ডা. ফ্রেডারিক ভ্যান আদেন (Dr. Frederik Van Eeden, 1860-1932) ছিলেন ওলন্দাজ সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক। বহুপ্রসবী লেখক, পেশায় ছিলেন মনস্তত্ত্ববিদ। লেখার মধ্য দিয়ে তাঁর দ্বৈতসত্তা প্রকাশিত হয়েছে — এক দিকে মহৎ নৈতিকতায় পৌঁছনোর জন্য তাঁর আর্তি, অন্য দিকে নিজেকে নিপীড়ন করা যৌনতাড়না। তাঁর অনুসন্ধান উপন্যাসের (১৯১১) নায়ক এক শিশু, সে খুঁজে বেড়াচ্ছে সত্য কাকে বলে। তাঁর কবিতা এবং নাটকের মধ্যেও প্রকাশ পেয়েছে একই সঙ্গে ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যবোধ, যৌনতাড়না এবং তত্সহ চিন্ময়স্বরূপের জন্য তৃষ্ণা।
ডাক্তারি পাশ করেন আমস্টার্ডাম থেকে — এখানে তাঁর সহপাঠী বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন উইলহেল্ম ক্লুস (Willem Kloos) এবং অ্যালবার্ট ভেরওয়ে (Albert Verwey)। ১৮৮৫ সালে তিনি এঁদের সহায়তায় De nieuwe gids (The New Guide : `নতুন পথের দিশারী') নামক একটি উজানপত্রিকা বা লিট্ল ম্যাগাজিন প্রকাশ করেন। সমাজকে কীভাবে বদলানো যাদ সেই বিষয় নিয়ে তরুণ লেখকরা এই পত্রিকায় লিখতেন। পরে তিনি উত্তর হল্যাণ্ডে হিলভারসাম-এর কাছে বাসাম নামক স্থানে একটি ক্লিনিক স্থাপন করে অঙ্গসঞ্চালন চিকিত্সা (Physiotherapy) আরম্ভ করেন। ১৮৯৮ সালে তিনি মার্কিন চিন্তাবিদ থোরো-র আদর্শ অনুসরণ করে ওয়াল্ডেন নামে একটি কৃষিনির্ভর কলোনি প্রতিষ্ঠা করেন।
ভ্যান আদেন-এর ব্যক্তিত্ব ছিল বহুমুখী, মূলত নীতিবাদী। তাঁর বিষয়ে আলোচকরা টলস্টয়ের* সঙ্গে তাঁর নানা সাদৃশ্য লক্ষ করেছেন। বহু দ্বিধা ও বাদানুবাদের পরে ১৯২২ সালে তিনি রোমান ক্যাথলিক ধর্মে যোগদান করেন।
যৌবনে দেশে ও দেশের বাইরে তাঁর খ্যাতি ছিল মূলত আদর্শবাদী সামাজিক ধারণার বাহক, কিন্তু ত্রক্রমে তিনি সাহিত্যিক হিসেবেই পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর সবচেয়ে পরিচিত রচনা হল একটি উপন্যাস De Kleine Johannes ( ছোট্ট জন ), 'নতুন পথের দিশারী' পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় বেরিয়েছিল, The Quest নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয় (১৯০৭)। একজন অতি সাধারণ মানুষ, চারপাশের পৃথিবীর কঠোর বাস্তবের সঙ্গে, আশাহীনতার সঙ্গে পরিচিত হতে হতে সে বড়ো হয়ে উঠছে। শেষ পর্যন্ত সে মানুষের ভালো করার মধ্যেই জীবনের অর্থ খুঁজে পায়। জীবনের প্রতি নায়কের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে একটিমাত্র বাক্যে আকৃতি দিয়েছেন আদেন — 'যেখানে মানুষ, যেখানে তার দু:খবেদনা, সেখান দিয়েই আমার পথ'। প্রতীকধর্মী এই রূপকথার কাহিনীটি তাঁকে বিপুল খ্যাতি এনে দেয়।
প্রথম জীবনে আদেন হিন্দু দর্শনের দ্বারা, বিশেষত তার আত্মার ধারণার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরিণত জীবনে তিনি প্রটেস্টান্ট থেকে রোমান ক্যাথলিক হয়ে যান।
আদেন এই নীতিবোধ যে কেবলমাত্র লেখার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করেছেন তাই নয়। আমেরিকান লেখক হেনরি ডেভিড থোরো-র আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর ওয়াল্ডেন (১৮৫৪)-এর আদর্শে উত্তর হল্যাণ্ডের বাসাম প্রদেশে একটি সমবায় সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি — তারও নাম দিয়েছিলেন ওয়াল্ডেন। এখানকার সদস্যরা নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যথাসম্ভব নিজেরাই প্রস্তুত করে নিতেন, সকলে সমস্ত দ্রব্য সমান ভাগে ভাগ করে নিতেন। আদেন নিজে জীবনযাত্রার যে মানে অভ্যস্ত ছিলেন তার চেয়ে অনেক নিম্ন মানে জীবন কাটাতেন এখানে।
ইংরেজি গীতাঞ্জলি পাঠ করে আদেন রবীন্দ্রনাথের ভক্তে পরিণত হন। তিনি রবীন্দ্রনাথকে লেখেন (২৮ জুলাই ১৯১২) :
...আমি আপনার গীতাঞ্জলি আমার নিজের মাতৃভাষায় তর্জমা করছি। এ কাজ যখন করি, মনে হয় যেন নিজেই গান সৃষ্টি করছি আমি। এই কবিতাগুলোর যত কাছে আমি পৌঁছেছি, এত কাছে আর কেউ পৌঁছতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না — আর পৃথিবীতে আপনিই একমাত্র মানুষ যাঁকে আমার নিজের চেয়ে বড়ো মনে হয় — অন্তত গানে। আমি যে দেশে মাঝে মাঝে প্রবেশাধিকার পাই, আপনি সেখানকার স্থায়ী নাগরিক।...
(রবিজীবনী, খণ্ড ৬, পৃ. ১২৬ থেকে অনূদিত)
এর তিন দিন পরে তিনি রবীন্দ্রনাথকে হল্যাণ্ডে নিমন্ত্রণ করেন।
এই পত্রবিনিময়ের ফলে উভয়ের মধ্যে এক দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুতার সূত্রপাত হয়। ডা: আদেনকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলির লিপিচিত্র শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবন সংগ্রহে রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লেখেন, অনুবাদের ব্যাপারে তিনি ফক্স-স্ট্র্যাংওয়েজকে রাজি করাবেন, আরো লেখেন ইউরোপ ত্যাগ করবার আগে তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনার কথা। ডা: আদেন তাঁকে 'ডিয়ার ফ্রেণ্ড' সম্বোধন করে চিঠি দেন, উত্তরে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দীর্ঘ ও আবেগপূর্ণ চিঠি লেখেন। তাঁরা প্রায় সমবয়সী, আদেন এক বছরের বড়ো। আদেনকে লেখা একটি চিঠি থেকে তাঁর প্রতি রবীন্দ্রনাথের মনোভাবটি আমরা অনুমান করতে পারি :
প্রিয় বন্ধু,
আমি এখনো ডাক্তারের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাইনি—তা ছাড়া আমার পরের কবিতার বইটি বেরোবে, আমার বক্তৃতাগুলিও বই আকারে প্রকাশিত হবে—এই সবের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে আছি। ফলে আটকেও আছি ইংলণ্ডে। ইউরোপ মহাদেশের যেসব দেশের কথা বইতে পড়েছি সেই সব অঞ্চলে ভ্রমণ করবার বাসনা আমার উদগ্র হয়ে উঠেছে, কিন্তু জানি না পেরে উঠব কিনা। কারণ আমার পুত্র ও পুত্রবধূ আমার সঙ্গে চলেছেন, এবং আপনাদের দেশে ভ্রমণ করা আমাদের পক্ষে বড়োই ব্যয়সাপেক্ষ।
বন্ধু আমাকে বিশ্বাস করুন, আমার হৃদয় আপনাদের প্রতি ধাবিত হচ্ছে কিন্তু আমি নিরুপায় হয়ে বসে আছি। আপনার সঙ্গে যে ভাষায় আমাকে কথা বলতে হবে সে আমার নিজের ভাষা নয়। আমার মধ্যে শ্রেষ্ঠ যা আছে তা আমি গানে প্রকাশ করি—না, আমি প্রকাশ করি বলতে পারি না—তা নিজে নিজেই বেরিয়ে আসে। আমার অতিজাগতিক মন, যা সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে আপনাকে প্রকাশ করে, তা আমার শাসনের অতীত—আমার সাধারণ ব্যক্তিত্ব অন্য লোকের সামনে বিব্রত ও লজ্জিত হয়ে থাকে। আমার প্রায়ই মনে হয়, আমি যেন একটি বাঁশি—বাঁশি কথা বলতে পারে না, কিন্তু ফুঁ পড়লে গান গেয়ে ওঠে। আমার বইতে এই কথাটি আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন আমাদের যখন সাক্ষাৎ হবে আমি নিজেকে কখনোই আপনার সামনে মেলে ধরতে পারব না—প্রদীপের দেহ তো অন্ধকার, তার কোনো নিজস্ব ভাষা নেই—ভাষা আছে শুধুমাত্র তার আলোর।
দেখতে পাচ্ছি আমার অনেক বন্ধুলাভ হয়েছে যাদের সঙ্গে আমার কখনো দেখা হবে না—কিন্তু আমি তাঁদের সঙ্গে মিলিত হতে পারি আমার ঈশ্বরের মধ্যে—আমার দিনের উপাসনার মধ্যে দিয়ে আমি তাঁদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা নিবেদন করে দিই।
নিতান্ত আপনার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(মূল পাণ্ডুলিপির প্রতিলিপি : রবীন্দ্রভবন, শান্তিনিকেতন। সিলেক্টেড লেটার্স অব রবীন্দ্রনাথ টেগোর, পৃ. ১২২ থেকে অনূদিত)
৪ সেপ্টেম্বর তারিখে ডা: আদেন প্রায় ভবিষ্যদ্বাণীর ভঙ্গিতে তাঁকে লেখেন :
... আপনি অতি শিগগিরই ইউরোপে একজন বিখ্যাত মানুষ বলে গণ্য হবেন। আপনার বিষয়ে আমি Mercure de France পত্রিকাগোষ্ঠীর সভায় একটি প্রবন্ধ পড়লাম—মনে হয় আপনার খ্যাতি চিরস্থায়ী হবে... ইউরোপে আপনার বাণী সেই রকম প্রয়োজন, যেমন প্রয়োজন মরুভূমির মাঝখানে এক পেয়ালা জলের। কারণ, সারা ইউরোপে আপনার মতো তাঁর [ঈশ্বরের : Him ] ব্যাখ্যাতা আর কেউ নেই—কোনো ধর্মে নেই, কোনো দর্শনে নেই। সারা পৃথিবী অপেক্ষা করে আছে, আপনি এসে আপনার কথা ও গান দিয়ে মানুষকে প্রণোদিত করবেন বলে।...
(রবিজীবনী, খণ্ড-৬, পৃ. ৪২৫ থেকে অনূদিত)
যে প্রবন্ধটি পড়বার কথা এখানে ডা: আদেন উল্লেখ করেছেন, সেই সভায় সেই প্রবন্ধ শুনে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে আগ্রহান্বিত হয়েছিলেন জার্মান কবি রাইনার মারিয়া রিলকে।
আদেন-এর করা গীতাঞ্জলির -র ডাচ অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৩ নভেম্বর ১৯১৩ তারিখে, যেদিন রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষিত হচ্ছে। পরবর্তী দশ বছরে (১৯১৩-২৩) তিনি ত্রক্রমান্বয়ে অনুবাদ করেন দ গার্ডনার, ওয়ান হাণ্ড্রেড পোয়েম্স অব কবীর, দ ক্রেসেন্ট মূন, সাধনা (২ খণ্ডে) চিত্রা ক্ষুধিত পাষাণ (গল্পসংগ্রহ: দুই খণ্ডে) ঘরে বাইরে দ ফিউজিটিভ এবং টেগোরের দেশ থেকে নামে ছিন্নপত্র থেকে নির্বাচিত অংশ। কোথাওই তিনি আক্ষরিক অনুবাদ করেননি, ভাবানুবাদ করেছেন বইগুলি বেরিয়েছে ছোট ছোট, সুন্দর চেহারায়—এই বারোটি সুদৃশ্য বই তখন হল্যাণ্ডের সমস্ত বইয়ের দোকানে কিনতে পাওয়া যেত। বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল বইগুলি, কোনো কোনোটি আজও বিস্মৃত হয়নি—অন্তত গীতাঞ্জলি ও কবীর পুনর্মুদ্রিত হয়েছে ১৯৫০ এবং ১৯৫৭ সালে (রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ পর্যন্ত সময়ের হিসেব)।
দীর্ঘকাল ডা. আদেন-এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্বপূর্ণ পত্রব্যবহার হয়েছে। মাঝে মাঝেই তিনি রবীন্দ্রনাথকে হল্যাণ্ডে আসতে অনুরোধ করে পাঠাতেন। রবীন্দ্রনাথেরও যাবার ইচ্ছে ছিল না তা নয়, যেমন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হবার ঠিক আগে একটি চিঠিতে তিনি লিখছেন (১৩ জুলাই ১৯১৪) :
... মনে হচ্ছে সেপ্টেম্বরে যেতে পারব না। সত্যি যদি যেতে পারতুম, আপনার সঙ্গে পরিচয় হত, মানুষের ভালো করবার নিষ্ফল প্রয়াসে, কোনো লক্ষ্যের অভিমুখে না গিয়ে উদ্দ্যেশ্যহীনভাবে কেবল এক পরিকল্পনা থেকে আরেক পরিকল্পনায় লাফিয়ে বেড়াতে না হত, তাহলে আনন্দও পেতুম বিশ্রামও লাভ হত। এখানকার একটি নিস্তব্ধ অঞ্চলে আমার একটি বোর্ডিং স্কুল আছে সেখানে আমি কাজও করতে পারি, আবার বিশ্রামেরও ব্যাঘাত ঘটে না। সত্যিকারের কোনো বড়ো ডাক না এলে এখান থেকে আমার নড়তে ইচ্ছে করে না। সেই রকম ডাক এসেছিল যখন দুবছর আগে ইউরোপের দিকে যাত্রা করেছিলুম। সে রকম ডাক নিশ্চয়ই আবার আসবে—কিন্তু তার জন্যে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে।...
(রবিজীবনী, খণ্ড-৭, পৃ. ২৩ থেকে অনূদিত)
আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার হৃদয়হীনতা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ও আদেনের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা একই রকমের ছিল। বিশ্বযুদ্ধকে উপলক্ষ করে আসুরিক শক্তিপ্রদর্শনের বীভত্স নেশা যে ইউরোপের তথাকথিত উন্নত জাতিগুলিকে মাতাল করে তুলছে, এই জাতীয় মত তাঁদের উভয়েরই চিঠিপত্রে একাধিক বার প্রকাশ পেয়েছে। ডা: আদেনের ১৫ অক্টোবর ১৯১৯ তারিখের চিঠির জবাবে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লেখেন (১৯ নভেম্বর ১৯১৯) :পি>
... মেশিনগান ও যুদ্ধবিমানগুলি পাইকারিভাবে মৃত্যু সরবরাহ করে চলেছে কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে কোন কাজে লাগবে এগুলি? চতুর ও কুত্সিত খেলনা হওয়া ছাড়া এগুলির কি আর কোনো আকর্ষণ আছে? বিজ্ঞানের কৌশল বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ মানুষ যখন এগুলি দেখে মূক আতঙ্কে অভিভূত হবে, তখন তাদের দেখে হাসি পাবে একমাত্র তাদের, কোনো রকম মানবিক আবেগ যাদের বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করতে পারে না। নিজের চোখকে আমরা বিশ্বাস করতে পারি না, যখন বিজ্ঞানের কৌশলে দানবে পরিণত হওয়া মানুষকে নিরস্ত্র নারী ও শিশুদের উপর তার আধুনিকতম মারণাস্ত্র ব্যবহার করতে দেখি। ওই সব ভয়ঙ্কর অস্ত্র তাদের উপরে প্রয়োগ করার কোনো দরকারই নেই—ওর এক মাত্র সার্থকতা হল ওর অস্বাভাবিক রকম অহংকারী মালিকের অন্যকে ভয় দেখাবার উপায় হিসেবে।
ইউরোপের মহত্ত্ব ও উদারতার যে ইতিহাস, সে কি একটা গল্পকথা মাত্র? নাকি তার মানবতার এই অপমানের পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠবার পিছনে অন্য কোনো গোপন কারণ আছে? হে আমার বন্ধু, এই বিপুল দুর্দিনে আমার হৃদয় আপনার প্রতিই ধাবিত হচ্ছে, কারণ সমগ্র ইউরোপে সামান্য যে কজন মানুষ আছেন যাঁরা এই দুর্দৈবকে তার শিকড়সমেত উত্পাটন করতে চেষ্টা করছেন, আপনি তাঁদের অন্যতম।...
(রবিজীবনী, খণ্ড-৭, পৃ. ৪৫০-৫১ থেকে অনূদিত)
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার* (১৩ এপ্রিল ১৯১৯) প্রতিবাদে `স্যার' উপাধি বর্জনের (৩১ মে ১৯১৯) কিছু দিন পর ডা: আদেন রবীন্দ্রনাথকে লেখেন (২০ ডিসেম্বর ১৯১৯),
...পাঞ্জাবে যে নৃশংস ঘটনা ঘটে গেল, তার প্রতিক্রিয়ায় আপনার 'স্যার' উপাধি বর্জনের ঘটনাটি ইউরোপে আমরা সবাই অত্যন্ত ঔত্সুক্যের সঙ্গে লক্ষ করেছি। আমরা সকলেই আপনার কাজের প্রশংসা ও সমর্থন করি—ইংলণ্ডে অবশ্য আপনার এই কাজের খুবই কঠোর প্রতিক্রিয়া হয়েছে।...
ডা: আদেন তাঁকে বহুবার ডেনমার্কে যাবার জন্যে নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথেরও যাবার খুবই ইচ্ছে ছিল, কিন্তু নানা কারণে ১৯২০ সালের আগে তাঁর ডেনমার্ক যাওয়া ঘটে ওঠেনি। ১ ফেব্রুয়ারি ১৯২০ তারিখে আদেনকে লেখা রবীন্দ্রনাথের আর একটি চিঠি :
...সমগ্র পৃথিবীর উপরে ইউরোপ যে কী ভয়ংকর সর্বনাশ উদ্যত করেছে, নিষ্ঠুর হতাশার মধ্যে দিয়ে তা আমরা বুঝতে পারছি। তার বিজ্ঞানের যত শক্তি আছে সব পুঞ্জীভূত করে সে তার নিজের চতু:সীমার বাইরের পৃথিবীতে মানবের চরতম অপমান করতে উদ্যত হয়েছে। তার জ্ঞান যেহেতু বিজ্ঞানের জ্ঞান, আত্মার জ্ঞান নয়, ফলে মানবতা যে এক ও অবিভাজ্য এই শেষ সত্য তার অনুভূতিলোকের বাইরে থেকে যাচ্ছে মানবতার বিরুদ্ধে যত অন্যায় যত অপমান হয়ে চলেছে, সব তারই উপরে ফিরে আসবে। সম্প্রতি আমাদের দেশে ইংলণ্ড থেকে একটি অনুদান এসে পৌঁচেছে, `রিফর্ম বিল' তার নাম—তাতে আমাদের কিছু পরিমাণে স্বায়ত্তশাসন দেবার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিল তো দান নয়, যদি তার পিছনে দেবার মন না থাকে ! আমাদের মানসিক গঠন যদি না বদলায় তবে সমস্ত বরই শেষ পর্যন্ত অভিশাপে পর্যবসিত হবে—ডান হাত যা দান করেছিল বাঁ হাত তা চুরি করে নেবে।...
(মূল পত্রের প্রতিলিপি : রবীন্দ্রভবন, শান্তিনিকেতন। রবিজীবনী, খণ্ড-৭, পৃ.৪৬১ থেকে অনূদিত)
১৯২০ সালের মাঝামাঝি (রবীন্দ্রনাথ এখন আবার ইংলণ্ডে) তাঁর কাছে হল্যাণ্ডে যাবার আমন্ত্রণ এসে পৌঁছল নোবেল পুরস্কারের নিয়ম অনুযায়ী সুইডিশ অ্যাকাডেমিতে তাঁর বক্তৃতা করবার কথা ছিল, সে কথা জানতে পেরে নিকটবর্তী আরো কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ তাঁকে নিমন্ত্রণ জানায়। হল্যাণ্ডে তাঁর বক্তৃতামালা প্রদানের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়, এবং কয়েক দিনের মধ্যেই হল্যাণ্ডের নানা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে নানা আমন্ত্রণ বহন করে বহু চিঠি এসে পৌঁছয়। উত্সাহিত রবীন্দ্রনাথ বন্ধু আদেনকে লেখেন (১২ জুলাই ১৯২০),
...আপনার দেশে ভ্রমণের সময় আপনার সঙ্গে দেখা হবার সুযোগের জন্যে আমি সাগ্রহে অপেক্ষা করে আছি। ভ্রমণসূচি স্থির হলেই আপনাকে জানাচ্ছি।...'
আবার ২০ জুলাই লিখলেন,
`হল্যাণ্ডে পদার্পণ করেই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব বলে আশা করছি। সুইডেন এবং নরওয়ের পরে ডেনমার্ক—ডেনমার্ক থেকে হল্যাণ্ডে যাব। শিক্ষা নিয়ে যে কোনো রকম পরীক্ষানিরীক্ষা চলুক, তাতে আমার উত্সাহ আছে—তা ছাড়া কৃষকদের মধ্যে সমবায় আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেবার জন্যে কী কী করা হচ্ছে, তাও আমি জানতে আগ্রহী। ভারতে ফেরবার পথে জাভা ও বালিদ্বীপ হয়ে ফিরতে চাই, সে সম্পর্কেও কিছু জানতে পারলে ভালো হয়।...'
হল্যাণ্ডে রবীন্দ্রনাথকে যথোচিত সংবর্ধনা জানানোর জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল এর শাখা বিস্তৃত হয়েছিল নানা শহরে। কমিটির কার্যনির্বাহী সম্পাদক য়োসে ভিগেভেনো জানিয়েছিলেন, হল্যাণ্ডের নানা স্থানে বসবাসের জন্য অনেকগুলি বাড়ি তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা আছে, আর সীমান্তের স্টেশনে তিনি নিজেই উপস্থিত থাকবেন যাতে শুল্ক-কর্তৃপক্ষের তল্লাসির হয়রানি তাঁদের স্পর্শ না করে। রাত দেড়টার সময় ট্রেন আমস্টার্ডাম-এ পৌঁছয়। তাঁর আসার সংবাদ কোথাও প্রচার করা হয়নি, ফলে স্টেশনে ভিড় ছিল না তবে ডা: ফ্রেডারিক ভ্যান আদেন উপস্থিত ছিলেন। রথীন্দ্রনাথ তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, তাঁর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল আয়োজকদের ব্যবস্থাপনায় তিনি খুশি হননি—তবে তিনি কোনো অসুবিধারও সৃষ্টি করেননি। স্টেশনের বাইরে এসে মোটরে করে তাঁরা শহর থেকে প্রায় ১৫ মাইল দূরে হুইজেন-এ পৌঁছে ই. এইচ. ভ্যান ইঘেন এবং মেরি ভ্যান ইঘেন বোয়াঁসেভাঁ দম্পতির সমুদ্রতীরবর্তী প্রাসাদোপম বাড়ি ডে ডুইনেন (De Duinen) -এ আতিথ্য গ্রহণ করেন।
আদেন-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয় ২০ সেপ্টেম্বর ১৯২০—কিন্তু সাক্ষাত্টি সুখের হয়নি। এইদিন সকালে য়োসে ভিগেভেনো ও অভ্যর্থনা কমিটির কয়েকজন সদস্য এলেন কর্মসূচি স্থির করবার জন্যে। ডা: আদেনও ছিলেন। এত তাড়াতাড়ি করে সফরসূচি তৈরি করা ও বিশেষ করে `আমের্সফুট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অব ফিলসফি'তে বক্তৃতা করার প্রস্তাবে তাঁর আপত্তি ছিল, যদিও তা গ্রাহ্য হয়নি। পরের দিন লেখা একটি চিঠিতে তাঁর ক্ষোভ ব্যক্ত হয়েছে :
`আপনি বলেছিলেন জনতার সঙ্গে যোগাযোগের ঘূর্ণির মধ্যে আপনি প্রবিষ্ট হতে চান না কিন্তু এখন তো আপনি সোজা তার মধ্যেই ঝাঁপ দিতে চলেছেন ! আমি আপনাকে রক্ষা করবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমার চেষ্টা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।... শ্রীযুক্ত ভিগেভেনো অত্যন্ত বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন ভদ্রলোক, কিন্তু তিনি ইহুদি—এবং ইহুদি জাতির সমস্ত চরিত্রলক্ষণই তাঁর মধ্যে রয়েছে। তিনি আগামী পক্ষকাল ধরে আপনার গায়ে সেঁটে থাকবেন, এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়কে উপভোগ করবেন। কিন্তু তাতে মানবতার কী উদ্দেশ্য সাধিত হবে?... তাঁর কর্মসূচিতে এমন কোনো ফাঁক থাকবে না যেখানে আপনি চুপ করে থাকতে পারবেন কিছুক্ষণ, অথবা গভীর সুরে কথা বলতে পারবেন এমন সব মানুষের সঙ্গে যাঁরা মানবতার পক্ষে কথা বলতে পারবেন।'
রবীন্দ্রনাথকে অধিকার করে রাখার এই আকাঙ্খা বিদেশে ও দেশে অনেকবারই দেখা গেছে, যাঁরা সেই অধিকারলাভে বঞ্চিত হয়েছেন তাঁদের ক্ষোভ মাঝে মাঝেই দুর্বাক্য ও বিদ্রুপের চেহারায় বিস্ফারিত হয়েছে।
কার্যসূচি স্থির হয়ে যাবার পরে রবীন্দ্রনাথ ডা: আদেনের সঙ্গে তাঁর বাসস্থান বাসাম-এ যান। ডা: আদেন সাম্যবাদী আদর্শে সেখানে একটি জনপদ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে তাঁর প্রয়াস ব্যর্থ হয়। রথীন্দ্রনাথ তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন,
`...তাঁর সম্পর্কে আমাদের সকলেরই বেশ প্রতিকূল ধারণা হল। তাঁর কথাবার্তার মধ্যে থেকেও আমরা তেমন কোনো বুদ্ধিমত্তা বা বোধশক্তির ছাপ আবিষ্কার করতে পারলাম না। তিনি যে একজন পরাদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি তা তাঁর নিজের দেশেও কেউ স্বীকার করে বলে মনে হল না—সে জন্য তাদের যে খুব দোষ দেওয়া যায় তাও নয়।...'
এখানে রথীন্দ্রনাথ অবশ্য আদেনের উপর খুব সুবিচার করেন নি — তাঁর চিঠিপত্রে বুদ্ধিমত্তা বা বোধশক্তির ছাপ না থাকলে রবীন্দ্রনাথ এতদিন ধরে তাঁর সঙ্গে এত অন্তরঙ্গ কথার আদানপ্রদান করতেন না নিশ্চয়ই। তা ছাড়া, ইউরোপের শ্রেষ্ঠ মনীষীগণ যে আদেনকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন তা রবীন্দ্রনাথকে লিখিত রোমা রোলাঁর (দ্র) চিঠিতে তাঁর বিষয়ে সসম্মান উল্লেখ দেখে অনুমান করা যায় [দ্র. ডিয়ার মি: টেগোর : ৪১ নং চিঠি, পৃ. ৫৩]।
তবে এমনও হওয়া সম্ভব যে, ডা: আদেন চিঠিতে নিজেকে যত মেলে ধরতে পারতেন সামনাসামনি কথাবার্তায় ততটা পারতেন না। উদাহরণ হিসেবে ড: আরনসন তাঁর ডিয়ার মি. টেগোর সংকলনে যে চিঠিখানি ব্যবহার করেছেন [১৭ নং চিঠি], সেটি তুলে দিলেই বক্তব্যটি প্রতিপন্ন হবে। চিঠিটির ইংরেজি দুর্বল এবং বানান অস্থির, কিন্তু তার Dear Brother সম্ভাষণ থেকে শেষ শুভেচ্ছা জানানো পর্যন্ত যে ভাবটি ফুটে উঠেছে তাতে স্পষ্টতার কোনো অভাব নেই :
ওয়াল্ডার, বাসাম, হল্যাণ্ড
৭ জানুয়ারি, ১৯১৪
প্রিয় ভ্রাত:,
সংক্ষিপ্ত বটে, কিন্তু তবু যে চিঠিটি লিখতে পেরেছেন সে জন্য আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। Frankfurter Zeitung-এ আমি যা লিখেছি তা যখন পড়ে উঠতে পারবেন তখন বুঝবেন, কী অভ্রান্তভাবে আপনার মনের কথা ধরতে পেরেছি আমি। ঈশ্বরের দোহাই, দয়াপরবশ হয়ে আপনার পবিত্র পীঠস্থানটিকে ধনশিকারী ও রোমাঞ্চশিকারীদের দ্বারা আক্রান্ত হতে দেবেন না। কঠিন হতে হবে আপনাকে—কারণ মহান দায়িত্ব পালন করবার কাজ আপনার।
আশা করি আমার অনুবাদের ছোট বইটি আপনার হাতে পৌঁচেছে। দামটা কম রেখেছিলাম—প্রথম সংস্করণ কয়েক দিনের মধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। এবার ম্যাকমিলানদের সঙ্গে ব্যবস্থা করে খুশি হয়েছি। আশা করি লাভের টাকাটা ওদের হাতে না গিয়ে আপনার হাতে যাবে। আমার মনে হয়, শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যে পরীক্ষার কাজ আপনি হাতে নিয়েছেন সেখানে টাকা সব সময় কাজে লাগে।
আমার বইটা পড়ে ওঠার সময় পাননি শুনে দু:খিত হলাম—যেমন আশা করেছিলেন তা হয়নি, জাহাজেও পড়বার সময় পাননি। আমি আপনাকে আমার আর একটা বই পড়াতে চাই, `প্রসন্ন মানবতা', নিউ ইয়র্কের ডাব্লডে পেজ অ্যাণ্ড কোং থেকে বেরিয়েছে। আপনার আরব্ধ কর্মে এ বইটার গুরুত্ব থাকলেও থাকতে পারে, এতে আমার আত্মজৈবনিক মন্তব্যগুলো আছে, আমার জীবনের অভিজ্ঞতা আছে।
আমরা পাশ্চাত্যের মানুষেরা চাই, আপনি অনুপ্রাণিতের নতুন রাজ্য থেকে আমাদের সাহায্য করুন। বংশানুক্রমিক রাজাদের বিষয়ে যে কুত্সিত কুসংস্কার আছে এবার তার সমাপ্তি ঘটা উচিত। মানবজাতির আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব একমাত্র তিনিই দিতে পারেন যিনি প্রত্যাদিষ্ট, যিনি প্রতিভাশালী, যিনি পরমের নিকট থেকে প্রেমের বাণী লাভ করেছেন।
পুরোহিততন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং পূর্বসংস্কারসমূহের কুপ্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত কোনো রহস্যময় মানুষই শুধু পারেন মানবতার আধ্যাত্মিক কম্পাসের কাঁটাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে রাখতে—এই রকম একটি ব্যবস্থার সম্ভাবনার দিকে আমরা তাকিয়ে বসে আছি।
আপনি ছাড়া এই মুহূর্তে আর কোনো জীবিত মানুষের কথা আমি মনে করতে পারি না, যিনি এই দায়িত্ব নিতে সক্ষম। প্রাচী আপনাকে চেনে, আপনাকে ভালোবাসে। প্রতীচীও আপনাকে স্বীকার করে নিয়েছে। দয়া করে শীঘ্র আরেকবার ইউরোপে আসুন ! আমার বৃদ্ধা মাতা আছেন, আমার পরিবার আছে, তাদের ছেড়ে আমি যেতে পারি না—নাহলে আমিই যেতাম আপনার কাছে।
আপনার ভ্রাতার কাছ থেকে সকল শুভেচ্ছা সহ
ফ. ভ. আদেন
(ড. অ্যালেক্স অ্যারনসন সম্পাদিত ডিয়ার মি. টেগোর : পৃ. ২২-২৩ থেকে অনূদিত)
পরবাস, জানুয়ারি, ২০১১