বিল্টুদের স্কুলের পেছনে একটা বড় পুকুর ছিল, যেখানে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে আসত বেশ কিছু মানুষজন। তাঁদেরই একজন, অলীক সামন্ত, মাছ ধরায় এমন নাম করেছিলেন, লোকে আদর করে ডাকত, ‘বক’। ওই নামকরণে ‘বক’-এর অনুভূতিটা জানা নেই, তবে বিল্টুর মনে হয়েছে, নামকরণটা যথার্থ নয়। কারণ ও নিজে দেখেছে, অলীক সামন্ত যে সমস্ত পেল্লাই মাছ ধরত, তা বকের পক্ষে কখনই সম্ভব নয়।
মাঝে একটা সময় ছিল, যখন কবিতা সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়, এমন লোকের মুখেও শোনা যেত, ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাব’ বা ‘অবনী বাড়ি আছো?’। জীবদ্দশাতেই প্রায় মিথ হয়ে যাওয়া শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার পিছনে লুকিয়ে থাকা ঘামের দাগ নিয়ে কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত লিখেছেন,
“জলপাইগুড়ির ওল্ড পুলিশ লাইন-এ একটা কাঠের বাড়ির একতলায় ভাড়াটে ছিলাম বউ আর দুটো গুঁড়িগুঁড়ি বাচ্চা সমেত। শক্তি রয়ে গেল, এবং মাস চার-পাঁচ থেকেও গেল সেই পয়লা দফায়”। এরপর তিনি লিখেছেন, “এক সকালে খুব ঠাণ্ডা, দেখি শক্তি আমার বারান্দার লাগোয়া ছোট্ট পড়ার ঘরটিতে চুপচাপ বসে। কিছুক্ষণ পর টেবিলে ঝুঁকে পড়ল তার মাথা। পেছনে দাঁড়িয়ে দেখি, অনর্গল লিখে যাচ্ছে। সকাল থেকে গড়িয়ে বেলা একটা-দেড়টা, সে লেখার বিরাম নেই। স্নানাহার বাতিল। মুহুর্মুহু সিগারেট টানছে আর লিখছে। এত ভূততাড়িতের মতো, যে আমি তাকে ঘাঁটালাম না। টেবিলের এক কোণে আমার স্ত্রী সামান্য কিছু খাবার দিয়েছিল, সে তাকিয়েও দেখল না”।
“চন্দ্রমল্লিকার মাংস ঝরে আছে ঘাসে” (‘কোনোদিনই পাবেনা আমাকে’)
চমকে ওঠার মতো লাইন। চন্দ্রমল্লিকার অবয়ব আর তার সঙ্গে ব্যবহৃত শব্দ মাংস একটা আশ্চর্য অনুভূতি তৈরি করে। এই কবিতার শেষদিকে,
“নিভন্ত লন্ঠনদৃশ্যায়নের চূড়ান্ত নমুনা বলা যায়। এ ব্যাপারে অমিতাভ লিখেছেন, “আমার জলপাইগুড়ির বাসাবাড়ির সামনে বেড়ায় ঘেরা একচিলতে উঠোন ছিল। সেখানে প্রচুর সুইট সুলতান, টাইগার লিলি আর চন্দ্রমল্লিকা ফুটত। রাতে প্রায়ই ফিরতে দেরি হত আমাদের, রত্না তাই সামান্য উসকে একটা লন্ঠন বারান্দার কোণে রেখে দিত। এই দুটো ঘটনাকে বন্দী করেছিল শক্তি”।
অস্তিত্ব সজাগ ক’রে বারান্দার কোণ
বসে থাকে”
“এই গ্রাম পর্বতে বাঁধানোপরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে সাধু-চলিতের একসঙ্গে প্রয়োগ। তাতে কিসসু যায় আসেনি। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, মেশাল দিলে তবেই লোহা ইস্পাত হয়। শক্তি সেটা জানত।
এখানে তাহাকে ডেকে আনো” (এই গ্রাম পর্বতে)
লোকে বলে মাছ ধরা একটা নেশার মতো। বিল্টুর মাঝে মাঝে মনে হয়, তারও কি নেশা হয়ে গেল! নইলে রোজ টিফিনের সময় কে তাকে টেনে নিয়ে যায় পুকুরের ধারে, অলীক সামন্তের পিছনে...
“বৃষ্টি নামলো যখন আমি উঠোন পানে একা।
দৌড়ে গিয়ে, ভেবেছিলাম তোমার পাবো দেখা
হয়তো মেঘে-বৃষ্টিতে বা শিউলিগাছের তলে
আজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছো আকাশ-ছেঁচা জলে” (যখন বৃষ্টি নামলো)
এই সহজ-সরল ভালোলাগা লাইনগুলো পড়ে মনে হতেই পারে, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় কেন শক্তির কবিতা নিয়ে তাঁর বন্ধুর ভাগ্নেকে বলেন, “ভালো। কিন্তু সব বুঝতে পারি না”। ওখানেই লুকিয়ে আছে আরো কিছু তথ্য। এই কবিতাটি যে কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ('ধর্মেও আছো জিরাফেও আছো'), সেটি উৎসর্গ করা হয়েছে, “আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্য পাঠকের হাতে”। আধুনিক কবিতায় দুর্বোধ্যতার অভিযোগের উত্তর শক্তি দিয়েছেন দু’ভাবে এবং সরাসরি। এক নম্বরে আছে ওই উৎসর্গ, যেটা এর আগে কেউ কোনোদিন করেন নি, আর ‘হয়তো’ নয়, নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যতেও কেউ করবেন না। আর দু’নম্বরে আছে এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোর সহজবোধ্যতা। উদাহরণ দিয়ে লাভ নেই, বরং দেখি, কবি নিজে কী বলেছেন এই কাব্যগ্রন্থের ব্যাপারেঃ
“আমি খুবই সচেতন ভঙ্গিতে জীবনানন্দকে নিয়েছি। আবার রবীন্দ্রনাথকেও নিয়েছি। 'ধর্মে আছো জিরাফেও আছো'তে রবীন্দ্রনাথের মতো ভাষায় লেখার চেষ্টা করেছি। এর একটা কারণ ছিলো। তখন অনেকেই বলত আধুনিক কবিতা সাধারণের জন্য নয়। ঐ কবিতা বিশেষ গোষ্ঠীর পাঠকদের জন্যই লেখা হচ্ছে। তখন বিষয়ের দিক থেকে নয়, রবীন্দ্রনাথ ধরনের ছন্দ বা ভাষায় একটু সরল করে নেওয়ার কথা চিন্তা করেই লিখেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ থেকে সরে আসতেই হবে। আসলে, কূট ঐ সারল্যের মধ্যেই কোথাও রইল, সেটিকে তোমাকেই ভাঙ্গতে হবে”। (পদ্যবন্ধঃ শারদসংখ্যা ১৩৮৭)।
শেষ লাইনটা বুঝতে হলে এই কাব্যগ্রন্থের 'অবনী বাড়ি আছো'ই যথেষ্ট। সঙ্গে রইল,
“লাইব্রেরির বহু ধাপ খেয়ে গেছে উই
আমরা তবুও কাছে শুই” (ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী)“উত্তর-বাতাসে ভেসে আসে চাঁদ - যেন শেষ ঘুড়ি
ভেঙ্গেছে লাটাই
আমরা ঝিনুকও খুঁজে পাই” (ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী)“ফুটবল খেলার শব্দ হয় উঁচু মাঠে
দূরের দিগন্ত আজো নীল
খেলোয়াড় খেলে যেন অনন্তে হাটে
উদভ্রান্ত দর্শক - মারি ঢিল।
সশস্ত্র ফুটবল, তুই তৃপ্তি পেলি নাকি?
খেলায় হয়েছে রক্তপাত
কিংবা এ-রেফারিহারা খেলা আছে বাকি-
কেঁপে ওঠে রাতের করাত”। (ফুটবল)
অলীক সামন্তের ছিপ আজকে আর বশে থাকছে না। বিল্টু দেখছে। সুতো ছেড়ে, টেনে, কোনোমতেই সামলানো যাচ্ছে না জলের তলার গন্ধমাদনকে। তবে কি আজ মাছের দিন? অলীক সামন্ত হাঁপিয়ে উঠেছেন। এক পা এক পা করে এগোচ্ছেন পুকুরের আরো কাছে। বিল্টু লক্ষ্য করল, অলীক সামন্তের হাতে একটা প্রজাপতি ধরার মতো জাল, সেটা জলে ডুবিয়ে দিয়ে তুলে আনতে চাইছেন দৈত্যাকার মাছটাকে। কাঠের হাতল বেঁকে গেছে। বুঝি আর হল না। দু’ মিনিট পরেই ডাঙায় মাছ, অলীক সামন্তের মুখে প্রজাপতি ওড়ানো হাসি। বিল্টুর এ সময় হঠাৎ বক ছেড়ে পেলিক্যানের কথা মনে পড়ল। শিবরাম চক্রবর্তী বলতেন, আমি মাস-মাইনে তুলি পেলিক্যান পেন দিয়ে সই করে। কারণ টাকা নিতে গেলেই মনে প্রশ্ন জাগে, পেলি ক্যান?
'হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান' কাব্যগ্রন্থ, যে কবিতার নাম নিয়ে হাজির, পড়লে চমৎকৃত হতে হয়।
“হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান ঘুরতে দেখেছি অনেক
তাদের হলুদ ঝুলি ভরে গিয়েছিলো ঘাসে আবিল ভেড়ার পেটের মতন
কত কালের পুরোনো নতুন চিঠি কুড়িয়ে পেয়েছে
এই অরণ্যের পোস্টম্যানগুলি
আমি দেখেছি, কেবল অনবরত ওরা খুঁটে চলেছে
বকের মতো নিভৃতে মাছ” (হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান)
বিদ্বজনেরা বলেন এই কাব্যগ্রন্থ থেকেই অন্য এক শক্তি পূর্ণ শক্তিতে হাজির হন। তাঁর কবিতা তীব্র বাঁক নেয়। কেমন সে বাঁক, দেখা যাক,
“শব্দের বেড়াতে যদি হাত পড়ে তবে যেন নিজের মাথা খাই
কাল-ভোলা মেয়েলিপনা আর আখুটে অভিমান আমায় জোড়া
হাতেই বেঁধেছে আজ
বেশ আছি, শব্দ ভুলে ন্যাংটো
ফুটো ইজেরে হাওয়া খেলছে
বীজ পুঁতে জল সইছি, মাতব্বর ব্যক্তি হে”। (অনেকগুলো শব্দের কাছে)“আমি তোমার ঘরের সেই পাল্লাদুটোর মতন বন্ধ
কেউ আচমকা এলেই ঠোক্কর খাবে
পাল্লার গায়ে লটকানো মন্তব্যঃ আছো কি নেই - ” (আবার একা সেই ঘরের পাল্লাদুটোর জন্য)“সবরমতী আশ্রম কোন দিকে, কোথায় ছিলো?
অন্ধকার ট্যাক্সিতে একটা সবরমতী আশ্রম খোলা যায় না?
আমার কথাটা একটু ভেবে দেখো, শুধু ভাবলেই চলবে না
মন্তব্য প্রকাশ করতে হবে
তোমার ভয় তো ওখানেই
কিছু কবুল করতে চাও না - মনে ভাবো - তোমার মন্তব্যমাত্রেই
রাজ্য ফেঁসে যাবে
ধুন্ধুমার লড়াই লাগবে নদীর দুতীরে -” (সবরমতী আশ্রম কোন দিকে)
উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই।
আমরা কবিতা কেন লিখি, কার/কাদের জন্য লিখি, এ নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলতে গেলেই যেন একটু দ্বিধায় পড়ে যাই। এখানেও শক্তি চট্টোপাধ্যায় অনন্য, তাঁর খোলামেলা চরিত্রের মতোই বল্গাহীন। কী বলেছেন তিনি? “কোনও প্রেরণা নয়, কোনও সনির্বন্ধ ভালোবাসায় না - শুধু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েই এইসব পদ্য লেখা।”
প্রিয় কবি, এমন কথা আপনিই বলতে পারেন। শুধু ঐ “প্রেরণা”র ব্যাপারটায় একমত নই। কী করব, আপনি আছেন যে!