বুদ্ধদেব বসুর চিঠি কনিষ্ঠা কন্যা রুমিকে; স্মৃতি সূত্র সম্পাদন: দময়ন্তী বসু সিং; প্রথম প্রকাশ: জুন ২০০৬, দ্বিতীয় সংস্করণঃ জুন ২০১৩; বিকল্প - কলকাতা; ISBN: 81-88098-19-1
সদ্য শেষ করলাম ‘বুদ্ধদেব বসুর চিঠিঃ কনিষ্ঠা কন্যা রুমিকে’ যা সম্পাদনা করেছেন দময়ন্তী বসু সিং মানে স্বয়ং রুমি। ‘শেষ করলাম’ বললাম বটে তবে বইটি এমনি মুল্যবান যে বারবার তার কাছে আমাকে যে ফিরতে হবে তা আমি জানি। ১৯৬২ সালে বাইশ বছর বয়সে দময়ন্তী যখন ডক্টরেট করতে আমেরিকা যান তখন এই পত্রমালার শুরু। ১৯৬৬-তে তিনি দেশে ফিরলেন বটে কিন্তু স্বামী-পুত্র নিয়ে সংসার পাতলেন সুদূর কানপুরে অতএব পিতার সঙ্গে চিঠির আদানপ্রদান বজায় রইল। এই পত্রসম্ভারের শেষ চিঠি ১৯৭৪ সালের ১১ই মার্চ লেখা যা বুদ্ধদেব বসুর মৃত্যুর (১৭ই মার্চ, ১৯৭৪) পরে কানপুরে পৌঁছয়।
এই চিঠিগুলি ১৯৮৮ সালে একবছর ধরে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তখন আমার সদ্য মাতৃত্ব লাভ হয়েছে তাই সেই সময় একরকম মন নিয়ে ঐ চিঠিগুলি পড়েছিলাম। কিন্তু এখন, এতো বছর পরে, যখন আমি নিজে প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় আর আমাদের একমাত্র সন্তান ডক্টরেট করতে আমাদের থেকে দূরে, এই চিঠিগুলিতে ব্যক্ত পিতার অনেক দুর্ভাবনা, আনন্দ, আশা আমার খুব চেনা লাগলো, অনেক কথাকে আমারও মনের কথা ব’লে মনে হ’ল। এতো গেল বইটির একটা দিক। অন্যদিকে, পণ্ডিত ও প্রাজ্ঞ বুদ্ধদেব বসু যখন কন্যাকে ভারতীয় দর্শন বা ইওরোপীয় চিত্রকলা অথবা বিশ্ববরেণ্য কোন কবির কাব্য বিষয়ে কিছু লেখেন, আমি মনে মনে তাঁর ছাত্রী হ’য়ে গিয়ে তখন আপ্রাণ চেষ্টা করি সেই অমূল্য শিক্ষার অন্তত কিছুটা আত্মস্থ করতে।
কবি-ঔপন্যাসিক-নাট্যকার বুদ্ধদেব বসুকে বাঙালি পাঠক খুব ভাল করেই চেনেন কিন্তু এই চিঠিগুলিতে বারবার আমরা দেখি ওঁর আরেক সত্তা যেখানে উনি একই সঙ্গে স্নেহশীল পিতা ও বিদগ্ধ গুরু। দময়ন্তী সদ্য আমেরিকা পৌঁছনোর পর বুদ্ধদেব বসু লিখছেন — “ঠাণ্ডা বিষয়ে খুব সাবধানে থাকবি, ‘গরম লাগছে’ এই মোহবশত অনাচ্ছাদিত হ’য়ে বেরোবি না — সর্দি ওখানে বড় সাঙ্ঘাতিক জিনিশ, খুব সাবধান। ওভারকোটের আন্দাজ ঠাণ্ডা না-হ’লে বর্ষাতি জড়িয়ে বেরোবি — এক-এক সময় ভীষণ হাওয়া দেয়, তখন মাথায় রুমাল-বাঁধা ভালো (শীতে নিশ্চয়ই)। ...তোকে বলেছিলাম — আবার লিখি — গরম আর ঠাণ্ডা জল মেশাবার সময় খুব সাবধান, ঝুপ ক’রে যেন ফুটন্ত জল গায়ে না পড়ে, বা হিম জলে মাথা ফেটে না যায়। ... মাথায় ঠাণ্ডা জল দিতে পারিস, কিন্তু চুল যেন শুকোয়”। আরেকটি চিঠিতে তিনি লিখছেন "... উচ্চারণের প্রতিও কান খোলা রাখবি, বহু ইংরেজি শব্দের উচ্চারণ আমরা ভুল জানি, সংশয়স্থলে জিজ্ঞেস ক’রে নিবি ঠিক উচ্চারণ কী — এ-সব বিষয়ে অমনোযোগের মানে হয় না"। কন্যার খাওয়া-দাওয়া, পড়াশুনো, সামাজিকতা-রক্ষা এই সবদিক নিয়েই তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ও কখনো কখনো কন্যাকে উপদেশ দিয়েছেন। কনিষ্ঠা কন্যার পাশাপাশি রয়েছে তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা ও জামাতা আর পুত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা ও তাঁদের সাফল্যে স্বস্তি ও আনন্দের প্রকাশ। তবে শুধু নিজের সন্তানদের নিয়েই যে তিনি ভাবতেন তা নয় — তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবন নিয়েও উনি নানাসময়ে দুশ্চিন্তা করেছেন, খুশি হয়েছেন তাঁদের সাফল্যে। এ প্রসঙ্গে বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় নরেশ গুহ, অমিয় দেব, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত ও নবনীতা দেবসেন-এর নাম যাঁদের এবং এরকম আরো অনেক ছাত্রছাত্রীকে তাঁর অপরিসীম ছাত্রপ্রীতির ফলে বুদ্ধদেব বসু যে নিজের পরিবারের সদস্য হিশেবে দেখতেন সেকথা এই বইতে বারবারই উঠে এসেছে।
এই চিঠির সম্ভার পড়তে গিয়ে বুঝি যে কন্যাকে ছেড়ে থাকতে পিতা কষ্ট পাচ্ছেন কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তাঁর বিদেশের বা প্রবাসের দিনগুলিকে আনন্দময় করে তুলতে। তাকে শেখাচ্ছেন কীভাবে পরিপার্শ্ব থেকে সে আনন্দ আহরণ করতে পারে। একটি চিঠিতে দেখি "আর-এক কথা — Sound and Sight, ব্যালে অভিনয় অপেরা ও গানবাজনা — যখন যা সুবিধে হবে দেখে নিবি ও শুনে নিবি, এগুলো তোর শিক্ষারই অঙ্গ"। শুরুর দিকে একটি চিঠিতে রয়েছে অসাধারণ এক শিক্ষাঃ "হঠাৎ এক সময় খুব মন খারাপ লাগে ব’লে বিদেশকে দোষ দিস কেন? কলকাতাতেও কি ও-রকম হয় না? যাকে আমরা বাড়ি বলি, সেখানেও কত পাহাড়ের মতো নিঃসঙ্গতা, কত অন্ধকার, কত শূন্য প্রহর! ওটাই মানুষের অবস্থা, তার নিয়তি — কোনো স্থান-কালের ওপর বিশেষ কিছু নির্ভর করে না। যাকে আমরা সুখ বলি, তা ক্ষণিক ও আকস্মিক — বাগবাজারে, মানহাটানে বা টেহেরানের বস্তিতে তা পাবার বাধা নেই, আমাদের তথাকথিত দেশে বা গৃহে তার সম্ভাবনা বেশি — এই ধারণা নিতান্ত ভ্রান্ত। তাছাড়া তোর যারা আত্মীয় বা বন্ধু বা স্বজন — তারাই তোর সব, জগতের লোক তোর কিছুই নয়, এই মোহকে কখনোই স্থান দিতে নেই। আত্মীয়পোষিত গ্রাম্য জীবন কাটাবার বেলা কতকাল অতিক্রান্ত হয়েছে, সেই মনোভাব আধুনিক সভ্যতার বিরোধী।..." কয়েক বছর পরেও আমেরিকা-বাসী কন্যাকে বুদ্ধদেব বসু লিখছেন "...রুমি, কোনো উত্তেজনাতেই ভুলে যাস না যে মানুষ মানুষই, আমরা প্রত্যেকেই এক-একজন ব্যক্তি — মার্কিনী, পাকিস্তানী, মুসলমান বা ইহুদী বলে কাউকে কখনো চিহ্নিত করিস না। মনে রাখিস সকলের মধ্যে ভালো-মন্দ দুই-ই আছে"। নিজের শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও পিতা তাঁদের সংসার ও দেশের ছোট-বড় নানা ঘটনা নিয়মিত কন্যাকে লিখে জানাতেন; স্থানগত দূরত্ব যাই থাক না কেন পিতার জীবনের আনন্দ-বেদনা সবেতেই কন্যাটি যেন তাঁর সঙ্গেই রয়েছেন। যেমন দেখি ১৯৬৩-র জানুয়ারিতে লেখা চিঠিতে "...আজকাল ৮বি-তে দোতলা বাস্ দিয়েছে — সেদিন কলেজ থেকে দোতলায় বসে ফিরলাম, অনেকদিন পরে যাদবপুরকে নতুন মনে হ’লো"। ১৯৬৮-র মার্চে লেখা চিঠিতে রয়েছে "...যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল — হেম গুহ, মল্লিক থেকে শুরু করে সব চেয়ারম্যান এবং আরো অনেকে — চব্বিশ ঘন্টা ধ’রে মাত্র কয়েকটি ছাত্রের দ্বারা (বলা বাহুল্য, এঞ্জিনিয়ারিং কলেজের) ঘেরাও হয়ে ছিলেন"। তেমনি আরেকটি চিঠিতে পাই সারমেয়-সংবাদ "...ভুতো ছাড়া দু’টি বেওয়ারিশ কুকুরও প্রতিপালিত হচ্ছে এ-বাড়িতে — একজন গোপাল, সে পেছনের দরজা পাহারা দেয়, গঙ্গামণির ফেভারিট — অন্যজনের নাম দুখীরাম, (ভুতোরই পুত্র) — সে থাকে সামনের দরজায়, তোর মা তাকে অল্পস্বল্প খাওয়ান তিন বেলা, তাই লিকলিকে চেহারা একটু ফিরেছে"। তাঁর পত্নী, স্বনামধন্যা লেখিকা প্রতিভা বসু, সম্বন্ধে বুদ্ধদেব বসুর যে অপার আস্থা ও তাঁর ক্ষমতার প্রতি বিস্ময়-মিশ্রিত শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে তার উল্লেখ না করলে এই বইটির আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাঁদের নতুন বাড়ি তৈরি নিয়ে লিখছেন "তোর মা বলছেন কয়েকমাসের মধ্যে নাকতলা শেষ হ’য়ে যাবে। কী ক’রে হবে জানি না — টাকা কোথায় — কিন্তু তোর মা-র নানারকম ম্যাজিক জানা আছে"। আরেকটি চিঠিতে তিনি কন্যার কাছে অনুযোগ করছেনঃ "আমার মতে তোর মা-র অনেক বেশী শারীরিক বিশ্রামে, লেখার কাজ নিয়ে থাকা উচিত, কিন্তু জমি, বাড়ি, বাড়ি বাড়ানো এ-সবের দিকে তাঁর ঝোঁক অদম্য, তার ওপর চারদিকে স্নেহজাল বিস্তার ক’রে নিজেকে নানাভাবে বিড়ম্বিত ও উৎকন্ঠিত করেন"।
বুদ্ধদেব বসু শুধু তো স্নেহশীল পিতা বা প্রেমময় স্বামী নন, নাতিনাতনিদের প্রতিও ছিল তাঁর অপার স্নেহ। বড় নাতনির কথা লিখছেন "...একদিন আমি টেবিলে ব’সে ব’সে শুনছি বারান্দায় তিতিরের গলা — ‘ও রুমি, ও রুমি, আমায় চিনবে নাকো তুমি, আমি তোমার পরিমা’"! এ চিঠির বাকিটুকু পড়লে চোখের পাতা ভিজে আসে। তেমনি রুমি তাঁর শিশুপুত্রকে নিয়ে কানপুরে ফিরে গেলে বুদ্ধদেব বসু একটি চিঠিতে লিখছেন তাঁর ‘বল খেলার সঙ্গী’ নাতিটির অভাব অনুভব করার কথা।
রুমির জীবনের নানা ওঠাপড়া ও গবেষণা নিয়ে পিতা চিন্তিত কিন্তু আদর্শ গুরুর মতো গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে কন্যা-শিষ্যাকে তিনি তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেন অনমনীয় ধৈর্যের সঙ্গে ও যথাকালে তাতে সফল-ও হন। কয়েকটি উদাহরণ দিইঃ "...রামানুজনের পেপারটা শেষ ক’রেই হ্বাইস্টাইনের পরীক্ষার জন্য পড়া শুরু কর। তুই যে-খাতাটা আমাকে দেখাতে চেয়েছিলি সেটা যদি এক্সপ্রেস ডাকে পাঠিয়ে দিস আমি যথাকর্তব্য সম্পন্ন করে তক্ষুনি ফেরত দিতে পারবো"। আরেকটি চিঠিতে তিনি লিখছেন "এতোদিনে তুই পরীক্ষা শেষ করে নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছিস, আশা করি। মোটামুটি কেমন হ’লো লিখিস। খুব বেশি ভালো না-হ’লে (কিছু) এসে যায় না — অংশত ভালো হবেই, আমার বিশ্বাস; সাহিত্য বিষয়ে তোর যে স্বাভাবিক বোধ আছে সেটাকে যদি ওঁরা একেবারেই মূল্য না দেন, সেটা তাঁদেরই দোষ, তোর নয়। ..."। কন্যাকে উৎসাহিত করতে একটি চিঠিতে তিনি লিখছেন "তুই কিছুদিন আগে থীসিস বিষয়ে প্রায় নিরাশ হয়ে পড়েছিলি, কিন্তু এবার বোধহয় বিষয়টাকে নতুন করে ভেবে দেখা উচিৎ। ...ইতিমধ্যে বৌদ্ধধর্ম বিষয়ে রাজ্যের বই জোগাড় ক’রে ফেলেছি, যদি বা তোর কাজে লাগে"।
এই বই-এর আরেকটি মূল্যবান অংশ হ’ল দময়ন্তী বসু সিং-এর লেখা মুখবন্ধ, স্মৃতিকথা ও সুপ্রযোজ্য টীকাগুলি। সম্পাদিকা সম্বন্ধে বলি যে এমন যাঁর জীবনবোধ, এতো চমৎকার যাঁর ভাষাজ্ঞান, এমন বিশাল যার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার তাঁর কাছ থেকে আমাদের পাঠককুলের অনেক প্রত্যাশা! তাই দময়ন্তী বসু সিং-এর পিতার মতো আমারও অভিযোগ উনি সাহিত্য সৃষ্টিতে বিশেষ মনোযোগ দেন না ব’লে। সংক্ষিপ্ত স্মৃতিকথায় সম্পাদিকা তাঁর পিতা সম্বন্ধে বলেন "তাঁর দক্ষিণ হস্ত আমার মাথার ওপর থেকে কখনো সরাননি। আমি ভাগ্যবতী"। বইটি শেষ ক’রে ওঁর অনুকরণে আমারও বলতে ইচ্ছে করছে উনি সত্যিই ‘ভাগ্যবতী’।