ধরা যাক সে মানুষ ক্ষীণদেহী, নিবিষ্ট, মাঝে মাঝে রেফরিজেরিটার থেকে নিজে হাতে একটি রূপোর গেলাসে জল ঢালতে যাবার সময় বিদ্যাসাগরী চটির আওয়াজ ছাড়া কোনো আওয়াজ তাঁর পাওয়া যায় না- একটি সাদাসিধে ঘরে তাঁর সাদাসিধে একটি টেবিলে তিনি কাজ করেন, তাঁর সামনে একটি বড় জানালা রয়েছে, কাজ করতে করতে তিনি বাইরে তাকান, সেখান থেকে আকাশ গাছ দুই-ই দেখা যায়, নির্জন এই পাড়ায় পাখির ডাকই কোলাহল, একটা একতোশিক সরু খাট তাঁর, সেখানে তিনি রাতে ঘুমোন-বই আছে, দেওয়ালে ঝুল আছে, পাশে ছাইদানি, অজস্র সিগারেট খেয়ে যান- সে মানুষ ক্ষীণদেহী, নিবিষ্ট, মাঝে মাঝে টাইপ করার পটাপট শব্দ শোনা যায়, নি:শব্দে তাঁর পায়ের কাছে শুয়ে থাকে বৃদ্ধ একটি কুকুর ।
এই লোকটি কোনো সংসারত্যাগী ব্যক্তি নন, তাঁর গভীর সংসার আছে । কেননা যে বাড়িতে তিনি থাকেন তা জনবিরল একেবারেই নয় - পঞ্চাশোর্ধা সুখী স্ত্রী পরিবারের খুঁটিনাটি দেখেন, পুত্রবধূ বসে শাড়িতে ফল্স লাগায়, নাতি হরবোলার মত দিদিমার পায়ে-পায়ে ঘুরে বেড়ায়, বিবাহিত কন্যা যে বাইরে থাকে, ছুটিতে বেড়াতে এলে শাড়ি কেনা আর বাইরে বেড়ানোর ধূম পড়ে যায়, বড় মেয়ে কাছেই থাকে - নিত্য তার আনাগোনা, ছেলের তিরিশ বছর বয়স, বন্ধুবান্ধব নিয়ে তার আড্ডা জমে প্রায়ই হুইস্কি বা রাম সমেত, জামাইরা পরিপাটি । সবই ঠিক-ঠাক আছে । আত্মীয় আগমন অবশ্য কম, কিন্তু বন্ধুবান্ধব দিয়ে তা পুষিয়ে যায় ।
নিবিষ্ট কর্মীটি, আবার বলি, সংসারে সন্ন্যাসী নন, কিন্তু সারাদিন তাঁর সময় হয় না । তাঁর টেবিলটি তাঁর সামনে বিছিয়ে থাকে জীবিকা আর প্রতিভার ছিলা টান টান করে । কখনো টেলিফোন ধরেন, কাজের কথা শেষ হলে ফোন নামিয়ে `চা দাও' ঈশ্বরের উদ্দেশে বলার মত করে বাড়ির অভ্যন্তরে শব্দটি পাঠিয়ে গুহায় ঢুকে যান । তিনি যেহেতু সকালেই দু'ঘন্টায় স্নান-ব্রেকফাস্ট ইত্যাদি সেরে নেন তাই একটার আগে তাঁর টেবিল থেকে উঠতে হয় না । পৌনে দুটো নাগাদ খেতে বসেন- এই পঁয়তাল্লিশ মিনিট তাঁর ছুটি, এবং সবাই জানে সেটা । স্ত্রী, পুত্রবধূ, কন্যারা থাকলে, বা পুত্রটির ছুটি থাকলে, নাতি নাতনী, সবার সঙ্গে তিনি আড্ডা মারেন, চিত্কার করে হাসেন, গসিপ শুনতে চান, চামচা ব্যাপারটা কি জানতে চান, রাজনীতি বিষয়ে এঁড়ে তক্ক করেন কিংবা মাঝে মাঝে দাম্পত্য কলহে ব্যাপৃত হয়ে পড়েন । মিনিট পঁয়তাল্লিশ বা আধ ঘন্টা বাড়িটা কথায়, হাসিতে, উষ্মায় জ্যাজের মত হয়ে দাঁড়ায় --
'My eyes are larger than my appetite' \এই কথা হাঁকতে হাঁকতে খেতে বসেন । স্বল্প নিয়মিত নিয়মমাফিক আহার করে দিকচক্রবালে পথিকের মত তিনি মিলিয়ে যান নিজের ঘরে । তাকে দেখা যায় টেবিলে বসে পড়েছেন, নিবিষ্ট হয়ে রয়েছেন কাজে, বাড়িতে দুপুর নেমে আসে, ঠাণ্ডা পুকুরের জলের মত শান্ত হয়ে যায় বাড়ি । বাড়িটা ছোটো কিন্তু সুন্দর, সামান্য বাগান আছে, বসার ঘরে উচ্চ মধ্যবিত্ত রুচি ও শিক্ষার ছাপ, প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জীবনের জন্য আলাদা ঘর, সমস্ত গৃহ সুনিপুণ গৃহিণীর ও বাধ্য ভৃত্যদের দেখাশোনায় টিপটপ, বড়লোকি নেই গরিবিও নেই - এ বাড়ি ঘিরে আছে নানা বয়সের নানা জনের বন্ধুরা, ভরে আছে নিবিষ্ট মানুষটির ছাত্র ও সুহৃত্বর্গে, অসুস্থ কলকাতায় এক টুকরো ঘাসের জমির মত । কাজের মানুষটির সামনে জীবিকা আর প্রতিভা এই ছিলা টানটান হয়ে পড়ে আছে যে টেবিলে তিনি বসেন । ক্ষীণদেহী, উজ্জ্বল নেত্র, মাত্র ৫ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতা; তিনি বসে আছেন -- মাঝে মাঝে চটির শব্দ পাওয়া যায়, রেফরিজেরিটার থেকে জল আনতে যাচ্ছেন ।
মাঝে মাঝে অনেক লোক চলে আসে এই বাড়িতে, কিন্তু সাড়ে ন'টার আগে তিনি ওঠেন না টেবিল থেকে -- সাড়ে ন'টা একটা বাতিক তাই পুত্রটি দেয়াল ঘড়ি অনেক সময় পট করে ফাস্ট করে দিয়ে বলে, বাবা এবার এস, তোমার ওঠার সময় হলো । মাঝে মাঝে ঠকে গিয়ে উঠে পড়েন । অনেক বরফ দিয়ে লম্বা গেলাসে হুইস্কি নিয়ে যোগ দেন আড্ডায়, আড্ডা চলে প্রশস্ত আলোচনার বিষয়ের ভেতর দিয়ে, তখন তিনি হাত-তালি দিয়ে জোরে হাসেন, কিংবা ক্ষিপ্ত হয়ে তর্ক করেন তরুণ লেখকদের সঙ্গে । ষাট বছরের লোকটিকে ভালোবেসে তাঁরা নাম ধরে ডাকেন ।
একদিন সন্ধেবেলার পর, সাড়ে আটটা নাগাদ অদ্ভুত এক নীল চাঁদ ওঠে, পাশের মেঘগুলো, ভয়ঙ্কর সুন্দর দেখায়, সৌন্দর্যের মধ্যে ভয় মেশানো, যেন একটা বিপদ এসেছে । ছেলে কর্মস্থল থেকে দেখে বাবা টেবিলের সামনে বসে সিগারেট খাচ্ছেন, পেছন থেকে তাঁর সাদা-কালো চুল বড় রুক্ষ দেখায় । মা বলেন, তোর বাবার আজ শরীরটা বোধ হয় ভালো নেই । ঘরে ঢুকলে দেখি তিনি একটা প্রায় আস্ত সিগারেট ফেলে দিয়ে আরেকটি ধরাবার চেষ্টা করছেন, কাঠিতে বাক্সে এক হচ্ছে না কেন ? `তোমার কি শরীর খারাপ ?' - `না তো একটু দুর্বল' -- এই বলে বাথরুমে ঢুকলেন । রাত তিনটের সময় এক হাসপাতালে চৈতন্যহীন অবস্থায় তিনি মারা গেলেন ।
গৃহ রইল, অর্থ রইল, স্ত্রী রইলেন, বিবাহিত পুত্র রইল, কন্যারা ঠিকঠাক, নাতি হামা দেয় - কিন্তু সব থেকেও কেউ রইল না । এক বছর পর দেখা গেল লোকটির সমস্ত জামা পোকায় খেয়ে ফেলেছে, চাকরেরা অবাধ্য ও লোভী, বই ধুলোভরা আব্রু নিষ্প্রাণভাবে সাজানো, বসার ঘর এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকে, পর্দার লাঠিগুলো কোথায় যে গেলো পাওয়া যায় না, গৃহিণীর মাথা ঘোরে, শরীরে বল পান না তিনি, উদাসীন, জানালার তাক পরিষ্কার হয় না, পাখাগুলো নোংরা, যে কুঠুরিতে যে থাকে তাদের ঘরে আলো জ্বলে, সাধারণ আলো জ্বলে না, খাবার টেবিলে লেবু-লঙ্কা কাঁচের বাটিতে ঢাকা থাকে না, কেনা হয় না সময়মত বেড-শীট বা বালিশের ওয়াড়, বোনেরা আসে কিন্তু কেমন যেন আড্ডা জমে না, অ্যাশট্রে পরিষ্কার করে না কেউ, পুত্র রাত করে বাড়ি ফেরে, পুত্রবধূ তেমন আর শাড়িতে উত্সাহী নয়, ভাইবোনে মাঝে-মাঝেই খটাখটি বাধে, জামাইরা কর্তব্য করতে আসে ।
ধীরে ধীরে বাড়িতে লোক আসা কমতে থাকে । টেলিফোন নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে, রেফরিজেরিটারে জল ভরা থাকে না - যখন যার ক্ষিদে পায় খেয়ে নেয়, একসঙ্গে বসার দরকার বোধ করে না । সংসার এলোমেলো হয়ে যায় - বোঝে সকলে, চেষ্টা করে চাকাটা ঠিকভাবে চালাতে, কিন্তু সব যেন খসে পড়ে হাত থেকে, কাঁচের গেলাসের মত । ভেঙে যায় । কেয়ারি বাগানে ঝোপ, ঝোপে গিরগিটি, লোড শেডিংয়ে দেখা যায় কেউ মোমবাতি কিনে রাখেনি । মাঝে-মাঝে পারিবারিক বন্ধুরা আসেন, বসার ঘর থেকে সেই ক্ষীণদেহী ব্যক্তির ঘরটা দেখা যায়, সেদিকে চোখ পড়ার পর তারা কিছুক্ষণ পরে বাড়ি চলে যান ।
একদিন সকালে তাঁর ঘর ঝাড় দিতে গিয়ে পরিচারিকা চেঁচিয়ে ওঠে, আমরা ছুটে গিয়ে দেখলাম, যে কুকুরটা অনুপস্থিত লোকটির পায়ের কাছে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে থাকত, সে মরে কাঠ হয়ে পড়ে রয়েছে ।
দেশপত্রিকায় ২৫-শে জুন, ১৯৭৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় । পরবাস-এ প্রকশকাল : ১৫ই জুন, ২০০৪