"কেউ না কেউ, কাউকে না কাউকে, কোথাও না কোথাও ভালবাসে, কিন্তু কতক্ষণ?" আর যখন বাসে না, বেসে উঠতে পারে না, তখনই কি সেই নিজের মধ্যে, নিজের সঙ্গে তার নিজের যুদ্ধের শুরু? - এইরকম টুকরো টুকরো স্বগতোক্তি যখন মঞ্চস্থ কোনও নাটক থেকে উঠে আসে, তখন কি তা আর শুধুই নাটকের সংলাপ-এ সীমাবদ্ধ থাকে? তা কি বয়ে নিয়ে চলে না আমাদেরও, সেই বিপন্ন বিস্ময়ের দিকে, যা আমাদের অন্তর্গত রক্তের মধ্যে খেলা করে, বেলা অবেলায়? যেখানে প্রাণ আছে, কিন্তু নেই সেই সঞ্চরণ! তাই বুঝি উড়িয়ে দেওয়া নীলকণ্ঠ পাখীর, হঠাৎ খসে পড়া একটি পালকের মতো মন তুলে নেয়, ভেসে যাওয়া সময় থেকে সেই কতক্ষণ-এর মায়া! আশা-নিরাশায় দুলতে থাকা জীবনে, প্রেম-অপ্রেমের মধ্যে দিয়ে আপনা থেকেই যেন চলতে থাকে মন এক আকাঙ্ক্ষিত অপেক্ষায়! হয়তো এই বিশেষ উপলব্ধি'র জন্য আমরাও অপেক্ষা করি কোথাও না কোথাও!
'থিয়েট্রন'-এর সাম্প্রতিক প্রযোজনায়, কবি এবং মনস্বী সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু'র 'নেপথ্য-নাটক' দেখতে দেখতে এমন কথাটাই মনে হচ্ছিল। নাটকটি'র নির্দেশক সলিল বন্দ্যোপাধ্যায়। 'থিয়েট্রন'-এর প্রতিষ্ঠা যাঁর হাতে সেই ১৯৭৪ সালে। সাম্প্রতিক নাটকটি নিয়ে এগোনোর আগে, ইতিহাসের পাতা উল্টে, একটু পুরোনো কথা ছুঁয়ে যাই। আসলে, থিয়েটারের সঙ্গে এই সংযোগ, এই ভাবনা, জীবনের অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করতে চায়। এই বিশ্লেষণ তো চলে না সবসময় মনের মধ্যে অবিমিশ্রভাবে! আর তখন মুঠো ভরে অকৃপণ কৃতজ্ঞতা জানাতে দ্বিধা থাকে না। কারণ, আমরা তো শুধু নিয়ত সেই "একটি মুঠিই ভরি", যে সজলজীবন থেকে মনে মনে অন্তত অকুণ্ঠভাবে যেন বলতে পারি - "দিতেছ দান দিবস বিভাবরী"।
..... আগের কথায় ফিরে আসি। পথচলার শুরু থেকেই 'থিয়েট্রন'- এর প্রয়াস প্রযোজনা ছিল লক্ষ্য করার মতো। বুদ্ধদেব বসু'র 'প্রথম পার্থ', 'সংক্রান্তি' এবং 'তপস্বী ও তরঙ্গিণী'-র মতো কাব্যনাট্য মঞ্চস্থ হয় 'থিয়েট্রন' থেকেই। রবীন্দ্রনাথের কাব্যনাট্য নিয়ে শম্ভু মিত্র মহাশয় যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, সম্ভবতঃ তার পরে 'কাব্যনাট্য নিয়ে এতটা সাহসী পদক্ষেপ, বিশেষতঃ বুদ্ধদেব বসু'র 'কাব্যনাট্য' নিয়ে এইরকম উৎসাহ তখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি। সলিল বন্দ্যোপাধ্যায় বুদ্ধদেব বসুর একই নাটকের কাছেই সময়ের ব্যবধানেও গেছেন। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা, হয়তো দেখাটা পাল্টাতে পাল্টাতে যাওয়া, একটা পরিণত বোধের আশ্রয়ে।
তাঁর পরের প্রজন্মের নাট্যনির্দেশক কৌশিক সেন অবশ্য পরবর্তী সময়ে, অর্থাৎ আরও পরে, বুদ্ধদেব বসু'র এই ধরনের নাটক নিয়ে বেশ অনেকটাই আগ্রহী হয়েছেন, কাজও করেছেন নিজে নির্দেশক হিসেবে। তবে ১৯৯৮ সালে, থিয়েট্রন প্রযোজিত নাটক 'তপস্বী ও তরঙ্গিণী'তে, কৌশিক মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন সলিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনাতেই।
প্রসঙ্গতঃ খুব উল্লেখযোগ্য এবং মনে রাখার মতো কথা হল এই যে, "বুদ্ধদেব", যখন তাঁর সাতান্ন বছর বয়সে, হঠাৎ করেই একটা নাটক লেখায় হাত দেন, তখন তাঁর মনে হয়েছিল যে, সেটা নতুন করে কিছু আরম্ভ করার বয়স বোধহয় নয়। নাটকটা লিখলেও হয়তো অভিনয়যোগ্য হবে না বা বই বেরোলেও বিক্রি হবে না, ইত্যাদি।
খুব ব্যক্তিগত ভাবেই রসিক মনে তিনি তাঁর ছোট মেয়ে বিদেশে থাকাকালীন, তাকে পত্রালাপে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে জানান যে, "এটা জাল গুটোবার সময়, কিন্তু আমার জালে যদি বা কিছু ধরা পড়ে, বাজারে তার খদ্দের জোটে না, অতএব সেটাও পণ্ডশ্রম।" আশ্চর্য ব্যাপার হল এই যে, সেই নাটকটিই ঠিক তার পরের বছরই "সাহিত্য নাটক আকাদেমি" পুরস্কার পায়। খ্যাতির মাইলফলক'এ এসে দাঁড়ায় তাঁর "তপস্বী ও তরঙ্গিনী"। নাটকটি 'থিয়েট্রনে'র প্রযোজনাতেও আদৃত হয় বিশেষভাবে। আশির দশকের প্রথমার্দ্ধে থেকে নব্বইয়ের দশকে'র শেষার্দ্ধ পর্যন্ত তিন-তিনবার 'থিয়েট্রন' এই নাটকটি পুর্ননির্মাণ ক'রে, এক ইতিহাস তৈরি করেন।
বুদ্ধদেব বসু 'নেপথ্য নাটক'টি লেখেন সত্তরের দশকের গোড়ায়। এই নাটকটি নিয়েও 'থিয়েট্রন' প্রথম মঞ্চ উপস্থাপনা করেন ১৯৮২ সালে প্রথম, যতদূর জানা যায়। তারপর, 'থিয়েট্রনে'র প্রযোজনায় আমরা যেমন রবীন্দ্রনাথের 'বিসর্জন' পাই, তেমনি পাই শেক্সপীয়রের 'রাজা লিয়র' এর মতো ধ্রুপদী নাটক সহ বেশ কিছু অন্যান্য নাটক; যা সমসাময়িক নাট্যচিন্তা এবং আধুনিকতার নিরিখে একটা মননশীল তৃষা জাগিয়ে তোলে। অন্তত গ্রুপ থিয়েটারে যে পরিবেশ ছিল প্রত্যাশিত। পরে বুদ্ধদেব বসু'র শতবর্ষে এই নাটকটিই 'থিয়েট্রন' থেকে হয়, থিয়েট্রনের শাশ্বতী বিশ্বাসের পরিচালনায় ২০০৭ সাল থেকে ২০০৯ পর্যন্ত। বেশ অনেকগুলি প্রদর্শন হয় এ-নাটকের। তখন অবশ্য গোটা বছর ধরেই বুদ্ধদেব বসু শতবর্ষ উদ্যাপনের চূড়ান্ত ব্যস্ততা চলছে চারদিকে।
তবে সেটা 'কবি বুদ্ধদেব' কে নিয়েই বেশি। তাঁর নাটক নিয়ে সরব হবার খুব ইচ্ছে কোথায়ই বা সেভাবে দেখলাম আমরা? কিছু লেখালিখি অবশ্য চলছিল।
'থিয়েট্রন'-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং নাট্যনির্দেশক সলিল বন্দ্যোপাধ্যায় ২০০২ থেকেই কয়েকবছর সম্পূর্ণ সরেছিলেন নির্দেশনা থেকে। এ বছরই আবার এতদিন পরে তিনি নির্দেশক দায়িত্ব নিয়ে ফিরে এলেন নতুন সম্পাদনায় বুদ্ধদেব বসুর সেই 'নেপথ্য নাটক' কে নিয়েই, তাঁর আজকের মননসঞ্জাত অভিপ্রেত বোধে এবং পরিণত বয়সে। ১৯৮২ সালের পর তাঁর নির্দেশনায় এই ২০১১ তে এল 'নেপথ্য নাটক', মাঝখানে প্রায় তিন দশক। অর্থাৎ সলিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় 'নেপথ্য নাটক' এল প্রায় তিরিশ বছরের ব্যবধানে।
জানি, বহতা সময়ের দিকে এগিয়ে যেতেই হয় মানুষকে। কিন্তু এই যে ফিরে দেখা, এ কি রোজ রোজ ঘটে? কার কাছে ফিরে যায় মন? এই যোগাযোগ কি একটা অবিচ্ছিন্ন সূত্রের কথাই বলে না? কেন মানুষ নতুন করে চায়? "নতুন" শব্দটাই কি প্রাণিত করে আমাদের? নাহলে সব দেখাই কি কেবল পুরোনো হতেই থাকতো, কিংবা বিবর্ণ?
হ্যাঁ, 'নেপথ্য নাটকে'ও এ আভাস থাকে। মনে পড়ছে নাটকেও কোনও একটা দৃশ্যে, কোনও কথার পিঠে এইরকম কথা শুনেছিলাম আমরা যে, "অনেক পুরোনো বলেই বোধহয় নতুন লাগছে ..."। হয়তো যে পুরোনোর মধ্যে অনেকদিনের না দেখা, না চাওয়া জড়িয়ে থাকে, জমাট স্মৃতির মতন! কোনও "হঠাৎ পাওয়ায় যদি চমকে ওঠে মন", তবে সে মুহূর্তটা তো নতুনই। হারিয়ে পাবার বাসনাও তো এক জীবনেই ঘটে, যা একেবারে অন্যরকম!
আসলে, উজানের মুখে জীবন কেবলই উন্মুখ। সে তো বাঁধাধরা বোধের মধ্যে ছটফট করে। একরৈখিক ভালমন্দের সঙ্কটটা, কে কাটিয়ে উঠবে সে নিজে ছাড়া? নাটকের চরিত্রগুলোর আড়ালে যে জীবনগল্প, তা এইভাবে উন্মোচিত হয়। গদ্যেই নাটকটা চলে, কিন্তু কেমন একটা বিধুর কাব্যময়তা যেন স্পর্শ করে থাকে তাকে প্রথম থেকেই। নাটকে, এক কবির উপস্থিতি তাঁর দর্শন, সেটাকে প্রদীপের সলতের মতো আরও উস্কে দেয়। অলক্ষ্যে আভাসিত হয় সেই কাব্য, একটি দিনের পর আরেকটি অনাগত দিনের অনির্দিষ্ট বাস্তবতাকে ছুঁয়েই।
মনে হয়, তাই কি নাটকে জীবনের গোধূলিতে এসে দাঁড়ানো প্রবীণ কবি অপরেশ, স্ত্রী বনানীকে বারবার অনুরোধ করেন একান্তে, এই সাজানো অভ্যস্ত নিরুত্তাপ ক্লান্ত জীবনের 'খোলস ভেঙে, আব্রু ছিঁড়ে ফেলে' বেরিয়ে আসতে? প্রতিদিনের জমে ওঠা ধুলোর মতো, মালিন্যের 'ঢাকনা' সরিয়ে একটা অনাবিল সম্পর্কিত মুহূর্তের মাঝে জীবনকে ফিরে পেতে? ক্রমশঃ স্পষ্ট হতে থাকে, আভাসিত হতে থাকে 'নেপথ্য নাটক'। তবু সে তো এত স্পর্দ্ধিত নয় যে একটানে জীবনের ক্যানভাসে সাতরঙা রামধনু ফোটাবে! আর সেখানেই শুরু হয় জীবনের নেপথ্যে জীবনকে মিলিয়ে দেখা।
চোখে দেখা কানে শোনার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা - নিয়েই ভিতরে ভিতরে চলে তার ভাঙাগড়া, ফেলে আসা পথ বেয়ে বর্তমানে। - "কোন্ ভুলে যাওয়া বসন্ত থেকে" যেন কে বা কারা আসে, সম্পর্কের 'দূতী' হয়ে, সেই 'অন্তর্গত নেপথ্য'-কে গড়ে দিতে মনের মধ্যে।
নাটকে, প্রথম দৃশ্য থেকেই আমরা ঢুকে পড়ি 'রামচন্দ্রপুর' মফস্বল শহরটিতে। যেখানে থাকেন প্রবীণ দম্পতি 'অপরেশ' - 'বনানী'। যাঁরা একসঙ্গে থেকেই বাস করেন যার যার নিজের জগতে। কবি অপরেশ যা লিখে উঠতে চান, তা লিখে উঠতে পারেন না। চিন্তাস্রোত এগোয় না। তাঁর লেখার অসম্পূর্ণ আবহে ঘরের অন্য প্রান্তেই বনানী পড়ে চলেন খবরের কাগজে যাবতীয় নিত্য নৈরাজ্যের খবর। কবির তন্ময়তা টুকরো হয় ক্রমাগত। তাঁর কবিসত্তার জিজ্ঞাসা ক্রমশঃ তাঁকে প্রান্তিক অসহায়তার মধ্যে টেনে নিয়ে যায়। কেবলই তাঁর মনে হতে থাকে এই বুঝি সেই বাস্তবসীমা, না কি সেই প্রান্ত, না কি তাঁর সীমাবদ্ধতার সীমানা! যেখানে থেমে থাকতেই হয় অতীত আর ভবিষ্যৎকে নিয়ে নিরন্তর অপেক্ষায়! অন্যদিকে, বাইরের সঙ্ঘর্ষ, - সন্ত্রাসের খবর, বনানীকেও ক্লান্ত করে, বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্নতায় তাঁর মনও ক্রমশঃ বিস্বাদে ও বিষন্নতায় ডুবতে থাকে। লেখার টেবিলের সাদা পাতার মধ্যে যেন শূণ্যতা প্রহর গোণে সময় অসময় পার করে এক আশ্চর্য - অলৌকিক মুহূর্তের অপেক্ষায়। একটা 'মির্যাকল'! হয়তো বা!
......................... মনে হয় যেন মনে মনে শুনছি কবি বুদ্ধদেব এর সেই আশ্চর্য চেতনার বুনোটে লেখা লাইন, ..................................
"আমার চোখ থেকে ফলের মত ঝুলছে - সে কি স্মৃতি? / আমার গা বেয়ে গাছের মতো বর্ধিষ্ণু - সে কি আশা?"
কিন্তু 'মির্যাকল' তো শুধু জীবন থাকতেই ঘটে মানুষের জীবনে! কখনও হয়তো বা, সেই প্রান্ত ছুঁয়েই ঘটে! কিংবা হয়তো ঘটেই না! তবু ...!
সময়কে সময়ের মধ্যে ধরে রাখা যায় না বলেই কি এই অর্ন্তলীন অপেক্ষা? বিগত'কে, অনাগত মুহূর্তের মাঝে উপলব্ধি করা? এভাবে কি চাইতে পারে সবাই? ভাবে? যে-জীবন পারে, যে-মন ভাবিত হয়, সেইই কি নিত্য তুচ্ছতার, নিত্য মালিন্যের ঢাকনা খুলে, খোলস ভেঙে সংলগ্ন হতে চায় জীবনের সত্য অর্থ খুঁজে পেতে? সে কোন জীবন? নিত্য যাপিত সত্যমিথ্যায় দিনগত পাপক্ষয় করে চলেছে যে জীবন? সময় অন্তরালে মন যেন থমকে দাঁড়ায়! একের ভিতর সদাসর্বদা সেই আর এক, যেন অন্তর্গত স্রোতে কেবলই খুঁজে ফিরছে সব 'সাফল্য' - 'ব্যর্থতা'র মাঝে, সেই কঠিন সত্য'কে সহজ করে।
নাটকে কবির সেই অস্থির পদচারণার মাঝখানে, সেই দমবন্ধ হয়ে আসা গুমোট অবস্থায় হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসে 'বসন্ত-সুগন্ধ'! আসে দুই প্রেমিক-প্রেমিকা 'জম্মু' আর 'ইমলি', এই প্রবীণ দম্পতির কাছে। তাদের উচ্ছ্বাস, তাদের মুখরিত বসন্ত - যেন ক্রমশঃ পালটে দিতে থাকে পরিবেশ পরিস্থিতি। চেনা-অচেনার ছন্দ যায় মিলে। জীবনের ধূসরতা মুছে যেতে থাকে বসন্তের স্মৃতিমথিত বকুলগন্ধে, গুঁড়ো গুঁড়ো রোদ্দুরে, ঝিরঝিরে বৃষ্টি বাতাসে, অনুভব অফুরান হতে চায়!
এ কোন গোপন সৌরভ, যা জীবনকে এমন আনমনে উদ্বেলিত করে তুলতে পারে? আমরা শুনি ছবির মত সেখানকার ঢেউ খেলানো লালমাটি, মাঝে সরু সরু আঁকাবাঁকা কালো পিচের পথ, জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া নীলজঙ্ঘা পাহাড়ের কোলে ফুলডুংরি নদী ...! তখন ভাবি, এ কোন রামচন্দ্রপুর? কেবলই বাতাসে বারুদের গন্ধে সন্ত্রাসিত ছিল যে মফস্বল শহরটি? না কি আর এক অনিঃশেষ পথ! এসব ছিল কি সেখানে? থাকে? কারা ফিরে দ্যাখে, যা দ্যাখেনি আগে? কোন অনুভবে 'গোধূলি' নামের বাড়িটি কখনো হয়ে যায় 'বালার্ক', কখনও বা 'বনশ্রী'? ছায়া নেমে আসে মনের মধ্যে! আবার যেন কবি বুদ্ধদেব চলেন কবি অপরেশ এর নির্জন-সঙ্গী হয়ে। কবি কী তখন মনে মনে বলেন - "আমি কী ছিলাম সেখানে কোনওদিন / না কি এখনও দেখিনি / না কি, আমি সেখানেই আছি"?
কিন্তু "নামে কী যায় আসে? আসল তো ভেতরটাই" এমন কথা নাটকে একসময় বলেন অপরেশ। যখন বনানী - বলেন "কিন্তু নামটাও তো জরুরী, নাহলে চেনা হবে কী করে?" সত্যিই তাই? নামই কী সত্যি সত্যি চেনায়? কি জানি। তাই শব্দ বদলাতে থাকে, ভেতরের প্রয়োজন বদলায় না। 'শম্ভু' হতেই পারে 'জম্মু', অথবা 'বিল্লি'ই 'ইমলি' হয়ে যায় কোন সন্ধিক্ষণে যেন। 'সংলাপ'-এরও একটা "অন্তর বাহির" থাকে, লিখেছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ।
কিন্তু "সংলাপটাই তো নাটক নয়?" - এমন কথাই শুনি। হ্যাঁ, সংলাপটাই যে নাটকের সব নয়, এ কথা হয়তো আমরা জেনেও যাই, নাটকের মর্মে। কিন্তু 'মর্ম'টাই যে উঠে আসে, নাটকটিকে বোঝায়, কথারই ছলে! তবে নাটকের আবহ-উন্মেষ, মঞ্চ পরিকল্পনা, দৃশ্য রূপায়ণ, অভিনয়, এ সবই তো নাট্য প্রয়োগ অন্তর্গত বটেই। তবু, একটা নাটক পড়লেও, মনে মনে ছবি আঁকাটা তো চলেই গানের মতো, রাগ-রাগিণী উদ্ভূত অনুভবের মতো। সংলাপ উচ্চারণে, স্বরক্ষেপণে, লয়ে, মীড়ে, শব্দ অন্তর্গত ব্যবধানে অবশ্যই একটা মাত্রা যুক্ত হয়, সঙ্গীতের মতো একটা ডিসিপ্লিন, শৃঙ্খলা ফুটে উঠতে থাকে, যা অর্ন্তনিহিত থাকে কতকটা নাটক-পড়ার সময়। তাই নাটক দেখাটা তখন ভীষণরকম ভাবে আলাদা হতে থাকে। অভিনয়ে সেই গতি, সেই মুডটা আসতে থাকে, চরিত্রদের মধ্যে দিয়ে যা সৃজিত হয় নির্দেশনা-গত হয়ে। যেমন কবির সংলাপ বলার ধরণটা কখনও নিতান্ত সাদামাটা, কখনও কাব্যিক, একটু প্রতীকি! যা নাটকে একটা ছন্দ আনে। জীবনদর্শন থেকে মানানসই ভাবে উঠে আসতে পারে যা একমাত্র!
ভাবলে উদ্দীপিত হতে হয় যে, কী অদ্ভুত এক বোঝাপড়া এই নির্মাণ। "অভিনেতা যে কেবলমাত্র নাট্যকারের রঙচঙে ইলাসট্রেশন নয়" -এ ভাবনায় ভাবিত হয়েছিলেন নাকি শম্ভু মিত্রের মতো নির্দেশক ! এ তো উপলব্ধ সত্য। কীভাবে বুঝেছিলেন তিনি অভিনয়কে, ভাবলে শিহরিত হতে হয়। সত্যিই তো, অভিনেতা নিজেও কি চারিত হন না, নিজের মধ্যে নিজেকে রেখেই, নাট্যচরিত্রের মধ্যে মিশে যেতে?
এ তো এক চূডান্ত ভারসাম্য! সেখানে মন ক্রিয়া করছে কি না। সেও তো ছন্দ হারায়, আবার হারিয়ে খোঁজে অদেখা মুহূর্তের নেপথ্যে! আত্মপরিচয় আত্মস্থ রেখেই নিজেকে ভোলে।
সেখানে আমরা কোনও কলের পুতুল'কে খুঁজবো কী? তবে, নির্দেশক তো নিশ্চিত তাঁর সেই নির্ভর-সুহৃদ। তিনিই সেই ঋত্বিক, যিনি নাট্যযজ্ঞ সম্পূর্ণ করেন আপন সৃষ্টিশীলতার তাগিদে তাঁর সহযাত্রী কুশীলবদের নিয়ে, এমন কী দর্শকদের নিয়েও। তবে তাঁকে আকাঙ্ক্ষিত অভিব্যক্তিতে পৌঁছবার প্রেরণা জোগান প্রথমেই লেখক, নাট্যকার। তিনিই তো ভাবিত হবার সেই সূত্র। বীজ রোপণ করলেন তো মনের মধ্যে তিনিই। তাঁর দেখাটা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ তো 'বুদ্ধদেব' এরই তপস্যা-অনুসৃত।
সেখানে সাহিত্য অন্তর্গত এই নাটক নির্বাচনটাও কিন্তু আর একটু এগিয়ে গিয়ে দেখা, যে দেখা'র জন্য নাট্যকার'এর নাটক অপেক্ষায় থাকে। নির্দেশকের কাছে এটা একটা চ্যালেঞ্জ এর মতো সবসময়। কারণ, একটা 'প্রসেস' এর মধ্যে দিয়েই তো তিনি যাচ্ছেন। নিজের মতো করে ভাবছেন, মূল্যায়ণ করছেন, সংযোজন করছেন, সম্পাদনা করছেন, মাত্রা যুক্ত করছেন, অভিনেতাদের তৈরী করছেন -এও তো একটা হয়ে-ওঠা। স্তরে স্তরে সেই প্রকাশধর্মীতা যুক্ত হচ্ছে নাট্য-সন্নিধ্যেই। এ তো শুধু বিনোদনের শর্তে পড়ে নেই, বলাই বাহুল্য। তবে তিনি প্রচারবিমুখ না প্রচারহীন, সেসব জটিলতার অবসান হোক।
নাটকের আবহসঙ্গীত খুব সংযত। আর, সংযোজিত রবীন্দ্রসংগীত, যা গুনগুন করে ওঠেন বনানী, চোখে জল আসে তাঁর একা বসে .... সে যেন স্বগতোক্তি! যা মনকে নিভৃতে জাগায়! মনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ কথা কইতে যেন সে গান আসে। সুর আসে। সুরের মধ্যে একটা চলা তো থাকেই, থেমে থাকা মনও সেখানে গতি পায়। তবু গেয়ে উঠতে পারার মতো সে মুহূর্ত তৈরী হয় না। তখুন সে গান একেবারেই - তাঁর "আপন-গান"! যা শুধু ভেতরে বাজতে থাকে বীণার মতো! বনানীর গলা বুজে আসে চাপা কান্নায়! আর, বুদ্ধদেব বসু-র গানগুলি তো নাটকে ছিলই। মঞ্চেও সে গান বনানী অন্যকে শোনান। অন্য গান অন্যের কণ্ঠে আবার নিজেরাও শোনেন। এক আনন্দ সন্ধ্যা নামে সেই জড়ো করা মুহূর্তে। যদিও নাটকে 'জম্মু'র গানে, 'ইমলি'র আগ্রহই বরাবর, এ কথাটা ওঠে এবং তাইই থাকে শেষ পর্যন্ত, সবাই শুনলেও। আর একটা মজার কথাও মনে পড়ে যে, 'গানের-খাতায় বানান ভুলে গান লেখা থাকলেও, গাইলে তা বোঝা যায় না'। কী সূক্ষ্ম রসবোধ নাট্যকারের!
দৃশ্য অবতারণা প্রসঙ্গেও মনে রাখার মতো কিছু থাকে। আমরা দেখি, নাটকে একটাই 'সেট'। সেটি বদলায় না দৃশ্যান্তরেও। খুব স্ট্রাইকিং লাগে, যখন লক্ষ্য করি ওই দুই প্রেমিক-প্রেমিকার আসা-যাওয়ার পথটা চিহ্নিত নয়। সবাই যে পথে, মানে, যে দরজা দিয়ে বাড়িটিতে বা ঘরটিতে ঢোকে, সেই পথ দিয়ে তারা আসে না।
কিন্তু পথ একটা খোলাই থাকে কিংবা পড়েই থাকে যেন আসলে, সকাতর-হৃদয়-অন্তরালে। "বসন্ত" হঠাৎ আসে সেই "অলখ-পথেই"। তাই অলিখিত, অঘোষিত, অনির্দেশিত সেই পথ দিয়ে তারা আসে যায়। এটা বুদ্ধদেব বসু'র নাট্য ভাবনায় ছিল না। অর্থাৎ মঞ্চ ভাবনায় ছিল না। তাকে উপলব্ধি করলেন নির্দেশক সলিল বন্দ্যোপাধ্যায় মনস্তাত্ত্বিক বিস্তারে!
এই যে সামঞ্জস্য রেখেই বুনে দেওয়া, এই দায়িত্ব তিনিই নিতে পারেন যিনি নেপথ্যে নিজেও সঞ্চারিত, আপন বোধিতে। এ তো আরোপিত নয়, এ তো মনের মধ্যে মিলিয়ে দেখা। এ তো একটা চর্চাও। মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার মত, নাটকেও প্রাণ সঞ্চার করেন তো নাট্যনির্দেশকই। সেই প্রাণ-ই তো আনন্দ। শিল্প-সান্নিধ্যের আনন্দ! সেখানেও প্রাণ অপেক্ষায়।
অনেকটা সঙ্গীতের মতো! গান-টা হয়তো কবিতার মতো পড়াই যায়! - সুরটা নিয়ে ভাষাহীনভাবে কোনও বাদ্যযন্ত্রে বাজালেও, বাজে। কিন্তু যতক্ষণ না গায়কের কণ্ঠে সে রূপ পায়, তার অসম্পূর্ণতা ঘোচে না। তবু, 'একাকী গায়কের নহে তো গান।' 'বন্ধন টুটে যাক,' এই প্রার্থনা। নাটক ও তো তেমনটাই। সৎ অর্থে, পারঙ্গমতায়, তাকে গ্রহণ করা চাই। এই প্রয়োগ-ভাবনায় শুধু নির্দেশক কেন, প্রস্তুত হতে হয় সমবেত সকলকেই। কুশীলবদের সঙ্গে দর্শককেও। এই অন্তরঙ্গ যোগাযোগটা লাগেই। এটাই 'আহুত', নাটকের জন্ম থেকেই।
তবে যিনি থিয়েটার দ্যাখেন, তিনি যে থিয়েটার করেন, এমনটা তো স্বাভাবিক ভাবেই সবসময় প্রত্যাশিত নয়। সব শিল্পমাধ্যমের ক্ষেত্রেই সে কথাটা বোধহয় প্রযোজ্য। আমার যেমন মনে হয়েছিল, নাটকটা দেখার একটা আয়োজন ছিলই মনের মধ্যে। যেন খানিকটা ওইরকম ভাবনায় মন বসতে চাইছিল হয়তো বা। তাই নাটক শুরু হতেই, কথাগুলো শুনতে শুনতে মনের মধ্যে একটা কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া শুরু হয়।
তেমন এটাও ঠিক যিনি এই নাটকটি আবার নতুন সুরে বাঁধলেন, তিনিও সেই কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া থেকেই নিঃশর্তে নিজেকে প্রকাশ করছেন, শুধু থিয়েটারকে ভালবেসে। শুধু থিয়েটারকে পেতে। সে যে সময়েই হোক, যত পরেই হোক আজ, বা তাঁর নির্দেশক হিসেবে সরে থাকার যে কারণই থাক না কেন বিগত কয়েকবছর। আত্মপ্রকাশ সঞ্চারিত হোক, এ প্রতীক্ষা শিল্পীর সাধনায় থাকেই না কি? যদিও তিনি অনেক আগে থেকেই প্রকাশিত এবং প্রচারিত। তাঁর বর্তমান প্রচার-অনীহা'র কার্যকারণ, যৌক্তিকতা বুদ্ধদেব বসুর 'নেপথ্য নাটককে' নিয়ে কি না, বা থাকলে, কেন? তা জানা নেই। কারণ মঞ্চ প্রদর্শন ব্যবস্থা তো হয়েছে বাণিজ্যিক ভাবেই। তাহলে?
রবীন্দ্রনাথের কথায় অবশ্য আমরা জেনেছি - "যে লোক কাজের উৎসাহে আছে, স্তবে'র উৎসাহে তাহার কোনো প্রয়োজনই থাকে না"। এখন এই প্রত্যয় যদি কাউকে নিজের অজান্তেই অতি সচেতন বা ভ্রুক্ষেপহীন করে তোলে, তাহলে বিখ্যাত-অবিখ্যাত দর্শক সমাগমে, কে স্তাবক আর কে সত্যকার গুণগ্রাহী, মূল্যায়ণ হবে কীভাবে? কারণ যিনি সৃষ্টি করছেন তিনি তো সঞ্চারও করছেন। তিনি এবং তাঁর দর্শক উভয়েই তো আনন্দযজ্ঞের অংশীদার। মূল্যায়িত হচ্ছে অন্তর থেকে অন্তরে। এই যোগাযোগের তো ব্যতিক্রম নেই। ব্যতিক্রম থাকতে পারে অপ্রেমে; যেখানে, যে অন্তরে বীণা বাজে না!
কিন্তু একটা সৎ ভাবনার বিশ্লেষণে, হয়তো থাকে কোথাও আত্মানুসন্ধান! সে কোনও লেখাতেও থাকতে পারে, যে কোনও আলোচনায় থাকতে পারে, কথোপকথনেও থাকতে পারে। তা তো মূর্খতা নয়? কোনও অযাচিত পাণ্ডিত্যও নয়? প্রাণিত হবার কোনও আয়োজন-ই কি কোথাও থাকতে পারে না, যেখান থেকে আমরা বিশ্লেষিত হতে পারি, সংশোধিত করে দিতে পারি নিজেকে অথবা অন্যকে? অন্তর-বাহির মিলিয়ে ডাক পাঠাতে পারি প্রার্থিত জীবনকে খুঁজে নিতে? শিল্পবোধের কাছে তখন তার নম্র চেতনায় সে কৃতজ্ঞ হতে থাকে নিশ্চিত! তাকে উপেক্ষা করা যায়? করব আমরা? তার সংবেদনশীলতাকে?
পরে মনে হয় আজকের সময়ে 'তাকে' না চেনাটাই হয়তো সহজ। চারপাশের কোলাহলে কিঞ্চিৎ প্রত্যাশিতও। তাই ফিরে যেতেই হয়! আসলে, কে কেমন আছে, কিভাবে কাকে খুঁজছে, আমরা কি সব জানি, যে, অনায়াস মন্তব্য করবো ব্যক্তিত্বের জোরে? তিনি অভিভূত হতেও পারেন, না হতেও পারেন, এই মাত্র। কিন্তু তাতে কী? তবু যিনি আগ্রহী? যিনি ইচ্ছুক? সে যাক।
..... তবু বলি, স্তব-স্তুতি, "উৎসাহে ভাঁটা তো আনে না, তাহলে জোয়ারের মুখে পড়ে যা ভেসে যায় তা যাক। নান্দনিক বোধে সেই স্পেসটাকে খুঁজে নেবো আমরা 'নেপথ্য নাটকে'র নেপথ্যেই। কারণ "রস জিনিসটা রসিকের অপেক্ষা রাখে; কেবলমাত্র নিজের জোরে নিজেকে সে সপ্রমাণ করিতে পারে না"। হ্যাঁ, এও বললেন রবীন্দ্রনাথই।
সবশেষে নাট্যকারের সমাজবীক্ষণের কথায় আসি। আসলে বুদ্ধদেব বসু-র যে কোনও নাটক কে 'গদ্যনাটক' বা 'কাব্যনাটক' বলে, গায়ে তকমা লাগিয়ে, এককথায় সেরে ফেলা সম্ভব নয়। যদি তার আত্মিক সম্পর্কটাকে যাচাই করে নিতে চাই, তাহলে দেখবো সে যেন কখনও কাব্য থেকে সরে আসছে গদ্যের কাছাকাছি, আবার গদ্য থেকে চলেছে সেই কবিতার দিকে। যেমনটা 'নেপথ্য-নাটকে'ও দেখি। তাই নাটকে, আটপৌরে কথা বলতে বলতেই এসে পড়ে একটা কাব্যিক অনুভব। এই আবহমান জীবন-অন্বেষণ, কবি-মন অন্তর্গত, বোঝা যায়। এমন কি তা 'মহাভারত' 'রামায়ণ' 'পুরাণ' আশ্রিত নাটক হোক বা সমসাময়িক সামাজিক নাটক। 'পুরাণে'র চরিত্রগুলিকেও উপলব্ধি করে, একজন শল্য চিকিৎসকের মতো বিশ্লেষণ করেন, কারণ তাদের মানবিক-সামাজিক মনস্তত্ত্ব, দায়বদ্ধতা, পারস্পরিক সম্পর্ক - পরতে পরতে উন্মোচিত হয় সেই বীক্ষণ।
'নেপথ্য-নাটকে'ও সময় থেকে এগিয়ে থাকে তাঁর মনস্ক উচ্চারিত চিন্তাশীল সংলাপ যা জীবনকে আলগা হতে দেয়না জীবনবোধ থেকে। কল্পনা-বাস্তব যে এতটা মিলেমিশে চলে আমাদের মনের মধ্যে, একথা আমরাও কি সবসময় টের পাই? নৈতিক সুস্থ বোধ-এর পাশাপাশি অনৈতিকতার চারা ও যে চরিত্রকে আড়াল করে রাখে, সেই তির্যক-চাহনিও সামাজিকতা উপেক্ষা করে নয়; কোন সম্পর্কে জাত হলে, মানুষ শৈশব থেকে সামাজিক হয়ে উঠবে? এ প্রশ্নেরও দ্বারস্থও হই আমরা তাঁর সব নাটকগুলো নিয়ে ভাবতে বসলে।
তাই আজকের 'নেপথ্য নাটক'ও শুধু নাটকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। দারুণ একটা অভিনয়ের দাপটে মুহূর্তে করতালির বন্যা হয়ে গেল, কিছুতেই তাও নয়। অর্ন্তমুখী প্রকৃতি তার। সেখানে জীবন কখনো উচ্ছ্বসিত, কখনও বিষাদগ্রস্ত। ফলে ব্যক্তিগত একটা গভীরতা নাট্যভাবনা থেকে আমাদেরও ভাবায়, কুরে কুরে খায়, অন্যমনস্ক করে।
নাটকটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতার বাতাবরণ একটা থাকেই, নাটকটি রচনার সময়ের প্রেক্ষিত থেকেই হয়তো আসে। সেটা সময়ের প্রতিফলন তো বটেই, যা সব সাহিত্যেই কোনও না কোনও ভাবে আমরা খুঁজে পাই। সেটাও ছিল সত্তরের দশকের শুরু, সেই সময়। তাই, আমরা নাটকের বাস্তবতায় দেখি 'জম্মু' 'ইমলি' দুটি অল্পবয়সী তরুণ-তরুণীকে ঘিরে হঠাৎ সন্দেহ, বিক্ষিপ্ততা, তির্যক চাহনি, অচেনা আশঙ্কা অথবা সেই সময়ের চেনা সন্ত্রাস যেন দানা বাঁধতে থাকে। খানিকটা পরিস্থিতিগত কারণে, অনাহুত'র মত আকস্মিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় 'জম্মু' 'ইমলি' প্রবীণ দম্পতির কাছ থেকে সামাজিক কারণেই।
কিন্তু সে তো আমাদের ব্যবহারিক জীবনের স্তর থেকে। অভ্যস্ত চোখের চাওয়া থেকে। যেটা তলিয়ে দেখার সুযোগ থাকে না, থাকলেও কে কতবার তা আমরা আজও সত্যি সত্যি দেখে উঠতে পারি? টালমাটাল সময়ের উপদ্রবে, চোখের সামনে যা হারায়, তাকে নিয়েই তো সকাতর মন ভেতরে ভেতরে আঁকড়ে বাঁচতে চায় চোখের আড়ালে। এমনটাই তো জীবনের নেপথ্যেও ঘটতে থাকে। তাই কি প্রবীণ 'অপরেশ' 'বনানী' ফিরে পেতে চায় পিছুটানের মতো তাদের 'শম্ভু' 'বিল্লি'কে? সেই স্নেহ মায়া মমতায় ছুঁয়ে থাকা যাচিত জীবনকে? যে মায়া কুড়িয়ে নিতে, নাটকের এই নেপথ্য পরিক্রমণ! সেই জীবন অন্তরাল মায়া! যা শুধু চোখেই ফুরোয়; অথবা ফুরোয় না আর! অন্ধকারের দুয়ার পেরোতে চায় যে দর্শন। নাট্যকারের এই উজ্জ্বল উপলব্ধি, অভিনিবেশ দাবী করে, বলাই বাহুল্য, যা সাহিত্য আর জীবনকে রাখে একই সঙ্গে, সাহিত্যগত করে। এই অপূর্বতাটা - আলোর মতো।
বুদ্ধদেব বসু নিজে তাঁর কোনও নাটকই মঞ্চস্থ হওয়া দেখে যেতে পারেননি, খুব উৎসাহী এবং আগ্রহী থাকলেও। তিনি জীবিত থাকাকালীন-ই সলিল বন্দ্যোপাধ্যায় নাটক মঞ্চস্থ করার তোড়জোড় শুরু করলেও, তাঁর দেখা হয়নি শেষ অবধি। এই আক্ষেপ তাঁর উত্তরাধিকারীদের মনে থেকেই গেল। এবং আমাদেরও।
তাঁর 'নেপথ্য নাটক' এ উচ্চারিত এবং অনুচ্চারিত যে আবহ তা খুবই অর্থবহ। তবে সব নাটককেই যে একটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্যে আনতেই হবে, এটা তো না হওয়াই ভাল।
রাজনৈতিক মতাদর্শের চাপান উতোরের মধ্যে কিংবা পরিস্থিতি পরিবর্তনের কথাই আনতে হবে ছক কষে কষে, এমনটাও তো না হতেই পারে। প্রয়োজনটা আপেক্ষিক। বহুজনের সৃজনী প্রতিভার দ্বারস্থ হয়েই তো আমরা ফিরে পাই অতীতকে বর্তমানে, আমাদের নতুন-পুরোনো জানাটাকে মিলিয়ে। সেক্ষেত্রে 'নেপথ্য নাটক' যেন চিন্তার এক উদ্বোধন। দেশজ-সম্পর্ক, নিভৃত অপেক্ষা, মানবিক উত্তরণ, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব এ সবই থাকে সেখানে। যা আমাদের শিকড় উৎপাটিত করে না, গন্তব্যে পৌঁছে দিতে কোনও তিক্ত সমালোচনামুখী করে না, বরং তির্যক রসবোধে মনকে সিক্ত করে। উচ্চকিত উগ্রতা নেই সেখানে, বিপরীত স্রোতে গা ভাসাতে শেখায় না, আবার নিশ্চিত নিরাপত্তার ঘেরাটোপে গণ্ডীবদ্ধ, স্বার্থমগ্ন হয়ে বাঁচার ইঙ্গিতও দেয় না। মেধার অন্তরালে জীবনকে লক্ষ্য করে, খোঁজে। মানুষের প্রতি মানুষের সহ-অনুভূতিকে খোঁজে। সকাতর প্রেমকে খোঁজে। জীবনের অনিবার্য অনিশ্চয়তা নিয়েই সাদামাটা যাপনকে অর্ন্তমুখী ক'রে বাস্তবে ফিরে পেতে চায়। তার কৌলীন্য সৎ-ভাবনার উদ্যাপনে। সে জীবন কি আজ ক্রমাগত অন্তর্হিত? 'নেপথ্য নাটক'ও চলেছে সে খোঁজে! মনস্তাত্ত্বিক খোঁজ!
এই আধুনিক নাগরিক কবি এবং সন্দীপ্ত চেতনার নাট্যকার সম্পর্কে, ভবিষ্যৎ সময় হয়তো আরও কথা বলবে অনেকটা পথ যেতে যেতে। কারণ এইরকম মনস্বী সাহিত্যিক মাত্রেই যুগকে প্রভাবিত করেন, তাই তিনি মূল্যায়িত হন পরেও। ইতিহাস পড়ে থাকে। বর্তমান তাকে কুড়িয়ে নেয়; ভবিষ্যতের সঙ্গে সে তখনই যুক্ত হতে শুরু করে প্রবাহমান সময়ের মধ্যে দিয়ে। আসলে, যা আছে, তাকেই তো ফিরে পাওয়া সম্ভব। 'নেপথ্য নাটকে'ও সেইরকম কথার মধ্যে জড়িয়ে থাকে কথা, ভাবের মধ্যে ভাব; জীবনের অন্তরালে বয়ে যাওয়া জীবনের গল্প ভেতর থেকে উঠে আসে। বুদ্ধদেব যেমন সেই "নস্ট্যালাজিয়া"ইয় বলেছেন -"সে কি যাওয়া না ফেরা? / না কি সন্ধান শুধু?" তাই নাটকের মধ্যেই থাকে সেই বীজ নিহিত। প্রতিদিনের বয়ে যাওয়া বাতাসের মাঝেই 'মুকুল ঝরা বেলায়' যেভাবে আমরা 'উদাসী হাওয়া'কে চিনে নিতে পারি সেই পথেই, - এ যেন সেইরকম "প্রচ্ছন্ন"!
নেপথ্য নাটকের একবারে শেষ দৃশ্যের শেষে এসে দেখি, কবি 'অপরেশ' এর মনে যেন সেই 'ঘন যামিনীর মাঝে, না বলা বাণী'র মত পড়ে থাকে, 'নেপথ্য সময়'! না কি 'নেপথ্য-নিভৃতি'? চিনতে একটুও বোধহয় ভুল হয় না কবি 'বুদ্ধদেব' এর "রাত্রি" র সেই "লুপ্ত সময়", যা তিনি দেখতে পান ধীরে ধীরে ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে।' তাঁর শেষজীবনের কাব্যগ্রন্থ 'একদিন চিরদিন'-এ তাই, কি-নিবিড় অনুভবে তিনি লিখেছিলেন, ......"অন্তরালে সবই অটুট / শুধু একটি পাতলা পর্দার অন্তরাল!"
এ কি সত্যি নয়? জীবন কি সত্যিই এভাবেই চিনতে চায় না কোথাও না কোথাও তার অন্তর্গত জীবন-কে?