• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Rabindranath Tagore | প্রবন্ধ
    Share
  • রবীন্দ্রনাথ : চলিত শব্দ : ভাবনায় ও কবিতায় : সুমিতা চক্রবর্তী

    'বালক' পত্রিকার পৌষ, ১২৯২ সংখ্যায় পাঠকদের উদ্দেশ্যে ছিল একটি পুরস্কার ঘোষণা। আমরা আগে ঘোষণাটি দেখি - "পাঠকদের প্রতি : বালকের যে-কোনো গ্রাহক 'হুজুগ', 'ন্যাকামি' ও 'আহ্লাদে' শব্দের সর্বোত্কৃষ্ট সংক্ষেপ সংজ্ঞা লিখিয়া পৌষ মাসের ২০শে তারিখের মধ্যে আমাদিগের নিকট পাঠাইবেন তাঁহাকে একটি ভালো গ্রন্থ পুরস্কার দেওয়া হইবে। একেকটি সংজ্ঞা পাঁচ পদের অধিক না হয়।"

    তিনটি অত্যন্ত চলিত, কথা শব্দের সংজ্ঞা নির্ধারণের এই পরিকল্পনাটি রবীন্দ্রনাথের কিনা তা নি:সংশয়ে বলা যাবে কিনা জানি না। শব্দ তিনটির নির্বাচন রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন কিনা তা-ও জানবার উপায় নেই, কিন্তু মনে হয়, সে সম্ভাবনা যথেষ্ট প্রবল। কারণ 'বালক'-এর সম্পাদক যদিও ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী তবু রবীন্দ্রনাথ যে পত্রিকাটির পরিচালনা-ব্যাপারে বউদিদিকে যথেষ্ট সাহায্য করতেন তার প্রমাণ আছে অনেক। প্রতিটি সংখ্যায় তাঁর লেখাও থাকত প্রচুর, সম্পাদকীয় দায়িত্বও অনেকটা পালন করতেন তিনি। ফাল্গুন, ১২৯২-এর 'বালক'-এ এই তিনটি শব্দের সংজ্ঞা নির্ধারণ প্রসঙ্গে সিদ্ধান্তে আসবার সময়ে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন 'সংজ্ঞাবিচার' নামক রচনাটি। এর থেকে অনুমিত হয় - হয়তো 'হুজুগ', 'ন্যাকামি', আর 'আহ্লাদে' শব্দগুলির নির্বাচনও তাঁরই।

    বাংলা ভাষা যখন প্রথম লিখিত আকার পেতে শুরু করেছে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে - তখন স্পষ্টতই তার গতি ছিল দ্বিমুখী। একদিকে সংস্কৃত অনুসারী, তত্সম শব্দবহুল, অনেকটা সংস্কৃত ব্যাকরণেরও অনুগামী ভারি ধরনের বাংলা অন্যদিকে ব্যঙ্গ-তির্যক, কৌতুক ভঙ্গিপ্রধান, চলিত ও দেশজ শব্দবহুল, কিছুটা স্ল্যাং শব্দ অধ্যুষিত ভাষা। একটি ধারায় মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার তারাশঙ্কর তর্করত্ন প্রমুখের রচনার নিদর্শন পাই অপর ধারাটি ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলম ধরে প্যারীচাঁদ মিত্র ও কালীপ্রসন্ন সিংহের 'আলালি' ও 'হুতোমি' ভাষায় পরিণত হল আরো কিছুকাল পরে। বঙ্কিমচন্দ্র রক্ষণশীল সংস্কৃত পণ্ডিতদের ভাষা গ্রহণ করলেন না, আবার 'আলালি' ভাষাও বর্জন করলেন। তাঁর হাতে যে-ভাষা বাংলা কথা-সাহিত্যের ভাষা রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল তা ঐশ্বর্যময় অথচ শ্রুতিমধুর, তত্সম শব্দ প্রধান অথচ স্বচ্ছন্দ গতিবেগসম্পন্ন, কখনো মেঘমন্দ্রের মতো গম্ভীর অথচ মোহন, কখনো নদীস্রোতের মতো কল্লোলময়। সেই ভাষাতেই সাহিত্যের পঠন ও লিখনে দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে যেতে লাগলেন বাঙালি পাঠক ও লেখককূল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সেই বঙ্কিম-অনুরাগী সাহিত্যিকদের অগ্রগণ্য।

    কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের পাঠকেরা জানেন কত সহজে তিনি তদ্ভব ও দেশজ শব্দ - সেইসঙ্গে প্রাত্যহিক বাগ্ভঙ্গির স্বাভাবিকতা তত্সম শব্দবহুল সাধু বাংলার সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারতেন। আমরা কয়েকটি মাত্র উদাহরণ দেব 'কৃষ্ণকান্তের উইল' উপন্যাসটি থেকে।

    'ইহার মাথা মুড়াইয়া, ঘোল ঢালিয়া, কুলার বাতাস দিয়া গ্রামের বাহির করিয়া দিব।'

    'ওর গোষ্ঠীর মুণ্ড কর্বে। একালের ছেলেপুলে বড় বেহায়া হয়ে উঠেছে। রহ ছুঁচো। আমিও তোর উপর এক চাল চালিব।"

    'যাহা হউক, দিনকতক বড় হাঙ্গামা গেল। হরলাল শ্রাদ্ধাধিকারী, আসিয়া শ্রাদ্ধ করিল। দিনকতক মাছির ভনভনানিতে, তৈজসের ঝন-ঝনানিতে, কাঙ্গালের কোলাহলে, নৈয়ায়িকের বিচারে, গ্রামে কান-পাতা গেল না। ... ছেলেগুলা মিহিদানা সীতাভোগ লইয়া ভাঁটা খেলাইতে আরম্ভ করিল : মাগিগুলা নারিকেল তৈল মহার্ঘ দেখিয়া, মাথায় লুচিভাজা ঘি মাখিতে আরম্ভ করিল গুলির দোকান বন্ধ হইল, সব গুলিখোর ফলাহারে, মদের দোকান বন্ধ হইল, সব মাতাল, টিকি রাখিয়া নামাবলী কিনিয়া, উপস্থিত পত্রে বিদায় লইতে গিয়াছে।


    বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় চলিত শব্দ ও বাগ্ভঙ্গির বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের মধ্যে আমরা এখানে যাবো না। কেবল এটুকু বলার জন্যেই এই উত্পাদন - রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যভাষার যে আদর্শ সামনে রেখে সাহিত্যরচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন সেখানে মসৃণ সাধুভাষাই প্রধানত আকল্প রূপে গৃহীত হলেও চলিত শব্দাবলী ও বাগ্ভঙ্গির প্রবেশ সেখানে নিষিদ্ধ ছিল না - বরং বিষয়ানুরোধে তাদের বেশ সমাদৃত স্থানই ছিল। 'আলালি' ও 'হুতোমি' ভাষার জনপ্রিয়তার কথাও এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে।

    বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন উপন্যাস। যাঁর কাব্যরচনা সেই পর্বে তরুণ রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিল তিনি কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী। 'অবোধবন্ধু' পত্রিকায় বিহারীলালের কবিতা পাঠ করে রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল 'আধুনিক বঙ্গসাহিত্যে এই বোধহয় কবির নিজের কথা।" (বিহারীলাল, আধুনিক সাহিত্য) এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের চয়িত সেই বিহারীলালের রচনাখণ্ডটি হল -


    সর্বদাই হু হু করে মন,
    বিশ্ব যেন মরুর মতন।
        
    চারিদিকে ঝালাফালা,
         উ: কি জ্বলন্ত জ্বালা,
    অগ্নিকুণ্ডে পতঙ্গ পতন।


    এই অংশটি রবীন্দ্রনাথের ভালো লেগেছিল। সেই সঙ্গেই তিনি একথাও বলেছিলেন - 'তখনকার বাংলা গদ্যে সাধুভাষার অভাব ছিল না, কিন্তু ভাষার চেহারা ফোটে নাই।' (পূর্বোক্ত প্রবন্ধ)। তাহলে সম্পূর্ণরূপে 'সাধুভাষা' নয় বলেই রবীন্দ্রনাথ ঐ নির্দিষ্ট কবিতাংশের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন - এই সিদ্ধান্তও কিছু যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়। 'ঝালাফালা'-র মত একান্ত প্রচলিত দেশোদ্ভূত শব্দ এবং 'উ:' আর 'হু হু '-র মতো ধ্বনি-প্রধান অভিব্যক্তি - যার বোধগম্যতা কেবল প্রাত্যহিক ভাববিনিময়ের ক্ষেত্রেই অর্থব্যঞ্জক হয়ে ওঠে - তা আমরা বিহারীলাল রচিত কবিতাংশে দেখতে পাচ্ছি। বিহারীলালের কবিতার ধারাবাহিক অনুসরণেও আমরা দেখতে পাই যে সহজ, দেশজ, প্রচলিত, প্রাত্যহিক শব্দ ও ক্রিয়াপদ ধ্বন্যাত্মক অভিব্যক্তি ও বাগ্ধারা প্রয়োগে সর্বদাই স্বচ্ছন্দ ছিলেন তিনি - যদিও তাঁর কবিতার ভাষা-কাঠামোটি ছিল 'কাব্যিক' এবং মূলত তত্সম শব্দাবলীর উপরই নির্ভরশীল।

    ভাষা ও সাহিত্যিক অভিব্যক্তির ক্ষেত্রে দেশজ উপাদানের প্রতি রবীন্দ্রনাথের কি অপরিসীম আগ্রহ ও সুগভীর প্রীতি ছিল তার আরো একটি প্রমাণ পাওয়া যায় লোকসাহিত্য গ্রাম্যসাহিত্য ও ছেলেভুলোনো ছড়া সম্পর্কে তাঁর ভাবনাচিন্তায়। বাংলার গ্রামগুলির সঙ্গে যখনই তাঁর পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়েছে তখন থেকেই তিনি টান অনুভব করেছেন গ্রামীণ ভাষায় রচিত এই সাহিত্যকৃতিগুলির প্রতি। চলিত শব্দবহুল বাংলার বাউলগান, শাক্ত সঙ্গীত - বিশেষত রামপ্রসাদী গানও রবীন্দ্রনাথের খুবই প্রিয় ছিল। বিভিন্ন লেখায় তার বহুল প্রমাণ রয়েছে। সেই প্রীতি কেবল ভালো লাগাতেই থেমে থাকেনি, নিজের সময় ব্যয় করে রবীন্দ্রনাথ এই গ্রামীণ সাহিত্যের নিদর্শন সংকলন করেছিলেন। তাঁর আগে এ কাজ করতে এগিয়ে এসেছেন বলে আর কাউকে সহজে মনে করতে পারি না। যে-সব প্রবন্ধ তিনি গ্রামীণ সাহিত্য বিষয়ে লিখেছিলেন সেগুলি থেকে চলিত ও গ্রামীণ ভাষা সম্পর্কে তাঁর মনোভাবটি দেখা যেতে পারে। -


    "ছড়াগুলি ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশ হইতে স.গ্রহ করা হইয়াছে এইজন্য ইহার অনেকগুলির মধ্যে বাংলার অনেক উপভাষা লক্ষিত হইবে। একই ছড়ার অনেকগুলি পাঠও পাওয়া যায় তাহার মধ্যে কোনোটিই বর্জনীয় নহে। কারণ ছড়ায় বিশুদ্ধ পাঠ বা আদিম পাঠ বলিয়া কিছু নির্ণয় করিবার উপায় অথবা প্রয়োজন নাই। কালে কালে মুখে মুখে এই ছড়াগুলি এতই জড়িত মিশ্রিত এবং পরিবর্তিত হইয়া আসিতেছে যে, ভিন্ন ভিন্ন পাঠের মধ্য হইতে কোনো একটি বিশেষ পাঠ নির্বাচিত করিয়া লওয়া সংগত হয় না। ...ইহারা অতীত কীর্তির ন্যায় মৃতভাবে রক্ষিত নহে। ইহারা সজীব, ইহারা সচল ইহারা দেশকাল-পাত্রবিশেষে প্রতিক্ষণে আপনাকে অবস্থার উপযোগী করিয়া তুলিতেছে। ছড়ার সেই নিয়ত পরিবর্তনশীল প্রকৃতিটি দেখাইতে গেলে তাহার ভিন্ন ভিন্ন পাঠ রক্ষা করা আবশ্যক।"

    (ছেলেভুলানো ছড়া ২, রচনাকাল ১৩০২)


    এই অংশটি থেকে বাংলার গ্রামীণ সাহিত্যের ভাষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারাটি যদি আমরা কিছুটা সূত্রাকারে সাজাই তাহলে কয়েকটি নির্দিষ্ট বক্তব্য পাবো। -

    (১) অনির্দেশ্যভাবে গ্রামীণ ভাষা নয়, আঞ্চলিক উপভাষার বৈশিষ্ট্যও রক্ষণযোগ্য বলে মনে করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
    (২) মৌখিক ভাষা সর্বদাই গতিশীল ও বিবর্তন-প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে তা চলতে থাকে।
    (৩) এই বিবর্তনশীলতা সচলতা ও সজীবতারই লক্ষণ।
    (৪) মুখের ভাষা অবস্থা-অনুসারে নিজেকে বদ্লে নিতে সক্ষম।

    এখান থেকে একথা স্পষ্টই বোঝা যায় যে, রবীন্দ্রনাথের মনে গ্রামীণ তথা দেশজ মৌখিক বচন ও বাচন সম্পর্কে কোনো অশ্রদ্ধার বা করুণার ভাব একেবারেই ছিল না। তিনি দেশজ, প্রচল ভাষার শক্তির উপর পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।


    "গাছের শিকড়টা যেমন মাটির সঙ্গে জড়িত এবং তাহার অগ্রভাগ আকাশের দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, তেমনি সর্বত্রই সাহিত্যের নিম্ন-অংশ
    স্বদেশের মাটির মধ্যেই অনেক পরিমাণে জড়িত হইয়া ঢাকা থাকে তাহা বিশেষরূপে সংকীর্ণরূপে দেশীয়, স্থানীয়। তাহা কেবল দেশের
    জনসাধারণেরই উপভোগ্য ও আয়ত্তগম্য,...। যে অংশ আকাশের দিকে আছে তাহার ফুল ফল-ডালপালার সঙ্গে মাটির নীচেকার শিকড়গুলার
    তুলনা হয় না - তবু তত্ত্ববিদ্দের কাছে তাহাদের সাদৃশ্য ও সম্বন্ধ কিছুতেই ঘুচিবার নহে।"

    (গ্রাম্য সাহিত্য, রচনাকাল ১৩০৫)


    এই অংশে দেখি - মৌখিক ভাষার কাছাকাছি, দেশজ ও প্রচলিত, অ-কুলীন, অ-সংস্কৃত ভাষার সাহিত্যকে কবি একটি ভাষার সাহিত্য-তরুর শিকড়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অর্থাৎ দেশজ ভাষার সাহিত্যকেই তিনি কোনো একটি দেশের সাহিত্যের ভিত্তিভূমি বলে উল্লেখ করেছেন। ভাষার দেশিক ও স্থানিক রূপটি বিশেষভাবে দেশের জনসাধারণেরই আয়ত্তাধীন একথা বলেও শিষ্ট সাহিত্যের সঙ্গে তার অবিচ্ছেদ্যতার কথাও স্বীকার করেছেন তিনি। এক কথায় সাহিত্যের দেশজ ভাষার শক্তি ও সৌন্দর্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পরিপূর্ণ অবহিত এবং আস্থাশীল।

    রবীন্দ্রনাথ রচিত যে ভাষা-বিষয়ক গ্রন্থটি আমাদের আজও বারবার বিস্ময়ে চমকিত করে সেটি হল 'বাংলা শব্দতত্ত্ব'। উনিশ শতকের শেষের দিক এবং বিশ শতকের একেবারে প্রথম দিকে বাংলা ভাষার শব্দ সম্পর্কে কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গ্রন্থটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৯ সালে। দ্বিতীয় সংস্করণ হয় ১৯৩৫-এ। দ্বিতীয় সংস্করণে প্রবন্ধের সংখ্যা কিছু বেড়েছিল।

    দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা-স্বরূপ প্রবন্ধটি লিখিত হয়েছিল 'সবুজপত্র'-সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীর অনুরোধে। আমরা জানি প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের ভাষায় চলিত রীতির একটি ধরন প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে তিনি পেয়েছিলেন তাঁর সমর্থকরূপে। তবু 'বীরবল' ছদ্মনামধারী প্রমথ চৌধুরীর 'বীরবলী' ভাষার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত তাঁরা জানেন সেই ভাষায় ক্রিয়াপদের চলিত রূপ এবং তদ্ভব, দেশজ ও বিদেশি শব্দের অনুপাত বৃদ্ধি সত্ত্বেও তাকে সর্বসাধারণের মধ্যে চলিত মৌখিক ভাষার প্রতিরূপ বলা চলে না। বৈদগ্ধ্যের দীপ্তি, বুদ্ধির চমক এবং সরস-বক্রোক্তির মিশ্রণে উইট আর এপিগ্রাম্‌-খচিত সেই ভাষাকে সাধারণ অর্থে চলিত ভাষা বলা যায় না আদৌ।

    কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যখন উনিশ শতকের শেষ দশক থেকে বাংলা ভাষা সংক্রান্ত নানাবিধ প্রশ্ন তুলতে শুরু করলেন ভাষার উচ্চারণ নির্দেশ, শব্দ-সংগ্রহ, ব্যাকরণিক নিয়ম অনুসন্ধান করতে লাগলেন তখন তাঁর লক্ষ্য সম্পাদিত হয়েছিল যে-ভাষার প্রতি সেই ভাষা ছিল একেবারে খাঁটি, চলিত, প্রাত্যহিক বাংলা ভাষা। সংস্কৃতের সঙ্গে বেঁধে না নিয়ে স্বাধীনভাবে বাংলা ভাষার- 'খাঁটি' বাংলা ভাষার কথাই তিনি ভেবেছিলেন। 'সবুজপত্র' পত্রিকার সম্ভাবনা তখনও দেখা দেয়নি। 'সবুজপত্রীয়' বাংলার কোনো প্রাক্‌-আদর্শও রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় ছিল না এই প্রবন্ধগুলি লেখার কালে।

    'বাংলা শব্দতত্ত্ব' গ্রন্থের প্রবন্ধগুলিতে যথাক্রমে বাংলা উচ্চারণ, বাংলা স্বরবর্ণ, নির্দেশবাচক অনুসর্গ, বহুবচন, সম্বন্ধপদ, শব্দদ্বৈত, ধ্বন্যাত্মক শব্দ, অনুকার শব্দ, স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ ইত্যাদি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের আলোচনা আছে। বাংলা কৃৎ ও তদ্ধিত প্রত্যয়ের আলোচনায় অত্যন্ত নিবিড় সচেতনতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ খাঁটি বাংলা প্রত্যয়ের অনুসন্ধান করেছেন এবং তাদের ব্যবহারবিধি দেখিয়েছেন। পঁচিশ-তিরিশ বছর আগেও আমাদের স্কুলগুলিতে বাংলা ব্যাকরণ অনেকখানি সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম-অনুসারে পড়ানো হত। খাঁটি বাংলা শব্দ-সংগ্রহ ও ব্যাকরণ-বিধি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও প্রয়াস সে কারণে আমাদের কাছে বিস্ময়করভাবে কালের পক্ষে অগ্রসর বলে মনে হয়। আমরা সামান্য কয়েকটি উদাহরণ দেখাব।

    বাংলা শব্দদ্বৈতের উদাহরণ দেখাবার সময়ে তিনি দেখিয়েছেন শব্দ-দ্বৈত দ্বারা কখনো বহুত্ব, কখনো প্রকর্ষ, কখনো অপকর্ষ, কখনো সংযোগ, কখনো সমাহার - ইত্যাদি নানাবিধ ভাব বোঝাতে পারে। তাঁর উদাহরণগুলি এরকম -

    মুঠো মুঠো, ঝুড়ি ঝুড়ি, বস্তা বস্তা - বহুত্ববাচক
    টাটকা টাটকা, গরম গরম, ঠিক ঠিক - প্রকর্ষবাচক
    আগে আগে, তলে তলে, পেটে পেটে - সংলগ্নতা বাচক
    পড়ো পড়ো, ভরা ভরা, ফাঁকা ফাঁকা - ঈষৎ অসম্পূর্ণতার ভাববাচক
    বোঁচকা-বুঁচকি, গোলা-গুলি, গুঁড়ো গাঁড়া, দড়া-দড়ি - ছোটো ও বড় মিলিয়ে সমগ্রতা বাচক।


    শব্দ-যুগ্মকের এই উদাহরণগুলি অতি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে দেয় যে, প্রচলিত এবং আপাত অনভিজাত বাংলা শব্দ বিষয়ে কী-তীক্ষণ পর্যবেক্ষণ ছিল রবীন্দ্রনাথের। কিভাবে প্রতিটি শব্দের বাক্য-অন্তর্গত বিন্যাস বুঝে নিতে সচেষ্ট ছিলেন তিনি।

    যে পাঠকেরা রবীন্দ্রনাথকে কেবল মসৃণ ও শ্রবণ-মোহন কবিতাবলীর রচয়িতা বলে এবং করুণ, মধুর, নন্দিতা, উদাত্ত-গভীর-প্রগাঢ় উপলব্ধির যথোচিত রূপদানকারী ভাষার স্রষ্টা বলে জানেন তাঁদের জন্য চয়ন করে দেওয়া যাক রবীন্দ্রনাথের সংকলিত কিছু বাংলা ধ্বন্যাত্মক শব্দ - আইঢাই, ইলিবিলি, কটাত্‌, কটর-মটর, কপাকপ, কিলবিল, কেঁইমেই, ক্যাঁটকেঁটে, খ্যাঁক খ্যাঁক, খ্যাঁচামেচি, গুটগুট, গুবগাব, গুড়গুড়, ঘোঁৎ ঘোঁত্‌, ঘ্যান ঘ্যান, চ্যাঁ, ভ্যাঁ, জ্যাব জ্যাব, ট্যাঁস ট্যাঁস, ঠ্যাঙ্ঠেঙে, ডিগডিগে, ঢুকঢুক, তিড়িং তিড়িং, থ্যাসথেসে, দড়াম, ধেই, নন্নড়ে, পড়াং পড়াং, ফড়র ফড়র, ফোঁ ফোঁ, ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ, বুগ বুগ, ব্যাজ ব্যাজ, ভুড়ুক ভুড়ুক, মস মস, রৈ রৈ, রগরগে, লিকলিকে, সড় সড়, হটর-হটর, হুপহাপ। ধ্বন্যাত্মক মূল থেকে জাত আরো কিছু শব্দ দেখিয়েছেন লেখক। যেমন - জ্যাবড়া, ধ্যাবড়া, ভাপসা, ঝুপসি, ঢ্যাপসা, হোংত্কা, মিটকি, ট্যাবলা ইত্যাদি। এ কেবল কয়েকটি নিদর্শন। বস্তুত-ই 'বাংলা শব্দতত্ত্ব' বইটি পাঠ করা একটি অভিজ্ঞতা। রবীন্দ্রনাথের বহু রচনার মতোই এই বইটি - আমার অন্তত, বারবার পড়তে ইচ্ছে করে। অবসরের আরামের মধ্যেও পড়তে ইচ্ছে করে।

    যেখানে খাঁটি বাংলা কৃৎ ও তদ্ধিত প্রত্যয়-নিষ্পন্ন শব্দ দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, সেখানে স্থান পেয়েছে - এমন কয়েকটি শব্দ এখানে তুলে দেওয়া গেল। কেবল শব্দ নয়, সেগুলির নিষ্পন্নতা, অর্থ এবং প্রয়োগবিধিও কিছু কিছু তিনি দেখিয়েছেন।

    থ্যাঁত্লা মাংস, বাঘ-আঁচড়া গাছ, নেই-আঁকড়া লোক, দাড়িযুক্ত > দাড়িয়া > দেড়ে, পিটান্‌, ঢলান্‌, ফোড়ন্‌, বাট্না, পাটনাই, বালাই, বামনাই, গুবরে, বেতো, রগড়ানি, কাঁকড়োল, হাবল, খাবল, ছ্যাত্লা, লেজুড়ে, লাফারু, ট্যাঁকসই, ছিবলেপনা, চিম্টি, বেঁটে (বামন্টিয়া), কাল্সিটে।

    খাঁটি বাংলা শব্দের এই সুস্বাদু সম্ভারের সামনে দাঁড়িয়ে কিন্তু একটুখানি প্রশ্ন আমাদের মনে জাগে। সাহিত্য যখন রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ তখন সত্যিই কি এই শব্দভাণ্ডারকে অকৃপণ হাতে উজাড় করে ব্যবহার করতে পেরেছেন ? ধরা যাক ধ্বন্যাত্মক শব্দ এবং ধ্বন্যাত্মক শব্দজাত বিশেষণের কথা। ছোটগল্পে ও উপন্যাসে খাঁ খাঁ, ধূধূ, ঝরঝর্‌, ঝিক্ঝিক, হাহা, ধিকি ধিকি, দরদর - এই জাতীয় শব্দের ব্যবহার প্রচুর। কিন্তু সত্যিই কি ট্যাঁঙস্‌ ট্যাঁঙস, তিড়িং তিড়িং, ধেই ধেই, পচপচ, ব্যাজব্যাজ কিংবা ফোঁৎ ফোঁৎ শব্দের প্রয়োগ ততটা পাওয়া যাবে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ? গদ্যেও এগুলির ব্যবহার কম। তার মূলে কিন্তু লেখায় চলিত শব্দ প্রয়োগের অনীহা ক্রিয়াশীল ছিল মনে করলে ঠিক হবে না। তার মূল নিহিত রবীন্দ্রনাথের কবিমানসেই। কর্কশ, ক্লেদাক্ত, গ্লানিময় অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিকে সামগ্রিকভাবেই কবিতায় প্রধান করে তুলতে আগ্রহ বোধ করতেন না রবীন্দ্রনাথ। অদ্ভুত বা উদ্ভট-কে কবিতায় তিনি স্থান দিয়েছেন - কিন্তু বিশেষ ধরনের কবিতায়। হাস্যরস বা তির্যক ভাষণও তাঁর কবিতায় স্থান পেয়েছে স্বল্প। কোথাও কোথাও বিস্ময়কর উচ্চতা স্পর্শ করেছে তাঁর এই জাতীয় সৃষ্টি। 'জুতা আবিষ্কার' বা 'হিং টিং ছট' তার উদাহরণ। তবু রবীন্দ্রনাথের কবিতা বললেই যে ধরনের কবিতার কথা মনে পড়ে আমাদের - তাদের মধ্যে উক্ত দুটি কবিতা আসবে না। 'খাপছাড়া', 'প্রহাসিনী', 'সে' -এক একটি অসামান্য রচনা সংকলন হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের পাঠকদের প্রথমেই মনে পড়বে না এই বইগুলির কথা। বাংলা চলিত শব্দাবলীর এবং ধ্বন্যাত্মক শব্দের সিংহভাগই একান্ত লৌকিক অনুভূতি যা মূলত প্রিয়-অনুভূতি নয় - তার ভাব প্রকাশ করে। অথচ রবীন্দ্র-কবিতায় প্রধানত পূর্ণ তৃপ্তি, মধুর বিষাদ, নিবিড় নিবেদন, স্নিগ্ধ মিলন, উচ্ছ্বসিত প্রেম ও সুন্দরের বোধ, উদাত্ত মহিমা, প্রগাঢ় আধ্যাত্মিকতার সন্ধান পাই। বিষয়ের অনুরোধেই তাঁর কাব্যভাষায় অ-প্রিয় বা অ-সুন্দর বাচক চলিত শব্দ খুব বেশি আসেনি চলিত শব্দের প্রতি কোনো অবজ্ঞাবশত নয়। ধ্বন্যাত্মক শব্দের প্রসঙ্গে মনে পড়ে - 'তালে তালে দুটি কঙ্কন কনকনিয়া / ভবন শিখীরে নাচাও গনিয়া গনিয়া' কিংবা 'হে কুমার হাস্য মুখে তোমার ধনুকে দাও টান / 'ঝনন রণন' - এরকম প্রয়োগ খুব সহজেই করেছেন তিনি। 'বর্ষামঙ্গল' - আর 'বর্ষশেষ' - 'কল্পনা' কবিতা-সংকলনের এই দুটি কবিতার সুর ও অনুভব - কোনোটিকেই দেশজ বলা চলে না। তাই ধ্বন্যাত্মক শব্দ প্রয়োগেও দেশজ চলিত, প্রাত্যহিক সাধারণত্ব আসেনি কবিতাগুলিতে। এই ধরনের ধ্বন্যাত্মক শব্দ প্রচুর ব্যবহার করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বিশেষত ঝরঝর, ঝিরঝির, ঝনঝন, কনকন, কলকল, গুনগুন, ঝিকিমিকি শব্দগুলি বহুবার প্রয়োগ করা হয়েছে। ধ্বন্যাত্মক অর্থ থেকে সরে এসে ভিন্ন ধরনের বিশেষণ হয়ে উঠেছে এক একটি ধ্বনিমূল শব্দ, এমন প্রায়ই দেখা যায় আমাদের বাচনে। রবীন্দ্রনাথও তেমনভাবে শব্দ প্রয়োগ করেছেন কিছু কিছু যেমন - 'মনে ছবি আসে ঝিকিমিকি বেলা হল' ('নিমন্ত্রণ', 'বীথিকা')। এসব প্রয়োগে কিন্তু চলিত বাগ্ভঙ্গি রক্ষিত হয়নি ততটা।

    ধ্বন্যাত্মক শব্দজাত বিশেষণ, ক্রিয়া ও বিশেষ্যপদ প্রয়োগের সুন্দর দৃষ্টান্ত দেখি 'মরণমিলন' (উত্সর্গ) কবিতায়। মৃত্যুর আগমনের প্রতিতুলনায় কবি যখন দেবাদিদেব শিবের বিবাহযাত্রার ছবি এঁকেছেন তখন ভস্মাবৃত, বৃষবাহন, সর্পভূষিত, জটাজুটধারী দেবতার মূর্তিটিতেই যে প্রগাঢ় দেশজতা আছে তা কবিতার শব্দ-প্রয়োগে সঞ্চারিত হয়েছে কিছুটা। - "তাঁর লটপট করে বাঘছাল / তাঁর বৃষ রহি রহি গরজে" এবং "তাঁর ববম্‌ ববম্‌ বাজে গাল / দোলে গলায় কপালাভরণ"। 'বাংলা শব্দতত্ত্ব'-এর অন্তর্গত 'ধ্বন্যাত্মক শব্দ' প্রবন্ধটিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন - "আমাদের বর্ণনায় যে অংশ অপেক্ষাকৃত অনির্বচনীয়তর, সেইগুলিকে ব্যক্ত করিবার জন্য বাংলা ভাষায় এই-সকল অভিধানের আশ্রয়চ্যুত অব্যক্ত ধ্বনি কাজ করে।" 'মরণমিলন' কবিতাটির ক্ষেত্রে এই উক্তি অনেকটাই সত্য হয়ে দাঁড়ায়।

    রবীন্দ্রনাথের কবিতায় দেশজ ও প্রত্যহ-প্রচল শব্দাবলীর স্থাননির্ণয় প্রসঙ্গে প্রথমেই তাঁর দুই জাতের কবিতার মধ্যে পার্থক্যটি বুঝে নিতে হবে। কিছু কবিতায় তাঁর সরস ও সপরিহাস মনের ছাপ আছে। কোথাও তা কৌতুক মুখ্য, কোথাও তার সঙ্গে বিদ্রুপ-তির্যকতা মিশেছে। আরো এক জাতের কবিতায় উদ্ভট কল্পনা, অদ্ভুতের অসঙ্গতি জমানো মজার দৃশ্যাবলী, চরিত্র ও সংলাপ আমাদের মুগ্ধ করে। এই দুই জাতের কবিতায় প্রচুর চলিত শব্দের প্রয়োগ আছে। কিন্তু এই সব কবিতার গড়নের একটি প্রধান শর্তই হল চলিত শব্দের ব্যবহার। আপাত লঘু-রম্যতার একটি আবহ প্রয়োজন হয় এই সব কবিতায়, সেই সরস চপলতার সঙ্গে চলিত শব্দের রসটাই মানায় ভালো। রবীন্দ্রনাথের এই জাতীয় কবিতা থেকে বিশেষ্য ও বিশেষণ শব্দের কিছু উদাহরণ দেখা যাক। দৃষ্টান্তগুলি যথা-ইচ্ছা সংকলিত। - হাঁড়ি, দাড়ি, কান্নাকাটি, মাহিনা, পিপে, ঝাঁটা, ভিস্তি, পাঁক, কিস্তি, মাদুর, (জুতা আবিষ্কার), উকুন, চড়, আঁচড়, দাঁড়, সুড়সুড়ি, ঝট্পট্‌, টিকি, টাক, ঢোল, ছাঁটাছোঁটা, টকটকে, ডাকাতি, হেঁটো, ডালকুত্তা, বিকট, চেলা, ধড়, কাছা, কোঁচা, উলটপালট, হাবুডুবু, লেজুড় (হিং টিং ছট্‌)।

    এই জাতীয় শব্দের অসামান্য কবিত্বময় প্রয়োগ আমরা দেখি, 'প্রহাসিনী', 'খাপছাড়া', 'ছড়ার ছবি'-র কবিতাগুলিতে। 'খাপছাড়া' থেকে প্রয়োগ-কুশলতার কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেখতে পারি। -

    ১) ভূত হয়ে দেখা দিল
         বড়ো কোলাব্যাঙ -
    এক পা টেবিলে রাখে,
         কাঁধে এক ঠ্যাঙ।


    ২) টাকা সিকি আধুলিতে
         ছিল তার হাত জোড়া
    সে সাহসে কিনেছিল
         পান্তোয়া সাত ঝোড়া।
         ফুঁকে দিয়ে কড়াকড়ি
         শেষে হেসে গড়াগড়ি
    ফেলে দিতে হল সব
    আলু ভাতে পাত-জোড়া।

    শিক্ষিত বাঙালির মৌখিক ভাষায় ইংরেজি শব্দের অনুপ্রবেশ এক দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া। রবীন্দ্রনাথের রচনায় সে নিদর্শনও আছে। -

    ৩) দিন চলে না যে, নিলেমে চড়েছে
         খাটি-টিপাই।
    ব্যাবসা ধরেছি গল্পেরে করা
         নাট্টিফাই।
    ক্রিটিক মহল করেছি ঠাণ্ডা,
         মুর্গি এবং মুর্গি-আণ্ডা
    খেয়ে করে শেষ, আমি হাড় দুটি
         চারটি পাই-
    ভোজন ওজনে লেখা করে দেয়


    চলিত শব্দকে একটি ছদ্ম সাধু রূপ দিয়ে কৌতুকজনক করে তোলা হাস্যরসের লেখকদের একটি অভ্যস্ত পদ্ধতি। "ইস্কুল এড়ায়নে সেই ছিল বরিষ্ঠ, চাকরির বিভাগে সে অতিশয় নড়িষ্ঠ -। গলদ করিতে কাজে ভয়ানক দ্রড়িষ্ঠ।" এখানে 'এড়ায়ন' আর 'নড়িষ্ঠ' শব্দ দুটির মজা ছাড়াও 'গলদ' আর 'দ্রড়িষ্ঠ'-র সন্নিহিত বিন্যাসে সাধু-চলিত মিশ্রণের অসঙ্গতির রসটুকু চমত্কার ব্যবহার করেছেন কবি।

    কিন্তু এই ধরনের কবিতাকে আমরা চলিত শব্দের প্রকৃত প্রয়োগক্ষেত্র বলে ধরছি না। বিষয় ও দৃষ্টিকোণ-অনুসারে এ জাতীয় কবিতায় চলিত শব্দই আসবে। সামগ্রিকভাবে কাব্যভাষায় চলিত শব্দের প্রয়োগ-পরিসরের বিস্তার তাতে প্রমাণিত হয় না। যেখানে গভীর ও গম্ভীর রসের উত্সারণ কবিতায়, সেখানেও চলিত শব্দের প্রয়োগ কতটা তা দেখতে গিয়ে দেখি যে-সব কবিতায় বাস্তব সংসারের আখ্যান-সংস্পর্শ আছে সেসব কবিতায় খুব সহজেই চলে এসেছে বাস্তব সংসার ও দৈনন্দিন জীবন-যাপনের স্বাভাবিক চলিত শব্দাবলী। 'যেতে নাহি দিব' কবিতায় যেখানে চাকুরি-সূত্রে প্রবাসী স্বামীকে কর্মস্থলে ফিরে যাবার আগে জিনিসপত্র গুছিয়ে দিচ্ছেন স্ত্রী - সেখানে বর্ণনা -


    সোনামুগ সরুচাল সুপারি ও পান,
    ও হাঁড়িতে ঢাকা আছে দুই-চারিখান
    গুড়ের পাটালি কিছু ঝুনা নারিকেল,
    দুই ভাণ্ড ভালো রাই সরিষার তেল,
    আমসত্ত্ব আমচুর, সের দুই দুধ
    এই-সব শিশি কৌটা ওষুধ বিষুধ।
    মিষ্টান্ন রহিল কিছু হাঁড়ির ভিতরে,
    মাথা খাও, ভুলিয়োনা, খেয়ো মনে করে।


    সাধু ক্রিয়াপদের প্রয়োগ এবং কিছু তত্সম শব্দের সন্নিবেশ সত্ত্বেও এখানেও বিষয় ও পরিমণ্ডল অনুসারে যে চলিত শব্দ এসেছে তা কবিতাটির মূলভাব - বিশ্বচরাচর ব্যাপ্ত প্রাণবন্ধনের উদাত্ততাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারেনি। আবার বিশ্বব্যাপ্ত এক হার্দিক ও দার্শনিক উপলব্ধির প্রকাশ যেহেতু এই মৃত্পৃথ্বীলগ্ন সংসারের পরিসরেই ঘটেছে - তাই চলিত শব্দগুলিও চমত্কার মানিয়ে গেছে কবিতাটিতে। এমনই উদাহরণ আরো পাওয়া যাবে 'কথা ও কাহিনী'-র 'কাহিনী' অংশে - 'দেবতার গ্রাস', 'দুই বিঘা জমি', 'বিসর্জন', 'গানভঙ্গ', কবিতাগুলিতে। 'পলাতক', 'পুনশ্চ' ও 'শিশু'-র একাধিক কবিতায়। 'কণিকা' সংকলনের ক্ষুদ্র ব্যঙ্গ-সরস কবিতাগুলির মধ্যেও কাব্যবিষয় ও কবিদৃষ্টির বিপুল বাস্তবতার একান্ত টানে চলিত শব্দ-সম্ভার অবলম্বনেই মূলত রচিত হয়েছে কবিতা-শরীর। -


    ১) কেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে -
    ভাই বলে ডাকো যদি দেব গলা টিপে
    হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা
    কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা ॥

    ২) সাতাশ হলে না কেন একশ সাতাশ-
    থলিটি ভরিত, হাড়ে লাগিত বাতাস।
    সাতাশ কহিল - তাতে টাকা হত মেলা।
    কিন্তু কি করিতে বাপু বয়সের বেলা ॥


    এই কবিতাদ্বয়ে কেরোসিন, চাঁদা, দাদা, থলি, হাড়, মেলা, বাপু - প্রভৃতি শব্দ বর্জনের বা রূপান্তরের কথা ভাবাই যায় না। 'গলাটিপে দেওয়া', 'হাড়ে বাতাস লাগা' ইত্যাদি বাগ্ধারাও রবীন্দ্র-লেখনীতে কেবল এখানেই নয়, সর্বত্রই এসেছে মসৃণভাবে।

    কিন্তু এইসব কবিতার কথাও আমরা ছেড়ে দিই যদি, যদি কেবলই সুগভীর উপলব্ধি-বদ্ধ কবিতার কথা ভাবি - 'চৈতালি'-র কিছু কবিতা, 'নৈবেদ্য', 'কল্পনা', 'বলাকা' এবং 'শেষসপ্তক' বা আরো পরের দিকের সংকলনগুলির কথা - তাহলে মনে হবে, সে ধরনের কবিতায় চলিত শব্দের কোনো জায়গাই রবীন্দ্রনাথ রাখেননি। 'মেঘদূত', 'মানসসুন্দরী', 'এবার ফিরাও মোরে', 'উর্বশী', 'দু:সময়', 'শঙ্খ', 'শা-জাহান' প্রভৃতি কবিতায় যেন চলিত শব্দ প্রবিষ্ট হবার খোলাই রাখা হয়নি। তত্সম শব্দের ধ্বনি, রূপ ও লাবণ্যকে কি অপরিসীম মধুর-মহিমায় সন্নিবেশিত করতে পারতেন রবীন্দ্রনাথ তার যে-কোনো দৃষ্টান্ত যে-কোনো কবিতা থেকে তুলে নিলেই যথেষ্ট। -

    যখন শুনালে কবি, দেবদম্পতিরে
    কুমারসম্ভব গান, চারিদিকে ঘিরে
    দাঁড়ালো প্রমথগণ। শিখরের পর
    নামিল মন্থরশান্ত সন্ধ্যামেঘস্তর -
    ('কুমারসম্ভব গান', চৈতালি)


    এই ভাষায় এত সাবলীল ও পারঙ্গম শিল্পীর মনে চলিত শব্দের জন্য অতখানি আগ্রহ ছিল - এই সত্যটিই আমাদের কাছে বিস্ময়কর মনে হয়।

    তবু, একেবারে প্রথম পর্বের রোমান্টিক কবিতাবলীর মধ্যেও এসেছে চলিত শব্দের একটি ক্ষীণ ধারা। বিশেষত ক্রিয়াপদের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে তাদের নির্বাচন মনে হয় অনিবার্যই ছিল। দু'তিনটি উদাহরণ -

    কেন তবে কেড়ে নিলে লাজ-আবরণ।
    হৃদয়ের দ্বার হেনে বাহিরে আনিলে টেনে
    শেষে কি পথের মাঝে করিবে বর্জন ॥
    ('ব্যক্ত প্রেম', মানসী)


    'ঢাকো ঢাকো মুখ টানিয়া বসন আমি কবি সুরদাস', 'সেথা হতে তারে উপাড়িয়া লও জ্বালাময় দুটো চোখ' ('সুরদাসের প্রার্থনা', মানসী)। এরকমই এড়ানো, খোলা, ঝাড়া, বাসা, ধাঁধা (তুমিও ছুটিছ চপলা লক্ষ্মী আলেয়া হাসো ধাঁধিয়া), চকানো (সব দিতে হবে চুকায়ে), ফুকারি, ছোটা, কোটা, জুড়নো, ফুরনো ইত্যাদি ক্রিয়াপদগুলি লোক-জীবন থেকে গিয়ে মিশে গেছে রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক কবিতায়। এই বাংলা ক্রিয়াপদগুলি বাদ দিয়ে বাংলা কবিতা লেখা মধুসূদনের পক্ষেও সম্ভব হয়নি, রবীন্দ্রনাথের পক্ষেও নয়।

    প্রাত্যহিকতার জীবনীশক্তি প্রতিদিনের বেঁচে থাকার সহজ ও কঠিনে মিশ্রিত সৌন্দর্য আর জীবন-দর্শনের প্রগাঢ় উপলব্ধি মিশিয়ে 'ক্ষণিকা'-র কবিতাগুলি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই 'ক্ষণিকা'-র ছন্দেও এসেছে বাংলার লোকায়ত ছড়ার ছন্দের আধার - যাকে রবীন্দ্রনাথ বলতেন প্রাকৃত ছন্দ এবং স্বাভাবিক ছন্দ। রামপ্রসাদের গানের উচ্চারণে তিনি সেই লোকজ ছন্দের ধ্বনি শুনিয়েছিলেন। 'ক্ষণিকা'-র কবিতাগুলিতে সহজ সুন্দরের, অনাড়ম্বর স্বাভাবিকতার, বাস্তব সম্মত সহজ বুদ্ধির পরিবেশ ও মানসিকতা ফুটেছে বলে চলিত শব্দ ও ক্রিয়াপদ চমত্কার মানিয়ে গেছে কবিতাগুলিতে। -

    কেউ বা তোমায় ভালবাসে
        কেউ বা বাসতে পারে না যে,
    কেউ বিকিয়ে আছে, কেউ বা
        সিকি পয়সা ধারে না যে-
    কতকটা বা সে দোষ তাদের,
        কতকটা বা তোমারো ভাই-
    কতকটা এ ভবের গতিক
        সবার তরে নহে সবাই।
    তোমার মাপে হয়নি সবাই,
        তুমিও হওনি সবার মাপে,
    তুমি মরো কারো ঠেলায়
        কেউ বা মরে তোমার চাপে
    ভেসে থাকতে পারো যদি,
        সেইটে সবার চেয়ে শ্রেয়-
    না পারো তো বিনা বাক্যে
        টুপ করিয়া ডুবে যেও
    সেটা কিছু অপূর্ব নয়,
        ঘটনা সামান্য খুবই-
    শঙ্কা যেথায় করে না কেউ
        সেই খানে হয় জাহাজডুবি।


    এই কবিতাংশের নির্দেশিত শব্দগুলি এবং 'টুপ করে ডুবে যাওয়া' জাতীয় বাগ্ধারাটি দেখলে বোঝা যায় যে-কোনো ধরনের কবিতাতেই চলিত শব্দের আসার পথ রবীন্দ্রনাথ উন্মুক্ত রাখতেই ভালোবাসতেন। যখন তিনি কবিতার ভাষা নিয়ে আধুনিক কবিদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন তখন দেখেছি বাংলা ভাষায় অ-প্রচল বিদেশি শব্দ কবিতায় ব্যবহার করবার ব্যাপারে তাঁর কিছুটা দ্বিধা ছিল। নজরুল ইসলামের 'খুন' কিংবা বিষ্ণু দে-র 'রিফ্লেক্স' বা 'পাইন' নিয়ে আপত্তি করেছিলেন যথেষ্ট। গুরুভার আভিধানিক শব্দ নিয়েও তাঁর আপত্তি ছিল। দুরূহ শব্দাবলীর বাধা কবিতায় তাঁর তেমন মনোমতো ছিল না। কিন্তু খাঁটি বাংলা শব্দ, বাংলা ভাষার সঙ্গে মিশে যাওয়া বিদেশি (মূলত আরবি, ফারসি) শব্দ ও ক্রিয়া নিয়ে তাঁর আপত্তি ছিল না কোথাও বরং সমর্থনই ছিল।

    তবু বলা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় চলিত শব্দ প্রয়োগের ও সন্নিবেশের ক্ষেত্রে ছিল কিছুটা রক্ষণশীলতাও। তীক্ষণ, ধারালো, তপ্ত, কুত্সিত ভাববাহী চালিত শব্দাবলী যেখানে কবিতার অন্তস্থলে পাঠককে পৌঁছে দেবার নৌকোর মতো কাজ করে সেখানে কিছুটা কুন্ঠা ছিল রবীন্দ্রনাথের। জীবনানন্দের মতো কবিতায় চলিত শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে এক আ-মূল ওলট-পালট ঘটিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে।

    ".... 'জলিফলি ছাড়া
    চেত্লার হাট থেকে টালার জলের কল আজ
    এমন কী হত জাঁহাবাজ ?
    ভিখারিকে একটি পয়সা দিতে ভাসুর ভাদ্র বৌ সকলে নারাজ।'
    বলে তারা রামছাগলের মতো রুখু দাড়ি নেড়ে
    একবার চোখ ফেলে মেয়েটির দিকে
    অনুভব করে নিল এইখানে চায়ের আমেজে
    নামায়েছে তার এক শাঁকচুন্নিকে।"

    (লঘু মুহূর্ত, সাতটি তারার তিমির)


    এই উপলব্ধির কবিতা লিখতে অভ্যস্ত ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ। চলিত ভাষা প্রয়োগের এই ডাইমেনশন সে কারণেই তাঁর কবিতায় আসেনি। সমাজ-লগ্ন মানসিকতার একটি তিক্ত বেদনাময় উপলব্ধির কবিতায় 'জাঁহাবাজ', 'রামছাগল' আর 'শাঁকচুন্নি' শব্দের প্রয়োগ সম্ভবত তাঁর কল্পনাতীত ছিল।
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments