• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Shakti Chattopadhyay | প্রবন্ধ
    Share
  • বর্ণচোরা শিশু : অরিত্র সান্যাল




    `আহা বেশিদিন বাঁচবো না আমি বাঁচতে চাই না
    কে চাইবে রোদ আচিতা অনল, কে চিরবৃষ্টি ?
    অনভিজ্ঞতা বাড়ায় পৃথিবী, বাড়ায় শান্তি
    প্রাচীন বয়সে দু:খশ্লোক গাইবো না আমি গাইতে চাই না'

    জীবনের প্রথম কবিতার বই `হে প্রেম হে নৈ:শব্দ্য'- তে এমন উচ্চারণ কেন ছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ? যুবক তো আজীবন-ই ছিলেন, কিন্তু তখন বয়সও ছিল অল্প । `অনভিজ্ঞতা বাড়ায় পৃথিবী, বাড়ায় শান্তি' - তাহলে অভিজ্ঞতা কি এযাবৎ তাঁর কাছে ছিল দু:সহ ? কেবল-ই অশান্তির ? এ গ্রন্থের-ই `জরাসন্ধ' কবিতায় তাঁর আমূল আক্ষেপ এই জন্ম-কে নিয়েই ! চেঁচিয়ে উঠছেন - `আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে ।' শুধু এই প্রথম কাব্যগ্রন্থেই নয়, শক্তি এই মৃত্যুচিন্তা-র বীজ বপণ করেছেন তাঁর চারণ ভূমির সমগ্রতে-ই । ছিন্ন বিচ্ছিন্নভাবে । বহু পরে, `অস্ত্রের গৌরবহীন একা' গ্রন্থে উদ্দাম লিরিকে ফিরে আসে এই একই সুর, `কষ্ট হয়' কবিতায় । `আমার ভিতরে কাঁদে / বর্ণচোরা শিশু এসে মৃত্যুর আহ্লাদে...'

    সারা জীবন এই বর্ণচোরা শিশুটি-ই তিনি থেকে গেলেন । আর তার মৃত্যুর আহ্লাদ । একটা কান্না যা উনি আজন্ম টিকিয়ে রাখলেন । কিন্তু কিসের কান্না ? তাঁর সৃষ্টিশীলতার চূড়ান্ত সময়ে ছন্দে, মন্দে, জীবনে, যাপনে, ফুত্কাতরতা নিয়ে সমাজে হয়ে উঠেছিলেন আলোচিত বিষয় - কিন্তু তা সব-ই কি ছিল উপরিতলের ঢেউ ? আসল শক্তি কোনটা ছিলো ? মৃত্যুর চোরা স্রোত ? না এই সজীবতা ? প্রশ্ন ওঠে । `শব্দের আড়ালে কিছু শব্দ ছিলো শিকড়ে জড়িয়ে-'

    এর প্রকৃত উত্তর বা উত্তরে আদলে কোনো ঈঙ্গিত লুকিয়ে আছে শক্তির আড়াই হাজার কবিতায় । আড়াই হাজার কবিতা ! যে কবি একবার বলেন "কী হবে জীবনে লিখে ? এই কাব্য, এই হাতছানি..." সে-ই কবি-ই বিপুল কাব্যভাণ্ডারে সারা জীবন তা হলে কী লিখে গেছেন ? জীবন ছাড়া ? কী অসাধারণ ছিল সে জীবন তাতে মৃত্যুময়তা, মুগ্ধতা, বৈপরীত্য সব-ই ছিল, সব-ই তাঁকে সচল রেখেছিল । যাপনে আপনে মিশে থাকা উদাত্ত একটা চিত্কার - যার মূল স্বরটি ছিল গ্রাম্য, সরল । এই শহরের অনিশ্চয়, ভয়, অস্বস্তি - কোনোদিন তিনি মেনে নিতে পেরেছিলেন কি না সন্দেহ আছে । জীবনে প্রথম কলকাতা এসে - সমস্ত মানুষজন ব্যস্ততা নিয়ে একটি হাঁ মুখে এগোচ্ছে - এ দৃশ্য দেখেছিলেন । আর এই শহুরে জীবনই হয়তো তাঁর কাছে ছিল মৃত্যুর দ্যোতক । এর কিছু জটিলতা, ক্ষুদ্রতা, অন্ধকার - এইসব ।

    এই চিন্তাসূত্র বিবর্তিত হয়েছে । সম্পূর্ণ বদলায়নি । পরবর্তীকালে শক্তি লিখেছেন `মৃত্যুর অমূল চাপ মৃত্যুতেই আছে,' জীবনের শেষ দিককার গ্রন্থ `জঙ্গল বিষাদে আছে'- তে এই যৌনচ্ছ্বাস কি তাহলে মৃত্যুচিন্তার বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন ? `মালবিকা স্তন দাও, দুই স্তনে মাখামাখি করি' - এই অদম্য খিদে মুখোমুখি রাখা মৃত্যুচিন্তার । এই জীবনে অন্তত:, `যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো ?' স্পর্ধা অস্বাভাবিক বা অত্যাশ্চর্য কোনো কিছু নয় । এই কবি-ই তো পারেন হেলায় মৃত্যু স্থগিত রেখে বাত্সল্য রসের বশে ঘরে ফিরে এসে সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খেতে । স্নেহ বা কামনা - জীবন তাঁকে ছেড়ে যায়নি । আজও । উদ্দাম ছন্দে কান পাতলেই শোনা যায় ধক্ধক্‌ শব্দ হচ্ছে ।

    ॥ দুই ॥

    `চাঁদের প্রচ্ছায়া জলে একাকী লুকোনো'
    শক্তি নামটার চারপাশেই একটা ঝলমলে রাজকীয়তা আছে, গড়ে উঠেছে । রাজকীয় আলো, এই মত্ততা, সুরাপান, মাতাল হয়ে ঘরে ফেরা, মধ্যরাত্রির শাসক হিসেবে তাঁর খ্যাতি, আইনভাঙা, লিরিক - আজ সকলই কিম্বদন্তী । এখন এই সমস্ত কিছুর উপস্থিতি এতটাই সরব ও জোরালো যে তা শক্তির কবিতার লেখ্য রূপের-ও অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে । এতটাই দাপুটে কবির ইমেজ যে শক্তির কবিতার পূর্ণাঙ্গ ও সম্পূর্ণ পাঠ - প্রকৃত পাঠ - বোধহয় আজও হওয়া বাকি থেকে গেছে । যে হেঁটে গেছে, তার বড়জোর পায়ের ছাপ নিয়ে আমাদের পরীক্ষা করতে হয় । কিন্তু সে কাঁদছিলো না হাসছিলো, কোন আইন ভাঙছিলো, তার মুখচ্ছিরি কেমন ছিল - এসব তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ সম্পর্কে অবগত থাকলে এই পায়ের ছাপ কে কি আর শুধু পায়ের ছাপ হিসেবেই দেখা যায় ? তীব্রতার সঙ্গে শক্তি এতটাই প্রকাশ্য যে তিনি নিজেই নিজের কাব্য হয়ে গেছেন । কী তিনি করেছেন বলার থেকে কী তিনি হয়েছেন বলাই যথোপযুক্ত । দিনে দিনে এই মিথ্‌ হয়ে ওঠার ফলে যা হয় - শক্তির ক্ষমতার মূল আধার তাঁর প্রথম দিককার গ্রন্থগুলি (বিশেষ করে প্রথম চারটি কবিতার বই তো বটেই) কী ভীষণ ভাবে দাপুটে, ও পৃথক তাঁর জীবনের শেষ দিককার বইগুলির থেকে । তাঁর কবিতা যুগান্তকারী, নতুন । আর কিছু কবিতা কিছু মানে বিপুল সংখ্যক - বিখ্যাত । কবি এটা বুঝতেন ?

    `কেবলি সুগন্ধ ওঠে নষ্ট কিছু ফলে
    আমার যা কিছু স্পষ্ট তাও কেন নেয় না সকলে'
    - উদ্ধৃতিটি মূল্যবান । `ছিন্নবিচ্ছিন্ন' থেকে । শক্তির উত্তাল রোম্যান্টিকতা তছনছ করে দিয়ে চলে যায় । তবে জাত কবির কাছে এটা কোনো বিশেষ কৃতিত্বের কিছু নয় । সবাইকে ধরাশায়ী করতে তাঁর অনুশীলনের ছিটেফোঁটাই যথেষ্ট ।

    শক্তির কাছে কবিতা অবশ্যই ছিল অনুশীলনের বস্তু । বয়:কনিষ্ঠদের প্রতি তাঁর পরামর্শ ছিল - ছন্দ শেখার । একশোটা সনেট চর্চাই, শক্তি মনে করতেন, প্রকৃত দরজা খুলে দিতে পারে কোনো নবীন কবির জীবনে । নিজেকে বারংবার পরীক্ষায় ফেলেও শক্তি শেষ বয়সে নিজের অতিকায় ছায়াটি ছেড়ে বেরোতে পারেন নি, এই অসহায়তা আমরা লক্ষ্য করি ।

    কবিতার সংশোধন নিয়ে শক্তি কোনোকালে বিচলিত ছিলেন কি ? এটি হয়তো তাঁকে স্বত:স্ফূর্ততার শেষ সীমাতে পৌঁছে দিয়েছে । কিন্তু জীবনের শেষের দিকে নির্মাণ কৌশলকে আর গুরুত্ব দেননি । ১৯৬৫ সালের ঘটনা । শক্তি জলপাইগুড়িতে । অমিতাভ দাশগুপ্তের বাড়ি । একদিনে সকাল থেকে রাত - হু হু করে লিখে গেলেন `অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে' । তাঁর জীবনের দীর্ঘতম কবিতা । একেবারে পুস্তক আকারে তা বেরোয় । শ্রী দাশগুপ্ত সাক্ষী ছিলেন সেই অসম্ভব সৃজনের । আর তিনিই দেখেন গোটা কবিতায় খুঁতখুঁতে আঁচড়, কাটাকাটি প্রায় নেই ।

    ছন্দের দিব্যতা ছিলই । তাই বহু কবিতা `তিনি' লিখেছেন বলেই উতরে গেছে । বহু কবিতা - যা নিয়ে ভাবনা চিন্তাও তিনি করেননি । তিনি নিজেকে ভাঙেননি আর ।

    অথচ শুরু তো করেছিলেন ভাঙতে ভাঙতেই । কৃত্তিবাস, হাংরিদের হৈহল্লা, নিজের তুমুল লিরিক - এসবে স্পষ্ট হয় যে ছবি - তাতে এক উদ্দাম বালক বসে আছে - ভাঙায় মশগুল । তিনি ছন্দে ভেঙেছিলেন, নিজের মতো করে, সব অনুশাসন কিন্তু বাঁধা পড়লেন ছন্দ । ছন্দও তো এক প্রতিষ্ঠান । এই ছিল শক্তির শৃঙ্খল । এই ছন্দ । সৃষ্টিশীলতার সময় তিনি ছিলেন তুখড় শৃঙ্খলাপরায়ণ । এই অনুশাসনই তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে ।

    তাঁর কবিতার নির্মাণ বিষয়ে `হে চিরপ্রণম্য অগ্নি' কবিতাটি প্রসঙ্গে তিনি তাঁর কাব্যচর্চার হাকিকত্টি সবার সামনে খোলসা করেন । স্বভাব কবি সম্পর্কে যে চলতি ধারণা তা ভেঙে শক্তি জানান : পথে-ঘাটে যখন তখন তাঁর কবিতা আসেনি । তিনি যখনই গুছিয়ে লিখতে বসেছেন - এসেছে ।

    ॥ তিন ॥

    `তাকে ছন্নছাড়া করে অগ্নির গণ্ডুষ
    মানুষের সব হুঁশ ছেড়ে তাকে পাথর করে'
    কবিতার নাম `পাথর গড়িয়ে পড়ে / গাছ পড়ে বোধে' । এই কবিতাতেই হঠাৎ -

    `-ইন্দ্র, ইন্দ্র, ইন্দ্রনাথ ? প্রতিধ্বনি ফেরে' - চলে আসে পংক্তিটি । ইন্দ্রনাথ ? কে ? বাংলা সাহিত্যের কি সেই ইন্দ্রনাথ যার পুরোটা কেউ কোনোদিন পায়নি । দুর্দম, বিদ্যুত্বাহী, বেপরোয়া যুবক । সঙ্গে ছিল শ্রীকান্ত । তাহলে এই কবিতা কি শরত্চন্দ্রের শ্রীকান্ত আখ্যানের `নৈশ অভিযান' পর্ব ?

    `কেন বা সন্ধান দেবে এলোমেলো হাওয়া ?'
    এখন প্রশ্ন হল শক্তি কে ? ছোটোবেলা থেকে পিতৃহারা, ঈশ্বরে বিশ্বাসী, আস্তিক বালক ? শ্রীকান্তর মতো স্বপ্নভূক ? নাকি দুর্দম । ইন্দ্রনাথের মতো । বা ইন্দ্রনাথ-ই ?

    না কি দুটোই ।
    এর উত্তর কে দেবে ? `শব্দ বড় কম' ।
    `নীরবতা কোথা আছে, কান পেতে শোনো' ।
    কান পাতছি । আর শুনতে পাওয়া যায় জীবন ।

    (পরবাস, জানুয়ারি, ২০১১)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments