সংক্ষেপে এবং সরলভাবে বলা যায় — অনুবাদ হল এক ভাষা থেকে ভাববস্তু অক্ষুণ্ণ রেখে অথবা ভাববস্তুর প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখে অন্য ভাষায় রূপান্তর। ‘ভাষা’ শব্দটিকে বিভিন্ন দিক থেকে গ্রহণ করা যায়। এক ব্যক্তির মনোভাব অন্য ব্যক্তির কাছে যে মাধ্যমের সাহায্যে প্রকাশ পায় তা কেবলই ‘শব্দ-ভাষা’ নয়। শরীরের ভাষা — হাত, পা, চোখ ইত্যাদির সঞ্চালনের ভাষা আছে; ধ্বনি ও সুর হল স্বর ও শ্রুতির মিলিত ভাষা; দৃশ্য-ভাষার দৃষ্টান্ত হল ছবি আর ভাস্কর্য। নাটক-চলচ্চিত্র, কাব্যগীতি হল মিশ্র ভাষার শিল্প। পরিস্থিতি-বিশেষে নৈঃশব্দের ভাষাও হয়।
সাহিত্যকে চিত্রে অনুবাদ করবার কয়েকটি সমস্যা আছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘ঝর ঝর বরিষে বারিধারা’। বাক্যটিতে অনেকটাই কিন্তু অনুক্ত আছে পাঠকের কল্পনার জন্য। এ ক্ষেত্রে চিত্রশিল্পীর দায় একটু বেশি। তাঁকে নিজের কল্পনা দিয়েই সৃষ্টি করতে হয়, দর্শকদের কল্পনার ভরসা তিনি একটু কম করতে বাধ্য থাকেন। বৃষ্টি ঝরে। দিনে না রাতে? পাহাড়ে, অরণ্যে, নদীর বুকে না শহরে? অথবা ভাঙা ঘরের চালের ফুটো দিয়ে? একসময় চিত্রশিল্পীকে নির্দিষ্টভাবে পরিবেশটি তুলে ধরতে হত। তারই প্রতিক্রিয়ায় চিত্রকলার জগতে ইমপ্রেশনিজ্ম্-এর ভাবধারা দেখা দেয় উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে — প্রথমে ফ্রান্স-এ, পরে সমগ্র ইউরোপে।
শব্দ-ভাষা আর চিত্র-ভাষা চিরকালই অবিচ্ছিন্ন পারস্পরিক। মানুষের আবিষ্কৃত ‘শব্দ’ ব্যাপারটাই চিত্রগুণসম্পন্ন। ‘সূর্য’ উচ্চারণ করবার সঙ্গেই অন্ধকার ঘরেও মনের মধ্যে সূর্যের ছবি ভেসে ওঠে। যে শব্দগুলিকে বিমূর্ত বলে জানি তারও উচ্চারণে দৃশ্যব্যঞ্জনা সঞ্চারিত হয়। ‘শান্তি’ শব্দটি উচ্চারণ করলে কারও মনে আসতে পারে স্তব্ধ পাহাড়ের ছবি; কারও চোখে ভাসতে পারে শেষশয্যায় শায়িত মানুষ। আবার নিত্যনিরন্ন মানুষ ‘শান্তি’ শব্দে হয়তো মনে মনে দেখবেন একথালা ভাত।
চিত্রভাষায় সাহিত্যের ভাষাকে রূপায়িত করবার অজস্র দৃষ্টান্ত প্রাচীনকাল থেকে চলে এসেছে। দেশি ও বিদেশি পুরাণ, মহাকাব্য, বাইব্ল্, জাতক, বৈষ্ণবীয় সাহিত্য অবলম্বন করে যুগে যুগে ছবি আঁকা হয়েছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে একটা প্রথাসিদ্ধতা থাকে। টেক্সট্গুলিতে আখ্যান এবং চরিত্রসমূহকে যে ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে সেই নির্দেশিকা থেকে যায় শিল্পীর মনে। সীতাকে আঁকা যাবে না উর্বশীর মতো করে। যিশুকে আঁকা যাবে না ক্লাউন-এর মতো।
একালের সাহিত্য থেকে যখন ছবি আঁকবার প্রচলন হল তখন দেখি, যেহেতু নির্দিষ্ট কোনো পরম্পরাবাহী সংস্কার সেই সাহিত্য থেকে গড়ে ওঠেনি, সেজন্য একটি কবিতা থেকে শিল্পীর মনে যে অনুভূতি জেগে উঠেছে তাকেই তিনি ছবিতে রূপ দেন। যেহেতু চিত্র-ভাষা শব্দ-ভাষা নয়, তাই শব্দের প্রতিশব্দ খোঁজবার কাজ চিত্রশিল্পী করেন না। তিনি কেবল কবিতা পাঠের পর তাঁর নিজের উপলব্ধিকে ছবির রেখায় আর রঙে ফুটিয়ে তোলেন।
রবীন্দ্রনাথের কবিতার শিরোনাম আর কবিতার পঙ্ক্তি থেকে এইভাবে অনেক ছবি আঁকা হয়েছে। তারই কিছু পরিচয় এখানে তুলে ধরবার চেষ্টা করব।
যখন এদেশের মুদ্রণশিল্প এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছল যে কাগজের পৃষ্ঠায় ছবি ছাপা যেতে পারে তখন থেকেই বাংলা পত্রিকায় সেই প্রয়াস গ্রহণ করা হয়েছে। ‘স্কুল বুক সোসাইটি’ থেকে ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল ‘পশ্বাবলী’ নামে কিশোরদের জন্য একটি পত্রিকা। পশু-পাখিদের পরিচয় দেওয়া পত্রিকাটির উদ্দেশ্য। প্রতি সংখ্যায় ছাপা হত কোনও একটি প্রাণীর বিবরণসহ একটি কাঠ-খোদাই চিত্র। যদিও এ ছবি সাহিত্যের দৃশ্যরূপ নয়। ছবিগুলিও তখন উন্নত মানের হওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু সেই শুরু। উনিশ শতকের শেষের দিকে ছোটোদের পাঠ্যপুস্তকে এবং ছোটোদের জন্য প্রকাশিত পত্রিকায় ছবি এবং অলংকরণ থাকত। অধিকাংশই সাদা-কালো রঙে আঁকা। রবীন্দ্রনাথের ‘সহজপাঠ’-এর সঙ্গে নন্দলাল বসুর আঁকা ব্লক করা ছবির সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত।
কিন্তু ‘সহজ পাঠ’-এর চিত্রিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৩০-এ। তার অনেক আগে থেকেই বাংলা সাময়িক পত্রে থাকত বিভিন্ন ধরণের পাতা-জোড়া ছবি। উনিশ শতকের একেবারে শেষের দিকে কবিতার নাম ও পঙ্ক্তির ক্যাপশন সহ মুদ্রিত হত ছবি। রবীন্দ্রনাথের কবিতা প্রায়শই হত অবলম্বন। এই রেওয়াজ খুব বেড়ে গেল ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ নোবেল-সম্মান পাবার পর। ১৯২০-র পর থেকে রঙিন ছবিও মুদ্রিত হতে শুরু করল একাধিক প্রথম শ্রেণির পত্রিকায়। রবীন্দ্র-কবিতার পঙ্ক্তি শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করে অনেক ছবি আঁকা হয়েছে। পত্রিকাগুলির মধ্যে প্রধান ছিল ‘ভারতী’, ‘সাধনা’, ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘মাসিক বসুমতী’, ‘বিচিত্রা’। পত্রিকা ছাড়াও বিভিন্ন সংকলন-গ্রন্থে, যেখানে রবীন্দ্রনাথের কবিতা মুদ্রিত হয়েছে সেখানেও এই রীতি দেখা যায়। বিশেষ উল্লেখযোগ্য নরেন্দ্র দেব সম্পাদিত ‘কাব্য দীপালি’ (প্রথম সংস্করণ ১৯২৭, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৩১)। এই সংকলনে অনেক কবির কবিতা সংকলিত হয়েছিল কিন্তু আর্ট পেপার-এ মুদ্রিত রঙিন ছবি ছিল কেবল রবীন্দ্রনাথের কবিতার সঙ্গেই। তখন রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন বইয়ের শোভন সংস্করণ প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। সেই সব বইতেও রঙিন ছবি থাকত।
এখন আমরা দেখে নেব কয়েকজন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পীর আঁকা ছবি। এই ছবিগুলির জন্ম হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে। রবীন্দ্রনাথের ‘শিশু’ কবিতা-সংকলন থেকে গৃহীত সুপরিচিত ‘বীরপুরুষ’ কবিতার ছবি। ক্যাপশন ছিল ইংরেজিতে ‘দ্য হিরো’। একটি বালক ভাবছে — সে তার মা-কে নিয়ে চলেছে। সে তার মা-এর রক্ষক। চলেছে ঘোড়ায় চড়ে বীরদর্পে। —
“তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার 'পরে
টগ্বগিয়ে তোমার পাশে পাশে।"
অশ্বারোহী বালকের ছবি অনেক শিল্পীই যথাযথ আঁকতেন। বালক চলেছে ঘোড়ায় চড়ে। কিন্তু নন্দলাল বসু অনুভব করেছেন শিশুটি সত্যিই তো যাচ্ছে না! সে ভাবছে। এই ছবিতে বালকটির ভাবনাকেই দেখানো হয়েছে। শিল্পীর অসাধারণ কল্পনা ঘোড়ার রূপচিত্রটি। শিশুর খেলাঘরের লাল কাঠের ঘোড়া। সেই ঘোড়াটিকেই সে চেনে। নন্দলালের ছবিতে কবিতার শব্দভাষার অনুসরণ নেই। আছে বালকটির প্রিয় কল্পনার চিত্র ভাষা। শিশুটির মনের মধ্যেই যেন ঢুকে গেছেন তিনি।
আর একটি ছবি। শিল্পী হ. চ. হ। হরিশচন্দ্র হালদার। তিনি ছিলেন ঠাকুরবাড়ির ঘনিষ্ঠ একজন শিল্পী। একেবারে প্রথম যুগে, ১৮৮৫-৮৬-তে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী সম্পাদিত ‘বালক’ পত্রিকায় প্রকাশিত হত তাঁর ছবি। একটি ছবিতে অবলম্বন রবীন্দ্রনাথের ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ কবিতা।
অন্য একটি প্রসঙ্গে আসা যাক। রবীন্দ্রনাথের বহু পরিচিত কবিতা ‘বর্ষামঙ্গল’ (সংকলন : কল্পনা)। এই কবিতাটি নিয়ে অনেক শিল্পীই এঁকেছেন ছবি। একটি ছবি দেখা যাক। —
“কেতকীকেশরে কেশপাশ করো সুরভি,‘বর্ষামঙ্গল’ নামে আরও কয়েকটি ছবি আছে। প্রত্যেকটিতেই সুসজ্জিত নারীর রূপাঙ্কন। কিন্তু কবিতাটি ‘বর্ষামঙ্গল’, সু-বেশা নারীর রূপ তুলে ধরবার কবিতা নয়। সেখানে বর্ষা ঋতু কীভাবে প্রকৃতিতে এক মানুষের মনে ভাব-উচ্ছ্বাসের তরঙ্গ তোলে তারই ভাষা-রূপ প্রকাশিত হয়েছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ‘বর্ষামঙ্গল’ সেদিক থেকে আলোড়িত করে আমাদের মনকে।—
ক্ষীণ কটিতটে গাঁথি লয়ে পরো করবী,
কদম্বরেণু বিছাইয়া দাও শয়নে,
অঞ্জন আঁকো নয়নে।"
রবীন্দ্রনাথের আর একটি কবিতা ‘হৃদয় যমুনা’ (সংকলন : সোনার তরী)। —
"যদি ভরিয়া লইবে কুম্ভ, এসো, ওগো, এসো মোরএই কবিতাটি চিত্রশিল্পীদের বেশ প্রিয় ছিল। অনেকগুলি ছবি আছে। সবগুলি ছবিতেই কলস-সহ নারীর মূর্তি।
হৃদয়নীরে।"
"যদি মরণ লভিতে চাও এসো তবে ঝাঁপ দাওনন্দলাল বসুর ছবিটির ক্যাপশনও হল “যদি মরণ লভিতে চাও”।
সলিলমাঝে”।
আরও বিভিন্ন ধরনের ছবি শিল্পীরা এঁকেছেন রবীন্দ্র পঙ্ক্তির অনুসরণে। ‘ভারতী’ পত্রিকায় গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এঁকেছিলেন ব্যঙ্গ-চিত্র। রবীন্দ্রনাথ একসময় অলস অকর্মন্য বঙ্গবাসীকে নিয়ে কিছু ব্যঙ্গ-কবিতা লিখেছিলেন। যদিও পরে ব্যঙ্গ-কবিতাকে প্রধানত নিজের অনুভবের আধার তিনি করেননি কিন্তু 'কণিকা'-র ছোটো ছোটো কবিতাগুলিতে মানুষের তুচ্ছতা, মিথ্যা অহংকার, আত্মপ্রাধান্যবোধ ইত্যাদিকে কটাক্ষ করে লেখা কবিতাগুলি বহু পরিচিত। 'কণিকা'-র অন্তর্গত সুপরিচিত একটি ছোটো কবিতার একটি পঙ্ক্তি "হাউই কহিল, মোর কি সাহস, ভাই," নিয়ে 'ভারতী' পত্রিকায় ছবি এঁকেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (ভাদ্র, ১৩২৪ বঙ্গাব্দে)।
“ধূপ আপনারে মিলাইতে চাহে গন্ধে,ছবিতে একটি মানবী মূর্তি দেখে প্রথমে মনে হয়েছিল ধূপ ও ধূপের গন্ধের এই ছবিতে কেন নন্দলাল বসুও একটি নারী মূর্তি নিয়ে এলেন। ছবি দেখবার পর আবার কবিতাটি ফিরে পড়লাম। এ-কবিতা ধূপ আর ধূপ-গন্ধের কবিতা নয়। এ কবিতা ভাব ও রূপের সমন্বয়ের কবিতা। রবীন্দ্র-মানসের সমগ্রতা ব্যাপ্ত করে সীমা আর অসীমের যে অবিচ্ছিন্ন সংশ্লেষ — এই কবিতা তারই ভাষ্য।
গন্ধ সে চাহে ধূপেরে রহিতে জুড়ে।
সুর আপনারে ধরা দিতে চাহে ছন্দে,
ছন্দ ফিরিয়া ছুটে যেতে চায় সুরে।"
“ভাব পেতে চায় রূপের মাঝারে অঙ্গ,এই কবিতার চিত্র-অনুবাদে থাকতে হবে ভাব আর রূপ, সীমা আর অসীম — দুই-এর মিলন। ছবিটিতে তা-ই আছে। জল ও আকাশের অনন্ত পটভূমি। নারী মূর্তিটি ঠিক রক্ত-মাংসের জীবন্ত নারীর মতো নয়। নমনীয়তার পরিবর্তে ঋজু দৃঢ়তা। স্থাপত্যের আভাস। নারীর প্রসাধন নেই। যেন একটি ভাস্কর্য। যেন কালো পাথরের ধূপাধার। নন্দলাল বসুর এই ছবিতে একটি ভাস্কর্যের সাবয়বতা থেকে রূপাতীত ধূপ-সুরভি মহাবিশ্বে মিশে যায়। মূর্ততা আর বিমূর্ততার সমন্বয়। 'রূপ পেতে চায় ভাবের মাঝারে ছাড়া।'
রূপ পেতে চায় ভাবের মাঝারে ছাড়া।
অসীম সে চাহে সীমার নিবিড় সঙ্গ,
সীমা চায় হতে অসীমের মাঝে হারা।"
অনুবাদ কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা আছে। আঁদ্রে লেফেভার (Andre Lefevere) লিখেছেন ‘ট্র্যানস্লেটিং পোয়েট্রি : সেভেন স্ট্র্যাটেডিজ অ্যান্ড আ ব্লু প্রিন্ট’ (১৯৭৫) নামের বই। তাঁর মতে সাতরকম পদ্ধতি আছে অনুবাদের। এ বিষয়ে মতান্তরে যাচ্ছি না, কিন্তু তিনি যে ‘ইন্টারপ্রিটেশন’ অনুবাদের কথা বলেছেন তা উল্লেখযোগ্য। মূল কবিতার ভাব-নির্যাস নিয়ে নতুন একটি সৃষ্টি হবে এ-জাতীয় অনুবাদ। কবিতার চিত্র-অনুবাদে অবনীন্দ্রনাথ ও নন্দলাল বসু উভয়েই উৎকৃষ্ট ‘ইন্টারপ্রিটেশন’ অনুবাদের স্বাক্ষর রেখেছেন।
এক প্রতিভাকে বুঝতে হলে আর এক প্রতিভার প্রয়োজন হয়। রবীন্দ্র-কবিতার চিত্র-অনুবাদেও দেখতে পাই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর নন্দলাল বসু রবীন্দ্রনাথকে যেভাবে বুঝেছিলেন অন্য চিত্র-শিল্পীরা ঠিক ততটাই গভীরে সবসময় যেতে পারেননি। তবু চিত্র-অনুবাদের প্রতিটি দৃষ্টান্তই কবিতার ব্যঞ্জনা বিচিত্রতর ব্যাপ্তিতে আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়।
চিত্র-শিল্পী পরিচিতিঃ-
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর -- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১) একজন খ্যাতিমান ভারতীয় চিত্রশিল্পী, নন্দনতাত্ত্বিক এবং লেখক। তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রপৌত্র এবং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় ভ্রাতা গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র ও গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র। পিতামহ ও পিতা ছিলেন একাডেমিক নিয়মের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের শিল্পী। এ সুবাদে শৈশবেই চিত্রকলার আবহে বেড়ে ওঠেন তিনি। ১৮৮১ থেকে ৮৯ পর্যন্ত সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করেন। ৮৯ সালেই সুহাসিনী দেবীর সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৮৯০ এ গড়া রবীন্দ্রনাথের খামখেয়ালি সভার সদস্য হয়ে তিনি কবিতা পড়েছেন, নাটক করেছেন। ১৮৯৬ সালে কোলকাতা আর্ট স্কুলের সহকারী অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম এই মর্যাদা লাভ করেন। ১৯১৩ সালে লন্ডনে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, এবং তিনি ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে সি আই ই উপাধী লাভ করেন। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি-লিট প্রদান করে ১৯২১ সালে। ১৯৪১ থেকে ৪৫ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর আচার্য রূপে দ্বায়িত্ব পালন করেন। চিত্রসাধনের শেষ পর্যায়ে অবনীন্দ্রনাথের শিল্পচিন্তা নতুন মাত্রা লাভ করে। গড়ে তোলেন কুটুম কাটাম – আকার নিষ্ঠ এক বিমূর্ত রূপসৃষ্টি।
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর -- গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬৭-১৯৩৮) ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রপৌত্র। শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ তাঁর অনুজ। সুনয়নী দেবী তাঁর বোন। পিতা গুণেন্দ্রনাথও ছবি আঁকতেন। ছোটবেলায় পড়াশুনা করেছেন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। বাড়িতে শিল্পচর্চার পরিবেশ ছিল। চিত্র রচনায় তিনি যথেষ্ট পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। দেশে-বিদেশে তাঁর চিত্রকলার প্রদর্শনী হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'জীবনস্মৃতি' গ্রন্থের অলঙ্করণ করেন। 'ভারতী', 'প্রবাসী', 'যমুনা', 'বঙ্গবাণী' প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর ছবি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। তাঁর চিত্রের রূপাবয়ব খুব সরলবোধ্য নয় ও কিছুটা কাব্যধর্মী। তিনি কিউবিজম রীতিতে ছবি এঁকেছিলেন। শিল্পশৈলী ছিল মূলত ইউরোপীয় ঘরানার। দেশি ওও বিদেশি রঙ বেশি ব্যবহার করতেন। ফটোগ্রাফিতেও তিনি পারদর্শী ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য চিত্র হল 'চৈতন্যের জন্ম', 'কালবৈশাখী', 'সাতভাই চম্পা' প্রভৃতি। 'ভোঁদড় বাহাদুর' নামে একটি গ্রন্থও রচনা করেন।
চারুচন্দ্র রায় -- চারুচন্দ্র রায় (১৮৯০-১৯৭১)-এর জন্ম মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে। পড়াশুনা প্রেসিডেন্সি কলেজ। ঠাকুরবাড়ির সান্নিধ্য লাভ করেন। যুক্ত ছিলেন চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে। বিভিন্ন সাময়িক পত্রিকায় তাঁর ছবি প্রকাশিত হয়। 'ভারতবর্ষ', 'যমুনা', 'প্রবাসী', 'ভারতী', 'মডার্ণ রিভিউ' পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে ছবি প্রকাশিত হয়। তিনি ব্যঙ্গচিত্র-শিল্পী হিসাবেও খ্যাতি লাভ করেন।
নন্দলাল বসু -- নন্দলাল বসু (১৮৮২-১৯৬৬) ছিলেন বাঙালি চিত্রশিল্পী। নন্দলাল বসুর জন্ম খড়গপুরের মুঙ্গেরে। বাবার নাম পূর্ণচন্দ্র বসু। মাতার নাম ক্ষেত্রমণি। ছেলেবেলা থেকেই তিনি প্রবল উৎসাহের সঙ্গে দেব-দেবীর মূর্তি সহ পুতুল তৈরি করতেন। চিত্রকলার প্রতি তাঁর আকর্ষণ এবং পড়ালেখায় অমনোযোগিতার কারণে এফ, এ পরীক্ষায় পর পর দুবার ফেল করেন। পরে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহায্যে কলিকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তির সুযোগ পান। এখানকার ছাত্র থাকাকালীন তিনি কর্ণের সূর্যস্তব, গরুড়স্তম্ভতলে শ্রীচৈতন্য, কৈকেয়ী, শিবমতি, নৌবিহার প্রভৃতি ছবি এঁকে নিজের প্রতিভার পরিচয় দেন। তিনি কর্মজীবনের শুরুতে পাটনা, রাজগির, বুদ্ধগয়া, বারাণসী, দিল্লী, আগ্রা, মথুরা, বৃন্দাবন, এলাহাবাদ ভ্রমণ করে উত্তর ভারতের শিল্প ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হন। ১৯৪৩ সালে তিনি বরোদার মহারাজের কীর্তিমন্দির অলঙ্কৃত করার দায়িত্ব লাভ করেন। এই কীর্তিমন্দিরের চারিদিকের এবং শ্রীনিকেতন ও শান্তিনিকেতনের দেয়ালচিত্র নন্দলাল বসুকে খ্যাতিমান করে তুলে। ভারতীয় সংবিধানের সচিত্র সংস্করণও নন্দলাল বসু অলংকৃত করেন। তাঁর আঁকা ছোট ছোট ছবিগুলোতেও তাঁর প্রতিভার এবং স্বাতন্ত্রের পরিচয় মেলে। শেষ জীবনে নন্দলাল বসু তুলি-কালি এবং ছাপচিত্রের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হন এবং এক্ষেত্রে সাফল্যের পরিচয় দেন।
পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী -- পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী (১৯০৩ - ?)-র জন্ম বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়। পড়াশোনা সিলেটে এবং কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে। যামিনীপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়ের সান্নিধ্য লাভ করেন। তাঁর ছবির বিষয় পুরাণ ও ইতিহাস। সম্পূর্ণ নিজস্ব অঙ্কনশৈলী। অনেকগুলি সচিত্র গ্রন্থ রচনা করেন। এবং অনেক গ্রন্থের অলঙ্করণ করেন।
হরিশচন্দ্র হালদার -- হরিশচন্দ্র হালদার (? - ?) রবীন্দ্র-রচনার প্রথম অলংকরণ করেন। হরিশচন্দ্র হালদার রবীন্দ্রনাথের লেখনীতে 'হ. চ. হ.' নামে পরিচিত ছিলেন। ঠাকুর পরিবারের ঘরোয়া পত্রিকা 'বালক'-এ তাঁর চিত্র প্রকাশিত হয়। পড়াশুনা ওরিয়েন্টাল সেমিনারি ও বেঙ্গল অ্যাকাডেমিতে। তিনি 'বিসর্জন' ও 'বাল্মীকি প্রতিভা' নাটকের দৃশ্য-সজ্জা করেন। 'কালাপাহাড়' নামে একটি নাটকও লিখেছেন। সেই সঙ্গে নাটকে অভিনয়ও করেছেন।
হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার -- হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার (১৮৯৪ - ১৯৪৮) বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহের গচিহাটা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। পিতা দুর্গানাথ মজুমদার। মাতা গঙ্গাময়ী দেবী। পড়াশোনা ময়মনসিংহের সিটি স্কুলে। পরে কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। চিত্রচর্চা শুরু করেন রণদা গুপ্তের 'জুবিলি আর্ট স্কুল'-এ। বিভিন্ন সাময়িকপত্রে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশহিত হয় তাঁর চিত্রকলা। জল রঙ, তেল রঙ, প্যাস্টেল, চক প্রভৃতির মাধ্যমে তাঁর চিত্ররচনা। সেই সঙ্গে ছিলেন প্রতিকৃতি-চিত্রকরও। তাঁর বেশহির ভাগ ছবি নারী দেহাশ্রিত। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন 'ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব আর্ট' নামে একটি চারুকলা সংস্থা। তাঁর উল্লেখযোগ্য চিত্রগুলি হল 'স্মৃতি', 'রূপের মোহ', 'পরিত্যক্তা', 'পরিণাম', 'রূপ', 'রবীন্দ্রনাথ', 'পল্লীশ্রী' এবং 'পল্লীপ্রাণ' প্রভৃতি।