বিবর্তন---আদি যুদ্ধ আদি প্রেম--জয়ন্ত দাশ; গাংচিল প্রকাশনালয়, কলকাতা-৭০০১০০; ডিসেম্বর ২০২১; ISBN 978-93-90621-61-3
বইটির শিরোনামে যত না আকৃষ্ট হয়েছি, তার অতিরিক্ত সংযোজনটাতে ততোধিক: ‘আদি যুদ্ধ আদি প্রেম’! ‘বিবর্তন’-এর মতো একটি বিষয়ের কেতাবে ‘যুদ্ধ’? ‘প্রেম’?
কেন নয়?
এই মিল আর এই অমিল---এই নিয়েই তো বিশ্বচরাচর বয়ে চলেছে গো..., বয়ে এসেছে বিগত চারশো কোটি বছর ধরে, মানে, প্রাণের উদ্ভব যবে থেকে। প্রথমে সরল প্রাণ, তা থেকে ক্রমে ক্রমে জটিল জীব---পারিপার্শ্বিকের সাথে মিলিয়ে নিয়ে থাকতে পেরেছে যে সে টিঁকে আছে। সেখানেই প্রেম, সেখানেই প্রেমের জয়। তবে এখানে এসে পৌঁছুতে অনেক যুদ্ধ করে আসতে হয়েছে যে প্রাণকে। হ্যাঁ, এই যুদ্ধ আজও জারি আছে যা চলতে থাকবে যাবৎকাল পৃথিবী থাকবে।
সেই নিয়েই এই বই।
বাংলাভাষায় যার জুড়ি পাইনি এতাবৎ।
**
হিব্রু বাইবেলে আছে, এলোহিম, অর্থাৎ আদি ঈশ্বর, ছয় হাজার বছর আগে মাত্র ছয়দিনের মধ্যে এই বিশ্বচরাচর ও সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি করেছিলেন (ও, সপ্তম দিনে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। সেটা সাবাথ, বা বিশ্রামের দিন। রবিবার)। ঈশ্বরের সৃষ্টি নিখুঁত, তাই সেখানে কোনো অদলবদল আসা সম্ভব নয়। এবং সে কারণেই সৃষ্টির আদি থেকে আজ পর্যন্ত, মানে মোটামুটি ছয় হাজার বছর ধরে, প্রাণীকুল অপরিবর্তিতই আছে।
১৮৩৫এ ছাব্বিশ বছরের এক ইংরেজ প্রকৃতিবিজ্ঞানী ‘বীগল’ জাহাজে চড়ে দক্ষিণ চিলির উপকূলের কাছে কুইরিকিনা দ্বীপে পৌঁছে দেখলেন সেখানে পাহাড়ের গায়ে অনেক উচ্চতায় শামুক-ঝিনুকের খোলার সাদা দাগ রয়েছে মাইলের পর মাইল। তার মানে ঐ উচ্চতা থেকে বর্তমানের স্তরে পৌঁছতে তো কোটি কোটি বছর লেগে যাবার কথা। তবে কি বাইবেলে বর্ণিত মাত্র ছয় হাজার বছর আগের সৃষ্টিতত্ত্বটা কেবলই ভাঁওতা? কালে এই যুবকের চিন্তন বিশ্বকে বদলে দিয়েছিল। তবে এঁর ডাক্তার ঠাকুর্দা ইরাসমাস ডারউইন (১৭৩১-১৮০২)-ও যে বিবর্তনের সদাসঞ্চারমান ধারাতে বিশ্বাস করতেন ও তার উপরে কবিতা লিখেছিলেন---সেটা এই বই পড়েই এখন জানলাম।
**
সাধারণ পাঠকের উদ্দেশে লিখিত একটি বই যে কত যত্নের ছাপ রাখতে পারে, বিষয়ের কত গভীরে যেতে পারে, এবং সাথে সাথে কতটা সুখপাঠ্য হতে পারে--এ’বই না পড়লে অনুমানই করতে পারতাম না। লেখক পেশায় এক কৃতবিদ্য চিকিৎসক, a practicing dermatologist--অর্থাৎ পুরো সময়ের গবেষক তিনি নন। তাতেই এই যে গ্রন্থটির উপস্থাপনা করেছেন দশে বারো পায় তা।
টুপি খুলি এমন লেখার সামনে।
**
সূচিপত্র তো কোনো বইয়ের আয়না---মুখছবি। একটা সূচিপত্র যে কতটা ক্রিস্প হতে পারে কিন্তু ঐ মুখচ্ছবিত্ব ধরে রাখায় অটুট হতে পারে…! এখানে বারোটি অধ্যায়ের দীর্ঘ লিস্টি পেতে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি করতে চাই না, তবু কয়েকটিতে তো চোখ বোলানোই যেতে পারে--গ্রন্থের গতিধারাটা বোঝা যাবেঃ
প্রথম অধ্যায়—কেন আমি বাবা-মায়ের মতো?
দ্বিতীয় অধ্যায়—চার্লস ডারউইন
তৃতীয় অধ্যায়—যৌন নির্বাচন
চতুর্থ অধ্যায়—মানুষের উদ্ভব ও বিবর্তন
অষ্টম অধ্যায়—জিন, সমাজ, আচরণ
একাদশ অধ্যায়—বিবর্তন কি সত্যি?
দ্বাদশ অধ্যায়—বিবর্তন নিয়ে ভুল ধারণা
এবং তিনটি যে পরিশিষ্ট রয়েছে জেনেটিক্স নিয়ে, মেন্ডেল নিয়ে--মাথায় করে রাখার মতো। অসংখ্য ছবি রয়েছে বইটি জুড়ে। স্বাভাবিক। ছবি না থাকলে এহেন একটি বিষয়ের ব্যাখ্যান সম্ভব নয়। তবে শেষে প্রতিটি চিত্র ধরে ধরে যে ‘চিত্র তালিকা’ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে অত্যন্ত খেটে কাজ তা, অত্যন্ত কাজেরও কারণ পরে ‘কোথায় গেল ছবিটা কোথায় গেল ছবিটা’ করে মাথা চাপড়াতে হবে না। প্রখ্যাত জেনোমিক্স বিজ্ঞানী শ্রীপার্থপ্রতিম মজুমদার চমৎকার একটি ভূমিকা লিখে দিয়েছেন, এবং ব্লার্বটি লিখেছেন আশীষ লাহিড়ী মশাই। সুখপাঠ।
বইটির ছাপাই বাঁধাই কাগজ বিশ্বমানের।
সব মিলিয়ে এ’ বই বাংলাভাষায় এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন---সন্দেহ নেই।
বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা--কল্লোল লাহিড়ী; ‘সুপ্রকাশ’ প্রকাশনালয়, কলকাতা-৭৩; সেপ্টেম্বর ২০২১; ISBN 978-81-952905-9-8
একটা আক্ষেপের কথা আগেও বলেছিলাম।
বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির গীতিকারগণ, যেমন শাহির লুধিয়ানভী বা কাইফি আজমি সাহেব যেমন হিন্দী-উর্দুভাষার প্রমুখ কবি বলেও স্বীকৃত, বাংলায় কিন্তু গৌরীপ্রসন্ন বা পুলক বন্দ্যো কখনই বুদ্ধদেব-বিষ্ণু দে-র সমকক্ষ কবির মর্যাদা পাননি। একজন গীতিকার কবিই বটেন, অবশ্যই কবি, কিন্তু উন্নাসিক বাংলা যেন এঁদের কবির চেয়ে নিচু দর্জা দিয়ে এসেছে।
আক্ষেপটা কাহিনীকার-চিত্রনাট্যকার বিতর্কেও সমভাবে প্রযোজ্য। সিনেমার চিত্রনাট্যকারকে যে কাহিনীকারও হতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই। বহু বহু কালজয়ী সিনেমার চিত্রনাট্য অন্যজনে লিখেছেন---তাঁদের মধ্যে নামী-অনামী দুইই আছেন। নামী মানে অন্যের গল্পের চিত্রনাট্য সত্যজিৎ-ঋত্বিক-তপন সিনহা লিখলে তো তাঁরা বিখ্যাতই (তাঁরা পরিচালকও বটেন কিনা), কিন্তু আজকের পদ্মনাভ-কল্লোলের মতো যাঁরা চিত্রনাট্য রচনাতেই নিবেদিতপ্রাণ তাঁরা যেন অন্তরালেই থেকে যান; যদিও চিত্রনাট্য রচনা যে সাহিত্যেরই একটা অন্যরকম বহিঃপ্রকাশ---সেটা কি আর আলাদা করে বলে দিতে হয়?
যদি না এক নামী চিত্রনাট্যকার বিশেষভাবে এক সাহিত্যকর্ম করেন। ও ছাপান। ও আমরা পড়ি।
বর্তমান গ্রন্থটির লেখক কল্লোল লাহিড়ী মশাই আজকের দিনের এক সফল চিত্রনাট্যকার। ‘মহানায়ক’, ‘মন্টু পাইলট’, ‘ড্রাকুলা স্যর’ প্রভৃতির মতো সফল ছবি/ওয়েবসিরিজের পালক রয়েছে ওঁর মুকুটে। কিন্তু যতক্ষণ না উনি এই ‘বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা’-র মতো এক সাহিত্যকর্ম সামনে আনলেন, তাঁকে ‘সাহিত্যিক’ মর্যাদা দিতে যেন কুণ্ঠিত ছিল বাঙালী পাঠক। [ওঁর ‘ইন্দুমতী ভাতের হোটেল’ ও ‘গোরা নকশাল’-ও আর দুটি মান্য উপন্যাস।]
**
দেশভাগ উপরান্ত এক ছিন্নমূল পরিবার কলিকাতা-শহরতলীতে গঙ্গাতীরে আস্তানা গাড়লেন। মা-বাবা-ভাইবোন-কাকাপিসি নিয়ে উচ্চবর্ণীয় এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার; সংসারকর্তা পেশায় স্কুলশিক্ষক। নুন-আনতে-পান্তা-ফুরনো বাবার একমাত্র শখ বলতে ছিল ফটো তোলা। এবং এই ক্যামেরাটিকে অবশ্যই এক জাপানী ‘ইয়াশিকা’ হতে হবে! ষাট-সত্তরের দশকেও ইয়াশিকা ছিল মধ্যবিত্ত বাঙালীর এক আধুনিকতার প্রতীক, আর তাতে তোলা কত কত ছবি আজকের এই সফল চিত্রনাট্যকারের জীবনের জলছবি হয়ে থাকে, আছে---আমরাও দেখতে পেলুম এই স্মৃতিমেদুর গ্রন্থে।
উত্তমপুরুষে কিছু লিখে উতরে দেওয়া কঠিন কাজ বলে মনে করি, বিশেষ করে যেখানে কিছুমাত্র কল্পনার আশ্রয় না নিয়ে, নামধাম না পালটে, হুবহু লিখে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ পাঠক তো ভাবতেই পারে, ‘তোমার বাপ-মা-ভাইবোনের গল্প আমি জেনে কী করব বল তো?’---যদি না লিখনগুণে এই বাধাকে অতিক্রম করে ফেলা যায়। এ’বইয়ের চরিত্রাবলী সন্তুকাকু বা ঠাম্মা বা মণি তখন আর চেনাগণ্ডীর বাইরের কেউ থাকেন না, কারণ ঠিক তেমনই এক এক ‘সন্তুকাকু বা ঠাম্মা বা মণি’ তো আমার-আপনার পরিমণ্ডলেও কেউ-না-কেউ ছিলেন গো। হ্যাঁ, ছিলেনই। ঐ নামে বা আরেক।
চমৎকার চমৎকার শিরোনাম অধ্যায়গুলিরঃ ‘মিষ্টি পিঠের কৌটো’, ‘এক টুকরো দেশ’, ‘খুঁজে পাওয়া সেই চিঠিগুলো’, ‘তেপান্তরের পার’ ---এমন (কিন্তু কোনো ‘সূচিপত্র’ নেই কেন?)। আর লেখার সুরটা এমনই আপন-আপন যে মনে হয় এ’তো আমার চেনা একটা গল্পই বলছেন কল্লোল! আর ছবিগুলো? না, শিল্পসুষমায় মোটেই কালোত্তীর্ণ নয়, বরং সাদাকালোয় অপটু হাতে তোলা সাইকেল-চালানো, ভাত-খাওয়া, পড়তে-বসা বা মেলায়-ঘোরার মত আটপৌরে ছবি এ’গুলি (বহু ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডের দেওয়ালে আবার ঘটা করে এক ছাপা বেডকভার টাঙানো---যেমন আমার-আপনার বাড়িতেও টাঙানোর চল ছিল)---কিন্তু এই অপটুত্বই বইটির ভূষণ হয়ে উঠেছে। কারণ? ‘নো স্টাইল ইজ দ্য বেস্ট স্টাইল’।
এখানে প্রাইজ-উইনিং ছবি দিলেই মার খেত বইটির মূল সুর।
কিছু কিছু ঘটনার উল্লেখ এত মনোগ্রাহী--যেমন সেই প্রথম রেজিস্ট্রি চিঠি রিসিভ করা--মনে পড়বেই আপনার নিজের জীবনের এমন কোন-না-কোন নাড়া-দেওয়া ঘটনা। আমার মনে পড়ে গেল ‘সীমাবদ্ধ’ ছবির নায়ক শ্যামলের চাকরি পাওয়ার সুসংবাদ বয়ে আনা চিঠিটির সেই দৃশ্য, এবং বরুণ চন্দের সেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানো! এই সব একটা একটা ছোট ছোট তুলির টানই শিল্পীর জাত চেনায়।
আসলে, এটি কতটা এক স্মৃতিচারণ আর কতটা এক নিখাদ কল্পনাভিত্তিক সাহিত্যকীর্তি---তার ভেদরেখাটা যেন কোথায় লীন হয়ে যায়। কাজই বা কী বাপু এহেন ভেদাভেদিতে?
নতুন এক প্রকাশনালয় চমৎকার এক প্রোডাকশন করেছেন--এই বইটি--মনোহর ছাপাই-বাঁধাই-বুকসাইজ--এ’সব কথাই মনে থেকে যাক।
বিতর্কিত দেশনায়কঃ সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনীতি---১৯২১-৪১--সৌম্য বসু; বুকপোস্ট পাবলিকেশন, কলকাতা ৭০০০০৯; ISBN 948-81-953502-9-2
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু যে এক প্রধান স্থান অধিকার করে আছেন---সেটা বলবার অবকাশ রাখে না; যদিও তাঁর ভূমিকাটিকে দিল্লির সত্ত্বারূঢ় দল বা গোষ্ঠী কীভাবে আর কতটা ক্ষুণ্ণ করতে সচেষ্ট হয়ে আসছে আজ পৌনে এক শতাব্দী ধরে---সেটাও বাঙালীর এক অতি প্রিয় আলোচ্য বিষয় হয়ে আছে।
নেতাজীর এই ভূমিকা প্রধানত তাঁর ‘আজাদ হিন্দ্বাহিনী’ গড়ে সশস্ত্র আক্রমণের মাধ্যমে বৃটিশ নাগপাশ থেকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করবার প্রয়াসকে ঘিরেই। বিফল হলেও, তাঁর এই মহান প্রয়াস দেশবাসীর মধ্যে আজও রোমাঞ্চ জাগায়, বিশেষত বাঙালীজাতির মধ্যে, যাঁরা সেই স্বদেশী আন্দোলন (১৯০৫ খ্রি)-ক্ষুদিরাম-বাঘাযতীনের কাল থেকে বোমা-পিস্তল হাতে বৃটিশ-খেদানোতেই বেশি উৎসাহ পেয়ে এসেছেন, গান্ধীজীর গ্রামোন্নয়ন-খাদি-অস্পৃশ্যতাদূরীকরণের এজেন্ডা যাঁদের কাছে পানসে লেগেছিল তাই।
কিন্তু ধনীর দুলাল আইসিএস-ত্যাগী সুভাষচন্দ্র ঐ সামরিক অভ্যুত্থানের জায়গাটিতে পৌঁছলেন কী করে? বিপুল ভোটে জয়ী দুইবারের কংগ্রেস-প্রেসিডেন্টের (‘রাষ্ট্রপতি’) তো ঐ কণ্টকাকীর্ণ পথে যাবার কথাই নয়। তবে কেন তাঁকে দেশত্যাগ করে জার্মানি/জাপানে গিয়ে উঠতে হলো ঠেলে?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে ১৯২১-এ দেশে ফেরা থেকে ১৯৪১-এর ‘মহানিষ্ক্রমণ’ পর্যন্ত বিশটা বছরে সুভাষের কর্মকাণ্ডকে পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখতে হবে যে! এবং সেখানে সুভাষচন্দ্র তখনও ‘নেতাজী’ নন, দেশবন্ধুর শিষ্য হয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করে থেকে তিনি তখন কলকাতা কর্পোরেশন কব্জা করতে দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী, এবং বিশ-ত্রিশের দশকের প্রবল দলাদলিকীর্ণ বঙ্গীয় রাজনীতির এক নাটের গুরু।
১৯২৮-এর পার্কসার্কাসে (কলকাতা) জাতীয় কংগ্রেসের যে অধিবেশনে সামরিক পোশাকে অশ্বারূঢ় সুভাষচন্দ্র GOC রূপে অবতীর্ণ হয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সকলকে তার অত অত ফান্ড কোত্থেকে এল---সে প্রশ্ন তখনই উঠে গিয়েছিল। রাশিয়ায় কমিন্টার্নে অংশগ্রহণ করবার আমন্ত্রণ সম্বলিত মস্কো থেকে এম এন রায়ের পাঠানো চিঠি নিয়ে মুজফফর আহমেদ দেখা করতে এলে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সুভাষচন্দ্র; এবং উনিই টাটা কারখানার মালিক-শ্রমিক বিরোধে একাধিকবার জামশেদপুরে গিয়ে মালিকপক্ষের স্বার্থে কথা বলেছেন।
১৯৪০-এ কলকাতা কর্পোরেশনকে পুনরায় কব্জা করতে হিন্দু মহাসভার সঙ্গে আসন-সমঝোতা করেছিলেন তিনি, কিছু পরে মুসলিম লিগের সঙ্গেও। হ্যাঁ, সালতামামি ও প্রাইমারি সোর্সের উল্লেখ করে করে বর্তমান লেখক সুভাষচন্দ্রের এই এই রাজনৈতিক বেচালের কথা উল্লেখ করেছেন, এবং ওঁর এমন এমন পদক্ষেপই যে ‘মহানিষ্ক্রমণ’-কে অনিবার্য করে তুলেছিল---প্রতিষ্ঠা করেছেন সে কথাও।
**
কোনো পূর্বঘোষিত সিদ্ধান্ত নয়, ঘটনাবলী যে যে ঘাটে ঘাটে এগিয়ে গেছে এক নির্মোহ ইতিহাসবেত্তার নৈর্ব্যক্তিকতা নিয়ে বর্তমান লেখক সৌম্য বসু সেগুলিকে সাপটে এনেছেন দুই মলাটের মধ্যে--এটাই বইটি থেকে পরম প্রাপ্তি। নৈলে AICC papers এর মতো হাজারো primary sources বা তিনমূর্তি ভবনে সংরক্ষিত নেলী সেনগুপ্তা/রজনী পালমে দত্তের নথিকৃত মৌখিক ইতিহাসের (oral history) নানান সূত্র ঢুঁড়ে বেড়াতে হতো আমাদের তথ্যের জন্যে। কালি ছেটানো লক্ষ্য নয় লেখকের, ভারতেতিহাসের এক মহান পুরুষকে প্রকৃত নৈর্ব্যক্তিকভাবে দেখবার প্রয়োজন আছে---যা থেকে এই গ্রন্থের উদ্ভব বলে মনে করি। (১) স্বাধীনতা আন্দোলনে বঙ্গীয় মুসলমানের ভূমিকা এবং (২) হিন্দুধর্মাশ্রয়ী জাতীয় আন্দোলনের উন্মেষের উপরে সৌম্যের আগের দুইটি গ্রন্থে ওঁর এই নিস্পৃহ দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। বর্তমান গ্রন্থটি আরও বাড়িয়ে দিয়ে গেল আমাদের আশা।
এই বইয়ের একটি অবশ্যম্ভাবী সিকুয়েল হয়---‘মহানিষ্ক্রমণ থেকে তাইহোকু’! সেটির দিকে তাকিয়ে রইলাম।
পুনঃ বইয়ের প্রথম বাক্যে ‘উৎকর্ষতা’ শব্দটি লেখা হয়েছে। ঠিক করে নিতে হবে।
Aligarh Muslim University---The Making of the Modern Indian Muslim--Mohammed Wajihuddin; Harper Collins, India; 2021; P-ISBN: 978-93-5489-331-5; E-ISBN:978-93-5489-332-2
পুরো বিষয়টা শুরু হয়েছিল একটা ছবি থেকে।
আরও সঠিকভাবে বললে, একটা ছবি টাঙানো থেকে।
‘আলিগড়’ শহরের নাম শুনলে অবশ্যই ‘আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি’-র নামটাই প্রথম মনে আসে, এবং উর্দু এই শহর ও জেলার দ্বিতীয় সরকারী ভাষা হলেও গত ত্রিশ বছরে দু’বার মাত্র অ-বিজেপীয় কোন এম.পি. হয়েছেন আলিগড় থেকে, এবং পঞ্চাশের দশকে একবারই মাত্র একজন মুসলিম ব্যক্তি এখান থেকে লোকসভায় গিয়েছিলেন (এক এবং অদ্বিতীয় দার্শনিক জামাল খ্বাজা সাহেব)। বর্তমান এম.পি. সতীশ গৌতমজীও ২০১৪ থেকেই আছেন, কিন্তু হঠাৎই ২০১৮তে তিনি দাবি তুলে বসেন যে ১৯৩৮ সন থেকে AMU-র ছাত্র-ইউনিয়ন হলে মুহম্মদ আলি জিন্নার যে ছবিটা টাঙানো আছে সেটি সরিয়ে দিতে হবে, কারণ তিনি যে ছিলেন দেশবিভাগের কাণ্ডারী! এই নিয়ে সেই সময়ে হৈ-হুল্লোড় তর্ক-বিতর্ক মিডিয়ায় লেখালেখি কম হয়নি। AMU-র অতি শক্তিশালী এলামনি এসোসিয়েশন থেকে উপাচার্য সকলেই বলেছিলেন যে ঐ ছবি তো আমাদের ট্রাডিশনের অঙ্গ হয়ে আছে আজ আশি বছর ধরে; যেমন মহাত্মা গান্ধীর ছবিটিও, যেটি কিনা ১৯২০ থেকে ওখানে টাঙানো আছে। ওঁকেও ছাত্রসংসদ সম্বর্ধনা জানিয়েছিল যে!
এই ঘটনাটিই TOI-এর তরুণ সাংবাদিক মো. ওয়াজিহুদ্দিনকে আজ এই বইটি লিখতে উদ্বুদ্ধ করল, যিনি নিজেকে এক অসফল আলিগড়ী বলতে ভালোবাসেন! এবং ওঁর এই ডাউন-টু-আর্থ এপ্রোচটাই বইটিতে এক বিশেষ তার এনেছে, এবং সেটি হয়ে উঠেছে এক সুখপাঠ।
আলিগড় আন্দোলনের উপরে কেতাবের সংখ্যা তো আর কম নয়, সামান্য কিছু কিছু পড়াও আছে।
তার মধ্যে এই বইখানি মন কাড়লো।
***
ঊনবিংশ শতকের এক যুগপুরুষ স্যর সৈয়দ আহমেদ খান ১৮৫৭-তে ভারতীয় মুসলমানদের কচুকাটা হতে দেখেছিলেন। সে সময়ে ইংরেজ বাহাদুরের পক্ষ নিয়ে জাতভাইদের কাছে কম নাকাল হতে হয়নি তাঁকে (জন্ম তাঁর আবার এক খানদানী শিয়া বংশে)--বেইমান খয়ের খাঁ প্রভৃতি আখ্যা মিলেছিল তাঁর। তবু মুসলমানদের পক্ষে আধুনিক ইউরোপীয় শিক্ষার অপরিহার্যতার কথা চিন্তা করে ইস্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এর পঞ্চাশ বছর আগে (১৮২৩) রাজা রামমোহন এই সুরেই সেই ঐতিহাসিক চিঠিটা লিখেছিলেন বড়লাট লর্ড আমহার্স্টকে, এবং এই পঞ্চাশ বছর পেছিয়ে থাকাটাকে মেক আপ করতে ১৮৮৫ তে সুরেন বাঁড়ুজ্যের কাছ থেকে পাওয়া জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেবার আমন্ত্রণকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন স্যর সৈয়দ।
এ’সব অজানা তথ্য নয়।
এটাও অজানা তথ্য নয় যে দ্বিজাতিতত্ত্বের আদিতম প্রবক্তা উনিই ছিলেন--- মুসলিম নবজাগরণ-উপরান্ত যেটা বোধহয় অমোঘ ছিল।
তাহলে ওয়াজিহুদ্দিন সাহেব এই শ’দুয়েক পৃষ্ঠার টান টান কেতাবে কী লিখলেন?
দশটি অধ্যায়ে ধরে ধরে দেশভাগ ও তার বেদনা থেকে শুরু করে আজ যে এই মহান ঐতিহ্যময় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিদীর্ণ করুণ অবস্থা, সেখানে তবলীগি দাপাদাপি, মৌলবাদের পদসঞ্চার ---এ’সব বড় খুঁটিয়ে লিখেছেন, এবং এক ইতিহাসবেত্তার নৈর্ব্যক্তিকতা দিয়ে। এ’সবই কিন্তু ছিল আলিগড়ী ফাউন্ডিং-ফাদার্সদের স্বপ্নের উল্টোস্রোতে--স্যর সৈয়দ থেকে জাকাউল্লাহ্ দেহলভী, রাজা জয়কিষণ দাস বা জর্জ ফারকুহার আরভিং গ্রাহামের মতো আলিগড়ী আন্দোলনের পুরোধাগণ এহেন সংকীর্ণ মৌলগন্ধী আলিগড় চাননি।
***
আর শোনা গেল কত কত ছুটকাহানী (anecdote) এই কেতাবেঃ
কবি ও স্বাধীনতা সংগ্রামী মৌলানা হসরত মোহানী এক সন্ধ্যায় হঠাৎ জিন্না সাহেবের বম্বে হাউজে উপস্থিত হয়ে দেখেন উনি যথারীতি আসবে নিমজ্জিত!
মুখ লাল করে বললেন, সে কী! আপনি মদ্যপান করেন?
‘কেন? একটু খেয়ে দেখবে নাকি? চমৎকার স্বাদ কিন্তু!’ চোখ মটকে বললেন কায়েদ-ই-আজম!
তওবা তওবা! আমাকে শেষ বিচারের জন্যে আল্লার দরবারে গিয়ে জবাব দিতে হবে না?
‘তাহলে দেখ মৌলানা সাহেব, আল্লার রহমতে (ক্ষমা ও করুণায়) তোমার চেয়ে আমার ভরোসা বেশি। তাই তোমার চেয়ে আমি বড় মুসলমান! ’ (এখানে চারটি হাসির স্মাইলি না দিলেই চলছে না যে!)
বা,
জিন্না তখন আলিগড়ের নয়নের মণি। জাতীয়তাবাদী আবুল কালাম আজাদ ঘোর শত্রু বলে পরিগণিত! দিল্লি থেকে কলকাতা ফেরার কালকা মেলে আজাদের বগিতে আক্রমণ করে কোপাতে গিয়েছিলে আলিগড়ের লীগপন্থী ছাত্ররা (১৯৪৫). পরম নৈর্ব্যক্তিকতা দিয়ে ওয়াজিহুদ্দিন শুনিয়েছেন এ’সব গল্প।
ফেসবুকে আলাপ হলো লেখকের সঙ্গে।
পাঠ-মুগ্ধতা জানালাম ওঁকে।
***
এককালে অবিভক্ত বঙ্গদেশের প্রিমিয়র ফজলুল হক সাহেব কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ সম্বন্ধে যেমনটি বলছিলেন, ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মহাপ্রাণ জাকির হুসেন আলিগড় সম্বন্ধেও সেই একই সুরে বলেছিলেন, ‘আলিগড় যে যে ভাবে ভারতের জাতীয়জীবনে অংশ নেবে, সেই সেই ভাবেই দেশে মুসলমানের স্থান নির্ধারিত হবে। তেমনই, ভারত যে চোখে আলিগড়কে দেখতে থাকবে, সেটা নির্ধারণ করবে ভারতের সেক্যুলার চরিত্র!’
ঐ ছবি-বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে মহাত্মনের এই বাণী অতীব অমোঘ বলেই আজ প্রতীত হয়।