• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৫ | জানুয়ারি ২০২২ | গল্প
    Share
  • আনন্দী آنندی : গুলাম আব্বাস
    translated from Urdu to Bengali by শুভময় রায়
    খোল দো | আনন্দী

    আনন্দী
    آنندی

    গুলাম আব্বাস



    মূল উর্দু থেকে অনুবাদ: শুভময় রায়



    [উর্দুভাষী এক সাহিত্য সমালোচক লিখছেন যে গুলাম আব্বাসকে (১৯০৯ – ১৯৮২) জানেন না এমন পাঠক-পাঠিকা পাওয়া গেলেও ‘আনন্দী’ গল্পটি পড়েননি এমন কাউকে বোধহয় পাওয়া যাবে না। দক্ষ হাতে মানুষের দুর্বলতা, শঠতা, ভণ্ডামি ও কপটতার মুখোশ লেখক খুলে দিয়েছেন তাঁর অনেক গল্পে। এই গল্পটিও তার ব্যতিক্রম নয়। এই কাহিনীর অনুপ্রেরণায় তৈরি হয়েছিল শ্যাম বেনেগালের নির্দেশনায় একটি বিখ্যাত হিন্দি সিনেমা। সে অনুসন্ধানের দায় পাঠকের ওপরই ছেড়ে দেওয়া গেল।

    অনুবাদের জন্য নাদিম আহমেদ সংকলিত ‘কুল্লিয়াত-এ-গুলাম আব্বাস’-এ প্রকাশিত মূল উর্দু গল্পটি ব্যবহার করেছি।

    —অনুবাদক]

    মিউনিসিপাল কাউন্সিলের মিটিং জোর চলেছে। হলে তিলধারণের জায়গা নেই। একজন সদস্যকেও অনুপস্থিত দেখা গেল না যা বেশ অস্বাভাবিক। কাউন্সিলের মিটিংয়ের আলোচ্য বিষয় জ়নান-এ-বাজ়ারি অর্থাৎ বাজারি মেয়েদের শহরের বাইরে বার করে দেওয়া হোক কারণ শুধু তাদের উপস্থিতিই শহুরে জীবনের মানবিকতা, শালীনতা আর সংস্কৃতিকে কলঙ্কিত করছে।

    কাউন্সিলের এক রাশভারী সদস্য, যাঁকে সাধারণভাবে দেশ ও রাষ্ট্রের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল এবং হিতৈষী বলে মনে করা হত, প্রখর বাগ্মিতার সঙ্গে বক্তৃতা করে চলেছিলেন: ‘আর ভদ্রমহোদয়গণ, আপনারা মনে রাখবেন যে এদের বসবাস শহরের এমন একটি অংশে যা শুধু শহরের মধ্যস্থলে জনসাধারণের ব্যবহৃত সড়ক সংলগ্নই নয়, সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্রও বটে। এই কারণে প্রত্যেক সম্মানীয় ভদ্রলোককে ইচ্ছে থাক বা না থাক ওই বাজারে যেতে হয়। এছাড়াও ওই বাজারের বাণিজ্যিক গুরুত্বের কারণে সম্ভ্রান্ত পরিবারের পবিত্র মেয়ে-বউরা সেখানে যেতে এবং কেনাকাটা করতে বাধ্য হয়। মাননীয় সদস্যগণ! সেই শরিফজ়াদিরা যখন ওই আব্রুহীন, অর্ধনগ্ন বেশ্যাদের সাজগোজ আর প্রসাধন দেখে, তখন স্বভাবতই তাদের মনেও পুরুষের মন-ভোলানোর জন্য নানাবিধ প্রসাধন আর অলঙ্কার প্রদর্শনের নতুন নতুন ইচ্ছে জাগে। এর পরিণামে তারা তাদের গরীব স্বামীদের কাছে রুজ়, ল্যাভেন্ডার, জরির কাজ করা শাড়ি আর দামী গয়নাগাটির জন্য আবদার শুরু করে। ফলত, তাদের খুশির সংসার, তাদের শান্তির নীড়গুলো জাহান্নমের নিদর্শন হয়ে ওঠে।’

    ‘আর ভদ্রমহোদয়গণ, এটাও তো আপনাদের স্মরণে রাখা উচিত যে রাষ্ট্রের নবীন ছেলেমেয়েরা, যারা ইস্কুলে তালিম নিচ্ছে এবং ভবিষ্যতে যাদের অগ্রগতির সঙ্গে রাষ্ট্রের আশা-প্রত্যাশা ওতপ্রোতভাবে জড়িত, আর যেখানে প্রত্যাশা করা হয় যে কোনও দেশের জাহাজটিকে ঘূর্ণাবর্ত থেকে উদ্ধার করার দায়িত্ব তাদেরই ওপর বর্তাবে, তাদেরও সকাল-সন্ধ্যে ওই বাজারের মধ্যে দিয়েই আসা-যাওয়া করতে হয়। এই বারবণিতারা সব সময় বারো রকমের আভরণ আর শৃঙ্গারের ষোড়শোপচারে সজ্জিত হয়ে অনবরত পথচারীদের দিকে তাদের ব্রীড়াহীন দৃষ্টির তির আর বল্লম নিক্ষেপ করে তাদের আমন্ত্রণ জানাতে থাকে। তাদের দেখে আমাদের অনভিজ্ঞ ভোলাভালা নওজোয়ানেরা, যারা যৌবনের নেশায় মেতে আছে, যারা লাভ-লোকসানের হিসেব করতে শেখেনি, তারা কীভাবে নিজেদের আবেগ আর চিন্তাভাবনাকে আর তাদের উচ্চ বংশমর্যাদাকে পাপ আর অবাধ্যতার বিষ থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারবে? সুধীবৃন্দ, তাদের সৌন্দর্য, যা যোগী-তপস্বীদের মাথা ঘুরিয়ে দেয়, তা কি আমাদের যুবকদের ন্যায়ের পথ থেকে সরিয়ে তাদের হৃদয়ে পাপের, কামনার আগুন জ্বালিয়ে তাদের মধ্যে একটা অস্থিরতা, একটা বিক্ষোভ, একটা উত্তেজনা তৈরি করবে না?’

    এই সুযোগে কাউন্সিলের এক সদস্য যিনি আগে শিক্ষকতা করতেন, আর যাঁর পরিসংখ্যানবিদ্যায় যথেষ্ট দখল ছিল, বলে উঠলেন, ‘মাননীয় সদস্যগণ, এটা যেন আমরা স্পষ্ট মনে রাখি যে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে এমন শিক্ষার্থীদের সংখ্যা পাঁচ বছর আগের তুলনায় অর্ধেক হয়ে গেছে।’

    এবারে বক্তব্য রাখলেন চশমা পরা এক সদস্য, যিনি সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের সাম্মানিক সম্পাদক ছিলেন: ‘মহাশয়গণ, আমাদের শহরে প্রতিদিন সম্মান, মহত্ত্ব, পরোপকার, সংযম ইত্যাদি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে আর তার স্থান দখল করছে অমর্যাদা, কাপুরুষতা, ভীরুতা, বদমাইশি, চুরি-চামারি আর জালিয়াতি। নেশার জিনিসের ব্যবহার বেড়েছে। খুন-খারাপি, আত্মহত্যা, আর দেউলিয়া হওয়ার ঘটনা বেড়েই চলেছে। এসব ঘটছে আসলে ওই বাজারি মেয়েছেলেদের দূষিত অস্তিত্বের জন্য, কারণ আমাদের শহরের ভোলাভালা মানুষেরা ওই মেয়েদের কেশকুন্তলের পাকে আটকে পড়ে তাদের বোধ আর বিবেচনাকে জলাঞ্জলি দেয়, আর সেই সম্ভোগের প্রাসাদের লাগামছাড়া ব্যয় মেটাতে আইনি বা বেআইনি পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। কখনও-সখনও সেই প্রচেষ্টায় তারা তাদের মনুষ্যত্ব সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে নোংরা জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়। এর অনিবার্য পরিণাম হল তারা তাদের অমূল্য জীবনকে বিসর্জন দেয় অথবা জেলখানায় পচে মরে।’

    বড় পরিবারের কর্তা কাউন্সিলের এক পেনশনভোগী সদস্য, যিনি ইতিমধ্যেই দুনিয়ার ঠান্ডা আর গরম অনেক দেখে ফেলেছেন আর জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে জীবনের বাকি দিনগুলো আরাম করতে আর নিজের হিতৈষী ছত্রছায়ায় আপন পরিবারের উন্নতি আর অগ্রগতি দেখতে চাইছিলেন, তিনি এবার বলতে উঠলেন। কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠস্বর আর গলায় যেন অভিযোগের সুর নিয়ে তিনি বললেন: ‘মাননীয় সুধীবৃন্দ, সারা রাত ধরে এদের তবলার চাপড়, চিৎকার-চেঁচামেচি, এদের প্রেমিকদের ঘুসোঘুসি, গালি-গালাজ আর শোরগোল, হা-হা-হি-হি শুনতে-শুনতে পড়শি ভদ্রজনের কান পচে গেছে। তাঁরা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছেন। রাতের ঘুম যেমন ছুটেছে, তেমনি দিনের শান্তিও উধাও। আমাদের বউ-বেটিদের আচরণের ওপর এদের কাছাকাছি বসবাসের যে কী কুপ্রভাব পড়ছে, সন্তানের পিতা-মাতারা তা খুব ভালোই আন্দাজ করতে পারছেন।’

    শেষ বাক্যটি বলতে বলতে বক্তার গলা ধরে এল, তিনি এর বেশি আর কিছু বলতে পারলেন না। কাউন্সিলের সব সদস্যের ওই ব্যক্তির ব্যাপারে গভীর সহানুভূতি ছিল কারণ দুর্ভাগ্যবশত তাঁর বাড়িটি ছিল ওই সৌন্দর্যের বাজারের ঠিক পাশেই। এর পরে বক্তব্য রাখলেন কাউন্সিলের আরেক সদস্য যিনি পুরনো রীতিনীতির ধ্বজাধারী ছিলেন আর প্রত্নতাত্ত্বিক ভগ্নাবশেষকে নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। ‘উপস্থিত সুধীবৃন্দ, বাইরে থেকে যে ভ্রমণকারী আর আমাদের আত্মীয়-বন্ধুরা এই বিখ্যাত আর ঐতিহাসিক শহরে বেড়াতে আসেন আর এই বাজারের পাশ দিয়ে যেতে যেতে জায়গাটা সম্পর্কে জিগ্যেস করেন, তখন ভেবে দেখুন লজ্জায় আমাদের কেমন মাথা কাটা যায়।’

    এবারে কাউন্সিলের সভাপতির কিছু বলার সময় হয়েছে। বামনাকৃতি আর হাত-পা ছোট ছোট হলেও তাঁর মাথাটি আকারে বড় ছিল, যে কারণে তাঁকে দেখে ধৈর্যশীল মানুষ বলে মনে হত। গম্ভীর কণ্ঠস্বরে তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘মাননীয় সদস্যবৃন্দ, আমি আপনাদের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত যে এই শ্রেণির মানুষের উপস্থিতি আমাদের শহর আর সভ্যতা-সংস্কৃতির পক্ষে শত লজ্জার কারণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু মুস্কিল হল এই যে কীভাবে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব? যদি এদের কলঙ্কজনক পেশা ছেড়ে দিতে বলা হয়, তা হলে প্রশ্ন উঠবে যে এদের খাবার জুটবে কোথা থেকে?’ এক সদস্য বলে উঠলেন, ‘এরা বিয়ে-শাদি করে নেয় না কেন?’

    এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে হলঘরে এমন হাসির রোল উঠল যে আর থামতেই চায় না। ঘরে যে শোকের আবহ বিরাজ করছিল তা মুহূর্তে বদলে গেল। এজলাসে হাসির আওয়াজ থামলে সভাপতি বললেন, ‘ভদ্রমহোদয়গণ, এই উপদেশ ওদের বারংবার দেওয়া হয়েছে। তারা এই প্রশ্নের উত্তরে বলে যে অবস্থাপন্ন ও সম্ভ্রান্ত মানুষজন পরিবারের মানমর্যাদা আর সম্মান রক্ষা করার জন্য তাদের ঘরে ঢুকতে দেবে না আর গরিব-গুর্বো সাধারণ মানুষ শুধু ধনদৌলতের জন্য তাদের বিয়ে করবে বলেই ওই মেয়েরা তাদের পাত্তাও দেবে না।’

    এই শুনে এক সদস্য বললেন, ‘ওই মহিলাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কাউন্সিলের মাথা ঘামানোর কোনও প্রয়োজন নেই। কাউন্সিলের শুধু এটুকু দেখলেই চলবে যে তারা ইচ্ছে করলে জাহান্নমেও যেতে পারে, শুধু এই শহর ছেড়ে চলে যাক।’

    সভাপতি বললেন, ‘এটাও খুব সহজ কাজ নয়। ওরা তো দশ-বিশজন নয়, ওদের সংখ্যা শত-শত আর তাদের মধ্যে অনেকেরই নিজস্ব বসতবাড়ি আছে।’

    এই বিষয়টি নিয়ে কাউন্সিলের সভাগুলিতে সারা মাস ধরে আলোচনা চলল। অবশেষে সব সদস্য এই সিদ্ধান্তে সহমত পোষণ করলেন যে বাজারি ওই মেয়েদের নিজস্ব বাড়িগুলি কিনে নেওয়া উচিত আর তাদের থাকার জন্য শহর থেকে অনেক দূরে কোনও একটা জায়গা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হোক। কিন্তু সেই বাজারি মেয়েরা কাউন্সিলের এই সিদ্ধান্তের কঠোর বিরোধিতা করল। কেউ কেউ প্রতিবাদ করে বড়সড় জরিমানা দিল, জেলেও গেল। কিন্তু কাউন্সিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাদের কোনও আপত্তিই ধোপে টিকল না, শেষ পর্যন্ত সকলকেই তা মেনে নিতে হল।

    তারপরে কিছুদিন ধরে সেই বাজারি মহিলাদের মালিকানায় থাকা বাড়িঘরের তালিকা তৈরি আর নকশা আঁকানোর কাজ চলল, সম্ভাব্য ক্রেতাদের খোঁজখবর নেওয়াও শুরু হল। অধিকাংশ বাড়ি নিলাম ডেকে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই মহিলাদের ছমাস পর্যন্ত শহরে তাদের পুরনো বাড়িতেই থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল যাতে তারা সেই সময় তাদের বসবাসের জন্য নির্ধারিত নতুন এলাকায় বাড়ি ইত্যাদি বানিয়ে নিতে পারে।

    শহর থেকে ছয় ক্রোশ দূরের একটি জায়গায় ওই বাজারি মেয়েরা থাকবে বলে ঠিক হল। পাঁচ ক্রোশ পর্যন্ত পাকা সড়ক থাকলেও তারপরে এক ক্রোশ কাঁচা রাস্তা ধরে সেখানে যেতে হত। কোনও কালে সেখানে মানুষের বসতি ছিল, কিন্তু এখন ধ্বংসস্তূপ ছাড়া চোখে পড়ার মত আর কিছুই নেই। এখন সাপ আর বাদুড়ই সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। দিনে-দুপুরে সেখানে পেঁচা ডাকে। সেই স্থানটির আশপাশে মাটির কাঁচা বাড়িঘর নিয়ে কয়েকটি ছোট গ্রাম ছিল। কিন্তু তাদের কোনওটির দূরত্বই দু-আড়াই মাইলের কম ছিল না। সেই সব গ্রামের কৃষকরা দিনের বেলায় চাষবাস করত, কাজ না থাকলে হয়ত এমনিই ঘুরে বেড়াত। কখনও-সখনও সেই ধ্বংসস্তূপের কাছেও তারা পৌঁছে যেত। নচেৎ অধিকাংশ সময় সেই স্থানটিকে নিঝুম ভূতপ্রেতের শহর বলেই মনে হত। সেখানে আলো থাকতেই ক্বচিৎ-কদাচিৎ শেয়ালের দেখা মিলত।

    সেই বারবনিতারা সংখ্যায় ছিল পাঁচশর কিছু বেশি। তাদের মধ্যে চোদ্দজন এমন ছিল যারা হয় প্রেমিকদের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে অথবা তাদের নিজেদের হৃদয়াবেগের কারণে অথবা অন্য কোনও হেতুবশত শহরের কাছাকাছি স্বাধীনভাবে বসবাস করত। তাদের ধনী প্রেমিকরা যেহেতু সব সময় তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে কখনও কোনও কার্পণ্য করত না, তাই এখন তারা তাদের অনিচ্ছুক মনকে এই নতুন এলাকায় গিয়ে বসবাস শুরু করার জন্য বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করেছিল। বাকিরা ভেবে রেখেছিল যে হয় শহরের হোটেলগুলিকে তাদের থাকার জায়গা করে তুলবে অথবা পুণ্যবতী মহিলাদের ছদ্মবেশ ধারণ করে ভদ্রলোকদের পাড়ার কোনও অস্পষ্ট কোণ খুঁজে নিয়ে বাসা বাঁধবে অথবা চিরতরে শহর ছেড়ে অন্য কোথাও পাড়ি জমাবে।

    ওই চোদ্দজন গণিকার অবস্থা বিশেষত ভালো ছিল। তাছাড়াও, শহরে নিজস্ব বাড়ি বিক্রি করে তারা ভালো দাম পেয়েছিল। এই নতুন এলাকায় নামমাত্র দামে জমি পাওয়ায় এবং তাদের প্রেমিকরা আর্থিক সাহায্য দিতে তৈরি থাকায় তারা সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূরে সরিয়ে রেখে বহু অর্থ খরচ করে তাদের জন্য নির্ধারিত সেই নতুন এলাকায় নিজেদের ইচ্ছেমত বিশাল-বিশাল, জাঁকজমকপূর্ণ অট্টালিকা তৈরি করবে বলে মনস্থ করল। ফুটোফাটা এক কবরস্থানের অনতিদূরে একটু উঁচুতে একখণ্ড সমতল জমি তাদের বাড়ি তৈরির জন্য নির্বাচন করা হল। তাদের পাওয়া নিজস্ব জমি পরিষ্কার করে দুর্দান্ত নকশা-নবিশদের দিয়ে বাড়ির নকশা তৈরি করিয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই নির্মাণের কাজ শুরু করা গেল। দিনভর ইট, মাটি, চুনসুরকি, লোহার বিম, গার্ডার আর অন্যান্য ইমারতি জিনিসপত্র লরি, গরুর গাড়ি, খচ্চর, গাধা আর মানুষের পিঠে চেপে সেখানে পৌঁছে যেত। মুনশি সাহেব হিসাব-কিতাবের কপি বগলের তলায় চেপে সেই সব মালমশলা গোনাগুনতি করে খাতায় লিখে রাখত। সর্দার-শ্রমিক রাজমিস্ত্রিদের আদেশ দিত। রাজমিস্ত্রিরা মজুরদের বকাঝকা করত, আর মজুররা আদেশ পালনে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করে মরত, আর সঙ্গী মজুরনিদের তারস্বরে ডাকাডাকি করত যাতে তারা হাতে-হাতে সাহায্য করে। সেই জায়গাটি সারাদিন কোলাহল আর ব্যস্ততায় ভরে থাকত। আশপাশের গ্রামের দেহাতি বাসিন্দারা তাদের চাষের ক্ষেত থেকে আর তাদের বউরা ঘর থেকে বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসা মৃদু খট-খট আওয়াজ শুনতে পেত।

    সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে এক জায়গায় একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পড়ে ছিল। তার পাশেই ছিল একটা মজে যাওয়া কুয়ো। রাজমিস্ত্রিদের মধ্যে কেউ কেউ জলের খোঁজে অথবা একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য আর নামাজ পড়ায় উৎসাহী মিস্ত্রিদের প্রার্থনার সুবিধে করে দিয়ে পুণ্য অর্জনের লক্ষ্যে প্রথমেই সেই মসজিদ আর কুয়োটি মেরামত করেছিল। যেহেতু সেই কাজটি মানবিক আর ধর্মের নিরিখে সুবিধেজনক ছিল, তাই কোনও আপত্তি উঠল না। দু-তিনদিনের মধ্যেই মসজিদ মেরামতের কাজ সুসম্পন্ন হল। বেলা বারোটায় দুপুরের আহারের বিরতি মিললেই রাজমিস্ত্রি, মজুর, সর্দার, মুনশি আর নির্মাণকাজের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পাওয়া গণিকাদের আত্মীয় বা প্রতিনিধির মত আড়াইশ মানুষ সেই মসজিদের পাশে জমায়েত হত। দেখে মনে হত যেন মেলা বসেছে।

    একদিন পাশের গ্রামের এক দেহাতি বুড়ি একটা ছোট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে সেই নতুন বসতির খবর পেয়ে মসজিদের পাশে গাছতলায় বিড়ি আর সস্তার সিগারেট, ছোলা-গুড় দিয়ে তৈরি মিষ্টি বারকোশে সাজিয়ে বসল। বুড়ির আসার পর দুদিন পেরিয়েছে কি না সন্দেহ, এক বৃদ্ধ কিষান মাটির একটা বড় ঘড়া নিয়ে কুয়োর পাড়ে হাজির। সেখানে ইটের একটা ছোট্ট বেদি বানিয়ে এক পয়সায় দুগ্লাস মিষ্টি শরবত বিক্রি শুরু হল। জিপসি মেয়ে খবর পেয়ে তরমুজ নিয়ে উপস্থিত। সে বুড়ির পাশে বসে ‘নিয়ে যাও তরমুজ, মধুর চেয়েও মিষ্টি তরমুজ’ হাঁক পাড়তে শুরু করল। আরেকজন কী করল জানেন? মাথা আর ঠ্যাঙের সুরুয়া বানিয়ে একটা পাত্রে ভরে আর রুটি তৈরি করে নিয়ে চলে এসেছে। সঙ্গে এনেছে মাটির ভাঁড় আর জল খাওয়ার টিনের গেলাস। উদ্দেশ্য সেই জঙ্গলের ভেতর যারা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছে তাদের ঘরে তৈরি খাবারের স্বাদ দেবে।

    দুপুর আর বিকেলে নমাজের সময় দেখা যায় শ্রমিক-সর্দার, রাজমিস্ত্রি আর বাকিরা কুয়ো থেকে মজুরদের দিয়ে জল তুলিয়ে উজু করে। একজন মসজিদে ঢুকে আজান দেয়। একজনকে ইমাম বানানো হয় আর অন্যরা তার পেছনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে। মসজিদে ইমাম নেই এই খবর এক গ্রামের মৌলবির কাছে পৌঁছলে তিনি পরদিনই ভোরে সবুজ ব্যাগে পবিত্র কোরান শরিফ, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের নিয়ম, কোরান রাখার স্ট্যান্ড আর ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক কতিপয় পুস্তিকা নিয়ে চলে এলেন আর মসজিদের ইমামের দায়িত্ব নিয়মানুগভাবে তার হাতে সঁপে দেওয়া হল।

    প্রতিদিন বিকেল পড়ে এলে গ্রামের এক কাবাব বিক্রেতা মাথার ঝুড়িতে জিনিসপত্র নিয়ে হাজির হত। সে বারকোশওয়ালা বুড়ির পাশে মাটির ওপর উনুন জ্বালিয়ে কাবাব, কলিজা, হৃৎপিণ্ড আর গুর্দা শিকে গেঁথে উনুনে চড়িয়ে বস্তিবাসীদের কাছে বিক্রি করত। তন্দুরওয়ালার বউ এই দেখে তার স্বামীকে নিয়ে মসজিদের সামনে হাজির। খোলা মাঠে রোদ থেকে বাঁচতে মাথার ওপর খড়ের ছাউনি লাগিয়ে তারাও তন্দুরে আগুন দিত। কখনও-সখনও গ্রামের এক যুবা নাপিতকে তার ছেঁড়াফাটা সরঞ্জাম বেল্টের সঙ্গে বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে কাঁচা রাস্তার নুড়িপাথর আর আবর্জনা মাড়িয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতেও দেখা যেত।

    সেই গণিকাদের বাড়ি তৈরির কাজের দেখাশোনা তাদের আত্মীয় অথবা ব্যবসার সঙ্গীসাথীরা তো করতই, কিন্তু কখনও দ্বিপ্রহরের আহারের পরে তারা নিজেরাই প্রেমিকদের সঙ্গে নিয়ে নিজেদের বাড়ি তৈরি দেখার জন্য চলে আসত আর সূর্যাস্ত পর্যন্ত সেখানেই থেকে যেত। সেই সময় সুযোগ বুঝে সেখানে ফকিরদের ঢল নামত আর যতক্ষণ পর্যন্ত তারা সবাই ভিক্ষের দান না পেত, ততক্ষণ এমন চিৎকার-চেঁচামেচি আর কান্নাকাটি জুড়ত যে কথা বলা দুষ্কর হয়ে পড়ত। বারাঙ্গনাদের এই নতুন বসতি দেখার জন্য শহর থেকে বেকার, অলস মানুষ আর গুণ্ডা-মাস্তানের দলবল পায়ে হেঁটে সেখানে পৌঁছে যেত, আর যদি সেই দিনই গণিকার দলও সেখানে পৌঁছেছে, তা হলে তো ঈদের উৎসব লেগে যেত। যুবকেরা দুয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে গণিকাদের ঘিরে ধরে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, উপহাস, হাসি-ঠাট্টার মোচ্ছব শুরু করত। কী অশালীন তাদের অঙ্গভঙ্গি! সে দিনগুলোয় কাবাবের বিক্রি বহুগুণ বেড়ে যেত।

    যেখানে কিছুদিন আগেই পতিত জমি আর বাড়িঘরের ভাঙা অবশিষ্ট ছাড়া কিছুই ছিল না, সেই এলাকায় এখন চারদিকে শুধু কোলাহল আর ব্যস্ততা। শুরুতে সেখানে থাকার প্রস্তাবে গণিকারা ভয় পেলেও এখন তা অনেকটাই দূর হয়ে গেল। তারা যেন খুশিতে তাদের নতুন বাড়িঘর সাজিয়ে তোলা আর বাড়ির বাইরে-ভেতরে নিজেদের পছন্দের রঙ লাগানোর জন্য রাজমিস্ত্রির ওপর জোর খাটাতে শুরু করল।

    বস্তির এক জায়গায় একটা ভাঙাচোরা সৌধ ছিল। দেখে বোঝা যেত যে কোনও জ্ঞানীগুণী পিরবাবার মাজার হবে। বাড়িঘর তৈরির কাজ তখন সবে অর্ধেক শেষ হয়েছে। এমন সময় রাজমিস্ত্রিরা দেখল যে সেই সৌধ থেকে অদ্ভুত ধোঁয়া উঠছে। এক দীর্ঘদেহী ফকির টকটকে লাল চোখ নিয়ে সেই ধোঁয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে। ল্যাঙট বাঁধা, দাড়ি-গোঁফ কামানো সেই ফকির মাজারের চারদিক থেকে ইট-কাঁকর-পাথরের টুকরো তুলে বাইরে ফেলছে। দুপুরে সেই ফকির একটা ঘড়া নিয়ে কুয়োর কাছে এল আর ঘড়ায় জল ভরে ভরে মাজার সাফসুতরো করার কাজে লেগে পড়ল। কুয়োর পাশে দু-তিনজন রাজমিস্ত্রিকে দেখে কিছুটা পাগলামি, কিছুটা বিচক্ষণতা দেখিয়ে সে বলল: ‘জানো এটা কার মাজার? কড়ক শাহ পির বাদশার! আমার বাপ-দাদা এখানে সেবক ছিলেন।‘ তারপরে চোখে জল নিয়ে হাসতে হাসতে সে পির কড়ক শাহের অবিশ্বাস্য কিছু কেরামতির গল্প বলে চলল।

    সন্ধ্যে বেলায় সেই ফকির কোথা থেকে চেয়ে-চিন্তে মাটির দুটো প্রদীপ আর একটু সর্ষের তেল নিয়ে এল। পিরের মাথা আর পায়ের দিকে রেখে সেই প্রদীপ জ্বালানো হল। গভীর রাতে কোনও কোনও দিন সেই সৌধ থেকে ‘আল্লাহ্‌-হু’ ধ্বনি শোনা যেত।

    ছমাসের মধ্যে চোদ্দটি বাড়ি তৈরি হয়ে গেল। চওড়া রাস্তার এক পাশে সাতটি, অন্য পাশে বাকি সাতটি দোতলা বাড়ি – প্রস্থে প্রায় সমান। প্রতিটি বাড়ির নিচে চারটি করে দোকান। বাড়ির ওপর তলায় রাস্তার দিকে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দার সামনের দিকটায় নৌকাকৃতি বসার বেঞ্চি। তার দুদিকে মার্বেল পাথরের নৃত্যরত ময়ূর অথবা জলপরীদের খোদাই করা মূর্তি। জলপরীর শরীরের অর্ধেকটা মাছের, বাকি অর্ধেক মানবীর। বারান্দার পেছনে বসার জন্য বড় ঘর যেখানে মার্বেল পাথরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্তম্ভ আর দেওয়ালে মোজাইকের কারুকাজ। ঘরের মেঝে ঝকঝকে সবুজ পাথরের তৈরি, যখন মার্বেল পাথরের স্তম্ভগুলি সেই উজ্জ্বল পান্না-সবুজ মেঝেতে প্রতিফলিত হয়, তখন দেখলে মনে হবে যেন চকচকে সাদা ডানার রাজহাঁসেরা বুঝি তাদের লম্বা গ্রীবা ঝিলের জলে ডুবিয়ে রেখেছে।

    বুধবারের শুভ দিনটি সেই নতুন বসতিতে যাওয়ার জন্য ঠিক হল। সেদিন সেই গণিকারা সকলে মিলে জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধনের আয়োজন করেছিল। খোলা ময়দান সাফসুতরো করে শামিয়ানা খাটানো হল। ডেকচি নাড়ার আওয়াজ, মাংস আর ঘিয়ের খুশবু এমনই যে বহু দূর থেকে ফকির আর কুকুরের দল সেখানে উপস্থিত। দ্বিপ্রহর হতে না হতেই লঙ্গরের জন্য নির্দিষ্ট পির কড়ক শাহের মাজারের পার্শ্ববর্তী স্থানে এত ফকির জমা হয়ে গেল যা ঈদের দিনে কোনও বড় মসজিদের পাশেও দেখা যায় না। মাজারটিকে খুব ধোয়া-ধুই করে পরিষ্কার করা হয়েছিল, ফুলের চাদর চড়ানো হয়েছিল। সেবক ফকিরের জন্য নতুন জোব্বা তৈরি হলেও মাতাল অবস্থায় সে পরার সঙ্গে সঙ্গে তা ছিঁড়ে ফেলল।

    সন্ধ্যায় শামিয়ানার নিচে দুধ-সাদা চাদর বিছিয়ে তাকিয়া, পানের ডিবে, পিকদান, হুঁকো আর গোলাপ জলের পাত্র অতিথিদের সুবিধের জন্য পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা হল। নৃত্য-গীতের আসর বসল। দূর দূরান্ত থেকে এদের বন্ধু অথবা আত্মীয় আরও অনেক বারাঙ্গনারা এসেছে। তাদের সঙ্গে আরও খদ্দের আর মক্কেলরাও আছে যাদের বসার জন্য একটি পৃথক তাঁবুতে ব্যবস্থা করা হয়েছে। গোপনীয়তার জন্য তাদের কঞ্চি দিয়ে তৈরি পর্দার ওপারে বসানো হয়েছে। অসংখ্য গ্যাসবাতির আলোর রোশনাই জায়গাটিকে ঘিরে রেখেছে। গণিকাদের পেটমোটা, কালো যন্ত্রানুষঙ্গীরা জরি আর কিংখাবের কাজ করা শেরওয়ানি পরে ঘুরছে, আতরে ডোবানো তুলো অতি সতর্কতায় তাদের কানে গোঁজা আছে। তারা গোঁফে তা দিতে দিতে ঘুরছে। প্রজাপতির পাখার চেয়েও ফিনফিনে শাড়ি আর সোনার কাজ করা পোশাকে সজ্জিতা মোহময়ী রসরঙ্গিণীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সারা রাত ধরে চলল সেই নৃত্য-গীতের আসর, জঙ্গলের মধ্যে সেই মহোৎসব।

    উৎসবের ক্লান্তি দূর হতে দু-তিন দিন লাগল। তারপরে বারবনিতার দল জিনিসপত্র আনা আর ঘর সাজানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঝাড়বাতি, আলোর ঢাকনা, বেলোয়ারি ঝাড়, পূর্ণ দৈর্ঘ্যের আয়না, নেয়ারের পালঙ্ক, সোনার ফ্রেমে বাঁধানো ছবি আর শৈল্পিক হস্তলিপি নিয়ে এসে নির্দিষ্ট ঘরে রাখা হল। আট দিনের মধ্যে বাড়িগুলো পরিপাটি করে সাজানো হয়ে গেল। সে মহিলারা তো দিনের অধিকাংশ সময় ওস্তাদের কাছে নাচ-গানের প্রশিক্ষণ নেওয়া, গজল মুখস্থ করা, সুর তোলা, পাঠ নেওয়া, হস্তলিপিশিল্পের অনুশীলন, সেলাই আর চিকনের কাজ শেখা, গ্রামোফোন শোনা, ওস্তাদদের সঙ্গে তাস আর ক্যারম খেলা, শব্দজব্দের আনন্দ নেওয়া আর ঘুমিয়ে অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দিত। বিকেলে তারা স্নানের ঘরে প্রবেশ করত যেখানে তাদের চাকর-বাকরেরা হাত পাম্প দিয়ে জল তুলে বালতি ভরে রাখত। স্নানের পরে তারা প্রসাধন সামগ্রী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত।

    রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এলে সেই সব বাড়িঘর গ্যাসবাতির আলোয় ঝলমল করত। সে বাতিগুলো মার্বেল পাথর কেটে তৈরি করা অর্ধ-উন্মীলিত পদ্মের মধ্যে অতি সন্তর্পণে ঢাকা থাকত। সেই বাতির আলো জানলা আর দরজায় ফুল-কাটা নকশায় যখন প্রতিফলিত হত, তখন যারা দূর থেকে সে দৃশ্য দেখত, তারা রামধনুর শোভার মত ঝলমলে অত্যাশ্চর্য এক দৃশ্যের সাক্ষী থাকত। গণিকার দল মার্বেল পাথরের বারান্দায় পায়চারি করতে করতে পথচারীদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাত, তাদের হাসির খিল-খিল আওয়াজ শোনা যেত। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হলে তারা ঘরের ভেতরে গিয়ে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে জ্যোৎস্নার মত সাদা ফরাশের ওপর বসে আরাম করত। তাদের বাজনদারেরা যন্ত্রে সুর মেলাত, আর মেয়েরা সুপুরি কাটার কাজে লেগে যেত। রাত আরেকটু গভীর হলে তাদের খদ্দের বা বন্ধুবান্ধব মোটর আর টাঙাগাড়িতে ফল-ফলাদি আর মদের বোতলের ঝুড়ি নিয়ে ঢুকত। সেই বসতিতে এই পুরুষরা প্রবেশ করলেই অন্য ধরনের ব্যস্ততা চোখে পড়ত। সুরেলা কণ্ঠের গান, সঙ্গীতের মূর্ছনা, নর্তকীদের ঘুঙুরের ঝন-ঝন, পানপাত্রে মদ ঢালার আওয়াজের সঙ্গে মিলে এক অদ্ভুত সুরেলা পরিবেশ সৃষ্টি করত। আয়েশ আর মজার সেই পরিবেশে অন্ধকার কেটে গিয়ে কখন যে ভোরের আলো ফুটত, তা কেউ টেরও পেত না।

    বারবনিতারা সেই এলাকায় আসার কয়েক দিনের মধ্যেই নিচের দোকান ঘরগুলো ভাড়া নেওয়ার জন্য লোক আসা শুরু হল। নতুন বসতির আবাদির দিকে লক্ষ্য রেখে ভাড়া কম রাখা হয়েছিল। প্রথম ভাড়াটে ছিল সেই বুড়ি যে মসজিদের পাশে গাছতলায় টুকরি নিয়ে বসত। দোকান ভরানোর জন্য বুড়ি আর তার ছেলে সিগারেটের অনেক প্যাকেট এনে দোকানের তাকে সাজিয়ে রাখল। বোতলে রঙিন জল ভরে রাখা হল যাতে শরবতের বোতলের মত দেখায়। খালি সিগারেটের প্যাকেট, কাগজের ফুল আর পুরনো ফিল্মি পত্রিকা থেকে কেটে রাখা নায়ক-নায়িকার ছবি দেওয়ালে সেঁটে দোকানঘর তো খুব সাজানো হল। দোকানে আসল বিক্রির জিনিস কিন্তু ছিল দু-তিন রকমের সিগারেটের তিন-চারটি করে প্যাকেট, আট-দশ বান্ডিল বিড়ি, হাফ ডজন দেশলাইয়ের বাক্স, দুশ পানের বান্ডিল, হুঁকোর তামাক আর আধ বান্ডিল মোমবাতি।

    দুনম্বর দোকানে এক ব্যাপারী, তিন নম্বরে মিঠাই আর দুধ বিক্রেতা, চার নম্বরে কসাই, পাঁচ নম্বরে কাবাব বিক্রেতা আর ছয়ে সব্জিওয়ালা। সেই সব্জিওয়ালা আশপাশের গ্রাম থেকে চার-পাঁচ রকমের তরকারি নিয়ে বসত আর ভালো লাভ রেখে বিক্রি করত। দুয়েক ঝুড়ি ফলও রাখত। তার দোকানে অনেক জায়গা থাকায় সে এক ফুল বিক্রেতাকে তার সঙ্গী করে নিল। ফুলওয়ালা সারা দিন ধরে ফুলের মালা, বালা, চূড় ইত্যাদি তৈরি করত আর সন্ধ্যেবেলা সেই সব জিনিস ঝুড়িতে ভরে নিয়ে বাড়ি-বাড়ি ঘুরে শুধু যে বিক্রি করে আসত তাই নয়, সব বাড়িতে কিছুক্ষণ বসে, বাজনদারদের সঙ্গে গল্পসল্প করে, তাদের হুঁকোয় দুয়েক টান মেরে তবে ফিরত। যেদিন লম্পটদের কোনও দল সেই ফুলওয়ালার উপস্থিতিতেই গণিকাদের কুঠিবাড়িতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসত, আর গান-বাজনা শুরু হয়ে যেত, সেদিন বাজনদারদের ভ্রূভঙ্গি সত্ত্বেও সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখান থেকে ওঠার নামও নিত না। গানের তালে ঘাড় দোলাতে দোলাতে বোকার মত বাজনদারদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। যদি কোনও দিন এভাবেই রাত ভোর হয়ে যেত আর তার ঝুড়িতে একটাও মালা অবিক্রীত পড়ে থাকত, তা হলে ভোরে সেই মালা গলায় ঝুলিয়ে সেই বসতির রাস্তায় তারস্বরে গান গাইতে গাইতে সে ঘুরে বেড়াত।

    কোনও এক গণিকার বাপ-ভাইয়ের দর্জির কাজ জানা থাকায় তারা একটি দোকানে সেলাই মেশিন নিয়ে বসল। এই করতে করতে এক নাপিত আর তার সঙ্গে আসা কাপড় ছোপানোর ব্যবসায়ীও একটা দোকানঘর নিয়ে নিল। তাদের দোকানের বাইরে কাপড় শুকোনোর দড়িতে টাঙানো রঙ্গিবিরঙ্গী দোপাট্টা চোখের আরাম দিত।

    দোকানের ভাড়াই তার ব্যবসা থেকে ওঠে না এমন এক ছোট ব্যাপারী শহরকে বিদায় জানিয়ে সেই বসতিতে চলে এল। এই এলাকাটি তাকে উদ্বাহু হয়ে স্বাগত জানাল। আর তার বিভিন্ন কিসিমের ল্যাভেন্ডার, পাউডার, সাবান, চিরুনি, বোতাম, সূচ-সুতো, লেস-ফিতে, সুগন্ধি তেল, রুমাল, মাজন ইত্যাদির বিক্রি খুব বাড়তে থাকল।

    বসতির বাসিন্দাদের দাক্ষিণ্য আর পৃষ্ঠপোষকতায় উৎসাহিত হয়ে ভাগ্যের সন্ধানে দলে দলে ছোট ব্যবসায়ীরা আসতে শুরু করল – কোনও কাপড় ব্যবসায়ী, কোনও মুদি, কোনও হুঁকোর নল বাঁধার কারবারি, কোনও রুটি বিক্রেতা মন্দার বাজার আর শহরের ক্রমবর্ধমান ভাড়া নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে সেই বসতিতে এসে আশ্রয় নিল।

    হাকিমি চিকিৎসায় মোটামুটি পারদর্শী বড়ে মিঞা এক ওষুধ বিক্রেতা শহরের কোলাহল আর হাকিম ও ঔষধালয়ের সংখ্যা অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় বিরক্ত হয়ে শাকরেদদের সঙ্গে নিয়ে উঠে এসে দোকানঘর ভাড়া নিল। বড়ে মিঞা আর তার শাকরেদরা সারা দিন ওষুধের ডিবে, শরবতের বোতল আর মোরব্বা, চাটনি আর আচারের বয়াম আলমারি আর তাকগুলোতে নিজ নিজ ঠিকানায় বসানোর কাজ শুরু করল। কোনও একটি তাক টিব্‌-এ-আকবর, কারাবাদিন-এ-কাদরি আর চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্যান্য বইতে ভরে গেল। আলমারির দরজার ভেতর দিকে আর দেওয়ালের খালি জায়গায় গাঢ় কালিতে আর বড় বড় স্পষ্ট হস্তাক্ষরে বিশেষ বিশেষ প্রামাণ্য ওষুধের বিজ্ঞাপন সেঁটে দেওয়া হল। রোজ সকালে গণিকাদের চাকর-বাকররা হাতে গ্লাস নিয়ে হাজির হত আর বীজের শরবত, বেগু্নি ফুলের শরবত, বেদানার শরবত এবং ওই ধরনের অন্যান্য স্ফূর্তিবর্ধক রুহ্‌ আফজ়া শরবত আর আরক, ভেষজ লেই আর রুপোর পাতায় মোড়া শক্তিবর্ধক মোরব্বা নিয়ে যেত।

    যে দোকানগুলো খালি পড়ে রইল, সেখানে গণিকাদের বাজনদার আর অনুচররা চারপাই পেতে রাখল। সেখানে সারাদিন ধরে তাস, ছক্কাদান, আর দাবা খেলার আসর বসাত, শরীরে তেল মালিশ করাত, পায়রার লড়াইয়ের আয়োজন করত আর তা দেখতে দেখতে ‘সবই তাঁর ইচ্ছা’ গোছের বুলি ছাড়ত আর ঘড়া বাজিয়ে গান গাইত।

    এক বাজনদারের ভাই বাদ্যযন্ত্র তৈরি আর সারানোর কাজ জানায় তাকে একটা দোকানে এনে বসানো হল। দোকানের দেওয়ালে পেরেক পুঁতে ভাঙা অথবা মেরামতের প্রয়োজন এমন সারেঙ্গি, সেতার, তম্বুরা, দিলরুবা ইত্যাদি নানা বাদ্যযন্ত্র ঝুলিয়ে রাখা হল। সে লোকটি ভালো সেতার বাজাত, সন্ধ্যেবেলায় নিজের দোকানে বসেই বাজাত আর সেতারের মধুর সুর শুনে আশপাশের দোকানদাররা দোকান ছেড়ে এসে নিঃশব্দে তাকে ঘিরে বসে সেই সুরেলা সঙ্গীতে মগ্ন হয়ে থাকত। সেই সেতার বাদকের এক শিষ্যও ছিল যে রেলের দপ্তরে চাকরি করত। তার সেতার শেখার বড় শখ। দপ্তরে ছুটি হলেই সে সাইকেল নিয়ে হাজির হত আর ঘণ্টা-দেড়-ঘণ্টা দোকানে বসেই রেওয়াজ করত। সংক্ষেপে বলা যায় সেতার বাদকের উপস্থিতিতে জনবসতিটি যেন আরও প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠল।

    যতদিন বসতিটি গড়ে উঠছিল, ততদিন মসজিদের মুল্লাজি সন্ধ্যেয় গ্রামের বাড়িতে ফিরে যেত। কিন্তু এখন দুবেলা তাকে সুস্বাদু খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়, তাই সেখানেই সে রাত কাটাতে শুরু করল। ক্রমে ক্রমে গণিকাদের ঘর থেকে তাদের বাচ্চারা মসজিদে লেখাপড়ার জন্য আসতে শুরু করল, মুল্লাজির অর্থাগমও খারাপ হত না।

    যখন শহরে জমিবাড়ির ভাড়া আর তাদের শৈল্পিক নিম্নমানের কারণে একটা ভ্রাম্যমাণ থিয়েটারের দল সেখানে খুব সুবিধে করতে পারছে না, তখন তারাও এই নতুন জনপদের শরণ নিল। গণিকাদের বাড়ির কিছু দূরে ময়দানের মধ্যে তাদের তাঁবু পড়ল। দলের অভিনেতারা নাট্যকলা আর অভিনয় সম্পর্কে তেমন ওয়াকিবহাল ছিল না। তাদের বেশভূষাও ফুটোফাটা আর পুরনো। পোশাকের অনেক তারা ঝরে গেছে আর অভিনয় শৈলীও যেন প্রাচীন আর দুর্বল। কিন্তু তাসত্ত্বেও কোম্পানি চলল। কারণ বোধহয় এই যে তাদের টিকিটের দাম বেজায় কম ছিল। শহরে মজদুরি করা মানুষ, কারখানার শ্রমিক আর গরিব-গুর্বো লোক যারা সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পরে হই-হল্লা আর কামোদ্দীপক নাট্য প্রদর্শনী দেখতে চায়, তারা পাঁচ-ছজনের দল বেঁধে গলায় ফুলের মালা জড়িয়ে, নিজেদের মধ্যে অথবা অন্য পথচারীদের নিয়ে গালিগালাজ আর হাসি-ঠাট্টা করতে করতে আর হঠাৎ বাঁশিতে গানের সুর তুলতে তুলতে পায়ে হেঁটে সেই বসতিতে থিয়েটার দেখতে চলে আসত। আর সেখানে পৌঁছলে একবার এই সৌন্দর্যের বাজার তো তারা ঘুরে দেখবেই। নাটক শুরু না হওয়া পর্যন্ত, থিয়েটারের তাঁবুর বাইরে টুলের ওপর দাঁড়িয়ে সং কখনও কোমর দোলায়, শূন্যে চুম্বন ছোঁড়ে অথবা পথচারীদের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ ভ্রূভঙ্গি করে। তাই দেখে লোকজন হাসিতে ফেটে পড়ে আর জঘন্য গালিগালাজ করে যাতে বোঝা যায় যে প্রদর্শনীটি তারা কতটা উপভোগ করছে।

    ধীরে ধীরে সে বসতিতে অন্য মানুষজনেরও পদচিহ্ন পড়ল। শহরের ব্যস্ততম মোড়গুলোয় যে টাঙাওয়ালারা দাঁড়ায়, তারাও ‘আসুন, নতুন বস্তিতে যাবেন তো’ বলে ডাকে। শহরের বাইরে যে পাকা সড়ক ধরে পাঁচ ক্রোশ যাওয়া যায়, সেই রাস্তায় পৌঁছে তারা যাত্রীদের ফরমায়েশ শুনে অথবা বেশি ভাড়া পাওয়ার আশায় একে অপরের সঙ্গে দ্রুত গাড়ি ছোটানোর প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। টাঙাওয়ালারা মুখ দিয়ে ঘণ্টা বাজায় আর যদি কোনও টাঙা সওয়ারিদের নিয়ে অন্যটিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়, তা হলে অগ্রবর্তী টাঙার যাত্রীরা চিৎকার করে আকাশ কাঁপায়। এই প্রতিযোগিতায় বেচারা ঘোড়াগুলো কাহিল হয়ে যায় আর তাদের গলায় ঝোলানো মালা থেকে সুগন্ধের বদলে ঘামের দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। রিকশাওয়ালারাই বা টাঙার থেকে কম যায় কীসে! তারাও কম ভাড়ায় যাত্রী তোলে, ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে নতুন বসতিতে দ্রুত পৌঁছোনোর জন্য জোরে গাড়ি ছোটায়। প্রতি শনিবার সন্ধ্যেয় স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা একেকটা সাইকেলে দুজন করে চড়ে দল বেঁধে সেই গোপন বাজার দেখতে পৌঁছে যায়, বড়রা তাদের ঠিক সেই জায়গাটিতে যেতেই নিষেধ করেছে যে!

    ক্রমশ সেই নতুন বসতির খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। বাড়িঘর আর দোকানপাটের দামও বেড়ে চলল। যে বারবনিতারা শুরুতে সেই বসতিতে যাওয়ার জন্য তৈরি ছিল না, তারা এখন সেই বসতির অসাধারণ অগ্রগতি দেখে তাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত নিয়ে আফশোস করত। এমন মেয়েরাও ছিল যারা আর দেরি না করে নয়া বসতির আশেপাশে সস্তায় জমি-জায়গা কিনে ছোট ছোট বাড়ি বানিয়ে ভাড়া দিতে লাগল। ফলে যে গণিকারা উচ্ছেদের পরে শহরের হোটেল অথবা সম্ভ্রান্ত পাড়ায় চলে গিয়েছিল, তারা পিঁপড়ে আর পঙ্গপালের মত পিলপিল করে তাদের গোপন বাসা থেকে বেরিয়ে এসে এই নতুন বাড়িগুলোতে আশ্রয় খুঁজল। ছোট ছোট বাড়ির কোনও কোনওটি ভাড়া নিল সেই সব দোকানদার যাদের পরিবার থাকায় তাদের পক্ষে রাতে দোকানেই শুয়ে পড়া সম্ভব ছিল না।

    লোকসংখ্যা বাড়লেও নতুন বসতিতে বিদ্যুতের বন্দোবস্ত হয়নি। সুতরাং বারাঙ্গনাদের দল আর বসতির সব বাসিন্দারা মিলে সরকারের কাছে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার জন্য দরখাস্ত পাঠাল। কিছুদিনের মধ্যেই সেই আবেদন মঞ্জুর হল। একটা ডাকঘরও খুলল। এক বড়ে মিঞা ডাকঘরের বাইরে একটা সিন্দুক আর খাম-পোস্টকার্ড, কলম-দোয়াত নিয়ে বসে বসতির মানুষদের চিঠিপত্র লিখে দেয়।

    একবার তো বসতির মাতালদের দুটো দলের মধ্যে বেজায় মারপিটও লেগে গেল। সোডা ওয়াটারের বোতল, ছুরি-চাকু, আর ইটের টুকরোর যথেচ্ছ ব্যবহার চলেছিল। বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হল। ঘটনার পরে সরকারের মনে হল যে নতুন বসতিতে এখন একটা থানারও প্রয়োজন।

    থিয়েটার কোম্পানি দুমাস সেখানে ছিল, তাদের যা সামর্থ্য তার তুলনায় রোজগার হল অনেক বেশি। এক সিনেমা মালিক ভাবল এই সুযোগে নতুন বসতিতে একটা সিনেমা হল খোলা যাক। যেমন ভাবা তেমন কাজ। জায়গা দেখে সিনেমা হল তৈরির কাজ শুরু হল। কয়েক মাসেই তা তৈরিও হয়ে গেল। সিনেমা হলের লাগোয়া একটা বাগান হল, বায়োস্কোপ শুরু হওয়ার আগে দর্শকবৃন্দ সেখানে বসে আরাম করতে পারবে। বসতির বাসিন্দারা সেই বাগানে এসে বসে, পায়চারি করে। সেটা একটা বেড়ানোর জায়গা হয়ে উঠল। জলবাহকরা গ্লাস বাজিয়ে ঘুরে ঘুরে তৃষ্ণার্ত দর্শনার্থীদের জল দেয়, মাথাব্যথা কমানোর জন্য জামার পকেটে তীব্রগন্ধী কমদামি মালিশের তেল আর কাঁধে ময়লা, ফুটিফাটা তোয়ালে নিয়ে তারা ঘোরে, দিলপসন্দ-দিলবাহার মালিশের সওদা নিয়ে তারা জুটে যায়।

    সিনেমা হলের বাইরে হলের মালিক গুটিকয়েক বাড়ি আর অনেকগুলো দোকানও বানিয়েছে। সেই বাড়িগুলোয় তৈরি হল হোটেল। রাতেও সেখানে থাকার জায়গা মেলে। দোকানগুলো নিয়ে নিল সোডা ওয়াটার কারখানার মালিক, ফোটো তোলার দোকানদার, সাইকেল সারাইয়ের মিস্ত্রি, লণ্ড্রি মালিক, দুজন পানওয়ালা, জুতোর দোকানি আর নিজের ওষুধের দোকান আছে এমন এক ডাক্তার। পাশের একটা ঘরে মদের দোকান খোলারও অনুমতি মিলল। ফোটোগ্রাফির দোকানের বাইরে এক কোণে ঘড়ি সারাইওয়ালা তার সাজসরঞ্জাম নিয়ে বসল। চোখে আতস কাচ লাগিয়ে সে ঘাড় গোঁজ করে সারাদিন ঘড়ির ভেতরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সরঞ্জাম নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

    কিছুদিনের মধ্যেই নয়া বসতিতে জলের পাইপ, বৈদ্যুতিক বাতি আর জঞ্জাল পরিষ্কারের সরকারি ব্যবস্থা চালু হল। জমি জরিপের সরকারি লোক লাল পতাকা, জমি মাপার ফিতে আর দূরে দেখার সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হয়ে গেল। তারা মাপ নেয়, হিসেব কষে, সড়ক আর গলি নির্দিষ্ট করতে দাগ দেয়। বসতির কাঁচা রাস্তায় স্টিমরোলার চলতে শুরু করেছে।

    এই সব ঘটনার পরে বিশ বছর অতিবাহিত হয়েছে। সে বসতিটি এখন জনকোলাহল মুখরিত এক শহর যার নিজস্ব রেল স্টেশন আছে, টাউন হল, আদালত আর জেলখানাও আছে। শহরের জনসংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। শহরে একটি কলেজ, দুটি হাই স্কুল – একটি ছেলেদের, অপরটি মেয়েদের। এছাড়াও আটটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌর কর্তৃপক্ষের তরফে বিনা খরচে শিক্ষা দেওয়া হয়। আছে ছটি সিনেমা হল, চারটি ব্যাঙ্কের শাখা যার মধ্যে দুটি আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্ক।

    এ শহর থেকে দুটি দৈনিক সংবাদপত্র, তিনটি সাপ্তাহিক, আর দশটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে চারটি সাহিত্য পত্রিকা, দুটি ধর্মীয় আর নীতিশাস্ত্র বিষয়ক জার্নাল, কারিগরি শিল্প আর চিকিৎসা বিষয়ে একটি করে আর মহিলা ও শিশুদের জন্যও একটি করে পত্রিকা বেরোয়। শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিশটি মসজিদ, পনেরোটি মন্দির আর ধর্মশালা, মুসলমানদের জন্য ছটি আর হিন্দুদের জন্য পাঁচটি অনাথ আশ্রম, তিনটি বড় সরকারি হাসপাতাল, যার একটি শুধু মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত।

    শুরুতে কয়েক বছর তার বাসিন্দাদের জন্যই শহরটি ‘হুস্‌ন-আবাদ’ নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু পরে সে নাম অনুপযুক্ত মনে হওয়ায় তাতে সামান্য পরিবর্তন করা হয়। ‘হুস্‌ন আবাদ’ না বলে শহরের নামকরণ হয় ‘হাসান-আবাদ’। কিন্তু সে নাম চলল না কারণ জনগণ ‘হুস্‌ন’ আর ‘হাসান’ এর মধ্যে কোনও পার্থক্য করত না। শেষমেশ অনেক পুরনো, মোটাসোটা বই পড়ে আর পাণ্ডুলিপি ঘেঁটে শহরের আদি নামটি আবিষ্কৃত হল। শত সহস্র বছর আগে ধ্বংস হওয়ার আগে পর্যন্ত সে জনবসতির নাম ছিল ‘আনন্দী’, আনন্দের শহর।

    এখন তো সে শহর ভরপুর, সাফ-সুতরো আকর্ষণীয় এক শহর। কিন্তু শহরের সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বাণিজ্যিক দিক থেকে সবচেয়ে কর্মচঞ্চল কেন্দ্রটি হল সেই বাজার যেখানে জ়নান-এ-বাজারি অর্থাৎ বাজারি মেয়েদের বসবাস।

    শহর আনন্দীর মিউনিসিপাল কাউন্সিলের মিটিং জোর চলেছে। হলে তিলধারণের জায়গা নেই। একজন সদস্যকেও অনুপস্থিত দেখা গেল না যা বেশ অস্বাভাবিক। কাউন্সিলের মিটিংয়ের আলোচ্য বিষয় জ়নান-এ-বাজ়ারি অর্থাৎ বাজারি মেয়েদের শহরের বাইরে বার করে দেওয়া হোক কারণ শুধু তাদের উপস্থিতিই শহুরে জীবনের মানবিকতা, শালীনতা আর সংস্কৃতিকে কলঙ্কিত করছে।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ শুভময় রায়
  • খোল দো | আনন্দী
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments