এত চিৎকারেও দেবু মানে দেবলের খুব একটা হেলদোল দেখা গেল না। সে শুধু মাথার বালিশটাকে কানচাপা করে পাশ ফিরে শুল।
এই দৃশ্য আর কথোপকথনে এবাড়ির সকলেই আজকাল অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। অবশ্য কথোপকথন শব্দটা ভুল, আসলে একটি গলাই শোনা যায় আর সেটি দেবলের মা চিত্রার। এদিকে চিত্রা তখনও বলে চলেছে— কে জানতো আমার অমন ছেলে আজ এমন হয়ে উঠবে।
বৃদ্ধা যশোদা ঘর ঝাঁট দিচ্ছিল। দাঁড়িয়ে পড়ে উদ্বিগ্ন গলায় বলল— কি হয়েছে মা ভাইয়ের? নেশাটেশার খপ্পরে পড়ল নাকি? পাড়ার ছেলেগুলো বেশি ভালো নয় মা। ওদের সাথে মিশতে দিও না। ওই শিবতলার ওইধারে মাঝে মাঝে ওরা গাঁজা খেতে যায়। আমি নিজের চোখে দেখেছি গো।
লাইন অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে দেখে চিত্রা তাড়াতাড়ি বলে ওঠে— উঃ মাসি কীসব যে বলো না। দেবু কি সেরকম ছেলে, দেখেছো কখনো?
যশোদা ফোকলা মুখে একগাল হেসে বলে,
— না না। তাই তো বলছি এত ভালো ছেলেকে রোজ রোজ এমন খোয়ার করো কেন? ও তো আর নেশাভাঙ করে না।
চিত্রা ওখান থেকে মানে মানে সরে পড়ে। কি জানি কি শুনতে কি বুঝবে তারপর পাড়াময় রাষ্ট্র করে বেড়াবে। কাজের লোকেদের কোন বিশ্বাস নেই।
তবে চিত্রার আজকাল খুব দুঃখ হয়। দেবল তার একমাত্র ছেলে। বরাবরের বুদ্ধিমান এবং স্থির। স্বভাবে ঠান্ডা আর বাধ্য। ছোটবেলা থেকে কখনো দেবলকে বকেঝকে কিছু করাতে হয়নি চিত্রার। কিন্তু ইদানীং তার স্বভাবে মস্ত পরিবর্তন হয়েছে। যত বড় হচ্ছে তত যেন কুঁড়েমি তাকে পেয়ে বসছে। আজকাল বেলা দশটা—এগারোটার আগে তার ঘুম ভাঙে না। ঘুম থেকে উঠেও একঘন্টা লেগে যায় তার ঘুমের রেশ কাটাতে। তারপর কিছু খেল কি খেল না বেরোয় বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডা মারতে। ফিরতে ফিরতে বাজে বেলা তিনটে। সন্ধ্যেতে চা দিতে গিয়ে চিত্রা দেখে ছেলে ভরসন্ধ্যায় ভোঁসভোঁস করে ঘুমাচ্ছে। তারপর আবার বেরোনো আর রাতদুপুর করে বাড়ি ঢোকা। আর সহ্য হচ্ছে না চিত্রার। একটা কাজও আজকাল তাকে দিয়ে করানো যায় না। করব করছি করতে করতেই সে পাঁচ দিন কাটিয়ে দেয়। শেষে চিত্রা, নয় সুদীপকেই সেই কাজ করতে হয়। এর জন্য অপমানও চিত্রাকে কম সহ্য করতে হচ্ছে না। এইতো দিন দশেক আগে দেবুকে পাঁচশো টাকা দিয়ে চিত্রা বলেছিল,
— দেবু পাড়ার কাঠের দোকানের বিশুকে টাকাটা দিয়ে দিস তো। কিছুদিন আগে কাজ করে মজুরি না নিয়ে গেছে।
দেবু হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিয়েছিল। বলেছিল— এখনি দিয়ে আসছি মা তুমি চিন্তা কোরো না।
কাল এক রাস্তা লোকের সামনে সেই বিশু তাকে যখন বলল — অনেকদিন হয়ে গেল বৌদি আমার টাকাটা কি এখন দিতে পারবেন?
লজ্জায় চিত্রার কান গরম হয়ে ওঠে। সে কোনও কথা না বলে টাকাটা দিয়ে বাড়ি চলে এসেছে। তখন থেকেই তার মাথায় আগুন জ্বলছে। বাড়ি ফিরেই দেবুর দুটো প্যান্টের পকেট হাতড়াতেই পাঁচশো টাকার নোটটা বেরিয়ে পড়ে। ব্যাপারটা দিন দিন অসহ্য হয়ে উঠছে চিত্রার কাছে। সুদীপ বাড়ি ফিরলে সে সব জানিয়ে রাগে গনগন করতে করতে বলে,— এ ছেলে চাকরি সংসার কি করে করবে বলোতো? এইটুকু দায়িত্ব যে নিতে পারে না সে বাবা মা-বৌয়ের দায়িত্ব নেবে কি করে?
— ও এখনো অনেক ছোট চিত্রা। সবেমাত্র ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ হয়েছে। কদিন পরেই তো চাকরির জোয়াল কাঁধে উঠবে। কটা দিন ওকে একটু আরাম করে নিতে দাও না। সুদীপ আবহাওয়া গরম বুঝে বলে।
চিত্রা সে কথা শোনার পাত্রী নয়। সে বলেইছে আজ এর একটা হেস্তনেস্ত সে করেই ছাড়বে। সুদীপ তাকে নিরস্ত করার অনেক চেষ্টা করেছে। বুঝিয়েছে ছেলে বড় হয়েছে তার সাথে এখন বুঝেশুনে কথা বলা উচিত।
— এভাবে চললে ও চাকরি করতেও পারবে না দেখো। চিত্রা বোঝায়, — শেষে আমাদেরকে আফসোস করতে হবে এই ভেবে যে সময় থাকতে ছেলেকে শাসন কেন করিনি।
শেষে সুদীপ হাল ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ সকালে তাই সুদীপ বেরিয়ে যেতেই চিত্রা চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করছে তাতেও অবশ্য ছেলের ঘুম ভাঙেনি। শেষে দেবলের ঘরের ফ্যান অফ করে জোরে সাউন্ড সিস্টেমে শচীনকর্তার গান চালিয়েছে চিত্রা। জানে এইসব পুরোনো গান দেবুর একেবারে পছন্দ নয়। তাতেও যখন ছেলে মটকা দিয়ে পড়ে থাকল তখন ঘাড় ধরে টেনে তুলেছে।
দেবল কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে শেষে মুখ ধুয়ে বেরিয়ে গেছে। চিত্রার মেজাজ আরো চড়েছে। একা একাই সে গজগজ করে চলেছে। — হে ভগবান এমন অলস ছেলে আমি ভূভারতেও দেখিনি। উত্তর দেওয়া তো দূরস্থান এমন ভাণ করে যেন শুনতেই পায়নি। অন্য কোন ছেলে হলে তেড়ে তর্কাতর্কি করতো। আর তার ছেলের আত্মপক্ষ সমর্থনেও আলস্য! না, আর পারা যাচ্ছে না।
সত্যিই চিত্রার ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। বিশেষত পাশের বাড়ির পীযূষকে দেখলে হুতাশ আরো বাড়ে চিত্রার। কি চটপটে কাজের ছেলে পীযূষ। সকাল থেকে বাজার করছে হাট করছে। মাকে নিয়ে মাসির বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে, বাবাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে। কোনও কাজে বিরক্তি নেই। দেবুকে পীযূষের কথা বললে সে বলে— যাঃ তুমি আর বাবা ওরকম আনস্মার্ট নাকি? তোমরাই বলে আমাকে সব জায়গায় নিয়ে যাও আর আমি নিয়ে যাব তোমাদেরকে!
এইভাবে আরো কিছুদিন কেটে গেল। চিত্রা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেল। দেবুর কোনও পরিবর্তনই সে ঘটাতে পারলো না। তাতে তার অস্থিরতা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। সে বেশ বুঝল এভাবে হবে না।
কিছুদিন ধরে বাড়ির আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা দেখে সুদীপ একদিন সন্তর্পণে চিত্রাকে জিজ্ঞেস করল— ইয়ে মানে তুমি কি একেবারেই হাল ছেড়ে দিলে নাকি। দেবুতো যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে।
এইকথার পর বেশ একটা ঝড়ের সম্ভাবনা ছিল কিন্তু কেমন যেন হাওয়াটা সেদিন খেললই না। চিত্রা খোঁচাটা বুঝেও রাগল না। শুধু বলল— ভেবে দেখলাম অপাত্রে দান করে কি লাভ? শুধু শুধু নিজের শরীরপাত। ওর জীবন ও বুঝে নিক। আমাদের এমনিও একা থাকতে হবে অমনিও একা থাকতে হবে। নিজেদের কাজ নিজেদেরই করতে হবে। তাহলে আর ওর সাথে যুদ্ধ করে খারাপ হব কেন?
সুদীপ চিত্রার মুখে এহেন বৈরাগ্যের কথা শুনে প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেল। তারপর ভাবল যাক বাড়িটা ঠান্ডা থাকাই ভালো। সুদীপ জানে চিত্রা অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, কর্তব্যপরায়ণ, মধুর স্বভাবের মেয়ে। চেঁচামেচি যা করে তার জন্য তিনি আর দেবলই নব্বইভাগ দায়ী। তবু চিত্রার এই হাল ছেড়ে দেওয়াটা হজম করতে আজ তার একটু কষ্টই হল।
সুদীপ কয়েকদিন ধরে খেয়াল করছে আজকাল দেবুর কাছে ফোন আসলে কোন কোন সময় সে উঠে অন্য ঘরে গিয়ে কথা বলে তাও একটু গলা নামিয়ে। চিত্রাকে সে কথা বলতেই সে চাপা হেসে বলল — শুধু এটুকুই চোখে পড়ল এটা চোখে পড়ল না আজকাল একটু সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠছে।
— না সেটা খেয়াল করিনি। আর কি কি হচ্ছে একটু বলতো।
— আজকাল একটু বই নিয়েও বসছে।
— বলো কি? চোখ কপালে তুলে বলল সুদীপ। — তা তোমার ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো মানে ইয়ে তোমার আড়ি পাতা কোম্পানি কিছু খবর দিচ্ছে না?
— ধীরে স্বামী ধীরে, ঠিক সময়ে খবর নেব। আপাতত নজরমিনারে বসে চার্ট মেনটেন করছি। সুদীপের খোঁচাটা তেমন গায়েই মাখল না চিত্রা।
সুদীপ এবারও অবাক হয়ে গেল চিত্রার নিস্পৃহতা দেখে। যে মা তার ছেলের দিন রাতের অণু-পরমাণুর একচ্ছত্র অধিকার এতকাল নিজের হাতে রেখেছে তার এই দ্বিতীয় দাবিদারের সম্ভাবনায় উদ্বেগ নেই! কিম্ আশ্চর্যম! কিম আশ্চর্যম !
দিন দুয়েক পরে রাতের খাবার টেবিলে চিত্রা দেবলকে স্ট্রেইট অ্যাটাকে নামল। সে রাতে মা ছেলের কথোপকথন এরকম:
— তোর কাছে কার ফোন আসে রে?
— কখন?
— সময়ের কি কিছু ঠিক আছে বাবা যে কখন বলব।
— তাহলে আমি কি করে বলব কোন ফোনের কথা বলছ।
— আরে যে ফোনটা এলেই ঘরে উঠে যাস।
এতক্ষণ সুদীপ খরগোশের মত কান খাড়া করে আর নিস্পৃহের মতো চোখ নামিয়ে খাচ্ছিল এবার একটু নড়েচড়ে ছেলের দিকে চোরা চাউনি মারল। কান শুনবে দেবুর মুখের কথা কিন্তু চোখকে দেখতে হবে তার মুখের প্রত্যেকটা রেখার ওঠানামা কারণ ওখানেই লুকিয়ে থাকবে আসল সত্য। কিন্তু হায়, সবই মাঠে মারা গেল। দেবু একটুও লজ্জা না পেয়ে একটুও না হকচকিয়ে সাবলীল গলায় যা বলল তা এরকম।
— ও ওই ফোনটা? কে জানে কে করে।
— সে কি রে চিনিস না? তাহলে ফোন ধরিস কেন?
— ওটা একটা গেম মা। গলার স্বর শুনে মানুষ আইডেন্টিফাই করার গেম।
— অ্যাঁ গেম? মানুষটাকে চিনতেই হবে তার কি মানে আছে? আর খেলাটা শুরুই বা করল কে?
— আমি অন্তত শুরু করিনি।
— ও, তা সে ছেলে না মেয়ে?
— মেয়ে মেয়ে।
— ও মা। এবার ফোন করলে তুই আর কথা বলিস না। কে জানে কি মতলব আছে। তা ফোন করে বলে কি সে? অল্পবয়স না বয়স্ক?
— আমাদের বয়েসি মনে হয়। সেরকম কিছু বলে না তো। শুধু একমাস সময় দিয়েছে ওকে চেনার জন্য। কথা শুনে মনে হয় আমাকে ভালো করে চেনে।
— কি করে বুঝলি?
— আমাকে ফোন করলেই জিজ্ঞেস করে ওকে চিনতে পেরেছি কি না? না বললে বলে অত বেলা অবধি যারা ঘুমায় তাদের বুদ্ধিও ঘুমিয়ে থাকে। কি জ্বালা বলো তো? আর আমি যে দেরি করে উঠি সেটা কি করে জানল? তার মানে আমাকে খুব চেনে।
চিত্রা মুচকি হেসে বলল— এটা বোধহয় সত্যি বলেছে। বেশি বেলা অবধি ঘুমালে আমারও মনে হয় বুদ্ধি একটু কমেই যায়। তারপর কৌতূহলী গলায় বলল— সেইজন্য বুঝি আজকাল তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠছিস?
— সেটা একটা কারণ হতেও পারে। আসলে গলাটা চিনতে পারছি না তো সেল্ফ কনফিডেন্সটা একটু ধাক্কা খাচ্ছে। তবে এমবিএর অ্যাডমিশনের জন্য পড়াটাও শুরু করছি। এইবার দেবল বোধহয় একটু অপ্রস্তুত হল।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পরে সুদীপ এবার জিজ্ঞেস করল— সেটাও কি তারই, মানে ওই ফোনওয়ালির খোঁচায়?
— আরে না না। দেবল ব্যস্ত হয়ে বলে -- ইন্দ্র, সৌগত সবাই তৈরি হচ্ছে আমাকেও তো তৈরি হতে হবে। তবে আশ্চর্য কথা কি জানো, আমাকে একদিন বলছিল ইন্দ্র আর সৌগত তো শিওর চান্স পাবে তুমি কি করবে? পড়াশোনা বানানটাও তো ভুলে মেরেছো।
চিত্রা এবারে রেগে যায় — সে কি রে, এতবড় সাহস? এবার ফোন এলে আমাকে একবার দিস তো ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দেব।
দেবল তটস্থ হয়ে বলে — না না মা। একমাস হতে আর দিন দশেক আছে। এর মধ্যে ঠিক ধরে ফেলব তারপর মেয়েটার বেশি জ্যাঠামি করা বের করব। এর মধ্যে তুমি আর ঢুকো না।
— আচ্ছা তুই যখন বারণ করছিস। তবে এইসব মেয়ে ভালো কি না কে জানে তুই কিন্তু বেশি মাখামাখি করতে যাস না।
চিত্রা কথাটা বলে বাসন নিয়ে উঠে যায়। রাতে শোবার ঘরে সুদীপ বিছানায় শুয়ে মোবাইল ঘাঁটছে। চিত্রা এসে আয়নার সামনে বসল চুল বাঁধতে। গুনগুন করে গান গাইছে দেখে সুদীপ বলল — ব্যাপারটা কি বলো তো? এতবড় খবরেও তুমি বিচলিত নও!
— বিচলিত? কেন? আমি তো বেশ খুশি। যে কাজ আমি এতদিনে করে উঠতে পারলাম না সেই কাজটা কে না কে একটা নাম না জানা পুঁচকে মেয়ে করে দিচ্ছে গো। চিত্রা কলকলিয়ে উঠল।
— কিন্তু তোমার রাগ হচ্ছে না? ছেলে তোমার কথায় যে কাজ করল না আর সেটা কোন এক কে তাকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। তাও আবার একটা মেয়ে। কাল যদি ঘাড়ে চেপে বসে?
— ধুর। ওসব অত সোজা নয়। আমি কি মরে গেছি? ঠিক সময়ে আসরে অবতীর্ণ হব, বুঝলে। আপাতত ঠাকুর ছেলের মাথায় সুবুদ্ধি দিক। সুদীপের আশঙ্কাকে চিত্রা পাররাই দিল না।
চিত্রার চুল বাঁধা শেষ। সুদীপ হেসে বলে— ঠাকুর নয় বলো অ—নামিকা। সেই তো বুদ্ধি দিচ্ছে।
একমাসের পরিক্রমা শেষ হয়ে গেছে দেবলের অনেকদিন। সাথে সাথে চিত্রা আর সুদীপেরও। বলা বাহুল্য দেবল গেমটা হেরেছিল অর্থাৎ ফোনের গলাটা সে চিনতে পারেনি। একমাস পরে সেই ফোন আসাও চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছিল। দেবলকে অবশ্য তা নিয়ে খুব একটা হাহুতাশ করতে দেখা যায়নি। তবে সুদীপ যথেষ্ট হতাশ হয়েছে এমন একটা রহস্যের সমাধান না হওয়ায়। চিত্রার ব্যাপারটা ঠিক বোঝা যায়নি। তবে তারা এখন খুব খুশি। দেবল আইআইএম দিল্লিতে এমবিএ জয়েন করেছে আজ ছমাস।
এমবিএ-র ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে দেবল আজ বাড়ি ফিরছে। চিত্রা রাজহংসীর মত গলা উঁচু করে ছোটাছুটি করছে বাড়িময়। আজ তার স্বপ্ন সার্থক। সেই অলস ঘুমকাতুরে দেবলের আজ নামকরা বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি পাকা। রেজাল্ট বেরোলেই সে মুম্বই চলে যাবে কাজে জয়েন করার জন্য। মাঝে কিছুদিনের অপেক্ষা। এই কটা দিন বাড়িতেই ছুটি কাটাবে বলে বাড়ি আসছে দেবল। চিত্রা একটা ছোটখাট পার্টির ব্যবস্থাও করেছে রাতে। তাতে কিছু আত্মীয়, আর দেবলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবীরা নিমন্ত্রিত। আর একটা চমক রেখেছে চিত্রা রাতে। তার এক বান্ধবী ইন্দ্রাণী আর তার পরিবারকে ইনভাইট করেছে এই পার্টিতে। ইন্দ্রাণীর মেয়ে নোয়া তার বড় পছন্দের। যেমন মিষ্টি দেখতে তেমন মার্জিত তার স্বভাব। সবচেয়ে বড় কথা সে কুঁড়ে বা অলস নয়। আর সে যে বুদ্ধিমতী তার প্রমাণ চিত্রা অনেকবারই পেয়েছে। সাইকোলজিতে মাস্টার্স করে এখন চাকরির চেষ্টা করছে নোয়া। দেবলের থেকে বয়সে এক বছরের ছোট। সুদীপ আর চিত্রার ইচ্ছে দুজনের দুজনকে ভালো লাগলে একটা পাকা কথা বলে রাখা। সেই কারণে একটু টেনশনেও আছে তারা। কি জানি এই দুবছরে দেবলের কোন বান্ধবী জুটেছে কি না।
দেবল সামনে এসে দাঁড়াতে চিত্রা তো অবাক। এ কাকে দেখছে সে। দেড় বছরে এত বদলে গেছে তার ছেলে। সেই এক মুখ দাড়ি, না কাটা এলোমেলো চুল, আর সবকিছুতেই উৎসাহহীন সাদামাটা ছেলের বদলে কায়দা করে চুলকাটা, ক্লিনসেভের ঝকঝকে স্মার্ট দেবল দাঁড়িয়ে আছে সামনে। পরনে ব্রান্ডেড পোশাক, চোখে দামি রোদ চশমা। আনন্দে চিত্রার মনটা দুলে উঠল, নোয়ার সাথে ভারি মানাবে। সারাদিন খাওয়াদাওয়া নানা গল্পগাছার মধ্যে নোয়ার কথাটা টুক করে নামিয়ে দিল চিত্রা। তাতে দেবলের বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। এখনই কিছু ভাবছি না বলে সে ঘরে চলে গেল। একটু চিন্তায় পড়ে গেল সে। দেবল কি কায়দা করে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে ব্যাপারটা। তাহলে কি অন্য কোন সম্পর্কে জড়িয়েছে ছেলে? চিত্রার এতদিনের পরিকল্পনা কি বৃথা হয়ে যাবে?
সন্ধ্যের পার্টি বেশ জমে উঠেছে। দেবলের বন্ধুবান্ধবের দল সব হাজির হয়ে গেছে। ছাদের এক কোণে তারা সব জটলা পাকিয়ে হা-হা হি-হি করছে। আত্মীয়স্বজনেরাও উপস্থিত। স্ন্যাক্সের পার্ট চলছে জোর কদমে। সুদীপ অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত। চিত্রা ঘন ঘন মোবাইলে সময় দেখছে। আটটা বাজে। এমন সময় ইন্দ্রাণী আর সোমনাথদা ঢুকল। সাথে নোয়া নেই। যাক, পরিকল্পনামতোই সব এগোচ্ছে। যদিও ইন্দ্রাণীরা এই ব্যাপারে কিছুই জানে না তাই চিত্রা এগিয়ে যায়।
— নোয়া কই ? সে আসেনি?
ইন্দ্রাণী বলল— আর বলিস না ও একটু দক্ষিণাপণ গেছে। ওখান থেকেই আসবে। ক্যাব পাচ্ছে না তাই দেরি হচ্ছে। তুই চিন্তা করিস না। তোকে ফোন করবে বলল।
বলতে বলতেই চিত্রার মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠল। চিত্রা স্ক্রিনটা দেখে বলল,
— নোয়ার ফোন। দাঁড়া কথা বলে নিই।
এরপর নোয়ার সাথে চিত্রার কথোপকথনের এক দিকে যা শোনা গেল তা এরকম।
— কি ব্যাপার তোর আজকেই দক্ষিণাপণ যেতে হল? এদিকে আমরা বসে আছি।
— ...
— তা আমি জানি না। দেরি করার জন্য সরি যদি বলতেই হয় তবে দেবলকে বল। আমি ওকে ফোন দিচ্ছি।
ফোন চলে গেল দেবলের হাতে। তারপর কে কি বলল তা জানার আগ্রহ ততটা চিত্রার ছিল না যতটা আগ্রহ ছিল ছেলের মুখের ভাব দেখার। ফোন ছেড়ে দেবল মার হাতে দিয়ে বলল — আমি নীচে যাচ্ছি। নোয়া এসে গেছে ওকে নিয়ে আসতে।
চিত্রা মুখে ছদ্মগাম্ভীর্য মেখে বলল— নোয়া এ বাড়ির সব চেনে।
— তবুও, গেমটা জেতার জন্য এটুকু প্রিভিলেজ আমার তরফ থেকে ওর প্রাপ্য কি বলো?
চিত্রা মুচকি হেসে ঘুরে দেখে সুদীপ বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চিত্রা সুদীপের গালে একটা ঠোনা মেরে বলল— চলো চলো খাওয়ার ব্যবস্থা দেখি।
সেই রাতে সবকিছু মিটে যাওয়ার পরে ড্রয়িংরুমে সুদীপ চিত্রা আর দেবল মুখোমুখি। সুদীপ আর দেবলের জিজ্ঞাসু মুখের দিকে তাকিয়ে চিত্রা বলল,
— আরে বাবা আমার ছেলের ভালো আমার থেকে বেশি কে বুঝবে? তাই যখন দেখলাম পুরোনো পন্থায় কাজ হচ্ছে না তখন সিস্টেমের আধুনিকীকরণ না করে উপায় ছিল কি? আর তার ফল তো সামনেই দেখতে পাচ্ছ। তা দেবু তোমার কি নোয়াকে নিয়ে কিছু বলার আছে নাকি আমরা এগোতে পারি?
দেবল চোখ নীচু করে মেঝেতে পা ঘষছে দেখে সুদীপ বলল— আরে ছেলেকে দেখে বুঝছ না আবার জানতে চাইছ। এগোও এগোও। শুভস্য শীঘ্রম।