কেন এই বিস্মরণ ? হয়ত এ সার্বিক এক বিস্মরণেরও অংশ, যেহেতু, তাঁর গদ্যের ধার ও দীপ্তি পাঠকের কাছে, তা যত সামান্যসংখ্যকের কাছেই হোক না কেন, এখনো অম্লান হলেও, কেউ কেউ বলবেন যে এমনকি বইয়ের দোকানেও বুদ্ধদেবের গদ্যবই বলতে দোকানির মনে প্রথম ভেসে ওঠে গুহ-পদবি-ধারী এক বুদ্ধদেবের কথাই।
আমার কাছে, বুদ্ধদেব কবিতা লেখার পাঠশালার মত, অমোঘ ও দিক নির্দেশক। এমনকি তিনি তাঁর সমকালীনতায়, যুক্তির স্বচ্ছলতায় এখনো চূড়ান্ত ব্যতিক্রমী, এবং অনস্বীকার্যভাবেই কসমোপলিট্যান। কিন্তু আমার কাছে যাঁর কবিতার কোন মুহূর্ত তেমন সর্বগ্রাসী বলে মনে হয় না। মোহের পাতলা আবরণটুকু খসিয়ে দেন তিনি তাঁর কবিতার দোষ ? অতিরিক্ত স্পষ্টতাই কি তবে মায়ার অন্তরাল রচনার পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায় তাঁর ক্ষেত্রে ? বরঞ্চ অনুবাদক বুদ্ধদেব, তাঁর বিপুল কর্মভারের মধ্যে জ্বলজ্বল করেন, কেননা, তিনি অপরিহার্য, অনিবার্য, অনিবার্য হয়ে ওঠেন আমাদের মেঘদূত বা বোদলেয়ার পাঠের ক্ষেত্রে।
এই মুহূর্তের শব্দশিল্পী, বা কবিতাশিল্পীর কাছে বুদ্ধদেব বসুর মূল্যায়ন কীভাবে জরুরি হয়ে উঠতে পারে, ভাবতে শুরু করে দেখি, আসলে যে বাংলা আধুনিক কবিতার প্রবহমানতায়, ধারায় আমাদের ওঠা বসা বাঁচা, তার প্রথম পথিকৃত্দের মধ্যে একজন তিনি, হয়ত বা প্রধান পুরুষ। এটা জানা কথা যে বুদ্ধদেব বসু - জীবনানন্দ দাশ প্রবর্তিত রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা কবিতার ব্যাপারটিকে একটা যুগাবসান বলা যায়, যখন আধুনিক বাংলা কবিতার সাথে তার পূর্ববর্তী কবিতার একটা বিচ্ছেদ রচিত হল চিরতরে।
গদ্যে বুদ্ধদেব বসুর তত্ত্বায়ন আমাদের শিরদাঁড়া জুগিয়ে এসেছে, মানে, তাঁর লেখালেখির পরবর্তী অর্ধশতক ধরে এই তত্ত্বচর্চা ইঁটের পর ইঁট বসিয়ে জোরালো করেছে `আধুনিক কবিতা'র ভিত্তি ও তার সৌধ। অন্যদিকে, তাঁর কবিতার ডাইড্যাকটিক প্রবণতা তাঁর কবিতাকে করেছে এক একটি প্রবন্ধের সমতুল্য। অর্থাত্, কবিতা হিসেবে নয়, তত্ত্ব হিসেবেই বুদ্ধদেব বসুর কবিতা আমাদের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সেজন্যেই, ভাষার নিরিখে জীবননান্দীয় বিপ্লব না ঘটিয়েও, বুদ্ধদেব আমার সেনসিবিলিটি তৈরি করে দিতে পেরেছেন, পেরেছেন, পাঠককে শিক্ষিত ও দীক্ষিত করে তুলতে।
শুরুর দিকে রবীন্দ্রভাষাবিশ্বেরই অংশীদার বুদ্ধদেব আমাদের চমকে দেননা, মধ্যরাত্রের মত মায়াবী কবিতায় `ভাবিয়ো আমার কথা একবার তারা-ভরা আকাশের তলে, / কহিয়ো আমার নাম একবার নিশীথের বাতাসের কানে' - আমাদের কোথাও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায় যদিও, তথাপি এক বিস্তৃত অর্থে রবীন্দ্র-লিরিকের অংশীভূত থাকেন তিনি যেন। অথবা আমার ১৫-১৬ বছর বয়সের প্রবল প্রিয় এক কবিতা `চিল্কায় সকাল'-এ কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায় / কেমন করে বলি ? সেখানেও যেন আমরা পাই ছন্দে প্রকরণে নিখুঁত ও সুন্দরের পূজারি এক বুদ্ধদেবকেই।
আজ নতুন করে যখন পড়তে বসি বুদ্ধদেব বসুর কবিতা, তখন আমার শহুরে, সমসাময়িক চোখ শুধু খুঁজতে চায় সেই চিহ্ন, যা তাঁকে করেছে তাঁর সময়ের প্রতিনিধিত্বে এক পুরোধা, প্রগতি ও কবিতা-পত্রিকা, দুই অস্ত্রের অনায়াস চালনে সাবলীল। আর ত্রক্রমশই দেখতে পাই, আজকের সময়েও বুদ্ধদেবের বিস্তৃতি, প্রথমে বিষয়ে, পরবর্তীতে নিজস্ব প্রকরণ-রচনাতেও।
তাঁর কবিতাতত্ত্ব ও তাঁর কবিতাকে একসাথেই দেখতে হবে, তাই, তাঁর কবিতার ভেতরে তাকিয়ে খুঁজে নিতে থাকি রবীন্দ্র-উত্তরণের চিহ্ন এবং নতুন কবিতার এক প্রোজেক্ট বা প্রকল্পের সচেতন সাক্ষর। যা একইসাথে একটি তুলনামূলক সাহিত্যের বিষয়ে। কারণ, এই প্রকল্প তো আসলে বিশ্ব সাহিত্যের সাথে সেতুবন্ধনের একটা সচেতন প্রয়াস। যেভাবে কলকাতা শহরকে বার্লিন বা নিউ ইয়র্কের সাথে মেলালেন তিনি মেলালেন, তেমনি তাঁর আত্মজৈবনিক গদ্যে বার বার খুঁজে পাই আন্তর্জাতিক এক সত্তার ত্রক্রমস্পষ্টতাকে। গোল্ড ফ্লেকের টিন ও প্রচুর সুগন্ধি চায়ের নেশায় শৌখিন বুদ্ধদেব তাঁর ঢাকার দিনগুলি থেকেই যে ছাত্রদের কমনরুমে `রংবেরঙের লণ্ডনি চালান' পাঞ্চ, রিভিউ অফ রিভিউজ থেকে আরম্ভ করে সম্ভ্রান্ত বাংলা মাসিক পত্রিকায় অবগাহন করেছেন, সে তথ্য বিস্মৃতব্য নয়। কলকাতায় এসে স্থিতু হবার পর, নিউ মার্কেটের শীতল ও সুগন্ধি অভ্যন্তর বা ওয়াইট ওয়ে লেডলের আমোদিত হলঘর তাঁকে সমান টানে, ভালো শৌখিন কাগজ ও কলমের মতই, তিনি স্বীকার করেন। এবং তাঁর সত্ত্বা নির্মিত হয় বিদেশি সাহিত্যের উপকরণে, নতুন কিছুর খোঁজে ব্রাউনিং, সুইনবার্ন ও প্রির্যাফেলাইট গোষ্ঠীর প্রতি গভীর মনোনিবেশ দিয়ে ছাত্রাবস্থা কাটে, তারপর প্রবেশ ঘটে ইয়েটস ও এলিয়টের। নতুন কবিতাতত্ত্বের কারিগর ও সওদাগর, দুইই হয়ে উঠতে হয় বুদ্ধদেবকে, হতেই হয়, সময়ের দাবি মেনে।
একসাথে হতে হয় নতুন বাংলা গদ্যেরও রূপকার। কেননা তিনি নির্মাতা ও পরিবর্তন-প্রণেতা। এখনকার ভাষায় মুভার অ্যাণ্ড শেকার। কলকাতা সম্বন্ধে তিনি লিখেছিলেন : এক অতি বৃহৎ ও মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। ভাষা, এই বাংলাভাষা, সেটিও একটি বিশেষ অর্থে আমাকে শিখতে হচ্ছে, কেননা আমার আদি মাতৃভাষা ও সাহিত্যের ভাষা এক নয়। এই প্রভেদে কবিতারচনায় সমস্যা হয়না, গদ্যে অনেক সমস্যা দেখা দেয়। কলকাতায় এসে নানা জেলার বুলি শুনছি আমি, কুড়িয়ে পাচ্ছি নতুন মৌখিক শব্দ, নানান জাতের বাংলা বই পড়ে পড়ে, অনেক বর্জন ও স্বীকরণের মধ্য দিয়ে, আমি গড়ে তুলছি সেই ভাষা, অন্তত তার কাঠামো - আজ দীর্ঘকাল ধরে আমি যাতে কথা বলছি, বই লিখছি।
`গড়ে তুলছি' শব্দবন্ধটি এখানে অত্যন্ত লক্ষ্যণীয়।
....`চয়নিকা'। ডবল ত্রক্রাউন ষোল-পেজি আকার, ইণ্ডিয়ান প্রেসে পাইকা অক্ষরে ছাপা; লেখক, শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর .... সেই বই হাতে পাবার পর আমি হারিয়ে ফেললাম হেম নবীন মধুসূদনকে, এর আগে যত বয়স্কপাঠ্য বাংলা কবিতা আমি পড়েছিলাম, তার অধিকাংশ আমার মন থেকে ঝরে পড়ে গেল। আমার শৈশবে এই কথা লেখেন বুদ্ধদেব।
এর পাশাপাশি, পরবর্তী সময়ে, বয়স্ক বুদ্ধদেব যে অতি শাণিত ভাষায় রবীন্দ্রনাথকে সমালোচনা করেছিলেন, সে বিষয় আমাদের অজ্ঞাত নয়। ১৯২৮ সালে রবীন্দ্রনাথের শনিবারের চিঠির প্রতি পক্ষপাতী বক্তৃতার প্রত্যুত্তরে, মাত্র কুড়ি বছরের যুবক বুদ্ধদেবকে বলতে শুনব, প্রগতিতে, `অধুনা বাঙলা সাহিত্যে একটি পরম বিস্ময়কর ও অভিনব মুভমেন্ট শুরু হয়েছে, এ কথা আমরা বিশ্বাস করি।' রবীন্দ্রনাথ নামক সূর্য যখন মধ্যগগনে, তখন এক যুবকের এই মন্তব্য বুঝিয়ে দেয় তাঁর কলিজার জোর।
বার বার বুদ্ধদেব রবীন্দ্রপ্রশস্তির সাথেই জড়িয়ে দিয়েছেন নির্মোহ সমালোচনা : `এত বেশি না লিখলে এত বড়ো তিনি হতেন না, অসংখ্যবার না-বললে কোনও কথাই তাঁর বলা হত না : তাঁর পরিমাণই তাঁর মহত্বের পরিমাপ।' আর সেই সাথেই বুদ্ধদেব রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেন, `তিনি আক্রান্ত হননি আধুনিক নগরজীবনের কোন চরিত্রলক্ষণে, ... আধুনিক বিক্ষুব্ধ নগর তাঁর চেতনার অন্তর্ভুক্ত হয়নি।'
তারাপদ রায় যেমন জীবনানন্দ দাশকে দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন, বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রবীন্দ্র রচনাবলী মাটিতে ফেলে পদাঘাত করার মনোবাঙ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর কবিতায়, কৃত্তিবাসীদের এই গভীর ও বিখ্যাত ইকনোক্লাস্টিক প্রবণতা পূর্বজ অনুরক্তিরই স্বাভাবিক এক প্রতিক্রিয়া, এটা বুঝতে ব্যক্তিপূজনপন্থী আমাদের সময় লেগেছে কিছু। বুদ্ধদেবের শৈশবস্মৃতির অনেকটাই জুড়ে যে রবীন্দ্রপ্রীতি, বা বলা ভালো রবীন্দ্র অধিগৃহীত হবার কাহিনি, এবং সত্যেন দত্ত প্রমুখের প্রশস্তি, পরবর্তী বিদ্রোহের বীজ বোধহয় ওখানেই প্রোথিত। এ একেবারেই সেই সুবিখ্যাত মনস্তাত্বিক ব্যাখ্যার মত মনে হয় আমার : পিতার সাথে প্রতিযোগিতাবোধ, আর পিতার সাথে একাত্মবোধ, একই মুদ্রার এ পিঠ ও পিঠ থেকে গেছে চিরকাল, সর্বদেশে।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একটি অতি আবশ্যক বোঝাপড়ার চেষ্টাও আমরা (প্রগতি-র মঞ্চেই) প্রথম করেছিলাম। বোঝাপড়া - মানে, এমন কোনো ব্যবস্থা, কিংবা বলা যাক আমাদের দিক থেকে একটি প্রস্তুতি যাতে রবীন্দ্রনাথের বিশাল জালে আমরা আটকে না থাকি চিরকাল, তাঁকে আমাদের পক্ষে সহনীয় ও ব্যবহার্য করে তুলতে পারি। লোকেরা এর নাম দিয়েছিল রবীন্দ্রবিদ্রোহ, কিন্তু শেষের কবিতার প্রথম দু তিনটি পরিচ্ছেদ পড়ে আমার মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ আমাদের মনের কথা আঁচ করেছেন।
প্রাপ্তে তু ষোড়শবর্ষে পুত্রকে সমকক্ষ ভাবতে শেখার ঘরানাও আবার আমাদের সংস্কৃতি, সুতরাং অনুজের কাছে পরাভূত হবার সম্মান বারংবার উপভোগ করেছেন অগ্রজ। রবীন্দ্রনাথের প্রতি এই প্রেম-ঈর্ষা-প্রণতি তাচ্ছিল্যের চক্রে বারংবার পাক খেয়েছেন বুদ্ধদেব। `যে যুগ রবীন্দ্রনাথকে সৃষ্টি করেছে, বহুদিন আগেই তা অতিক্রান্ত হয়েছে।' ... ১৯৩৮ এ এক সভায় `আধুনিক বাংলা : আধুনিক লেখকের অবস্থা' বক্তৃতায় বুদ্ধদেবের এই মন্তব্যকে ইংরিজি কাগজে তর্জমা করা হয়, the age of Rabindranath is over. দু:খ করে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, খবর এল, সময় আমার গেছে (সময়হারা)। আজ আমাদের কাছে, বুদ্ধদেবের স্বঘোষিত আন্দোলনের এই দিগদর্শন নির্ভুল ও যুগান্তকারী। যখন তিনি বলেন, : এই কারণেই রবীন্দ্রসাহিত্যে একটি নি:সংশয় বিশ্বাস পাওয়া যায়, যার পটভূমিকায় আধুনিকদের নাস্তিকতা আজ এমন উগ্র হয়ে ফুটেছে। .... তার পরেই তিনি যোগ করেন, আধুনিক বাংলা ভাষা রবীন্দ্রনাথই সৃষ্টি করলেন।
কবি বুদ্ধদেব রাবীন্দ্রিক ভাষাবলয় থেকে নিজেকে মুক্ত করার কোন প্রয়াস দেখালেন না বোধহয় এ কারণেই। রাবীন্দ্রিক ভাষাবলয়, ভাষা-অভ্যাস, লিরিক মাধুর্য-সহ যে কাব্যভাষা প্রণয়ন করলেন বুদ্ধদেব তা কিন্তু ধারণ করল রবীন্দ্রভাবনার এক প্রতিক্রিয়াকেই, বিষয়ের নতুনত্বে। কারণ, স্পষ্টতই রবীন্দ্রপরবর্তী কবিতার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবার পরিকল্পনাই তো তাঁর কাছে শুরু থেকেই স্পষ্ট।
বুদ্ধদেব লিখেছিলেন, `যে বিশ্ববোধ গ্যেটে আয়ত্ত করেছিলেন সচেতন ও সচেষ্টভাবে, তা ছিল রবীন্দ্রনাথের স্বজ্ঞাপ্রসূত' (রবীন্দ্রনাথ : বিশ্বকবি ও বাঙালি)। বলেন, `যেন তিনি সেই স্থায়ী ও সুন্দর রূপকল্প যার মধ্যে বাঙালির শ্রেষ্ঠ আকাঙ্খাগুলি গৃহীত হল।'
অবিনশ্বর-নশ্বরের ডায়ালেকটিকস-এ রবিঠাকুর যদি ও পক্ষে, তাহলে বুদ্ধদেব অবশ্যই এ পক্ষে। নশ্বরতার পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে তাঁকে তো তাই করতেই হবে বন্দীর বন্দনা, হতেই হবে শাপভ্রষ্ট। আমরা বলি বাণপ্রস্থ যৌবনেতেই ভালো চলে-র উত্তর হতে পারে শুধু `যৌবন আমার অভিশাপ' ... `অক্ষম, দুর্বল আমি, নি:সম্বল নীলাম্বর-তলে ভঙ্গুর হৃদয় মম বিজড়িত সহস্র পঙ্গুতা' এ সত্ত্বেও তিনি লিখতে ভোলেন না, `রবির গভীর স্নেহে, শিশিরের শীতল প্রণয়ে শুষ্ক শাখে' ফুল ফোটার কথা। আর্ট ফর আর্টস সেকের দিন শেষ, সুতরাং ত্রুটিহীন সৌন্দর্য নয়, দৈনন্দিনতায় ক্লিষ্ট `প্রবৃত্তির অবিচ্ছেদ্য কারাগারে চিরন্তন বন্দী'র আকুতি, সৌন্দর্যের দিকে ধাবিত হবার প্রচেষ্টাই সম্বল শুধু। `মুক্তি শুধু মরীচিকা', এবং `বাসনার বক্ষোমাঝে কেঁদে মরে ক্ষুধিত যৌবন'।
মহাজাগতিক রোম্যান্টিক-এর হাত থেকে বাংলা কবিতাকে উদ্ধার করে পোস্ট-রোম্যান্টিক মহানাগরিক কসমোপলিট্যান-এর কাছাকাছি নিয়ে যাবার এই যাত্রা। আসঙ্গ-বাসনা-পঙ্গু আমি সেই নির্লজ্জ কামুক : ১৯২৮-এ লেখা এই শব্দচয়, বোদলেয়ারের ক্লেদজ কুসুমের ধ্বনিকেই প্রতিধ্বনিত করেছে, আক্ষেপ, আক্ষেপ শুধু ! সময়ের খাদ্য এ জীবন .... এ দিকে, মনের প্রান্তে, হেমন্ত যে আগত এখনি ...
রবি ঠাকুর বর্ষা আর বসন্তের পেটেন্ট নিয়ে নিয়েছিলেন, যদি জীবনানন্দ হেমন্তের ইজারা নিয়েছেন। এবং শীত, অবশ্যই তার দখল নিয়েছেন বুদ্ধদেব বসু, কেননা, বত্সরের হ্রস্বতম দিনে স্বল্প সূর্যালোক আর কফিনের মত ঠাণ্ডা দিনে প্রায়-বুড়ো এক মানুষের কথা তো বাংলা কবিতায় তিনি প্রতিষ্ঠিত করলেন। (মৃত্যুর পরে : জন্মের আগে)। জীবনানন্দের তুলনায় যা আরো বেশি শহুরে ও ক্লান্ত বলে মনে হয়। `শীত নয় সুখের সময়।' "টেবিলের ঠাণ্ডা কাঠ, পায়ে ঠেকে ঠাণ্ডা অন্ধকার" ... এই একই গভীর ঘুমের থেকে না ওঠবার সাধ, অন্ধকারের সারাত্সারের কথা তো জীবনানন্দেও, যে অন্ধকার, যে শীতের গল্প কথিত জীবনানন্দের গদ্য কাহিনীতে : মাল্যবানেও তো সেই `বেশি রাত, বেশি অন্ধকার, বেশি শীত' একই শীত, শহুরে ও ক্লিষ্ট অন্ধকার।
অতএব রবিঠাকুরের যে আলো, তা তো বিমূর্ত মাতৃভূমির থেকে উথ্থিত সদ্যপ্রাপ্ত জাতীয়তাবাদের অ্যাজেণ্ডারই রোম্যান্টিক ফসল। আর বুদ্ধদেব-জীবনানন্দ অন্ধকারের বাদশা, কারণ আশাভঙ্গ আর অবক্ষয়ের সমকালীনতাকেই তো বিধৃত করবেন কল্লোলের কবিরা, কোনো জাতীয়তা নয়। জাতিসত্ত্বাকে অতিক্রম করে চূড়ান্ত অনিবার্য এক কসমোপলিট্যানে, এক বিমূর্ত মহানাগরিকতাবোধের পরিসরে হিস্যা নেওয়ার সংকল্পে। যেখানে মুক্তির আলোর মত নিটোল ইউটোপিয়ার মহাপ্রয়াণ হয়ে গেছে। জীবনের যাবতীয় অভিজ্ঞতাকে শীত অন্ধকারের বিমূঢ়তার মধ্যে দিয়ে প্রতিনিয়ত চালিত করতে হচ্ছে। কেননা, সেটাই নিয়তি।
জাতীয়তাবাদী মুক্তির আদর্শ এরপর নতুন সূর্য ও লালচে পুব আকাশের আদর্শে রূপান্তরিত হবে, সমান্তরাল এক ধারায় রাজনৈতিক মুক্তির কবিতাতে স্থান করে নেবে, কিন্তু মূল স্রোতের আধুনিক কবিতায় শীত ও অন্ধকারের প্রতি-আদর্শ, মাছি, ড্রেন ও কুষ্ঠরোগীর প্রতি-আদর্শ বহাল থাকবে বহুদিন। ঈশ্বরকে ছুঁড়ে ফেলার স্পর্ধা ও শয়তানের প্রতি একনিষ্ঠতা বজায় থাকবে। `কলকাতার প্রধান রং অ্যাসফল্টের ধূসর, প্রধান শব্দ ট্রাফিকের চীত্কার, এখানে গতি তীব্র, সংঘর্ষ অনেক, চাঞ্চল্য অবিরাম ... কলকাতা আমার ভবিষ্যত্, হাজার হাতে আমাকে টেনে নিচ্ছে নিজের মধ্যে।' এই মহানাগরিকতা একমাত্রিক নয়, দ্বিমুখী এক টানে উত্তেজক। ডেকেডেন্ট রোম্যান্টিক প্রি র্যাফেলাইট সুইনবার্ন-এর ফাউস্টিনের কথা মনে পড়বে, সমকামিতা, মৃত্যুকামিতা, স্যাডোমাসোকিস্ট প্রবণতার কবি, ঘুম ও অভিশাপ নিয়ে কবিতা লেখার কবি সুইনবার্ন, ত্রক্রুশবিদ্ধ যীশুকে এক ফুত্কারে নস্যাৎ করে কবিতা লেখার কবি : ফাউস্টিনের প্রতি লেখেন,
"carved lips that make my lips a cup / to drink, Faustine / wine and rank poison, milk and blood / being mixed therein"
And indeed there will be time
And indeed there will be time
For the yellow smoke that slides along the street,
Rubbing its back upon the window-panes;
There will be time, there will be time
To prepare a face to meet the faces that you meet;
There will be time to murder and create,
And time for all the works and days of hands
That lift and drop a question on your plate;
Time for you and time for me,
And time yet for a hundred indecisions,
And for a hundred visions and revisions,
Before the taking of a toast and tea.
(Love song of J Alfred Prufock, T. S. Eliot)
এর পাশাপাশি দেখব, `মাল্যবানের আশ্চর্য লাগছিল। কোনোদিনও যে জেগে উঠতে হবে না আর, শীত, যা সবচেয়ে ভাল, এই বিশৃঙ্খল অধ:পতিত সময়ে সমাজে রাতের বিছান, যা সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ, সেই শীত রাতের কোনোদিন শেষ হবে না আর, উত্পলা সব সময়ই মাল্যবানের সময় ঘেঁষে থেকে যাবে অনি:শেষ শীত ঋতুর ভেতর। গভীর গভীর এই শীতের রাত।'
সময়ের মুখপাত্র হয়ে ওঠার তাগিদ যে যুবকের মূল চালিকাশক্তি, তাঁর পক্ষে এই অন্ধকার-কে, শীতকে বরণ করাও একটি নিজস্ব মুদ্রা হয়ে উঠতে পারে। ঢাকা থেকে যিনি কলকাতা আসেন, কলকাতার সদ্য মান্য হয়ে ওঠা চলিত বাংলাকে নিয়ে বাঁকিয়ে চুরিয়ে নানা পরীক্ষা করে যিনি অজস্র লেখালেখি করেন কেবলমাত্র জীবনধারণের জন্য, তাঁকে বলতে শুনছি :
`অনুকূল ছিল না সময়টা - কারো পক্ষেই নয়, সদ্য যারা উপার্জনে সচেষ্ট তাদের পক্ষে রীতিমত বৈরী। জগৎ জুড়ে ব্যবসা মন্দা চলছে, ... ঢাকা চাটগাঁর সন্ত্রাসবাদ সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ল। আর অবশ্য বিবর্ধমান বেকারবাহিনি, বেসরকারি আপিশগুলোতে ছাঁটাই - বাঙালির বিপুলবাঙ্ছিত সরকারি কর্মেও কুঞ্চিত হলো মাসান্তিক বেতন ... আমার ও-পথে (কলেজের চাকরি) কোন আশা নেই, কেননা আমার ডিগ্রি ঢাকার, এবং আমার লেখা অশ্লীল, অন্তত: লোকেরা তা-ই বলে থাকে। ... কখনো আশা, কখনো অবসাদ, কখনো একটা দম-আটকানো অনুভূতি, কখনো আবার ক্ষনিকের জন্য স্বস্তিবোধ - এই সব নিয়ে আসে যায় আমার দিনগুলি সংগ্রামে ভরা - যে সংগ্রাম ও অনিশ্চয়তা আমি সারা জীবনে কাটিয়ে উঠতে পারলাম না।'
এরই মধ্যে কলকাতা ছেড়ে চাকরি নিয়ে অন্যত্র যাবার প্রস্তাবে, তিনি বলেন, `কিন্তু কোনোটাই লুব্ধ করল না আমাকে, টানাটানির মধ্যেও এ-ই আমার মস্ত সুখ আমি কলকাতায় আছি - কলকাতার ধুলোর গন্ধেও মাদকতা।'
বুদ্ধদেব নিজেই বলেন, এই অনিশ্চয়তা তাঁকে ছেড়ে যায়নি সারাজীবন। আর সারাজীবনই তাই তিনি লিখবেন তাঁর শহুরে কসমোপলিট্যান প্রোজেক্টের উপাদান, শীত ও অন্ধকার -এর কবিতা, হয়ত ছেড়ে ছেড়ে।
যে শীত ও অন্ধকার ট্রপিকাল বাংলার নিজস্ব ভৌগোলিক উপাদান নয়, তাকে কবিতার কসমোপলিটান উচ্চারণে উদ্ধার করতে হবে। শীত, যা ইয়েটস পাউণ্ড এলিয়ট সিঞ্চিত ভগ্নজানু বিগতকাম মেট্রোপলিট্যান মনের ওয়েস্টল্যাণ্ডের প্রতীক। নব্য আধুনিকতার উত্স, উত্তর-ঔপনিবেশিক কলকাতার মাধ্যমে লণ্ডন-বার্লিন-নিউইয়র্ক নামক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিশ্বকেন্দ্রগুলির সঙ্গে এক সূত্রে যুক্ত হবার এক সচেতন প্রক্রিয়া।
অথচ হৃদয়ে জরা ঠাণ্ডা আনে — সে ভালোবাসার তবু শীত নেই,যে-কোন পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত যে কবি, মূলস্রোতের ভেতরে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদ্যত, নিজেকে ঠেলে দিতে পারেন অনিশ্চয়ের প্রান্তে, তিনি জানেন, সম্পূর্ণ নতুন এক কাব্যভাষা তৈরি হয়ে উঠতে পারে নতুন চিন্তার দরজা খুলে দিয়ে :
অথচ হৃদয় ঝরে অন্ধকারে — সে-ভালোবাসার তবু শেষ নেই।
এই তো এখন,
এখনই আমার মন ঠাণ্ডা ঘরে, অন্ধকার দিন ভ'রে একা ব'সে-ব'সে
যেন মিশে যায় হাওয়ার হত্যায়। এই তো এখনই আমি
ফিরে যেতে চাই যেন তামসী মাতার গর্ভে, তারপর অজাত আত্মার
নিশ্চিন্ত নির্বাণে
যে-বাসা ভেঙেই যাবে, তাকে যেন নিজ হাতে ভেঙে দিতে চাই,
হৃদয়েরে নিজেই ঝরাই পাতাঝরা হাওয়ার হত্যায়। মনে হয়,
আজই মনে হয়,
এই যেন সেই শীত, যে-শীতে আমার
বুকে আর পড়বে না কবিতার হাত, আর হাতে আর ফিরবে না
কবিতার তাপ ;
ঠাণ্ডা ঘরে, অন্ধকারে, হাতে হাত ঘ'সে, একা ব'সে-ব'সে,
কবিতারে ভালোবেসে বলবো না আর, `ভালোবাসি,'
অন্তহীন ওষ্ঠহীন অন্ধকারে,
অন্তহীন কঠিন ঠাণ্ডায়।
তাই শুয়ে পড়ি তাড়াতাড়ি, তাড়া-খাওয়া কুকুরের মতো কুঁকড়ে লুকোই
লেপের তাপের তলে :
যতক্ষণ বিছানা গরম হয়, মনে হয় ঘুম যেন জীর্ণ কোনো
জন্তুর গোপন গুহা, ছোটো তার অন্ধকার রেখেছে ঠেকিয়ে
আরো বড়ো অন্ধকারে এখনো — এখনো।
আর ঘুম যখন গরম করে, মনে হয় ঘুম যেন মাতার মমতা,
তামসী-মাতার নির্জন করুণ যোনি, ...
মুখ-ঢাকা বুক-চাপা অন্ধকারে, লেপের গোপন, গরম গুহায়
রাত্রি কাত্রায়; আর রাত্রিরে জড়ায়ে ঘুম হাত্ড়ায় স্বপ্নের শেষ ;
তবু ওঠে, আরো ওঠে ডাক, ফোটে দিন, আরো এক দিন !
(মৃত্যুর পরে : জন্মের আগে)
বাইরে বরফের রাত্রি। ডাইনি-হাওয়ার কনকনে চাবুকশীতরাত্রির প্রার্থনা, এই কবিতা, পিটসবার্গে বসে কবি লেখেন ১৯৫৩ তে। কবিতার ভেতরে বার বার কথোপকথন চলে আবার সেই বিশ্বাস সদর্থক বোধের সাথেই, যেন এক টাগ অফ ওয়ার চলে, ধীরে ধীরে কবিতা এগোয় যত পরিণতির দিকে, জেগে আছে দীর্ঘ দীর্ঘ রাত্রি। শুধু জেগে আছে তাই নয় / কাজ করে যাচ্ছে গোপনে গোপনে / সৃষ্টি করে যাচ্ছে মৃত্যুর বুকে নতুন জন্ম / ... আর তাই, এই মৃত্যু তোমার প্রতীক্ষা - তোমাকে তার যোগ্য হতে হবে ...
গালের মাংস ছিঁড়ে নেয়, চাঁদটাকে কাগজের মতো টুকরো ক'রে
ছিটিয়ে দেয় কুয়াশার মধ্যে, উপড়ে আনে আকাশ, হিংসুক
হাতে ছড়িয়ে দেয় হিম ; শাদা, নরম, নাচের মতো অক্ষরে
পৃথিবীতে মৃত্যুর ছবি এঁকে যায়।
শেষ হচ্ছে এই উত্তরণে এসে, যে `তোমার শূন্যতার অজ্ঞাত গহ্বর থেকে নবজন্মের জন্য প্রার্থনা করো, প্রতীক্ষা করো, প্রস্তুত হও।' ( শীত রাত্রির প্রার্থনা )
এই শীত ও অন্ধকার তার মূল খুঁজে পাবে পাশ্চাত্যের কবিতাতে : বোদলেয়ারের কথা আগেই তো বলা হয়ে গেছে, বুদ্ধদেবের অনুবাদের সূত্রে। বাঙালি পাঠকের প্রিয়তার সূত্রে, সহজেই স্মৃতিধার্য সেই সব লাইনগুলিও আর একবার উল্লেখ করাই যায়, এলিয়টের "the winter's evening settles down / with smells of steaks in passageways."
মনে পড়বে ওয়েস্টল্যাণ্ড-এর বেরিয়াল অফ দ্য ডেড,
"winter kept us warm, covering / Earth in forgetful snow, feeding / a little life with dried tubers."ডবলিউ এইচ অডেনের লেখা `ইন মেমরি অফ ইয়েটস'-এর ভেতরেও শীতের অব্যর্থ চিত্রকল্প বলে দেয়, পাশ্চাত্যের এই অবসেশন কীভাবে আমাদের ভেতরে চারিয়ে যেতে থাকবে বুদ্ধদেবের হাত ধরে।
He disappeared in the dead of winter : The books were frozen, the airports almost deserted, the snow disfigured the public statues; the mercury sank in the mouth of the daying day. What instruments we have agree the day of his death was a dark cold day.সারা জীবন জুড়ে বুদ্ধদেবের কবিতায় থেকে যাবে শীতরাত্রি ও অন্ধকারের আবহ, অনুষঙ্গ, আর আমাদের কাছেও তিনি পুনরাবিষ্কৃত হবেন এভাবেই :
রাত্রি, প্রেয়সী আমার, প্রসন্ন হও, নিদ্রা দিয়ো না। ... তুমি আমাকে দিয়েছিলে তোমার চাঁদ, অনেক চাঁদ, / আরো অনেক তারা, তারা-ভরা আকাশ, জ্বলন্ত, / আগুনের নিশ্বাস-ফেলা অন্ধকার। (রাত্রি)একদিন : চিরদিন -এ আমরা দেখব এই চেতনার সঘন বিস্ফোরণকেই : র্`.ঽঅত্রির মোড়কে ঢাকা / বেদানার দানার মত চুমো, তারায় তারায় প্রকাণ্ড ঘড়ির / পেণ্ডুলামের মতো আমার হৃদয়'
উপসংহারের ছলে এইটুকুই বলে নেব এখন, বুদ্ধদেবের কবিতা, এবং গদ্যও, আমাদের কাছে ঠিক তাই, `আমাদের' শব্দটি এই আলোচনায় আজকের কবিতা চর্চায় লিপ্ত কারুকে বোঝাবে এখন : অনেকটা ঠিক যেমন ছিল তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথের লেখা : বাংলাসাহিত্যে আদিগন্ত ব্যাপ্ত হয়ে আছেন তিনি, বাংলা ভাষার রক্তে মাংসে মিশে আছেন, তাঁর কাছে ঋণী হবার জন্য এমনকি তাঁকে অধ্যয়নেরও আর প্রয়োজন নেই তেমন, সেই ঋণ স্বত:সিদ্ধ বলেই ধরা যেতে পারে। ( রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক, ১৯৫২)
বুদ্ধদেব বলেছিলেন : রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষায় প্রথম য়োরোপীয় সাহিত্য লেখেন। ( রবীন্দ্রনাথ ও প্রতীচী, ১৯৬০)। আধুনিক বাংলা উপন্যাস, ও অবশ্যই কবিতার ক্ষেত্রে, আমরা এ কথা তো বুদ্ধদেবের বিষয়েও প্রয়োগ করতে পারি। যদিও, এ কথা স্বীকার করতেই হবে, কবিতার ক্ষেত্রে এই সম্মান অনেকটাই ভাগ করে নিয়ে গেছেন জীবনানন্দ। কিন্তু পরবর্তী কবিদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক জীবিত কবির প্রৌঢ়ত্ব পেয়েছিলেন তিনি, যা জীবনানন্দের পক্ষে সম্ভব ছিল না তাঁর অকালপ্রয়াণের ফলে।
নৈশ নগরের ফেনোচ্ছ্বাস ;১৯৬৫-র `আরোগ্যের তারিখ' ( মরচে পড়া পেরেকের গান গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত) কবিতায় তো স্পষ্টতই বুদ্ধদেব পেরিয়ে এসেছেন গোলার্ধ, পেরিয়ে এসেছেন পৃথিবীর আপ্রান্ত। এখন তাঁর ভাষা যেন বিস্তার করে আছে পরবর্তী প্রজন্মের কবিতার ভাষাকেও, যেন ছুঁয়ে আছে তরুণতম কবির কলম। প্রতিস্পর্ধা জানাচ্ছে কৃত্তিবাসী আন্দোলনের স্পর্ধাকেও, ঠিক যেভাবে জানানো উচিত অগ্রজের।
জ্যাজের ঝঞ্চনা, উধাও ট্রেন ;
হ্রদের দর্পণে মকর ভেসে ওঠে ;
এবার শুরু হ'লো বরফ গলা।
প্লেনের জানালায় মেঘের বৈভব ;
আঁধারে হেডলাইট তীরন্দাজ...
এক মুহূর্ত : এই তবে তার মৃত্যু —এভাবেই অনিশ্চিতির বলয় আর বৃত্ত আর সম্পূর্ণ হয় না যেন কবির।
চৌরঙ্গিতে, প্রেয়সী কলকাতায়। ...
এই মুহূর্ত : এই তবে তাঁর বাঁচা ংউ —
ট্রামের তারের জ্বলে-নিবে-যাওয়া ফুলকি।