বিপিনচন্দ্র পাল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন - 'উপাধ্যায় মহাশয়ের নামে একটা বাৎসরিক স্মৃতিসভার আয়োজন পর্যন্ত হয় না কেন?' মোহিতলাল মজুমদারও ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন - 'আজ সেই পুরুষসিংহকে ..... বাঙালি ভুলিয়াছে - কোন উপলক্ষ্যে একবারও স্মরণ করে না।' এই ২০১১ রবীন্দ্রনাথের মতো ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়েরও দেড়শ বছর, কিন্তু বাৎসরিক দূরে থাক, উপলক্ষ্য খুঁজে স্মরণ - তাঁকে স্মরণের ২টি বাদে কোনো খবর আমাদের জানা নেই। এ বড়ো লজ্জার কথা। আত্মগরিমা সম্পন্ন বাঙালির পক্ষে এই বিস্মৃতি বা উদাসীনতা বাঙালী চরিত্রের গৌরব বৃদ্ধি করে না।
এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে আমরা আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখব রবীন্দ্রনাথ ও ব্রহ্মবান্ধবের মধ্যেই। চারটি সূত্রে প্রসঙ্গ নিবেদিত হবে - ব্রহ্মচর্যাশ্রম, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও সম্পর্ক, চার অধ্যায়ের ভূমিকায় ব্রহ্মবান্ধবের উক্তি রূপে রবীন্দ্র উত্থাপন, রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর কাব্য বিষয়ে দুটি প্রবন্ধ।
আপাততঃ তাঁর জীবন প্রসঙ্গে জানানো যাক যে তাঁর জন্ম হিন্দু পরিবারে, একসময় রামকৃষ্ণের কাছে যান, পরে কেশবচন্দ্রের অনুগামী হিসাবে নববিধান ব্রাহ্মসমাজে যোগদান, এরপর প্রটেস্টান্ট হওয়া, পরে রোমান ক্যাথলিক (নিজেকে বলতেন ভারতীয় ক্যাথলিক), জীবন সায়াহ্নে হিন্দুমতে প্রায়শ্চিত্ত, কালীঘাটের কালী মন্দিরে মাতৃদর্শনে প্রত্যাদেশ - সন্দেহ নেই ধর্মচেতনায় ছিল নিয়ত অস্থিরতা, হয়ত সে কারণেই ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মন্তব্য সঠিক - 'উপাধ্যায়জী আজও আমাদের দেশে misunderstood হইয়া আছেন।' পাঠক মুচকি হাসবেন বিনয় সরকারের মন্তব্যে - 'ব্রহ্মবান্ধব একজন জবরদস্ত, স্বার্থত্যাগী ও নির্ভীক কর্মবীর। লোকটা ডানপিটে, ত্যাঁদড় আর ভবঘুরে।'
জানা যাচ্ছে ১৯০০ তেই ব্রহ্মবান্ধবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয়, কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়। কার্তিক লালের বেথুন রোর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ আসতেন। কবিকে চেয়ার ব্রহ্মবান্ধব আসনে বসা, ঘন্টার পর ঘন্টা আদর্শ বিনিময় চলত। তখন 'সারস্বত আয়তন' নামে একটা স্কুল সিমলা স্ট্রীটে চালাচ্ছিলেন ব্রহ্মবান্ধব ও তাঁর সিন্ধি শিষ্য রেবাচাঁদ। এই বিদ্যালয় ব্যবস্থা ছিল প্রাচীন আশ্রম পদ্ধতিতে গুরুকুল রীতির। চালিত হচ্ছে হিন্দুধর্ম ভাবনায়, ব্রহ্মচর্য ও সেবাধর্ম তাতে প্রাধান্য পায়। আর্থিকতাহীন এ বিদ্যালয়ে মনুষ্যত্ব অর্জনের লক্ষ্য ছিল। ঐতিহাসিক সুমিত সরকার দেখান এই সময় রবীন্দ্রনাথ তীব্রভাবে হিন্দুভাবনায় ভাবিত। নৈবেদ্য কাব্যে তার নানাবিধ প্রকাশ আছে, তৎকালীন প্রবন্ধেও আছে। এরপর আসবে শিল্পে ও শিক্ষায় আত্মত্যাগ ক'রে গ্রাম পুনর্গঠন, শিক্ষা নিরীক্ষা, তপোবন আদর্শ ও আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের সমন্বয় - এসব ভাবনায় চলে আসেন। এর আগেই আলাপ ব্রহ্মবান্ধবের সঙ্গে। বর্ণাশ্রম প্রথার আদি বিশুদ্ধ রূপটির পুনরুত্থান ঘটাতে চেয়েছিলেন ব্রহ্মবান্ধব। পিতার অনুমতি পাবার পর রবীন্দ্রনাথ যখন শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় (যা পরে ব্রহ্মচর্যাশ্রম) গড়বেন ঠিক করলেন তখন তিনি ব্রহ্মবান্ধবকে পেলেন। রবীন্দ্রনাথ যতই বলুন, রবীন্দ্রভক্তেরা যতই বলুন, আজ এটি প্রমাণিত সত্য যে ব্রহ্মবিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল উভয়েরই উদ্যোগে। ছিল - ভাবের ঐক্য। অধ্যাপনার আর্থিক ও কর্মভার লঘু হয়েছিল ব্রহ্মবান্ধব এবং রেবাচাঁদের সক্রিয়তায়। তিনি শুধুমাত্র রবীন্দ্রের 'সুহৃদ' ছিলেন না। এই বিদ্যালয়ের সূচনাকালীন ছাত্র ১০ জনের মধ্যে ৮ জনকে ব্রহ্মবান্ধবই নিয়ে আসেন, বাকি ২ জন - রবীন্দ্রপুত্র রথীন্দ্র ও শমীন্দ্র। এটাও জানা যায় ব্রহ্মবান্ধব কোনো দিনই এ বিদ্যালয়ের 'অধ্যক্ষ' ছিলেন না, নিয়মিত শিক্ষাকার্যে অংশ নেননি। মাঝে মধ্যে শান্তিনিকেতনে যেতেন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ আলোচনা হত, দর্শন বিষয়ক বিতর্কও থাকত। রথীন্দ্রনাথ তাঁর 'পিতৃস্মৃতি' বইতে এক পাঞ্জাবি পালোয়ানের সঙ্গে ব্রহ্মবান্ধবের কুস্তির লড়াই, পাঞ্জাবি পালোয়ানের হারের কথা জানিয়েছেন। কার্তিক চন্দ্র নন, যিনি ছিলেন ব্রহ্মবান্ধব ভক্ত ও রবীন্দ্রভক্ত, যার পুত্র সুধীরচন্দ্র বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রদের একজন তিনি রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করিয়ে দেন (২১ শ্রাবণ, ১৩৪০) যে রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মবান্ধব ও কার্তিকচন্দ্রকে শান্তিনিকেতনে যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে যান। তার কিছুদিন পর কার্তিক, ব্রহ্মবান্ধব, কার্তিকের এক আত্মীয়, পুত্র সুধীর শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রের অতিথি হন। 'আপনাদের মিলিত উৎসাহে তখনই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা শুরু হয়।' দু-এক দিন পরে আসেন রেবাচাঁদ। রবীন্দ্রনাথের বিদ্যালয় সূচনার ভাষণেও ছিল আদর্শায়িত হিন্দু অতীতের পুনরুদ্ধারের কথা, ১৯০২তেও তাই, ১৯০৪-এ স্বদেশী সমাজের নায়ক করতে চান গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে। রেবাচাঁদ বা অনিমানন্দ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও তত্ত্বাবধায়করূপে দিবারাত্রই ছাত্রদের সঙ্গে থাকতেন, ব্রহ্মবান্ধবের নির্দেশে, কবির সমর্থনে ক্লাসের পড়াশুনো ছাড়াও আশ্রম জীবনের সকল কাজ দেখাশোনা করতেন, তাতে অংশগ্রহণ করতেন। আহার ও বেশভূষায় কঠোর হিন্দুত্ব রাখার চেষ্টা হত, ব্রাহ্মণদের পৃথক ভোজনের ব্যবস্থা হয়। রেবাচাঁদের কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ছাত্রদের পছন্দ না হলেও তাঁর অভিভাবকত্ব খারাপ লাগে নি। আট মাস পরে ব্রহ্মবান্ধব ও রেবাচাঁদ আশ্রম সংশ্রব ত্যাগ করেন। এর কারণ কি ? ১৯৩৩ এ এইচ. সি. ই. জাকারিয়াস 'রেনাসেন্ট ইণ্ডিয়া - ফ্রম রামমোহন রায় টু মোহনদাস গান্ধী' একটি বই লেখেন। তাতে তিনি বলেন - ব্রহ্মবান্ধবদের স্কুলটাই বোলপুরে স্থানান্তরিত হয় এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুররের আপত্তিতেই ব্রহ্মবান্ধব ও রেবাচাঁদকে বিদ্যালয় ত্যাগ করতে হয়। রেবাচাঁদ নাকি বাইবেল পড়িয়ে ছাত্রদের খ্রীষ্টান করতে সচেষ্ট। 'মডার্ন রিভিউ' এবং 'প্রবাসী'-র সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এই দুটি কথারই তীব্র প্রতিবাদ করেন। বলেন - রবীন্দ্রনাথই বিদ্যালয়টি শুরু করেন, ব্রহ্মবান্ধব যোগ দেন অনেক পরে। রবীন্দ্রনাথ ও রামানন্দ দেবেন্দ্রনাথের আপত্তির কথাটি অস্বীকার করেন। রামানন্দ বলেন যে পরিস্থিতিতে দুজনের 'বিচ্ছেদ' ঘটে তা নিয়ে আমরা কিছু বলব না, বলতে বাধ্য নই। জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায় জানান ঠাকুর পরিবারের কিছু অভিভাবক ও সভ্যের আপত্তিতে দেবেন্দ্রনাথ তাঁদের না রাখায় মত দেন। প্রশান্ত কুমার পাল 'রবিজীবনী'তে জিতেন্দ্রর মন্তব্যকে 'বেশি নির্ভরযোগ্য' মনে করেন। দুজনের 'বিচ্ছেদ' কিন্তু ঘটেনি। ১৯০২ তেই ব্রহ্মবান্ধব, মাত্র সাতাশ টাকা ও একটি কম্বল সম্বল করে বিলেত চলে যান। সেখান থেকে রবীন্দ্রনাথকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন। কেম্ব্রিজে হিন্দু দর্শনের অধ্যাপনার জন্য একটি স্থায়ী পদ সৃষ্টির কথা হ'লে তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরামর্শ করেন। অনিমানন্দ মহর্ষির মৃত্যুর পর জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের দুই পুত্রের গৃহশিক্ষক ছিলেন, তাঁর বিদ্যালয়ে ১৯০৯, ৩০ মের পুরস্কার বিতরণী সভায় রবীন্দ্রনাথ সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। সন্তোষ মজুমদার এবং রথীন্দ্র আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর তাঁরা দুজনে অনিমানন্দের সঙ্গে দেখা করতে এবং তাঁকে শান্তিনিকেতনে ফিরে যাবার সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন।
তৃতীয় প্রসঙ্গ - চার অধ্যায়। বইটির প্রকাশ ২২ ডিসেম্বর, ১৯৩৪। প্রথম প্রকাশের সময় উপন্যাসের 'সূচনা'য় 'আভাস' নামে একটি অংশ ছিল। সেখানে আছে 'অন্ধ উন্মত্ততার দিনে' হঠাৎ একদিন জোড়াসাঁকোয় এলেন ব্রহ্মবান্ধব, নানা কথার শেষে চলে যাবার আগে ব্রহ্মবান্ধব বলেন - 'রবিবাবু, আমার খুব পতন হয়েছে।' চার অধ্যায় বিপ্লবীদের মর্মাহত করেছিল, দেউলী বন্দী নিবাসের রাজবন্দীরা রবীন্দ্রনাথকে ক্ষোভ নিবেদন করে চিঠি লেখে। ক্ষোভের মূল কথা - রবীন্দ্রনাথ এমন দুর্দিনে এ উপন্যাস লিখলেন কেন? বিপ্লবীদের সদর্থক কি কিছুই নেই? তখন থেকেই ব্রহ্মবান্ধবের এই উক্তি নিয়েও গৌণ ক্ষোভ জেগে উঠেছে। যা হোক, দেশব্যাপী ক্ষোভ দেখে রবীন্দ্রনাথ ২য় সংস্করণে এই 'আভাস' বাদ দিয়ে দেন। 'প্রবাসী' পত্রিকায় লেখেন 'কবির কৈফিয়ৎ' সেখানে বলতে চান (ক) একমাত্র আখ্যান এলা ও অতীন্দ্রের ভালোবাসা (খ) রাজনীতি নিতান্তই পরিবেশ রচনার জন্য (গ) উপাধ্যায় প্রসঙ্গ কেন এল 'এ প্রশ্ন নিশ্চয়ই জিজ্ঞাস্য'। কিন্তু এ জিজ্ঞাসার উত্তর রবীন্দ্রনাথ এ লেখায় দেন নি। বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় 'কবিগুরুর কৈফিয়ৎ' নামে একটি বড়ো লেখা লিখে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কিন্তু উপাধ্যায় প্রসঙ্গের উত্তর কে দেবে। তিনি তো সাতাশ বছর আগে মারা গেছেন। বন্ধু বা শিষ্যরাও কিছু লিখে যান নি। প্রশান্ত কুমার পাল একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন অনেকবছর পরে। তা হল - 'বৈদান্তিক সন্ন্যাসী থেকে রাজনৈতিক নেতায় বিবর্তনকে ব্রহ্মবান্ধব এক বিশেষ মুহূর্তে 'পতন' ('নিজের স্বভাব থেকে ভ্রষ্ট') বলে মনে করতেই পারেন।' আসলে রবীন্দ্রনাথ 'বিভীষিকা পন্থা'কে কখনই সমর্থন করেন নি, কাছের লোকজনদের বিপ্লব নিয়ে 'তোমাদের ভাববার দরকার নেই' (জামাইকে লেখা চিঠি) বলেছেন আর প্রচার করেছেন - চার অধ্যায় হল প্রেমের উপন্যাস। কিন্তু প্রফুল্লনাথ ঠাকুরকে ১৯৩৪ সালে রবীন্দ্রনাথ লেখেন - 'উপন্যাসটি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একটি যথার্থ প্রতিবাদ।' রবীন্দ্রভক্তরা যেমন স্মৃতিকথায় ব্রহ্মচর্যাশ্রম তৈরিতে ব্রহ্মবান্ধবের ভূমিকাকে এড়িয়ে গেছেন তেমনি চার অধ্যায় প্রসঙ্গে বিপ্লব পন্থার বিরোধিতা নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন নি, এটি এক প্রেমের উপন্যাস বলে রবীন্দ্র মন্তব্যকেই সমর্থন ক'রে গেছেন। আর, ঘটনা হল - রবীন্দ্রসদনে ১৯৩৪ এর খবরের কাগজের কাটিং এর ফাইল উধাও করে দেওয়া হয়েছে। ফাদার ফালোঁ শতবার্ষিকীতে একটি প্রবন্ধে চার অধ্যায় উপন্যাসে ইন্দ্রনাথ চরিত্রে ব্রহ্মবান্ধব কিছুটা আছেন বললেও গোরা উপন্যাসের গোরা চরিত্রে অধিকতর প্রতিফলনের কথা বলেছেন, বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্যের একই ধাঁচের প্রবন্ধ আছে গোরা ব্রহ্মবান্ধব ও রবীন্দ্রনাথ নামে। এ বিষয়ে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের মন্তব্য হল - গোরা, ঘরে বাইরে, চার অধ্যায় এই তিনটি উপন্যাসে গোরা, সন্দীপ, অতীন ও ইন্দ্রনাথের সঙ্গে ব্রহ্মবান্ধবের হুবহু মিল খোঁজা পণ্ডশ্রম, কিন্তু এইসব চরিত্রের মধ্যে ব্রহ্মবান্ধবের ছায়া আছে।