ধ্যার একটি ক্ষীণ তনু প্রদীপের প্রজ্জ্বলন সময়টুকুতে ছাড়া সুপ্রাচীন অন্ধকারের অধিকার বিরাজ করছে সেখানে। সেই অন্ধকারের ভেতর হেমন্ত খ্যাপার সেদিন হতে চিরস্থায়ী অস্বস্তি শীতল গোঙানির রূপ ধরে বিরাজ করতে লাগল নিরবিচ্ছিন্ন সকাল ও সাঁঝগুলিতে। আগের চেয়েও সে আরো বিষদ উন্মাদ হয়ে উঠলো। ভয়ে আর কেউ মন্দিরের ধার মাড়ায় না। একমাত্র শরাবন শত ঝুঁকি নিয়েও তাকে পরিত্যাগ করতে পারে না। কী এক অমোঘ আকর্ষণ তাকে বিকেলের পর থেকেই টানতে থাকে। তাকে উপেক্ষা করার সাধ্য তার নেই।
এই আখ্যান শুনে বাসুর বোধহয় বোধগম্য হতে সময় লাগলো খানিক। ময়াল সাপের মতো ব্যাপারটির পাচনের প্রত্যাশায় সে গুম হয়ে বসে রইলো তো রইলোই।
নেপাল হঠাৎ এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালো বাসুর সেদিনের সান্ধ্য আহারের জন্য প্রজ্জ্বলিত উনুন থেকে জ্বলন্ত একটা কাঠ টেনে বার করে নিয়ে।
নেপালের চোখে ধকধক করছে উন্মত্ত ক্রোধ। সে তার জরা এবং শরীরের অসামর্থ্য পুরোপুরি বিস্মৃত হয়েছে।
শরাবন হকচকিয়ে গেছে দারুণ। তার অপরাধ সে সুনির্দিষ্ট ভাবে বুঝতে পারছে না। বাচলতা হয়েছে এইটুকু মাত্র বোধগম্য হয়েছে।
নেপালের তুলনায় সে অনেক বেশি জোয়ান, তার বয়েসও এমন বেশি কী! তা ছাড়া এই বনের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে দামদর নদ; তার জলে ডোবা ও আধডোবা হয়ে রয়েছে অনেকগুলি প্রাচীন জৈন মন্দির, সেগুলির দর্শনে শীতকালে আসে পর্যটক; জায়গাটার প্রসিদ্ধি ছিল একদিন ভালোই – সেই সব দিনে শরাবনের দল কর্তৃক পর্যটকরা প্রায়শই মাঝ নদীতে লুন্ঠিত হতো – সেই ডাকাতে পেশাদারিত্বের অবলুপ্তিও শরাবনের শরীরে বা মনে ঘটেনি সে বাহ্যত তা পরিহার করলেও।
তবু নেপাল বাবার সঙ্গে সে সংঘর্ষে যাবার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারলো না।
সে একটি অভিনব কিশোরের মতো অভিমানের গলায় বলল, তোমাদের তিন নম্বর চোখ আছে, আগেই সব দেখে রেখেছো; আর আমি মুখে বলতে গেলেই যত দোষ!
কথাটা বলেই শরাবন বুঝল বাসুদার ছোটো ছেলে আপেলের প্রসঙ্গটিই এই অনিষ্টের মূল।
দ্রুত পালাতে গিয়ে কাঁটায় আটকে তার জীর্ণ জামাটা ছিঁড়ে গেল ফরফর করে। প্যান্টটাও ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। তখন সে নিম্নাঙ্গের পোশাকও খুলে ফেলে সম্পূর্ণ বিমুক্ত ও নির্ভার হয়ে অন্ধকারে অবলুপ্ত হয়ে গেল।
নেপাল বাবা তার পলায়ন-পথের দিকে জ্বলত কাঠটা ছুঁড়ে দিয়ে বলল, লোকের অনিষ্ট করতে লোককে কাঁদাতে আসিস এখানে! তারপর, শরাবন যেন ঝোপঝাড়ের আড়ে তার কথা শোনার জন্যেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে বসে আছে এমনি ভাবভঙ্গিতে উচ্চৈঃস্বরে নেপাল বাবা বলতে লাগলো, তুই শালা আবার হেমন্তের কাছে যাস! হেমন্তের কাছে? যে একা নিরন্ন অবস্থায় কাঁদে কে এক মানুষ কবে চলে গেছে তার জন্য – তার মতো হতে পারবি তুই কোনোদিন? তার নখের যুগ্যি? – ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেই সন্ধ্যায় তারপর নেপাল বাবাকে স্বয়ং খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্তে নিয়োজিত হতে হলো।
দেখা গেল সুদীর্ঘ অনভ্যাসে এই কাজে সে বেশ পিছিয়ে পড়েছে। ভাত পুড়ে গেল, অথচ ভাতের সঙ্গে আলুগুলি সেদ্ধই হলো না ঠিক মতো।
বাসু আহারাদি কিছুই করলো না। যেমন ছিল তেমনই ঠায় বসে থাকলো।
ক্রমশ রাত্রি আরো নিঝুম হয়ে এলো। মাথার ওপরকার পরিষ্কার আকাশটি এখন শব্দহীনতায় গমগম করছে। এই আকাশের নিচেই কতো বড়ো বড়ো শহর, বন্দর। মানুষের শহর ওপরেও বাড়ছে বিরাট বিরাট সব অট্টলিকার কল্যাণে। কিন্তু এক সময় কোথাও না কোথাও একটা অদৃশ্য দুর্লঙ্ঘ্য সীমায় এই ব্যাপ্তিকেও আটকে যেতে হয়। তার ওপরে আকাশ আগের মতোই নির্বিঘ্ন অপরিবর্তনীয় ও অনাধুনিক। সেখানে তাকে আর কোনো বিকার বা সাকার কিছুই স্পর্শ করতে পারে না। তার গৃহীরূপ – বৃক্ষশীর্ষের কচি ডালপালাগুলির উদ্দেশে সস্নেহ কোল পেতে রাখা – প্রভৃতি প্রবৃত্তি সবই এখানে অপ্রাসঙ্গিক, অসাড়, অনিত্য। গগনচুম্বী বা অভ্রংলিহ কোনো শব্দই যথার্থ নয়। হয় কথার কথা, নয় সান্ত্বনা। ঊর্ধ্ব সম্পর্কে মানুষের এই সান্ত্বনা বেশি দূর বিস্তৃতও নয়; সেটুকু মাত্র উপদ্রবের পরে এই আকাশ কেবলই এক তর্কহীন উদাসী অনন্ত । কিন্তু ঐ যে ‘এক’ কথাটি ভেবে বসেছে বাসু, সেটিও বড়ো অর্থহীন। অনন্তের একই বা কী দুই-ই বা কী!
এই ঘটনার পরে নেপাল বাবা আরো গভীর অভিভাবক রূপে বাসুদেবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। কত কথা একেক রাতে শুয়ে শুয়ে।
একদিন বলল, আমরা আশ্রয়ের কথা কত সহজ করে ভাবি – বলি তার চেয়েও তরল করে। কিন্তু আমার কেন জানি মনেহয় রে বাসু, আশ্রয়-কেন্দ্রিক মানুষের মনোজগৎটি কী রকম যেন গোলমেলে।
বাসু তার দিকে পাশ ফিরে শুলো। ভুরভুর করে বেরোচ্ছে তামাকের গন্ধ নেপাল বাবার মুখ দিয়ে। ঘরের বাতাস বেশ ভারী, চলাচলহীন। বনজঙ্গলের যেগুলি স্ফূটাস্ফূট স্বাভাবিক শব্দ তারা আনাচেকানাচে, কাছেপিঠে – এমনকি বহুদূর পর্যন্তও বিলীন এবং বেবাক নয়। কিন্তু তারা নৈঃশব্দেরই প্রতিনিধি; ওদের ব্যত্যয়ে নিস্তব্ধতার পরিপূর্ণ প্রকাশ নেই। একেকবার কোথা থেকে নিশাচর লাজুক গন্ধ আসছে একেবারে ভেতর অব্দি।
বাসু বলল, হঠাৎ আশ্রয়ের কথা বলছো যে বড়ো? আবার কোথাও সাধু হয়ে পালাবার মতলব বুঝি?
নেপাল বলল, দূর, কী যে বলিস! দু-বার কেউ সাধু হয়! এবং এখেনেও আমারা যেন কতো সাধু হয়ে দিন কাটাচ্ছি! সংসার ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে আসা শুধু। তারপর সেই ত দু-বেলা খাচ্ছিদাচ্ছি, দিবানিদ্রার অভ্যেস পর্যন্ত হয়ে গেছে এখন যা কস্মিনকালেও ছিল না।– বলে নেপাল বাবা হঠাৎ রাতের পর্দা কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো; বলল, চুল-দাড়ির গতি রোধ করিনি ঐটুকুই আমাদের উদারতা। তার বাইরে একটা অলস গার্হস্থ্য জীবন কাটাচ্ছি নিরবিচ্ছিন্ন। তা ঐ কথাই এতোক্ষণ শুয়ে শুয়ে ভাবছি – বিশ্বাস কর। গরু-ছাগল যেমন বিক্রি হয়ে গেলেও নতুন মালিকের দড়ির টান প্রতিরোধ করে পুরনো বাড়িতে এসে হাজির হয়, আমার মনটা হয়েছে তাই। তোর ভাবনাটাই ওর আবাস। দ্যাখ এতোক্ষণে ঠিক অকুস্থলে এসে পৌঁছে গেল। বলছি, সাধু হয়ে তুই দেশ নানা বেড়িয়ে এলি বটে কিন্তু –
বাসু আহত হয়ে বলল, দেশ বেড়াতে গিয়েছিলাম বুঝি!
–আহা, এসে ত পড়লি প্রায় নিজেরই ভিটেমাটিতে। এটা লোকারণ্য নয় বটে তবু খান্ডবপ্রস্থ বা নৈমিষারণ্য বলতে ত পারি না একে। তুই যে ফিরে এলি পুনরায় এটা কিন্তু কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয় রে। এটা একটা চক্র। সেই চক্রেই তুই ঘুরপাক খাচ্ছিস।
বাসু বলে, তবে যে তুমি বলো এযাবৎ শাস্ত্রোক্তি শ্রবণের যেটুকু অভিজ্ঞতা তোমার হয়েছে তার কিছুই তুমি বোঝো না – বা পরের জন্ম ইত্যাদি নিয়ে ভাবিত হওয়ার বদলে এই জীবনেই ধাবিত হতে পারাকেই মহাপ্রাপ্তি ভাবো। তা তুমি যে শাস্ত্রজ্ঞ তা তোমার কথার আভরণেই টের পাই।
নেপাল বলল, না রে, আমি শাস্ত্রজ্ঞ একেবারে নই। সংহিতা-টংহিতায় ওরকম ধরণের একটা চক্রের কথা শুনি বটে, কিন্তু আমি অশাস্ত্রীয় জীবনের কথাই বলছি। জীবনচক্র। তারপর হেসে নেপাল বাবা বলল, সেদিন ভাবিত-র সঙ্গে ধাবিত মিলিয়ে দিয়েছিলাম বুঝি! হবেও বা। তা বাসু, আমাদের গৃহীজীবনেই ত অলৌকিক কম নেই রে! এই যে ভাত পুড়ে গেল, আলু সেদ্ধ হলো না, এ ত সোজা কথা নয়। যাই হোক, সেদিন তোর মন বলছিল আশ্রয়ে ফেরো, সেকথা তুই সোচ্চারে শুনতে পাসনি বটে তবে কথাটা ছিল বিলক্ষণ; – হয়ত একটা তীক্ষ্ণ অকথ্য অনুভব রূপে। তাই আমি ভাবছিলাম আশ্রয়ের অনুভব ঠিক কীরকম? নিজের গাঁয়ের পথ ধরে মধ্য যামে আমার যদি দু-তিন মাইল পথ হেঁটে একটু বেড়াতে ইচ্ছে হয় – তখন চোখে কেবলই যেন একটা স্বস্তিক চিহ্নের অভয় মুদ্রা দেখতে পাই – তার দিক থেকে আসছে অকুন্ঠ প্রশ্বাস ও প্রশ্রয়, আমি তা গ্রহণ করছি আহরণ করছি যথেচ্ছ – সে যে কী আরাম বাসু তুই নিজেও নিশ্চয় জানিস! কেমন এক আত্মবিশ্বাস তখন জ্বরের আতপের মতো প্রখর হয়ে থাকে – আমার যদি কিছু হয় এই মুহুর্তে, আশেপাশের গাছতলে আমি পাবো স্বতঃপ্রণোদিত কোল এবং তার অব্যর্থ শুশ্রূষা। বা এই রাস্তাই হয়ত সংবাদ-তরঙ্গ পাঠিয়ে দেবে গাঁয়ে; গাঁয়ের মানুষ গুচ্ছ গুচ্ছ হিতাকাঙ্ক্ষা নিয়ে ছুটে আসবে। প্রাকৃতিক ও মানবিক ও মানসিকভাবে এই চেনাশোনার স্বস্তিটাই আশ্রয়ের বৈশিষ্ট। এই স্বস্তি আমার হিসেবে যেহেতু অন্য অন্য অচেনা স্থানের আকাশে ও হাওয়ায় বিরাজমান নয়, তাই সেই সেই জায়গায় আমার মন নিরাশ্রয় বোধে আবিল হয়ে রইবে।...
নেপাল বাবার এমন নিবিড় শারীরিক সাহচর্য ও আন্তরিকতা বাসু তারপর আর কোনদিন লাভ করেনি। এর মাস কয়েক পরেই নেপাল বাবার নশ্বর শরীরের অবলুপ্তি ঘটে। মাঝখানের সময়টা তার রোগভোগের ও বাসুর তাকে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত দিয়ে সেবা করার অধ্যায়।
নেপাল বাবা আজও আছে। সেই আগের মতোই কড়া অভিভাবক হয়ে – তাত্ত্বিক ও আন্তরিক হয়ে। আগের মতোই সে নিজেরই বলা কথার অপলাপ ঘটায়। মায়া ও মতিভ্রমে বাসুকে ঘুরিয়ে মারে। তবে বেশিরভাগ সময় অদৃষ্টই থাকে। পাঁচ-ছয় মাস পরে হঠাৎ করে একদিন হয়ত দেখা গেল তারপর আর নেই তো নেই-ই। তখন সে শুধু অশরীরে ধ্বনিত হতে লাগল বাসুর মনে ও কানে।
সেই প্রাক্তন ডাকাত শরাবন এখনো আসে। তবে সম্পর্কটা বদলে গেছে আমূল। তার সকল সাহস কেন জানি একেবারে অন্তর্হিত হয়েছে। সে অলক্ষ্যে নানা জিনিস রেখে একেকদিন বাসুকে একাকী আলাপরত অবস্থায় দেখে দুরুদুরু বক্ষে ফিরে যায়। দেখা আর কোনোদিনই দেয় না সে। নেপাল বাবার সেবাও করেছে এরকম অলক্ষ্যে।
বাসু টের পায় তার অস্তিত্ব। মুখে কিছু বলে না। চায়ও না কিছু।
বাসুর ছোটো ছেলে আপ্লা আসার পরে বাসুর একদিন শরাবনের সঙ্গে পুরনো সম্পর্কটিকে এরকম নিরাকার অবস্থা থেকে আমার সাকার করতে ইচ্ছে হয়। ইতিমধ্যে একটি জিজ্ঞাসার তাড়নাও বাসুর মধ্যে প্রবল হয়েছে। সেটি এই যে, শরাবন আপ্লাকে দেখতে পায় কিনা! কেন তার এমন প্রশ্নের প্রাবল্য ঘটলো? তার কারণ হলো এই – আপলা আসার পর অনেকদিন কেটে গেলেও শরাবন এখনো তাকে এমন কিছু জিনিস দিয়ে যায় যাতে বোঝা যায় যে এ হলো একজনের মাত্র হিসেব। যেমন, ত্রিশ-বত্রিশটি শালপাতা এক মাস অন্তর। এতে বেশ বোঝা সম্ভব যে এ দিয়ে সে একজনকে এক মাস চালাতে দিয়েছে।
শরাবনের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপচারিতা হওয়ার কথা পরদিন সকালে। কিন্তু সেই রাতেই নেপালবাবা প্রবল ভাবে ধ্বনিত হয়ে বাসুকে বারংবার নিষেধ করে দিলো ঐ প্রশ্নটি শরাবনকে না শুধোতে। ‘কেন’ – তার উত্তর নেই কিছু – নেপাল বাবা রাগ ও বিরক্তির সঙ্গে জানিয়ে দিলো। এটুকু শুধু সে জানাতে চায়, বাসু ইদানিং নেপালের শোকে পাথর, বাৎসল্যে কাতর – এবং যে কর্তব্য সে অবহেলা করে এসেছে সংসার জীবনে তার অপরাধবোধে পীড়িত। এখন যদি সে দৃষ্টিপথের বাইরে কিছু চায় বা নয়নপথগামীও কিছু দেখে উভয় ক্ষেত্রে অনুতাপ ও হতাশা এড়ানো হবে তার প্রধান উদ্দেশ্য। যদি ভ্রষ্ট তারা দেখে আকাশে – তার মনে হবে তারাটি আদৌ পতনশীল নয়, বরং পৃথিবীতে ফিরতেই উৎসুক ও উন্মুখ। এই হয়েছে তার মনের বর্তমান অবস্থা।– শুনে বাসু ভারী আশ্চর্য হয়ে গেল। বাসুর মন এরকম উর্বর হয়েছে বলেই না নেপাল পঞ্চভূতে বিলীন হয়েও এখনো ওখানে নিজের অস্তিত্বের চাষ করতে পারছে। কিন্তু নেপাল বাবার সন্দর্ভ থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, বাসুর হৃদির ভেতর বর্তমানে প্রচুর অনুচিত ও অবর্তমানের প্রাবল্য ঘটেছে; এর আরেকটা মানে এও হয় যে,নেপালের ধ্বনিটি নিজেই নিজের বিরোধিতা করছে! এমন আত্মঘাতী ধ্বনি বাসু জীবনে শোনেনি।
যাই হোক, নেপাল বাবার কথা মেনে বাসু শরাবনের সঙ্গে আলাপচারিতায় গেল না আর। কিন্তু পূর্বোল্লিখিত সেই জিজ্ঞাসাটির কণ্টকে সে ক্ষতবিক্ষত হতে লাগলো।
আরেক দিন ওরকম। বেলা তখন দুপুর। মাটির মেঝের ওপর শুয়েছিল বাসু। ঘামে ভিজে গিয়ে পিঠের নিচের মাটি একখাবলা আঠার মতো সেঁটে গিয়েছে। আজকাল সারাক্ষণ বড়ো ক্লান্ত লাগে। প্রায়শই অসময়ে নেমে আসে অনৈতিক স্বেচ্ছাচারী ঘুম।
আপ্লাকে যতো দেখে মায়া বাড়ে ততো। ছেলেটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ও একটা হাতের সাহায্যে ঝোপঝাড় ভর্তি গভীর বিপজ্জনক ইঁদারা থেকে জল তোলে। তৎক্ষণাৎ উঠে গিয়ে বাসুর তাকে সাহায্য করার ইচ্ছে হয় বটে কিন্তু পরমুহুর্তেই সেই অভীপ্সার স্ফুলিঙ্গে আলস্যের জল সিঞ্চিত হয়ে তাকে নির্বাপিত করে।
সেই দুপুরে বাতাস থেকেই বাসু যেন অনেকটা শক্তি আহরণ করলো। হঠাৎ তড়াক করে উঠে বসলো। তার মনে হলো, তার কৌতূহলের ভদ্রাসনকে যথাস্থানে রেখে যদি ঠিক উল্টো দিকে আগের জিজ্ঞাসাটির একটি দোর খোলা যায় ত মন্দ হয় না। কথাটির মীমাংসা সে করলো এইভাবেঃ আপলার কাছে নেপালের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তার উত্তর সম্ভব-অসম্ভবই যাই হোক না কেন নেপাল বাবার ‘থাকা-র মতো না-থাকাটি’ তাতে হয় ক্ষুণ্ণ হবে নয় অক্ষুণ্ণ থেকে যাবে বা ক্ষুব্ধ হবে; স্পর্শকাতর কিছু একটা ব্যাপার ঘটবে মোটকথা। তাতে আপ্লার থাকাটা নেপালের কাছে সপ্রমাণ করতে পারা যাবে, তদুপরি নেপাল-রচিত ‘আছে-র মতো নেই’– এই ভাববিহ্বল অদৃশ্য তরঙ্গটির সঙ্গে আপ্লার অস্তিত্ব দিয়ে একটা সন্তোষজনক যুদ্ধ জেতা যায়। (নেপাল বাবার ‘আছে-র মতো নেই’ তত্ত্বটি হলো – যেমন, কোনো লোকের প্রাক-মানুষ জীবনে সেই লোকটিকে সরাসরি পাওয়া যাবে না। যেখানে সে থাকে তার নাম মুখে-বলা অবর্তমান; অর্থাৎ কার্যক্ষেত্রে সেটি অবর্তমানও নয় অনস্বীকার্যও নয়। জন্মের পরেই সে লভ্য ও দৃশ্যমান হবে, তার অসাক্ষাৎ দূর হবে। সুতরাং জীবনের পূর্ববর্তী জীবনে লোকটি হলো, নেই-এর মতো আছে। আবার কিছু কিছু ব্যাপার ঘটে যেন আছেই ঠিকই । যথা মনের নানা রূপ ভ্রম। বা ভ্রমের নানারকমের মন। মানুষের কোনো কোনো বিভ্রান্তি মাঝে মাঝে মন বদলে ফ্যালে; তখন তাকে দেখতে অন্যরকম হয়। এগুলি হলো আছে-র মতো নেই – ইত্যাদি ইত্যাদি।)
কিন্তু আপলাকে বাসু আজও কোথাও খুঁজে পেল না।
সে বনের সবুজ রূপে ঘুমোচ্ছে না তো! পাতার কাঁপন হয়ে ছেলেমানুষি হাসছে না তো বাসুকে বিব্রত দেখে! – প্রভৃতি নানা কথা বাসুর আজ মনে হল।
ভাবনাগুলি যে অর্থহীন একথা তার খানিক পরে বোধগম্য হলো। তখন সে একটা সত্যিকার বিবেচকের মতো কাজ করলো।
নেপাল বাবার কবরটার কাছাকাছি একটা ঝোপের মধ্যে সে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল। খেলা জমে গেলে দাদু-নাতির কোনোদিকে হুঁশ থাকে না বটে তবু আশেপাশে মানুষ থাকার একটা অতীন্দ্রিয় অনুভূতি সকল মানুষের থাকে। বাসু যতোটা সম্ভব সাবধান হয়ে রইল।
কররটা থেকে গেল আগাগোড়াই ফাঁকা। ক্রমে সেই বিকেলটি পর্ণমোচী হলো। ঝরা পাতার মতো হলদে হয়ে অপনীত হলো তার আলো।
বাসু উদ্বিগ্নই রয়ে গেল দুপুর হতে সন্ধ্যে। একেকবার তার মনে হলো, অন্ধকার হলে তো ফিরে আসতেই হবে তার কাছে আপ্লাকে। ... একটি তারার পরাঙ্মুখ ঝরে যাওয়া দেখতে পেলো বাসু; দেখে সে বড়োই স্বস্তি লাভ করলো। নেপাল-কথিত বিচ্যুত নক্ষত্রের অলীক উন্মুখতার বদলে সে প্রত্যক্ষ করেছে সেই তারার বাস্তব অনিচ্ছা। অর্থাৎ বাস্তব যেমন অনুর্বর অকরুণ হওয়া উচিত তেমনই ঘটছে সবকিছু; তার দশ বছরের অন্যমনস্ক ছেলে অস্থায়ী ভাবে হারিয়ে গেছে, সে-ও ফিরবে ধুলোখেলা করে ঘরে ফেরা কিশোরের মুখ নিয়ে; এর মধ্যে যৎসামান্য নাটকীয়তাও থাকতে পারে, কিন্তু সেটিও হবে লৌকিক শাসনে আড়ষ্ট, তার মধ্যে রূপকথার মতো বেপরোয়া রোমাঞ্চকর কিছু থাকবে না।
সে রাতে কোন্ সময় জ্যোৎস্না ব্যাপ্ত হলো, কখন সে উঠে গিয়ে নেপাল বাবার কবরের ওপর শুয়ে পড়লো কিছুই যেন সজ্ঞানে বুঝতে পারলো না বাসুদেব। একসময় শুধু মনে হলো, তার আবিল দাড়ি ও বুকের লোমের ’পরে নির্মল ঠাণ্ডার একটা পুঁটুলি। আচ্ছন্নতার মধ্যেই পুঁটুলিটিকে বাসু বলল, এতো রাতে এলি বাবা! তারপর প্রাণপণে যেন সেটিকে আঁকড়ে ধরতে চাইল।
এর কিছুদিন পরে এক রাতে নেপালের কণ্ঠস্বর বাসুর প্রতি প্রায় পিতৃপ্রতিম হয়ে উঠলো।
নেপাল যেন তার বাক্ দিয়েই বাসুর সারা গায়ে মাথায় হাত বুলোতে চায়। সেরকম ভাব-প্রবণতা নিয়েই নেপাল বলল, ওরে বাসু তোর শরীর যে বড়ো খারাপ হয়ে উঠলো বাপ!
বাসু অপ্রকৃতিস্থের মতো বলল, আমার আপ্লা ইঁদারা থেকে জল তুলছে।
নেপাল উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, আহা, অমন করলে কী চলে! অমন করলে তুই কি আর বাঁচবি?
বাসু বলল, আমি ওকে পড়াবো। ইস্কুলে পাঠাবো ঠিক।
নেপাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি রে বাসু, তোর প্রাণসংশয়!
বাসু হঠাৎ রেগে উঠে বলল, হ্যাঁ, তোমার ভারী চোখ কিনা! তুমি ত নেই-এর মতো আছো। তুমি আবার একটা মানুষ নাকি!
নেপাল বাবা ওর কথায় রাগ করলো না একটুও। বলল, আমি বলছি বলছি বাসু, তুই ওকে ফিরিয়ে দিয়ে আয়।
–ফিরিয়ে দেবো? কোথায়?
–কেন, যেখান থেকে এনেছিস তাকে! তোর স্বপ্নে!
বিহ্বলতার মধ্যেও বাসুর মুখে বিস্ময়ের রেখা অঙ্কিত হয়ে গেল স্পষ্টতর হয়ে।
স্বপ্নে প্রত্যর্পণ! তার মানে আমার আপলা তো আছে। নাহলে ফেরাবো কোথা থেকে?
নেপাল সংক্ষেপে বলল, তোর প্রবণতা থেকে।
পরদিন বাসু যেন কোন্ এক বিশল্যকরণীর গুণে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেছে। শরীর বেশ ঝরঝরে লাগছে। কোনো ক্লেদ নেই গ্লানি নেই। নেপালের সঙ্গে গত রাত্রির আলাপের সকল অণু-পরমাণু পরস্পর অসংলগ্ন হয়ে বহু টুকরোয় বিভজিত ও বিলীন হয়ে গেছে বিস্মৃতির মাঝে।
সে আপ্লাকে দেখতে পেলো। ইঁদারায় জল তুলছে আজও। ঐ তার কাজ। মুখখানা তুলে বাবাকে দেখলো একবার। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত মুখ বলে মনে হলো বাসুর। এই বালকের উন্মার্গে যাওয়ার কোনো লক্ষণই দেখতে পেলো না বাসু। সে বেশ গর্বিত বোধ করলো আপন মনে।
বাসু তার কর্তব্য আগেই ঠিক করে রেখেছিল। সে পুত্রকে বলল, ইস্কুল যাবি? লেখাপড়া করবি? খেতে পাবি কতো! পরতে পারবি অনেক। ফুটবল পাবি, ব্যাট পাবি। যাবি এক জায়গা?
আপ্লা বলল, বাপ হে যাব তবে।
বাসু তার কাছে গিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে সস্নেহে বলল, এমন বলতে নাই। বলবি, বাবা গো! আরো বহুৎ শিখে যাবি একদিন। হু হু করে ইংরেজি বলবি।
বাসু একটা পুটুলি বেঁধে চিড়ে-মুড়ি নিলো সামান্য যা সঞ্চিত ছিল। শরাবনের দিয়ে যাওয়া পঞ্চাশটা টাকা নিলো সঙ্গে। তারপর পুত্রের হাত ধরে চলল এক অনির্দিষ্ট যাত্রায়। ছেলেকে বোর্ডিং ইস্কুলে রেখে সে জঙ্গলে ফিরে আসবে। মাঝে মাঝে দেখতে যাবে। কিন্তু কোন্ ইস্কুল অথবা কোথায় সেটি তা সে মালুম করতে পারলো না। শুধু চোখের সামনে যেন দেখতে পেলো একটা হলদে রঙের তেতলা বাড়ি। তার কক্ষে কক্ষে গমগম করছে বিদ্যাচর্চা।
অনেকগুলি গ্রাম অতিক্রম করলো তারা। কোনো লোকালয়ের ভৌগলিক অবস্থানই চিনতে পারলো না বাসু। পরিচিত কারুর সঙ্গেও এ যাবৎ সাক্ষাৎ হলো না। বাসু বহু দেশ-ঘোরা লোক, চেনা গন্ডীতে বেশিদিন থাকেনি কোথাও। সুতরাং এই বহির্দেশেও তার স্বাছন্দ্য ও সাবলীলতায় ব্যাঘাত ঘটার কথা নয়। কিন্তু কেন জানি এবার প্রথমাবধি নেপালের আশ্রয়ের সংক্রান্ত সন্দর্ভটি তাকে ভাবিয়ে তুলেছে ও তার গতি বারে বারে মন্দায় আক্রান্ত হয়েছে। এখানে বিপদে কিংবা অসুখে পড়লেও এই নিসর্গ বা লোকসংসর্গ কারুর কাছ থেকেই সে সমর্থন পাবে না?
পথের ধারে একজায়গায় একটা হাট বসেছে। তার অভ্যন্তরে ঢুকে কিছুদূর থেকে একটি লোককে বাসুর চেনা চেনা মনে হলো। সে ঝুড়ি-ঝড়া ভর্তি করে শাকপাতা বেচছে।
একেবারে নিকটে গিয়ে তাকে পুরোপুরি চেনা গেল। সে শরাবন। বাসুর সহৃদয় সুহৃদ।
শরাবনও বাসুকে দেখে খুশি হয়ে – ও রে বাসুদা – বলে তাকে কাছে বসালো। এবং এখন বাসুর পোষিত সেই পুরানো কৌতূহলটারও তৎক্ষণাৎ মীমাংসা হয়ে গেল। শরাবন বাসুর ছোটো ছেলে আপ্লাকেও দিব্যি দেখতে পাচ্ছে। বাসুর বুক জুড়িয়ে গেল বসন্তের সুপবনের মতো স্বস্তিতে। শরাবন আপ্লাকে কয়েকটা গজা খেতে দিল। বাসুকে বলল, তুমিও খাও অ্যাকটা। একটু জল ধরে যাও। (অর্থাৎ কিছু একটা খেয়ে জল খাও।)
বাসু বলল, জল্পনা করে যেতেও দোষ নাই। এমন বিদেশে তোর দেখা পাবো ভাবি নাই শরাবনা। এখানে গাছপালাও আমাদের চেনে না।
শরাবন বলল, তারপর তোমার বনজঙ্গল কেমন চলছে? বহুৎ দিন ওদিকে যাওয়া হয় না বাসুদা। মন টানে। যাওয়া হয় না।
বসু হাসলো। বনজঙ্গলকে যেন সংসার চালানোর মতো চালাতে হয় – শরাবনের আলাপের ধরণটা লাগলো এইরকম।
তারপর কেন জানি বাসুর হতে লাগল কেমন কেমন একটা অস্বস্তি। শাকের ঝুড়িগুলির কয়েকটির মুখ কাপড়ে বাঁধা। সেগুলির একটিতে আছে ছোটো ছোটো সাপ। এই সাপগুলি যে বাসুর বনের বাসার ঝোপরূপী দেওয়াল থেকে প্রতিদিন পুষ্প চয়নের মতো শরাবন তুলে এনেছে এইটে সে ওখানে বসেই কীভাবে যেন অনুভব করতে পারলো। আরো একটু জটিল ভাবের সঞ্চার হলো তৎসহ। ঝুড়ির সাপ যে বাসু তার তৃতীয় নয়নের মারফৎ দিব্যি দেখতে পাচ্ছে, তাও ন্যাকা সেজে আছে – শরাবনের এই অপ্রকাশিত ভাবে বাসু ভাবিত হয়ে উঠলো। তার অর্থ এই যে, বাসুর কি তবে সত্যিই তিন নম্বর চক্ষু আছে – কারণ শরাবন তাকে এখনো ঝুড়ির মুখ খুলে কিছু দেখায়নি। বাসুর এই ক্ষমতা আছে এটা শরাবন হয়ে বাসু টের পাচ্ছে – যদিও এর বিরোধাভাসের আতপও সে অনুভব করতে পারছে সাক্ষাৎ বাসুরূপে, যে, না, ওরকম ক্ষমতা তার আদৌ নেই।
এই রকম একটা অমীমাংসার মাঝেই বাসুর যাত্রা সমাপ্ত হয়ে গেল।
সে কানের কাছে নেপাল বাবার হেঁড়ে গলা শুনতে পেল, বাসু, বাসু, ওঠ। তুই স্বপ্নে আমাকে মেরে ফেলেছিস। আমি আর থাকতে পারলাম না। প্রাণপণে ফিরে এলাম।
বাসু ধড়ফড় করে উঠে বসার চেষ্টা করলো; পারলো না।
নেপাল বাবা বলল, এবং তুই নিজেও মরতে বসেছিস।
বাসু এখন অন্য কিছু ভাববার বদলে অস্থির ভাবে বাইরে তাকালো। ঝকঝক করছে রোদ্দুর। আপ্লা আছে।
বাসু আবার শ্রান্ত চোখ ফিরিয়ে আনলো ঘরের ভেতর; নেপাল বাবাকে সে বলল, ইস্কুলটা আর কদ্দূর?
নেপাল বাবা খানিকটা রুক্ষ স্বরে বললেন, ইস্কুল নাই। তুই কোত্থাও যাস নাই এতোদিন। এই ঘরেই মরণাপন্ন হয়ে আছিস। স্বপ্নের ঘোরে দেখছিস, আমি মরে গেছি; ঐখানে আমার মাটির কবর; আমি তোর কানে প্রায়শই ধ্বনিত হই; ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে একেবারে স্বৈরাচারী স্বপ্ন নয়, নইলে কবে ভেঙে চুরচুর হয়ে যেতো। মাঝেমাঝে ঐ অবস্থায়ই কোথা থেকে ভস্মীভূত বনের মাঝে তৃণাঙ্কুরের মতো অতিশয় যুক্তিযুক্ত ক্ষীণ একটা চিন্তসূত্রও উত্থিত হচ্ছে এইমর্মে যে, আমি মরে গিয়ে ফিরে আসিনি, তোর নিঃসঙ্গতাই দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে আমার মৃত্যুর পরে – তাই তোর নিজেরই শরণার্থী তুই। তা দেশ ভ্রমণে গিয়ে আমি শান্তি পাই না কিছুতেই। তুই আমায় মেরে ফেলেছিস এবং নিজে অসহায় হয়েছিস; আমি দেখলাম এবার কিছু একটা করতে হয়। দেশ ভ্রমণের সঙ্গী-সাথিদের মাঝপথে ত্যাগ করে তোর স্বপ্নে আমাকে ঢুঁ মারতে হলো। সেখান থেকে এখান। ধকল বড়ো কম দিলি না রে বাসু তুই আমাকে।
বাসু আবারো বাইরের দিকে চাইলো। সেই যে কতদিন আগে দেখেছিল আপ্লাকে এখনো সেইভাবেই ইঁদারা থেকে জল তুলছে সে।
মস্ত একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো বাসুর বুক থেকে। সত্যিই সে আপলাকে নিয়ে কোথাও যেতে পারেনি।
নেপাল বাবা বাসুর দিকে চেয়ে বলল, আমার নাহয় যা সর্বনাশ করার করতে চলেছিলি, কিন্তু ঐটুকু ছেলেকে এমন শাস্তি দিতে হয়!
বাসু সপ্রশ্ন তার দিকে চেয়ে রইলো।
নেপাল বাবা বলল, আমাকে স্বপ্নে টেনেছিলি আর এই শিশুকে স্বপ্নের বাইরে বের করে এনেছিস। এ কী বিরোধাভাস! কিন্তু তাতেও লাভ নেই কিছু। তোর ছোটোছেলেকে তুই কিশোর বয়েস অব্দি দেখে সংসার ছেড়েছিস। তারপর সে দ্রুত তরুণ হয়ে উঠছে এই সংবাদ পেয়েছিস মাঝেমাঝে। তুই তার পিতা হিসেবে কিছুই করতে পারিসনি। এবার সেই তরুণকেই করুণ ক’রে কাছে পেতে চেয়েছিস। তবু এখানে এখন আর নতুন করে শুরু করা যায় না বাসু। স্বপ্নটা রূপোলি পর্দা, সেখানে যা সম্ভব এই জড় পৃথিবীতে তেমনটা নয়।
নেপাল বাবা চুপ করে গেল। তারপর একসময় নিঃশব্দেই উঠে চলে গেল।
বাসু হাতেপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে এলো। দেখলো, আপ্লা এতোদিন ধরে ইঁদারা থেকে জল উত্তোলন করছে, ঢালছে, কিন্তু ইঁদারার গোড়ার মাটি পর্যন্ত শুকনো খটখটে। এতোটুকু রসালো হয়নি মাটি। বালকটি কেমন শ্রান্ত অস্থিতিশীল ও ম্রিয়মান। বাসুর বুকটা মোচড় দিয়ে উথলে উঠলো।
গোটা দিন বসে বসে কাঁদলো বাসু।
সন্ধ্যার প্রাক্কালে, যখন অসংখ্য পাখি ঘরে ফিরছে, বাসু একেবারে নির্ভার ও প্রশান্ত হয়ে নেপালকে বলল, বাবা, আমি আমার আপ্লাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই। স্বপ্নে।
নেপাল খানিক চুপ থেকে বলল, হ্যাঁ, সেই বরং ভালো। ইঁদারার লক্ষণেই ত স্পষ্ট যে এখানে আদর্শ ও কৃতসিদ্ধ বাপ-ছেলে হিসেবে নতুন করে তোমাদের সফল হতে পারা সম্ভব নয়। স্বপ্নই ভালো।
নেপাল আজ বাসুকে ‘তুমি’ বলছে। বাসুর সব কিছুই কেমন যেন নতুন লাগছে।
বাসু মাথা নিচু করে বসে থাকলো; তারপর বলল, কিন্তু কীভাবে ফিরবো সেখানে?
নেপাল বলল, দ্যাখো, আমার কোনো অতি লৌকিক শক্তি নেই। তুমি জানো আমি সাদামাটা মানুষ। কিছু চাই-টাই না বিশেষ। সেরকম মানুষ হিসেবে আমার মনেহয়, তোমার একটা গভীর সমৃদ্ধিশালী নিরবিচ্ছিন্ন ঘুমের বড়ো প্রয়োজন। সত্যিকার ঘুম তুমি বহুদিন ঘুমোয়নি। তোমার অপরাধবোধ সতত তোমায় নিপীড়িত করেছে। তুমি ঘুমোবার চেষ্টা করো। এইখানে। আমার কোলে মাথা রেখে। বাসুদেব, আমার বড়ো ঘুম হয়। সেই ঘুম কিছুটা নির্দয়, কারণ সেটি নির্দায়। আমি তখন মানবিক ও মানসিকভাবে তোমার অনেক কাছে চলে আসতে পারি। তোমার স্বপ্নে আমার পরিসর রচনা করে নিতে পারি একখানি। এটা তুমি বুঝতে চেষ্টা করো বাসুদেব।
বাসু অস্ফূটভাবে বলল, আমি...
নেপাল তাকে থামিয়ে বলল, ছেলের সঙ্গেই থাকবে...
মাঝপথে বাসু একবার বিড়বিড় করে বলল, কিন্তু আমার স্বপ্নের মধ্যে আমি নিজেই যে চলে যাচ্ছি তাহলে কী করে বুঝবো কে স্বপ্নটা দেখছে?
নেপাল বাবা বলল, হ্যাঁ, এরকম একটা অসুবিধে আছে বটে...