যে কোনও শিল্প সৃষ্টিতে ছায়া ফেলে তার সমকালীন ইতিহাস, যে-কোনও শিল্পসৃষ্টিকে ঘিরে থাকে তার সময় ও স্বদেশ - এ সত্য এতই স্বত:সিদ্ধ যে স্পষ্টত কোনো বিতর্ক কেউ তুলেছেন বলে জানি না । কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে আমরা অন্তত একটি প্রবন্ধে খোলাখুলিভাবে এই ধারণার বিপরীত অভিমত প্রকাশ করতে দেখেছি ।
বুদ্ধদেব বসুকে রবীন্দ্রনাথ একটি পত্রাকার প্রবন্ধ লিখেছিলেন জীবনের একেবারে অন্তিম পর্বে। কবিতা পত্রিকার ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যায় সেই প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল 'সাহিত্যে ঐতিহাসিকতা' শিরোনামে। রবীন্দ্রনাথ তখন প্রয়াত হয়েছেন। কাজেই ধরে নিতে হবে এই প্রবন্ধটিতে যা তিনি বলেছিলেন তা তাঁর পরিণত বয়সের ও পরিণত মানসের চিন্তা ও ভাবনার অভিব্যক্তি । রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধটি শুরু করেছেন এইভাবে -
"আমরা যে ইতিহাসের দ্বারাই একান্ত চালিত, একথা বার বার শুনেছি এবং বার বার ভিতরে ভিতরে জোরের সঙ্গে মাথা নেড়েছি।"
এই 'মাথা নাড়া' সমর্থনের নয়, অ-সমর্থনের। তারপরেই রবীন্দ্রনাথ বলেন - "এ তর্কের মীমাংসা আমার নিজের অন্তরেই আছে, যেখানে আমি আর কিছু নই, কেবলমাত্র কবি। সেখানে আমি সৃষ্টিকর্তা, সেখানে আমি একক, আমি মুক্ত, বাহিরে বহুতর ঘটনাপুঞ্জের দ্বারা জালবদ্ধ নই। ঐতিহাসিক পণ্ডিত আমার সেই কাব্যসৃষ্টির কেন্দ্র থেকে আমাকে টেনে এনে ফেলে যখন, আমার সেটা অসহ্য হয়।" ( সাহিত্যে ঐতিহাসিকতা, সাহিত্যের স্বরূপ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত, বিশ্বভারতী সংস্করণ ১৩৫০ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা-৫৭ )
রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি আমাদের ভাবায়। আমাদের মনে পড়ে যে, সত্যিই রবীন্দ্রনাথের কবিতায় সমকালীনতার রাষ্ট্রীয়, সামাজিক এবং ঐতিহাসিক কোনো ঘটনারই প্রত্যক্ষ উল্লেখ প্রায় নেই। চেতনার উন্মেষের লগ্ন থেকে মৃত্যুর মুহূর্তটি পর্যন্ত ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রত্যক্ষ পরিস্থিতির মধ্যেই জীবন অতিবাহিত করেছিলেন তিনি। অন্তত একবার ইংরেজ প্রশাসকের বঙ্গভঙ্গের আদেশ রদ করবার দাবিতে নেমেছিলেন পথে। তখনও কন্ঠে তাঁর কোলাহল ছিল না, ছিল গান। সেইসব গানগুলিতে সংকল্পের কথা আছে আছে সাহস, শৌর্য, সত্যনিষ্ঠা এবং দেশপ্রেমের উদ্দীপ্ত বাণী। কিন্তু ১৯০৫ বা ১৩১২ বঙ্গাব্দের কোনো উল্লেখ নেই। বাংলার এক হওয়ার মর্মস্পর্শী সঙ্গীত তিনি রচনা করেছিলেন সেই উপলক্ষ্যে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসকের প্রতি বিরুদ্ধতার কোনো প্রত্যক্ষ উক্তি তাঁর কোনো গানেই পাওয়া যায় না। সেজন্য বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় রচিত গানগুলি চিরকাল দেশাত্মবোধ এবং আত্মশক্তি জাগাবার উদ্দীপক রূপে গাওয়া যেতে পারে যে-কোনও সময়ে।
বস্তুত চিরকাল, নিত্যকাল, অনাদিকাল, আবহমানকালের বাতাবরণের মধ্যেই যেন রচিত রবীন্দ্রনাথের কবিতা এবং গান। সময়ের স্পর্শ সম্পূর্ণ এড়িয়ে থাকা কিছুতেই সম্ভব নয় বলে তাঁর কবিতায় কোথাও কোথাও বিশেষ করে আখ্যান ভিত্তিক কবিতাগুলিতে সমকালীন সমাজের পরিবেশ-পরিস্থিতি ফুটে উঠেছে। যেমন 'দুই বিঘা জমি' কবিতাটি জমিদারি প্রথার যুগে লিখিত - তাতে কোনও সংশয় থাকে না। 'বিসর্জন' কবিতায় গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জনের যে চিত্র আছে 'ক্যামেলিয়া' কবিতায় আছে কলকাতার ট্রামের যে ছবিটি - তার সাহায্যে আমরা সময়টিকে অনুমান করে নিতে পারি। কিন্তু সময়ের জ্ঞাপন কোনো সাল তারিখের প্রত্যক্ষ উল্লেখ আমরা রবীন্দ্রনাথের কবিতায় প্রায় কখনও পাই না।
তার কারণ এই নয় যে বিশেষ ভাবেই ব্রিটিশ-বিরোধী কোনো উক্তি করবার ঝুঁকি থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর ছোটোগল্পগুলিতে এই প্রত্যক্ষভাষিতা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত নয়। 'মেঘ ও রৌদ্র' গল্পে ইংরেজ প্রশাসকের অন্যায় উত্পীড়ন তিনি খোলাখুলিই দেখিয়েছেন। 'রাজটীকা' গল্পে ইংরেজ প্রভুর স্তাবক বাঙালি চাকুরিজীবীর নির্লজ্জ তোষণবৃত্তিকে তীক্ষণবিদ্রুপ করেছেন তিনি। 'বদনাম' গল্পে ইংরেজের পুলিশকে তুচ্ছ করে মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন বিপ্লবী নায়কের। তাঁর উপন্যাসেও, সাল তারিখের উল্লেখ কিছু অস্পষ্ট থাকলেও মোটের উপর ঐতিহাসিক ঘটনাবলি একেবারে অনুল্লেখিত থাকে নি। গোরা, ঘরে-বাইরে, চার অধ্যায় স্মরণীয়। কিন্তু কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় সেভাবে কি কখনও সমাজ এবং ইতিহাসের বাস্তবতাকে তুলে আনবার কথা ভেবেছিলেন ?
'সাহিত্যে ঐতিহাসিকতা' প্রবন্ধটিতে দেখা যায় পরিষ্কার ভাষাতেই শিল্পে প্রত্যক্ষভাবে ঐতিহাসিক বাতাবরণ রচনার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছেন বিদ্রুপ-পরিহাসের ভঙ্গিতে।
একদিন স্কুল থেকে এসে আমাদের পশ্চিমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক অতি আশ্চর্য ব্যাপার দেখেছিলুম। ধোপার বাড়ি থেকে গাধা এসে চরে খাচ্ছে ঘাস - এই গাধাগুলি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যনীতির বানানো গাধা নয়, এ আমাদের সমাজের চিরকালের গাধা, এর ব্যবহারে কোনো ব্যতিক্রম হয়নি আদিকাল থেকে - আর একটি গাভী সস্নেহে তার গা চেটে দিচ্ছে। এই যে প্রাণের টান আমার চোখে পড়েছিল আজ পর্যন্ত সে অবিস্মরণীয় হয়ে রইল।
(পূর্বোক্ত প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা - ৫৮)
উদ্ধৃত অংশটিতে 'চিরকালের' এবং 'আদিকালের' শব্দবন্ধ-দুটি লক্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় সময়ের এই নিত্যকালের লীলাই উত্সারিত হয়েছে প্রধানত। তিনি যখন প্রেমের অনুভূতির কথা বলেন তখন এই উপলব্ধি জড়িয়ে থাকে সেই অনুভূতিতে -
<>" আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগল প্রেমের স্রোতে / অনাদিকালের হৃদয় উত্স হতে / আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে / বিরহ বিধুর নয়ন সলিলে, মিলন মধুর লাজে " ( 'অনন্ত প্রেম', মানসী )এই কবিতাংশটিতেও 'অনাদিকালের হৃদয় উত্স' বাক্যাংশের প্রয়োগে প্রেম-অনুভূতির নিত্যকালীনতা সূচিত হয়েছে ।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় দেখি একজন্মের প্রেমিক পূর্বজন্মের হারানো প্রেয়সীর সন্ধানে পাড়ি দিতে পারে জন্মান্তরের পথ । (`স্বপ্ন', কল্পনা ) কোথাও কোনও বাধা ঘটে না । কালান্তর যেন কোথাও ঘিরে থাকে না রবীন্দ্রনাথের কবিমানসকে । সময়ে সময়ে তিনি ক্ষণকালের কথাও বলেছেন অবশ্য । যেমন -
চিরকাল রবে মোর প্রেমের কাঙাল
একথা বলিতে চাও বোলো
এই ক্ষণটুকু হোক সেই চিরকাল
তারপরে যদি তুমি ভোলো
মনে করাব না আমি শপথ তোমার
আসা যাওয়া দুদিকেই খোলা রবে দ্বার (`দায়মোচন' মহুয়া )
এখানে যে ক্ষণকালের কথা বলা হয়েছে তা-ও কিন্তু চিরকালেরই আর একটি রূপ । বৌদ্ধ দার্শনিকেরা যেমন জীবনধারাকে বিচ্ছিন্ন মুহূর্তের ধারাবাহিক প্রবাহ বলে মনে করেছেন এবং স্বীকার করেছেন সেই প্রবাহের অনন্ততাকে, রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটির ক্ষণকাল যেন চিরকালেরই দর্পণ ।
একমাত্র যে কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথ একটি কালবাচক শব্দ ব্যবহার করেছেন কবিতার শিরোনামে সেটি হল `১৪০০ সাল' ( চিত্রা ) । কিন্তু সে কবিতা পড়ামাত্রই অনুভূত হয় যে নির্দিষ্টভাবে ১৪০০ বঙ্গাব্দ বা ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দকেই কবি নির্দেশ করতে চেয়েছেন এমন নয় । কবি বর্তমানকালে দাঁড়িয়ে অনাগত এবং অন্তহীন ভবিষ্যত্কালের যে-কোনো কবিতা পাঠককে উদ্দেশ করে রচনা করেছেন এই কবিতা - "আমার বসন্তগান তোমার বসন্তদিনে ধ্বনিত হউক ক্ষণতরে-"
এই তাঁর অন্তরের অভিলাষ । আগামী দিনের যে-কোনো কাব্যরসসিক্ত মুহূর্ত - যখন `নবীন ফাল্গুনদিন । সকল বন্ধনহীন' । কাজেই এই সিদ্ধান্ত করাই যায় যে, রবীন্দ্রনাথের কাব্য-কল্পনার পরিসরে নির্দিষ্ট দিনক্ষণে বাঁধা নির্দিষ্ট ঘটনাবলির- অর্থাৎ প্রথাসিদ্ধ ঐতিহাসিকতার, সত্যিই তেমন গুরুত্ব নেই । - "আপন সৃষ্টিক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ একা, কোনো ইতিহাস তাকে সাধারণের সঙ্গে বাঁধেনি" । - লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ `সাহিত্যে ঐতিহাসিকতা' প্রবন্ধটিতে ।
প্রবন্ধটি রচিত হয়েছে চল্লিশের দশকের শুরুতে । সেই সময়ে ভারতের স্বাধীনতা-আন্দোলন ত্রক্রমেই জোরালো আর জটিল হয়ে উঠেছে । কংগ্রেস, মুসলিম লিগ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ব্রিটিশ রাজের পারস্পরিক সম্পর্ক হয়ে উঠেছিল বহুধা এবং কুটিলতাময় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সেই পরিস্থিতিকে করেছিল আরও ঘোরালো । তবু সব কিছুর উপরে ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদের স্রোত প্রবল ও অগ্নিস্রাবী হয়ে উঠেছিল ত্রক্রমেই । পরিস্থিতি এমন ছিল বলেই ১৯৪২-এ গান্ধীজি-র পক্ষে তাঁর `ভারত ছাড়ো' আন্দোলনে দেশের প্রায় প্রতিটি কোণ থেকেই পেয়েছিলেন অভূতপূর্ব সাড়া ।
সেই সময়ের বাংলা কবিতায় রাজনীতি-সচেতন দেশপ্রেমের চিহ্ন অপ্রতুল ছিল না । গান্ধীজির নাম উল্লিখিত হয়েছে অনেক কবির কবিতায় । সত্যাগ্রহ, অসহযোগ, ডাণ্ডি-অভিযান, বিদেশি জিনিস বয়কট অন্যদিকে অরবিন্দ, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, মানিকতলা বোমার মামলা, আন্দামানের কারাগৃহ, মাতঙ্গিনী, প্রীতিলতা, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন- এসবই বাংলা কবিতায় কম বেশি স্থান পেয়েছিল ।
১৯০৫ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত সময়পর্বে বাংলা সাময়িক পত্র খুললেই এজাতীয় কবিতার নিদর্শন চোখে পড়বে । কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবিতায় তেমন হয়নি । জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডে বিচলিত রবীন্দ্রনাথ ইংরেজের দেওয়া উপাধি ত্যাগ করতে দ্বিধা করেননি । কিন্তু জালিয়ানওয়ালাবাগ স্থান পায়নি তাঁর কবিতায় । - "ইতিহাস যেখানে সাধারণ সেখানে ব্রিটিশ সাবজেকট ছিল, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিল না । সেখানে রাষ্টীয় পরিবর্তনের বিচিত্র লীলা চলছিল, কিন্তু নারকেল গাছের পাতায় যে আলো ঝিলমিল করছিল সেটা ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের রাষ্ট্রীয় আমদানি নয় ।" (`সাহিত্যে ঐতিহাসিকতা')
এইভাবেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতা থেকে দূরে রেখেছিলেন সমকালীন ইতিহাসকে । তার দিনাঙ্ক আর স্থানাঙ্ক - দুটিকেই সরিয়ে রেখেছিলেন তাঁর কাব্যভাবনার পরিসর থেকে । ইতিহাসের সারাত্সার, ইতিহাসের নির্যাস আছে তাঁর কবিতায় । আমরা স্মরণ করতে পারি `ভারততীর্থ' (হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে) আর `অপমানিত' (হে মোর দুর্ভাগা দেশ) কবিতা -- যেগুলির মধ্যে ভারতের বর্হিদেশীয় আর অন্তর্দেশীয় সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ইতিহাসের সমন্বয় ঘটেছে । কিন্তু সাধারণত সমকালীন ইতিহাসের নাম-ধাম-দিন-তারিখ-ঘটনার নির্দিষ্ট বাস্তবতা তাঁর কবিতায় নেই । কেবল যে নেই তা নয়, সেভাবে কবিতা রচনা করতে ভালোও বাসতেন না তিনি । সেকথাই লিখে গেছেন পূর্বোক্ত প্রবন্ধটিতে বারবার ।
এই মনোভঙ্গির তীক্ষণ পরিবর্তন আমরা দেখতে পাই রবীন্দ্র-উত্তর বাংলার কবিদের রচনায় । ইতিহাসবোধের অনুভাবনায় এক আ-মূল দিক-বদল হয়ে গেছে এই পর্বের কবিদের লেখায় । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলার কালে জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, অমিয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র সকলেই বালক ও কিশোর । সমকালীন রাজনীতিতে স্কুলের ছাত্রদের খুব সরাসরি আগ্রহী হয়ে না ওঠাই স্বাভাবিক ছিল । কিন্তু স্বাধীনতা-সংগ্রামের তরঙ্গগুলি, সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ঢেউ তাঁরা প্রত্যক্ষ না করে পারেননি । বিংশ শতকের তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের যে তীব্র ঘাত-প্রতিঘাত - তার সবটা সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম না করলেও ভারতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনমন আর সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিকতার জটিল সম্পর্কটি তাঁরা মোটের উপর বুঝে গিয়েছিলেন । তিরিশের দশকে ফ্যাসিবাদের উথ্থানের সংকটবোধ আর ফ্যাসিবিরোধী চেতনার উদ্দীপন - দুইই তাঁদের উপলব্ধি-গোচর ছিল ব্যাপকভাবে । সেই উপলব্ধি রবীন্দ্রনাথেরও ছিল না - এমন নয়, কিন্তু কবিতায় বাস্তব চিত্রের অনুপুঙ্খতায় তাকে পরিস্ফুট করবার কল্পনা তাঁকে আকর্ষণ করত না । ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চেয়ে নারকেল পাতায় আলোর ঝিলমিলির প্রতিরূপ কবিতায় এঁকে তুলতেই ভালো লাগত তাঁর প্রধানত । জীবনের শেষ পর্বেও এই তাঁর লিখিত স্বীকারোক্তি ।
কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তীকালের কবিদের মনেরই ঘটে গেল পরিবর্তন । সমকালকে তাঁরা অনন্তকালের আবহমণ্ডলে রেখে তুচ্ছ ভাবতে পারলেন না । সমকালীন ইতিহাসে ও রাষ্ট্রনীতিতে ক্ষমতালোভ ও নৃশংসতার যে সংঘর্ষ চলেছে- তার ফলে সাধারণ মানুষের ধন-জন-জীবন বিপন্ন থেকে বিপন্নতর হয়ে উঠছে প্রতিদিন । এই পরিস্থিতিকে চিহ্নিত না করে উপায় ছিল না তাঁদের । তাঁরা এর প্রয়োজন বোধ করেছিলেন গভীরভাবে । প্রয়োজনবোধের এই মাত্রাবদল থেকে আমরা রবীন্দ্রযুগের পরবর্তী কালের বাংলা কবিতাকে চিনতে পারি কিছুটা ।
ঐতিহাসিক কাল নির্ণয় ও নির্দেশের এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় চল্লিশের দশকে । কারণ ঐ সময়টিতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রশক্তিগুলির মধ্যে ফ্যাসিবাদের সঙ্গে চলেছে এই শতাব্দের মানুষের মরণান্তিক সংগ্রাম অন্যদিকে ভারতের রাজনীতি ও দেশীয় পরিস্থিতিতে সবচেয়ে মন্থন-প্রখর দশক এই সময়টি । `ফ্যাসিস্ট-বিরোধী লেখক শিল্পীসংঘ'- এর প্রতিষ্ঠা (১৯৪২), ভারতছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২), মন্বন্তর (১৯৪৩), গণনাট্য সংঘ- এর প্রতিষ্ঠা (১৯৪৪), দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ অন্তে আণবিক বোমা বিস্ফোরণ (১৯৪৫), মুসলিম লিগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘোষণা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, নৌ-বিদ্রোহ, কলকাতায় গণবিক্ষোভ (১৯৪৬), তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬-১৯৪৯), দেশের দ্বিখণ্ডীকরণ ও স্বাধীনতা (১৯৪৭), পুনশ্চ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, গান্ধীজির মৃত্যু (১৯৪৮) - এই সবই ঘটেছিল ঐ এক দশকের মধ্যে । কারোরই সাধ্য ছিল না ঐ রক্তঝরানো কালচিহ্নগুলি মুছে ফেলার । রবীন্দ্রনাথ জীবিত থাকলে কী করতেন তা বলা কঠিন কিন্তু আধুনিক কবিরা সেই কালের চিহ্ন প্রচ্ছন্ন রাখবার কোনো চেষ্টাই করেননি । বিপরীতপক্ষে বলা যায়, ইতিহাসকে তাঁরা বিশেষভাবে সময়-চিহ্নিত করে দাগিয়ে দিতেই চেয়েছেন কবিতায় ।
"সে পাড়া জুড়নো বুলবুলি নও তুমি । বর্গির ধান খায় উনতিরিশে"। (`উটপাখি', ত্রক্রন্দসী ) কবিতার এই পংক্তিতে `উনতিরিশে' শব্দটি ইউরোপীয় অর্থনীতির `গ্রেট ডিপ্রেশন ইয়ার' অর্থাৎ অর্থনৈতিক মন্দার তুঙ্গতম বত্সরটিকে বোঝায় । বিশ্বজোড়া সেই দুর্বত্সরকে বিশেষভাবে নির্দেশ করবার জন্যই এই সালটি উল্লেখ করেছেন কবি ।
ফ্যাসিবাদের প্রতিষ্ঠা যদিও ঘটেছিল ১৯২২ সাল থেকে যখন মুসোলিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন ইতালিতে, কিন্তু বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদের ভয়ঙ্করতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ও বুদ্ধিজীবীরা যথার্থভাবে অবহিত হয়েছিলেন ১৯৩৩-এর পর যখন হিটলার জার্মানির একনায়ক পদে অধিষ্ঠিত । তিরিশের দশকের ঐ সময়টি বিশ্বে ফ্যাসিবাদের উথ্থানের কাল । স্পেনে গণতন্ত্রী সরকারের পতন এবং জেনারেল ফ্রাঙ্কো-র ক্ষমতা অধিকার ও স্বৈরতন্ত্রীয় সরকারের প্রতিষ্ঠা ঘটে ১৯৩৬ সালে জাপান সামরিক তত্পরতায় দুর্বল ও অসংগঠিত চীনের উপর আক্রমণ হানতে থাকে ১৯৩৭ সাল থেকে । সেই সময় বাংলায় সমাজতন্ত্রবাদী চিন্তাভাবনা প্রসারিত হয়ে চলেছে । ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধতায় বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করেছে সমাজতন্ত্রবাদ । ১৯৩৮ সালে সুভাষ মুখোপাধ্যায় `চীন ১৯৩৮' নামে যে কবিতাটি লিখেছিলেন সেই কবিতা সরাসরি জাপান-বিরোধী ছিল এবং সার্বিকভাবে ছিল সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদ-বিরোধী । সেই কবিতা মুদ্রিত করতে সহজে স্বীকৃত হতে পারেননি অধিকাংশ সাময়িক পত্রের সম্পাদক । সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ প্রভু বিরক্ত হতে পারে - এই ভেবে কবিতাটিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন অনেকে । `আনন্দবাজার পত্রিকা'-র সম্পাদক তখন ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার । `আনন্দবাজার পত্রিকা'র তখন ছিল সুস্পষ্ট ফ্যাসিবিরোধী ভূমিকা । `আনন্দবাজার পত্রিকা'র সাহিত্যের পৃষ্ঠা তখন দেখতেন কবি অরুণ মিত্র । এই কবিতাটি নির্বাচন করে তিনি ১৯৩৮ সালে শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশ করেন । `চীন ১৯৩৮'- এই কবিতাটি দিয়ে বাংলা সাহিত্যের নতুন যুগের কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে চিনে নিলেন বাঙালি পাঠক । এই কবিতায় ধরা রইল ফ্যাসিবাদী জাপানের আক্রমণের ঐতিহাসিক কালের ছবি ।
"জাপপুষ্পকে ঝরে ফুলঝুরি জ্বলে হ্যাঙ্কাও"। বাংলা কবিতার এই পর্বের ইতিহাসে `কাস্তে'র কবি অভিধায় খ্যাত দিনেশ দাসকে ভুলে থাকার কোনো উপায় নেই । খোলামনে, মুক্ত হৃদয়ে, স্বাধীন কলমে, উজ্জ্বল ও প্রগতিশীল প্রত্যয়-সমৃদ্ধ কবিতা তিনি অজস্র লিখে গেছেন চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে । তারপরেও তাঁর কবিতা রচনার ধারা ক্ষীণ হয়নি, যদিও সুদৃঢ় সাম্যবাদের সরল প্রত্যয় কিছুটা সংশয়-আকীর্ণ হয়ে পড়েছিল ষাটের দশকে চীন-ভারত যুদ্ধ, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির বিভাজন ইত্যাদি ঘটনায় । কবিতাকে নির্দিষ্ট রচনা এবং তার দেশকালের সঙ্গে সংলগ্ন করে দেওয়ার ব্যাপারে দিনেশ দাসের দ্বিধা তো ছিলই না, বরং অনন্তকালের প্রেক্ষিতে কবিতা না লিখে বিশেষ কালের বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে ইতিহাসের বিশিষ্ট প্রতিফলন হিসাবেই কবিতা লিখতে যেন ভালোবাসতেন তিনি । আমরা কয়েকটি কবিতার নাম উল্লেখ করছি । কবিতা (১৯৪২) সংকলনের অর্ন্তভুক্ত কবিতাগুলি হল -`ব্ল্যাকাউট : ১৯৩৭', `জাপান : ১৯৪০', `আগামী : ১৯৪২', নভেম্বর : ১৯৪১' । ভুখ মিছিল (১৯৪৪) কবিতা সংকলনের অন্তর্গত কবিতাগুলি হল `ভারতছাড়ো : ১৯৪২', `বেতার : ১৯৪৩' । দিনেশ দাসের কবিতা (১৯৫১) সংকলনের অন্তর্গত কবিতাগুলি `কোরিয়া : ১৯৫০', `পনেরই আগষ্ট : ১৯৪৭', `বাংলা : ১৩৫০' । অহল্যা (১৯৫৪) সংকলনে আছে - `শিক্ষক ধর্মঘট : ১৯৫৪', `শিক্ষক মিছিলে ১৯৫৩' । কাচের মানুষ (১৯৬৪) সংকলনের কবিতা - `জন্মদিন : ১৩৬০', `বন্যা : ১৩৬৬', `পুবে ঝড় : ১৩৬৭' । অসঙ্গতি (১৯৭২) সংকলনভুক্ত কবিতা - `বাংলা, ১৯৬৪', `বন্যা : ১৩৭৫' । রাম গেছে বনবাসে (১৯৮১) গ্রন্থে আছে- `আইন : ১৯৭৫' ।
উদ্ধৃত তালিকায় কেবল কবিতাগুলির নামের উপর চোখ রাখলেই যেন ইতিহাস কথা বলতে থাকে । সাম্যবাদে আস্থা ছিল দিনেশ দাসের । `এ যুগের চাঁদ হল কাস্তে'- এই আশ্চর্য পঙ্ক্তিবিশিষ্ট কবিতাটিও ১৯৩৮ সালের শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকায় অরুণ মিত্রের নির্বাচনে প্রকাশের আলো দেখেছিল । কিন্তু সাম্যবাদের বিশ্বাস তাঁকে একচক্ষু করে দেয়নি । ইতিহাসের পদচিহ্ন তিনি যতটা যথার্থভাবে উপলব্ধিতে আনতে পেরেছিলেন ততটা তখন অনেকেই পারেননি । গান্ধীজি আর সুভাষচন্দ্র বসুর মতের সঙ্গে মিল না থাকলেও দেশব্রতীরূপে যে শ্রদ্ধা তাঁদের প্রাপ্য ছিল তা তখন অনুভব করতে পারেননি সাম্যবাদীদের অনেকেই । সেই ভুলের দাম তাঁদের দিতে হয়েছে দীর্ঘকাল ধরে । দিনেশ দাস কিন্তু ভুলটি করেননি । `ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের নায়ক গান্ধীজিকে স্মরণ করে তিনি `ভারত ছাড়ো : ১৯৪২' কবিতাটি লিখেছিলেন -
চেয়ে দ্যাখো কত যোজন দীর্ঘ পড়ে আছে আড়াআড়িকবিতাটি তাত্পর্যময় । `ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের উন্মাদনা প্রত্যক্ষ করে এবং অনুভব করে দিনেশ দাস এই কবিতায় গান্ধীজিকে `কালের দৌবারিক' বলে সম্বোধন করেছেন । তবু কিন্তু এই আন্দোলনের ফল-পরিণাম রূপে সেই মুহূর্তেই স্বাধীনতা আসেনি ভারতবর্ষে । এসেছিল তারও পাঁচ বছর পরে, বহু আলোচনা, কূটনীতি, স্বার্থ-সংরক্ষণের পথ ধরে দেশকে টুকরো করবার পর । হয়তো সেই কারণে হতাশা স্পর্শ করেছিল কবিকে যখন কেবলই কিছুটা তরঙ্গ-উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করে থেমে গেল এই আলোড়ন । হয়তো কিছুটা বিষাদভরেই কবি উচ্চারণ করেছিলেন - "এই বালুময় সময়ের সৈকতও / তোমার চরণ চিহ্নেও সে তো রয়ে গেল অক্ষত ।" বিশাল দেশের ব্যাপ্ত পরিসর পরদেশি শাসকের শৃঙ্খলমুক্ত হল না । সময়ের সৈকতে, এমনকি গান্ধীজির আন্দোলনও নিয়ে এল না পরিবর্তন । পঙ্ক্তিটি কিছু বিতর্কমূলক সন্দেহ নেই । কিন্তু তা ছিল সেই সময়েরই বিতর্ক । সেই নির্দিষ্ট কালখণ্ড - ১৯৪২ এবং সেই বিশিষ্ট আন্দোলনটির ইতিহাস না জানলে সর্বকালের পাঠক অনন্তকালের পটভূমিতে স্থাপন করে এ কবিতার রস সম্পূর্ণ গ্রহণ করতে পারবেন না । কবিতার এই সময়-শর্তাধীন রসগ্রহণ ব্যাপারটাই অপছন্দ করতেন রবীন্দ্রনাথ ।
চল্লিশ কোটি জীবনের বালিয়াড়ি
অগ্নি তামাটে প্রখর সৌর করে
বালি আর কঙ্করে :
এই বালুময় সময়ের সৈকতও
তোমার চরণ-চিহ্নেও সে তো রয়ে গেল অক্ষত ।
দিনেশ দাসের আর একটি কবিতার নাম `বেতার ১৯৪৩' ( ভুখ-মিছিল (??)) । এক উদাত্ত আহ্বান যেন ধ্বনিত হচ্ছে ইথারতরঙ্গে, আলোড়িত করে তুলছে দেশের মর্মকেন্দ্র । কবিতাটিতে কেবল এই অনুভবই ব্যক্ত । কিন্তু কবিতা-শেষে কবি একটি `জ্ঞাপিকা' রেখেছেন পাঠকের জন্য - এই সময়ে মধ্যরাতে বেতারে ভেসে আসত প্রবাসী সুভাষচন্দ্রের কন্ঠস্বর । বাঙালি শ্রোতা প্রতীক্ষা করে থাকতেন সেই দেশপ্রেম-উদ্দীপ্ত মধ্যরাতের বাণী শুনে নেবার জন্য । কবিতাটির নামে সেই সাময়িক ঘটনাকেই দেওয়া হয়েছে গুরুত্ব ।
দিনেশ দাসের আর একটি কবিতার নাম `আইন ১৯৭৫' ( রাম গেছে বনবাসে, ১৯৮১) । স্বাধীন ভারতের প্রশাসন জরুরি আইন জারি করলে গণতান্ত্রিক দেশের ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষপাতী কবি অপরিমিত ক্ষুব্ধতায় লিখেছিলেন এই কবিতা -
ছোট ছোট মানুষের আইনকবিতার শিরোনামের `১৯৭৫' সালের ভারতের জরুরি আইনের ইতিহাস না জানলে কোনো পাঠকই এই কবিতার উত্স-উপলব্ধির শরিক হতে পারবেন না ।
লিলিপুটদের আইনের সুতো
আমাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে :
অথচ স্বাধীনতার পর
আমি কখনও আইন ভাঙিনি
আইনই আমাকে প্রত্যহ ভাঙছে ।
যে কবিরা রবীন্দ্রজীবনের শেষ দশকে আবির্ভূত হয়েছিলেন নতুন যুগের কিছু পরিবর্তিত কাব্যচিন্তা নিয়ে, তাঁদের সতর্ক, সচেতন দৃষ্টি ছিল কেবল ভারতের নয় - সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসের প্রতি । সুপষ্ট ইতিহাসমনস্ক আন্তর্জাতিকতাবোধ আধুনিক কবিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে তাঁদের বাল্য-কৈশোর কেটেছিল । হয়তো এই যুদ্ধের পূর্ণ তাত্পর্য তখনই তাঁরা বোঝেননি । কিন্তু যখনই কৈশোর অতিক্রম করে তাঁরা বহির্বিশ্বের মুখোমুখি হলেন, তখনই বুঝে নিলেন যে, এই বিশ শতকীয় সভ্যতা ক্ষমতালোভী, সাম্রাজ্যবাদীদের হানাহানিতে বিপন্ন । সেই বিপর্যস্ত পৃথিবীতে ফ্যাসিবাদের উথ্থান থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত যে কাল-পর্ব - তাতে সচেতন মানুষের পক্ষে সম-সময়ের সুতীব্র আততি অনুভব না করে কোনো উপায় ছিল না । তাই আধুনিক কবিদের প্রত্যেকেই সমকাল-সচেতন এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সজাগ ছিলেন । তাঁদের অনুভবলোক, উপলব্ধির জগৎ এই খণ্ড-ইতিহাসকেই জীবনের অনন্ত বিপন্নতাবোধের প্রতীক করে তুলেছিল । তিরিশের কবিরা তিরিশের দশকে নির্দিষ্ট সময়-স্বাক্ষর-মুদ্রিত কবিতার বদলে মানব-মনের নিত্য-উপলব্ধির কবিতাই প্রধানত লিখলেও তাঁদের পক্ষে চল্লিশের দশকে - যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সত্যিই চলছে - তখন আর সমকাল-উদাসীন থাকা সম্ভব হয়নি । সে-রকম ইচ্ছেও করেননি তাঁরা । এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মতো কোনো সচেতন আপত্তিও তাঁদের ছিল না ।
তিরিশের কবিদের মধ্যে প্রথমাবধি সময়, স্বদেশ ও বিশ্ব-সমাজ সম্পর্কে অতীব জাগ্রত মনের কবি ছিলেন বিষ্ণু দে । সাম্যবাদী ভাবধারায় আকৃষ্ট ছিলেন বলে বাস্তব ইতিহাস সম্পর্কে এক সচেতন বিশ্ববীক্ষণ তিনি আয়ত্ত করেছিলেন । বিদগ্ধ ও সুপণ্ডিত এই কবি আন্তর্জাতিক কবিতার মানচিত্রটি সম্পর্কেও ছিলেন অবহিত । তিনি দেখেছিলেন, বিংশ শতাব্দের পাশ্চাত্য কবিরা সময়ের নির্দিষ্ট চিহ্ন কবিতায় মুদ্রিত করে দিতে কুন্ঠিত হন না । বিষ্ণু দে নিজেও সেই কুন্ঠা বোধ করেননি ।
বিষ্ণু দে-র অজস্র কবিতা আছে যেগুলিতে কালাঙ্ক মুদ্রিত হয়েছে স্পষ্টাক্ষরে । আমরা বেছে নিয়েছি সাত ভাই চম্পা সংকলনের দুটি মাত্র নিদর্শন । ফ্যাসিবাদ যখন ত্রক্রমেই ভীষণ আকার ধারণ করেছে তখন বাংলার লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা একযোগে তার বিরুদ্ধতা করতে দ্বিধা করেননি । এই বিরোধিতা আরও তীব্র হল যখন অনাক্রমণের চুক্তি ভঙ্গ করে রাশিয়া আক্রমণ করলেন হিটলার । তখন বিশ্বের একমাত্র সাম্যবাদী দেশ সোভিয়েত রাশিয়া । এই আক্রমণের ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই মর্মন্তুদ মনে হল বিশ্বের শুভবাদী মানুষের কাছে । বিষ্ণু দে এই ঘটনা নিয়ে কবিতা লিখলেন একেবারে সাল তারিখসহ । সাত ভাই চম্পা সংকলনের অন্তর্ভুক্ত কবিতার নাম `২২শে জুন, ১৯৪১' । এই দিনেই আক্রান্ত হয়েছিল রাশিয়া । কবিতাটিতে সরল ভাষ্যে হিটলার-এর নাম উল্লিখিত হয়নি । ঘটনাটিকে কেবলই দু-দেশের সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ করে দেখেননি বিষ্ণু দে । তিনি এই শিরোনামের কবিতাটিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সেই ঘন সংকটাপন্ন বিশ্ব-পরিস্থিতিকেই তুলে ধরেছেন -
জনগণমনে অধিনায়কের স্থান পূর্ণ করো বীর ।ঠিক এক বছরের ব্যবধানে কেবল সালটি বদলে দিয়ে দ্বিতীয় কবিতাটি লিখলেন বিষ্ণু দে - নাম `২২শে জুন, ১৯৪২' । তখন রাশিয়া মিত্রপক্ষের সহায়তা পেয়েছে । সেখানে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়েছে হিটলারের বাহিনী । উদ্দীপ্ত কবি লিখেছেন -
সেয়ানে সেয়ানে হোক কোলাকুলি
সংগোপনে : তবু চীন, রুশ -
দেশে দেশে কৃষাণ মজুর যত ঢেলে দেয়
তাদের পৌরুষ
স্বার্থের বর্ধিষ্ণু ছিদ্রে, বনেদির বনিয়াদে,
মুমূর্ষু অস্থির
জলে স্থলে যুদ্ধ চলে, ভারতেরও ভিত
টলে, প্রাণের নির্দেশে,
কলকাতার পূর্ণিমাও জটায়ুর পাখা ঝাড়ে
দূর দেশে দেশে ।
..... চোখে জাগে নবীন সভ্যতা,। উল্লেখ্য যে ২২শে জুন নামে একটি মিতকায় কবিতা-পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন বিষ্ণু দে স্বতন্ত্রভাবে । পরে সেটি সাত ভাই চম্পা -র সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় । নির্দিষ্ট কাল-জ্ঞাপক কবিতাকে, খণ্ডকালের ইতিহাসকে এই কবিরা কতটা গুরুত্ব দিতেন তার দৃষ্টান্তরূপেই বিষয়টিকে দেখতে হবে ।
অজেয় প্রাণের অগ্নি রক্তাক্ত সে জনতার হাতে
মৃত্তিকাসন্তান যারা, মৃত্যুহীন, যুগান্ত সাক্ষাতে
নির্ভীক, কর্মিষ্ঠ যারা । তাই আজ উচ্ছ্বসিত কথা
আমাদেরও মৃত্যুহীন সমাজের করি জয়গান
উজবেক, তাজিক, তুর্কি, কাজাক - ও দূর হিন্দুস্তান
কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তন্বী (১৯৩০) থেকে উত্তরফাল্গুনী (১৯৪০) পর্যন্ত কবিতা-গ্রন্থ প্রকাশকালে সাধারণভাবে নিত্যকালের অনুভবকেই কবিতার সময়সূচক বাতাবরণ রূপে গ্রহণ করেছিলেন । কিন্তু তিনি ১৯৪০-এর পর তেরো বছর ধরে অল্প কয়েকটি কবিতা লিখলেন । প্রতিটি কবিতাতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত প্রাক্-কাল থেকে শুরু করে যুদ্ধ-অন্তিম বিশ্ব-রাজনীতির বিপর্যস্ত পটভূমির অতীব সুনির্দিষ্ট ছবি গাঢ় রেখায় এঁকে দিলেন তিনি । কবিতাগুলি সংকলিত হল সংবর্ত কবিতা-গ্রন্থে ১৯৫৩ সালে । সংবর্ত শব্দের অর্থ `প্রলয়কালীন মেঘ' তথা `প্রলয়' । এই কবিতা-গ্রন্থটির পঠন আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস পাঠ একই সঙ্গে করা আবশ্যিক । স্থানের নাম, ব্যক্তির নাম, ঘটনার প্রসঙ্গ-উল্লেখ এবং সালের উল্লেখ - এই কবিতার বইটিকে চল্লিশের দশকের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির একটি ঐতিহাসিক দলিল করে তুলেছে । এই প্রবণতার প্রথম আভাস অবশ্য পেয়েছিলাম ত্রক্রন্দসী (১৯৩৭) সংকলনের `উটপাখি' কবিতার `উনতিরিশে' শব্দটির প্রয়োগে ।
সংবর্ত -এর প্রতিটি কবিতার সঙ্গে প্রদত্ত আছে রচনাকাল । সেই কালের সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে হবে কবিতা । যে কবিতাগুলি ১৯৩৮ এবং ১৯৩৯-এর প্রথম দিকে রচিত সেগুলিতে ফ্যাসিবাদের প্রতি ঘৃণা নিক্ষিপ্ত, কিন্তু যুদ্ধের প্রত্যক্ষ বর্ণনা নেই কারণ যুদ্ধ তখনও শুরু হয়নি । যে কবিতার রচনাকাল ১৯৪০, তাতে হিটলার ও স্তালিনের মধ্যে স্বাক্ষরিত অনাক্রমণ চুক্তি প্রসঙ্গে কবির অস্বস্তি ও বিরাগ প্রকাশিত । সেই যুগে এই চুক্তি সম্পর্কে এ-জাতীয় বিরুদ্ধতা অনেকের মনেই ছিল । তখনও সোভিয়েত রাশিয়া হিটলার-এর দ্বারা আক্রান্ত হয়নি । যুদ্ধশেষের সূচক কবিতার নামই কবি রেখেছেন `১৯৪৫' । ১৯৫৩ সালে রচিত কবিতা `প্রত্যাবর্তন'-এ জাপানে আণবিক বোমা বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়ায় বহু অসুস্থ মানুষের উল্লেখ আছে ।
তরুণতর যে কবিরা চল্লিশের দশকেই লিখতে শুরু করেছিলেন কবিতা তাঁদের রচনায় এই রাষ্ট্রনীতি-উত্তাল সময়-পর্বের প্রত্যক্ষ ছাপ থাকা খুবই প্রত্যাশিত । তিরিশের কবিরাই বরং এ ব্যাপারে তাঁদের মনোভঙ্গিকে যুগের সঙ্গে কালোপযোগী করে নিয়েছিলেন । চল্লিশের কবিদের মধ্যে সুকান্ত ভট্টাচার্যকে প্রতিনিধি নির্বাচন করা যায় । কালের ইতিহাস সালের ফলক-চিহ্নে তাঁর কবিতাতেই কথা বলে উঠেছে সবচেয়ে বেশি । ছাড়পত্র কবিতা-গ্রন্থের কয়েকটি কবিতার শিরোনাম - `চট্টগ্রাম- ১৯৪৩', `মধ্যবিত্ত ৪২', `সেপ্টেম্বর ৪৬', `ফসলের ডাক ১৩৫১' । ঘুম নেই কবিতা-গ্রন্থের কয়েকটি কবিতার শিরোনাম - `পয়লা মে-র কবিতা : ১৯৪৬', `একুশে নভেম্বর : ১৯৪৬', `১৯৪১ সাল', `রোম, ১৯৪৩' ।
সালের অজস্র উল্লেখ সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় । সব সময় তিনি সনগুলির তাত্পর্য ব্যাখ্যাও করে দেননি । ধরে নিয়েছেন পাঠকের কাছে স্বতই উদ্ভাসিত হবে সেই সময়ের ঝলক । চল্লিশের দশকের পরিস্থিতি তেমনই ছিল । রুশ বিপ্লাবাত্মক অনুষঙ্গে অক্টোবর ও নভেম্বর, শ্রমিক দিবস উপলক্ষে মে, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মাস আগস্ট, রবীন্দ্রনাথের জন্মমাস বৈশাখ - বারবার ঘুরে এসেছে তাঁর কবিতায় । `অনুভব' নামে সুকান্তের পরিচিত কবিতাটি উল্লেখ করা যায় । কবিতাটি দুই অংশে বিভক্ত । প্রথম অংশটি শুরু হয়েছে -
অবাক পৃথিবী ! অবাক করলে তুমি !
জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি !
- এই অংশটির উপ-শিরোনাম - `১৯৪০' ।
কবিতার দ্বিতীয় অংশের প্রারম্ভ
- বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে,এই অংশের উপ-শিরোনাম `১৯৪৬' । দ্বিতীয় উপ-শিরোনামটি ১৯৪৬ সালের ভারতের উত্তালতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় । `ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ' প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনও ১৯৪২-এ । `গণনাট্য সংঘ' প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৪-এ । নৌবিদ্রোহ, রশিদ আলি দিবস, বিভিন্ন ধরনের ধর্মঘট - ট্রাম কোম্পানিতে, ডাক ও তার বিভাগে, সুতোর কলে - সব ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৬- এর মধ্যে । তেভাগা আন্দোলনের সূত্রপাত ১৯৪৬- এ - `বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে' ।
আমি যাই তারি দিনপঞ্জিকা লিখে ।
এত বিদ্রোহ কখনো দেখিনি কেউ
দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ ।
বিশিষ্ট এক-একটি তারিখকেও যেন প্রতীকত্ব দিয়েছেন সুকান্ত তাঁর কোনো কোনো কবিতায় । একটি দৃষ্টান্ত - "কখনো হাত কেঁপে ওঠে খবর দিতে : বাইশে শ্রাবণ, বাইশে জুনে" ।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন আর হিটলারের রাশিয়া আক্রমণ - দুর্দিন হিসাবে এই দুটি তারিখের উল্লেখ করেছেন সুকান্ত । কবিজীবনের প্রথম পর্বে জীবনানন্দ মানবমনের নির্দিষ্ট দেশকালের বন্ধন অতিক্রম করেই কল্পনাকে বিস্তীর্ণ করে দিতেন । পলকে পলকেই তিনি বহু শতাব্দী অতিক্রম করে যেতে পারতেন । রবীন্দ্রনাথের অভিব্যক্তিতে যে-ভাবে খুব সহজেই চলে আসে `অনাদি কাল' `নিত্যকাল' ইত্যাদি শব্দবন্ধ, তেমনই জীবনানন্দ উচ্চারণ করতেন `হাজার বছর'- চিরকাল অর্থেই প্রায় ।
কিন্তু ফ্যাসিস্ট-উথ্থানের কালে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্-কালে জীবনানন্দের মনের চেহারা স্পষ্টভাবেই বদলেছিল । `জার্নাল ১৩৪৬' নামের একটি কবিতা স্থান পেয়েছে মহাপৃথিবী সংকলনে । অবশ্য মহাযুদ্ধের কালো ছায়া তেমন ঘনঘোর হয়ে পড়েনি । কবিতাটি কবির ব্যক্তিগত অনুভূতিরই উত্সারণ । তবু যে বিশেষভাবে খণ্ডকাল সচেতন হয়ে উঠেছেন কবি - এই কবিতা তারই নিদর্শন ।
এরপর থেকেই, বিশেষভাবে ১৯৪২ সাল থেকে, জীবনানন্দ অভ্রান্তভাবে সমকাল-সচেতন হয়ে উঠলেন । চল্লিশের দশকের রক্তাক্ত, প্রতিবাদী দিনগুলি তাঁকে ব্যবিলন, মিশর, নিনেভে, এসিরিয়া থেকে শ্রাবস্তী, বিদিশা, দারুচিনি দ্বীপ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এল আকাল-জর্জরিত, দাঙ্গা-বিধ্বস্ত, আন্দোলন-স্পন্দিত কলকাতায় । বারবার তাঁর কবিতায় চল্লিশের দশকের সাল উল্লেখিত হতে লাগল । `খেতে প্রান্তরে' ( সাতটি তারার তিমির ) কবিতায় তিনি এক বিষণ্ণ কৃষকের বর্ণনা করেছেন -
এদিকে দিনমান - এযুগের মতো শেষ হয়ে গেছেপ্রগাঢ় বিষাদ-দর্শনের ভাষায় কবি রচনা করেছেন `বিভিন্ন কোরাস' কবিতাটি - "নদীর চেয়েও বেশি উনিশশো তেতাল্লিশ, চুয়াল্লিশ, উত্ক্রান্ত পুরুষের হাল / কামানের ঊর্ধ্বে রৌদ্রে নীলাকাশ অমল মরাল / ভারতসাগর ছেড়ে উড়ে যায় অন্য এক সমুদ্রের পানে-" ভারতীয় উপমহাদেশের সংকটকালের সংকেত এখানে যেমন অমল মরালের ভারত-সাগর ত্যাগের চিত্রকল্পে - তেমনই উল্লিখিত সনগুলিতেও লিপিবদ্ধ হয়েছে ।
না জেনে কৃষক চোত-বোশেখের সন্ধ্যার বিলম্বনে পড়ে
চেয়ে দেখে থেমে আছে তবুও বিকাল
উনিশশো বেয়াল্লিশ বলে মনে হয়
তবুও কি উনিশশো বেয়াল্লিশ সাল ।
জীবনানন্দের `১৯৪৬-৪৭' কবিতাটির অমোঘ উদাহরণ হতে পারে কবিতার ইতিহাস-কাল নির্দিষ্টকরণ সম্পর্কে শেষ কথা । সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিধ্বস্ত কলকাতার রাস্তায় দাঁড়িয়ে কবি লিখেছিলেন - "যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হয়ে / বলে যাবে কাছে এসে, `ইয়াসিন আমি, / হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ আর তুমি' ?"....
রক্তনদী উদ্বেলিত হয়ে বলে যাবে, "গগন, বিপিন, শশী পাথুরেঘাটায়, / মানিকতলার, শ্যামবাজারের, গ্যালিফ স্টীটের এন্টালীর -"
`বনলতা সেন' -এর নিবিড় উচ্চারণ নয়, `হায় চিল' কবিতার বেতের ফলের মতো ম্লান চোখের স্মৃতি নয় বাংলার মুখের দিকে মুগ্ধ চোখ রেখে, বিশ্ব-বিস্মৃত হবার বাসনা নয় - সরাসরি হিন্দু আর মুসলমানের হৃত্পিণ্ড-ঘাতী রক্তপাতের ভাষা তখন কবিতার । `সাহিত্যে ঐতিহাসিকতা' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন "ইতিহাস যেখানে সাধারণ সেখানে ব্রিটিশ সব্জেক্ট ছিল, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিল না ।"
চল্লিশের দশকের বাংলার ইতিহাসকে `সাধারণ' বা নির্বিশেষ ভাবতে পারেননি সেই কালের শিল্পীরা । তাঁদের মনের কথা ছিল এরকম - ইতিহাস যেখানে গভীর সর্বনাশের দেশক সেখানে মানবিকতার বুকের উপরে নেমে আসা বৈনাশিক আঘাত বুক পেতে না নিয়ে কোথায় সরে থাকবেন কবি ।