‘আমাকে বিয়ে করবেন?’
বড়োজোর বছর তেরো-চোদ্দো বয়স হবে মেয়েটার। কোলে একটা মাস ছয় সাতের উলঙ্গ শিশু।
সন্ধ্যা তখন। দিনের আলো ফুরিয়ে চারদিক থেকে চাপ চাপ গাঢ় আঁধার চুঁইয়ে পড়ছে। একটা দোকানের পিছনে লুকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ ধরে। এদিক-ওদিক থেকে ভেসে আসছিল গোলাগুলির আওয়াজ, চিৎকার আর্তনাদ, বিমানের শব্দ, হঠাৎ হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দ, গাড়ির দ্রুত ছুটে চলার আওয়াজ। কঠিন দীর্ঘ মুহূর্তগুলো মৃত্যুর আশঙ্কায় কেটেছে। সকাল থেকে কাবুল এয়ারপোর্টের ইভাকুয়েশন্ কন্ট্রোল চেকপোস্টের সামনে অপেক্ষা করছিলাম। বাচ্চা, বুড়ো নানা বয়সের নানা দেশের হাজার হাজার মানুষের ভিড়। স্থানীয় আফগানদের সংখ্যাই বেশি। সবাই কোনরকমে এখান থেকে পালানোর জন্য মরিয়া। বিকেলের দিকে ভিড়ের ওপর হঠাৎ গুলিবৃষ্টি শুরু হওয়ায় দিশেহারা হয়ে পালিয়ে ঐখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম। মেয়েটাও কোথার থেকে পেছন পেছন ছুটে এসে আমার সাথে লুকিয়েছিল। মাঝে মাঝে আমার দিকে চাইছিল। বাচ্চাটা কেঁদে উঠলেই মুখটা চেপে ধরে আওয়াজ ঢাকার চেষ্টা করছিল।
কতক্ষণ এভাবে কেটেছে জানি না। মেয়েটা হঠাৎ আমাকে বলে, ‘আমাকে বিয়ে করবেন?’
অনেক আফগান মেয়েই কাবুল এয়ারপোর্টের বাইরে বাধ্য হয়ে বিদেশিদের বিয়ে করছিল। বেশিরভাগই পড়ত নারীপাচারকারিদের খপ্পরে। পরিণাম তারা নিজেরাও যে জানত না তা নয়। কিন্তু সে নারকীয় জীবনও আজ তাদের কাছে স্বর্গ।
‘নিয়ে যাবেন আমাকে? বিয়ে না করলেও আমাদের দুজনকে খেতে দিলেই হবে। আপনার সব কাজ করে দেব।‘’
‘কেউ নেই তোমার?’
‘বছর কয়েক আগে বাবা আমাকে বাদ দেয় (বিবাদ মেটাতে আফগানরীতি ‘বাদ’ অনুযায়ী অপরাধী পরিবার, তাদের কুমারী মেয়েকে ক্ষতিগ্রস্তের হাতে তুলে দেয়)। তারা আমাকে ঠিকমতো খেতে দেয় না। মারধোর করে। যখন তখন যে সে আমাকে বিছানায় টেনে নিয়ে যায়। কখনো কখনো পর পর দু তিন জন। বাধা দিলে মারে। কেউ বিয়ে করলে, একজনকে সহ্য করা সহজ। তা ছাড়া ভালোমতো খেতে পরতে দেয়। মার কাছে একদিন পালিয়ে গিয়েছিলাম। সে বলল কিছু করতে পারবে না। বাবা মারপিট করে আবার তাদের কাছে রেখে এল। এ যখন পেটে তখনও ওরা আমার সাথে জোর করত। পারছিলাম না আর, পালিয়ে গিয়েছিলাম। একটা খবরের কাগজের লোক আসমাদির সাথে দেখা করিয়ে দেয়। সেখানে আমার মতো অনেক মেয়েই থাকত। আমাদের একটু করে লেখাপড়া শেখাত। কত যত্ন করত। গালিচা বুনতে শিখিয়েছিল।‘’
‘সেখান থেকে এলে কেন? ওখানে ফিরে যাওয়াই তো ভালো। ওরাই একটা ব্যবস্থা করে দেবে।’
‘আসমাদিকে তালিবানিরা মেরে দিয়েছে। ওদের হাতে পড়লে আবার আগের মতো অবস্থা হবে। খাবারও যা ছিল ফুরিয়েছে। আমরা কয়টা মেয়ে কি করব! কিছু জানি না। রোজ আসি যদি অন্য কোথাও কিছু ব্যবস্থা হয়। অন্য দেশে যেতে গেলে কিসব কাগজ লাগে, সে আর কোথায় পাব! দু একজনের আমাদের মধ্যে বিয়ে হয়েছে। আমারও হয়ে যেত যদি বাচ্চাটা না থাকত। একে আর কোথায় ফেলি বলুন!’
চুপ করে ছিলাম। কিই বা বলতাম!
‘এর কোন একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন? শুনেছি আসমাদির মতো অনেকেই আছে যারা বেওয়ারিশ বাচ্চাদের রাখে।‘’
নীরব ছিলাম।
‘আমাদের কি উপায় হবে বলতে পারেন?’
বাচ্চা মেয়েটার গলায় ছিল অসহায়তা, ক্লান্তি, ঝরে পড়ছিল তীব্র আকুতি। আকাশে ছিল প্রাগৈতিহাসিক আদিম আঁধার। তার ছোট্ট বাচ্চাটা মায়ের কোলে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। নির্মল প্রশান্তি তার নরম মুখে।
যা স্বাভাবিক, পালিয়ে এসেছি আমি। সে মেয়েটার মতোই একটু খোলা হাওয়ার খোঁজে।