• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৫ | জানুয়ারি ২০২২ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • রস : সংগ্রামী লাহিড়ী





    একদিন নাকি অনেকদিন, একবছর নাকি অনেকবছর, সেই উত্তরের দেশে যেখানে অতলান্তিক সমুদ্দুর এসে ডাঙার সঙ্গে লুকোচুরি খেলে, অ্যালগনকুইন পাহাড়ের মাথায় কুয়াশা জমে, মাইলের পর মাইল বিছিয়ে থাকে তুন্দ্রা আর স্প্রুস গাছের অরণ্য, সেইখানে ওদের বাস। লাল-লাল মানুষগুলো। ছোট ছোট ঘর বেঁধে থাকে। বনে গিয়ে শিকার করে, হ্রদের জলে মাছ ধরে। তবে সে আর বছরে কমাস? ঠান্ডার দেশ, চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই গরমকাল ফুরিয়ে যায়। শীতের বেলা ছোট হয়। বরফে ঢাকে মাটি। পশুপাখির মাংস, চর্বি শুকিয়ে রাখে ওরা। এগুলো খেয়েই কাটাতে হবে দীর্ঘ শীতকাল। তারপর আবার বরফ পাতলা হবে, ন্যাড়া গাছের ডালে লাগবে প্রাণের ছোঁয়া। ফুলে ভরে গিয়ে হাওয়ায় দুলতে দুলতে বসন্তের খবর জানান দেবে।

    ওরা নিজেরাও অনেক কিছু জানে, বুঝতে পারে। যেমন ধরো, এখান থেকে সোওওওজা চলে যাও আরো উত্তরপানে, তুমি শুনবে দূর থেকে ভেসে-আসা গম্ভীর গর্জন, যেন মেঘের ডমরু বাজছে। দেখবে আকাশে উঁচিয়ে ওঠা জলের কণা দিয়ে তৈরি ধোঁয়া, আর তার ফাঁকে আশ্চর্য সব রামধনু। ওরা জানে ওখানেই সেই বিরাট নদী তার সমস্ত জল নিয়ে আছড়ে পড়ে খাদে - thundering water. ওদের ভাষায় 'নায়াগ্রা'। মা-দিদিমার কাছে শুনেছে, ওদেরই এক মেয়ের গল্প। এক টগবগে তরুণ ছিল তার ভালোবাসার মানুষ। এদিকে বাবা বিয়ে ঠিক করেছে রাজার সঙ্গে। মনের দুঃখে মেয়ে নৌকা বাইল সেই বিরাট নদীতে। দাঁড় বেয়ে চলে আর তার প্রেমিককে খোঁজে। খেয়াল করেনি, সামনেই নদী জলপ্রপাত হয়ে আছড়ে পড়ছে। মুহূর্তে নৌকাশুদ্ধ মেয়েকে টেনে নিল অতল খাদে। নৌকা উলটে গেছে, ছিটকে গেছে দাঁড়, মেয়ে নিচে পড়ছে জলের ধারার সঙ্গে, তলিয়ে যাচ্ছে নিচে, আরও নিচে। জলপ্রপাতের দেবতা সব দেখছিলেন, এবার হাত বাড়িয়ে মাঝপথে তাকে লুফে নিলেন। রামধনু হয়ে গেল সেই মেয়ে। জলপ্রপাতের ওপর যে রামধনু ভেসে থাকে সবসময়। ওরা বলাবলি করে, "ওই দ্যাখ, আমাদের মেয়ে কেমন আকাশে ভাসছে।"

    গাছ ওদের বন্ধু। পাহাড়ের কোলে দৈত্যাকৃতি সব মেপল, বার্চ। গাছের ডাল কেটে ঘর বানায় ওরা, কনকনে শীতের হাত থেকে বাঁচতে গাছের ছাল দিয়ে ঢেকে দেয় তাকে। গাছের ছাল আর বনের পশুর লোমে তৈরি হয় শীতের পোশাক।

    এনোলা আর আনাকিন তাদের ঘর বেঁধেছে মেপলগাছের বনে। আকাশে মাথা উঁচু করে থাকা দৈত্যের মতো মেপল। খাঁজকাটা সবুজ পাতা। শীত আসার মুখে মুখে সেই মেপল পাতায় যেন আগুন লাগে। হলুদ, কমলা, লাল রঙে রঙিন হয় অ্যালগনকুইন পাহাড়। সে কী শোভা তখন! তারপরই ঝরে যাবার পালা। ন্যাড়া ডালপালা আকাশে মেলে উদ্বাহু হয়ে থাকে মেপলবন।

    তিনটে ছোট ছোট বাচ্চা ওদের। দুজনে সারাদিন হাড়ভাঙা খাটে ওদের বাঁচিয়ে রাখবার জন্যে। আনাকিন যায় বনে, শিকার করে নিয়ে আসে হরিণ, খরগোশ, পাখি। জাল ফেলে সমুদ্রের মাছ ধরে। সেই মাছ শুকিয়ে রাখতে হয় লম্বা শীতকালের জন্যে। সেবার তখন সবে শীতকাল শেষ হয়েছে। মাটির বুকের উত্তাপে বরফ গলছে। পাশের ছোট্ট ঝোরাটা জমে গিয়ে থমকে ছিল এতদিন। আবার কুলকুল বইতে শুরু করেছে। কী ঠান্ডা জল তার! অসাড় হয়ে যায় হাত। সেই জলই রোজ সকালে এনোলা কাঠের বালতিতে ভরে নিয়ে আসে, রান্না করে। আজ জল আনতে যায়নি। কী হবে গিয়ে? ঘরে কিচ্ছু নেই। জমানো খাবার সব শেষ। রান্না করবে কী দিয়ে?

    আনাকিন শিকারে বেরিয়েছে। যদি কিছু পায় তাহলে রান্না চাপাবে।

    এনোলা চুপচাপ বসেছিল ঘরে। বাচ্চাগুলোকে শুকনো-মাছের শেষ কয়েকটা টুকরো দিয়ে দিয়েছে। বসে আছে অপেক্ষায়, কখন আনাকিন শিকার নিয়ে আসে। ও এলে জল ভরতে যাবে। কাঠের বালতিটা মেপল গাছের নিচে বসানোই আছে।

    বেলা গড়িয়ে আনাকিন ফিরল। সূয্যিমামা পাটে বসেছে তখন। খালি হাত, হতাশ। কিচ্ছু পায়নি আজ। বাড়ি এসেই হাতের ছোরাটা ছুঁড়ে দিল দূরে। মেপলগাছের গায়ে গিয়ে বিঁধল সেটা। বালতিটা যেখানে বসানো আছে ঠিক তারই ওপরে।

    এনোলার বুকটা কেঁপে উঠল। আজ নাহয় দুজনে উপোস করল, কাল কী হবে? বাচ্চাগুলোকে কী খেতে দেবে?

    আনাকিন ভরসা দেয়, "কিচ্ছু ভাবিসনি বউ, কাল খুব সক্কালবেলা উঠেই বেরিয়ে যাব। সমুদ্রে বরফের চাঁই গলতে শুরু করেছে। বরফে গর্ত খুঁড়ে মাছ ধরে আনব। তুই জল ভরে রাখিস, এলেই রান্না চাপাবি।"

    পরদিন ভোরে আনাকিন কখন যে বেরিয়ে গেছে কে জানে। ধড়মড় করে উঠে পড়ল এনোলা। চোখ মুছতে মুছতে বালতি খুঁজছে, জল ভরতে যাবে। আনাকিন মাছ নিয়ে আসবে নিশ্চয়ই। আশায় বুক বাঁধে সে। কিন্তু বালতি কোথায়? খুঁজেই পাচ্ছে না যে! ওমা, কাণ্ড দ্যাখো, সেই যে মেপলগাছের তলায় বালতি রেখেছিল কাল, তুলতেই ভুলে গেছে। ঝটপট লোমের পোশাকটা পরে নিয়ে বাইরে এল। ওমা, বালতি যে ভরা! এ নিশ্চয়ই আনাকিনের কাজ! ভোরে বেরোবার আগে কখন বালতি ভরে রেখে গেছে। যাতে ঠান্ডা জল ভরতে বউয়ের কষ্ট না হয়। এনোলার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার ভালোবাসার মানুষটার কথা ভেবে। আর তখনই শুনতে পায় আনাকিনের গলার আওয়াজ।

    "বউ দেখ, কত্তবড় হরিণ পেয়েছি। দেবতা আজ আমাদের ওপর সদয়! রান্না চাপা।" দূর থেকে লাফাতে লাফাতে আসছে মানুষটা। কাঁধে একটা বিরাট বলগা হরিণ, ডালপালা মেলা শিং। উফ, কত বড়! এর মাংসে বেশ কয়েকদিনের খাবার হয়ে যাবে! দেবতা কৃপা করেছেন তাহলে!

    চোখে জল আর মুখে হাসি। ঝটপট কাঠের উনুন জ্বালায় এনোলা। হরিণের মাংস ফোটে বালতির জলে। সুগন্ধ ছড়ায় বাতাসে। বাচ্চাগুলো উনুনের ধারে ঘিরে বসে আছে। আনাকিন তাদের শোনাচ্ছে আজকের শিকারের গল্প। কেমন করে অতবড় হরিণটা মারল সে। এনোলা নিজেও শুনছে। আহা, বড় সুখের দিন আজ।

    রান্না শেষ। সবাই মিলে বসেছে খেতে।

    "আজকের মাংসে কী দিয়েছিস বউ? বড় স্বাদের।" আনাকিন বলে।

    ছেলেমেয়েগুলোও আনন্দ করে খাচ্ছে। এনোলার শুকনো মুখখানা তৃপ্তিতে ভরে যায়।

    "আমাদের যেমন কপাল, কী আর দেব, ঘরে কীই বা আছে। সেই যে তুমি জল ভরে রেখেছিলে, তাই দিয়েই তো রান্না।"

    "আমি? জল ভরেছি? কই? না তো?"

    "বাহ্, তুমি সকালে তোমার ছোরা নিয়ে বেরিয়ে গেলে, সেখানেই তো ছিল আমার বালতি, গাছের তলে। জলে ভরা ছিল তো।"

    "গাছের তলায় বালতি জলে ভরা?" আনাকিন আশ্চর্য, "কই, চল তো দেখি সে গাছতলায়!"

    দুজনে মেপলবনে এসেছে। কাল হতাশ হয়ে আনাকিন নিজের যে ছোরাটা ছুঁড়ে দিয়েছিল, সেটা বিরাট মেপলগাছের গায়ে বিঁধে গিয়ে গর্ত হয়েছে। সেই গর্ত থেকে গাছের গা বেয়ে নেমে আসছে ফোঁটায় ফোঁটায় রস। অমৃতধারা।

    বিস্ময়ে হতবাক তারা। এই বিরাট মেপলগাছ তাহলে শীতে জমে গিয়েছিল? এবার উষ্ণতার দিন এল, তাই জমাট-বাঁধা রস গলে গিয়ে ছুটছে গাছের শিরা-উপশিরায়। আনাকিনের ছোরা গাছের গা কেটে পথ খুলে দিয়েছে, তাই সুধারস বেরিয়ে আসছে বাইরে।

    "এই রসেই তোর বালতি ভরেছে এনোলা।" আনাকিনের মুখে প্রথম কথা ফোটে। এনোলা তাড়াতাড়ি নিয়ে আসে পাত্র, রস ধরে রাখবে।

    মাটির পাত্রে রস নিয়ে দুজনে চুমুক দেয়। কুসুম কুসুম হালকা মিষ্টি রস। মেপল গাছের বুকের ওমে ভরা। কী সুন্দর গন্ধ তার।

    দুজনে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেবতাকে ধন্যবাদ দেয়। তাঁর দয়াতেই তো গাছের বুক থেকে বেরিয়ে এল এমন প্রাণরস।

    দুজনে মিলে যুক্তি করে, এই রসকে ফুটিয়ে রাখা যাক, যাতে বেশিদিন ধরে খাওয়া যায়। সেইমত উনুনে রস চাপায় আর ফোটায়। ফুটে ফুটে ঘন হয় রস আর সুগন্ধে ভরে যায় চারদিক।

    এনোলা নিজেও জানে না যে পৃথিবীর সর্বপ্রথম মেপল সিরাপটি সে-ই জ্বাল দিল। মেপলগাছের রস ঘন করে বানানো মিষ্টি মেপল সিরাপ। মানুষের অজানাই ছিল এতকাল।

    অনেকযুগ পার হয়ে গেলে একদিন জাহাজ-বোঝাই করে আসবে সাদা মানুষ, বিদেশ-বিভুঁই থেকে, কলম্বাসের দেখানো পথ ধরে। এনোলা-আনাকিনের মত লাল মানুষের কাছে শিখে নেবে কেমন করে সুগার-মেপলের বুক থেকে রস চুঁইয়ে নিয়ে জ্বাল দেওয়া যায়। তৈরি হবে বিশ্বজোড়া মেপল সিরাপের বাজার। প্যানকেক মিষ্টি হয়ে উঠবে, বারবিকিউ সস মেপলের গন্ধ ছড়াবে, ক্রিসমাসের সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে ওয়াফল আর ক্রেপের ওপর গড়িয়ে যাবে সোনালি রঙের তরল সিরাপ। রান্না হবে সুস্বাদু, ঠিক যেমনটি হয়েছিল এনোলার রান্না করা হরিণের মাংস।

    সেইসঙ্গে অ্যালগনকুইন পাহাড়ের কোলে তৈরি হবে গরু-বাছুরের খোঁয়াড়ের মত রিজারভেশন। লাল মানুষগুলোর নতুন ঠিকানা। নিজের হাতে গড়া বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে, নিজের দেশেই পরবাসী হয়ে যাবে তারা।

    সে গল্প আরেকদিন।

    ***
    অ্যালগনকুইন উপজাতির মানুষের মধ্যে প্রচলিত উপকথা অবলম্বনে এই গল্পটি লেখা হয়েছে।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments