গবেষণার কাজে অনেক বার, অনেক দিনই হেলা কোষ ব্যবহার করতে হয়েছে আমাকে। এই কোষের ইতিহাস নিয়ে এইটুকুই শুধু জানতাম যে, হেনরিয়েটা ল্যাকসের জরায়ুর ক্যান্সারাস টিউমার টিসু থেকে এই অমর মানব কোষ-পরম্পরার বা cell line-এর সৃষ্টি। এর পর আমার ছেলে যখন হাইস্কুলে পড়ে, তখন তার জুনিয়র ইয়ারের অ্যাডভান্সড ইংরেজি পাঠ্যক্রমে ছিল ক্রাউন পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত রেবেকা স্কুলট-এর লেখা তাঁর প্রথম প্রবন্ধের বই ``দ্য ইমর্টাল লাইফ অফ হেনরিয়েটা ল্যাকস’’। ২০১০ সালের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া নতুন বইগুলির মধ্যে একটি, যা ছ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলারের তালিকায় দাপটে রাজত্ব করে এবং অবশেষে প্রথম স্থানে পৌঁছায়। বিজ্ঞান, প্রকৌশল বা চিকিৎসা শাস্ত্রের বিষয়গুলি মানুষকে সহজভাবে বোঝানোর জন্য সাহায্য করে যে ন্যাশনাল একাডেমি অফ কমিউনিকেশন, তাদের বিচারে ২০১১ সালের সেরা সৃজনশীল কাজের জন্যও বিজয়ীর শিরোপা পায় বইটি। আর আমাদের এমনই সৌভাগ্য যে কোনো ইলেকট্রনিক পিডিএফ কপি নয়, ঝকঝকে পেপারব্যাকে ছাপা আস্ত বইটাই আমার ছেলে স্কুল থেকে উপহার পায়। মা ছেলে মিলে নিঃশেষে আস্বাদন করি হেনরিয়েটা ল্যাকসের সেই অসাধারণ জীবনকাহিনী। পড়ি, আর মনের মধ্যে কেমন ঝড় ওঠে। এই লেখাটি পড়ছেন এমন কোনো ব্যক্তি নেই যিনি হেনরিয়েটার কোষ (যার কোড নাম ``হেলা’’) থেকে উপকৃত হননি। কিন্তু আমরা বেশিরভাগই সে-কথা জানি না। এই লেখায় ‘হেলা’ কোষ কী, কীভাবে আমরা সবাই এর উপকার পেয়েছি ও পাচ্ছি, আর এমনকি এই নিয়ে এখনো যে কিছু বিতর্ক চলছে তার কিছু আভাস দেয়ার চেষ্টা করছি।
এই ফাঁকে চট করে একটা কথা বলে রাখি, শুধু ওই বইটাই নয়, লেখিকা রেবেকা স্কুলটও কিন্তু সাধারণ মানুষ নন। অনিয়মিত উপস্থিতির জন্য আপাতদৃষ্টিতে ক্লাস নাইন পাশ করতে ব্যর্থ হন তিনি। স্কুলট তখন একটি বিকল্প উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এরপর পোর্টল্যান্ড কমিউনিটি কলেজে কোর্স করার সময়েই তিনি প্রথম হেনরিয়েটা ল্যাকস সম্পর্কে জানতে পারেন এবং মিসেস ল্যাকসের জীবনী তাঁকে এতটাই নাড়া দেয় যে, সর্বসাধারণের কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার সংকল্পে লেখনী তুলে ধরেন তিনি।
হেনরিয়েটা ছিলেন সাধারণ দরিদ্র; শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত কৃষ্ণাঙ্গ রমণী, আমাদের বৈষম্যময় সমাজব্যবস্থার একেবারে নিচুতলার মানুষদের একজন। হেনরিয়েটার শরীর থেকে তার সম্মতি বা জ্ঞান ছাড়াই নেওয়া হয়েছিল যে বিশেষ ধরনের কোষ, জৈব বিজ্ঞানকে অন্য একটা স্তরে উন্নীত করে দিয়েছে সেই কোষ। পোলিও এবং এইচপিভি ভ্যাকসিনের উন্নয়ন, ক্যান্সারের চিকিৎসা এবং এইডস গবেষণায় দুর্দান্ত অবদান রেখেছে এই কোষ। ২০০১ সাল থেকে, হেলা কোষ নিয়ে সম্পাদিত গবেষণার ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস এবং সার্ভিকাল ক্যান্সারের মধ্যে গূঢ় সংযোগ (২০০৮, হারাল্ড জুর হাউসেন), এবং ক্রোমোজোমের অবক্ষয় রোধে টেলোমারেজ এনজাইমের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা (২০০৯, এলিজাবেথ ব্ল্যাকবার্ন, ক্যারল গ্রাইডার এবং কানাডিয়ান আমেরিকান বায়োলজিস্ট জ্যাক সস্ট্যাক) পৃথিবী চিরকাল মনে রাখবে। বিজ্ঞান সাধনার নিরন্তর জয়যাত্রায় হেনরিয়েটার নাম অমর করে দিয়েছে তাঁরই কোষ। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের সমান সেই অমর কোষের আবিষ্কারের ঘটনা আরেকবার আপনাদের সঙ্গে আজ ফিরে দেখতে চাই।
আমাদের এই কাহিনীর সূত্রপাত ১৯৫১ সালে, যখন জাতিগত বিচ্ছিন্নতা আমেরিকান সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মোক্ষম ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। শুধুমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার অপরাধে যে সময় ক্যানসাসের টোপেকার-8 বছরের মেয়ে লিন্ডা ব্রাউনের কোনো অধিকার নেই তার বাড়ি থেকে হাঁটা দূরত্বে সাদাচামড়ার ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে যাবার। পৃথকীকরণের কারণে, তাকে বাসে করে যেতে হয় আরও অনেক দূরের কালো শিশুদের জন্য নির্ধারিত স্কুলে। ১৯৫৪-এর দেশজোড়া নাগরিক অধিকার আন্দোলন তখনও উত্তাল হয়ে আছড়ে পড়েনি মার্কিন সমাজের বুকে।
তেমনই এক সময়ে মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোরে বাস করতেন ৩১-বছর বয়সি আফ্রিকান আমেরিকান হেনরিয়েটা ল্যাকস। পাঁচটি ফুটফুটে ছোট শিশুর তরুণী মা, স্বামী ডেভিড ল্যাকসের সাথে সুখী তাঁর বিবাহিত জীবন। কিন্তু ভাগ্যের আকাশে কখন জানি মেঘ জমতে শুরু করেছিল। ফেব্রুয়ারির এক শীতের দিনে অস্বাভাবিক যোনি রক্তপাতের অভিযোগ নিয়ে জনস হপকিন্স হাসপাতালে আসেন হেনরিয়েটা। সেই সময়ে, জনস হপকিন্স ছিল বাল্টিমোরের বিস্তৃত অঞ্চলের একমাত্র ক্লিনিক যেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হত।
প্রখ্যাত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হাওয়ার্ড জোন্স হেনরিয়েটার জরায়ুর উপর একটি বড়সড়, সন্দেহজনক টিউমার আবিষ্কার করেন। রোগী বা রোগীর পরিবারের কোনো সদস্যের অজান্তেই হেনরিয়েটার টিউমারের বায়োপসির টিসু সংগ্রহ করেন হাসপাতালের চিকিৎসকরা। সেই টিস্যুর একটি অংশ রোগ নির্ণয়ের জন্য যথারীতি প্যাথলজি ল্যাবে পাঠানো হয়। আরেকটি ছোট্ট পেনি আকারের টিস্যুর নমুনা সার্ভিকাল ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ রিচার্ড টেলিন্ডে জনস হপ্কিন্সেরই গবেষক ডক্টর জর্জ অটো গে এবং তাঁর স্ত্রী মার্থা গে-র টিসু কালচার গবেষণাগারে পাঠান।
গে দম্পতি পূর্ববর্তী ত্রিশ বছর ধরে তাই এমন একটি মানব কোষ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলেন, যা ল্যাবরেটরিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য বৃদ্ধি পেতে পারে। আসলে এসবেরই মূলে ছিল ক্যান্সারের নিরাময় খোঁজার প্রতি জর্জ গে-র পরম অভিনিবেশ। তিনি একরকম নিশ্চিত ছিলেন যে এই ধরনের একটি মানব সেল লাইন একবার যদি আবিষ্কার করা যায়, তাহলে সেটাকে মডেল হিসাবে ব্যবহার করে গবেষকরা সহজেই ক্যান্সারের থেরাপি এবং ওষুধ তৈরি করতে পারবেন। যদিও ১৯৫০এর দশকের মধ্যেই বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে প্রাণীকোষের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন, কিন্তু মানুষের সেল লাইন প্রতিষ্ঠার সাফল্য তখনও অধরাই ছিল। গে-রা রাত দিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলেছিলেন এই বিষয়ে। বিভিন্ন উৎস থেকে অগণিত মানব কোষকে বিচ্ছিন্ন করা, কোষগুলোর পুষ্টিসাধনের জন্য বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন উপকরণ, যেমন মুরগির রক্ত, লবণ এবং প্লাসেন্টা এসব দিয়ে কালচার মিডিয়াম তৈরি করা-কিছুই তাঁরা বাদ রাখেননি। কিন্তু কিছুতেই বেশি দূর এগোতে পারছিলেন না। বেশ কিছু কোষ-বিভাজনের পরেই মানব কোষগুলি বংশবিস্তার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়।
হেনরিয়েটার বায়োপসি টিসু যখন এল ওঁদের হাতে, গে দম্পতি একথা কল্পনাও করতে পারেননি যে সেখান থেকে এমন একটা কোষের সন্ধান পাওয়া যাবে, যা চিকিৎসা গবেষণায় একটা বিপ্লব আনবে। এ যাবত তাঁরা হতাশভাবে দেখে যাচ্ছিলেন যে, ক্যান্সার কোষগুলো কয়েকবার মাত্র বিভক্ত হয়েই মরে যায় এবং তাই সেগুলো দিয়ে গবেষণার কাজ বেশিদিন চালানো যায় না। অথচ হেনরিয়েটার কোষগুলি মোটেই সেরকম নয়। মাইক্রোস্কোপে চোখ রেখে বিস্ফারিত হয়ে ওঁরা লক্ষ করলেন যে, কালচার মিডিয়ামে কোষগুলো খুব সহজেই অতি দ্রুত বৃদ্ধি পায়; এক দিনে সংখ্যায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। সত্যি কথা বলতে কি, হেনরিয়েটার কোষগুলো বিভাজনের পর বিভাজন চালিয়েই যায়, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির সঠিক মিশ্রণ সরবরাহে কোনো ঘাটতি হচ্ছে। আরও আশ্চর্যের কথা, অন্যান্য ক্যান্সার কোষের মতো হেলা কোষ কিন্তু কয়েকটি কোষবিভাজনের পরে মারাও যায় না।
ইউরেকা! এই তো খুঁজছিলেন ডক্টর গে। এর আগে তো এ জিনিস কখনও তিনি দেখেননি। অতঃপর ডক্টর গে এই নির্দিষ্ট কোষটিকে আলাদা করলেন, এটিকে সংখ্যায় অনেক অনেক গুণ বাড়িয়ে তুললেন এবং শেষ পর্যন্ত একটা বিশুদ্ধ ‘হেলা সেল লাইন’ শুরু করতে সক্ষম হলেন। শেষ হল এই দুই গবেষকের সুদীর্ঘ অনুসন্ধান পর্ব। আজ সার্থক হল ওঁদের এতদিনের সাধনা। পেরেছেন, পেরেছেন ওঁরা তৈরি করতে সেই আশ্চর্য মানুষের সেল লাইন।
একদিকে যখন আনন্দের বন্যা বইছে গে ল্যাবরেটরিতে, অপরদিকে, তখন, প্যাথলজি ল্যাবরেটরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দ্রুত নিশ্চিত করে যে, দুর্ভাগ্যবশত, হেনরিয়েটার জরায়ুর টিসুটি আসলেই ক্যান্সার। অস্ত্রোপচার এবং সেই সময়কার প্রচলিত ক্যান্সারের চিকিৎসার অঙ্গ হিসাবে হেনরিয়েটাকে রেডিয়াম-থেরাপি দেওয়া হয়। কিন্তু ম্যালিগন্যান্ট কোষগুলি কেবল গবেষণাগারের টেস্ট টিউবেই নয়, হেনরিয়েটার দেহেও তীব্র গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কিছুতেই ঠেকানো গেল না মারণ রোগকে, সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে মাত্র আট মাস পরেই হেনরিয়েটা মারা যান।
১৯৫১ সালের অক্টোবরে. হেনরিয়েটার মৃত্যুর দিনে, জর্জ গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় টেলিভিশনে উপস্থিত হয়ে ঘোষণা করেন যে চিকিৎসা গবেষণায় একটি নতুন যুগ শুরু হয়েছে। মিলে গেছে বিশ্বের প্রথম অমর মানবকোষ যা শরীরের বাইরে পরীক্ষাগারে বেঁচে থাকে এবং তাদের ক্রমাগত বৃদ্ধি করা সম্ভব। তিনি এও জানান যে এই কোষের উৎস হেনরিয়েটা ল্যাকসের সার্ভিকাল টিউমার বায়োপসি-র নমুনা। দাতার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জর্জ গে হেনরিয়েটার নামের প্রথম দুটি অক্ষর অনুসারে এই সেল লাইনের নাম দেন 'হেলা সেল'।
ডক্টর গে এই হেলা কোষগুলি থেকে কখনও মুনাফা অর্জন করেননি। কিন্তু সেগুলি অন্যান্য বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতরণ করেছিলেন। ওই সময় আলাবামার টাস্কেগী ইনস্টিটিউটে পোলিও রোগের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তৈরির কাজ করছিলেন ইমিউনোলজিস্ট জোনাস সালক। এই কাজে তাঁর দরকার ছিল প্রচুর প্রচুর কোষ। খুশিমনে গে হেলা কোষ পাঠিয়ে দিলেন যাতে সেগুলিকে সালকের পরীক্ষার জন্য ব্যাপকভাবে উৎপাদন করা যায়। দেখা গেল হেলা কোষ সহজেই পোলিওমাইলাইটিস ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয় এবং সংক্রামিত কোষগুলি পরিশেষে মরেও যায়। হেলার এই চমৎকারিত্বের জন্য ১৯৫৪ সালে মানুষের করায়ত্ব হয় দেবতার আশিস-সম পোলিও ভ্যাকসিন।
সেই তখন থেকে, হেলা কোষগুলি বিশ্বজুড়ে অগণিত ল্যাবরেটরিতে বেড়ে উঠেছে এবং ল্যাকসের শরীরের ভিতরে তাঁরা যতদিন ছিল তার দ্বিগুণ দীর্ঘ সময় ধরে এখন তারা বাইরে বেঁচে আছে। চিকিৎসা গবেষণা, ওষুধ আবিষ্কার এবং প্রায় ৭০ বছর ধরে মানুষের নানারকম বায়োলজিক্যাল টেস্টিংয়ের জন্য হেলা কোষের ব্যবহার হয়েছে। তাদেরকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে, বিষাক্ত কেমিকাল, রেডিয়েশন ইত্যাদি তাদের উপর ব্যবহার করা হয়েছে--এ সবই বিজ্ঞানের স্বার্থে। যুগ যুগ ধরে হেলা কোষ আমাদের চিকিৎসার উন্নয়ন এবং জ্ঞান বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। এন আই এইচ-এর পাবমেড ডাটাবেসে ১৯৫৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে হেলা কোষের ব্যবহার উদ্ধৃত করে ১১০,০০০টিরও বেশি প্রকাশনা খুঁজে পেয়েছে। হেনরিয়েটা ল্যাকস-এর জীবনী রচয়িতা রেবেকা স্কুলট-এর মতে, হেলা কোষের সাথে জড়িত ১০,০০০টিরও বেশি পেটেন্ট দায়ের করা হয়েছে।
জানলে আশ্চর্য হবেন, বিশ্বজুড়ে আজ যে অতিমারি সৃষ্টি করেছে সেই করোনা ভাইরাস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানার হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করছে হেলা সেল লাইন।
এতক্ষণে আপনারা বুঝতেই পারছেন যে, হেনরিয়েটা এটা জেনে যাবার সুযোগ পাননি যে তাঁর শরীরের কোষ চিকিৎসা গবেষণায় তুমুল আলোড়ন তুলেছে। জানবেনই বা কি করে? যে বছর ক্যান্সার ধরা পড়ে সে বছরই তো তিনি মারা যান। এমনকি তাঁর মৃত্যুর কয়েক দশক পর পর্যন্ত তাঁর পরিবারও হেলা কোষের কথা শোনেননি। হেনরিয়েটার কোষগুলি যে বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে, এই কোষ উৎপাদনের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রবল কর্মকাণ্ড চলছে এবং তারপর বাণিজ্যিকভাবে সেই কোষ ব্যবহার করা হচ্ছে--এসব কোনো খবরই তাঁদের কাছে পৌঁছায়নি। না হেনরিয়েটার স্বামী, না তার সন্তানসন্ততি--কেউই হেনরিয়েটার কোষ থেকে লব্ধ মুনাফার কানাকড়িটিও পাননি। একদিকে যখন চিকিৎসশিল্প হেলা কোষের মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার উপার্জন করে চলেছে, হেনরিয়েটার অভাবী পরিবার তখন দারিদ্রের সঙ্গে রীতিমতো লড়াই করে টিকে আছে। অর্থের অভাবে স্বাস্থ্যবীমাটুকুও তাঁরা জোটাতে পারেননি।
হেনরিয়েটা বা তাঁর আত্মীয়দের কাউকেই বায়োপসি সম্পর্কে কিচ্ছু বলা হয়নি। সেকালে যদিও এটা অস্বাভাবিক ছিল না। মেডিকেল পরীক্ষাগুলোও বিনামূল্যেই করা হত, শুধু ঊহ্য থাকত তার বিনিময়ে বৈজ্ঞানিক জরিপে অংশ নেওয়ার জন্য রোগীদের অলিখিত সম্মতি। স্বভাবতই, হেনরিয়েটার কোষে কী ঘটেছিল সে সম্পর্কেও বেশ কয়েক দশক ধরেই তাঁর পরিবারকে অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সত্য কি কখনো চাপা থাকে? ১৯৭৩ সালে বিজ্ঞানীরা দেখেন যে বহুল ব্যবহৃত হেলা বস্তুত গবেষণাগারের অন্যান্য সব সেলের নমুনা দূষিত করে দিয়েছে। মাথায় হাত দেন গবেষকরা। গুটি গুটি পায়ে ল্যাকসের পরিবারের কাছে তাঁরা ডিএনএ নমুনা চাইতে আসেন। ব্যাস, অমনি সব সত্য জানতে পারেন হেনরিয়েটার পরিবার।
তবে হেনরিয়েটা ল্যাকস-এর ঘটনাই একমাত্র নয়, সমসাময়িক এরকম আরো কাহিনী রোগীর অধিকার এবং রোগীর শরীরের নানা ধরনের উপাদান ব্যবহার সম্পর্কিত নৈতিকতার এক বিস্তৃত আলোচনার সূচনা করে। এইসব ঘটনা ডাক্তার এবং বিজ্ঞানীদের চিন্তাধারার পরিবর্তন এনেছে এবং চিকিৎসা ও গবেষণার ক্ষেত্রে আজ যে নানা ধরনের সম্মতি-নির্দেশিকাগুলি সাধারণত ব্যবহৃত হয়, ওইসব ঘটনার জের টেনে অচিরেই তার সূত্রপাতও হয়।
হেনরিয়েটা কখনোই তাঁর প্রাপ্য খ্যাতি পাননি, কিন্তু জনস হপকিন্স হাসপাতাল বায়োমেডিকেল অগ্রগতিতে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদানকে সম্মান করার উপায় হিসেবে ২০১০ সালে একটি বার্ষিক "হেনরিয়েটা ল্যাকস মেমোরিয়াল লেকচার" অন্তত চালু করেছিল। অত্যন্ত সুখের কথা যে ২০১৩ সালে ল্যাকস পরিবারের সাথে এন. আই. এইচ. একটা ঐতিহাসিক বোঝাপড়ায় আসে যেখানে প্রয়াত হেনরিয়েটার বিশাল অবদানের প্রতি জনসাধারণের স্বীকৃতি নিশ্চিত করার সাথে সাথে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি সক্ষম করার জন্য ল্যাকস পরিবারের ইচ্ছাকে তারা সম্মান জানায়। ২০১৪ সালে হেনরিয়েটাকে মেরিল্যান্ড উইমেনের ‘’হল অফ ফেম’’-এও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এই গল্পের এখানেই শেষ নয়। হেনরিয়েটা মানেই শুধু ``হেলা’’ সেল নয়, রক্তমাংসের একটা পূর্ণ মানবী এবং তাঁর গল্পে অনেক কিছু আছে। হেনরিয়েটা রান্না করতে ভালোবাসতেন। স্প্যাগেটি ছিল তাঁর একটি প্রিয় খাবার। নাচতে খুব পছন্দ করতেন হেনরিয়েটা--প্রায়শই পাঁচ সন্তানের কাউকে না কাউকে কোলে নিয়ে তিনি নাচতেন। সৌখিন মানুষ ছিলেন--টকটকে লাল নেলপালিশ আর সুন্দর পোশাকে নিজেকে সাজিয়ে রাখতে ভালোবাসতেন। এই মিশুকে আর আমুদে মানুষটি ছিলেন বাড়ির সব মনন, চিন্তনের প্রাণবিন্দু। লোকজন অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাই তাঁকে ঘিরে তাঁর বর্ধিত পরিবার জড়ো হত আর তাঁর বাড়ির দরজা লোকেদের আপদেবিপদে সব সময় খোলা থাকত।
হেনরিয়েটার নাতি আলফ্রেড ল্যাকস কার্টার মনে করেন, হেলা কোষ সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সেগুলো কীভাবে ক্যান্সার গবেষণায় উন্নতি সাধন করেছে--এটাই তো হেনরিয়েটার প্রতি একটি উপযুক্ত শ্রদ্ধা প্রদর্শন, যেখানে এই রোগের কারণেই হেনরিয়েটার জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। ভাবাতুর আলফ্রেড আরও বলেন, অনেকেই তাঁকে বলেছেন যে তাঁরা ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের মাধ্যমে বহু আকাঙ্ক্ষিত সন্তান ধারণে সক্ষম হয়েছেন এবং সেটা সম্ভব হয়েছে হেলা কোষের জন্যই। হ্যাঁ এটা ঠিকই যে, এই কোষ হেনরিয়েটার কাছ থেকে নিয়ম মেনে ঠিকঠাক ভাবে নেওয়া হয়নি, কিন্তু সারা বিশ্বের জন্য হেলা অনেক ভালো কিছু করছে এবং এ ব্যাপারে মানুষের জাতিগোষ্ঠীর কোনো ভেদাভেদ নেই।
তথ্যসূত্র:
1. The Immortal Life of Henrietta Lacks. February 2010. Book by R. Skoolt
2. The good, the bad, and the HeLa. April 2014. Berkeley Science Review by A. del Carpio