• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Shakti Chattopadhyay | প্রবন্ধ
    Share
  • শক্তিসঙ্গ : অরণি বসু


    লুখড়-এর চারটে সংখ্যা বেরিয়ে গেল অথচ আমার প্রিয় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সেভাবে পরিচয় হল না, একদিন শুধু তাকে দেখেছি ভারবির কাউন্টারে। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র বিখ্যাত সিরিজটা তখন বেরোতে শুরু করেছে। শোনা কথা, এই 'শ্রেষ্ঠ কবিতা' সিরিজের পরিকল্পনাটা না কি শক্তিদারই মস্তিষ্কপ্রসূত। সুব্রতদা (সুব্রত চক্রবর্তী) আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন ইন্দ্রদার (ইন্দ্রনাথ মজুমদার) সঙ্গে। ইন্দ্রদা একদিন সুবর্ণরেখায় ঝড়ের মতো আসা শক্তিদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। দিলেন যখন আর কোনো ছাড়ছুড় নয়। লেখা দেওয়ার জন্য শক্তিদার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। উনিও গা ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিলেন না আমায়। জিগ্যেস করলেন গীতার অনুবাদ চলবে কিনা। তখন গীতার অনুবাদে মন দিয়েছেন। আমরা পাব একাদশ অধ্যায়, তাও ঠিক হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। এবার শুরু হল আসল খেলা। লেখা হাতে পাওয়ার জন্যে আমাদের, বিশেষ করে আমার অধ্যবসায়ের পরীক্ষা। শক্তিদার সঙ্গে দেখা করতে যাই, কখনো দেখা হয় নাকখনো হয়। দেখা হলে লেখা নয় পরে আবার কবে যোগাযোগ করব ঠিক হয়। একদিন বললেন, 'অমুক দিন সকালে চলে এসো। বাড়িতে। সকাল দশটা-সাড়ে দশটা নাগাদ। আশা করছি হয়ে যাবে।' 'হয়ে যাবে'-তে বেশ জোর ছিল। তখন শক্তিদা বন্ডেল রোডে থাকেন। সম্ভবত দেড়তলার ঘরে। আমি সময়মতো হাজির। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঘরে ঢুকে দেখি শক্তিদা দাড়ি কামাচ্ছেন আর তিতির ও তাতার বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। অবশেষে লেখাটা পাব এই উত্তেজনায় আমি টানটান, কিন্তু লেখাটেখার কথা নয়, আমাকে দেখেই শক্তিদা জিগ্যেস করলেন, 'তুমি খেয়ে এসেছ?' আমি জানিয়ে দিলাম জলখাবার খেয়ে এসেছি, বাড়ি গিয়ে ভাত খাব। এখানে একটু অর্ধসত্য ছিল। বুদ্ধদেবদার (বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত) সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল একটা-দেড়টা নাগাদ হাজরার বসুশ্রী কফিহাউসে। একটা জরুরি দরকার ছিল। কথা হয়েছিল আমরা বাইরে কোথাও খেয়ে নেব। শক্তিদা বললেন, ‘মীনাক্ষী আমাদের ভাতটাত খাইয়ে আপিস চলে গেছে। আমার একটু জ্বর-জ্বর হয়েছে, আজ আর আপিস যাব না। তুমি একটু বোসো।' গীতার কোনো কথা নেই। দাড়ি কামানো শেষ করে শক্তিদা বেরোবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছেন। তাতার সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিল আর তিতির বেশ কয়েকটা টফি নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে একের পর এক মুখে পুরছে। শক্তিদা ওকে বললেন 'কাকুকে একটা টফি দাও।' তিতির আমার দিকে একবার উদাসীনভাবে তাকাল কিন্তু পিতৃ-আজ্ঞা পালনে কোনো আগ্রহ দেখাল না। এবার শক্তিদা ওকে বকলেন, তাতেও কোনো কাজ হলনা। এমন সময় ওপরতলা থেকে এক কিশোরী এসে দুটো একশো টাকার নোট শক্তিদার দিকে বাড়িয়ে বলল, 'কাকু কাল আমায় যে বইটা পড়তে দিয়েছিলেন তার মধ্যে এই টাকাটা ছিল’। শক্তিদা খুব ক্যাজুয়ালি 'তাই' বলে টাকাটা গ্রহণ করলেন। মরিয়া হয়ে লেখার কথা তুলতে উনি হাত তুলে অভয় দিলেন। বললাম, 'বেরোবেন না বললেন ....।' উনি বললেন আপিস যাব না বলেছি, একটু কাজে কাছাকাছি যাব। তুমিও চলো। লেখা না পাওয়ায় আমি ক্ষুণ্ণ হলেও তখনই কিংবদন্তী আমার প্রিয় কবি এই মানুষটার ওপর রাগ করে চলেও আসতে পারছি না। বেরিয়ে উনি প্রথমে গেলেন বিখ্যাত বিজ্ঞাপন-প্রতিষ্ঠান 'হিন্দুস্থান টমসন'-এর অফিসে। সেখানে নাকি ওঁর কিছু টাকা পাওনা আছে। ওখানে যেতেই কিছু লোকজন, তাঁরাও সম্ভবত স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিখ্যাত, ওঁকে ঘিরে হৈ চৈ শুরু করলেন। কিছুক্ষণ হাসি-মস্করার পর ওখান থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরলেন। আমাকে উঠতে বললেন। উঠলাম। ড্রাইভারকে ধর্মতলায় যেতে নির্দেশ দিলেন। আমি তো অবাক। আপিস যাবেন না অথচ ধর্মতলায় যাবেন! ধর্মতলাতেই তো আপিস।

    মেট্রো সিনেমার পাশের গলি দিয়ে যে জায়গায় উনি আমায় নিয়ে গেলেন তার নাম আমি পরে জেনেছি। ছোটো ব্রিস্টল। শক্তিদা ঢুকতেই সেখানে রীতিমতো সাড়া পড়ে গেল। কোণের দিকে একটা ছোটো খুপরিতে আমরা বসলাম। শক্তিদা একজনকে ডেকে ওঁকে হুইস্কি না রাম কি যেন দিতে বললেন আর আমাকে দেখিয়ে বললেন, 'ভাই-এর খাওয়া হয়নি ওর জন্যে মেটের তরকারি সেঁকা পাউরুটি আর এক বোতল বীয়ার নিয়ে এসো।' বীয়ারের ব্যাপারে আমি জোর আপত্তি করতে উনি ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলেন, 'তুমি কখনও বীয়ার খাওনি?' আমি উত্তর দিলাম, 'সে এক-আধবার খেয়েছি কিন্তু সুব্রতদা বলে দিয়েছেন অচেনা লোকের সঙ্গে এসব না খেতে।' উনি প্রথমে চোখ ছোটো করে তাকালেন আমার দিকে তারপর হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন, 'উফ্‌! অচেনা লোক! আমি তোমার অচেনা লোক! দাঁড়াও সুব্রতকে দেখাচ্ছি মজা।' খাবার এলো। খেতে খেতে নানারকম কথা হচ্ছে। আমার বাড়িঘরের খোঁজখবর নিলেন। তারপর হঠাৎ জিগ্যেস করলেন, 'সুনীলের কবিতা তোমার কেমন লাগে?' আমি বললাম, 'ভালো — খুব ভালো।' উনি খুশি হয়ে বললেন, 'ঠিক বলেছ। সুনীল বড়ো কবি। অনেকে আমাকে তোষামোদ করার জন্য সুনীলের কবিতা নিয়ে উল্টোপালটা বলে, আমার খুব খারাপ লাগে।' তারপর ওঁর নিজের কবিতা নিয়ে কিছু কথা বললেন। হঠাৎ বললেন, 'জানো একেকদিন মনে হয় নতুন আর কিছু লেখার নেই। সব লেখা হয়ে গেছে আর যা বাংলায় লেখা হয়নি তা অনুবাদে বাংলায় এসে গেছে। তারপর যখন আচমকা ৭/৮ টা কবিতা লিখে ফেলি তখন ভাবি এগুলোতো লেখা বাকি ছিল।' হাসলেন। দরজা জানালা খোলা দরাজ হাসি। আমাকে বললেন, 'লেখালিখির নিয়মিত চর্চা করবে, যখন লেখা আসবে না অনুবাদ করবে। অনুবাদ করতে করতে আবার লেখা এসে যাবে।' খাওয়া শেষ হল। শক্তিদা যতই অভয় দেন আমি এক গ্লাসের বেশি বীয়ার খাইনি। বাইরে বেরিয়ে এসে আমি বললাম, 'আমি একটু হাজরা যাবো বুদ্ধদেবদা বসুশ্রী কফিহাউসে অপেক্ষা করবেন। 'সে কথা শুনে উনি বললেন বুদ্ধদেবদার সঙ্গে ওনারও না কি বিশেষ কোনো দরকার আছে, উনিও আমার সঙ্গে যাবেন। অগত্যা আবার ট্যাক্সি। এবার বসুশ্রী কফিহাউস।

    বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও বুদ্ধদেবদার কোনো হদিশ পাওয়া গেল না। হতাশ হয়ে উঠে পড়লাম আমরা। রাস্তায় নেমে আবার ট্যাক্সি। আমি বাড়ি ফেরার তাল করছি দেখে শক্তিদা আমায় ট্যাক্সির ভিতরে ঢুকিয়ে দিলেন। কে যেন বলেছিল শক্তিসঙ্গেই নেশা হয়ে যায়। আমি তা প্রবলভাবে টের পাচ্ছি। ড্রাইভারকে বললেন কলেজস্ট্রিট। আমাকে বললেন 'চলো ইন্দ্রর দোকানে যাব। দরকার আছে।' যেতে যেতে নানারকম গল্প করতে লাগলেন। ট্যাক্সি পার্ক স্ট্রিট আসতেই উনি ড্রাইভারকে পথ নির্দেশ করতে শুরু করলেন। বড়ো গলি মেজ গলি দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে ট্যাক্সি একসময় এসে পৌঁছল খালাসিটোলা। দুপুরের প্রায় ফাঁকা খালাসিটোলা। অতিথি সৎকার করতে সামনে এসে দাঁড়ালেন বিখ্যাত কালীদা। দুটো গ্লাস আনতে বলতেই আমি তীব্র প্রতিবাদ করলাম। শক্তিদা হতাশা ও বিরক্তি মেশানো গলায় বললেন, 'কী যে করো ! যাও ড্রাইভারকে ডেকে নিয়ে এসো’। পাঞ্জাবি ড্রাইভার এসে সবিনয় জানাল যে গাড়ি গ্যারাজ করার আগে সে দারু খায় না। শক্তিদা ওকে জিগ্যেস করলেন গাড়িতে কোনো বোতল আছে কিনা এবং থাকলে নিয়ে আসতে বললেন। ড্রাইভার দ্রুত পায়ে একটা বোতল আনতে শক্তিদা অবশিষ্ট পানীয় তাতে ঢেলে দিলেন। গ্লাস শেষ করতে করতে কালীদার সঙ্গে আশকথা পাশকথা বলতে বলতে উঠে পড়লেন। এবার সত্যি সত্যিই ইন্দ্রদার দোকানে অর্থাৎ সুবর্ণরেখায় পৌঁছলাম। সুবর্ণরেখায় বসে শক্তিদা আমাকে এক প্যাকেট সিগারেট (চারমিনার?) আর দেশলাই আনতে বললেন। নিয়ে এসে দেখি ইন্দ্রদার কাছ থেকে প্যাডের মতো কিছু নিয়ে কিছু একটা লেখার তোড়জোড় করছেন। আমি ঢুকতেই একটা সিগারেট ধরিয়ে যুৎসই টান দিয়ে আমায় বললেন, 'অরণি, তোর কাছে আমার কী কী বই নেই?' 'তুমি' হঠাৎ বিদায় নিয়েছে বুঝতে পারলাম। আমার সংগ্রহে না-থাকা শক্তিদার বই-এর লিস্ট বলে গেলাম। গীতার অনুবাদ না-পাওয়ার বেদনা অনেকক্ষণ আগেই আমায় ছেড়ে গেছে। এখন এক নতুন উত্তেজনা। শক্তিদা তিনটে চিঠি লিখলেন তিন প্রকাশককে। একটা আনন্দ পাবলিশার্স, একটা বিশ্ববাণী প্রকাশনী আর শেষেরটা সম্ভবত দে'জকে। চিঠি তিনটে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বই নিয়ে নিতে বললেন। সবকটা বই একদিনে নিয়ে বাড়ি ফেরা আমার পক্ষে বেশ ঝামেলার তাই দুটো চিঠি ভবিষ্যতের জিম্মায় রেখে আমি দৌড়ে গিয়ে শুধু আনন্দর বইগুলো নিয়ে এলাম। ফিরে এসে দেখি ইতিমধ্যেই এসে উপস্থিত হয়েছেন কবি পার্থসারথি চৌধুরী যিনি আবার হাওড়া ইম্‌প্রুভমেন্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান। পার্থসারথি চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে শক্তিদা ওঁকে বললেন, 'পার্থ এরা হাওড়া থেকে একটা সুন্দর কাগজ করে উলুখড়,ওদের একটা ফুলপেজ বিজ্ঞাপন দিয়ে দিও।' প্রত্যুত্তরে উনি সরাসরি কিছু বললেন না আমার দিকে তাকিয়ে শুধু একটু হাসলেন। ওমা, কথা নেই, বার্তা নেই হঠাৎ সুব্রতদা বর্ধমান থেকে এসে হাজির। লোকজন বেড়ে যাওয়ায় আমরা দোকান খালি করে ফুটপাথে এসে দাঁড়ালাম। সুব্রতদার উপস্থিতি, অন্তত আমার কাছে, সবসময়েই আনন্দময়। সুব্রতদার সঙ্গে গল্প করছি শক্তিদা আমায় ডাকলেন। পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকা বার করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। বললেন, 'সিগারেট দেশলাই-এর দামটা নিয়ে নে।' আমি কিছুতেই নেব না। তখন আমি খালি ভাবছি কতক্ষণে বাড়ি গিয়ে বইগুলো নিয়ে বসব। শক্তিদা বললেন, 'শোন চাকরি-বাকরি পেলে খবর দিস তখন বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসব। এখন বাপের পয়সায় ফুটুনি করতে হবে না।' অগত্যা। পার্থসারথি চৌধুরীর গাড়ি করে দলবল চলল খালাসিটোলার দিকে। সুব্রতদা প্রথমে চেষ্টা করেছিলেন আমাকেও জড়িয়ে নেওয়ার, পরে সারাদিনের কাণ্ডকারখানা শুনে বাড়িই চলে যেতে বললেন। ওঁরা চলে গেলেন। বুকের কাছে জড়ো করে ধরা নতুন পাওয়া বইগুলো নিয়ে আমি বাড়ির দিকে। একটা রোমাঞ্চকর, ঝোড়ো, স্বপ্নের দিন সন্ধে পেরিয়ে রাত্রির দিকে ঝুঁকে পড়ল।

    গীতার অনুবাদ পেয়েছিলাম দিন দশেক পর। উলুখড়-এর জন্যে হাওড়া ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের বিজ্ঞাপনও।

    প্রথম ঘটনার বেশ কয়েকবছর পরের একদিন। চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি ততদিনে। এই শহরে খুঁজে পেয়েছি প্রেমিকাও। উলুখড়-এর একটা সংখ্যা থেকে পরের সংখ্যার সময়ের ব্যবধান বাড়ছে ক্রমাগত। চাকরি পেলেও সাংসারিক কারণে বেশ অর্থনৈতিক চাপ আছে। চাকরি, প্রেম এবং খুচখাচ কিছু কাজকর্ম আর তার সঙ্গে পত্রিকার চিন্তা নিয়ে দিন কেটে যাচ্ছে কিন্তু লেখালিখি বেশ কমে গেছে। এইরকম এক সময়ে একদিন শেষ-বিকেলে তখন প্রেমিকা এখন স্ত্রী গৌরীকে সঙ্গে নিয়ে দে বুক স্টোরে বই কিনতে গেছি। সেই আদি দে বুক স্টোর যার একটাই মুখ, কাউন্টারে বেশিরভাগ সময়েই সেই পরেশদা। বই কিনতে কিনতে হঠাৎ লক্ষ করলাম ভেতর থেকে বেরিয়ে প্রায় কোনোদিকে না তাকিয়ে শক্তিদা আমাদের পাশের সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন। গৌরী তার আগে শক্তিদাকে কোনোদিন চাক্ষুষ দেখেনি শুধু বাঁশি শুনেছে। আমি ওকে ইশারায় দেখিয়ে অস্ফুটে বললাম, শক্তিদা। পরেশদাও কেন জানি না একটু মুচকি হাসলেন। কয়েক সেকেন্ড পরেই গলির রাস্তা থেকে জলদগম্ভীর স্বরে ডাক, 'অরণি না!' আমি তৎক্ষণাৎ সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম। ওঁর সামনে দাঁড়ানো মাত্রই উনি ডান হাত দিয়ে আমার বাঁ হাত খুব শক্ত করে ধরে বললেন, 'চল্‌'। আমার বেশ অপ্রস্তুত অবস্থা। শক্তিদার মুঠোয় খুব জোর। আমাকে নিয়ে গলি থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, 'চল তোকে নিয়ে যাব, আজ একটা গাড়ি কিনব।' হতভম্ব গৌরী দে’জ-এর কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছে। এবার ক্রমশ ওর মেজাজ চড়বে। শক্তিদাই বা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন কিছু বুঝতে পারছি না। আমি বেশ ঘাবড়ে গেছি। আমার অবস্থা অত্যন্ত অসহায়। শক্তিদা বিশেষ কথা বলছেন না শুধু শক্ত করে আমার বাঁ হাত ধরে আছেন যাতে আমি দৌড়ে পালাতে না পারি। সিগনেট, সংস্কৃত কলেজ পেরিয়ে যখন জালান কলেজের সামনে চলে এসেছি আমরা তখন মরিয়া হয়ে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম ফলত শক্তিদাকেও দাঁড়াতে হল। আমি কাতরভাবে বললাম, 'শক্তিদা, আজ আমায় ছেড়ে দিন। দে'জ-এ আমার বান্ধবী দাঁড়িয়ে আছে।' শক্তিদা হুঙ্কার দিলেন, 'কীসের বান্ধবী?' বান্ধবী কীসের হয় আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। অসহায় ভাবে বললাম, 'অনেক দিনের বান্ধবী'। পাথরও সময় বিশেষে গলে। শক্তিদা চোখ কুঁচকে যেন আমাকে যাচাই করছেন এভাবে জিগ্যেস করলেন, 'বিয়ে করবি?' তখন অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনার কোনো অবকাশ নেই আমার, আমি ঘাড় কাত করে উত্তর দিলাম, 'হ্যাঁ করব।' আশ্চর্য এক লহমায় বজ্রমুষ্টি আলগা হয়ে গেল। হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন, 'যা'। অনেক ঝামেলা ঝঞ্ঝাটের পর গৌরীর সঙ্গে যে শেষপর্যন্ত আমার বিয়ে হল তা বোধহয় অনেকটা শক্তিদা কবুল করিয়ে নিয়েছিলেন বলেই।

    আরেকটা ঘটনার কথা সহসা মনে পড়ে গেল। প্রথম ঘটনার কাছাকাছি সময়েই ঘটেছিল। তখন আমি আর প্রিতম উলুখড়-এর লেখার তদ্বির করতে দুপুর কি বিকেলবেলায় বেরিয়ে পড়তাম। এইভাবে একদিন আনন্দবাজারে শক্তিদার সন্ধানে গিয়ে তাঁকে পেয়েও যাই। তখন উনি সাপ্তাহিক আনন্দমেলার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। লেখা সংক্রান্ত কথা শেষ করে আমরা উঠে পড়ছিলাম কিন্তু শক্তিদা উঠতে দিচ্ছিলেন না। এটা সেটা কথা বলে, প্রশ্ন করে আড্ডা চালু রাখছিলেন এমন সময় বছর ২২/২৩-এর এক সুন্দরী একটা অটোগ্রাফ খাতা নিয়ে শক্তিদার সই সংগ্রহে ঘরে ঢুকে পড়ল। শক্তিদা মেয়েটির দিকে এক ঝলক তাকিয়ে স্বভাবসিদ্ধ স্বাভাবিকতায় সই করে দিলেন তারপর খাতা ও পেন আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন ওই খাতায় আমারও একটা সই-এর জন্যে। আমি তখন কাউকে সই দেওয়ার কথা সুদূর কল্পনাতেও ভাবতে পারি না। ভাবার কথাও নয়। ওই সুন্দর খাতাটি আমার হাতে পড়ায় মেয়েটিও বেশ বিচলিত। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় মেয়েটির দিকে তাকাতে দেখি সে কটমট করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মনে হল আমার সই-এ খাতাটা কলঙ্কিত হলে আমাকে কামড়েও দিতে পারে। আমি দ্রুত খাতাটা ফেরৎ দিই এবং মেয়েটিও আরো দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। শক্তিদার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি পুরো ঘটনাটা উপভোগ করে মুচকি মুচকি হাসছেন। আজও কেউ অটোগ্রাফ চাইলে শক্তিদাকে এবং ওই মেয়েটির আগুনে দৃষ্টির কথা মনে পড়ে।

    কবি হিসেবে আমার খুব ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল, তবে শক্তিদার সঙ্গে সেই অর্থে আমার কোনো মাখামাখি ছিলনা। কিন্তু আমার প্রতি তাঁর সবিশেষ স্নেহের নজর আমার কানে পৌঁছে যেত। 'গল্পকবিতা' উঠে যাওয়ার পর দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তখন কৃত্তিবাস-এ কাজ করে। ও বলত, ‘শক্তিদা এসে তোর লেখা ফাইলের নীচ থেকে তুলে ওপরে করে দেন যাতে পরের সংখ্যাতেই তোর লেখা ছাপা হয়ে যায়’। মণীন্দ্র গুপ্ত তখন এক বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা বার করেন। উনি একদিন বলেছিলেন, শক্তিবাবুর কাছ থেকে এক বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা-র জন্যে অনুমতি নিতে গেলে উনি হঠাৎ জিগ্যেস করেছিলেন ‘অরণি বসুর কবিতা নিয়েছেন?' শক্তিদা নিজেও আনন্দবাজার-এর এক গদ্যে আমার না লেখা নিয়ে শ্লেষমিশ্রিত ভর্ৎসনা করেছিলেন। ছড়ানো গল্পের বাইরে শক্তিদা আমার কাছে এক অন্য মানুষ, পারিবারিক ও স্নেহশীল। অনেক শীত গ্রীষ্ম বর্ষা পেরিয়ে এসেও শক্তিদার এই সামান্য সঙ্গ ভুলে যাওয়া সহজ কাজ নয়।


    ছবি : "বিটুদা" ('শক্তির কাছাকাছি' [সংকলন ও সম্পাদনা- সমরজিৎ ও ইনা সেনগুপ্ত] বই থেকে নেয়া)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments