তুতুলের ভালো লাগে না সমুদ্দুর—এক ফোঁটাও নয়। কিন্তু ওর কপালটাই খারাপ! ওর বাবা-মা না যেন কী অদ্ভুত। সমুদ্দুর দেখার জন্য ওরা একেবারে পাগল! ছোট্ট একটা ছুটি পেলেই হল। অমনি দুজনে মিলে গুজুর-গুজুর করে প্ল্যান করে ফেলবে: সমুদ্দুরের কাছে একটু ঘুরে আসার জন্য। আসলে টুটুলদের বাড়ি থেকে ঘন্টা খানেক ড্রাইভ করলেই তো মারিনা বিচে পৌঁছে যাওয়া যায়। তুতুলকেও ওরা ভুলিয়েভালিয়ে ঠিক নিয়ে যাবে, ওর কোনো কথাই কানে তোলে না ওরা, হেসে উড়িয়ে দেয় ওর সব বুক-কাঁপুনি। বলে দূর বোকা, আমরা দুজনে তো তোর সাথে থাকব, ভয় কীসের? আমাদের কাছ থেকে তোকে কেড়ে নেবে, এমন সাধ্য আছে সমুদ্রের? তাছাড়া সমুদ্রটা আসলে খুব একা, তাই সবার সাথে ভাব করার জন্য ও কেবলই ছুটে ছুটে আসে, আর গান গেয়ে গেয়ে সব্বাইকে ডাকাডাকি করে।
কিন্তু, ওসব বানানো কথায় তুতুল মোটেই ভুলছে না, বাবা। সে সমুদ্দুরকে ভালো বাসবে না, বাসবে না, বাসবে না, ব্যাস!
সমুদ্দুরকে ভালো না লাগলে কী হবে, তার তীরের চিকচিকে বালি ঘেঁটে ঘেঁটে ঝিনুক কুড়োতে তুতুলের কী যে ভালো লাগে! কোনোটা দেখতে জাপানি হাতপাখা উচিওয়ার মতো, কোনোটা বাজনদারের শিঙার মতো, কোনোটা আবার বুনো শুয়োরের বাঁকানো দাঁতের মতো। কত না বাহার তাদের রঙের—কেউ হলদেটে, কেউ ধূসর, গোলাপি অথবা বেগনি রঙের। সূয্যিমামা যেন সাত রঙের তুলি আলতো করে বুলিয়ে দিয়েছেন ওদের গায়ে। একদিন তো সে একটা এত্ত বড় শাঁখ পেয়ে গেল: অনেকটা নাশপাতির মতো দেখতে, বাইরেটা বাদামি রঙের আর ভিতরে কেমন হালকা কমলাটে।
বাবাকে দেখাতেই বাবা বলল, এটা একটু অন্য জাতের ঝিনুক, কানের বাইরে ঠেকা, দেখবি সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাবি কানের ভিতরই।
ধ্যাৎ, তাই বুঝি হয় কখনো? ওই প্রচণ্ড দস্যু সমুদ্দুরটা বুঝি ওই এত্তটুকু ঝিনুকের মধ্যে থাকতে পারে! বাবাটা না ভারি দুষ্টু—তুতুলকে ছোট্ট পেয়ে বোকা বানাতে চাইছে! কিন্তু সে-গুড়ে বালি! তুতুল ভুলবেই না এসব আষাঢ়ে গল্পে। সে মাথা নেড়ে বলে, মোটেই না, এরকম হয়ই না কক্ষনো।
বাবা হো-হো করে হাসতে হাসতে তুতুলের মাথার চুলে ইলিবিলি কেটে বসার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
তুতুল অপেক্ষা করে, বাবার পায়ের শব্দ এক্কেবারে মিলিয়ে যেতেই, এদিক-ওদিক একটু দেখে নেয়। না, কেউ নেই আশেপাশে। তারপর আস্তে আস্তে শঙ্খটাকে নিয়ে নিজের কানে চেপে ধরে, ভালো করে শোনবার চেষ্টা করে। কী আশ্চর্য, সত্যি তো! ওর কানে সমুদ্দুরের সেই শব্দটাই আসছে বটে, কিন্তু এটা অনেক শান্ত, অনেক মিষ্টি। তুতুলের মোটেই ভয় করছে না, এক ফোঁটাও নয়।
তুতুল শাঁখটাকে ওর বেডরুমে নিয়ে আসে। ওর পড়ার টেবিলের পাশে যে-দুটো চেয়ার আছে, তার একটাকে নিজের বিছানার পাশে টেনে এনে, শাঁখটাকে সেটার উপর রাখে।
সমুদ্দুরের জন্য ওর কিন্তু এখন খুব কষ্ট হচ্ছে। অত্ত বড় সমুদ্দুরটা পারে কি কখনো ওইটুকু শঙ্খের মধ্যে এঁটে যেতে? ওর দমটা বোধ হয় একেবারে বন্ধ হয়ে আসছে, সেই উচ্ছল সমুদ্রটার নিশ্চয়ই এখন আর একটুও আনন্দ হচ্ছে না! ওর খেলার প্রকাণ্ড জায়গাটাই যে হারিয়ে গেছে!
তুতুলের ছোট্ট বুকটার মধ্যে বেজায় দুঃখ হচ্ছে দামাল সমুদ্রের জন্য। ও বিছানায় উঠে বসে, তাকায় আড়চোখে শাঁখটার দিকে, ছেড়েই দিই না কেন সমুদ্দুরটাকে? এই একটুখানি সময়ের জন্য! ও তো আর এই, এত্ত বড়টি নয়, আর ওর আওয়াজও তো বেশ মিহি। ওকে বেশ বন্ধুর মতোই তো লাগছে। ছেড়ে দিলে কীই বা আর ক্ষতি হবে? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে তুতুল আস্তে করে হাতের তালুতে তুলে নেয় শঙ্খটাকে, সেটার গায়ে নরম হাত বুলিয়ে, ফিসফিসিয়ে বলে, বেরিয়ে এসো সমুদ্দুর, আমি তোমায় একটুও ব্যথা দেব না, সত্যি বলছি। নিজের বুকে হাত রেখে প্রমিস করে সে।
তারপর অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে তুতুল। কিছুই হল না তো! হঠাৎই একটা দীর্ঘ হিস-হিস শব্দ শোনে সে, ঠিক যেন একটা চাবুক বাতাসকে কেটে কেটে দিচ্ছে। চমকে এদিক-ওদিক তাকায় তুতুল। আর তার পরই, ওর চোখ গোল গোল হয়ে যায়, ও দেখে, সমুদ্দুরটা শঙ্খের খোলস ছেড়ে গা মোচড়ানি দিতে দিতে টুক করে বেরিয়ে এল। প্রথমে তুতুলের পায়ের আঙুলের চারপাশে জড়িয়ে জড়িয়ে একটু ঘুরে বেড়াল, তারপর ওর পুরো পায়ের পাতা দুধ-সাদা ফুরফুরে ফেনায় ভরিয়ে দিল। তুতুলের এত সুড়সুড়ি লাগছে যে ও উঃ উঃ করে অল্প হেসে উঠল। সমুদ্দুরটা তারপর ওর বিছানার গায়ে আলতো করে ধাক্কা দিতে লাগল—খাটটা এখন একটু একটু করে দুলছে, মিষ্টি সেই দুলুনিটার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্দুরের জলের ছররায় আস্তে আস্তে ভিজে যাচ্ছে তুতুল। ওর কিন্তু খারাপ লাগছে না মোটেই—একটুও না, এক ফোঁটাও নয়। অত উঁচু থেকে খেলাটা জমে কখনো? বিছানা ছেড়ে তাই এবার মেঝেতে নেমে আসে তুতুল—জলের মধ্যে ধেবড়ে আধশোয়া হয়ে, পা দিয়ে লাথি মেরে মেরে জল ছড়াতে ছিটকাতে থাকে সে চারপাশে, তারপর খেলনার বাক্সে চড়ে ডিঙা ভাসাল সে, চিৎ সাঁতার দিয়ে জলে ভেসে রইল, আর শেষমেশ গোটা কয়েক ডিগবাজি খেয়ে নিল জলেতে—এক, দুই তিন। লাল টাগ-বোট, হলুদ কাঠের হাঁস, নীল ডোরাকাটা সি-প্লেন—ওর সব খেলনাগুলো যেন অদৃশ্য এক নাগরদোলায় চড়েছে, চারপাশের জলের রাশির মধ্যে তারা থেকে থেকে ডুবছে আর ভেসে ভেসে উঠছে। মুঠো করে করে দুহাতে সমুদ্দুরের ফেনা ভরছে তুতুল আর সেই বুদ্বুদরাশি তার হাতের ফাঁকে নিমেষেই উধাও হয়ে যাচ্ছে। কী যে মজা! ও হাসতে লাগল, প্রথমে চুপি চুপি, তারপর একদম খিলখিল করে।
তাই শুনে, পাশের ঘর থেকে ওর বাবা-মা জিজ্ঞেস করে, কিরে, তুই কী করছিস?
ঠিক তখন ঢেউয়ের মধ্যে একটা ঝাঁপ দিচ্ছিল তুতুল, জল থেকে মাথা তুলে ফুসফুসে নোনা বাতাস ভরে নেয় ও। তারপর চেঁচিয়ে বলে, মা, বাবা, আমার বেডরুমে একটা সমুদ্দুর এসে গেছে, আমি ওর ঢেউয়ে ঝাঁপাচ্ছি, আমি ভিজে যাচ্ছি।
তুতুলের বাবা-মা একে অপরের দিকে তাকায়—বাবা বলে ওর ঘরে সমুদ্দুর, সে আবার কী?
তুতুলের মা ঠোঁট উলটে বলে, কে জানে, কিছুই বুজছি না মাথামুণ্ডু! চলো তো দেখে আসি, মেয়েটা যে কী হেঁয়ালি শুরু করেছে!
ওরা দুজনে তুতুলের বেডরুমের দরজাটা ফাঁক করে ভিতরে উঁকি দেয়। দেখে চারপাশে তার সব খেলনাপাতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মেঝেতে সাঁতার কাটছে তুতুল। কিন্তু, কোথায় কীসের সমুদ্র? নাহ, কোনো সমুদ্র তো নেই সেখানে।
এই তুতুল কীসব বলছিস? স্বপ্ন দেখছিলি না কি?
স্বপ্ন? মানে?
তড়াক করে মেঝে থেকে উঠে বসল তুতুল। জামা-প্যান্ট, চুল, হাত-পা সব ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল সে, নাহ, সব খটখটে শুকনো! কোথায় গেল ওর সমুদ্দুরটা? বাবা-মায়ের দিকে অপ্রস্তুত চোখে তাকিয়ে ও বলে, একটু আগেই তো এখানে সমুদ্দুরটা ছিল, ওই শাঁখের খোলটার মধ্যে থাকে ও, তোমাদের দেখতে পেয়েই নিশ্চয়ই সেখানে ফিরে গেছে। ও আমার বন্ধু—খুব নরমতরম আর মিষ্টি।
তুতুলের বাবা-মা নির্বাক। শুধু পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ওরা। তারপর বাবা বলল, এটা তো সত্যিকারের সমুদ্র নয়। শুধুমাত্র একটা শব্দ পাবি যখন তুই এটাকে কানের বিপরীতে চেপে রাখবি—ওর মা যোগ করল।
তুতুলের কান্না পায়, বড়োরা কেন এরকম অদ্ভুত হয়, সোজা জিনিসটা কিছুতেই বুঝতে চায় না!
কিন্তু সে নিশ্চিত জানে যে, তার শোবার ঘরে সমুদ্দুরটা ছিল। চারিদিকে অসহায়ের মতো তাকায় তুতুল, তারপরেই ওর নজরে আসে ওর চেয়ারের নিচের ছোট্ট বালির স্তূপটার দিকে, সেটার দিকে আঙুল দেখিয়ে উত্তেজনায় চিৎকার করে ওঠে সে—বাবা, মা দেখো, দেখো, সমুদ্দুর যদি নাই ছিল তো, ওই বালি এল কোথা থেকে?
ওর বাবা-মা বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। সত্যিই তো! কী হল ঘটনাটা? কিছুই আর উত্তর দিতে পারে না ওরা।
বিজয়ীর হাসিতে উদ্ভাসিত এখন তুতুলের মুখ। সে বলে চলে, আমি এই বালিটা একটা বয়ামে ভরে রেখে দেব সবসময়ের জন্য। আমার বন্ধুর চিহ্ন যে ওটা!
তাহলে কাল কি আমরা সক্কলে মিলে সমুদ্রসৈকতে যাব? —বাবা জিজ্ঞেস করল তুতুলকে, তাহলে সাধ মিটিয়ে সাগরে সাঁতার কাটতে পারবি তুই।
বাবার কথা শুনেই তুতুল একেবারে হইহই করে নেচে উঠে বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব মজা হবে!
পরদিন বাবা-মা ওঠার আগেই, সাত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে, সাঁতারের পোশাক, স্নরকেল, কিক-বোর্ড, বালতি, কোদাল সব গুছিয়ে তুতুল একেবারে তৈরি। সমুদ্দুর যেন ওকে ডাকছে, তার কাছে যেতে আর তর সইছে না ওর।
বাবা-মা আর তুতুল যখন সমুদ্দুরের তীরে এল, ওই সুনীল সুগভীর জলরাশিকে দেখে তুতুল কিন্তু একটুও আর ভয় পেল না, হোক না বিশাল, ও তো তুতুলের বন্ধু। বন্ধুকে কি কেউ ভয় পায়? তোমরাই বলো!