চলচ্চিত্রে চিত্রকলার প্রভাব প্রায় তার আবিষ্কারের সময় থেকেই। শুরুতে চলমান ছবি দেখিয়ে অবাক করাটাই প্রধান উদ্দেশ্য হলেও, কদিনের মধ্যেই চলচ্চিত্র নির্মাতারা এই মাধ্যমটির আশ্চর্যরকম বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে গল্প বলার ক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতন হতে থাকেন। কিন্তু প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে সেইসময়ে বাস্তবানুগ সেট তৈরী করা ছিল অসম্ভব। অথচ এই নতুন শিল্পমাধ্যমের পুরো ক্ষমতাটা আহরণ করবার জন্যে এই শর্তটা পূরণ করা ছিলো জরুরী, বিশেষত, নাটকের থেকে তাকে আলাদা করা জন্যে। পৃথিবীর প্রথম স্টুডিও বানানো হয় ১৮৯৭ সালে, ফ্রান্সের Montreuil-এ। Melies-এর তৈরী এই স্টুডিও ছিল কাঁচের, কারণ সূর্য্যের আলো ছাড়া শুটিং করা তখনকার দিনে সম্ভব ছিলো না। দৃশ্য তৈরী করতে এই স্টুডিওতে ব্যবহার করা হত বড় বড় ক্যানভাসে আঁকা ছবি। শুরুতে দারুণ সাফল্য পেলেও, এই রীতি কিন্তু বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। প্রযুক্তির হাত ধরে বাজারে এসে যায় light sensitive film stock। কৃত্রিম আলোতে চার দেওয়ালের মধ্যে চিত্রগ্রহণ শুরু হয় এবং প্লাইউড দিয়ে বাস্তবানুগ দৃশ্যরচনার সুচনা ঘটে। পরে, আউটডোর শুটিং শুরু হয়ার পর ছবি আঁকা দৃশ্যাবলীর ব্যবহার ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে।
এর পরের পর্যায়ে চলচ্চিত্রের উপর চিত্রকলার প্রভাব ঘটে অন্যভাবে, একটু সম্মানজনকভাবে। ততদিনে চলচ্চিত্র শিল্পমাধ্যম হিসেবে খানিকটা রসিকজনের সম্মান আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। এই পর্যায়ের প্রভাবটা ছিল মূলত: দুদিক থেকে। প্রথমটা কারিগরী ও নান্দনিক দিক সংক্রান্ত। কারিগরী ক্ষেত্রে, composition, perspective, lighting, setting, texture ইত্যাদি বিষয়ে চিত্রকলার ছাপ ছেড়ে চলচ্চিত্রের উপর। নান্দনিক ক্ষেত্রে প্রভাবটা অত্যন্ত লক্ষণীয় ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবধি। এই সময় বহু ‘ism’-এর প্রভাব পড়ে চলচ্চিত্রে যার অধিকাংশেরই শুরু চিত্রকলায়। যুগটাই ছিল একটা ব্যাপক রদবদলের। পুরানো দৃষ্টিভঙ্গি ভেঙে গিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী হচ্ছিল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি রাখার যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন উঠছিল। চলচ্চিত্রের আবির্ভাব হয়েছিল এই যুগসন্ধিক্ষণে। Impressionism শেষ হয়ে ইউরোপে ততদিনে দেখা দিয়েছে আরো নানা আন্দোলন, যেমন expressionism, cubism, futurism, Dadaism, surrealism ইত্যাদি। চিত্রকরেরা অনেকেই এ সময়ে চলচ্চিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ, দুইভাবেই এই মাধ্যমের গড়ে ওঠায় সামিল হন। এছাড়াও চলচ্চিত্রকারদের মধ্যেও অনেকেই এই সব আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকায় এই প্রভাব খানিকটা অবশ্যম্ভাবী ছিলো। ছোটখাটো দৃশ্যরচনায় প্রভাব তো ছিলই, যেমন দেখা গেছে Eiscustein-এর October, Pudovkin-এর Mother বা Dovchenko-র Earth ছবিতে কিংবা Renoir-র A Day in the Country ছবিতে, বড় ধরনের প্রভাব বা পুরো একটি শিল্প আন্দোলনেরই পরিবাহক ছবিও তৈরী হয়েছিল। যেমন Salvador Dali ও Louis Bunuel এর Un Chein Andalou ও L’Age d’or (Surrealist), Dziga Vertov- এর The Man with the Movie Camera ও Fritz Lang-এর Metropolis (Futurist) এবং Robert Weine-এর The Cabinet of Dr. Calogari (Expressionist). দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্ত্তীকালে কিন্তু এই প্রভাবটা ক্রমশ: কমে আসে। এর সঠিক কারণ নির্ধারণ বর্ত্তমান আলোচনার আয়ত্তের বাইরে। একটা বড় কারণ এটা হতে পারে যে ততদিনে শিল্পমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র একটা মোটামুটি সর্বজনগ্রাহ্য রূপ পেয়েছিল, সুতরাং নতুন পরীক্ষা- নিরীক্ষার তাগিদটা একটু কমে আসে। পরবর্ত্তীকালে এই ধরণের প্রভাব পড়েছে বটে যেমন Pop Art-এর যুগে, তবে তা বোধহয় খানিকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখাটাই উচিত হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্ত্তীকালে চলচ্চিত্রের উপর চিত্রকলার অন্য প্রভাবটি লক্ষ্য করা যায়। এই সময় চিত্রকলার নানান দিক চলচ্চিত্রের বিষয়ে হয়ে উঠতে থাকে। তথ্যচিত্র থেকে হলিউডের বড় বাজেটের ছবি- সবকিছুতেই এর প্রভাব পড়ে। বহু নতুন ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষাও হতে থাকে কিভাবে এক মাধ্যমকে অন্য আর এক মাধ্যমের সাহায্যে প্রকাশ করা যায় তা নিয়ে। পাঁচ ও ছয়ের দশকে হলিউডে বেশ বড় ধরণের তিনটি ছবি তৈরী হয় যাদের বিষয় ছিল চিত্রকরদের ঘিরে। ১৯৫২ সালে তোলা John Huslon এর অস্কার পাওয়া ছবি Moulin Rouge-এর বিষয় ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর ফরাসী চিত্রশিল্পী Henry Toulouse-Lautrec। চার ফুট আট ইঞ্চির Lautrec- কে পর্দায় ধরতে Huslon-কে তাঁর অভিনেতা Jose Ferrer-কে হাঁটুতে প্যাড পরিয়ে চলাফেরা করাতে হয়েছিলো। আরো বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিল Lautrec-এর আঁকা ছবির বিষয় ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা। শেষ দলে মিউজিক হলের লোকজন ও দেহোপজীবনীদের আনাগোনা ছিলো একটু বেশী। হলিউডের কর্ত্তাদের চোখ রাঙানিতে Huston-কে Lautrec-এর জীবনের এই দিকগুলো এড়িয়ে যেতে হয়। আঁকা ছবি দেখিয়ে ইঙ্গিত দেওয়া ছাড়া আর কিছুই তাঁর করার ছিল না। তুলনায়, ১৯৫৬ তে তোলা Irving Stone-এর Van Gogh-এর জীবনী অবলম্বনে লেখা Lust for Life-এর চিত্ররূপ নি:সন্দেহে অনেক বেশী সৎ ছিল তার বিষয়ের প্রতি। এই ছবিটির বহু অংশ তোলা হয় দক্ষিণ ফ্রান্স্ ও হল্যান্ডে যেখানে Van Gogh তাঁর জীবন কাটিয়েছিলেন। মূল ভূমিকায় Kirk Douglas আর Gaugin-র ভূমিকায় Anthony Queen-এর অভিনয় এ চবির একটি উল্লেখযোগ্য দিক। Van Gogh-এর সাঁইত্রিশ বছরের জীবনের অনেকটাই ধরা হয়েছিল এই ছবিতে।
Atlantic-এর অন্য পারে, ইউরোপে এই সময়ের একটু আগে থেকেই শুরু হয়েছিল চিত্রকলাকে বিষয় করে তথ্যচিত্র নির্মাণ। উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে আছে Alain Resnais ও Luciano Emmer-এর তোলা তথ্যচিত্রগুলি। ১৯৪৭ সালে পঁচিশ বছরের তরুণ Resnais ছটি তথ্যচিত্র বানিয়ে ফেলেন তাঁর প্রিয় চিত্রকারদের নিয়ে। এর সবগুলোই ছিল ১৬মিমি ফিল্মে তোলা। এইসব কাজে মোটামুটি হাত পাকানোর Resnais তাঁর প্রথম বড় বিষয় Van Gogh-এর উপর কাজ শুরু করেন। নানা পুরস্কারে ভূষিত এই চিত্রটিকে অবশ্য ‘তথ্যচিত্র’ বলা যায় কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। Resnais-র এ তথ্যচিত্রে Van-Gogh-এর আঁকা ছবি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি ছবি হয়ে না এসে, ভেঙ্গে-চুরে, এডিটিঙ-এর সাহায্যে আগে পরে হয়ে ও নতুন ধরনের ক্যামেরা চালনার সূত্র ধরে যে ভাবে দেখা দিয়েছে, তাতে মূল বিষয়ের প্রায় অনেকটাই বাদ পড়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত যা পাওয়া যায় তা পরিচালকের অত্যন্ত ব্যক্তিগত একটি ছবি যা চলচ্চিত্র ও চিত্রকলা, এই দুই মাধ্যমের মাঝামাঝি কোথাও দাঁড়িয়ে থাকে। সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় এই ছবিটিকে ঘিরে, যার আক্রমণাত্মক দিকটা প্রধানত ছিল চিত্রকর ও চিত্রকলা- রসিকদের দিক থেকে। আত্মপক্ষ সমর্থনে Resnais বলেন, “It concerns itself, in effect, with finding out if painted trees, painted houses, can, in a narrative, thanks to the montage of the cinema, serve to take the place of real objects, and if, in this case, it is possible to substitute for the spectator, and almost without his knowledge, the internal or interior world of an artist, a world such as is revealed by photography.” সমালোচনা অবশ্য থামেনি, বরং ১৯৫০ সালে পিকাসোর Guernica অবলম্বনে ছবি তলার পর আবার নতুন সমালোচনা শুরু হয়। Resnais এবং New Wave-এর অন্যান্য পরিচালকদের গুরু Andre Bazin-কে কলম ধরতে হয় এই বিষয় লেখার জন্যে। “Painting and Cinema” শিরোনামে যে প্রবন্ধটি লেখা হয় তা চলচ্চিত্রে ও চিত্রকলার space’-এর উপলব্ধির তফাৎ থেকে, এবং নানা যুক্তির পর এই সিদ্ধান্তে অবতীর্ণ হন যে চলচ্চিত্রে চিত্রকলার প্রকাশ যেভাবে Resnais বা Emmer করেছেন সেটাই গ্রহণযোগ্য। ‘space’-এর প্রসঙ্গে Bazin-এর বক্তব্য ছিল এই যে চিত্রকলায় ‘space’ হয় অন্তর্গামী। চিত্রকলা বহির্জগতকে নকল করার চেষ্টা করে না এবং তার বিষয়ের গভীরতা প্রকাশ পায় একান্তভাবেই তার ফ্রেম-এর বাঁধনে। ফ্রেম-কে Basin তুলনা করেছেন নাটকের জোরালো আলো বা আঁকা দৃশ্যাবলীর সঙ্গে যা দর্শকদের সচেতন করে দেয় বাস্তবের সঙ্গে নাটকে দেখানো দৃশ্যের তফাতকে। অর্থাৎ ফ্রেম শুধুমাত্রই ছবিকে ঘিরে রাখে না, তার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবের সাথে ছবির তফাতটাকেও ফুটিয়ে দেয় দর্শকদের চোখে। উল্টোদিকে চলচ্চিত্রের ‘space’ Bazin-এর মতে বহির্গামী। তা কখনই পর্দার বাঁধনে আটকে থাকে না। ছবি দেখানোর সময়ও সে চেষ্টা হয় না এবং দর্শক সচেতন থাকেন যে তিনি যা দেখছেন তা বাস্তবের খন্ডচিত্র মাত্র। সুতরাং চলচ্চিত্রে চিত্রকলার উপস্থাপনা ঘটলে চিত্রকলার নিজস্ও অন্তর্গামী ‘space’ নষ্ট হয়ে যেতে বাধ্য এবং তা পাবে নতুন একটি বহির্গামী রূপ। Bazin-এর মতে, এই পরিবর্ত্তনতা যদি আমরা মেনে নিতে পারি তাহলে Resnais বা Emmer-এর চলচ্চিত্রগুলোকে তাদের অন্যান্য পরীক্ষা নিরীক্ষা সমেত, নতুন ধরণের সৃষ্টি হিসেবে মেনে নেওয়া একেবারেই কঠিন নয়। এ পর্যন্ত বুঝতে বা মেনে নিতে হয়ত আমাদের অসুবিধা হবে না এবং এদিক থেকে দেখলে হয়ত Resnais-র ক্যামেরার Van Gogh-এর ছবির উপর স্বচ্ছন্দে আগে পরে চলাফেরা (যেন Van Gogh-এর পুরো সৃষ্টি একটাই ছবি) খানিকটা যুক্তিগ্রাহ্য মনে হবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠবেই যে মূল বিষয়ের কতটা বজায় তজাকছে এই ধরণের ছবিতে। এ প্রশ্ন আরো উঠবে কেননা Basin তাঁর লেখায় তুলনা টেনেছেন এই ধরনের ছবির সঙ্গে সাধারণ তথ্যচিত্রের। গল্প- উপন্যাসের থেকে সার্থক চলচ্চিত্রায়নের সময় যে সম্পর্ক মূলের সঙ্গে থাকে ঠিক ততটা কি থাকছে এই ধরনের চলচ্চিত্রে? Resnais-র Van Gogh, Gaugin ও Guernica ছাড়াও Emmer-এর Goya এ ধরণের ছবির উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। তুলনায় অনেকটাই তথ্যচিত্রের মেনে নেওয়া নিয়মের পথে হাঁটেন Henri Storck- Paul Haeserts তাঁদের Rubens-এর উপর তোলা তথ্যচিত্রে। ১৯৫০ সালে তোলা The Titan আরো একটি উল্লেখযোগ্য চিত্রকলা- বিষয়ক চলচ্চিত্র। এর মূল বিষয় ছিল Michelangelo-র ছবি। পরিচালক কোনো চরিত্রের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে পাশাপাশি সেগুলিকে রেখে চিত্রকরের ছবির সূত্রগুলিকে ধরার চেষ্টা করেন। এই প্রচেষ্টাকেই আরো অনেক গভীরে নিয়ে যান Henri Georges Clouzot তাঁর ১৯৫৬ সালে তোলা Mystery of Picasso ছবিতে স্বয়ং চিত্রকরকে, তাঁর জীবন ও কাজে নিমগ্ন দৃশ্যগুলিকে সমেত ফিল্মে বন্দী করে।
ভারতবর্ষে চিত্রকলা বিষয়ক উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের সংখ্যা কম। চিত্রকলার প্রভাব ভারতীয় চলচ্চিত্রে কতটা এ বিষয়ে অবশ্য আলোচনার অবকাশ আছে। চরিত্র রূপায়ণে রবিবর্মার আঁকার প্রভাব সুস্পষ্ট ভারতীয় চলচ্চিত্রে, অন্তত পৌরাণিক কাহিনীভিত্তিক চলচ্চিত্রে তো বটেই। হয়ত সামাজিক বাধার কারণেই পুরানো যুগের ভারতীয় চিত্রকলার চরিত্ররূপায়ণের পথে না গিয়ে নির্মাতারা রবিবর্মার পথে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। হিন্দী ছবির বহু নাচ-গানের দৃশ্যরচনাতেই রাজপুত মিনিয়েচার ও আধুনিক ক্যালেন্ডারের পাতার পৌরাণিক ছবির মাঝামাঝি একটা জায়গায় অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। এ বিষয়ে স্বতন্ত্র আলোচনার পথ ছেড়ে দিয়ে আমরা বরং চলচ্চিত্রের বিষয় হিসেবে চিত্রকলার উপস্থিতির দিকটা দেখি। এই ধারার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছবি সত্যজিতের Inner Eye আমাদের পরবর্তী আলোচনার বিষয়।
সত্যজিতের Inner Eye উচ্চমানের এবং সত্যজিতের অন্যান্য তথ্যচিত্রের থেকে বেশী পরিণত বলে মনে হয়। ‘রবীন্দ্রনাথ’ বা ‘সুকুমার’এ যা তিনি পাননি এবং এ ক্ষেত্রে পেয়েছিলেন তা হল স্বয়ং বিষয়কে নিজের ক্যামেরার সামনে। বলাই বাহুল্য তিনি পূর্ণমাত্রায় তার সদ্ব্যবহার করেছেন। তথ্যচিত্রে আসল পাত্রপাত্রীদের দিয়ে অভিনয় করানোর ব্যাপারেও তাঁর যে আপত্তির কথা তিনি অন্যত্র জানিয়েছেন তাও এখানে খাটেনা কারণ বিনোদবিহারী নিজের অংশগুলিকে অসাধারণ বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। ছবির মূল উদ্দেশ্য, তাঁর Inner Eye-কে পর্দায় ফুটিয়ে তোলার অনেকটাই এই দৃশ্যগুলির জোরের উপর দাঁড়িয়ে।
১৯৫৭ সালে চুয়ান্ন বছর বয়েসে শিল্পী বিনোদবিহারী তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারান। তাঁর সৃষ্টি সেখানেই থেমে যায়নি। কিছু পরিবর্ত্তন হবারই ছিলো যেমন রং বা কারিগরী নৈপুণ্যের ক্ষেত্রে। কিন্তু যা তিনি হারাননি তা হল একজন শিল্পীর অর্ন্তদৃষ্টি বা Inner Eye. Andrew Robinson-এর কাছে বিনোদবিহারীর ছাত্র K G Subramanyam এই বিষয়ে বলছেন: “There was not a trace of self-pity in his attitude; he took it as easily as if it were a passage from one room to another.” বিনোদবিহারীর শিল্পসৃষ্টিতেই এর প্রমাণ আছে। আঁকা ও কোলাজ তৈরী করা থেকে তিনি ক্রমশ সরে গেছেন আরো form বা আকার সংক্রান্ত কাজের দিকে। দৈনন্দিন জীবন থেকে উঠে আসা চরিত্ররা বিশেষ বিশেষ আকার পেয়েছে তাঁর কাজে এবং সেই সব form কে পাশপাশি রেখে তার থেকে জাত পারস্পরিক tension এই শিল্প খুঁজে পেয়েছেন তাঁরব প্রিয় বিষয়ে। সত্যজিৎ যে সময় তাঁর ছবি তোলেন তখন বড় ধরনের এরকম একটা ম্যুরাল গড়ে তুলছিলেন বিনোদবিহারী। তথ্যচিত্র শুরু হয়েছে এই ম্যুরালটির গড়ে ওঠার কাহিনী দিয়েই। এখানে তুলনা চলে আসতে পারে ‘রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্রটির সঙ্গে। সেখানেও এরকম শেষ থেকে শুরুর ব্যাপারটা এখতে পাওয়া যায়। Inner Eye-এর ক্ষেত্রে এই বিশেষ রীতি আরো সূক্ষ্মভাবে কাজ করেছে বলে মনে হয়। ছবিকে ধারাবাহিক জীবনবিবরণ থেকে আরো আকর্ষণীয় স্তরে নিয়ে যাওয়া ছাড়াও ছবির বিষয়ের সঙ্গে দর্শকদের প্রাথমিক পরিচয়টা সূক্ষ্মভাবে ঘটিয়ে দেওয়ার কাজও করেছে এই দৃশ্য। একই সূত্রে আমরা পাই শিল্পীর আড়ম্বরহীন জীবনের একটুকর পরিচয়। ছবির সবচেয়ে চলচ্চিত্রগুণসম্পন্ন অংশগুলো সম্ভবত এইসব দৃশ্যে ফুটে উঠেছে। পরিচারিকা গল্প পড়ে শোনানো থেকে শিল্পীর চা ঢেলে খাওয়া, চা ঢালার “জীবন্ত” আওয়াজ, সব কিছু বাকি ছবিটার জন্যে এক অসাধারণ পরিবেশ গড়ে তুলেছে।
এর পরের দৃশ্যে খুব ছোট অংশে আমরা জানতে পারি বিনোদবিহারীর প্রাথমিক জীবনকাহিনী, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য তথ্য আঁকার ক্ষেত্রে তাঁর পারিবারিক প্রভাব। আরো জানতে পারি যে তিনি জন্মসূত্রেই একটি চোখ হারিয়েছিলেন। সংক্ষিপ্ত এই দৃশ্যটি শষ হয় শান্তিনিকেতনের কলাভবনে বিনোদবিহারীর আগমনের ঠিক পরে। নন্দলাল বসুর পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর শিক্ষক রূপে এবং শিল্পী হিসেবে তিনি যে ভিন্ন পথ বেছে নেন তা জানিয়ে ছবির এই ভাগ শেষ হয়। শেষ কাজটি সত্যজিৎ সেরেছেন নন্দলালকে ঘিরে ছাত্রদের একটি ছবির মধ্যে বিনোদবিহারীকে ছাড়া বাকিদের “black-out” করে দিয়ে। এইভাবে পরিচালক শুধু শিপী বিনোদবিহারীর উপরে দর্শকদের আকর্ষণই ফিরিয়ে আনেননা, তার সঙ্গে তাঁর “শিল্পের ক্ষেত্রে এককীত্ব”টাকেও পরিষ্কার করে দেন। শুধু প্রথমটা করার প্রয়োজন হলে হয়ত পরিচালক “zoom in” করেই তাঁর উদ্দেশ্যসাধন করতে পারতেন।
ছবির পরের ভাগে আমরা মূলত: বিনোদবিহারীর শিল্পসৃষ্টির মধ্যে দিয়ে এগোই। শিল্প সম্বন্ধে পরিচালক মন্তব্য করেছেন কম, বেশিরভাগ সময় সেই সব পরিবেশগুলির প্রতি দিক্নির্দেশ করেছেন যা শিল্পির প্রেরণা হয়ে কাজ করেছে। ছবির এই অংশটিতেই জানতে পারা যায় যে বিনোদবিহারী তাঁর সমকালীন বেশিরভাগ শিল্পীর মতো পুরাণ ও মহাকাব্য’কে ছবির বিষয় করাতে আগ্রহী ছিলেন না, বরং তাঁকে বেশী টানতো প্রকৃতি ও সাধারণ মানুষ। এই তথ্যের সঙ্গে আসা শান্তিনিকেতনের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিষয়ক শিল্পীর একটি সুন্দর composition এর উপর সত্যজিতের ক্যামেরা অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে তুলির মতো প্যান করেছে। আবহে লোকসঙ্গীতের সঙ্গে পরের দৃশ্যে দেখা যায় শান্তিনিকেতনের গ্রামের মানুষ, জীবজন্তু ও পল্লীপ্রকৃতি। বিনোদবিহারীর আঁকা ও ছবিতে আলোচিত তিনটি বিখ্যাত ফ্রেস্কোর প্রথমটার প্রতি দিক্নির্দেশ করে এই দৃশ্য। এই ফ্রেস্কোর কেন্দ্রে আছে একটি পুকুর যা পল্লীগ্রামের জীবনকেন্দ্র-স্বরূপ। এরই চারধারে গড়ে উঠেছে বিনোদবিহারীর চোখে দেখা পল্লীবাংলার রূপ। পুরোটা continuous একটাই দৃশ্য নয়, খন্ড খন্ড দৃশ্যাবলী জুড়ে শিল্পী গড়ে তুলেছেন তাঁর ছবি। সত্যজিতের ক্যামেরাও এগিয়েছে এই রীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে। আগের ছবিটির মতো ক্যামেরা এখানে প্যান করে না। পুকুরকে কেন্দ্রে রেখে zoom-out করে আসে ক্যামেরা, তারপর বিচ্ছিন্ন শটে ধরা পড়তে থাকে বিনোদবিহারীর ছবির নানাবিষয়। পুরো দৃশ্যটিকে গ্রন্থনা করতে সত্যজিতের ভাষ্যপাঠ ও আবহসঙ্গীত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়।
অন্য একটি ফ্রেস্কো দেখানোর সময় সত্যজিৎ বিনোদবিহারীর নিজের গলা বযবহার করেছেন। ভারতের মধ্যযুগের সধুসন্তদের বিষয় করে আঁকা এই ফ্রেস্কোটি সত্যজিতের মতে সমকালীন ভারতের শিল্পক্ষেত্রে মহত্তম সৃষ্টি। এটির উপস্থাপনা করফতে গিয়ে পরিচালক আমাদের পরিচয় করিয়েছেন বিনোদবিহারীর প্রাথমিক স্কেচগুলির সঙ্গে। ফ্রেস্কোর সধুসন্তদের সার্বজনীন চিন্তাধারা ও ভালোবাসার আদর্শ সম্বন্ধেও আভাস দিয়েছেন। সঙ্গে বিনোদবিহারীর নিজের গলায় আমাদের জানান কিভাবে এইসব সাধুসন্তরা সময়ের বাধা পেরিয়ে তাঁর ছবিতে একইসঙ্গে পাশাপাশি ফুটে উঠেছে।
বেনারসের ঘাটের দৃশ্যের সঙ্গে সত্যজিতের চলচ্চিত্র ওতপ্রোতভাবে জরিত। Inner Eye-তে বেনারস ফিরে এসেছে বিনোদবিহারীর ছবির সূত্র ধরে। সত্যজিৎ ক্যামেরায় তলা দৃশ্য ও শিল্পীর ছবি পাশাপাশি রেখেছেন। এ ক্ষেত্রে পরিচালকের অসাধারণ কম্পোজিশনের গুণ লক্ষনীয়। ঘাটের শটগুলি শুধু কম্পোজিশনের গুনেই আঁকা ছবির মতো হয়ে উঠেছে। সমতুল্য কনো শট কিন্তু দেখা যায় না বিনোদবিহারীর আঁকা হিমালয়ের উপর চিত্রগুলি দেখানোর সময়, যদিও সে সুযোগ ছিল বলেই মনে হয়। তথ্যচিত্রের মধ্যভাগ শিল্পির জীবনের এই হিমালয় পর্যায়ে এসে শেষ হয়েছে। ঠিক এর পরেই বিনোদবিহারী তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারান। হিমালয়ের চিত্রগুলির mystic, আবছা গুণের সঙ্গে হয়ত এর সম্পর্ক আছে। দৃষ্টি হারানোর বিষয়টি পরিচালক খুবই মর্মস্পর্শী ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।শিল্পীর ছবিগুলিকে তিনি সাজিয়ে নিয়েছেন তাদের ঔজ্জ্বল্য অন্যযায়ী। ক্রমশ: আরো ভারী ও গাঢ় জয়ে আসে ছবিগুলি ও শেষমুহূর্তে একটুকরো আলো ঝলসে উঠে পর্দায় অন্ধকার নেমে আসে। একচিলতে আলো ফুটে ওঠে এই অন্ধকারের মধ্যে, ক্যামেরা zoom-out করতে বোঝা যায় তা হোলো বিনোদবিহারীর কালো চশমার উপর আলোর প্রতিফলন। অসাধারণ কাব্যময় এই দৃশ্যটির গভীর ব্যঞ্জনার রেশটুকু ধরে পরিচালক শিল্পীর জীবনের তৃতীয় ও শেষ ভাগে প্রবেশ করেন। এই পর্যায়ে আমরা দেখতে পাই শিল্পী বিনোদবিহারীকে- তাঁর সৃষ্টিতে নিমগ্ন। স্কেচ, কোলাজ, ম্যুরাল, প্রভৃতি এই সময় করা তাঁর নানান কাজ একে একে পর্দায় আসে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে। সদাব্যস্ত এক সৃষ্টিশীল শিল্পীর পরিচয় ধরতে বিশেষ সাহায্য করেছে এই দৃশ্য। আবহে সত্যজিৎ ব্যবহার করেছেন সেতার- নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাজানো আশাবরী। সত্যজিতের মতে “The raga that comes after the blindness is Asavari. A morning raga. Very few morning ragas are optimistic in character because there is something wistful about dawn.” এই দৃশ্যায়ণেরে সঙ্গেও “রবীন্দ্রনাথ” তথ্যচিত্রের মিল লক্ষণীয়। সেখানে “মোর বীণা ওঠে”, গানের যন্ত্রে তোলা সুরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নানান দৃশ্যের এরকমই একটি কোলাজ-সুলভ দৃশ্য ছিল। সৃষ্টিশীল শিল্পীর কাজের নানান দিক ধরতে এই চিত্রগ্রহণ রীতি বেশ আকর্ষণীয়।
Inner Eye শেষ হয়েছে বিনোদবিহারীর একটি close-up শট দিয়ে- শিল্পী নিজের কাজে নিমগ্ন, পর্দায় ফুটে ওঠে অন্ধত্ব সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা:
Blindness is
A new feeling
A new experience
A new state of being
দেখাই যাচ্ছে যে তথ্যচিত্র তৈরী করার সময় সত্যজিৎ পুরোপুরি একনিষ্ঠ থেকেছেন তাঁর বিষয়ের প্রতি এবং কখনই বিষয়কে অতিক্রম করে নতুন কিছু করার চেষ্টা করেননি যেমন দেখা যাচ্ছে Resnais-এর Van Gogh চিত্রটির ক্ষেত্রে। আঁকা ছবিকে ভেঙ্গেচুরে দেখার মধ্যে নতুন কিছু পাওয়ার আশা আছে ঠিকই, হয়ত বা নতুন তথ্যও বেরিয়ে আসতে পারে শিল্পর সম্বন্ধে তার থেকে, তবে এ প্রচেষ্টাতে নি:সন্দেহে ঝুঁকি প্রচুর এবং প্রতিমুহূর্তেই মূল বিষয় থেকে সরে আসার আশঙ্কা থেকে যায়। তথ্যচিত্রের আসল উদ্দেশ্য যদি হয় শিল্পসম্মত উপায়ে তথ্যের আহরণ ও তার গ্রন্থনা তাহলে সত্যজিতের Inner Eye যে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটি সৃষ্টি তাতে সন্দেহ নেই। ভারতবর্ষে এ ধরণের কাজ বোধহয় খুবই কম হয়েছে। পূর্ণেন্দু পাত্রাইড় “অবনীন্দ্রনাথ” ও খুব আধুনিক কালে ঋতবান ঘটকের তোলা শিল্পী K G Subramanyam-এর উপরে একটি তথ্যচিত্র ছাড়া আর কিছু মনে পড়ছে না। যে কোনো সৃষ্টিশীল পরিচালকের কাছেই চিত্রকলার মাধ্যমকে ধরে রাখার এই সুযোগ নিশ্চয়ই খুব আকর্ষণীয় এবং আশা করা যায় ভারতে এরকম তথ্যচিত্র হয়ত আরো তৈরী হবে। তার সঙ্গে আমরা কি আশা করতে পারিনা কোনো চিত্রশিল্পীর জীবন ও সৃষ্টির একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্ররূপ?
তথ্যসূত্র:
১) Film and the Arts is Symtiosis, A Resource Guide, Ed. Gary R. Edgerton, Green wood, NY
২) Satyajit Ray: The Inner Eye, Andrew Robinson; Univ. Of California Press, Berkeley and Los Angeles.
৩) বিষয় চলচ্চিত্র, সত্যজিৎ রায়, আনন্দ, কলকাতা
৪) What is Cinema (1) Andre Bazin, Univ. Of California Press, Berkeley and Los Angeles.