• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Rabindranath Tagore | প্রবন্ধ
    Share
  • শান্তিনিকেতনে বাইশে শ্রাবণ ও বৃক্ষরোপণ উৎসব : স্বপনকুমার ঘোষ



    শ্রাবণ মাসের বাইশ তারিখটিকে কি আমাদের বিশেষভাবে মনে পড়ে? বিচ্ছেদের মন কেমন করা এই দিনটিতে আমরা কি যথাযথভাবে মনে রাখি? এই মৌসুমী মাস শ্রাবণ ছিল কবির অতি প্রিয়। বিরহের কাল বর্ষাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এক আশ্চর্য অনুভব।

    পঁচিশে বৈশাখ আমাদের দেশে যত মহা সমারোহে আসে, বাইশে শ্রাবণ কিন্তু যেন ততটা নয়। কিন্তু পঁচিশে বৈশাখ এবং বাইশে শ্রাবণ — এদুটিই আমাদের সহায়সম্বল। ঋষিকল্প অত বিশাল মহাজীবনের আবির্ভাব পৃথিবীতে প্রতিদিন ঘটে না। কবির দীর্ঘ জীবনের সেই অপূর্ব-জীবনসংগীত ধীরে ধীরে এসে থেমে দাঁড়াল এক বাইশে শ্রাবণের দিনে। বাইশে শ্রাবণ — এই দিনটি কবির মহাপ্রয়াণের তাৎপর্য নিয়ে আমাদের জীবনে ফিরে আসে বারবার।

    অঝোর ঝরা শ্রাবণের এমন একটা দিনে রবীন্দ্রনাথ বিদায় নিয়েছিলেন আমাদের কাছ থেকে। আবার ফিরে এসেছে বাইশে শ্রাবণ। আজ আটাত্তর বছর পরেও, সেই বিষাদ সংগীতের মূর্চ্ছনা যেন আমরা আশ্রমের আকাশ-বাতাস ছাড়িয়ে সারা দেশ জুড়ে শুনতে পাই। এখনো বিশেষ করে শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন তথা বোলপুরবাসীদের কাছে এই দিনটির একটি স্বতন্ত্র তাৎপর্য ও মাত্রা আছে।

    তবে একথা স্বীকার করতেই হবে যে, রবীন্দ্রনাথের তিরোধানের পর থেকেই, শান্তিনিকেতনের বুকে কোথায় যেন একটা গভীর বেদনা ছড়িয়ে গেছে। বছরের অন্য সময় সেটি গোপন থাকলেও বাইশে শ্রাবণে তা একেবারে প্রকাশ্য হয়, আমাদের সকলের কাছে বেদনাবিথারী হয়ে ওঠে। বাইশে শ্রাবণ আমাদের সবাইকে বারে বারে ডাক দিয়ে যায়।

    এই দিনটি বিষাদের দিন, আশ্রমগুরু রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি তর্পণের দিন, জীবন ও সৌন্দর্যের সম্মিলনের দিন। এই দিনটি আমাদের কাছেও আত্ম আবিষ্কারের মুহূর্ত। কবিকে নতুন করে পাবার, জানবার সুযোগ হয়।

    পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব আর বাইশে শ্রাবণ তাঁর প্রয়াণ। আবির্ভাব আর তিরোভাব — এই দুয়ের মাঝেই সত্তার বিকাশ ও পূর্ণতা। জন্ম ও মৃত্যু, সূচনা এবং পরিসমাপ্তি — দুইই আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মৃত্যুকে কবি তাই বলেছেন — ‘জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা’। তাঁর জীবনব্যাপী সৃষ্টি শৈলীর সাধনার মধ্য দিয়ে এই চিরসত্যই প্রকাশ পেয়েছে বারবার। রবীন্দ্র প্রতিভার সর্বতোমুখী বিকাশ আমাদের কাছে নিয়তই এক পরম বিস্ময়ের। সাহিত্য, কবিতা চলে জীবন নিয়ে, সেই সঙ্গে মৃত্যুর ছায়া চলে তাঁর সঙ্গী হয়ে। কবির সাহিত্য কর্মের অতি প্রশস্ত আঙিনায় শোক দু:খ ও মৃত্যুচিন্তা নিয়ে বিভিন্ন লেখা দেখতে পাই।

    রবীন্দ্র-কাব্যে জীবনের সম্পর্কে যত কথা বলা আছে, তার চেয়ে মৃত্যুর সম্পর্কে কম কথা বলা হয়নি। কারণ জীবনের কথা আর মৃত্যুর কথা আসলে একই কথা। সবটা নিবিড়ভাবে জড়িয়ে তা হয়ে যায় জীবনেরই কথা। কবিতায়, গানে, নাটকে, প্রবন্ধে, নানান ভাষণ-মালায় আর বিভিন্ন চিঠিপত্রে মৃত্যু সম্পর্কে কবির চিন্তাভাবনা নানানভাবে প্রকাশ পেয়েছে। মৃত্যুর নির্মমতা, অনিবার্যতা, মাধুর্য ও রহস্যকে তিনি নানাভাবে বিভিন্ন দিক থেকে উপলব্ধি করেছিলেন। মৃত্যুতে মানব জীবনের ধ্বংস হয় না। এই কথা কবি অনুভব করেছিলেন তাঁর জীবনের প্রথম দিকে, ‘প্রভাত- সঙ্গীত’ কাব্য রচনার কালের সময়।

    ‘পঁচিশে বৈশাখ চলেছে/ জন্মদিনের ধারাকে বহন করে/ মৃত্যুদিনের দিকে’। রবীন্দ্রনাথ যেমন জীবন অনুভবের বিচিত্র স্রষ্টা, তেমনিই মৃত্যু অনুভবও সেই টানে এসেছে বিচিত্রতায়। জীবন ও মৃত্যু আমাদের চলিষ্ণুতার দুটি পর্যায়। তাই মৃত্যু জীবনের শেষ নয়। প্রাচ্য মতে, মহাকালের ধারায় এ কেবলই একটি রূপান্তর মাত্র। সেকারণে দু:খ, মৃত্যু, বিরহ, বিচ্ছেদ — এসব কিছুর মধ্যেও প্রাণের গতিময় ছন্দকে রবীন্দ্রনাথ সবার ওপরে স্থান দিয়ে গেছেন। সত্তার সত্য যে প্রাণ, মৃত্যু কখনওই নয় — উপনিষদ থেকে এই উপলব্ধি লাভ করেছিলেন।

    জন্ম ও মৃত্যু — সূচনা ও সমাপ্তি দুটিই জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আমাদের জাতীয় জীবনে দুটিই চিরস্মরণীয় — পঁচিশে বৈশাখ ও বাইশে শ্রাবণ। বিশেষ করে এই দুটি দিন আমাদের একান্তভাবে কবির অনুধ্যানে ব্রতী হবার দিন, চিরশুদ্ধির দিন।

    বাইশে শ্রাবণের এই অমৃত বার্তাটিকে রবীন্দ্রনাথ এমন করে আশ্রমবাসীদের মনে গেঁথে দিতে পেরেছিলেন যে, শান্তিনিকেতনে এই দিনে আশ্রমগুরুর স্মৃতিতর্পণ অনন্যসাধারণরূপে স্মরণ করা হয়। এই দিনটি কেবলমাত্র তর্পণের দিন নয়, বৃক্ষরোপণের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণের এক অভিনব পার্বণ।

    পৃথিবীর এই যে মরুবিজয়ী বৃক্ষ, তাকেই রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন ‘আদিপ্রাণ’ হিসেবে। সমস্ত প্রাণীর পূর্বপুরুষ বলে কবির কাছে বৃক্ষবন্দনার মানে ছিল প্রাণের উপাসনা। সেকারণে বাইশে শ্রাবণ সেই প্রাণ বন্দনার, বৃক্ষবন্দনার তাৎপর্যে সমৃদ্ধ হয়ে আছে। শান্তিনিকেতনে সাতাত্তর বছর হয়ে গেল, রবীন্দ্রনাথের তিরোধান দিবস স্মরণ করা হচ্ছে বৃক্ষরোপণ উৎসবের মৃত্যুতিথি মিলিয়ে।

    এখন সারা দেশ জুড়ে বনমহোৎসব এবং সামাজিক বনসৃজনের যে কর্মযজ্ঞ চলছে তার পথিকৃৎ হচ্ছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। বৃক্ষকে ভালোবাসা, প্রকৃতির সঙ্গে আত্মিক অনুভবের নান্দীপাঠ যে শৈশবেই শুরু করা উচিত ছিল তা তিনি নির্ভুলভাবেই বুঝেছিলেন। তাই বৃক্ষরোপণ উৎসবকে তিনি অবশ্য পালনীয় অনুষ্ঠানের অন্তর্গত করে গেছেন।

    শান্তিনিকেতনে প্রথম বৃক্ষরোপণ উৎসবের সূচনা হয়েছিল কবির ৬৪ বছরের জন্মদিনে, ১৯২৫ সালে, ১৩৩২ বঙ্গাব্দের পঁচিশে বৈশাখ। সে-বছর কবির আবাসস্থল উত্তরায়ণের উত্তর দিকের পথের ধারে ‘পঞ্চবটী’ প্রতিষ্ঠাই ছিল রবীন্দ্র জন্মদিন উৎসবের প্রধান অঙ্গ। কবি রোপণ করেছিলেন অশ্বত্থ, বট, বেল, অশোক ও আমলকী — এই পাঁচটি গাছের চারা।

    প্রথম বৃক্ষরোপণ উপলক্ষে রচিত ‘মরু বিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে’ গানটি গাওয়া হয়। সন্ধ্যায় অভিনীত হয় ‘নটীর পূজা’। পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী আশ্রমের প্রথম বৃক্ষরোপণ উৎসব উপলক্ষে একটি শ্লোক রচনা করেন—

    “পান্থানাং পশুনাং পক্ষিনাং চ হিতেচ্ছায়া
    এষা পঞ্চবটী রবীন্দ্রেনেহ রোপিতা।”
    ১৯২৮ সালের ১৪ জুলাই, ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের তিরিশে আষাঢ় শান্তিনিকেতনের গৌরপ্রাঙ্গণে বৃক্ষরোপণ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এর পর সিংহসদনে আয়োজিত এক সভায় কবি তাঁর সাম্প্রতিক রচিত ‘বলাই’ নামক লেখাটি পড়েছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পিতৃ-মাতৃহীন বলাই তার নিঃসঙ্গ জীবনে উদ্ভিদদের সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করিত।

    বৃক্ষরোপণ উৎসব সম্পর্কে ইয়োরোপ প্রবাসী পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে পঁচিশে জুলাই রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে লিখেছিলেন — “তোমার টবের বকুল গাছটাকে নিয়ে অনুষ্ঠানটা হল। পৃথিবীতে কোনো গাছের এমন সৌভাগ্য কল্পনা করতে পার না। সুন্দরী বালিকারা সুপরিচ্ছন্ন হয়ে শাঁখ বাজাতে বাজাতে গান গাইতে গাইতে গাছের সঙ্গে যজ্ঞক্ষেত্রে এল। (বিধুশেখর) শাস্ত্রী মহাশয় সংস্কৃত শ্লোক আওড়ালেন — আমি একে একে ছয়টা কবিতা পড়িলাম।”

    ‘তপতী’ নাটক রচনার কয়েকদিন পর, ১৯২৯ সালের দশই অগাষ্ট বৃক্ষরোপণ উপলক্ষে গান রচনা করেন —

    “আয় আমাদের অঙ্গনে
    অতিথি বালক তরুদল
    মানবের স্নেহ-সঙ্গনে।“
    ১৯৩৬ সালের বাৎসরিক বর্ষামঙ্গল ও বৃক্ষরোপণ উৎসবের আয়োজন হয়েছিল শান্তিনিকেতন আশ্রম ছাড়িয়ে ভুবনডাঙ্গা গ্রামে। সেবারে ভুবনডাঙ্গা গ্রামের বিশাল জলাশয় প্রতিষ্ঠা ছিল বর্ষামঙ্গল উৎসবের একটি বিশেষ অঙ্গ। কবি এই জলাশয়ের ধারে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের চারা রোপণ করেন। সেবারের বর্ষামঙ্গলে কবি-রচিত যে-সব গান গাওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে তিনটি নতুন গান ছিল — ‘চলে ছল ছল নদীধারা নিবিড় ছায়ায়’, ‘আঁধার অম্বরে প্রচণ্ড ডম্বরু’ এবং ‘ঐ মালতীলতা দোলে’।

    ১৯৩৭ সালের ১৪ অগাষ্ট ‘আন্দামান দিবস’-এ শান্তিনিকেতনের নিকটবর্তী সাঁওতাল গ্রামে কবির পৌরোহিত্যে বৃক্ষরোপণ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। পরের বছর ১৯৩৮ সালে বৃক্ষরোপণ উৎসবে কবির বিশেষ আমন্ত্রণে সর্বপল্লী ড. রাধাকৃষ্ণণ উপস্থিত ছিলেন, সন্ধ্যায় ‘পরিশোধ’ নৃত্যনাট্যটি দেখেন।

    ১৯৪০ সালের তেসরা সেপ্টেম্বর শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ ও বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘এসো এসো ওগো শ্যামছায়াঘন দিন’ — এটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের রচিত শেষ বর্ষা সঙ্গীত।

    ১৯৪১ সালের সাতই অগাষ্ট, বাইশে শ্রাবণ কবি প্রয়াত হন। এর মাসখানেক পর কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ বৃক্ষরোপণ করেন। পরের বছর কবি-কন্যা মীরা দেবী ছাতিমতলার কাছে গাছের চারা রোপণ করেছিলেন। ১৯৪২ সাল থেকে বাইশে শ্রাবণের দিনে বৃক্ষরোপণ উৎসব পালিত হচ্ছে।

    বৃক্ষরোপণ যে জীবনবৃক্ষের নব সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে দেয়, তা বারে বারে মনে করিয়ে দেয় এই উৎসব। বাইশে শ্রাবণ কবির মহাপ্রয়াণ নয় — বৃক্ষবন্দনার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে আমাদের ফিরে পাবার দিন।

    ফোটোঃ লেখকের সৌজন্যে প্রাপ্ত


  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments