বাংলা চলচ্চিত্রের অভিধান--গৌতম চট্টোপাধ্যায়; বাণীশিল্প, কলকাতা-৯; নভেম্বর ২০১৫; ISBN: নেই
বিড়লা-গোয়েঙ্কাদের মতো ইস্পাহানী-আদমজীরাও ক্লাইভ স্ট্রিট শাসন করতেন সেকালে!
না, ক্লাইভ স্ট্রিট বলতে শুধুমাত্র আজকের কলকাতার বিবাদী বাগ অঞ্চলের নেতাজী সুভাষ রোড বুঝলে চলবে কেন? ক্লাইভ স্ট্রিট হলো একটা প্রতীক, অবিভক্ত বঙ্গের বাণিজ্যের সুষুম্নাকাণ্ড!
চাউল থেকে এয়ারলাইন্স—বিবিধ ব্যবসার প্রাণপুরুষ মীর্জা আহমদ ইস্পাহানী (১৮৯৮—-১৯৮৬ খ্রি.) সাহেব বিবাহ করলেন জ্যোৎস্নাসম সুন্দরী অভিনেত্রী কলকাত্তাইয়া এংলো-ইণ্ডিয়ান পেশেন্স কুপার (১৯০২—১৯৯৩ খ্রি.)-কে। তাঁকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করলেও ইস্পাহানীর ইরানীয় শিয়া সম্প্রদায় কুপারকে মেনে নেয়নি তাদের গৃহবধূ হিসেবে। হ্যাঁ, দেবিকারাণী-কাননবালারও আগের কালের, বস্তুত ভারতীয় সিনেমার আদিতম, মহানায়িকা ছিলেন এই পেশেন্স কুপার-ই; পরে সাবরা বেগম নামে যিনি এই সেদিন পর্যন্ত করাচী শহরে বেঁচে ছিলেন—অনেক অনেক অনাথ সন্তানের কাছে তাদের মায়ের মতো। সেকালে কলকাতায় তোলা 'নল-দময়ন্তী', 'ধ্রুবচরিত্র', 'সতী' প্রভৃতি প্রথম যুগের বহু বহু হিট সিনেমার নায়িকা ছিলেন এই পেশেন্স কুপার।
না, এই গল্পটা লেখা নেই আলোচ্য অভিধানটিতে।
যদিও যা যা আছে তার থৈ পাই কৈ?
হিন্দী, তামিল, তেলুগু প্রভৃতি ভাষার সিনেমা-কোষ আজ সহজেই নেটে উপলব্ধ, যদিও বাংলা ছবি ধারে-ভারে-মানে ও জ্যেষ্ঠতায় এদের আগে থাকে। তবুও, 'নন্দন'-এর সরকারি ছত্রছায়ায় অংশু সূর মহাশয়ের সম্পাদনায় বিশ বছর আগে যে কোষগ্রন্থটি রচিত হয়েছিল সেটি ছাড়া আলোচ্য বইটির তুলনীয় আর তৃতীয়টি পাইনি। সবচেয়ে বড় কথা এই বইটি গৌতমবাবুর সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ও অর্থে নির্মিত হয়েছে।
বর্ষীয়ান গ্রন্থাগারিক শ্রীগৌতম চট্টোপাধ্যায় বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এক মান্য ব্যক্তিত্ব, যদিও 'পেজ-থ্রি'-তে এমন মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাবে না; কারণ স্ক্রিনের সামনে নয়, পিছনে থাকতেই পছন্দ করেন এমন সাধক। দীর্ঘকাল 'নন্দন'-এর গ্রন্থাগারিক ছিলেন, এবং সেখানে Film appreciation course-টি পড়াতেন। এই গ্রন্থটি যাদবপুরে ওঁর পিএইচ ডি-র ডিসার্টেশন ছিল, যার পরীক্ষক ছিলেন স্বয়ং মৃণাল সেন। মুদ্রিত 'ভূমিকা'-টিতেও তিনি অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন বইটির, লিখেছেন, "তথ্যের বৈচিত্র্যে পাঠকের আকর্ষণ ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে রাখতে পেরেছেন লেখক।"
সর্বাংশে সত্যি কথা। উপস্থাপনার গুণে সুখপাঠ হয়ে উঠেছে একটা অভিধান গ্রন্থও।
***
অভিধানের গ্রন্থ-সমালোচনা লেখা কঠিন কাজ কারণ কোনো গ্রন্থ পুরোটা না পড়ে লেখা যায় না আবার গোটা একটা মোটকা অভিধান পুরো পড়েও তো ফেলা যায় না একাসনে বসে। তাহলে কি কোষগ্রন্থের সমালোচনা লেখা হবে না? পাঠক আইডিয়া পাবেন না একটি অভিধান গ্রন্থ কেমন, তার ? তা কেন?
যেমন, এই কোষগ্রন্থটি সম্বন্ধে জানতে পাই...
"এই গ্রন্থ বাংলা কাহিনিচিত্র এবং তার সঙ্গে যুক্ত উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সমূহের তথ্যবহুল আকর। ... নির্বাচিত ছবিগুলির ক্ষেত্রে ছবির সঙ্গে যুক্ত কলাকুশলীদের নামোল্লেখের পাশাপাশি ছবিটির সংক্ষিপ্ত কাহিনিসূত্রও দেওয়া আছে। শুধুমাত্র চিত্রপরিচালক নন, পাশাপাশি কাহিনী/চিত্রনাট্যকার, আলোকচিত্রী, শিল্পনির্দেশক, শব্দযন্ত্রী, সম্পাদক, সঙ্গীতপরিচালক ও গায়কগায়িকা এবং অভিনেতা/অভিনেত্রী সংক্রান্ত তথ্যাদির সন্নিবেশ ঘটেছে এখানে।"
চলচ্চিত্র যে একটি বিশাল ইজেলে আঁকা মস্ত এক জ্যান্ত ছবি—শুধুমাত্র এক director's medium নয়, এক যৌথ-শিল্পমাধ্যম—-এ' অভিধানে যথেষ্ট স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে সেই দিকটার।
এই ব্লার্বটি পড়লেই গ্রন্থটির বিস্তৃতির থৈ কিছুটা পাওয়া যায়।
**
যেমন, ভাবুন না, এক শব্দযন্ত্রী বা শিল্পনির্দেশক বা ক্যামেরাম্যান বা এডিটরের সফল কাজ ছাড়া কোন সিনেমা উতরোতে পারে কি? পারে না। শিল্পনির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত ছাড়া 'চারুলতা' বা 'শতরঞ্জ কে খিলাড়ী' ভাবা যায়? সুরকার রাজেন সরকার ছাড়া 'ঢুলী' (১৯৫৪) সিনেমা? কিন্তু বহু বহু ক্ষেত্রেই এই নন-পেজ-থ্রি শিল্পীগণ অন্তরালেই থেকে যান। নৈলে, সত্যেন চট্টোপাধ্যায় বা মধু শীলের মতো শব্দযন্ত্রী; বিভূতি লাহা বা বিশু চক্রবর্তীর মতো ক্যামেরাম্যান; অথবা বীরেন নাগ/রবি চট্টোপাধ্যায়ের মতো শিল্পনির্দেশক কি চিরকালই অন্তরালে থেকে যান/যেতেন, যদি না গৌতমবাবুর এই কোষগ্রন্থে ঠাঁই পেতেন ওঁরা?
সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালের বাইরেও বাংলা সিনেমাজগৎ ছিল, আছে রমরম করেই। এটা ভুললে চলবে না।
আন্তর্জাতিক ফিল্মোৎসবের পুরস্কার নাম ও মান বাড়ায় অবশ্যই, তবে ইন্ডাস্ট্রির পেটে ভাত জোগাতে উত্তম-ভানু থেকে অঞ্জন-সুখেন-হরনাথ আছেন থাকবেন থাকা উচিত। এই কোষগ্রন্থে এমন শিল্পকর্মীদের যোগ্য স্থান দেওয়া হয়েছে।
***
সিনেমা নিয়ে ছুট্কাহানী (anecdote) ও ট্রিভিয়া আজকাল বিশেষ জনপ্রিয়। এই অভিধানগ্রন্থটিতেও কথাচ্ছলে এমন কত কত যে চলে এসেছে! পড়তে পাওয়া বেশ আনন্দের
যেমন, শুনবেন? (কত কত তথ্য যে জানতামই না!)
১. ঐ আদি মহানায়িকা পেশেন্স কুপার যে পার্শী ব্যবসায়ী জামশেদজী ফ্রামজী ম্যাডনের ('Father of Indian Film-production') ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছিলেন কলকাতা শহরে, সেই 'ম্যাডন থিয়েটার' কোম্পানি এককালে কলকাতার 'মিনার্ভা' (চ্যাপলিন), 'এলিট' থেকে আরম্ভ করে সারা ভারতবর্ষে ডেড়শ'রও বেশি সিনেমাহলের মালিক ছিল—লাহৌর থেকে রেঙ্গুন পর্যন্ত! হ্যাঁ, ১৫০ প্লাস!
২. আদিযুগের চলচ্চিত্রকার প্রেমাঙ্কুর আতর্থী (১৮৯০-১৯৬৪ খ্রি.) কলকাতায় বসে সেকালে 'নিউ থিয়েটার্স' কোম্পানির ব্যানারে তিনটি উর্দুভাষার ছবিও তুলেছিলেন। হিট! হ্যাঁ, ইনিই বাংলাভাষায় 'মহাস্থবির জাতক' উপন্যাস লিখে অমর হয়ে আছেন।
৩. 'দাদাসাহেব ফালকে' ও 'পদ্মভূষণ' পুরস্কারপ্রাপ্ত 'নিউ থিয়েটার্স'-এর প্রতিষ্ঠাতা বীরেন্দ্রনাথ সরকার (১৯০১-১৯৮০ খ্রি.) ছিলেন কলকাতার হিন্দু স্কুল ও প্রেসিডেন্সী কলেজের কৃতী ছাত্র যিনি অতঃপর লন্ডন থেকে এঞ্জিনিয়রিং পাশ করে আসেন। পিতৃদেব তাঁর ছিলেন অবিভক্ত বঙ্গপ্রদেশের অ্যাডভোকেট জেনারেল স্যর নৃপেন্দ্রনাথ সরকার!
৪. 'বিলেত ফেরৎ'-নামে কিন্তু একটা নয়, দুটো সিনেমা হয়েছিল। একটা ১৯২১-এ নির্বাক চিত্র যাতে ডিজি, মানে প্রবাদপ্রতিম ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ('দা. সা. ফালকে, ১৯৭৫') অভিনয়জীবন শুরু। দ্বিতীয়টি তার ৫০ বছর পরে, আরেক প্রবাদপ্রতিম চিদানন্দ দাশগুপ্তের পরিচালনায়, যাতে উনি কন্যা রীনা-কে (অপর্ণা সেন) নিয়েছিলেন। দুটি আলাদা আলাদা কাহিনী কিন্তু।
না, ভাববেন না যে এই কেতাবে শুধুমাত্র সেকালের তথ্যই আছে। অনেক অনেক আধুনিককালের তথ্যও এই অভিধান থেকেই জানতে পারা গেল। যদিও ঘোষণা মোতাবেকই কেবলমাত্র কাহিনিচিত্র সংক্রান্ত তথ্যই এখানে আছে, তথ্যচিত্র সম্বন্ধে নয়।
***
প্রাচীন প্রকাশক 'বাণীশিল্প'-র কাজে বিন্দুমাত্র আধুনিকতার ছোঁয়া না পেয়ে হতাশ হয়েছি। শুধু যে ISBN নেই তা-ই নয়, বইটির কপিরাইট কার তারও উল্লেখ নেই ক্রেডিট পেজে। প্রকাশকের ই-মেইল ঠিকানাও দেওয়া নেই। যদিও ছাপাই-বাঁধাই ভালোই এবং মুদ্রণপ্রমাদও চোখে পড়েনি।
পুনঃ- পূর্বপাকিস্তান/বাংলাদেশে নির্মিত বাংলা চলচ্চিত্রের কোনো তথ্য ঠাঁই পায়নি এখানে। ব্লার্বে বা ভূমিকায় সে কথাটা বলে দিলে ভালো হতো।
গ্রন্থঃ "বাংলা চলচ্চিত্রের অভিধান"—-গৌতম চট্টোপাধ্যায়। প্রকাশনালয়ঃ 'বাণীশিল্প', কলকাতা-৯ . প্রথম প্রকাশঃ নভেম্বর ২০১৫. ISBN নেই.
|| বারোদুয়ারী বালচন্দ্রের অভিধান||
বাংলা অকথ্য শব্দের অভিধান—সত্রাজিৎ গোস্বামী; প্রকাশনালয়ঃ 'পত্রভারতী', কলকাতা-৯. প্রথম প্রকাশঃ ডিসেম্বর ২০২০; ISBN 978-81-8374-627-4
বছর পাঁচেক আগেও জানতাম না যে ব্রাত্যশব্দ নিয়ে বাংলাভাষায় যথেষ্ট উচ্চমানের কাজ আছে, হয়ে গেছে, হচ্ছে। (কোন্ লজ্জায় গ্র.স.-বাবু সেজে বসে আছি, ভাবি! এখানে দুটি ক্রন্দন-স্মাইলি!)
পঁয়ষট্টি সংখ্যায় আলটপকা এমন মন্তব্য করে ফেলায় এক আদি-পরবাসী বন্ধু আমারে শুধরে দিলেন। অতঃপর আটষট্টি সংখ্যায় বাংলা স্ল্যাং-এর উপরে অভ্র বসুর বইটি নিয়ে লিখি (তার আগে মাসখানেক বইটি শয়নে-স্বপনে ছিল)। (গ্রন্থ সমালোচনা, ভবভূতি ভট্টাচার্য; পরবাস-৬৮ (parabaas.com)) সেই থেকে ব্রাত্যশব্দ বিষয়ক অনুসন্ধিৎসা বেড়েই চলেছে বেড়েই চলেছে, এবং ইতোমধ্যে ৭৮-সংখ্যায় তৃপ্তি সান্ত্রার 'মেয়েদের স্ল্যাং', ও ৮০-সংখ্যায় অসীম মান্না-র 'দক্ষিণবঙ্গের প্রবচন' বই নিয়ে লিখেছি।
বস্তুত, ব্রাত্যশব্দের খনন সামাজিক ইতিহাসের এক মোক্ষম পাঠ, যা অনেক অনেক ইতিহাসগ্রন্থেও পাওয়া যাবে না। কারণ এর যোগ মাটির সঙ্গে, নাড়ির টান সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। কোনো এক শব্দ যখন যুগ বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে সুসভ্য থেকে ব্রাত্যে অধঃপতিত হয়, সমাজেতিহাসের ধারাটা সেখানেই প্রোথিত হয়ে যায় না কি? ব্রাত্যশব্দের পাঠ তাই এত আকর্ষণীয়। কোনো শব্দ কেন এবং কবে থেকে ব্রাত্য বলে পরিগণিত হতে লাগল—সে ইতিহাসের ধারা কিন্তু আজকেও খুঁজে পাইনি। আবার কোনো শব্দ হয়তো এক পরিমণ্ডলে বেবাক চালু, অন্যত্র ভয়ংকর ভুরু কোঁচকানোর কারণ (উদা. নারীর স্তন বোঝাতে 'ম্যানা' শব্দটা ষাটের দশকেও পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে বড় একটা অশ্লীল মানা হতো না, কিন্তু কলকেতার সংস্কৃত পরিমণ্ডলে সেটা ভয়ানক ব্রাত্য! ভয়ানক! গ্রাম থেকে ঘুরে এসে কেলাস ফাইভের এক বালক জেঠামশায়ের পেল্লায় থাপ্পড় খেয়েছিল, বলে।)
***
অধ্যা. সত্রাজিৎ গোস্বামী মশায়ের বর্তমান আলোচিত গ্রন্থটি কিন্তু অভ্র বসুরটির (৬৮ সংখ্যা) চাইতে প্রবীণতর; এবং ধারে-মানে কম নয়, হয়ত বা বেশিই (আদত প্রকাশ ২০০০ সনে, বর্তমানেরটি পরিবর্ধিত সংস্করণ)।
যদিও পুরোটা পড়া যায়নি।
কেন?
অভ্রের কেতাবে যেমন 'আলোচনা' ও 'অভিধান' দুইটি নির্দিষ্ট ভাগ আছে, সত্রাজিতের আদি গ্রন্থটিতেও (প্রকাশ সন ২০০০) ছিল তেমনই । কিন্তু গত বিশ বছরে ক্রমে ক্রমে এর অভিধানাংশে শব্দ যোগ হতে হতে কলেবর বৃদ্ধির কারণে ডিসেম্বর ২০২০তে প্রকাশিত বর্তমান বইটি শুধুমাত্রই অভিধান (শব্দকোষ); সূচনার আলোচনা নিয়ে আরেকটি বই প্রকাশিতব্য। জানা গেল। বেশ। সেটিও পড়ার ইচ্ছা রইল।
এখন যেটা পড়া গেল তার কথা বলিঃ
প্রায় সওয়া দুই শত পৃষ্ঠা ব্যেপে এই যে অভিধান, অগুনতি এন্ট্রি (কত? গুনিনি। বলাও নেই কোথাও।), তত তত অশ্লীল শব্দ কি আছে বাংলাভাষায়? সন্দেহ হয়। বস্তুত, শুধু বাংলায় কেন, ইংরেজি বা ফ্রেঞ্চের মতো অনেক বেশি পুষ্ট ও আহরিত ভাষাতেও কি অত অত ব্রাত্যশব্দ হয়/আছে? যদি না ...যদি না, একই শব্দের ভিন্ন ভিন্ন দ্যোতনাকে আভিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়, হোক্ না সে ব্রাত্য-অভিধান।
একটা উদাহরণ দিয়ে বিশ্লেষ করিঃ
একটা নিরীহ শব্দ 'বাপী'। সংসদ অভিধান খুললে পরিষ্কার অর্থ পাওয়া যায় 'পুকুর'। এটি তৎসম শব্দ। তাহলে হাতের এই ব্রাত্য-অভিধানটিতে এই শব্দ ঠাঁই পায় কী করে? জানা গেল, সিঁধেল চোরেদের মহলে 'বাপী'-র অর্থ '(পুকুরের মতো) মস্ত বড় সাইজের সিঁধ'। বাঃ! দেখুন, এই দ্যোতনাটিই একটি শব্দকে ব্রাত্য বা না-ব্রাত্য করে দেয়। এই প্রকার বহু বহু পেশা-কেন্দ্রিক ব্রাত্যশব্দ খুঁজে এনে জড়ো করেছেন ডঃ গোস্বামী যা বইটিকে এক বিশেষ উচ্চতায় তুলে দেয়।
আরেকটি শুনবেন?
'গুবলু'। মেডিক্যাল রেপ্রেজেন্টেটিভদের মহলে এর গূঢ়ার্থ হয় 'কাজ না করে কাজ দেখানো'। বা, 'দূরবীন'—মানে, 'কাজে না গিয়ে ডাক্তার ভিজিটের রিপোর্ট করা'।
এমন এমন হাজারো শব্দের সমাহার ঘটিয়েছেন ডঃ গোস্বামী তাঁর এই ব্যতিক্রমী গ্রন্থটিতে, অধ্যা. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে অধ্যা. শিশিরকুমার দাসের মতো মান্য ভাষাবিজ্ঞানীগণ যার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন (এই গ্রন্থটিতে সংযোজিত)।
এ' অভিধান হাঁটকাতে হাঁটকাতে (১) অপরাধ-জগৎ (২) সাধারণ (৩) কারাকর্মী (৪) ছাত্র-যুবা (৫) গ্রাম্য/আঞ্চলিক (৬) নাগরিক/শিক্ষিত বা উচ্চশিক্ষিত (৭) চোরাকারবারি (৮) সোশাল মিডিয়া (৯) পকেটমার/কেপমার (১০) তৃতীয়লিঙ্গ গোষ্ঠী (১১) নেশাখোর—এমন এমন বহু উপ-বর্গীকরণ (sub-classification) খুঁজে পেয়েছি, 'ভূমিকা'-তে লেখক যার একটি দুটির উল্লেখ করে দিয়েছেন মাত্র, পুরো লিস্টি থাকলে ভালো হতো। তবে, পুরো অভিধান জুড়ে প্রতিটি শব্দের পাশে পাশে ঐ বর্গীকরণটি ব্র্যাকেটের মধ্যে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি। এইটি একটি কাজের কাজ হয়েছে।
***
কালের সাথে সাথে শব্দের অবনমন ঘটে—গ্রহণযোগ্য থেকে ব্রাত্যে পতিত হয়—-এ' তো জানা কথা।
বিবেকানন্দ-বঙ্কিমের কালে 'মাগী' 'রাঁড়' 'মিনসে' প্রভৃতি শব্দ অনায়াসে চালু থাকলেও আজকের দিনে কঠোর ব্রাত্যশব্দ। আজকের দিনে 'এই ছোঁড়া, এদিকে শোন্ তো?'—বলে দেখুন না (যদিও সংস্কৃত শব্দ 'ছমণ্ডা' ভেঙে বাংলায় এই শব্দটা এসেছে); ছোঁড়ার স্ত্রীলিঙ্গে 'ছুঁড়ি' তো কঠোরতর ব্রাত্যশব্দ। এমনধারা চলছেই, চলতেই থাকবে যদ্দিন ভাষা থাকবে।
কালের সাথে সাথে শব্দের অবনমন যেমন হয়, তেমনি উত্থানও হয় বৈ কি?
'উত্তম-মধ্যম', 'পাকামো’, 'পাখি উড়ে যাওয়া’, 'ভিজে বেড়াল', 'হ্যানো ত্যানো' প্রভৃতি শব্দ আজকের দিনে আর ভ্রূকুঞ্চনের জায়গায় নেই, বাবা-মায়ের সামনেও এ'সব শব্দ অনায়াসে বলা চলে। তাই সন ২০২০এ প্রকাশিত এই 'অকথ্য' শব্দাভিধানে এদের ঠাঁই পাওয়ার কথা ছিল না।
'ব্যাঙের ছাতা', 'বাস্তু ঘুঘু', 'ব্যাঙের আধুলি' 'পাল্লায় পড়া', 'হরিদাস পাল', 'বারোটা বাজা'-র মতো অনেক অনেক প্রবাদ-প্রবচনও এই অভিধানে রয়েছে দেখছি যাদের আর আজকের দিনে 'অকথ্য' শব্দ বলে নাক সিঁটকানো চলে না। যদিও 'বাতেলা'-র মতো শব্দ সুভদ্র-অভিধানে ঢুকে আসা সত্ত্বেও সবিশেষ কৌলীন্য পায়নি এখনও। এমন তো চলতেই থাকে, থাকবে। দেশাচার ও স্থান-কাল-পাত্রের উপরে নির্ভরশীল এটা।
চমকে গিয়েছি পাক্কা অপরাধজগতে চালু বেশ কয়েকটি ব্রাত্যশব্দ পেয়ে। উদা. 'বারকান্সি' (অর্থ, যৌনকর্মী) 'গিলিতোড়' (অর্থ, 'সক্রিয় পায়ুকামী'), 'প্যানা' (অর্থ. 'গণিকার দেওয়া অর্থসাহায্য'), 'আসমান কবুতর' (অর্থ, নারীস্তন), 'গেঁড়েচোদা' (অর্থ, অত্যন্ত দুষ্ট), 'ছিলুক' (অর্থ, মুসলমান) 'প্রিন্টেড' (অর্থ, নিতম্ববতী মহিলা। 'ছাপা' শব্দ উল্টিয়ে পাওয়া)।
পঞ্চাশ বছর পূর্বে প্রকাশিত অধ্যা. ভক্তিপ্রসাদ মল্লিক মহাশয়ের যুগান্তকারী 'অপরাধ জগতের শব্দকোষ' (১৯৭১) গ্রন্থটির পরে এমন এমন শব্দ চোখে পড়েনি।
স্থানভেদে শব্দের ব্রাত্যতা বদলায়। যেমন 'চুঁচে দেওয়া' শব্দের অর্থ এখানে দেওয়া রয়েছে 'প্রহার করা'। আমাদের হুগলীর গ্রামেগঞ্জে কিন্তু মা-ঠাগমারা 'দেহের ব্যাথার স্থান ডলে দেওয়া বা ম্যাসেজ করে দেওয়া' অর্থে হামেশা শব্দটা ব্যবহার করতেন। আজ লুপ্ত হয়ে গেছে এর ব্যবহার। আশাপূর্ণা দেবী ও গজেন্দ্রকুমার মিত্রের লেখায় এমন শব্দ হুদো-হুদো পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত, 'বহু বহু' বোঝাতে এই 'হুদো হুদো' শব্দটি এই অভিধানে ঠাঁই পেলেও মোটেই ব্রাত্য শব্দ নয় এটি। আমাদের গ্রামের ঘরে মা-বাবার সামনেও এই শব্দ হামেশাই বলি। ব্রাত্য শব্দের একটা মাপকাঠি তো হলো এই যে যেটা গুরুজনের সামনে বলা চলে না। তাই তো?
যুগের সঙ্গে সঙ্গে নূতন নূতন শব্দবন্ধ বা abbreviation বাংলাভাষায় ঢুকে এসেছে, যাদের দ্যোতনা নিশ্চয়ই ব্রাত্যধর্মী। যেমন, 'পে টি এম' (অর্থ, পে টু মোদী—নোটবন্দীর সময়ে চালু তির্যক শব্দ), 'পি এ ডাব্লু' (অর্থ, Parents Are Watching). এই রকম বেশ কিছু শব্দ সযত্ন সঞ্চয় করে এনেছেন সত্রাজিতবাবু। গ্রেট!
কৌশিক মুখার্জীর তোলা 'গাণ্ডু' বলে একটা চমৎকার বাংলা সিনেমা এসেছিল কয়েক বছর আগে। কিন্তু সেই সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরলে শ্বশ্রূমাতা যখন জিগাইলেন, 'কী বই দেখে এলে বাবা?', বলতে পারিনি নামটা, শব্দটা ব্রাত্য কিনা। 'গাণ্ডু' কিন্তু খাঁটি বাংলা শব্দ। অতি প্রাচীন। 'শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে' আছে। অর্থ, তুলোর বালিশ বা তাকিয়া। 'অনুভূতিহীন নির্বোধ ব্যক্তি' বোঝাতে বালিশের উত্তেজনাহীন জড়ত্বের অনুষঙ্গে অর্থাপকর্ষ ঘটেছে আজকের দিনে।
কঠোর থেকে কঠোরতর অশিষ্ট/অশ্লীল/ব্রাত্য শব্দের মূল ধরে আলোচনা রয়েছে এই বইয়ে, যাদের আরও দু'একটি নিয়ে এখানে লেখার ইচ্ছে ছিল কিন্তু কলমের ডগায় অদৃশ্য ভিক্টোরিয় মোজা পরানো রয়েছে না! তাই পারলুম না। ক্ষমাপ্রার্থী।
এ'বইয়ের আলোচনা এমন সহজে ফুরিয়ে যাবার নয়।
পড়ার ঘরের তাকে সযত্ন রেখে দিন। অবশ্যব্যবহার্য একটি রেফারেন্স বই এটি।
দশে নয়।
|| ভাগ্যিস চড়িয়েছিলেন মোষ—কলকেতার কথক ||
কলিকাতাঃ সেকালের গল্প, একালের শহর—তিলক পুরকাস্থ; কলিখাতা প্রকাশনী, কলকাতা-৪৯; সেপ্টেম্বর ২০২১; ISBN 978-93-5493-791-0
কলকেতের চীনেম্যান, ফিরিঙ্গি বো ব্যারাক, গাঁজা—যা সাধুনামে গঞ্জিকা, খেচর বাঙালি রাম চাটুজ্জ্যে, পান (তাম্বুল)-ও-হুঁকোবিলাসী বাঙালি, জাদুঘরের স্থাপক ডাক্তার ওয়ালিচ থেকে আরমানি রেজাবিবি—না, এর কোনো নামই সম্পূর্ণ অপরিচিত নয় কিন্তু দুই মলাটের ভিতরে তরতরে গদ্যে এই এই আখ্যান পড়তে পাওয়া যথেষ্ট আয়েসী!
পলাশী-বক্সারের যুদ্ধ! অতঃপর অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ভাগ থেকে মিউটিনির একশো বছরে একদিকে যেমন অপার ব্রিটিশ লুণ্ঠন চলেছে ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে, আবার এই সময়েই নব্য নগর কলিকাতার উত্থান, বাঙালির দবদবা, পায়রা ওড়ানো ও বাজি পোড়ানো! ইহা ভালো না মন্দ হইয়াছিল? তার চুলচেরা বিচার করার আমি কে হে? নগদ সাড়ে তিনশ' টঙ্কা দে' এই অক্টেভো সাইজের কেতাবটি কিনে আরামকেদারায় পায়ের উপরে পা তুলে পড়তে লেগেছি কলকেতার গপ্প—-আমার শহর কলকেতার আদি বৃত্তান্ত, যেখানে গপ্পচ্ছলে এয়েচেন জব চার্নকবাবু, বুলবুলির লড়াই, বটতলার বই থেকে টেরাম গাড়ি থেকে 'স্বপনকুমার'!
সে কী! স্বপনকুমার? সেই গোয়েন্দা দীপক-রতন যার "দু-হাতে দু'টো রিভালবার, অন্য হাতে টর্চ'?! হ্যাঁ, তিনিই। বইটির শীর্ষনামে সেকালের পাশাপাশি একালও জড়িয়ে আছে যে গো! তাই ডঃ স্বপনভৃগু পাণ্ড্যে-কে খুঁজে পাওয়া গেল এ'-কেতাবে।
পড়লে রসটা পাওয়া যাবে, হাঁড়িটা হাটে ভেঙে দেব না।
***
কৃতবিদ্য চিকিৎসক তিলকবাবুর বহু বহু লেখা নানান কাগজে-পত্রিকায়-ফেসবুকে পড়ে পড়ে ফ্যান হয়ে পড়ি, এবং এ'বইয়ের ক্রয়। ঠকি তো নিই, বরঞ্চ না পড়লে অকৃত্রিম পাঠসুখ থেকে বঞ্চিত হতেম। কারণ এঁর লেখার ভঙ্গিটি অতীব বৈঠকী, কোথাও পণ্ডিতির দেখনদারি নেই। যে যে সোর্স থেকে পেয়েছেন সঙ্গে সঙ্গে পাঠককে সেটা বলে দিয়ে আরও পাঠের জন্য ডালরিম্পল বা হরিসাধন মুখুজ্জ্যে রেফার করেছেন। শহর কলকাতার আদি-মধ্য ইতিহাস নিয়ে তো লাইব্রেরির তাক তাক জোড়া বই থাকে, বহু বহু পণ্ডিত মানুষের seminal work রয়েছে—তার মধ্যে ক্ষুদ্র এই বই পাঠকের মনে ঠাঁই করে নেবে বিষয়-চয়নে ও প্রকাশভঙ্গিমায়। ভালো লাগল।
মুখবন্ধে লেখকের সবিনয় নিবেদন এ'বইয়ের আখ্যানগুলির 'অজানা' চরিত্র নিয়ে। ‘অজানা’ বিষয়টা তো আপেক্ষিক। যাঁর কাছে নাহুমের কেক থেকে পিজি হসপিটালের ইতিহাস 'অজানা', তিনি তো এ'বইয়ের নিবন্ধগুলি পড়ে নিখাদ আনন্দ পাবেনই, যাঁর কাছে তাহা নহে, তিনিও তিলকবাবুর গপ্পে স্টাইলটায় মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না।
চমৎকার অনেক অনেক সাদাকালো ছবি দিয়ে পাঠকের পাঠসুখ বহুগুণ বর্ধিত করতে নিবেদিত হয়েছেন শিল্পী সুদীপ চক্রবর্তী; এমনকি সঙ্গে দেওয়া বুকমার্ক কার্ডখণ্ডও শিল্পসুষমামণ্ডিত। ভালো লাগল নব্য প্রকাশনালয়টির সযত্ন কাজ।
জ্যাকেটের লেখক-পরিচিতিতে এই বর্ষীয়ান লেখককে মোষ-চারক বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে (ঘরের খান কি না সেটা বলেনি)। বেশ।
ভাগ্যিস চরিয়েছিলেন মোষ, তাই তো শহর কলকেতার এই কথকতা শুনতে পেলেম আমরা।
থ্যাঙ্কু!!
|| মা অন্নপূর্ণা—না-বলা কাহিনী ||
Annapurna Devi—The Untold Story of a Reclusive Genius— Atul Merchant Jataayu. Ebury Press, an imprint of Penguin Random House. First published on 29 November 2021. ISBN 9-780670-095339
পিতৃদেব তাঁর বিবাহবাসরে ঘুমন্ত বালিকাবধূ মদনমঞ্জরীকে ফেলে রেখে ব্রাহ্মণবেড়িয়া থেকে কলকেতায় পেইলে এসেছিলেন সঙ্গীতের তাগিদে।
কিংবদন্তির গিরীশ ঘোষের থ্যাটারে তবলচি হিসেবে যোগ দিলেন প্রসন্ন বিশ্বাস নামে।
'এই নেড়েটা বেশ বাজায় তো!' বলে তারিফ করতেন গিরীশবাবু।
অনেক ঘাটের জল খেয়ে বুন্দেলখণ্ডের দেশীয় রিয়াসত মাইহারে সভাগায়কের পাকা চাকুরি পেলেন যখন ততদিনে ভারতের সঙ্গীতমণ্ডলে আচার্য আলাউদ্দীন খান মস্ত এক নাম! ডবল বেতনেও কাশ্মীর-জয়পুরের সভাগায়ক হয়ে চলে যাননি মাইহাররাজ তথা শিষ্য বৃজনাথের টানে। কুমিল্লা থেকে মাইহারে ততদিনে সংসার পেতে নিয়ে এসেছিলেন বেগম মদিনা ও পুত্র আলি আকবরকে। ছোট মেয়ে রোশেনারার জন্ম মাইহারেই। ১৯২৭-এ।
ইনিই মা অন্নপূর্ণা!
১৫ই মে ১৯৪১-এ আলমোড়ায় বাবার প্রধান শিষ্য রবিশঙ্করের সঙ্গে বিবাহের ঠিক আগে আর্যসমাজী মতে হিন্দুধর্মে দীক্ষিত হয়ে রোশেনারা হয়ে উঠলেন অন্নপূর্ণা, যিনি কত বড় সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন আজকে তা আর কেউ জানে না, কারণ ১৯৫০-এর দশকে কয়েক বছর স্বামী রবিশঙ্করের (১৯২০-২০১২) সঙ্গে জনসমক্ষে বাজানো ছাড়া অন্নপূর্ণাদেবীকে আর কেউ বাজাতে শোনেনি; পুরনো আর্কাইভে ও ব্যক্তিগত সংগ্রহে পাওয়া যায় সামান্য কিছু নমুনা। উনি বেঁচে আছেন ওঁর মহীরুহসম শিষ্যদলের মধ্যে—নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, বাহাদুর খান, হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, নিত্যানন্দ হলদীপুর...তালিকাটি দীর্ঘ।
দীর্ঘ অর্ধ-শতাব্দীর বেশি সময় ধরে বোম্বাইয়ের এক সাততলার ফ্ল্যাটে একাকী নিবাস করে সঙ্গীত-শিক্ষকতার মধ্যে দিয়ে সঙ্গীত-সাধনা করে গেছেন মা অন্নপূর্ণা (১৯২৭-২০১৮ )—ততদিনে রবি ছেড়ে গেছেন তাঁকে, মার্কিনদেশে একমাত্র পুত্র শুভশঙ্করের (১৯৪২-১৯৯২) অকালমৃত্যু ঘটেছে।
সব সয়েছেন। সয়ে গেছেন।
বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কেবলমাত্র সুরবাহারের মূর্ছনায়।
***
সদ্য এক হপ্তা আগে মহা ঢক্কানিনাদে পেঙ্গুইন-র্যানডম হাউজ এই বইখানি লঞ্চ করেছে, লোভে পড়ে প্রি-বুক করে কেনা।
না, ঠকিনি।
পেশায় মণিকার শিষ্য-লেখক অনেক 'কিন্তু কিন্তু ' করে নামিয়েছেন এই সাড়ে তিনশ' পৃষ্ঠার ঢাউস হার্ডবাউণ্ডটি, শুধু ছবি দেখে চললেই যার ছ' আনা উশুল হয়ে যায়; সেরাটা হচ্ছে ইহুদি মেনুহিনের আলিঙ্গনে ইন্দিরা গান্ধী (পৃ. ১৯৬), যাঁর সঙ্গে অন্নপূর্ণার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল ১৯৫০-এর দশক থেকে যখন রবিশঙ্কর দিল্লিতে রেডিওর চাকুরি করতেন, আর নেহেরুজীর আমন্ত্রণে মেনুহিন এসেছিলেন ভারতে। পুনরায় এলেন, তখন ইন্দিরা পিএম। এসে অনুরোধ করলেন অন্নপূর্ণাকে শোনবার, কিন্তু ততদিনে মা যে অন্তরালে চলে গেছেন, সমক্ষে আর বাজান না। বন্ধু ইন্দিরার অনুরোধ প্রায় ফিরিয়ে দেন দেন! শেষাবধি ঠিক হলো মাঝরাতে মা যখন দেবতার সম্মুখে বসে রেওয়াজ করেন পাশের কক্ষে চুপটি করে বসে শুনবেন মেনুহিন।
এ'-বইয়ে এমন এমন ছুট্কাহানী (anecdote) রয়েছে বহু বহু।
এই ইন্দিরাই ইমার্জেন্সির সময়ে বম্বে সফরকালে পুরনো বান্ধবীর সাথে দেখা করতে এলেন ওঁর ফ্ল্যাটে। দিল্লি গিয়ে মা পুরস্কার নিতে চাননি বলে পরে 'পদ্মভূষণ'-এর মেডেল ডাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন (১৯৭৭)।
সেই IPTA-র কাল থেকে সলিল চৌধুরী বন্ধু ছিলেন রবিশঙ্করের। সেই সূত্র ধরে অনেককাল পরে (১৯৮০) সলিল এলেন একদিন অন্নপূর্ণার বম্বের ফ্ল্যাটে, সঙ্গে এক অপরিচিত ব্যক্তি। নিভৃতচারিতায় অন্নপূর্ণাদেবী তো সুচিত্রা সেনের অনেক সিনিয়র, তবু সলিলদার সঙ্গে সহৃদয় আলাপচারিতা হলো, চা-পান। পরদিন 'যুগান্তর' কাগজে মায়ের দীর্ঘ ইন্টারভ্যু বেরিয়েছে দেখে কলকাতা থেকে ফোন গেল। হতবাক অন্নপূর্ণা! সলিলদাকে কঠোর পত্র দিলেন।
সলিলবাবু নাকি জানতেনই না যে নিজের সঙ্গীটি আসলে সাংবাদিক।
***
রবিশঙ্করের সাথে অন্নপূর্ণার অ-বনিবনা, পেশাগত ঈর্ষা—এ'সবে বাঙালির আদি ইন্টারেস্ট! মাতৃভক্ত আজকের এই লেখকও রবি-কে ঝেড়ে ইয়ে পরিয়ে দিতে কসুর করেননি তাঁর বহুগামিতার কারণে মা-কে যন্ত্রণা দেওয়ায়, ছেলেকে প্রলোভিত করে আমেরিকায় টেনে নিয়ে চলে যাওয়ায় বগর বগর। তবে রুশীকুমারের বিষয়ে লেখক কিন্তু অনেকটাই মূক; একটি মাত্র অধ্যায়ে দু'-কথায় তাঁদের বিবাহের গল্পটা সেরেছেন।
বিয়ে?
হ্যাঁ। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকেই রবি-অন্ন পৃথক হলেও ওঁদের আইনি ডিভোর্স ১৯৮২তে, যে বছরের শেষাশেষি ৮ই ডিসেম্বর অন্নপূর্ণা আইনত বিবাহ করেন তেরো বছরের কনিষ্ঠ ছাত্র এইচ-আর গুরু ডঃ রুশীকুমার পাণ্ড্যে-কে (১৯৩৯-২০১৩)। এই বিয়ে টিঁকে ছিল একত্রিশ বছর—রুশীকুমারের জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। মায়ের একাকিত্ব কাটাতে ও আর্থিক সঙ্গতির জন্য এই বিয়ে সংঘটিত হয়েছিল। অন্নপূর্ণা তখন পঞ্চান্নে, রুশীর বয়স ৪২। পুত্র শুভ বাজনা ছেড়ে তখন আমেরিকায় এক মদিরা-বিপণীতে কেরানিগিরি করছেন; আর রবিশঙ্কর রয়েছেন তৃতীয়া 'পত্নী'-র সাথে (নোরা জোন্সের মা)।
শত্রুভাবাপন্ন রবি-ক্যাম্প প্রচার করেছিল, কেবলমাত্র অবলম্বনের কারণে হলে অন্নপূর্ণা স্বামীরূপে নয়, রুশী-কে পুত্র হিসেবে দত্তক নিলে ভালো দেখাতো!!
হ্যাঁ, বয়সে রুশী-শুভো পিঠোপিঠি ছিলেন বটে।
সত্যি, অন্নপূর্ণা দেবী সারাজীবনে কত কত কষ্ট পেয়েছেন ভাবলে স্তম্ভিত হতে হয়, তার মধ্যে কঠোরতমটি হলো অবিশ্বাসী স্বামী রবিশঙ্করের লাগাতার মিথ্যাচার!
'অন্নপূর্ণা দেবী' নামক কিংবদন্তির চর্চায় এই বই মাইলফলক হয়ে থাকবে,—স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় ও যতীন ভট্টাচার্যের বইদুটির পাশাপাশি।
***
মা যে পি জি ওডহাউজের লেখার মস্ত ভক্ত ছিলেন—তা-ও কি এ'-বই না পড়লে জানতে পারতাম?