'ইহার মাথা মুড়াইয়া, ঘোল ঢালিয়া, কুলার বাতাস দিয়া গ্রামের বাহির করিয়া দিব।'
'ওর গোষ্ঠীর মুণ্ড কর্বে। একালের ছেলেপুলে বড় বেহায়া হয়ে উঠেছে। রহ ছুঁচো। আমিও তোর উপর এক চাল চালিব।"
'যাহা হউক, দিনকতক বড় হাঙ্গামা গেল। হরলাল শ্রাদ্ধাধিকারী, আসিয়া শ্রাদ্ধ করিল। দিনকতক মাছির ভনভনানিতে, তৈজসের ঝন-ঝনানিতে, কাঙ্গালের কোলাহলে, নৈয়ায়িকের বিচারে, গ্রামে কান-পাতা গেল না। ... ছেলেগুলা মিহিদানা সীতাভোগ লইয়া ভাঁটা খেলাইতে আরম্ভ করিল : মাগিগুলা নারিকেল তৈল মহার্ঘ দেখিয়া, মাথায় লুচিভাজা ঘি মাখিতে আরম্ভ করিল গুলির দোকান বন্ধ হইল, সব গুলিখোর ফলাহারে, মদের দোকান বন্ধ হইল, সব মাতাল, টিকি রাখিয়া নামাবলী কিনিয়া, উপস্থিত পত্রে বিদায় লইতে গিয়াছে।
সর্বদাই হু হু করে মন,
বিশ্ব যেন মরুর মতন।
চারিদিকে ঝালাফালা,
উ: কি জ্বলন্ত জ্বালা,
অগ্নিকুণ্ডে পতঙ্গ পতন।
"ছড়াগুলি ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশ হইতে স.গ্রহ করা হইয়াছে এইজন্য ইহার অনেকগুলির মধ্যে বাংলার অনেক উপভাষা লক্ষিত হইবে। একই ছড়ার অনেকগুলি পাঠও পাওয়া যায় তাহার মধ্যে কোনোটিই বর্জনীয় নহে। কারণ ছড়ায় বিশুদ্ধ পাঠ বা আদিম পাঠ বলিয়া কিছু নির্ণয় করিবার উপায় অথবা প্রয়োজন নাই। কালে কালে মুখে মুখে এই ছড়াগুলি এতই জড়িত মিশ্রিত এবং পরিবর্তিত হইয়া আসিতেছে যে, ভিন্ন ভিন্ন পাঠের মধ্য হইতে কোনো একটি বিশেষ পাঠ নির্বাচিত করিয়া লওয়া সংগত হয় না। ...ইহারা অতীত কীর্তির ন্যায় মৃতভাবে রক্ষিত নহে। ইহারা সজীব, ইহারা সচল ইহারা দেশকাল-পাত্রবিশেষে প্রতিক্ষণে আপনাকে অবস্থার উপযোগী করিয়া তুলিতেছে। ছড়ার সেই নিয়ত পরিবর্তনশীল প্রকৃতিটি দেখাইতে গেলে তাহার ভিন্ন ভিন্ন পাঠ রক্ষা করা আবশ্যক।"
(ছেলেভুলানো ছড়া ২, রচনাকাল ১৩০২)
"গাছের শিকড়টা যেমন মাটির সঙ্গে জড়িত এবং তাহার অগ্রভাগ আকাশের দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, তেমনি সর্বত্রই সাহিত্যের নিম্ন-অংশ
স্বদেশের মাটির মধ্যেই অনেক পরিমাণে জড়িত হইয়া ঢাকা থাকে তাহা বিশেষরূপে সংকীর্ণরূপে দেশীয়, স্থানীয়। তাহা কেবল দেশের
জনসাধারণেরই উপভোগ্য ও আয়ত্তগম্য,...। যে অংশ আকাশের দিকে আছে তাহার ফুল ফল-ডালপালার সঙ্গে মাটির নীচেকার শিকড়গুলার
তুলনা হয় না - তবু তত্ত্ববিদ্দের কাছে তাহাদের সাদৃশ্য ও সম্বন্ধ কিছুতেই ঘুচিবার নহে।"
(গ্রাম্য সাহিত্য, রচনাকাল ১৩০৫)
মুঠো মুঠো, ঝুড়ি ঝুড়ি, বস্তা বস্তা - বহুত্ববাচক
টাটকা টাটকা, গরম গরম, ঠিক ঠিক - প্রকর্ষবাচক
আগে আগে, তলে তলে, পেটে পেটে - সংলগ্নতা বাচক
পড়ো পড়ো, ভরা ভরা, ফাঁকা ফাঁকা - ঈষৎ অসম্পূর্ণতার ভাববাচক
বোঁচকা-বুঁচকি, গোলা-গুলি, গুঁড়ো গাঁড়া, দড়া-দড়ি - ছোটো ও বড় মিলিয়ে সমগ্রতা বাচক।
১) ভূত হয়ে দেখা দিল
বড়ো কোলাব্যাঙ -
এক পা টেবিলে রাখে,
কাঁধে এক ঠ্যাঙ।
২) টাকা সিকি আধুলিতে
ছিল তার হাত জোড়া
সে সাহসে কিনেছিল
পান্তোয়া সাত ঝোড়া।
ফুঁকে দিয়ে কড়াকড়ি
শেষে হেসে গড়াগড়ি
ফেলে দিতে হল সব
আলু ভাতে পাত-জোড়া।
৩) দিন চলে না যে, নিলেমে চড়েছে
খাটি-টিপাই।
ব্যাবসা ধরেছি গল্পেরে করা
নাট্টিফাই।
ক্রিটিক মহল করেছি ঠাণ্ডা,
মুর্গি এবং মুর্গি-আণ্ডা
খেয়ে করে শেষ, আমি হাড় দুটি
চারটি পাই-
ভোজন ওজনে লেখা করে দেয়
সোনামুগ সরুচাল সুপারি ও পান,
ও হাঁড়িতে ঢাকা আছে দুই-চারিখান
গুড়ের পাটালি কিছু ঝুনা নারিকেল,
দুই ভাণ্ড ভালো রাই সরিষার তেল,
আমসত্ত্ব আমচুর, সের দুই দুধ
এই-সব শিশি কৌটা ওষুধ বিষুধ।
মিষ্টান্ন রহিল কিছু হাঁড়ির ভিতরে,
মাথা খাও, ভুলিয়োনা, খেয়ো মনে করে।
১) কেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে -
ভাই বলে ডাকো যদি দেব গলা টিপে
হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা
কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা ॥
২) সাতাশ হলে না কেন একশ সাতাশ-
থলিটি ভরিত, হাড়ে লাগিত বাতাস।
সাতাশ কহিল - তাতে টাকা হত মেলা।
কিন্তু কি করিতে বাপু বয়সের বেলা ॥
যখন শুনালে কবি, দেবদম্পতিরে
কুমারসম্ভব গান, চারিদিকে ঘিরে
দাঁড়ালো প্রমথগণ। শিখরের পর
নামিল মন্থরশান্ত সন্ধ্যামেঘস্তর -
('কুমারসম্ভব গান', চৈতালি)
কেন তবে কেড়ে নিলে লাজ-আবরণ।
হৃদয়ের দ্বার হেনে বাহিরে আনিলে টেনে
শেষে কি পথের মাঝে করিবে বর্জন ॥
('ব্যক্ত প্রেম', মানসী)
কেউ বা তোমায় ভালবাসে
কেউ বা বাসতে পারে না যে,
কেউ বিকিয়ে আছে, কেউ বা
সিকি পয়সা ধারে না যে-
কতকটা বা সে দোষ তাদের,
কতকটা বা তোমারো ভাই-
কতকটা এ ভবের গতিক
সবার তরে নহে সবাই।
তোমার মাপে হয়নি সবাই,
তুমিও হওনি সবার মাপে,
তুমি মরো কারো ঠেলায়
কেউ বা মরে তোমার চাপে
ভেসে থাকতে পারো যদি,
সেইটে সবার চেয়ে শ্রেয়-
না পারো তো বিনা বাক্যে
টুপ করিয়া ডুবে যেও
সেটা কিছু অপূর্ব নয়,
ঘটনা সামান্য খুবই-
শঙ্কা যেথায় করে না কেউ
সেই খানে হয় জাহাজডুবি।
".... 'জলিফলি ছাড়া
চেত্লার হাট থেকে টালার জলের কল আজ
এমন কী হত জাঁহাবাজ ?
ভিখারিকে একটি পয়সা দিতে ভাসুর ভাদ্র বৌ সকলে নারাজ।'
বলে তারা রামছাগলের মতো রুখু দাড়ি নেড়ে
একবার চোখ ফেলে মেয়েটির দিকে
অনুভব করে নিল এইখানে চায়ের আমেজে
নামায়েছে তার এক শাঁকচুন্নিকে।"
(লঘু মুহূর্ত, সাতটি তারার তিমির)