• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৫ | জানুয়ারি ২০২২ | প্রবন্ধ
    Share
  • ইতিহাসের আগের যুগে ভারতে শিল্পচর্চা : শ্রীতমা মাইতি



    মহেঞ্জোদাড়োর নর্তকী


    ২০২১ সালকে রাষ্ট্রপুঞ্জ সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তির বছর হিসেবে পালন করছে। আর এই অতিমারিতে সৃজনশীল কাজকর্মগুলো যে বিশ্বব্যাপী ঝড়ের মুখে পড়া অর্থনীতিকে খানিকটা হলেও আশার আলো দেখাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। সত্যিই তো করোনার আক্রমণে বাড়িতে বসে আমরা অনেকেই নিজেদের সৃজনশীল প্রতিভাকে নতুন করে আবিষ্কার করেছি, আর শিল্পচর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন নতুন সৃষ্টি করবার চেষ্টাও করছি—এ বিষয়ে নতুন করে কিছু বলবার নেই। এখন এই যে মানুষের এই সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা, মনের ইচ্ছেকে, কল্পনাকে নতুন রূপ দেবার আকাঙ্ক্ষা--এর গোড়ার কথা খুঁজতে গেলে আমাদের অবশ্যই যেতে হয় ইতিহাসের আগের যুগে, অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক, মানে যে যুগে মানুষ লিখতে শেখেনি এবং প্রায়-ঐতিহাসিক, মানে যখন লিপির ব্যবহার শুরু হলেও আমরা এখনও তার পাঠোদ্ধার করতে পারিনি (যার মধ্যে পড়ে হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়ো), সেই যুগে। এই সময়ের শিল্পী গুহার দেওয়ালে, মাটির পাত্রে, সিলমোহরে বা খেলনায়, মূর্তিতে যেসব ছবি এঁকেছিলেন বা ভাস্কর্য গড়েছিলেন, তার প্রকাশশৈলী, শিল্পগুণ ও বাঙ্ময়তা আধুনিক দর্শককে অবশ্যই আশ্চর্য করে, এবং আধুনিক শিল্পীকে অনুপ্রাণিতও করে। ইতিহাস বইতে আমরা পড়ি, প্রাগৈতিহাসিক যুগের এসমস্ত নিদর্শন থেকে আমরা সেসময়ের অর্থনৈতিক জীবনযাপন, ধর্মীয় চেতনা ইত্যাদির আভাস পাই। সে তো অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ, পাশাপাশি শিল্পের চোখ দিয়েও এসব নিদর্শনের অশেষ মূল্য, যার আলোচনা জরুরি।

    ভারতে প্রথম গুহাচিত্রের আবিষ্কার হয়েছিল স্পেনের আলতামিরা গুহাচিত্র আবিষ্কারেরও কিছু আগে, ১৮৬৭ সাল নাগাদ। আবিষ্কার করেছিলেন ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক আর্চিবল্ড কার্লাইল, যিনি আলেকজান্ডার কানিংহামের সহকারী হিসেবে আগ্রা অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁজের দায়িত্বে ছিলেন। উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুরের কাছে সোহাগিঘাট অঞ্চলে বিন্ধ্যপর্বতমালার মধ্যে তিনি কিছু গুহাচিত্র খুঁজে পেয়েছিলেন। এখন একে মোটামুটি মধ্যপ্রস্তর থেকে তাম্রপ্রস্তর যুগের মধ্যেকার সময়ের বলে ধরা হয়। তিনি কিছু নোট রেখে যান, যা পরে বিখ্যাত ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ প্রচারের আলোয় নিয়ে আসেন। তাঁর নোটেও তিনি লাল গেরিমাটি দিয়ে আঁকা ছবির উল্লেখ করেছিলেন। এই গুহাগুলোর কাছে লাল লোহাপাথর বা হেমাটাইটের চাঙড় দেখা যায়। এই পাথর থেকেই ঘষে ঘষে লালচে বা খয়েরি রঙের গুঁড়ো বের করা হত, সেই গুঁড়ো থেকে রঙ তৈরির জন্য শিলনোড়াও পাওয়া গেছে সেখানে। বেশিরভাগই শিকারের ছবি, জন্তুজানোয়ার ছুটে যাচ্ছে--গন্ডার, সাম্ভার, বড়ো সিংওয়ালা হরিণ, এসবের ছবি দেখা যায়। প্রাচীন শিল্পী যে স্বতঃস্ফূর্ত গতিময়তার প্রকাশ এসব ছবিতে করেছেন, তা সত্যিই অবাক করার মতো!


    ভীমবেটকার গুহাচিত্র



    গুহাচিত্রের কথা বললে ভারতের সবথেকে পুরনো গুহাচিত্র পাওয়া গেছে যেখানে, সেই ভীমবেটকার কথা না বললেই নয়। ১৯৫৭ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক বিষ্ণু ওয়াকাঙ্করের নেতৃত্বে এক প্রত্নতাত্ত্বিক দল মধ্যপ্রদেশের রাইসেন জেলার বিন্ধ্যপর্বতের দক্ষিণে অবস্থিত এই গুহাশ্রয়ের কথা প্রথম জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। ভীমবেটকায় সাতশোটিরও বেশি গুহাশ্রয় জুড়ে ছবি রয়েছে, যেমন ইতিহাসের আগের যুগের ছবি, তেমনি ইতিহাসের পরের যুগের ছবিও রয়েছে। সবচেয়ে পুরনো ছবিগুলি Upper Paleolithic বা উচ্চ-পুরাপ্রস্তর যুগের (আনুঃ ৪০,০০০ – ৮,০০০ খ্রি.পূ.)। ছবিতে সবুজ ও গাঢ় লাল বা খয়েরি রঙের ব্যবহার দেখা যায়। বাঘ, গণ্ডার, বাইসনের মতো পশুর ছবি আঁকা হয়েছে নিপুণ ও বলিষ্ঠ রেখার প্রয়োগে। এরপর মধ্যপ্রস্তর যুগের (আনুঃ ৯,০০০ – ৪,০০০ খ্রি.পূ.) ছবিও পাওয়া গেছে বেশ কিছু। মধ্যপ্রস্তর যুগে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র হাতিয়ার ব্যবহার করতে শিখেছিল মানুষ, একে তাই ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগও বলে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই পর্বের ছবিগুলিতে ধারালো বর্শা, তীর-ধনুক হাতে নিয়ে দাঁড়ানো মানুষের ছবি পাওয়া যায়। তাম্রপ্রস্তর পর্বেরও (আনুঃ ২,০০০ – ৭০০ খ্রি.পূ.) বেশ কিছু ছবি পাওয়া যায়। বাঘ, হাতি, ভালুক, হরিণ ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখির ছবিরও অভাব নেই। সেযুগের জীববৈচিত্রের এক ধারণা দেয় এই ছবিগুলি। মানুষের ছবিও অনেক; মানুষ কখনও নিরাবরণ ও নিরাভরণ, কখনও বা পোশাক ও অলঙ্কারে সুসজ্জিত। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ছবি, মৃত শিশুসন্তানকে কবর দেওয়া হচ্ছে, পাশে শোকার্ত মাতাপিতার বিলাপের দৃশ্যও চিত্রায়িত হয়েছে। বিমূর্ত ভাবনাকেও কিছু ক্ষেত্রে প্রকাশ করেছেন শিল্পী যার প্রকৃত মর্ম বোঝা এখনও সম্ভব হয়নি। বলা বাহুল্য, মাটি ও পাথরের আকরকে গুঁড়ো করে ছবিতে রঙের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। লাল রঙের জন্য গেরিমাটি, সাদা রঙের জন্য চুনাপাথর, সবুজ রঙের পাথর গুঁড়িয়ে সবুজ রং তৈরি হয়েছিল প্রাচীন শিল্পীর স্টুডিয়োয়। মনে করা হয়, ভীমবেটকার শিল্পীই পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম Engraving বা খোদাই করে ছবি এঁকেছিলেন, যার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ও ফ্রান্সের Lascaux গুহাচিত্রের খানিক সাদৃশ্য আছে। প্রকৃতি ও মানবসমাজ মিশে মানবসভ্যতার প্রথম যুগে যে দৈনন্দিন ও সামাজিক জীবনের সৃষ্টি হয়েছিল, শিল্পী তাকে ছবিগুলির মধ্যে গভীর অনুরাগে, বলিষ্ঠ রেখা, গতি ও বেগের দ্যোতনা সৃষ্টি করে প্রকাশ করেছেন।


    পাঁচমারীর গুহাচিত্র (শিল্পীঃ লেখক)



    ভারতীয় উপমহাদেশের ঠিক মাঝখানে, সাতপুরা পর্বতমালার মধ্যে মধ্যপ্রদেশের এক অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা পাহাড়ি শহর পাঁচমারী। জি. আর. হান্টারের উদ্যোগে ১৯৩৫ সালের প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে মধ্যপ্রস্তর পর্বের বেশ কিছু গুহাচিত্র আবিষ্কার হয়েছিল। গত শতাব্দীতে প্রত্নতাত্ত্বিক মীনাক্ষী পাঠক স্থানীয় বাসিন্দাদের সাহায্যে ১৫টি নতুন গুহা আবিষ্কার করেন। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির, বিশেষ করে মানুষ ও পশুর মধ্যে সম্পর্ক--পাঁচমারীর ছবিগুলির এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বাভাবিকভাবেই শিকারের দৃশ্য অনেক। ষাঁড়, বুনো মহিষ, হাতি, বাঘ, হরিণ, বানর, কুমিরের মতো বড়ো বড়ো যেমনি, তেমনি ইঁদুর, গিরগিটি, কচ্ছপের মতো ছোটো ছোটো প্রাণী, আবার উটপাখি, ময়ূরের মতো পাখির ছবিও রয়েছে এখানে। প্রায় ষোলোটির মতো রঙের ব্যবহার হয়েছে, তার মধ্যে লাল আর সাদা রঙের প্রাধান্যই বেশি। এখানে মধ্যপ্রস্তর পর্বের শিল্পীর নান্দনিকতাবোধ যে কেমন উচ্চপর্যায়ে পৌঁছেছিল, তা ছবির সুসামঞ্জস্য ও রঙের অপূর্ব ব্যবহার দেখলেই বোঝা যায়। শিল্পী বহু সময়ে জ্যামিতিক নকশা এঁকেছেন, এমনকী X-ray রীতিতেও ছবি এঁকেছেন (অর্থাৎ প্রাণীর বাহ্যিক দেহগঠন আঁকবার পর শরীরের অভ্যন্তরীণ গঠনের অঙ্কন করা)। সন্তানসম্ভবা গাভীর ছবি পাওয়া যায়, যার মধ্যে অজাত শাবকটিরও ছবি আঁকা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ছবি যা এখানে পাওয়া যায়, তা হল ‘Head Hunting’-এর ছবি। অর্থাৎ একজন মানুষ আরেকজনের কাটা মাথা নিয়ে দৌড়ে আসছে, তার গতির বিপরীত দিকে নিজের মাথাটি ঘোরানো, দেখলে অনেকটা মনে হয় যেন পিছনে কেউ তাড়া করছে। ছুটে আসা ব্যক্তির মাথায় মুকুটের মতো কিছু পরা। আদিম বর্বরতার এই ছবি দেখে ধারণা হয়, বুঝি বা এতে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ছবি তুলে ধরা হয়েছে, কিংবা অনেকে ভাবেন ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গেও হয়তো বা এর যোগ থাকতে পারে, কিংবা হয়তো দুটোই। পাঁচমারীতে মুগ্ধ করবার মতো এক ছবি হল সাদা খনিজ রঙ ব্যবহার করে আঁকা নৃত্যরত মানুষের ছবি, তাদের দেহভঙ্গিমা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শিল্পী এমন নিপুণ ও সাহসী হাতে এঁকেছেন, যে আপনা থেকেই প্রশংসা না করে উপায় নেই।

    ভারতের প্রায় সব রাজ্যেই গুহাচিত্র পাওয়া যায়। তবে মধ্য ভারতে, বিশেষ করে সাতপুরা, বিন্ধ্য ও কাইমুরে পাওয়া গেছে সবচেয়ে বেশি। আসলে, ঘন বন, জলের ও খাদ্যের সুবিধা আর অসংখ্য গুহাশ্রয় মানুষকে এখানে থাকতে উৎসাহিত করেছিল সন্দেহ নেই। আরো কিছু গুহাচিত্রের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন--উড়িষ্যার সুন্দরগড় জেলার মানিকমুন্ডা গুহাশ্রয়ে লোহাপাথরে বা এজাতীয় আকর গুঁড়িয়ে তাদের রঙে চর্বি বা প্রাণীদের তেল দিয়ে গুহার গায়ে আঁকা ছবি। এর মধ্যে বেশিরভাগই শিকারের দৃশ্য। মধ্যপ্রদেশের রায়গড় জেলার সিংহনপুরে গুহার দেওয়ালে বেলে পাথরের গায়ে লাল রঙে আঁকা প্রাচীন কিছু ছবি রয়েছে; প্রাগৈতিহাসিক যুগের অতিকায় জন্তু, কর্মব্যস্ততায় মুখর মানুষ ছবির বিষয়বস্তু। এখানে বাইসন শিকারের একটি ছবি রয়েছে, উলটো দিকের দেয়ালে বুনো মোষ শিকারেরও একটি ছবি আছে। প্রাণীগুলির মৃত্যুযন্ত্রণা আর শিকারীদের উল্লাস স্বল্প রেখার মধ্যেও স্পষ্টভাবে প্রকাশিত। এছাড়া কর্ণাটকের গুলবর্গা, মধ্যপ্রদেশের আদমগড়, হোসেঙ্গাবাদ, উড়িষ্যার সম্বলপুর, রাজস্থানের বিরাটনগরের কাছে আরাবল্লী পাহাড়েও কিছু গুহাচিত্র পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে দেখা যায়, প্রাগৈতিহাসিক শিল্পী বাস্তবতাকে অনুসরণ করলেও সম্পূর্ণভাবে করেননি, বিভিন্ন সময়ে বিমূর্তের দিকে ঝুঁকেছেন। আঁকার মধ্যে আদিম বলিষ্ঠতা ও ঋজুতা ছিল প্রবল। প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক, মনের আবেগ অনুভূতিকে ছবিতে রূপ দেবার তীব্র ইচ্ছা প্রাগৈতিহাসিক এসব পাহাড়-চিত্রের মধ্যে খুবই স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

    শিল্পবোধের, শিল্পচর্চার এই ধারা এভাবেই এসে পৌঁছোয় পশ্চিমে জোব ও পূর্বে সিন্ধু নদীর মধ্যবর্তী আধুনিক বালুচিস্তান ও সিন্ধু অঞ্চলে, যেখানে রাণাঘুন্ডাই, কোয়েটা, আমরি, নান্দারা, নাল বা কুল্লী-তে খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৩০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ পর্যন্ত সময়কালে বেশ ঘন বসতি গড়ে উঠেছিল। ১৯২২ সালে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯২৫ সালে হারগ্রীভস, ১৯২৬-২৮ সালের মধ্যে স্যর অরেলস্টাইন ও ননীগোপাল মজুমদারের প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য ও গবেষণা এ অঞ্চলে গড়ে ওঠা সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রথম ধারণা দেয়। এখান থেকে পাওয়া চিত্রিত মাটির পাত্রগুলির বিষয় ও শৈলীর বৈচিত্র্য অবাক করার মতো, এবং তা শিল্পের সেই প্রবহমানতারই ইঙ্গিত দেয়।


    অলংকৃত পাত্র (নাল)



    রাণাঘুন্ডাইয়ের মাটির পাত্রগুলি চাকে ঘুরিয়ে তৈরি, সুন্দর রং করা। তাদের গোলাপি বা হলুদ বা গাঢ় পোড়ামাটির রঙের গায়ে সাহসী হাতে সুন্দর স্টাইলাইজ করে (অর্থাৎ আকৃতিকে মোটামুটি এক রেখে প্রধান বিশেষত্বটিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফুটিয়ে তোলা) আঁকা ষাঁড় আর সোজাসোজা কালো শিংওয়ালা হরিণের ছবি। ইতিহাসের আগের যুগে শুধু নয়, ইতিহাসের পরের যুগেও এই বৈশিষ্ট্যটি ভারতীয় চিত্রে বহুবার শিল্পী বড়োই যত্নের সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। রাণাঘুন্ডাইতে আরেক ধরনের পাত্র পাওয়া গেছে, যেখানে পাত্রের গা-ও লাল আবার এর উপর নকশাও করা হয়েছে লাল রং দিয়ে। এইরকম একই রঙের উপর একই রং দিয়ে মোনোক্রমিক নকশা এখন আমরা বড়োই পছন্দ করি।

    MET 2003 592 2 O
    অলংকৃত পাত্র (বালুচিস্তান)


    কোয়েটা সংস্কৃতির মাটির পাত্রগুলির জমি বাফ বা হলদেটে রঙের, বেগুনি আভাওলা লালচে খয়েরি বা কালো রঙের কালি দিয়ে এর উপরে নিপুণ, নিশ্চিত হাতে জ্যামিতিক নকশা আঁকা, জীবজন্তুর ছবি নেই। আমরি, নান্দারা বা নাল সংস্কৃতির পাত্রগুলিতে প্রথমে বড়ো তুলি দিয়ে কালো বা ব্রাউন রঙে আঁকা হতো। আমরি আর নান্দারায় লাল দ্বিতীয় রং হিসেবে ব্যবহার হতো, নালে যদিও হলুদ, নীল, সবুজ রঙেরও ব্যবহার হতো। এই পাত্রগুলোয় সরু, মোটা, ঋজু, লীলায়িত বা কুঞ্চিত রেখা ব্যবহার করে এত সুন্দর নকশা ও অলঙ্করণ করা হয়েছে, খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, যার ধারা এখনও আলপনায়, লৌকিক চিত্রে, পোশাকে, গৃহসজ্জায় বহমান। নান্দারা ও নালের পাত্রে স্টাইলাইজড রীতিতে আঁকা জীবজন্তুর সুন্দর ছবি পাওয়া যায়। কুল্লীর পাত্রে উপরে নীচে জ্যামিতিক নকশা বা দুটি মোটা পটির মধ্যে জীবজন্তু গাছপালার নকশা পাত্রের চারদিকে গোল করে ঘুরিয়ে আঁকা। এখানকার সব পাত্রই নরম তুলি দিয়ে কালো রঙে আঁকা। পাত্রের বিস্তৃত বাঁকের জমি ভরাবার জন্য অনেক সময় ডিসটরশন রীতির প্রয়োগ হয়েছে। অর্থাৎ শরীরটা অদ্ভুত লম্বা ও চ্যাপটা করে দেওয়া হয়েছে, যদিও পা, খুর এসব খুবই নিখুঁত করে আঁকা। এসব ছবি ও নকশাগুলিকে ভালো করে দেখলে বোঝা যায়, এখনকার আধুনিক সব জিনিসপত্র--নকশিকাঁথায়, ছাপা কাপড়ে, চীনেমাটির বাসনে এসব প্যাটার্ন আমরা কতোই না দেখতে পাই! আর্টের যে চিরন্তনতা--তা এই সুদূর অতীতের শিল্পকাজ দেখলেই বোঝা যায়।


    সিলমোহর



    শিল্পের এই ধারা এর পর চলে আসে হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োর সংস্কৃতিতে। হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োর নগর পরিকল্পনা, যা আমরা প্রত্যেকেই নির্ঘাত কখনো না কখনো পরীক্ষার খাতায় উত্তর হিসেবে লিখেছি, তাকে আর্টের এক চমৎকার উদাহরণ বললে অত্যুক্তি হয় না। হরপ্পার শিল্পধারার পরিচয় মোটামুটি পোড়ামাটির অজস্র কাজ, চিত্রিত মাটির পাত্র, আশ্চর্য সব ধাতু ও পাথরের মূর্তি ও সিলমোহরের ছবির মধ্য দিয়ে পাওয়া যায়।

    হরপ্পা থেকে পাওয়া মাটির পাত্রের গায়ে লাল জমির উপর কালো রঙে আঁকা ছবিগুলি রাণাঘুন্ডাইয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। জ্যামিতিক জাফরি প্যাটার্নের নকশাও যেমন দেখা যায়, প্রকৃতি থেকে নেওয়া গাছপালা, পশুপাখির সংখ্যাও বেশ। এখানকার পশুপাখির ছবি কুল্লীর কথা মনে করায়, জন্তুদের শরীরগুলো তেমনি চ্যাপটা, লম্বা করে স্টাইলাইজ পদ্ধতিতে আঁকা। তবে বালুচিস্তানের থেকে হরপ্পার ছবিতে ঘন গাছপালা, লতাপাতার পরিমাণ অনেক বেশি। হরপ্পায় পটারির গায়ে মানুষের একটি খুব সুন্দর ছবি আছে, মানুষটি কাঁধে বাঁক ঝুলিয়ে যাচ্ছে। রেখার স্বল্পতা আর শিল্পীর সাহসী হাতের কাজ উল্লেখ করবার মতো।

    হরপ্পা থেকে যে-ক’টি ধাতু ও পাথরের মূর্তি পাওয়া গেছে, তাতে শিল্পীর দক্ষতা দেখলে বিস্ময়ে স্তব্ধ হতে হয়। সবার প্রথমে তো মহেঞ্জোদাড়োর বিখ্যাত নর্তকী (যদিও নর্তকী কি না সে নিয়ে বিতর্ক কম নেই)। প্রায় চার ইঞ্চি লম্বা ব্রোঞ্জের তৈরি এই মূর্তিটি দ্বিভঙ্গ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, তার বাম হাতে প্রায় ২৪-২৫ টি বালা, আর খালি ডান হাতখানি কোমরে রাখা, হাত-পা অস্বাভাবিক রকম দীর্ঘ। গলায় একটি নেকলেস, চুলগুলি ভারি গুছিয়ে বাঁধা। চোখদুটি অর্ধনিমীলিত, মুখটি অল্প একটু উপরে তোলা। মূর্তিটি কীসের প্রতীক, কী কী সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব করে--এ’ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে ভিন্নমতের অভাব নেই। তবে এ কথা কি অস্বীকার করার উপায় আছে যে একজন মানুষ তার সমাজ, সংস্কৃতি বা ধর্মের প্রতিনিধিত্ব তো অবশ্যই করে, কিন্তু সবার আগে সে প্রতিনিধিত্ব করে তার অন্তরের গভীর সত্তাটির? আর এই মানবীমূর্তিটির মধ্যে যে সহজ, স্বাভাবিক আত্মবিশ্বাস, আন্তরিক প্রশান্তি ও সুখে পূর্ণ এক সত্তার ছবি ফুটে উঠেছে--তার জন্য শিল্পীর কাছে মাথা নত না করে উপায় নেই!

    এছাড়া লাল রঙের পাথরে তৈরি একটি পুরুষ মূর্তি, ধূসর রঙের পাথরে তৈরি এক নর্তকের মূর্তি ও মহেঞ্জোদাড়োর চুনা পাথরের পুরুষ মূর্তির কথা উল্লেখ করবার মতো। দেহগঠনের নির্মাণে বা পোশাক ও গহনাপত্র তৈরিতে শিল্পী এক সূক্ষ্ম সৌন্দর্যচেতনার পরিচয় দিয়েছেন। আর স্টেটাইট পাথরে তৈরি দাড়িওলা ‘পুরোহিত-রাজা’র মূর্তিটিও বেশ কৌতূহল জাগানোর মতো (এবং দেশে-বিদেশে তা জাগিয়েছেও)। মূর্তির চোখদুটি অর্ধনিমীলিত, গায়ে চাদর জড়ানো। মূর্তিটির চুল, দাড়ি, পোশাক বা গহনাপত্র তৈরিতে যেভাবে গভীর টানা টানা রেখার প্রয়োগ হয়েছে, তা বেশ আকর্ষণীয়। সিন্ধু উপত্যকায় পোড়ামাটির কাজ অজস্র পাওয়া গেছে । পোড়ামাটি দিয়ে বাঁদর, কাঠবিড়ালী, গরু, ছোট গাড়ি, পশু ও পাখিতে টানা রথ--এরকম নানান খেলনা, জীবজন্তু আর মানুষের মূর্তি তৈরি হতো। মানুষের মূর্তিগুলির গায়ে বিচিত্র অলঙ্কার। বেশ কিছু মাতৃকামূর্তিও পাওয়া গেছে।


    পশুপতি (মহেঞ্জোদাড়ো)



    সিন্ধু উপত্যকা থেকে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার সিলমোহর আবিষ্কার হয়েছে, আরো হবে। বেশিরভাগই পোড়ামাটির তৈরি, কিছু রুপো, তামা, চিনেমাটি ও স্টেটাইট পাথরেও তৈরি হয়েছিল। এগুলো খুবই ছোট, গড় মাপ ২.৫৪ সেন্টিমিটার। এক বিখ্যাত সিলমোহর হল ‘পশুপতি’ বা ‘যোগী’ সিলমোহর, এক ব্যক্তি পশুপরিবৃত হয়ে ধ্যানের ভঙ্গিতে বসে আছেন। অনেকেই একে শিবের আদি রূপ বলে মনে করেন। যোগীর মুখে ধ্যানের গাম্ভীর্য ও প্রশান্তি বেশ সুন্দর হয়ে ফুটে উঠেছে। আরেক বিখ্যাত সিলমোহর হল ‘ইউনিকর্ন’ সিলমোহর (এর ছবি আমরা প্রায় সবাই দেখেছি)। একশৃঙ্গ এই প্রাণীটি যাই হোক না কেন, প্রাণীটির দেহগঠন, পা, খুর আঁকায় শিল্পীর সূক্ষ্ম ও নিপুণ কারুকাজ মুগ্ধ করার মতো। সত্যি বলতে, সব সিলমোহরেই পশুপাখি, গাছপালা প্রতিটি বিষয়ের ডিটেলিং অবাক করার মতো। এই সিলমোহরগুলিতে কিছু লিপিও রয়েছে; যার পাঠোদ্ধারের আশায় আমরা সবাই বসে আছি, তখন নির্ঘাত ‘ইউনিকর্ন’ বা ‘পশুপতি-যোগী’র সম্পর্কে আরো বেশি জানা যাবে।

    সভ্যতার সেই প্রথম যুগে মানুষ কেন ছবি আঁকতে শুরু করেছিল--এই প্রশ্ন নিয়ে বিভিন্ন মতামত, তর্কবিতর্ক রয়েছে। কেউ বলেন ধর্মীয় কারণে, বিশেষ কোনো শক্তিকে তুষ্ট করার জন্য। আবার শিকারে গিয়ে যাতে শিকার সফল হয় সেই উদ্দেশ্যেও এই ছবিগুলি আঁকা বলে কারো কারো ধারণা। এ সম্পর্কে ‘ভারতের চিত্রকলা’ বইতে অশোক মিত্র ভারি সুন্দর একটি কথা বলেছেন, “মানুষের স্বভাবই হচ্ছে আঁকা। সে যেমন আঁকাই হোক, এ স্বভাব যেমন খুব অল্পবয়সে দেখা দেয়, তেমনি অনেক যুগ আগে মানুষের ইতিহাসের শৈশবেও নিশ্চয় এই স্বভাব ছিল”। অর্থাৎ কিনা আঁকার জন্যই আঁকা, সৃষ্টির আনন্দেই সৃষ্টি। আর এই সুপ্রাচীন সৃষ্টিশীলতার মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ফুটে উঠেছে যে অনন্য শিল্পগুণ, তা আধুনিক শিল্পীকে, শিল্পের প্রশংসককে মুগ্ধ করে, অনুপ্রাণিতও করে কম নয়। Picasso, Pierre Soulages-এর মতো শিল্পীরা প্রাগৈতিহাসিক ছবির শিল্পগুণ, এমনকি নিজেদের সৃষ্টিতে তার প্রভাবের কথা মুক্তকন্ঠে স্বীকার করেছেন।

    ভারতের এসব ছবি, নকশাগুলির সঙ্গে অন্যান্য দেশের ইতিহাসের আগের যুগের ছবি, নকশার বেশ খানিক মিল পাওয়া যায়। বোঝা যায়, বিশ্বজনীনতা শুধু আজকের নতুন আদর্শ নয়, বিশ্বজনীনতার ধারা অনেক পুরনো। তবে একটা সুন্দর পার্থক্যও দেখা যায়। আসিরিয়া বা মিশরে যেমন সম্রাট বা রাজারাজড়াই ছবির প্রধান বিষয়, ভারতের ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়। ঘরোয়া কাজে রত নিতান্ত সাধারণ মানুষ; গরু বাঁধছে, মাছ ধরছে, মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে--এসবই ছবির বিষয়, আর সেজন্যই এত সহজে একাত্ম হওয়া যায় এর সঙ্গে।

    ভারতীয় শিল্পে সবসময়েই প্রকাশ পেয়েছে জীবনের সবকিছুর প্রতি শিল্পীর অসীম ভালোবাসা, আবেগ ও আগ্রহ। বিশ্বপ্রকৃতির ছোট বড়ো সমস্তকিছু; গাছপালা, পশুপাখি, ফুলপাতা, মানুষ--সবকিছুর সঙ্গেই শিল্পী একাত্ম হয়েছেন, ভালোবেসেছেন আর তারপর হৃদয়ের অন্তঃস্থলে যে রূপটি দেখেছেন, তাকে গভীর যত্নে ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের শিল্পে। ইতিহাসের আগের যুগেও শিল্পী ঠিক এই কাজটিই করেছেন। শুধু যে নকশায়, আলপনায় বা ভাস্কর্যে, চিত্রকলায় এই রীতি প্রবাহিত হয়ে এসেছে বা আসছে তা নয়, শিল্পকে দেখবার, অনুভব করবার ক্ষেত্রেও দেখি প্রথম যুগের শিল্পীর থেকে পাওয়া সেই একই চিরন্তন প্রবহমানতা।

    তথ্যসূত্র :

    •ভারতের চিত্রকলা - অশোক মিত্র

    •The Prehistoric Paintings of the Pachmarhi Hills by Dr. Meenakshi Dubey Pathak (Article from Bradshaw Foundation)

    •Lines and Colours- Discovering Indian Art by Ella Datta

    •Prehistoric Art in Modern and Contemporary Creations (Article from Google Art and Culture)

    •ভারত ইতিহাসের সন্ধানে - দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়

    • Wikipedia, Wikimedia, এবং আরো বেশ কিছু লেখার সাহায্য নিয়েছি। তবে মূলত এই লেখাটি লিখতে উপরের সূত্রগুলিই সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে ।

    অলংকরণঃ লেখক ও উইকিমেডিয়া



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ শ্রীতমা মাইতি
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments