পাত্রপাত্রী
অষ্টমী মণ্ডল
মধুসূদন মণ্ডল
জয়া সান্ন্যাল
চয়ন দাশগুপ্ত
বীথি সান্ন্যাল
মৌমিতা বসু
রাজর্ষি
মৌসুমি
ক্যারল অ্যারোনসন
হিতেশ আগরওয়াল
প্রথম অঙ্ক
(কলকাতার রাস্তা, অষ্টমী ও চয়ন)
চয়ন— আরে অষ্টমীদি না! এই দেখো, এসেই তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তা এখানে একলা একলা বসে কী করছো?
অষ্টমী— ভালো আছো চয়ন? কবে এলে?
চয়ন— আরে আটচল্লিশ ঘণ্টা এখনো হয়নি! জেটল্যাগ সামলে এই তো সবে বেরিয়েছি। কিন্তু তুমি একলা কেন, জয়ামাসিরা কোথায়? আর বীথি? আরে বীথির বিয়ের জন্যেই তো কলকাতায় আসা। (উত্তর না পেয়ে একটু থমকে যায়) ও, এইবার বুঝেছি, বীথি বিয়ে করে বিদেশে চলে যাবে, সেইজন্য মন খারাপ? তুমিও যেমন! আচ্ছা, চলো আমার সঙ্গে, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই।
অষ্টমী— না, না তার দরকার নেই। তুমি বিদেশ থেকে এসেছো, বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম করো একটু। আমার বাস এসে গেছে, আমি চলি, পরে দেখা হবে, কেমন।
চয়ন— অষ্টমীদি! আরে দেখো সামনে যে বাসটা পেল তাতেই উঠে পড়লো। আরে, ওটা সাউথ নয়, নর্থে যাচ্ছে।
(নেপথ্যে গান)
আজ তোমারে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে।
ভয় নেইকো সুখে থাকো, অধিক ক্ষণ থাকবো নাকো।
এসেছি দণ্ড দুয়ের তরে।
চয়ন— (দর্শকদের প্রতি) নমস্কার, আমার নাম চয়ন মৈত্র, পেশায় ডেটা সাইন্টিস্ট, নিবাস ক্যালিফোর্নিয়া, কিন্তু মনের বাসা কলকাতায়। পুরনো বান্ধবীদের মধ্যে বিশেষ একজনের বিয়ে ঠিক হয়েছে, তাই জন্য দেশে আসা কিন্তু এর মধ্যে আমার নিজের গল্পও আছে। বেশি কিছু বলবো না, আপনারা বরং আমাদের অন্য এক বান্ধবী, এই মৌমিতার সঙ্গে আলাপ করে নিন, বাকিটা ওইই বলে দেবে।
(মৌমিতা ঢোকে)
মৌমিতা— অ্যাই চয়ন, হাঁ করে ওই ফুচকা খাওয়া মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে আছিস কেন রে? আশ্চর্য এতদিন আমেরিকায় কাটালি, অথচ তোর এই মেয়ে দেখা স্বভাবটা আর গেল না!
চয়ন— (দর্শকদের দিকে) এই হচ্ছে মৌমিতা, আমাদর ব্যাচের হোমকামিং কুইন। বন্ধুদের ওপরে ওর যেমন ভালোবাসা, তেমনি খবরদারি। (মৌমিতাকে) কতদিন বাদে দেখা, কেমন আছিস মৌ।
মৌমিতা— আর বলিস না, একে তো অফিসের কাজ, তারপর ছেলেটাকে নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত। মরার সময় নেই।
চয়ন— আর ছেলের বাবাটা, যে তোর জন্য শহীদ হয়েছে? তার খবর কি?
মৌমিতা— ওটাও তো মনে হয় ভালোই আছে। কিন্তু তোর ব্যাপারটা কী রে চয়ন? মাসিমার কাছে শুনলাম তুই এখনও সিঙ্গল, অর্থাৎ কিনা দেবদাস! আরে বাবা, বীথির তো বিয়ে হয়েই যাচ্ছে, এবার ঝপ করে তুইও শহীদ হয়ে যা।
চয়ন— চুপ কর মৌ, তোর দিদিগিরি করার স্বভাব এখনো গেল না। শোন, আমি বিয়েটা এখনও করিনি বটে কিন্তু দেবদাস মোটেই নই। আমার দস্তুরমতন একজন ফিয়াসেঁ আছে। ইন ফ্যাক্ট সে আমার সঙ্গে কলকাতায় এসেছে।
মৌমিতা— কি?! মানে সত্যি? তু-তু-তুই এমন একটা খবর বন্ধুদের কাছ থেকে চেপে রেখেছিলি! স্টুপিড, গদ্দার, ধোঁকাবাজ, ছুপা রুস্তম! আচ্ছা নাম বল শিগগির। দেখি তোর ফোনটা দে তো, ছবিগুলো দেখে নিই। হ্যাঁরে, বাঙালি, নাকি আমেরিকান? ফিয়ান্সে মানে গার্লফ্রেন্ড তো, নাকি তুই আসলে গে, ওটা বয়ফ্রেন্ড, সেইজন্যেই চেপে রেখেছিলি। এত করে বলছি, দেখা না বাবা ছবিটা।
চয়ন— আচ্ছা দ্যাখ। এই হচ্ছে ক্যারোলিন, বন্ধুরা ওকে ক্যারল বলে ডাকে। আমরা বার্কলিতে একটা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে থাকি। হলো এবার?
মৌমিতা— তার মানে? তুই লিভ টুগেদার করিস! মানে তুই? আর আমরা কিছু জানি না।
চয়ন— আজ্ঞে হ্যাঁ দিদিমনি। ওদেশে কেউ তোদের মতন ঝপাং করে ঝুলে পড়ে না, কিছুদিন বাজিয়ে দেখে, বুঝলি?
মৌমিতা— তুই কেমন করে বাজলি? টং টং করে? ও মা, মেয়েটাকে কী মিষ্টি দেখতে রে। তা, এমন মেয়ে পটিয়েছো, তুমিই তো শেষ অবধি সেন্ট জেভিয়ার্সের নাম রোশন করলে বাবা।
চয়ন— মৌমিতা, এই খবরটা এখুনি টালা থেকে টালিগঞ্জ রটিয়ে দিস না প্লীজ। ওদেশে না, প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে, সেটা ঘাঁটলে লোকজন বহুৎ খচে যায়।
মৌমিতা— ওটা ওদেশ, এটা এদেশ, এখানে প্রাইভেসি মাগুর মাছের মতন, ধরতে গেলেই পিছলে যাবে। আগে বল, মেয়েটা এখন কোথায়?
চয়ন— আমার বাড়িতে। আমার সঙ্গে কলকাতায় এসেছে, বাবা-মার সঙ্গে আলাপ করতে। ওদেশে এটা প্রি-ম্যারেজ রিচুয়াল, সবাই করে। মিট দা পেরেন্টস।
মৌমিতা— মিট দা পেরেন্টস! ওরে বাবা, আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাবো। চল এক্ষুনি ওর সঙ্গে আলাপ করে আসি।
চয়ন— একদম না। দেখা হলেই তুই ওকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবি, আর আমি আঙুল চুষবো।
মৌমিতা— চয়ন!
চয়ন— মৌ?
মৌমিতা— সামনে এই দোকানটা দেখেছিস--প্রিয়গোপাল বিষয়ী। তোকে এখন আমার সঙ্গে দোকানে ঢুকতে হবে, তারপর শাড়ি-ব্লাউজ, পাঞ্জাবি-পাজামা, ধুতি, সালোয়ার কামিজ, সব পছন্দ করে কিনবো, তুই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবি, আর যখন বলবো, তখন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলবি। রেহাই নেই চাঁদু, তুমি ম্যারেজ কমিটিতে সাইন আপ করেছো।
চয়ন— মৌ তোর পায়ে পড়ি আমায় যেতে দে।
মৌমিতা— নোপ। তোর যদি প্রেমিকার সঙ্গে সময় কাটাতে ইচ্ছে হয় তাহলে ওকে ফোন কর, আমার ড্রাইভার পাঁচ মিনিটে ওকে তুলে নিয়ে আসবে। মোদ্দা কথা ওর সঙ্গে দেখা না করানো অবধি তোকে রেহাই দেবার প্রশ্নই ওঠে না।
চয়ন— মৌ, ও জেটল্যাগে কাবু হয়ে আছে। চল না তোকে বরং গুনে গুনে একাশিটা ফুচকা খাওয়াচ্ছি, আমায় প্লীজ ছেড়ে দে। তোর সঙ্গে ওই শাড়ির দোকানে ঢুকলে আমি না বেঘোরে মারা যাবো, তাহলে আমাদের প্রেমের গল্পটাও আর তোর শোনা হবে না।
মৌমিতা— চালাকি করার জায়গা পাওনি চাঁদু। পুরনো প্রেমিকার বিয়ের আসরে নতুন প্রেমিকা নিয়ে হাজির হবে, আর আমরা বন্ধুরা তোমায় বেমালুম ছেড়ে দেবো। ইয়ার্কি পেয়েছো।
চয়ন— শোন মৌ, আমার সঙ্গে আজকে, মানে একটু আগেই অষ্টমীদির দেখা হয়ে গেল জানিস। ঠিক এইখানে বসে ছিলো। এতদিন বাদে দেখা কিন্তু মনে হলো, আমার কাছ থেকে পালিয়ে গেল, জানিস। সেই অষ্টমীদি। মনে আছে, বীথিদের বাড়ির ছাতে বসে আমরা চার-পাঁচজনে বিকেল-সন্ধ্যা আড্ডা মারতাম, আর অষ্টমীদি লুচি-আলুর দম, মুড়ি-চানাচুর, ফুলকপির তরকারি সব ঠিক সময়ে ফটাফট সাপ্লাই করে যেত।
মৌমিতা— গত পাঁচ বছরে অনেক কিছু পাল্টে গেছে রে চয়ন। আমরা আর কলেজে নেই, আমাদের পুরনো দুনিয়াগুলোও কেমন যেন উল্টেপাল্টে গেছে।
চয়ন— আরে, তুই তো হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে গেলি। আচ্ছা বাবা, ক্যারলকে ডেকে নিচ্ছি, তোর বাড়িতেই নাহয় ডিনার করবো। মা একটু রাগবে, কিন্তু কী আর করা।
মৌমিতা— সত্যি তোরা আসবি চয়ন। চল, খুব মজা হবে তাহলে। খাবার নিয়ে চিন্তা নেই, আমি বেছে বেছে এমন ছেলে বিয়ে করেছি না, এক্কেবারে পাকা শেফ। তোরা আয়, আমি আরো কয়েক জনকে ডেকে নিই। যাকে বলে প্রি-ম্যারেজ ধামাকা!
(দুজনে বেরিয়ে যায়। নেপথ্যে গান)
খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি
আমার মনের ভিতরে
কতরাত তাই তো জেগেছি
বলবো কি তোরে
খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি।
দ্বিতীয় অঙ্ক
(চয়নের বাড়ি। চয়ন ও ক্যারল। নেপথ্যে মৃদু ভৈরবীতে আলাপ)
ক্যারল— আচ্ছা, তুমি কি আমার ঘরের বাইরে সারা রাত ঘাপটি মেরে বসেছিলে?
চয়ন— ধরে নাও তাই। আমি তো জানি শেষরাতে তোমার ঘুম ভেঙে যাবে। জেটল্যাগ ওইরকমই অদ্ভুত। দিনকে রাত, রাতকে দিন করে ছাড়ে।
ক্যারল— এরকম কোরো না চয়ন। তোমার বাবা-মায়ের ঘুম ভেঙে গেলে ওরা কী ভাববেন বলো তো। আমি তোমার দেশে এসেছি, তোমাদের কালচার অ্যান্ড কাস্টমস মেনে চলতে চাই।
চয়ন— লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করা এই শহরের পয়লা নম্বর কালচারাল হেরিটেজ ডার্লিং। বাড়ির সবাই যখন জেগে উঠবে ততক্ষণে আমরা ভোর হওয়ার শব্দ শুনতে শুনতে আরেকবার ঘুমিয়ে পড়েছি। আঃ, ছুটির সকালে সেই চুরি করা ঘুম কী যে আরামের!
ক্যারল— ভোর হওয়ার শব্দ?
চয়ন— নয়েজ পলিউশনের জন্য কলকাতার বদনাম আছে, কিন্তু শহরটা এই লাগাতার ক্যাকোফোনির আড়ালে কিছু গোপন শব্দ লুকিয়ে রাখে। শুধু যারা তাকে ভালোবাসে, একমাত্র তারাই সেই শব্দ শুনতে পায়। এসো, এই জানলাটার সামনে দাঁড়াও। দেখবে, যেমন করে আকাশে আলো ফুটছে, ঠিক তেমনি করেই জেগে উঠছে রাস্তাগুলো। লক্ষ লক্ষ মানুষ শুধু আরেকটা দিন বেঁচে থাকার জন্য পথে নামছে, তাদের পায়ে পায়ে বেজে উঠছে জীবনের এই অদ্ভুত সিম্ফনি। বলো তো ক্যারল, বেঠোফেন কি এর থেকেও মহান সংগীত সৃষ্টি করতে পারতেন?
ক্যারল— চয়ন চলো না, সবার জন্য ব্রেকফাস্ট রান্না করি। ওরা তো জানে না তুমি কী চমৎকার ব্রেকফাস্ট বানাও।
চয়ন— পাগল! খবরদার এখানে আমার রান্নার কথা তুলো না। তাছাড়া এখন সবাই ঘুমোচ্ছে, ঠিক সময় ব্রেকফাস্ট হাজির হয়ে যাবে, তুমি একটুও চিন্তা কোরো না। তার চাইতে চলো আরেকটু মটকা মারি।
ক্যারল— মটকা কি কোনও কোডওয়ার্ড? আচ্ছা ঘুম থেকে উঠে তোমার মা যদি খোকাকে তার ঘরে না দেখতে পায়, তাহলে কোনো কেলেঙ্কারি হবে না তো?
চয়ন— তার আগেই পালাবো। চলো--
ক্যারল— শোনো না, তোমার মা বলছিলেন, উনি আমাকে নিয়ে বেলুড় মঠে যাবেন। আমি খুব নার্ভাস কিন্তু। কী করতে যে কী করে বসবো। আচ্ছা তুমি বসো আমি একটু কিচেনের দিকে যাই।
(ক্যারল বেরিয়ে যায়)
চয়ন— যাচ্চলে। এ তো দেখি আদর্শ ভারতীয় গৃহবধূ হবার মতলবে আছে। হিতে বিপরীত না হয়ে যায়।
(চয়নের ফোন বেজে ওঠে)
চয়ন— বীথি! বীথির ফোন এই সাতসকালে! হ্যালো...
বীথি— চয়ন কেমন আছিস? আমেরিকান গার্লফ্রেন্ড নিয়ে খুব ব্যস্ত বুঝি?
চয়ন— আরে দূর, এসে থেকে বাড়ির লোকরাই ওকে গ্রেফতার করে রেখেছে। বল কী ব্যাপার?
বীথি— একটু দেখা করতে পারবি? কথা আছে।
চয়ন— মানে, আ- আজকে? দেখা?
বীথি— শোন আমি জানি এটা খুব অকওয়ার্ড। এটাও জানি তুই আমাকে অ্যাভয়েড করছিস, করাটাই স্বাভাবিক। ভয় পাস না, এটা বিয়ের আগে পুরনো প্রেমিকের সঙ্গে রঁদেভ্যু নয়, আমি মৌকেও ডেকেছি। একজনের বাড়িতে যাবো।
চয়ন— কার বাড়িতে?
বীথি— অমিমাসির বাড়িতে। ও এখন ওর ছেলের সঙ্গে থাকে বৈষ্ণবঘাটায়।
চয়ন— বললেই হয়? এখানে ক্যারলকে নিয়ে সারাদিন প্রোগ্রাম আছে।
বীথি— পারি না! কিছু একটা ঢপ দিয়ে দিস। আসছি, এই ধর ঘন্টাখানেক।
চয়ন— ইয়ার্কি পেয়েছিস। বাড়িভর্তি লোক, তার মধ্যে এতো শর্ট নোটিসে--
(ক্যারল ঢুকছে। চয়ন ফোন কেটে দেয়)
ক্যারল— চয়ন, তুমি প্লীজ কিছু মনে কোরো না। আমরা সবাই আজকে দক্ষিণেশ্বর আর বেলুড় মঠ যাচ্ছি। তোমার মায়ের ইচ্ছে, আমি না বলতে পারলাম না। তুমি সারাদিন বোর হবে। সরি।
চয়ন— এটা কিন্তু ঠিক নয় ক্যারল। এদিকে আমি ভাবছি তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দেবো। দাঁড়াও আমি মাকে বলছি।
ক্যারল— না, না, প্লীজ মাকে বোলো না। উনি কী সুন্দর করে বললেন-- ঠাকুরকে সাক্ষী রেখে তুই আমাদের পরিবারে আসবি, আমার ঘর ভরে উঠবে। ঠিক তখনই তোমার বাবা এসে আস্তে করে আমার মাথায় হাত রাখলেন, জানো? আমার ভেতরটা জুড়িয়ে গেল।
চয়ন— না, মানে সেটা ঠিকই, কিন্তু তাই বলে গোটা একটা দিন--
ক্যারল— তুমি প্লীজ আপত্তি কোরো না। তোমার ফ্যামিলির সবাইকে আমার খুব ভালো লেগেছে জানো। আমি মা-বাবার ভালোবাসা পাইনি, আমার ছোটবেলাতেই ওরা আলাদা হয়ে গেছিল। তারপরে শুধু রাগ আর নোংরামি, একে অপরকে দোষ দেওয়া, আঘাত করা, তার মাঝখানে একটা কনফিউসড ছোট্ট মেয়ে--আ লিটল গার্ল উইথ নাথিং রং। আমি ঠিকমতন জানিও না যে বাবা এখন কোথায়, কেমন করে জীবন কাটাচ্ছে। অথচ কী সুন্দর, কী নরম সুরে স্যাক্সোফোন বাজাতো মানুষটা। না চয়ন, আমাকে তোমার পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে দাও। বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করার সময় তো পড়েই রয়েছে।
চয়ন— আচ্ছা যাও। কী আর করা,…
ক্যারল— থ্যাঙ্ক ইউ চয়ন। কাল থেকে আমি পুরোপুরি তোমাদের সঙ্গে। তুমি নাহয় আজকের দিনটা তোমার পুরনো বন্ধুদের সঙ্গেই কাটাও। সি ইউ ইন দি ইভনিং।
(ক্যারল বেরিয়ে যায়)
চয়ন— (দর্শকের প্রতি) ধোঁকাবাজির দেবতা যদি কেউ থাকেন, তবে অবশ্যই তিনি আজ আমার ওপর সদয়।
(বীথি ঢোকে। চয়ন চমকে উঠে ওর দিকে তাকায়)
বীথি— কেমন আছিস চয়ন?
চয়ন— ভালো আছি। তুই?
বীথি— যেমন দেখছিস। তোর ফিঁয়াসে কোথায়?
চয়ন— বাবা-মায়ের সঙ্গে বেলুড় মঠে গেছে। বীথি আমি তোকে আগেই বলতাম, কিন্তু--
বীথি— থাক থাক বলতে হবে না। মৌয়ের পাঠানো ছবিটা দেখেছি। খুব সুন্দর আর ইনোসেন্ট দেখতে। তোর চয়েস তো সব সময়েই ভালো।
চয়ন— আমার কথা ছাড়। তোকে কনগ্রাচুলেশনস অবধি বলা হয়নি। সত্যি দারুণ বিয়ে হচ্ছে তোর, (এদিক-ওদিক তাকায়) আচ্ছা মৌ কোথায়?
বীথি— মৌ আসতে পারছে না রে। বিয়ের জোগাড়যন্ত্র নিয়ে আটকে আছে। এখন চল দেখি, ট্র্যাফিক ঠেলে বৈষ্ণবঘাটা যেতে অনেক সময় লাগবে।
চয়ন— সেকি রে? জাস্ট আমরা দুজনে যাবো!
বীথি— কেন, তোর নার্ভাস লাগছে? শোন, দিস ইজ অ্যাবাউট অমিমাসি, নট ইউ। মৌ বলল তোর সঙ্গে নাকি অমিমাসির দেখা হয়েছিল। তুই কি জানিস যে ও আমাদের বাড়ির কাজ ছেড়ে চলে গেছে? ঠিক দু সপ্তাহ আগে।
চয়ন— আমি কিছুই জানি না রে বীথি। বাট দিস ইজ স্ট্রেঞ্জ। এতদিনের লোক, যে কিনা ছোটবেলা থেকে তোকে কোলেপিঠে করে বড়ো করেছে, সে কিনা, তোরই বিয়ের দু-সপ্তাহ আগে কাজ ছেড়ে দিল! তুই জানিস, সেদিন রাস্তায়, শী লুকড একজ্যাক্টলি লাইক আ ঘোস্ট। ঠিক আছে আমি বুঝছি যে ওর ছেলে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, ওর আর অন্যলোকের বাড়িতে কাজ করার দরকার নেই। কিন্তু বিয়েটা অবধি তো থেকে যেতে পারতো।
বীথি— পারতো না। মায়ের সাথে ভয়ঙ্কর ঝগড়া হয়েছিল। ঠিক কী নিয়ে, সেটা আমিও ভালো করে জানি না। তাছাড়া পরের বাড়ি বলতে তুই কী মিন করছিস চয়ন? ছোটবেলা থেকে ওই মহিলাই আমাকে মানুষ করেছে, আর ঠিক আমারই বিয়ের সময় এই কাণ্ড! সেই ধাঁধার উত্তরটা পাবার জন্যেই তো যেতে চাইছি। যাকগে, শুধু শুধুই তোকে বিরক্ত করলাম। ছাড়, আমি একাই যাচ্ছি।
চয়ন— বীথি তুই আগের মতোই রগচটা আছিস দেখছি। দেখ, আমাদের জীবন আলাদা আলাদা রাস্তায় চলে গেছে, কিন্তু বন্ধু হিসাবে তুই আমার ওপর ভরসা রাখতে পারিস। মনে আছে সেদিন ব্রেক-আপ করার সময় বলেছিলি, আমরা সারাজীবন বন্ধু থাকবো।
বীথি— কথাটা মিথ্যে চয়ন, তুইও জানিস, আমিও জানি। বাদ দে ওসব, আমি তোর কাছে এসেছি কারণ অমিমাসিকে আমি একলা ফেস করতে চাই না। তাছাড়া বিয়ের আগে তোর সঙ্গে একটু কথা বলতেও ইচ্ছে করছিলো।
চয়ন— কেন বলতো? আমি তো তোকে ডাম্প করিনি, তুই-ই আমাকে করেছিলি।
বীথি— তা যাই বল, আমি তোর প্রাক্তন প্রেমিকা, তুই আমেরিকান গার্লফ্রেন্ড সঙ্গে করে এনেছিস, তাই দেখে একটুখানি জ্বলন হবে না? চল, গাড়িতে যেতে যেতে তোদের গল্প শুনবো। তোদের নাকি একসঙ্গে ইউরোপ ঘোরার প্ল্যান? ইস কী মজা, আই অ্যাম রিয়ালি জেলাস।
চয়ন— বীথি, প্লীজ এরকম ক্যাজুয়ালি কথা বলিস না। ঠিক আছে চল, অমিমাসির সঙ্গে দেখা করে আসি।
বীথি— তোর মুখটা এমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে কেন রে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি কেঁদে ফেলবি।
চয়ন— চুপ কর। আমারও তোকে দেখতে ইচ্ছে করছিল বীথি।
(দুজনে বেরিয়ে যায় নেপথ্যে গান।)
যা আমার সবার হেলাফেলা, যাচ্ছে ছড়াছড়ি,
পুরানো ভাঙা দিনের ভেলা, তাই দিয়ে ঘর গড়ি,
যে আমার নতুন খেলার ধন, তারি এই খেলার সিংহাসন
ভাঙারে জোড়া সে দেবে, কিসের মন্তরে
তৃতীয় অঙ্ক
(অষ্টমীর ফ্ল্যাট, নেপথ্যে টেলিভিশনের আওয়াজ)
অষ্টমী— (দর্শকদের প্রতি) বাবুমশায়েরা, আমার নাম অষ্টমী মণ্ডল, বয়েস, ওই ধরুন ষাট। গাঁয়ের ইশকুলে লেখাপড়া করেছি কেলাস এইট অবধি। তার পরে বাবা তো বিয়ে দিয়ে দিল, আমিও কলকাতার এক বস্তিবাড়িতে স্বামীর ঘর করতে এলাম। কী বলবো গো, এই গপ্পো আপনারা অনেক শুনেছেন। আমার স্বামী, নিতাই ছিল রাজমিস্তিরি কিন্তু সে আবার কাজ যতো না করতো মদ খেত আর কুসঙ্গ করতো তার পাঁচগুণ। ইচ্ছা হলে বাড়ি আসতো, তখন নেশার ঘোরে কখন যে ঠ্যাঙাতো, কখন যে সোহাগ করতো, তা জানেন শিবঠাকুর। এরই মধ্যে পেটে একটা বাচ্চা এল। সে দুনিয়ার আলো দেখার আগেই তার বাবা কোথাকার এক ঠিকাদারকে ধরে আরবদেশে চলে গেল, সেখানে নাকি মস্ত মস্ত সব বাড়ি তৈরি হচ্ছে। ব্যাস তখন থেকে আর তার খবর নেই।
তা আমার মতন মেয়েছেলেদের কপাল ভালো থাকলে শহরের কোনো ভদ্দরলোকের পরিবারে আশ্রয় পায়, আর কপাল খারাপ থাকলে রাস্তায় দাঁড়ায়। আমার কপাল ভালোই বলতে হবে, জয়াবৌদির কাছেই রয়ে গেলাম এই এতগুলো বচ্ছর। ফুলের মতন মিষ্টি, ওই একরত্তি মেয়েটা আমার কাছেই বড়ো হয়ে উঠলো, স্কুল থেকে কলেজে গেল, আর তার সাথে সাথে আমার নিজের ছেলেটাও লেখাপড়া করার সুযোগ পেল।
(চয়ন ও বীথি ঢোকে)
অষ্টমী— বীথি তুই? মানে তোরা! আজকে? ওমা, আয় আয়! কেমন আছিস রে। ইস রোদ্দুর লেগে মুখটা কালো গেছে।
বীথি— অমিমাসি, তুমি আমাকে না বলে, কাজ ছেড়ে চলে এলে কেন? বলো কী হয়েছিল? মা তোমায় কিছু বলেছে, খারাপ ব্যবহার করেছে তোমার সঙ্গে?
অষ্টমী— কিচ্ছু হয়নি, তোরা আগে তো বোস, দুটো নাড়ু চিবিয়ে, এক গ্লাস জল খা দেখি।
বীথি— আমি আর তোমার সেই বাচ্চা মেয়েটা নেই, যে আমাকে ভুলিয়েভালিয়ে ভাত খাইয়ে বিছানায় গুঁজে দেবে। গত তিন মাস তোমার মুখে বিয়ে ছাড়া কোনো কথাই ছিলো না। কী পরলে আমায় ভালো লাগবে, কেমন করে তত্ত্ব সাজাবে, কোন দোকান থেকে ফুল আনবে, কোন সেলুনে গিয়ে চুল বাঁধা হবে, এই নিয়ে রিসার্চের আর শেষ নেই। হঠাৎ করে বিয়ের দুহপ্তা আগে দুম করে কাজ ছেড়ে দিলে! সত্যি করে বলো সেদিন মায়ের সঙ্গে কী কথা হয়েছিল তোমার?
অষ্টমী— কিচ্ছু হয়নি রে, এমনিই। তুই তো কোন বিদেশে চলে যাবি, আমারও আর কাজ করার দরকার নেই। এই দ্যাখ না আমার ছেলে, ছেলের বউ নিয়ে কেমন সুখে আছি। হ্যাঁ রে মেয়ে, তোর বিয়ে নিয়ে খুব মেতেছিলাম বটে, যেন নিজের মেয়েরই বিয়ে দিচ্ছি।
বীথি— কী আশ্চর্য, এর মধ্যে ভুলটা কোথায়? তুমি কি আমার মায়ের চেয়ে কিছু কম, অমিমাসি?
অষ্টমী— না রে পাগলি, আমারই মাথাটা খারাপ হয়ে গেছিল। ভাগ্যিস সময় থাকতে বৌদি ভুলটা ভেঙে দিলো। ছাড় ওসব কথা। পুরনো দিনের মতন একটু গপ্পো কর দেখি দুজনে, আমি একটু চা করে নিয়ে আসি...
(বেরিয়ে যায়)
বীথি— চয়ন, আমি যা ভয় করেছিলাম ঠিক তাই হয়েছে।
চয়ন— বিয়ে নিয়ে অষ্টমীদির অতি উৎসাহ জয়ামাসি ভালো চোখে দেখেনি, এইতো?
বীথি— কিন্তু কতখানি ইনসাল্টেড হলে, জাস্ট আমার বিয়ের আগে অমিমাসি কাজ ছেড়ে পালিয়ে আসতে পারে সেটাই ভাবছি। চয়ন ছোটবেলা থেকে আমাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা, আমার হোমটাস্ক, টিফিন, নাচের ক্লাস, গান শেখা, সাঁতার, ব্যাডমিন্টন, সব কিছুর দায়িত্বে ছিল অমিমাসি। তার ওপরে রান্না, ঘর-পরিষ্কার, চা জলখাবার বানানো, সব কিছু। মায়ের তখন প্র্যাকটিস বাড়ছে, নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই।
চয়ন— তারপর হাইস্কুল আর কলেজ, তোর বাড়িতে তখন বন্ধুদের ভিড়। সেই সময় অমিমাসি যাকে বলে হাইপারভিজিলেন্ট ছিলো। ওর নজর এড়িয়ে তোর কাছে ঘেঁষাই মুশকিল। আমার মনে আছে কে যেন একটা বলেছিল, বুড়িকে গুম করে দিলে কেমন হয়।
বীথি— হিতেশ। তা যাই বল অমিমাসি কিন্তু তোকে পছন্দ করতো। ওর রাগ ছিল আমার অবাঙালি বন্ধুদের ওপর বিশেষ করে যারা বড়লোক। অমিমাসির কাছে বড়লোক মানেই চরিত্রহীন।
চয়ন— বীথি চুপ কর, পুরনো কথা আর তুলিস না!
বীথি— কেন, তুই হঠাৎ এত এক্সসাইটেড হয়ে উঠলি কেন রে? হিতেশের নাম শুনেই-
চয়ন— ফর গুড রিজন, বীথি!
(অষ্টমী ঢোকে। দুজনেই চুপ করে যায়)
অষ্টমী— তোরা আবার ঝগড়া করছিস নাকি রে? ছোটবেলার মতন।
বীথি— নাঃ, দেখছ না আমরা বড়ো হয়ে গেছি। শোনো, তুমি না এলে আমি কিন্তু বিয়ের আসর থেকে উঠে যাবো। এই বলে রাখলাম। চয়ন, আমি যাচ্ছি, তুই ইচ্ছে হলে বসতে পারিস।
(বেরিয়ে যায়)
চয়ন— আরে বীথি, শোন। আসছি অমিমাসি ...
(চয়ন বেরিয়ে যায়)
অষ্টমী— আরে, চা-টুকু অন্তত খেয়ে যা। (একটুক্ষণ চুপ করে থাকে) হায়রে আমার কপাল। বীথিকে নিজের মেয়ে ভাবতে শুরু করেছিলাম, বুঝতে পারিনি বৌদির মনে আঘাত লাগবে। মাঝখান থেকে নিজের ছেলেটা পর হয়ে গেল। তবু যা করেছি মেয়েটার ভালো চেয়েই করেছি। ভগবান জানেন।
(অষ্টমী বেরিয়ে যায়। মধুসূদন ঢোকে)
মধু— সুমি, এই তরকারিগুলো রেখে দাও, একদম টাটকা। আর তুমি যে ওই নতুন সানন্দাটা আনতে বলেছিলে, নিয়ে এসেছি।
(মৌসুমি ঢোকে)
মৌসুমি— ওমা, তুমি এসে গেছ, ওদিকে তোমার বন্ধুরা তো ভাগলবা। আচ্ছা, দাও, ওগুলো ফ্রীজে রেখে আসি। থ্যাঙ্ক ইউ। এবার দেখবে তোমার মনের মতো কন্টিনেন্টাল রান্না করে খাওয়াবো। সানন্দায় সব রেসিপি দেওয়া আছে। আচ্ছা তুমি বোসো, আমি চা নিয়ে আসি।
মধু— এ কি? এই পারফিউমের গন্ধটা এল কোথা থেকে? মা! মা! আরে গেল কোথায় সবাই?
(অষ্টমী ঢোকে)
অষ্টমী— কী ব্যাপার খোকা, চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করছিস কেন?
মধু— মা, বাড়িতে কি কেউ এসেছিলো?
অষ্টমী— হ্যাঁ এসেছিল তো। চয়ন আর বীথি। তা তুই এরকম হাঁকপাঁক করছিস কেন?
মধু— আচ্ছা, ওরা এল আর তোমরা আমায় একটা ফোনও করলে না। আশ্চর্য!
অষ্টমী— আরে ওরা তো এল আর গেল, ফোন করার সময়টা কোথায় পেলাম।
মধু— না, আমি জানি। তুমি চাও না যে বীথির সঙ্গে আমার দেখা হোক, তাইতো?
অষ্টমী— এ আবার কী রকম কথা? বলি, আমি কি ওদের নেমন্তন্ন করে এনেছি নাকি যে সবাইকে জানাতে হবে। তোর ব্যাপারটা কী বলতো খোকা?
মধু— কিছু না। তোমার তো শুধু বীথি আর বীথি! আচ্ছা, ওরা কি আমাদের ওই বাড়ির কুকুরটার থেকে বেশি কিছু ভেবেছে কোনোদিন!
অষ্টমী— ওঃ খোকা, এতটা অবিচার করতে তোর এতটুকু বাধল না? কোথায় থাকতিস তুই, কোন বস্তির অন্ধকারে, যদি দাদাবাবু তোকে স্কুল-কলেজে না পাঠাতেন। কে তোর সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে দিত? আমি যা করেছি, তোর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই করেছি রে খোকা। আর তুই! তুই কেমন করে এত অকৃতজ্ঞ হলি রে? তোকে তো এরকম শিক্ষা দিইনি!
মধু— না না, এরকম বিদঘুটে শিক্ষা তুমি দেবে কেন? তুমি বরং শিখিয়েছিলে যে বাবুদের সামনে সব সময় মাথা নিচু করে থাকতে হয়। তুমি শিখিয়েছিলে যে বাবুর বাড়ির মেয়েরা আমাদের নাগালের বাইরে। এই শিক্ষা নিয়েই তো আমি বড়ো হয়ে উঠেছি মা! কিন্তু তাই যদি সত্যি হয় তাহলে আমাকে লেখাপড়া শিখিয়ে কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পাঠালে কেন? বড়োজোর ওদের বাড়িতে ড্রাইভার করে রাখলেই পারতে! তাহলে তো আমি আমার জায়গাটা চিনে নিতাম, বাইরের দুনিয়া আমার নাগালের বাইরেই থাকতো। কেন আমায় লেখাপড়া শেখালে মা, কী দরকার ছিল?
(মৌসুমি ঢোকে)
মৌসুমি— এই নাও চা! একি, তোমার চোখমুখ এরকম দেখাচ্ছে কেন? মা, কী হয়েছে? হ্যাঁ গো অফিসে কোনো গণ্ডগোল হয়েছে নাকি?
অষ্টমী— কিছু হয়নি বৌমা, চলো, আমরা একসঙ্গে বসে একটু টিভি দেখি গে। ওকে একলা একটু ঠান্ডা হতে দাও।
মৌসুমি— না মা, মনে হচ্ছে কিছু একটা তো গোলমাল হয়েছে। বলো না গো?
অষ্টমী— ঠিক আছে তোমরা কথা বলো। আমি বরং রুটিগুলো সেঁকে নিই গে যাই।
মৌসুমি— মা! মা, শোনো। আচ্ছা কদিন ধরে তোমাদের মা-ছেলের কী হয়েছে বলো তো? যখন তখন রাগারাগি করো, কথা বললে উত্তর দাও না। বলি ব্যাপারটা কী?
মধু— ব্যাপারটা গণ্ডগোলের সুমি। ছেড়ে দাও, চলো আমরা বরং টিভি দেখি সবাই একসাথে বসে। আচ্ছা টিভি ছাড়ো, চলো তোমায় একটা পুরনো গল্প বলি।
মৌসুমি— চলো। আজকাল তো আমার জন্য সময়ই নেই তোমার। খালি কাজ আর কাজ। শোনো, একটা কথা আছে, কিন্তু কিছুতেই বলার সময় হচ্ছে না। শুনবে? খুব দরকারি কথা।
(নেপথ্যে গান)
না বুঝে কারে তুমি ভাসালে আঁখিজলে, না বুঝে
ওগো কে আছে চাহিয়া শূন্য পথপানে,
কাহার জীবনে নাহি সুখ
কাহার পরান জ্বলে, না বুঝে
চতুর্থ অঙ্ক
(হিতেশ আগরওয়ালের অ্যাপার্টমেন্ট)
হিতেশ— মধু, তুই আভি বাড়ি যা। ওখানে সবাই তোর জন্য ইন্তেজার করছে।
মধু— হিতেশ, তোর মনে পড়ে, যেদিন তুই জাস্ট বীথিকে ইমপ্রেস করার জন্য দশ ফুট উঁচু দেওয়াল টপকেছিলি?
হিতেশ— হাঁ, ইয়াদ তো আসেই। ও খুব ডরে গেছিল, তারপর কেমন একটা পিকিউলিয়ার হাসি হেসে বলেছিল- তুমি কি টিকটিকি, আমার কিন্তু ভীষণ টিকটিকির ভয়। হাঁ, বহুৎ ইয়াদ আসে।
মধু— আমার আর ওই বিয়েবাড়ির মধ্যে ওইরকম একটা দশ ফুট উঁচু দেওয়াল আছে। আমার ওই দেওয়াল টপকানোর ক্ষমতা নেই, কিন্তু পারলে ওটাকে ভেঙে ফেলতে চাই।
হিতেশ— হোয়াই আর ইউ সো অ্যাংরি মধু। যো হোনা থা ও তো হো চুকা। এতে কারো গলতি নেই, সব কিসমত। আমি আমার প্রেজেন্ট কন্ডিশনে যদি রিয়্যালিটিকে অ্যাকসেপ্ট করতে পারি, তবে তুই পারছিস না কেন?
মধু— তুই তো গ্রীক ট্রাজেডিস্টদের মতন কথা বলছিস রে হিতেশ। মানুষের কিছু করার নেই, সবই ফেট কিংবা অ্যাক্টস অফ গডস। আমি এটা মানতে পারছি না। তোর অ্যাক্সিডেন্ট এমনি এমনি হয়নি, ইউ আর ভিক্টিম অফ আ ক্রাইম! সেই ক্রিমিন্যালরা বহাল তবিয়তে শহর দাপিয়ে বেড়াবে, কারুর এন-আর-আই জামাই হবে, কারুর আমেরিকান গার্লফ্রেন্ড, আর আমরা শুধু নেমন্তন্ন খেতে যাবো, এ কথা ঠিক নয় দোস্ত।
হিতেশ— সহি বাত যে কি, কোন জানে? সেদিন কী হয়েছিল আমার কিচ্ছু ইয়াদ নেই, এভরিথিং ইজ আ ব্লার। শুধু ওই হরিবল ইমপ্যাক্ট, তিনতলা থেকে পেভমেন্টের ওপরে সপাটে আছড়ে পড়া, ওনলি দ্যাট ইজ ট্রু। সেদিন বড্ড নেশা করে ফেলেছিলাম রে। সত্যি কথা বলতে কি, আই অ্যাম হ্যাপি দ্যাট বীথি ইজ গেটিং ম্যারেড টু আ ডিসেন্ট গাই।
মধু— হাউ ডু ইউ নো? কী করে জানলি ওই রাজর্ষি বলে অচেনা, ভুঁইফোঁড় লোকটা শুধু এন-আর-আই বলেই ধোয়া তুলসীপাতা, প্লেন হাঁকিয়ে আসবে আর রাজকন্যা তুলে নিয়ে যাবে। ডিসগাস্টিং!
হিতেশ— মধু, তোর দিমাগ খারাপ হয়ে গেছে। নো ওয়ান ইজ স্পেশাল, কেউ কিছু ডিসার্ভ করে না, দেয়ার ইজ নো রাইম অর রিজন ফর এনিথিং। রাগ, রসুই, পাগড়ি, কভি কভি বন যাতা হ্যায়। এত লেখাপড়া করে এইটুকু সমঝালি না, দোস্ত।
মধু— চুপ কর! আমার দোষ! সব আমার দোষ!
হিতেশ— না রে আসল কসুর আমার। আমি বুঝতে পারিনি যে দিস ইজ সাচ আ উইয়ার্ড লাভ ট্রিয়াঙ্গল। মনে আছে, যেদিন সাউথ সিটি মলে তুই আমাদের ইন্ট্রোডিউস করে দিয়েছিলি?
মধু— মনে আছে। বীথি আমাকে পাত্তা দিতো না কিন্তু তোর সঙ্গে দিব্যি জমে গেল। তারপর তুই ওকে বারে নিয়ে গেলি, জীবনে প্রথমবার অ্যালকোহলের স্বাদ চিনিয়ে দিতে। শালা, চয়নের তখন কী রাগ!
হিতেশ— হ্যাঁ, থোড়া টিপসি হয়ে গেলে ওকে আরো প্রিটি লাগত। সেদিন আমি যখন ওকে আমাদের প্রডাকশনে কাজ করতে বললাম, ও কিন্তু আগের মতন হেসে উড়িয়ে দিলো না। কেমন একটা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকলো আমাদের দিকে, তারপর নিজে থেকেই তোর স্ক্রিপ্টটা চেয়ে নিল।
মধু— আমার সেই কতো সাধের স্ক্রিপ্ট। ভেবেছিলাম আমি ডাইরেক্ট করবো, তুই প্রডিউসার আর বীথি হবে হিরোইন। আমাদের সবার সামনে একটা নতুন দুনিয়ার দরজা খুলে যাবে।
হিতেশ— পাইপ ড্রিমস। দিস ইজ একজ্যাক্টলি হোয়াটস রং উইথ ইউ বং’স। উইথ অল ইয়োর ট্যালেন্ট, ইউ গাইজ লিভ ইন ইউটোপিয়া।
মধু— ঠিকই বলেছিস। ট্যালেন্ট দেখানোর চান্স পেলাম কোথায়, বল? তোর অ্যাক্সিডেন্ট সব কিছু নষ্ট করে দিল। তোর এই হাল বানিয়ে ওই কামিনা চয়নটা মাঝখান থেকে হিরো বনে বেরিয়ে গেল।
হিতেশ— মধু, মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড, তোকে বহুৎ বার বলেছি, কামিনা যদি কেউ থাকে তো আমি। আই শুড নট হ্যাভ ব্রট দোজ টু বাস্টার্ডস টু মিট বীথি। ড্যাডিজী প্রডাকশনের টাকা দিতে ইনকার করে দিলো, প্রডিউসার তো একটা ধরতে হবে। ওই লোক দুটোকে ভালো করে চিনতাম না, তাও ওরকম একটা হেস্টি ডিসিশন নিয়ে ফেললাম।
মধু— বীথি অ্যাডাল্ট মেয়ে, ও জেনেশুনে ওদের সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছিল। তাতে তোর দোষ কী? চয়ন তোকে তিনতলার বারান্দা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল, হি ওয়ান্টেড টু কীল ইউ। হি ইজ দি রিয়াল ভিলেন। আর বীথি! বীথি সব জেনেও চুপ করে রইলো, তোকে একবার দেখতে অবধি এল না!
হিতেশ— মধু, তোকে অনেক বার বলেছি, আমার কিচ্ছু ইয়াদ নেই। ওরা আমাদের মালের সঙ্গে কেটামাইন মিশিয়ে দিয়েছিল, দ্যাট ক্রিয়েটস অ্যামনেশিয়া, তার ওপর হেড ইনজুরি। ইটস অল ওয়াইপড ক্লিন।
মধু— আমি তখন মেইনল্যান্ড চায়না থেকে খাবার তুলতে গেছি। শালা চাকর হয়ে জন্মেছিলাম, চাকরের কাজটা তো আমাকেই করতে হবে।
হিতেশ— ফালতু বাত করিস না, ওটা তোর ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স।
মধু— ওই যে বীথি হাসতে হাসতে বলেছিল না-- কী রে মধু, তুই দেখছি ঠিক চয়নের মতো হয়ে গেছিস। সবকিছুতে খালি বারণ করা আর জ্ঞান দেওয়া। যা না রে বাবা, খাবারটা নিয়ে আয়। শুনে, আমার মাথাটা কেমন যেন হয়ে গেল, আমি রওনা হয়ে গেলাম। ফিরে এসে দেখি তুই ফুটপাথে পড়ে আছিস, লোক জমা হচ্ছে, পুলিশের গাড়ি, প্রডিউসারদের পাত্তা নেই। পরে শুনলাম কোত্থেকে নাকি চয়ন এসে বীথিকে বাড়ি নিয়ে গেছে। শালা হিরো!
হিতেশ— মধু ইয়ার, তুই কিন্তু সাইকো হয়ে যাচ্ছিস। শোন, পেয়ার আর নফরৎ এক জায়গায় থাকে না। আমি বলছি, লেট ইট গো।
মধু— লেট ইট গো! যে মা ওকে ছোটবেলা থেকে বড়ো করেছে, যার জন্য নিজের ছেলেটার দিকে ভালো করে ফিরেও তাকায়নি কোনোদিন, তাকে এক কথায় বাড়ি থেকে বার করে দিলো ওরা। চমৎকার, কোই বাত নেই, জানে দো, জাস্ট লেট ইট গো!
(ফোন বেজে ওঠে)
হিতেশ— মধু, দেখ তো ফোনটা কোথায় গেল? বাথরুমে ফেলে এলাম বোধহয়।
মধু— দেখছি, দাঁড়া।
হিতেশ (হুইলচেয়ার চালিয়ে মঞ্চের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়) হাঃ হাঃ আমি, হিতেশ আগরওয়াল এখন হুইলচেয়ারে বসা বুড্ডা বিবেকের রোল নিয়ে আসরে নেমেছি, সো আই মাস্ট স্পীক সেন্স। কিন্তু সেদিন আমিও তো জোয়ান তুর্কি ছিলাম। মধু গ্রীক ট্রাজেডির কথা বলছিল না। মজার কথাটা এই যে সেই আদিমকাল থেকেই ফেট অলওয়েজ উইনস, তাই আমিও হিরোর বদলে জিরো হয়ে গেলাম। জিরো আসলে খুব অদ্ভুত নম্বর। আমাদের সব কোশিশ, সব ইন্তেজার যেখানে গিয়ে স্রেফ ছবি হয়ে যায়। ভ্যান গগের সেই সব জ্বলন্ত তারাদের ছবি।
(হঠাৎ এদিক ওদিক তাকায়) আরে মধু ভাই, মোবাইল খুঁজতে খুঁজতে ধাপার মাঠেই চলে গেলি না কি রে?
মধু— এই নে তোর ফোন। আলমারির তলায় পড়েছিল।
হিতেশ— ওঃ, আই অ্যাম সরি মধু। অপারিজ লোক, কী যে কখন, কোথায় ফেলে রাখি তার ঠিক নেই।
মধু— ডোন্ট ওরি দোস্ত। বিয়ের আসরেই দেখা হবে তাহলে। গুড নাইট।
(মধু বেরিয়ে যায়)
হিতেশ— মধু শোন! বিয়ের আগে কোনো গণ্ডগোল পাকাস না প্লীজ। লেট ইট গো!
পঞ্চম অঙ্ক
(বীথির বাড়ি। বিয়ের আগের সন্ধ্যা। নেপথ্যে বিয়ের গান, জয়া, বীথি, ক্যারল আর মৌমিতা মেহেন্দি করছে)
ক্যারল— কী পারফেক্ট সিমেট্রি, মৌ! ইউ আ রিয়াল আর্টিস্ট। কোথায় শিখেছো?
বীথি— আর্ট কলেজ অফ বেহালা।
জয়া— এই, তোরা ওর লেগ পুল করা বন্ধ করবি? ক্যারল, এসব আমাদের ট্র্যাডিশন, শখের ব্যাপার, সব মা-মাসিদের কাছে শেখা। নো ফর্মাল ট্রেইনিং। এইভাবেই চলে আসছে সেঞ্চুরিস আফটার সেঞ্চুরি।
ক্যারল— ওরাল ট্র্যাডিশন। কামিং ডাউন থ্রু সেঞ্চুরিস ফ্রম দি মাস্টার টু দি ডিসাইপল। দিস ইস ইন্ডিয়া।
মৌমিতা— ওরে বাবা, ক্যারল কী সব বলছে। আসলে আমি না খুবই ইগনোর্যান্ট, এইসব আসলে জয়ামাসির কাছে শেখা। যদি ভালো লাগে তো সে তোমার ফর্সা হাতের জন্য। চয়ন ইজ ভেরি লাকি।
ক্যারল— আই থিংক, আই অ্যাম দি লাকি ওয়ান।
জয়া— সো সুইট। ক্যারল, মাই ডিয়ার যতদিন পারো এই অহেতুক ভালোলাগাটুকু বাঁচিয়ে রেখো। রিয়্যালিটি যাই হোক না কেন, কীপ বিলিভিং ইন লাভ। যতদিন পারো।
বীথি— (দর্শকদের দিকে) আচ্ছা বিয়েটা কার শুনি, আমার না ওর? আমাকে যে এরা পাত্তাও দিচ্ছে না, মেমসাহেবকে নিয়েই সবাই ব্যস্ত। অমিমাসি থাকলে এমনটা কিছুতেই হতো না। (হঠাৎ চমকে ওঠে) একি তুই?-
(হাতে বিরাট একটা সাজানো থালা নিয়ে মধু ঢোকে)
মধু— মা তত্ত্ব পাঠিয়েছেন।
(মধু জয়াকে প্রণাম করে)
জয়া— থাক থাক। এসব আবার কী করেছিস?
বীথি— অমিমাসি কোথায়? তোর হাত দিয়ে পাঠিয়েছে কেন, নিজে আসতে কী হয়েছিল?
মধু— মা একটু ব্যস্ত আছে। বিয়ের সময় আসবে।
বীথি— বিয়ের সময় আসবে! রিয়ালি? আমার বিয়েতে অমিমাসি শুধু নেমন্তন্ন খেতে আসবে! বল না, চুপ করে আছিস কেন? আরো যা যা কিছু বলার আছে সব বলে ফ্যাল!
মধু— না, না ওরকম করে বলছিস কেন? আসলে মায়ের শরীরটা একটু খারাপ। চলি তাহলে?
জয়া— মধু, শুকনো মুখে যাস না, একটা মিষ্টি অন্তত খেয়ে যা।
চয়ন— আরে মধু কেমন আছিস। বোস, অন্য বন্ধুরা এসে পড়লো বলে। এরা মেহেন্দি করবে আর আমরা সিঙ্গল মল্ট সেবা করবো।
মধু— তোরাই খা। আমি মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।
চয়ন— সে কী রে? কবে ছাড়লি?
মৌমিতা— খুব ভালো করেছিস। (জয়াকে) মাসি এসো না, আমার হাতটা একটু করে দাও।
জয়া— তাই ভালো। চয়ন তুই ভেতরে যা, তোর মেসো ওদিকে হা-পিত্যেশ করে বসে আছে। আর শোন, এইটাও নিয়ে যা না, কিচেনে রেখে দে (তত্ত্বের ডালাটা এগিয়ে দেয়)।
বীথি— চয়ন শোন, কিচেনে নয়, ওটা আমার ঘরে রেখে দে একটু প্লীজ।
চয়ন— আচ্ছা, রেখে দিচ্ছি, তুই চিন্তা করিস না। আচ্ছা মেসো কোথায়? মেসোর ফেভারিট জিনিস নিয়ে এসেছি--
(চয়ন বেরিয়ে যায়। জয়া মৌমিতার হাতে মেহেন্দি লাগাচ্ছে। ক্যারল আর বীথি মঞ্চের অন্যদিকে সরে যায়)
ক্যারল— ইজ দেয়ার সামথিং রং উইথ দিস গাই, মধু? হি লুকড উইয়ার্ড।
বীথি— ও ছোটবেলা থেকেই ওইরকম। টিপিক্যাল বাঙালি, একদিকে যেমন ইমোশন্যাল আর পজেসিভ, অন্যদিকে তেমনি ভীতু। ওর কথা ছাড়ো, আমি না তোমাদের কথা শুনতে চাই। তোমরা কেমন করে মিট করলে, কেন প্রেমে পড়লে, তোমাদের মধ্যে কোন জিনিসগুলো কমন আর কোনগুলো অসহ্য। আচ্ছা নিউ জার্সিতে তোমরা নাকি একসঙ্গে থাকো? চয়নকে কী করে রাজি করালে বলো না? মানে ও তো ভীষণ প্রুড, লাইক দি জ্যাঠামশাই।
ক্যারল— হোয়াট?
বীথি— ওই মানে, খুব পিউরিটান টাইপের আরকি। যাকে ভালোবাসে, পারলে তাকে একটা কৌটোর মধ্যে পুরে রাখে।
ক্যারল— রিয়ালি? তোমার বুঝি ওইরকম এক্সপিরিয়েন্স।
বীথি— ও ইয়েস। ওর জন্যই তো আমার নায়িকা হবার শখ ঘুচলো, এখন দেখো কী সুন্দর বিয়ে করে তোমাদের দেশে রওনা হচ্ছি।
ক্যারল— বীথি, আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড। কী বলছো তুমি?
(দুজনে ফিসফিস করে কথা বলছে। ওদিকে জয়া আর মৌয়ের গলা শোনা যায়)
জয়া— মৌ, এক সপ্তাহ হয়ে গেল, দুশ্চিন্তায় আমার রাত্তিরে ঘুম হচ্ছে না। কেন যে সেদিন ওইরকম মেজাজ খারাপ করে ফেললাম। অষ্টমী এখানে নেই, এখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে জানিস।
মৌমিতা— তুমি কেন এরকম করছো মাসি? আমরা সকলে তো রয়েছি, সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে দেখো। মানে, বীথি চিরকালই একটু খাপছাড়া, আনপ্রেডিক্টেবল, তাও দেখো শেষমেশ ওর বিয়েটা তো ভালোই হচ্ছে, সেটা মানবে নাকি? ও মাই গড, রাজর্ষি কাল আসছে, আমি না খুব এক্সসাইটেড।
জয়া— ইজ শী ম্যানিপুলেটিভ? আসলে কাজের চাপে ছোটবেলা থেকে ওকে যথেষ্ট সময় দিইনি। মধু কীরকম করে তাকাল দেখলি? হয়ত আমারই দোষ।
মৌমিতা— মধুটা ওইরকমই। মাসি, বীথি ম্যানিপুলেটিভ নয়, প্যাশনেট। তোমার একমাত্র মেয়ে। ওর বিয়ের সময় তোমার দুশ্চিন্তা হবে, এটা স্বাভাবিক। আর ভুল বোঝাবুঝি, সে তো মানুষ মাত্রেই হয়।
(জয়া কিছু না বলে মেহেন্দি লাগাতে থাকে)
বীথি— চয়ন আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল, বাট আই লস্ট হিম। আমারই দোষ, আমি রাখতে পারিনি।
ক্যারল— বুঝতে পারছি, বীথি, থ্যাংকস ফর বিয়িং সো ফ্র্যাঙ্ক উইথ মি। আই অ্যাপ্রিসিয়েট ইট।
বীথি— শুধু যদি অমিমাসি একবার এসে দাঁড়াতো, তাহলে আমার এত ভয় করতো না।
ক্যারল— ডিয়ার বীথি, আই উইল স্ট্যান্ড বাই ইউ ইফ থিংস এভার গেট রং। দিস, আই প্রমিস।
বীথি— তোমার হিংসে হচ্ছে না...
ক্যারল— তোমার হচ্ছে না?
বীথি— হচ্ছে।
ক্যারল— আমারও হচ্ছে। দ্যাটস অল রাইট। উই আর বোথ বিগ গার্লস, উই ক্যান হ্যান্ডল ইট।
(হন্তদন্ত হয়ে চয়ন ঢোকে)
চয়ন— জয়ামাসি, এখানে হিতেশকে কে ডেকেছে? হোয়াই ইজ হি হিয়ার?
বীথি— হিতেশ? হিতেশ কী করে জানলো? আমি তো ওকে কিছু বলিনি! নিশ্চয় মধু!
(হুইলচেয়ারে হিতেশ ঢোকে। মধু ওকে ঠেলে নিয়ে আসছে)
হিতেশ— কনগ্রাচুলেশনস বীথি। দেখো দেখি, শাদির সময় পুরনো দোস্তদের ইয়াদ করোনি, তাও তারা ঠিক হাজির হয়েছে। এই মধু ব্যাটা আমাকে কত্ত ডিসকারেজ করলো, বলল আমাদের দেখলে নাকি তোমার গুসসা হবে। আমি বললাম বীথি ইজ নট দ্যাট আনস্পোর্টিং। অ্যাম আই রং?
চয়ন— ইউ আর নট ওয়েলকাম হিয়ার হিতেশ। আর মধু, তুই তো সব জানিস, তাও আজকের দিনে তুই কী করে ওকে নিয়ে আসলি?
মধু— মাপ করেন বাবুমশায়, চাকরের একটা ভুল হয়ে গেছে। বলেন তো কান ধরে ওঠবোস করি?
জয়া— কী বলছিস মধু? তোকে না আমরা ছেলের মতন মানুষ করেছি, লেখাপড়া শিখিয়েছি, কাজ দিয়েছি! তোর মুখে এইরকম বাঁকা কথা?
মৌমিতা— মধু, আমরা এক কলেজে পড়েছি, এখানে আমরা সবাই তোকে বন্ধু বলেই মনে করি। বিশ্বাস কর।
মধু— বন্ধু! তুই আমার বন্ধু চয়ন? গার্লফ্রেন্ডের সামনে আর কতো উদার হবি বলতো?
হিতেশ— না না, বন্ধু তো বটেই। সবাই বন্ধু। শুধু কেউ কেউ ব্রোকেন, হ্যান্ডিক্যাপড, য্যায়সে এই রকম. লেকিন চয়ন ভাইয়া, তুমি এতো গুসসা হয়ে যাচ্ছ কেন? মধুর কাছে শুনলাম বীথি ইস ওয়েডিং অ্যান্ড মুভিং অ্যাব্রড, তাই ভাবলাম দেখা করে একটা ছোটিসি গিফট দিয়ে আসি। হোয়াটস রং উইথ দ্যাট জয়াআন্টি।
জয়া— না না প্রবলেম কিছু না তবে তুমি আবার কষ্ট করে আসলে কেন? দাও আমাকে দাও।
বীথি— না, মা আমার জন্য ও গিফট এনেছে। আমিই নেবো। হিতেশ দাও।
(হিতেশ একটা প্যাক করা ছোট্ট বাক্স বার করে)
হিতেশ— থ্যাঙ্ক ইউ বীথি, অনেক অনেক বধাই অ্যান্ড জেনুইন গুড উইশেস (বীথির হাতে বাক্সটা দেয় কিন্তু হাত ছাড়ে না। বীথি একটু নিচু হয়, হিতেশ ফিসফিস করে কথা বলে) নো কপিজ এনিহোয়ার, আই গ্যারান্টি। বাই বীথি। মধু লেট আস গো নাউ
জয়া— হিতেশ, একটু বসো, কিছু অন্তত মুখে দাও।
হিতেশ— মাপ চাইছি আন্টি, আমি নর্মাল খাবার খেতে পারি না। আই হ্যাভ আ স্টম্যাক টিউব। আচ্ছা আলবিদা, সবাইকে প্রণাম।
(নেপথ্যে গান)
পড় নি কাহার নয়নের ভাষা
বোঝ নি কাহার নয়নের আশা
দেখনি ফিরে কার ব্যাকুল প্রাণের সাধ এসেছ দলে
না বুঝে
ষষ্ঠ অঙ্ক
(বীথির বাড়ি। বিয়ের দিন বিকেল। সানাই বাজছে)
ক্যারল— বাব্বা সেই ভোর থেকে কত কিছু না হচ্ছে। তোমাদের এই থ্রী-ডে ম্যারেজ সেরিমনি, কী করে যে সামলাও তোমরাই জানো।
মৌমিতা— জাস্ট ওয়েট মেমসাহেব, তোমাদের বিয়েতে কী কাণ্ড করি দেখে নিও।
ক্যারল— শিওর মৌ, অবশ্য যদি বিয়েটা হয়।
মৌমিতা— কী বলছো তুমি! বিয়ে তো তোমাদের হবেই।
ক্যারল— কেন? আমরা লীভ টুগেদার করি বলে। আই অ্যাম আফ্রেইড আমাদের দুনিয়ায় ওটা নিয়ম নয়। এখানে এসে থেকে আমার কেমন যেন লাগছে। হ্যাভ ইউ সীন চয়ন অ্যান্ড বীথি-
মৌমিতা— প্লীজ তুমি ভুল বুঝো না, ওরা আসলে কতগুলো এক্সপেরিএন্স শেয়ার করে, সেগুলো, কী বলবো- নট নাইস। বিলিভ মি ওরা শুধু একটা ক্লোজার খুঁজছে।
ক্যারল— আই হোপ সো। ক্লোজার মে বি পেইনফুল।
(নেপথ্যে জয়ার উত্তেজিত গলা, তারপর বীথির চীৎকার শোনা যায়। দুজনেই চমকে ওঠে)
“রাজ তুমি কী বলছ! আমার ছবি? কে তোমাকে পাঠিয়েছে”
(জয়া ঢোকে)
জয়া— কে করলো? এরকম নোংরা কাজ কে করলো?
ক্যারল— হোয়াট হ্যাপেনড? প্লীজ তোমরা একটু খুলে বলো। তোমাদের এই সিক্রেসি আমার অসহ্য লাগছে।
মৌমিতা— জয়ামাসি কী হয়েছে?
জয়া— কেউ একজন কিছু ছবি আর করেস্পন্ডেনস রাজর্ষির কাছে পাঠিয়েছে। সেন্ডার কে ট্রেস করা যাচ্ছে না। দি কনটেন্ট ইজ স্ক্যান্ডালাস! শুধু বীথির জন্য নয়, চয়নের জন্যও। আমি এটাই ভয় করছিলাম। অষ্টমী আর ওর ছেলে, দে আর হ্যাভিং দেয়ার রিভেঞ্জ।
মৌমিতা— এরকম বোলো না প্লীজ। যাই হোক না কেন অমিমাসি প্রাণ থাকতে বীথির কোনো ক্ষতি হতে দেবে না।
জয়া— কী করে জানলি? জেলাসি মানুষকে কোথায় নামিয়ে নিতে পারে জানিস?
বীথি— কার জেলাসি মা?
জয়া— কী বলতে চাস রে তুই? ওই অষ্টমীই তোর আসল মা, আমি কেউ নই? তোর জন্য সকলের মুখে চুনকালি লাগতে চলেছে, তুই জানিস। রাজর্ষির বাবা আমার কলেজের বন্ধু, বিয়েটা এইভাবে ভেঙে গেলে আমি ওকে কী মুখ দেখাবো!
ক্যারল— ফরগিভ মি, কিন্তু আমার মনে হয়, বীথি অ্যান্ড রাজ শুড ফিগার দিস আউট দেমসেলভস। পার্সোন্যালি আমি এটুকু বলতে পারি যে আমার ফিয়ান্সেঁ যদি উড়ো চিঠি পড়ে লাইফ ডিসিশন নেয়, তাহলে তার সঙ্গে লাইফ শেয়ার করার প্রশ্নই ওঠে না।
বীথি— থ্যাঙ্ক ইউ ক্যারল।
(চয়ন ঢোকে)
চয়ন— বীথি হোয়াট দা হেল ইজ গোয়িং অন?
বীথি— সে কথা তো তুই আমাদের বলবি চয়ন।
জয়া— চয়ন, মধু কোথায়?
চয়ন— মধুকে সকাল থেকে দেখিনি। কিন্তু একটা ইমেইল পেয়েছি।
মৌমিতা— মানে, তোকেও পাঠিয়েছে। ফোন দেখা। হ্যাঁ ওই একই চিঠি।
চয়ন— বীথি তুই এটা কী করে অ্যালাউ করলি?
বীথি— তুই কী করে একটা লোককে খুন করতে গেলি চয়ন?
ক্যারল— স্টপ দিস ননসেন্স, ইউ বোথ! এটা একটা অ্যানোনিমাস স্ল্যান্ডার, তোমরা এটাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছ কেন? স্পীক ট্রুথ ফর গডস সেক।
মৌমিতা— অমিমাসি! অমিমাসি এসেছে!
(অষ্টমী, মধু আর মৌসুমি ঢোকে)
জয়া— তোমরা! কোন সাহসে তোমরা এখানে এসেছ! বিয়েটা ভেঙে শখ মেটেনি!
মধু— আমি নিজের ইচ্ছেয় আসিনি, মা জোর করে ধরে এনেছে।
চয়ন— আমি তোর এগেইন্সটে লীগাল অ্যাকশন নেবো মধু। দিস ইজ ক্যারাকটার অ্যাসাসিনেশন। স্কাউন্ড্রেল, তুই এত নিচে নামলি, বন্ধুদের বিয়ে ভাঙার জন্য।
অষ্টমী— বৌদি, তুমি সরে যাও এখন নাটক করার সময় নেই। আর চয়ন, সব কথা না জেনে চিৎকার কোরো না। বিয়ে ভাঙা এত সহজ নয়। বৌমা বলো তোমার যা বলার আছে।
(কোলাহল। সবাই একসাথে কথা বলছে)
ক্যারল— প্লীজ বি কোয়ায়েট অ্যান্ড লেট হার টক। প্লীজ!
মৌসুমি— ইমেইল আমি পাঠিয়েছি। আর কারো কোন দায়িত্ব নেই।
(সবাই চুপ)
ক্যারল— তুমি পাঠিয়েছ! বাট হোয়াই?
মৌসুমি— ধরে নাও হিংসে। তোমার বর যদি সারাক্ষণ আরেকজন মহিলাকে নিয়ে অবসেসড হয়ে থাকে, তার জন্য বদনাম কুড়োয়, তাহলে তোমারও হিংসে হবে রাগ হবে।
মধু— কিন্তু তুমি! তুমি কী করে এসব কথা জানলে।
মৌসুমি— জানতাম না তো? তোমাকে যে চোখ বুজে বিশ্বাস করতাম মধু। মা আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো।
মধু— মা! মা দেখালো মানে।
অষ্টমী— বৌদি, শান্ত হও।
জয়া— কী যে হচ্ছে জানি না। কারো ওপরে ভরসা করার উপায় তো নেই। হয়তো তোমাদের মা-ছেলের ওপর অবিচার করেছি, তাই তোমরা প্রতিশোধ নিতে চাইছো। কিন্তু মৌসুমির কাছে আমি তো কোন দোষ করিনি। বরং নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের বিয়ে দিয়েছি। ও কেন আমার মেয়ের বিয়ে ভাঙতে চাইবে?
অষ্টমী— বলো বৌমা। মন খুলে যা বলার বলো, কাউকে ভয় পেও না।
মৌসুমি— ওই ফটোশ্যুট আর নেশার ঘোরে বীথির আজেবাজে ইমেইল। ফাইলটা হিতেশ নষ্ট করে দিয়েছিল, ওর ধারণা শেষ কপিটা ও বীথিকে দিয়ে গেছে। বেশ নাটকীয় তাই না? কিন্তু হিতেশ জানতো না যে মধু তার আগেই একটা কপি চুরি করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল।
মধু— হ্যাঁ দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি তো কাউকে ব্ল্যাকমেইল করতে চাইনি, কারো বিয়েতে ভাংচি দিতেও চাইনি। বিয়ে হয়ে যাবার পরে বীথিকে দেখিয়ে ওটা নষ্ট করে দিতাম। আমার একটা ইমোশনাল ক্লোজার হতো। তোমরা তার খোঁজ পেলে কী করে?
অষ্টমী— ও পায়নি। আমি তোর ফোন আর ল্যাপটপ থেকে খুঁজে পেয়েছি। তার জন্য ওর সাহায্য লেগেছিল তাই ওকে না জানিয়ে কাজটা করতে পারিনি। বউমা তো তোদের কম্পিউটারের ভাষায় তুখোড়, অন্তত তোর থেকে অনেক ভালো।
মধু— তুমি! মা তুমি আমার ওপর স্পাই করেছো! কেন?
অষ্টমী— আবার কেন জিগ্যেস করচ্ছিস। পিঠের চামড়া তুলে নেওয়া উচিত তোর।
বীথি— (ফোন দেখে) রাজ টেক্সট করেছে, দশ মিনিটের মধ্যে আসছে। নাটক শেষ।
জয়া— ব্যাস সব শেষ! কেউ একজন গিয়ে বাইরের আলোগুলো নিভিয়ে দাও।
মধু— সুমি, যা বলার বলো, আমাদের যেতে হবে।
মৌসুমি— বলছি। কাকিমা, বীথিদি আমার দিকে তাকিয়ে দেখো। আমি তো একটা সাধারণ মফঃস্বলের মেয়ে, তোমাদের তুলনায় আমি কিছু না। কিন্তু তাই বলে আমার কী রাগ, দুঃখ, অভিমান কিছুই থাকতে নেই।
বীথি— সবই আছে সুমি। কিন্তু তোমার কাছ থেকে এটা আনএক্সপেক্টেড। তাছাড়া তোমার মোটিভটাও আমি বুঝতে পারছি না।
মৌসুমি— বলছি না, আমার বর তোমাকে নিয়ে অবসেসড বীথিদি। ও তোমাকে পুজো করে। আমি জানতাম না কিন্তু মা জানতো, মায়ের ভয় ছিল। প্রথমে বিশ্বাস করিনি কিন্তু মায়ের কথায় সেদিন দুপুরবেলায় আমি ওর ল্যাপটপ খুলে দেখলাম। পাসওয়ার্ড বীথি। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছিল। সব কথা শুনলাম, জানলাম, বুকটা যেন ফেটে গেল।
মৌমিতা— কী সাংঘাতিক। তারপর?
মৌসুমি— মা কীরকম শক্ত হতে পারে, তুমি তো জানো বীথিদি। পরশুদিন তুমি আর চয়নদা চলে যাবার পর দুপুরবেলায় মধু গেল হিতেশের বাড়িতে। তার মধ্যে যা হবার হয়ে গেছে। ও ফেরত আসতেই মা সোজা ওকে কনফ্রন্ট করলো।
ক্যারল— (ফিসফিস করে চয়নকে) সো ইউ ওয়েন্ট দেয়ার উইথ বীথি। ইউ কুড হ্যাভ টোল্ড মি। হোয়াই ডিড ইউ লাই?
চয়ন— (ফিসফিস করে) আই অ্যাম সরি ক্যারল।
মধু— কনফ্রনটেশন না থ্রেট বলো সুমি। ফাইলগুলো মুছে ফেলতে হবে, বীথির বিয়ের সময় যদি এক ফোঁটা গণ্ডগোল হয়--
অষ্টমী— তাহলে তুই আমার মরা মুখ দেখবি, আর তার আগে বাড়িটা রামকৃষ্ণ মিশনে দান করে দেবো। সবাই জানে আমার কথার নড়চড় হয় না।
মৌসুমি— একটা স্কুলের বাচ্চার মতন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকুনি খেল মানুষটা। আমি দেখলাম একটা ভাঙাচোরা, রোম্যান্টিক মানুষের ওপর জীবনের নির্দয় চাবুক-- লেখক হতে পারলো না, মুভি ডিরেক্টর হতে পারলো না, যে মেয়েটাকে ছোটো থেকে ভালবেসেছিল তার কাছে অবজ্ঞা ছাড়া কিছু পেল না, এখন মা-বউয়ের বিশ্বাসটুকুও হারালো।
বীথি— আর সেই মেয়ে এখন বিয়ে করে, অতীত মুছে ফেলে আমেরিকায় চলে যাচ্ছে। তাইতো?
মৌসুমি— তাই বটে। তখন কোথা থেকে জানি প্রচণ্ড রাগ হল। দুঃখ আর অভিমান ছাপিয়ে তোমার আর চয়নদার ওপর অসম্ভব একটা রাগ আমাকে পেয়ে বসলো বীথিদি। আসলে যে মানুষটার সঙ্গে তুমি বিছানা ভাগ করো, যার সন্তান তোমার শরীরের ভেতরে বড়ো হয়, তার ওপর একটা অবুঝ অধিকারবোধ জন্মায়, তার অপমান তোমার গায়েও লাগে। সব কিছু জানার পরও লাগে। তোমরা হয়তো বুঝবে না।
অষ্টমী— এইটাই বুঝতে পারিনি গো বৌদি। একেবারেই সন্দেহ করিনি যে বউমাও একটা কপি নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। রাজর্ষির ইমেইল জোগাড় করতে আর কী লাগে, ওই ল্যাপটপেই তোমাদের সব ইমেইল একে-তাকে ফরোয়ার্ড করা আছে না।
মৌসুমি— ঝোঁকের মাথায় কাজটা করে ফেলেই মনে হলো, কী সর্বনাশ। মা তো ভাববে ও পাঠিয়েছে! তখন লজ্জার মাথা খেয়ে মাকে সব খুলে বললাম। তারপর তো এই দেখছো। আমাকে পুলিশে দিলে দাও কিন্তু ওকে--
বীথি— যাকগে, রাজ এসে গেছে। তোমরা বোসো, কথাবার্তা যা বলার আমিই বলে আসি।
জয়া— না, না চল তোর সঙ্গে আমিও যাচ্ছি, সত্যিই তো একটা ভুল বোঝাবুঝি-
বীথি— না মা, এটা আমার ব্যাপার, আমাকে ডীল করতে দাও। তোমরা অনেক করেছো, ফর বেটার অর ফর ওয়ার্স।
(কয়েক মিনিটের স্তব্ধতা। রাজর্ষি আর বীথি পাশাপাশি ঢোকে তারপর একসঙ্গে অষ্টমীকে প্রণাম করে)
রাজর্ষি—বীথি বলল সবার আগে আপনার আশীর্বাদ নিতে, তাই-
(দুজনে জয়াকে প্রণাম করে)
জয়া— সব ঠিক আছে তো রে?
বীথি— সব ঠিক আছে মা। ওর কাছে এটাই এক্সপেক্ট করেছিলাম। আমাদের জেনারেশনের কেউই সারা জীবন ধরে অতীতের ভূত ঘাড়ে করে বইতে থাকে না। তোমরা বোধহয় জানো না আমার সঙ্গে আলাপ হবার আগে তোমাদের এই লালটু ছেলেটাও না আরেকজনের সঙ্গে লীভ টুগেদার করতো। ওর বাবা-মা জানলে মূর্ছা যাবে, তাই না রাজ?
রাজর্ষি—বীথি চুপ করো। আমরা সব জেনেশুনেই এই কমিটমেন্টে যাচ্ছি। আমাদের ব্যাচেলার লাইফে কার কী হয়েছিল, তাই নিয়ে আমরা কেউই মাথা ঘামাই না।
জয়া— হ্যাঁ হ্যাঁ তাইতো হওয়া উচিত। কিন্তু তুমি যে আগেই এসে পড়লে, তোমার মা, বাবা সবাই-
রাজর্ষি—সবাই আসছে।
মৌমিতা— অ্যাই বীথি ওর হাত ছেড়ে দে বলছি। এখন কয়েক ঘণ্টা, তুই আর ও অন্য ঘরে থাকবি। ওরে বাবা, এতো খাটাখাটনি সব ভণ্ডুল হতে বসেছিল। জয়ামাসি শিগগিরই চলো ...
অষ্টমী— চলো, এবার আমরাও যাই।
(জয়া এসে অষ্টমীর হাত ধরে)
জয়া— যাবে মানে। তোমার মেয়ের বিয়ে, আর তুমি থাকবে না? সব আমাকে একা সামলাতে হবে?
অষ্টমী— বৌদি!
জয়া— (মধু আর মৌসুমিকে) তোদের ওপর দিয়ে অনেক গেছে। আমাকে মাপ করিস, আর রাগ করে চলে যাস না। যা হয়েছে তা হয়েছে, তার জন্য বীথির দায়িত্বও তো কম নয়। হৃদয় নিয়ে খেলা মানে আগুন নিয়ে খেলা। ভুলে যা এসব। প্রার্থনা কর ও যেন সুখে থাকে।
চয়ন— ক্যারল, এসো।
ক্যারল— গিভ মি আ মিনিট, চয়ন। আসছি। আচ্ছা সেদিন কি তুমি সত্যিই হিতেশকে অ্যাটাক করেছিলে?
বীথি— না ক্যারল। ও পুরোপুরি ইনটক্সিকেটেড ছিল বাই মাল্টিপল সাবস্ট্যানসেস। বারান্দা থেকে বমি করতে গিয়ে রেলিং উল্টে পড়ে যায়। আই-উইটনেস আছে, চয়ন ঘটনাটার পরে এসেছিল। ও না আসলে ওই লোকদুটো হয়তো আমাকে তুলে নিয়ে যেত, তারপর আরেকটা খবর শুনতে পেতে সবাই। মা বলল না, আগুন নিয়ে খেলা।
(ক্যারল একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। মৌমিতা এগিয়ে আসে, চয়নকে টেনে একদিকে নিয়ে যায়)
মৌমিতা— বাকি রইলো এই দেবদাস। ওঃ বাবা, আর পারি না। চয়ন গাধার মতন মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকিস না, এই নে, এখুনি ওকে প্রপোজ কর। নাহলে বহুৎ পস্তাবি এই বলে রাখলাম। যা, চল, আগে বাড়। ওর আর আমার আঙুলের সাইজ এক, আমি দেখে নিয়েছি।
(নিজের আঙুল থেকে আংটি খুলে দেয়)
চয়ন— থ্যাঙ্ক ইউ মৌ, কিন্তু আমার নিজের আংটি আছে। অনেক দিন ধরেই আছে, শুধু সাহসে কুলোচ্ছিল না।
(চয়ন পকেট থেকে আংটি বার করে ক্যারলের সামনে দাঁড়ায়, তারপর হাঁটু গেড়ে বসে)
চয়ন— ক্যারোলিন নিকোল অ্যারোনসন, উইল ইউ ম্যারি মি।
ক্যারল— ইয়েস। ও মাই গড ইয়েস। বাট প্রমিস দ্যাট ইউ ওন্ট লাই টু মি এভার এগেইন।
চয়ন— প্রমিস।
ক্যারল— ইউ লায়ার।
(চয়ন ক্যারলের আঙুলে আংটি পরিয়ে দেয়। বীথি ও রাজর্ষি ওদের পাশে এসে দাঁড়ায়। বাকিরা ওদের দুপাশে। হুইলচেয়ার চালিয়ে হিতেশ ঢোকে। নেপথ্যে গান। যবনিকা)
ওগো বধূ সুন্দরী
তুমি মধু মঞ্জরী
পুলকিত চম্পার, লহ অভিনন্দন
ওগো বধূ সুন্দরী।