• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Rabindranath Tagore | প্রবন্ধ
    Share
  • 'প্রগতিসংহার', অমিতা সেন এবং রবীন্দ্রনাথ : গোপা দত্তভৌমিক


    || ১ ||

    শুধু প্রিয়জনের মৃত্যু নয়, প্রিয়জনের সঙ্গে মনোমালিন্য ও বিচ্ছেদ রবীন্দ্রনাথের জীবনে কম ঘটেনি। কোন ঘটনায় কে দায়ী সেই বিতর্কে যাওয়া এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য, তাঁর গানের কিংবদন্তী গায়িকা অমিতা সেন (খুকু) কীভাবে গল্পগুচ্ছের একটি গল্পে ধরা দিয়েছেন সেটিই আমরা একটু দেখব। অমিতা সেনকে নিয়ে বা তাঁর অসময়ে সমাপ্ত ছোটো জীবনের ব্যথাময় কাহিনী নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও কম নেই। এই মুহূর্তে আমার হাতে রয়েছে ব্যক্তিগত সম্প্রচারের জন্য প্রস্তুত একটি সি. ডি.। তাতে আছে খুকুর গাওয়া দশটি গান, আধেক ঘুমে নয়ন চুমে, ওগো দখিন হাওয়া, অলি বার বার ফিরে যায়, ও চাঁদ তোমায় দোলা, ফিরে ফিরে ডাক দেখি, চিনিলে না আমারে কি, তোমায় সাজাব যতনে, ওগো বধূ সুন্দরী, যে ছিল আমার স্বপনচারিণী, যদি প্রেম দিলে না প্রাণে। আশ্চর্য সুরেলা প্রাণবন্ত খোলা গলায় গাওয়া — একেবারে অন্যরকম। সিডির জ্যাকেটে আছে অমূল্য কিছু তথ্য।

    'কবির গানের ধারক ও বাহক দিনেন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ছেড়ে যাবার পর তাঁর একান্ত স্নেহের পাত্রী খুকু অমিতার গাওয়া গানে কবির নিজস্ব গায়কী ধরা থাকবে এ কথা তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন বলে কবি অসীম আগ্রহে প্রশান্ত মহলানবিশের ভাই বুলার সাহায্যে হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে ১০ খানি গান রেকর্ড করিয়েছিলেন; গানগুলি এই সঙ্কলনে পাওয়া যাবে। ১৯১৪তে খুকুর জন্ম আর মৃত্যু ১৯৪০। এই গানগুলির প্রকাশ তাঁর জীবনের শেষদিকে। খুকুর বহুমুখী প্রতিভার যে বিচ্ছুরণ সবাইকে মুগ্ধ করেছিল তার মধ্যে অন্যতম তাঁর গাওয়া গান। আশ্রমমাতা প্রতিমাদেবী আক্ষেপ করে বলেছিলেন, খুকুর গানের মতন এমন গান আর কারও গলায় শুনলুম না। কবি খুকুকে উদ্দেশ্য করে রচনা করেছিলেন — আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ।'

    খুকুর মৃত্যু ১৯৪০ সালে, আর ১৯৪১ সালে (১৩৪৮) আনন্দবাজার পত্রিকা শারদীয়া সংখ্যায় প্রকাশিত হল 'প্রগতিসংহার'। বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলীর গ্রন্থপরিচয় জানাচ্ছে গল্পটির পূর্বনাম ছিল 'কাপুরুষ'। গল্পপাঠে মনে হয় পূর্বনামটি অধিকতর প্রত্যক্ষ ছিল। ঐ নামে লেখকের ক্রোধ ও ধিক্কার তীব্রভাবে প্রকাশ পেয়েছে। 'প্রগতিসংহার' নামটি ইঙ্গিতময় এবং ঈষৎ ব্যঙ্গাত্মক হয়ে উঠেছে। কিঞ্চিৎ অবহেলিত গল্পটির বিষয়বস্তুর দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। প্রতিমা দেবীর বয়ান অনুসারে 'বদনামের' মতোই 'খেলার ছলে গল্প বলতে বলতে 'প্রগতি-সংহার' তৈরি হয়ে উঠেছিল।' পত্রিকায় তেসরা আশ্বিন প্রকাশিত গল্পটির রচনাকাল ১১-২১ জুন। ২২শে শ্রাবণ ঐ বছরই প্রয়াত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। গল্পটি প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পরে।

    গল্পটির আদি পটভূমি একটি কলেজ, যেখানে সহশিক্ষা চালু রয়েছে। মোটামুটি ধনী ঘরের ছেলেমেয়েরা পড়ে সেখানে। সরস্বতী পুজোয় ধুমধামে গাঁদাফুলের আকালের প্রসঙ্গ আসাতে বোঝা যায় শান্তিনিকেতন, প্রেসিডেন্সি বা স্কটিশচার্চ নয় — অন্য কোনো কলেজ। অবশ্য ছাত্রাবাসে সরস্বতী পুজো সব কলেজেই চলে সুতরাং শেষোক্ত দুটির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সুরীতি এই কলেজেরই ছাত্রী, পুরুষ সহপাঠীদের গৌরবে মুগ্ধা মেয়েদের মধ্যে সে যেন বহ্নিশিখা। শুধু মেয়েদের জন্য সে স্থাপন করেছে 'নারীপ্রগতিসংঘ'। সংঘের প্রধান অ্যাজেন্ডা হল পুরুষবিদ্রোহ। তাছাড়া পালে পার্বণে বাজে খরচ না করে গরিব ছাত্রীদের সাহায্য করার নৈতিক দায়িত্ব তার ছিল। কড়া স্বভাবের নেত্রী সুরীতির শাসনে কলেজে নারীপুরুষে একটা দূরত্ব তৈরি হল। ছেলেদের এগিয়ে এসে ভাব করা বা পাশে বসে সিগারেট খাওয়া রীতিমতো বিরক্তির দৃষ্টিতে দেখা শুরু হল। এই সংঘের মেয়েরা বিশ্বাস করত 'ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে বুদ্ধিতে কম। দৈবাৎ প্রায়ই পরীক্ষার ফলে তার প্রমাণ হতে থাকত।' 'দৈবাৎ' শব্দটি বুঝিয়ে দেয় মেয়েদের এই বিশ্বাসে লেখকের একেবারেই সায় নেই।

    কলেজের মেয়েরা পুরুষের মনভোলানো প্রসাধনে গহনায় ধিক্কার জানাল। পরনে বেরঙা খদ্দর চালু হল। সুরীতির মতে বিধাতা যাকে যেরকম রূপ দিয়েছেন তার উপরে রঙ চড়ানো অসভ্যতা। রবিঠাকুরের চিত্রাঙ্গদার দৃষ্টান্ত তার কাছে পেড়েছিল কেউ কেউ, 'চিত্রাঙ্গদা লড়াই করতে জানত, কিন্তু পুরুষের মন ভোলাবার বিদ্যে তার জানা ছিল না, সেখানেই তার হার হল।' সুরীতি বলেছিল 'ও আমি মানিনে। এমন অপমানের কথা আর হতে পারে না।' যদিও সব মেয়ের যে এমন নীরস জীবনরীতি পছন্দ ছিল তা নয়। ধনী ঘরের মেয়ে সলিলা চলে গেল বিরক্ত হয়ে দার্জিলিঙের সাহেবি কলেজে। ছেলেরাও নানারকমে উৎপাত শুরু করল সুরীতির ওপর। আধুনিক পরিভাষায় যাকে বলা হয় 'ইভটিজিং'। কলেজের আওতায় ঘটেছে বলে র‍্যাগিং এর নব অবতারও বলা যেতে পারে। কখনো সুরীতির বাবার হাতের অক্ষরে লেখা লেফাফা থেকে ফর্‌ফর্‌ করে ক্লাসে বেরিয়ে এল আরশোলা, কখনো ক্লাসে তার নোটবইয়ের পাতায় ছড়ানো কড়া নস্যির গুঁড়ো লাগিয়ে দিল হাঁচির হুলুস্থূল।

    ইভটিজিং থেকে ব্যাপারটা ক্রমে পৌঁছল প্র্যাকটিক্যাল জোকে। একদিন রব উঠল কোনো এক মহারাজা দেখতে আসবেন কলেজ, বিশেষ করে মেয়েদের ক্লাস। গুজব রটল আসলে তার উদ্দেশ্য বধূ জোগাড়। ক্রোড়পতি অতিথির জন্য মেয়েরা যেন আনমনে একটু আধটু সাজসজ্জা করে ফেলল। কিন্তু রাজদূত জানাল মহারাজের পছন্দ ঐ সুরীতিকেই।

    'সুরীতি জানে, এ রাজার তহবিলে অগাধ টাকার জোরে পুরুষ জাতির সমস্ত নীচতা কোথায় তলিয়ে যায়। ভান করলে এ প্রস্তাবে সে যে কেবল রাজি নয় তা নয়, বরঞ্চ সে অপমানিত বোধ করেছে। কেননা, মেয়েদের ক্লাস তো গোহাটা নয়, যে, ব্যবসায়ী এসে গোরু বাছাই করে নিয়ে যাবে। কিন্তু মনে মনে ছিল আর একটু সাধ্যসাধনার প্রত্যাশা।'

    সময়ে প্রকাশ পেল মহারাজাটি নকল। বাপ মার সম্পত্তি ফুঁকে ওড়ানো এক পুরোনো ছাত্র। এই সব উপদ্রবের নেতা ছিল নীহার। সে ছাত্র ভালো, বুদ্ধিমান এবং সংস্কৃত ও বাংলায় তার দখল যথেষ্ট। নানা অলঙ্কৃত বিশেষণে প্রকাশ্যভাবে ডেকে সুরীতিকে বিরক্ত করায় সে ছিল পারঙ্গম। ডিগ্রি নেবার সময় থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে চলত এই সব সম্বোধন, 'পরিণতশরচ্চন্দ্রবদনা', 'নিখিলবিশ্বহৃদয়-উন্মাদিনী', 'যৌবনমদমত্তমাতঙ্গিনী'। ক্লাসশুদ্ধু ছেলেকেও এই সব বিশেষণ শিখিয়ে কোরাস চলত। সুপারিন্‌টেন্ডেন্ট গোবিন্দবাবুকে নালিশ জানাল সুরীতি বারবার। সে উলটো ঠাট্টা করতে জানে না।

    "রাস্তায় ঘাটে এরকম সম্ভাষণ আমার সহ্য হয়না।"

    নীহার বললে "আমার অন্যায় হয়েছে। কাল থেকে ওকে বলব 'মসীপুঞ্জিতবর্ণা', কিন্তু সেটা কি বড্ড বেশি রিয়ালিস্টিক হবেনা।"

    সুরীতি প্রায় কাঁদতে কাঁদতে ছুটে চলে গেল।

    নীহারের চরিত্রে একটা নিরেট নিষ্ঠুরতা ছিল। যথোপযুক্ত ঘুষ দিয়ে তবে সেটাকে শান্ত করা যেত। এ কথা সবাই জানে।'

    ক্লাসে কটকটে আওয়াজ করা জাপানি কাঠের ব্যাঙ আনা নিয়ে ব্যাপারটা লঙ্কাকাণ্ডে পৌঁছল। সুরীতির ডেস্কেই ভরে রাখা হয়েছিল দশটা কেঠো ব্যাঙ। প্রতিবাদ জানানোতে মেঝেতে জুতো ঘষে ও মুখে সানাইয়ের আওয়াজ করে উৎকট কনসার্টের সৃষ্টি করল ছেলেরা। কলেজের সেক্রেটারি বা প্রফেসারদের ও আয়ত্তের বাইরে অবস্থাটা। নীহারকে কলেজ ছাড়তে হবে এমন পরিস্থিতি। সলিলা নিজের খরচে নীহারকে নিয়ে গেল দার্জিলিঙে — পড়ার ব্যবস্থা করে দিল। ধনী মেয়েদের আনুকূল্য নীহারকে বিশেষ প্রীত করত।

    'ছেলেরা কেউ কেউ ঈর্ষা ক'রে ও কেউ কেউ ঘৃণা ক'রে নীহারকে বলত 'ঘরজামাই'। নীহার তা গ্রাহ্যই করত না। তার দরকার ছিল পয়সার। যতক্ষণ পর্যন্ত তার ফিরপোর দোকানে বন্ধুদের নিয়ে পিক্‌নিক্‌ করবার খরচ চলত এবং নানাপ্রকার শৌখিন ও দরকারী জিনিসের সরবরাহ সুসাধ্য হয়ে উঠত, ততদিন পর্যন্ত সেই মেয়ের আশ্রিত হয়ে থাকতে তার কিছুমাত্র সংকোচ হতনা।'

    এই ব্যবস্থা অবশ্য বেশিদিন চলল না। ডবল নিমোনিয়া হয়ে মারা গেল সলিলা। তার উইলে মোটা কিছু টাকা পাবার আশা ছিল নীহারের। সে আশা পূর্ণ হয়নি। আবার সে ফিরে এল কলকাতার কলেজে। সলিলার মৃত্যু তাকে তিলমাত্র বিচলিত করেনি। সে সুরীতির সঙ্গে কথাবার্তায় সলিলার মৃত্যুর উল্লেখও করল না। সম্ভবত তখনি সে মেধাবী স্বাধীনচেতা মেয়েটির মধ্যে পরবর্তী শিকারকে আবিষ্কার করেছিল। ফ্রান্সের সর্বন ইউনিভার্সিটির এক ভারতপ্রত্নতত্ত্ববিদ্‌ পণ্ডিত এই সময় কলকাতায় এসে নীহারের সুবিধা করে দিলেন। প্রগতি সংঘ তাঁকে নিমন্ত্রণ জানাল কিন্তু সম্বর্ধনা সভায় অভিনন্দন পাঠে ফরাসী পণ্ডিতকে ফরাসী ভাষায় সম্মান প্রকাশের দায়িত্ব নিল নীহাররঞ্জন। তার ফরাসী শেখার পটভূমিটিও রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করতে ভোলেননি। 'নীহাররঞ্জনের বাড়ি চন্দননগরে। প্রথমবয়সে ফরাসীস্কুলে তার বিদ্যাশিক্ষা, সেখানে ওর ভাষার দখল নিয়ে খুব খ্যাতি পেয়েছিল।' ফলে অভিনন্দন পাঠ করে নীহার সকলের মন জয় করে নিল। তার ভাষার ছটায় ফরাসী পণ্ডিত এবং তাঁর অনুচররা আশ্চর্য হয়ে গেলেন।

    'বললেন, এ ছেলেটির উচিত প্যারিসে গিয়ে ডিগ্রি অর্জন করে আসা। তারপর থেকে ওদের কলেজের অধ্যাপকমণ্ডলীতে ধন্য ধন্য রব উঠল; বললে — কলেজের নাম রক্ষা হল, এমন-কি, কলকাতা ইউনিভারসিটিকে ও ছাড়িয়ে গেল খ্যাতিতে।'

    নীহার এবার বিখ্যাত হয়ে পড়ল। তার গুণপনার ধাক্কায় প্রগতিসংঘের বিধিনিষেধ ভেঙে পড়ল। সুরীতি যে মুগ্ধ তার প্রমাণ পাওয়া গেল যখন রঙ লাগল তার আঁচলে। সুপ্ত অনুরাগ তার আগেই ছিল — সলিলা নীহারের প্রিয় হয়ে ওঠাতে সে দুঃখ পেয়েছিল। এবার কলেজে নীহার যাকে বলে হিরো — মেয়েরা কেউ তাকে চায়ে ডাকছে, কেউ দিচ্ছে মূল্যবান গ্রন্থ উপহার। একটি মেয়ে নিজের হাতের এমব্রয়ডারি করা টেবিলঢাকাও দিল নীহারকে। সুরীতির মনের অবস্থা অনেকটা রবিঠাকুরের চিত্রাঙ্গদার মতোই হয়ে উঠল। ... 'ভাবল, 'আমি যদি এই-সব মেয়েলি শিল্পকর্মের চর্চা করতাম।' সে যে কোনোদিন সুঁচের মুখে সুতো পরায়নি, কেবল বই পড়েছে। সেই তার পাণ্ডিত্যের অহংকার আজ তার কাছে খাটো হয়ে যেতে লাগল। ... তার আত্মনিবেদন অন্য মেয়েদের চেয়েও আরো যেন জোর পেয়ে উঠল। সে নীহারের জন্য কোনো অছিলায় নিজের কোনো একটা ক্ষতি করতে পারলে কৃতার্থ হত।'

    নীহারের মেঝেতে পড়ে যাওয়া ফাউন্টেন পেন কুড়িয়ে দেওয়া থেকে নীহারের প্রতিটি অন্যায্য নির্দেশ মেনে নেওয়া পর্যন্ত তার প্রেম ও ভক্তি পৌঁছল। নীহার স্ত্রীস্বাধীনতার বিরোধী — সে বলে দেখা দেওয়ার দ্বারা মেয়েদের মূল্য কমে যায়। তাদের কমনীয়তার উপরে দাগ পড়তে থাকে। একদা প্রগতিসংঘের নেত্রী সুরীতি এই বিধানে সবার আগে নীহারকে সমর্থন করল। এমনকি পুরুষ অভিভাবকের সঙ্গে গিয়ে সিনেমা দেখাও নীহার হুকুমজারি করে বন্ধ করল। সুরীতি ভালো সিনেমা কখনো ছাড়ত না। এই অভ্যাসও সে ত্যাগ করল। নীহারের অনুমতি প্রয়োজন চাকরি নেবার ব্যাপারেও। স্কুলে খুব ছোটো পুরুষছাত্রও রয়েছে তাই অনুমতি মিলল না।

    'তার ফল হল সে অর্ধেক মাইনে স্বীকার করে মাস্টারি নিয়ে বললে, তার বাকি বেতন থেকে ছেলেদের আলাদা পড়াবার লোক রাখা হোক।'

    লজ্জার মাথা খেয়ে নীহারকে বিবাহ প্রস্তাবও পাঠিয়েছিল সুরীতি। 'সমাজের নিয়ম অনুসারে শুনতে পেল ওদের বিয়ে হতে পারে না কোনোমতেই। অথচ এই পুরুষের আনুগত্য রক্ষা করে চিরকাল মাথা নিচু করে চলতে পারে তাতে অপরাধ নেই, কেননা বিধাতার সেই বিধান।'

    শুধু নিজের স্কলারশিপ ও চাকরির টাকা নীহারকে পাঠিয়ে সুরীতি সন্তুষ্ট হতে পারল না। নীহারের চাকরির জন্য ও রীতিমতো চেষ্টা করতে লাগল।

    'একবার একটি কলেজে বাংলা অধ্যাপকের পদ খালি ছিল। সুরীতির অনুরোধে নীহারকে সে পদে গ্রহণ করবার প্রস্তাবে অনুকূল আলোচনা চলছিল। তাতে নীহারের নাম নিয়ে কমিটিতে আলোচনায় তার অহংকারে ঘা লাগল।' নীহারের মতে তাকে গ্রহণ করতে হলে বিনা তর্কে গ্রহণ করতে হবে, না হলে তার মান বাঁচবে না। তার বক্তব্য গর্বোদ্ধত,

    'আমি বাংলা ভাষায় এম. এ. তে সব-প্রথম পদবী পেয়েছি। আমি অমন করে কমিটি থেকে ঝাঁট দিয়ে নেওয়া পদ নিতে পারব না।'

    চাকরি না নেওয়ায় নীহার আর্থিক দিক থেকে সুরীতির উপরই নির্ভরশীল রইল। আত্মত্যাগের বাড়াবাড়িতে সুরীতির স্বাস্থ্য খারাপ হতে শুরু করল। তার অভিভাবকরা এই সর্বনাশা প্রেমের ফাঁদ থেকে মেয়েটিকে বাঁচাবার চেষ্টা করে বিফল হল। নীহারকে তারা বলেছিল, 'হয় তুমি একে বিবাহ করো, নয় এর সঙ্গ ত্যাগ করো।' নীহার বিবাহ করতে কোনোমতেই রাজি নয় আর সঙ্গের ব্যাপারে তার ঘোষণা নির্মম
           'সঙ্গ ইচ্ছে করলেই তো তিনি ত্যাগ করতে পারেন, আমার তাতে কিছুমাত্র আপত্তি নেই।'

    সুরীতি ভালো করেই জানত নীহারের কাছে তার কোনো মূল্য নেই, একমাত্র মূল্য তার আর্থিক সহায়তার।


           'সেই সুবিধাটুকু বন্ধ হলে তাকে অনায়াসে পথের কুকুরের মতো খেদিয়ে দিতে পারে।' তবু কখনো বই, কখনো নতুন খদ্দরের থান উপহার অব্যাহত রইল। মফস্বলে বেশি মাইনের প্রিন্সিপালের পদ পেয়েছিল সুরীতি কিন্তু তার সর্বদা মনে হত, 'আমি তো খুব আরামে আছি, কিন্তু তিনি তো ওখানে গরিবের মতো পড়ে থাকেন — এ আমি সহ্য করব কী করে।' অগত্যা আবার কলকাতায় সামান্য বেতনে শিক্ষয়িত্রীর পদ নিল সে। মাইনের বারো আনা যেত নীহারের পেট ভরাতে। রবীন্দ্রনাথ সুরীতির এই আত্মবিলোপী প্রেমের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। 'এই ক্ষতিতেই ছিল তার আনন্দ। সে জানত মন ভোলাবার কোনো বিদ্যে তার জানাই ছিল না। এই কারণেই তার ত্যাগ এমন অপরিমিত হয়ে উঠল। এই ত্যাগেই সে অন্য মেয়েদের ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। তা ছাড়া আজকাল উলটো প্রগতির কথা সে ক্রমাগত শুনে আসছে যে, মেয়েরা পুরুষের জন্য ত্যাগ করবে আপনাকে এইটাই হচ্ছে বিধাতার বিধান। পুরুষের জন্য যে মেয়ে আপনাকে না উৎসর্গ করে সে মেয়েই নয়। এই - সমস্ত মত তাকে পেয়ে বসল।'

    কলকাতায় সস্তায় এক বাসা ভাড়া করল সুরীতি, স্যাঁৎসেঁতে, রোগের আড্ডা — কলতলায় সর্বদা জল পড়ছে, ছাদে বেরোবার জো নেই। নিজে রান্না শুরু করল খরচ বাঁচাতে — রান্না সে জানত না। অখাদ্য অপথ্য খেয়ে দিন চলত কোনো মতে। ক্ষয়রোগ ধরা পড়ল তার। প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করাল আত্মীয়রা। তার গোপনে সঞ্চিত টাকা থেকে 'বরাদ্দ-মতন দেয়' নীহারের কাছে পৌঁছত।

    'নীহার সব অবস্থাই জানত, তবু তার প্রাপ্য ব'লে এই টাকা সে অনায়াসে হাত পেতে নিতে লাগল। অথচ একদিন হাসপাতালে সুরীতিকে দেখতে যাবার অবকাশ সে পেত না। সুরীতি উৎসুক হয়ে থাকত জানলার দিকে কান পেতে, কিন্তু কোনো পরিচিত পায়ের ধ্বনি কোনোদিন কানে এল না। অবশেষে একদিন তার টাকার থলি নিঃশেষে শেষ হয়ে গেল আর সেইসঙ্গে তার চরম আত্মনিবেদন।'


    || ২ ||

    ল্পটিতে সুরীতি যেন প্রেমের বেদীমূলে শহীদ হয়েছে। শোপেনহাওয়ারের একটি উক্তি মনে পড়ে যায় 'Woman pays the debt of her life, not by what she does but by what she suffers.' শরৎচন্দ্রের 'ত্যাগদহনদীপ্ত' নারীদের প্রসঙ্গে মোহিতলাল মজুমদার 'martyrdom' শব্দটি ব্যবহারও করেছিলেন। দুঃখে যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে বিমুখ প্রেমিকের কাছে আত্মনিবেদন করে অনেক সময় মেয়েরা যেন আশ্চর্য তৃপ্তি পায়। সুরীতির চরিত্রে অবশ্য একটি নাটকীয় পরিবর্তন আছে, প্রথমদিকে সে নারীস্বাতন্ত্র্যের প্রবক্তা — প্রসাধনে, পুরুষের মন ভোলাবার ছলাকলায় তার তীব্র অনীহা, শুধু নিজে নয়, 'নারীপ্রগতিসংঘ' স্থাপন করে সে মেয়েদের 'দাস্য' মনোবৃত্তি যেন ভাঙতে চেয়েছে। শিভ্যালরিতেও তার এবং তার দলের মেয়েদের আপত্তি, কারণ তাতে মেয়েদের দুর্বলতা প্রমাণিত হয়। মনেপ্রাণে তখন সুরীতি লিঙ্গবৈষম্যের বিরোধী — এতটাই তার মতামতের তীব্রতা যে পুরুষবিদ্বেষ তার জীবনদর্শনের অঙ্গ। এখানেই পাঠকের মনে একটা সংশয় থাকে, চরম বিরাগের উলটো পিঠেই অনেক সময় থাকে পরম অনুরাগ। এই পর্বেই নীহার ও তার দলবল সুরীতিকে উৎপীড়ন করেছে। সেই সব নির্যাতনে সে আপাতবিরক্ত কিন্তু সংগোপনে একমাত্র তারই প্রতি এমন বিশেষ মনোযোগে হয়ত কোথাও যেন আনন্দিত। এই ধরনের নির্যাতন যেমন বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ, এতে আনন্দ পাওয়াও ঠিক স্বাভাবিক নয়। সুমথনাথ ঘোষের একটি গল্প মনে পড়ে যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র — একটি মধ্যবয়সী নারী, রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো বখাটে ছেলেদের অশালীন 'রিমার্কে' বাইরে বিরক্তির ভান করলেও মনে মনে খুশি হত, নিজের আকর্ষণী ক্ষমতা এখনো অক্ষুণ্ণ আছে ভেবে। কোথাও স্পষ্ট না করা হলেও পাঠক ধরে নিতে পারে সুরীতি মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত কিন্তু সুন্দরী নয়। যে বিশেষণটি নীহার নিজে 'বড্ড বেশি রিয়ালিস্টিক' বলেছে তা হল 'মসীপুঞ্জিতবর্ণা'। সুরীতি যে গৌরবর্ণা নয় তা মোটামুটি বোঝা যায়। সুরীতির অন্তরে কোথাও প্রখর পুরুষবিদ্বেষ, স্বাতন্ত্র্যঅভিলাষী ঝক্‌ঝকে যুক্তিবুদ্ধির আড়ালে অবদমিত ছিল পুরুষের কাছে আদরণীয়া হবার বাসনা। তাই হয়ত নিপীড়নের মধ্যে সে অনাদরের উল্টোদিক দেখে এবং 'আঘাত আছে, নাইকো অবহেলা' ভেবে সূক্ষ্ম তৃপ্তি পেত। তা না হলে নীহার সলিলার অনুগত হয়ে পড়লে তার মনে দুঃখ হবার কোনো কারণ নেই। লেখক এখানে পরিষ্কার করেই বলেছেন, 'তার মনের ভিতরে এই নীহারের মন পাবার ইচ্ছাটা যে ছিল না, তা বলা যায়না।'

    দার্জিলিং থেকে নীহার ফিরে আসার পর বলা যায় গল্পের ও সুরীতির জীবনে দ্বিতীয় পর্ব শুরু। নীহারের কথায় কথায় সংস্কৃত শ্লোক আওড়ানো এবং তুখোড় ফরাসী বলা সুরীতিকে সম্পূর্ণ অভিভূত করে ফেলেন। আকর্ষণীয় মেধা নীহারের ছিল আর দার্জিলিং থেকে ফেরার পর সরাসরি তার চেহারার প্রশংসা আমরা নারীর ছলাকলার পাঠে রীতিমত আনাড়ি সুরীতির মুখেই শুনেছি।

    'কেন, সাজ তো মন্দ হয়নি আর আপনার চেহারাও তো দেখাচ্ছে ভালো, ভুটিয়া বকুর সাজসজ্জাতে আপনাকে ভালো মানিয়েছে।'

    এই কথোপকথনের সময়ই আকস্মিক ভাবে নীহারের প্রতি দূরত্বজ্ঞাপক আপনি থেকে সুরীতি 'তুমি'-তে অবতীর্ণ হয়েছে। র‍্যাগিং-এর বর্ণনা রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য গল্পেও ভয়ংকর। এই ধরনের নির্যাতনকে তিনি তীব্র ঘৃণা করতেন — 'গিন্নি', বা 'রাসমণির ছেলে', 'অপরিচিতা' অথবা 'হৈমন্তী' গল্পে ক্ষমতাশালীদের চূড়ান্ত অমানবিক নির্যাতন পাঠকের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বইয়ে দেয়। কিন্তু সেখানে নিপীড়িত ব্যক্তির অন্তরেও প্রবল প্রতিক্রিয়া জেগে উঠেছে। 'প্রগতি-সংহার' গল্পের ইভটিজিং বা র‍্যাগিং কিন্তু রাগের বদলে অনুরাগ জাগিয়েছে। সুরীতি নারীর সহজাত অনুভূতিসমূহ দমন করে উলটো পথে হেঁটেছিল বলেই কি এমনটি ঘটল? রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস ছিল স্বভাবের বিরুদ্ধতা করলে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়। এ কি সেই বিশ্বাসের ফলিত রূপ? 'পশ্চিম যাত্রীর ডায়ারি'তে রবীন্দ্রনাথ নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে যে তত্ত্বের অবতারণা করেছেন তাতে নারীর রহস্যময়ী মনোরমা মূর্তিকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পুরুষের সৃজন উৎসবে নারীকে সেখানে প্রেরণাদায়িনী শক্তি হিসেবেই দেখা হয়েছে। নারী পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কে সামঞ্জস্যময় সৌন্দর্য কীভাবে আসবে সে বিষয়ে জীবনের প্রান্তবেলায় তাঁর ভাবনা কিছুটা ধরা পড়েছে 'আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থে। প্রাসঙ্গিক দুটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হল।

    'জন্ম থেকেই মেয়েরা দায়িত্ব নিয়ে জন্মায়। এই দেখ্‌-না মেয়েরা জন্মেই হয় ছোটোভাইকে কোলে করে বেড়ায়, নয় দাদামশায়ের কাছে বসে হাওয়া করে মাছি তাড়ায়। কিছু করবার না পায় তো, 'পুতুলের মা' হয়ে বসে থাকে। ... পুরুষরা জন্মায়ই তাদের কর্তৃত্ব করবার স্পিরিট নিয়ে, কৌতূহল নিয়ে। ... আজকাল অবশ্যি এর যুগ বদলাচ্ছে। মেয়েরাও পুরুষের মতো উপার্জন করতে, স্ট্রাগল করতে চাইছে। এরও দরকার আছে। তা হচ্ছে তার আত্মরক্ষার উপায়। নয়তো কেবল মেনেই নিতে হয় জীবনভোর। সব কিছু মেনে নেওয়াও তো সহজ কথা নয়। বাইরের দিক থেকে এই মেনে নেওয়াকে বলে 'অপমান'। কিন্তু আসলে ভিতরে হৃদয়ের দিক থেকে এর মস্ত সম্মান। মেনে নিয়ে যে অপমানকে এরা জয় করে তার তুল্য সম্মান কোথায় ও কিছুতেই নেই।'

                                                                             ১৩ জানুয়ারি, ১৯৪১
                                                                                        সকাল
                                                                                        উদয়ন

    হঠাৎ করে মনে হয় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'দর্পচূর্ণ' গল্পের ভাষ্য শুনছি। এতটা একপেশে মতামত রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রত্যাশিত নয়। বোঝা যায় তাঁর নিজের মনেও যথেষ্ট খট্‌কা ছিল তাই দুদিন পরেই বিষয়টি নিয়ে গভীরতর এবং পূর্ণতর একটি ব্যাখ্যার দিকে এগিয়ে গেছেন। এবার তাঁর সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও বৈপ্লবিক অভিমত আমাদের শুধু আশ্চর্য করেনা, মুগ্ধ করে ফেলে।

    'মেয়েদের এই বিশ্বজনীনতায় একটা মস্ত শক্তি নিহিত আছে — যে শক্তি জীব রক্ষা করছে। এই জন্যেই মেয়েদের এক নাম প্রকৃতি। পুরুষরা আপনাদের অ্যাসার্ট করে, মেয়েরা তাতে ইল্ড করছে, আর তাকে পুরুষরা এক্সপ্লয়েট করে। মেয়েদের এই মেনে-নেওয়াকে পুরুষ নিজের শক্তির নীচে আরো দাবিয়ে রাখে। তাই মেয়েদের এই শক্তি সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে তাদের ঘরকন্নায়। ... বিদেশে এটা নেই। মেয়েদের শক্তি বাইরে ও অনেকদূর ছড়িয়ে পড়েছে। ওখানকার পুরুষরাও মেয়েদের একটা সম্মান দিতে পেরেছে। আমাদের এখানেও যতদিন-না আমরা মেয়েদের দানের সেই সম্মান না দিতে পারব ততদিন আমাদের স্বভাবের অসভ্যতা দূর হবেনা। এই যে হোম বলে আমাদের একটা জিনিস, এটি হচ্ছে পরাধীন প্রকৃতির একটা সৃষ্টি। এই হোম এল বলেই নারী আজ এত পরাধীন, পুরুষ তাকে এত বাঁধতে পারলে। এই হোম-এর বাঁধনকে আমাদের সমাজ এতখানি ব্যাপ্ত করে রেখেছে যে, এর থেকে ছাড়া পাবার তাদের উপায় নেই। মেয়েদের এই দান আজ সীমাবদ্ধ না থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়বে না, যতদিন-না তারা মুক্তি পাবে, স্বাধীন হবে। এটা হচ্ছে বোধ হয় অনেকটা অর্থনৈতিক কারণে।'

                                                                             ১৩ জানুয়ারি, ১৯৪১
                                                                                        উদয়ন

    'প্রগতিসংহার' গল্পে নীহাররঞ্জন অ্যাসার্ট করছে, এক্সপ্লয়েট করছে। সে নিপীড়ক এবং বর্বর — যতই সংস্কৃত, ফরাসী আওড়াক, বাংলায় এম. এ.-তে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হোক। কিন্তু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সত্ত্বেও সুরীতি পরাধীন, তার আত্মবিনাশী প্রেম তাকে অদৃশ্য শৃঙ্খলে বেঁধে রেখেছে। সে জানে নীহার তাকে ভালোবাসেনা, তবু এই একপক্ষের প্রেমের পদতলে নিজের সম্ভাবনাময় জীবন অঞ্জলি না দিয়ে তার উপায় নেই। নীহারের জন্য আত্মপীড়ন তাকে অদ্ভুত এক সুখ দিয়েছে একে যৌন আনন্দ বলতে ভয় হয়। কোনো মনস্তাত্ত্বিক পরিভাষা ব্যবহার করতে চাইনা। 'শ্যামা' নৃত্যনাট্য প্রসঙ্গে আবু সয়ীদ আইয়ুব যা বলেছিলেন তা বরং উদ্ধৃত করছি, 'মানবজীবনের অতি দুর্বোধ্য জটিলতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ আটাত্তর বৎসরের বহু বিচিত্র বেদনায় দগ্ধবিদগ্ধ রবীন্দ্রনাথও যেন বলতে চাইছেন মানুষকে হৃদয় দিয়ে বোঝো, ছককাটা বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে চেয়োনা।'

    এমন যুক্তিহীন একতরফা প্রেমে আত্মবলিদান রবীন্দ্রসাহিত্যে আমরা আগেও পেয়েছি — 'চতুরঙ্গ' উপন্যাসের ননিবালা। সে সরাসরি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিল, সুরীতি তিলে তিলে জেনে বুঝে মৃত্যুর দিকে এগিয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র পতঙ্গ ও বহ্নির উপমা দিয়েছিলেন নীহারের প্রতি প্রেম সুরীতির জীবনের সেই আগুন যাতে ঝাঁপ দিয়ে সে চরিতার্থ হয়েছে। মনে পড়ে যেতে পারে চেকভের 'গ্রাসহপার'। সেলিব্রিটি পুরুষের প্রেমে অন্ধ একটি মেয়ের নিঃস্ব হবার গল্প। সেও বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু পায়নি। পুরন্দর অশিক্ষিত, চরিত্রহীন কিন্তু চারিত্র্যে নীহারের সঙ্গে তার বিশেষ তফাত নেই। বাইরে উচ্চশিক্ষিত, সুবক্তা, রমনীমনোমোহন নীহার অন্তরে পুরন্দরের মতোই অসভ্য, নিষ্ঠুর, স্বার্থপর এবং অশালীন। 'কাপুরুষ' নামে নীহারের প্রতি ইঙ্গিত রেখে লেখক বিতৃষ্ণা উজাড় করে দিয়েছিলেন। প্রগতিসংহার নামে রয়েছে বিষণ্ণ অপচয়বোধ। মুক্তিপিপাসু স্বাধীনচেতা মেয়েটিকে নারীর জন্য শক্তপোক্ত ভাবে নির্মিত মানসিক ও সামাজিক ফ্রেম শেষপর্যন্ত গিলে খেয়েছে। সেই সঙ্গে উচ্চকিত অথচ ভিতরে অসার প্রগতিপন্থার প্রতি লেখকের তির্যক বিদ্রূপ ও রয়েছে।

    || ৩ ||

    প্রগতি সংহারের সঙ্গে অমিতা সেনের (খুকু) কী সম্পর্ক? হয়তো কিছুই নয়। বাস্তব জীবন আর সাহিত্য তো এক নয়। তবে অমিতা ও সুরীতির মধ্যে কিছু সাদৃশ্য চোখে না পড়ে যায়না। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন খুকু ছিলেন সাহসী মেয়ে, স্পষ্টবক্তা। সহপাঠী ছাত্রদের কোনো প্রগল্‌ভতা, অশোভন ঠাট্টা সহ্য করার মেয়ে তিনি ছিলেন না। পড়াশোনায় চিরকালই তিনি প্রথম সারির। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কিন্তু শেষপর্যন্ত চূড়ান্ত তিক্ততায় গড়িয়ে ছিল। তার দায় কিছুটা হয়তো দু পক্ষেরই। খুকু তাঁর প্রিয় মানুষ শম্ভুনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাবটি কমিটিতে পাঠান, কমিটি বিবেচনা করে চাকরি দিতেও চেয়েছিল যদিও কোনো পদ তখন খালি ছিল না। ব্যাপারটি নিয়ে খুকু ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে উত্তপ্ত এবং তিক্ত পত্রবিনিময় হয়। শম্ভুনাথ সম্ভবত সম্মানহানিকর বিবেচনা করে শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনার চাকরি নেননি। সামাজিক নিয়ম মেনে শম্ভুনাথের সঙ্গে অমিতার বিবাহ অসম্ভব ছিল সেকালে, কারণ শম্ভুনাথ ব্রাহ্মণ, অমিতা বৈদ্য। শুধু তাই নয় অমিতা ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়ে। প্রেমিকের জন্য অমিতার দান ছিল একেবারে সর্বস্ব উজাড় করা। স্কুলে যা বেতন পেতেন সবই যেত প্রেমিকের চিকিৎসা ও ভরণপোষণে। অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্কে তাঁর প্রেমিকের আপত্তি ছিলনা, সেইরকম কোনো ধনী রমণী তাঁকে দার্জিলিং নিয়ে যায় স্বাস্থ্য উদ্ধারকল্পে। প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে এসে আকস্মিক এই খবরে বিমূঢ় অমিতা জানেন তাঁর জন্য রয়েছে ঘর ভাড়া মেটানো ও আসবাবের ব্যবস্থা করবার দায়িত্ব। কতোটা ব্যথা পেয়েছিলেন জানা অসম্ভব কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। যন্ত্রণা নিশ্চয়ই আরো বাড়িয়েছিল রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক তাঁর ছয়টি গানের রেকর্ড আটকে দেওয়া। কতোদূর বিরূপতা রবীন্দ্রনাথকে আচ্ছন্ন করেছিল ভাবলে বিস্ময়বোধ হয়। যদিও যে প্রফুল্লচন্দ্র মহলানবিশের (বুলা) সহায়তায় এই সব রেকর্ড — অমিতা মৃত্যুশয্যায় জেনে, তাঁকে চিঠি লিখে রবীন্দ্রনাথ রেকর্ড প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। ছাব্বিশ বছর বয়সে পূর্ণ যৌবনে প্রতিভাময়ী অমিতার জীবনদীপ নিভে গেল। গান গুলি শোনার সময় যেন বহু যুগের ওপার হতে ভেসে আসে খুকুর ট্রাজিক জীবনের গাঢ় বেদনা। খুকু জেনে যাননি, যে-রবীন্দ্রনাথের ওপর তাঁর তীব্র অভিমান, তিনি ভোলেননি এই অসহ্য অপচয়। সাময়িক বিরোধ তাঁর অন্তরের গভীর স্নেহকে শুষ্ক করতে পারেনি। স্নেহভাজন কন্যাটির অর্থহীন বিনাশের ছবি তিনি আঁকলেন নিজের মৃত্যুর বৎসরে 'প্রগতিসংহার' গল্পে। গল্পটি পড়ার সময় কাহিনীটি পুরো বলে রাখার একটা তাড়া অনুভব করা যায়। খুব জানা কোনো আখ্যান যেন বিবৃত করতে চাইছেন লেখক। রবীন্দ্রনাথ তো জানতেন তাঁরও সময় ফুরিয়ে আসছে। 'প্রগতিসংহারে' তিনি ধরে রাখতে চেয়েছিলেন একটি সম্ভাবনাময় জীবনের শোচনীয় সংহার, একটি কাপুরুষ প্রেমিকের প্রতি তাঁর ক্রোধ ও বিতৃষ্ণা। খুকু জানেননি সুরীতির অবয়বের ভিতরে আদরের খুকুকে লুকিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজের সুগভীর বেদনা ও নিরুদ্ধ অশ্রুকে প্রকাশ করে গেলেন।

    একটি বিষয় শুধু ভাবনা জাগায়, যে গানের জন্য খুকুর প্রতি তাঁর নিবিড় স্নেহ সেই গানের প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ একবারও আনলেন না প্রগতিসংহারে? এখানে তাঁর অভিমানও লুকোনো থাকেনা। বড়ো যত্নে খুকুকে নিজের গানে দীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি, দিনেন্দ্রনাথও। খুকু কিন্তু শম্ভুনাথের জন্য আচমকা ছেড়ে দিয়েছিলেন সংগীতভবনের চাকরি। আমরা সকলেই জানি নিজের সব সৃষ্টির মধ্যে গান সম্বন্ধেই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সর্বাপেক্ষা সংবেদনশীল এবং দুর্বল। তাঁর গানকেও খুকু প্রত্যাখ্যান করলেন এই বেদনাতেই কি প্রগতিসংহারের সুরীতির কণ্ঠে সুরের লেশমাত্র রাখলেন না রবীন্দ্রনাথ? একবার শুধু 'রবি ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদার' উল্লেখ আছে। পুরুষের নির্মোক ভেঙে চিত্রাঙ্গদার নারীত্বে জাগরণের আখ্যান সম্বন্ধে সুরীতি বলেছে 'ও আমি মানিনে। এমন অপমানের কথা আর হতে পারেনা।' নৃত্যনাট্যের রিহার্সাল ভালো লাগত না খুকুর। রবীন্দ্রনাথের গানে ডুবে থাকলেও, এই সব মহড়া তাঁর কাছে 'অশুচিকর ও দুঃখকর' মনে হত। গল্পটি লেখার সময় সেসব স্মৃতি কি আলোড়িত করেছিল রবীন্দ্রনাথকে? আরো অনেক অকথিত কাহিনী হয়তো রইল স্মৃতিকথা ও বাস্তবের চূর্ণমুষ্টি থেকে গড়ে উঠে শিল্পলোকের দিকে ডানা মেলে দেওয়া 'প্রগতিসংহার' গল্পের বাইরে, সে সব কোনো দিনই জানা যাবেনা। আমাদের প্রাপ্তি হয়ে রইল রবীন্দ্রনাথের প্রাণে বড়ো বেদনার মতো বেজে থাকা খুকুর ছোট্ট জীবন — গল্পটিতে যা চিরায়ত হয়ে আছে।


    তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতাস্বীকার :

    ১. অমিতা সেনের সম্পর্কিত ছোটো বোন প্রয়াত সুনন্দা দাশগুপ্ত, প্রধানা অধ্যাপিকা, বাংলা বিভাগ লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ।
    ২. যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে আমার ছাত্র অভীক।
    ৩. 'কালো তারে বলে পাড়ার লোক' -- আশিস পাঠক; আনন্দবাজার পত্রিকা ২১ মে ২০১৬।
    ৪. রবীন্দ্র রচনাবলী সপ্তবিংশ খণ্ড -- বিশ্বভারতী।
    ৫. অমিতা সেনের বিষয়ে প্রকাশিত পুস্তক ও প্রবন্ধ --
    (ক) অমিতা (সম্পাদনা ইলিনা সেন)
    (খ) বুলবুলি -- পার্থ বসু।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments