• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Rabindranath Tagore | প্রবন্ধ
    Share
  • রবিবাবুর গান ও তার গায়ন : অনিন্দ্য বসু

    গান ভালবেসে গান। আধুনিক বাংলাগানের এই এখন মূল মন্ত্র। হক্‌ কথা। ন্যায্য কথা। কিন্তু শুধু ভালবেসে গাইলেই হল? গানের ব্যাকরণ, শৈলী, স্বরলিপি ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না? বিশেষতঃ গানটি যদি রবীন্দ্র সঙ্গীত, অর্থাৎ যা রবিঠাকুরের সময়ে ‘রবিবাবুর গান’ বলে পরিচিত ছিল, তা হলে? তার বেলায় কী খালি ভালবাসলেই চলবে? আমাদের মত শ্রোতারা, যারা বাথরুমে গায়ক বনে গিয়ে নিজস্ব রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুরোধের আসর বসাই, অথবা হঠাৎ নেমে আসা বর্ষার প্রভাবে গুনগুন করে বা কাছে পিঠে কেউ না থাকলে গলা ছেড়ে ‘ঝরঝর বরিষে বারিধারা’ গেয়ে উঠি – যাদের শ্লীল-অশ্লীল সব প্রসঙ্গেই রবিবাবুর গান মনে চলে আসে তাদের কি কখনও মনে এই প্রশ্ন জাগে যে, এই যে লোকটা এত রকম কথা আর এত রকম সুর বসিয়ে গান লিখে গেছে, তার গানটা ঠিক কী নিয়মে গাওয়া যেতে পারে?আমরা কি কদাচিৎ মনস্ক হয়ে ভাবি এসব? এই গান নিয়ে তো পন্ডিত মহলে বিস্তর তর্ক, চিঠি চালা-চালি, আলোচনা ইত্যাদি সেই রবীন্দ্রনাথের আমল থেকে হয়ে আসছে। সেই আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যোগ দিয়েছেন বহুবার। রবীন্দ্রনাথ নিজে সঙ্গীত সম্বন্ধে বেশ কিছু লেখা লিখেছেন, ভাষণ দিয়েছেন, আলোচনা করেছেন এবং বলা বাহুল্য নিজের গানের ব্যাপারে মতামত দিয়েছেন। ছাপার অক্ষরে সেসব ধরাও আছে। অতএব, যদি শুরুর থেকে শুরু করি, তাহলে দেখা যাক যে রবীন্দ্রনাথের কী বক্তব্য ছিল তাঁর নিজের গানের গায়ন সম্বন্ধে?

    রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টতই প্রথম দিকে বলেছেন যে তাঁর গান অবিকৃত ভাবে গাইতে হবে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপকুমারকে তাঁর গানে variation করার অনুমতি না দিয়ে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘হিন্দুস্থানী সঙ্গীতকার, তাঁদের সুরের মধ্যকার ফাঁক গায়ক ভরিয়ে দেবে এটা যে চেয়েছিলেন।তাই কোনো দরবারী কানাড়া্র খেয়াল সাদামাটা ভাবে গেয়ে গেলে সেটা নেড়া-নেড়া না শুনিয়েই পারে না।কারণ দরবারী কানাড়া তানালাপের সঙ্গেই গেয়, সাদামাটা ভাবে নয়। আমার গানেতো আমি সেরকম ফাঁক রাখিনি যে সেটা অপরে ভরিয়ে দেওয়াতে আমি কৃতজ্ঞ হয়ে উঠব।’ (‘সঙ্গীতচিন্তা’) অর্থাৎ এখানে হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে নিজের গানের তফাৎ নির্দেশ করেছেন। হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে স্বাধীনতা সঙ্গীতকার নিজেই দিয়ে রাখেন শিল্পী কে, যেহেতু তাঁর সৃস্টি একটি বিশেষ সুরসমষ্ঠির উপর ভিত্তি করে রচিত গান এবং যা দাঁড়িয়ে থাকে গায়ক বা গায়িকা কেমন করে সেই বিশেষ সুরের ধরনটিকে ফুটিয়ে তুলছেন তার ওপর। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দাবি ছিল যে তাঁর গানের প্রত্যেকটির নিজস্ব ও সম্পূর্ণ রূপ আছে। অন্যদিকে তিনি তাঁর ‘সঙ্গীতের মুক্তি’ প্রবন্ধে লিখছেন ‘এইখানে য়ুরোপের সঙ্গীত-পলিটিক্সের সঙ্গে আমাদের সঙ্গীত-পলিটিক্সের তফাত। সেখানে ওস্তাদকে অনেক বেশি বাঁধাবাঁধির মধ্যে থাকিতে হয়। গানের কর্তা নিজের হাতে সীমানা পাকা করিয়া দেন, ওস্তাদ সেটা সম্পূর্ণ বজায় রাখেন। তাঁকে যে নিতান্ত আড়ষ্ট হইয়া থাকিতে হইবে তাও নয়, আবার খুব যে দাপাদাপি করিবেন সে রাস্তাও বন্ধ। য়ুরোপে প্রত্যেক গান একটি বিশেষ ব্যক্তি, সে আপনার মধ্যে প্রধানত আত্মমর্যাদাই প্রকাশ করে। ভারতে প্রত্যেক গান একটি বিশেষ-জাতীয়, সে আপনার মধ্যে প্রধানত জাতিমর্যাদাই প্রকাশ করে।’ এই দুটি লেখা পাশাপাশি রেখে পড়লে তো মনে হয় গানের রূপায়ণের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ হয়ত য়ুরোপীয় রীতিকেই আদর্শ মানতে চেয়ে ছিলেন। প্রত্যেকটি গানের যে নিজস্ব একটি রূপ আছে, যা তাকে অন্য একটি গানের থেকে আলাদা করে এবং যা একটি composition হিসেবে স্বয়ং সম্পূর্ণ এবং যা কোন বিশেষ গোষ্ঠির সুরসমষ্টির মধ্যে পড়ে না। কিন্তু প্রত্যেক গানের অবিকৃত রূপের খোঁজ আমারা পাব কি করে? সহজ উত্তরটা হল স্বরলিপি দেখে। সেইটেই য়ুরোপীয় পদ্ধতি। কিন্তু রবীন্দ্র সঙ্গীতের ক্ষেত্রে সেখানে গন্ডগোল আছে। তার অনেকগুলি কারণ।

    প্রথমতঃ একাধিক রবীন্দ্র সঙ্গীতের একটির বেশি স্বরলিপি চালু আছে। ধরুন ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ গানটি। এই গানটি একটি জনপ্রিয় গান। কিন্তু এর তিনটি স্বরলিপি বাজারে পাওয়া যায়। একটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের করা, একটি সরলা দেবীর(রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নি) করা এবং তৃতীয়টি দিনু ঠাকুরের করা। তিনটি স্বরলিপিতে সামান্য হলেও বিভেদ আছে। অতএব অবিকৃত একক রূপের নির্ধারণ করা এক্ষেত্রে সম্ভব নয়। সেইরকম আবার ‘তবু মনে রেখ’ গানটির ও চারটি স্বরলিপির খোঁজ মেলে। সেগুলি প্রায় এক হলেও হুবহু এক নয়। এবার ধরুন ‘এ পরবাসে রবে কে’ গানটি। এটির অনেকগুলি রেকর্ড বাজারে পাওয়া যায়। তার মধ্যে যদি কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের রেকর্ডটি শোনেন এবং অমিয়া ঠাকুরের গাওয়া গানটি (এটি সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির জন্য রেকর্ড করান) শোনেন, তা হলে দেখবেন, ‘কে রবে সংশয়ে’ এই অংশে, কণিকা ‘-শয়ে’-তে মধ্যম থেকে কোমল নিখাদ( ম-ণ) অবধি একটি মীড় টেনেছেন, স্বরলিপিতেও তাই আছে, কিন্তু অমিয়া ঠাকুর তা করেন নি। দুজনেই তো সমান মান্য। একজন শান্তিনিকেতনের সঙ্গীতভবনে শৈলজারঞ্জনের শিষ্যা, আর অন্যজন ঠাকুরবাড়ির বউ, এবং রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর গান ভীষণ ভালোবাসতেন ও তাঁকে নিজে শিখিয়েছেন! এবারে দেখা যাক রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর অন্যান্য প্রিয় গায়ক-গায়িকারা কেমন করে গেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিকের লেখা গান, ‘স্বপন যদি ভাঙ্গিলে’ ( রামকেলী রাগে নিবদ্ধ), এই গানটি বিষ্ণুপুর ঘরানার বিখ্যাত গায়ক রাধিকা প্রসাদ গোস্বামী গেয়েছেন শুদ্ধ আকারে বিস্তার করে এবং তান করে, তবে রামকেলি রাগের রূপ অবিকৃত রেখে। সে গান রেকর্ডের অনুমতি তো রবি ঠাকুরই দিয়েছেন। এবং পরবর্তী কালে সেই গান শুনেই ওস্তাদ ভি ভি ঝলওয়ার গানটির স্বরলিপি করেছেন। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে, গান গাওয়া আগে, পরে স্বরলিপি এসেছে । কিন্তু, সেই বিস্তারের তো স্বরলিপি নেই! গোপেশ্বর বন্দোপাধ্যায়ের গাওয়া, নটমল্লার রাগে ‘মোরে বারে বারে ফিরালে’ গানটিতেও, স্বাধীন সুরবিহারের নজীর মিলবে। তেমনি আবার ‘বুঝি ঐ সুদুরে’ গানটির কোন স্বরলিপি প্রথমে ছিল না। রবীন্দ্রনাথ একবার বসন্ত উৎসবের জন্য গানটি লেখেন (সাহানা দেবীর কাছে একটি হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় গান শুনে) এবং সাহানা দেবীকে শেখান। এই গানটি পরে সাহানা দেবী রবীন্দ্রভারতীর জন্য রেকর্ড করে দেন, যা থেকে স্বরলিপি করা হয়। অর্থাৎ এখানেও আগে গাওয়া গানটি ও পরে তার স্বরলিপি। এদের সবাইকে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত পছন্দ করতেন এবং উচ্চশ্রেণীর সঙ্গীতশিল্পী বলে মনে করতেন। এইসব ক্ষেত্রে কিন্তু গানের রূপটি পুরোপুরি গায়ক বা গায়িকা নির্ভর হয়ে রইল । এবং রবীন্দ্রনাথ নিজেই দিলীপকুমারের সঙ্গেই আলোচনায় পরের দিকে বলছেন, ‘আমিতো একথা বলি নি যে, কোনো বাংলা গানেই তান দেওয়া চলে না। অনেক বাংলা গান আছে যা হিন্দুস্থানী কায়দাতেই তৈরী, তানের অলংকারের জন্য তার দাবি আছে। আমি এ রকম শ্রেণীর অনেক গান রচনা করেছি। সেগুলিকে আমি নিজের মনে কত সময়ে তান দিয়ে গাই।’(‘সঙ্গীতচিন্তা’) তাহলে কী উনি নিজেই নিজের বিরুদ্ধাচরণ করলেন? তা বোধহয় নয়। কারণ পরের দিকে আবার দিলীপ কুমারের সঙ্গে আলোচনায় উনি সে প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘শেষ কথা সুরবিহার সম্বন্ধে। ইংরেজী improvisation কথাটির তুমি বাংলা করেছ সুরবিহার-এও আমি ভালবাসি । এতে যে গুণী ছাড়া পায় তাও মানি । আমার অনেক গান আছে যাতে গুণী এরকম ছাড়া পেতে পারেন অনেকখানি। আমার আপত্তি এখানে মূলনীতি নিয়ে নয়। তার প্রয়োগ নিয়ে। কতখানি ছাড়া দেব? আর, কাকে? বড়ো প্রতিভা যে বেশি স্বাধীনতা দাবি করতে পারে একথা কে অস্বীকার করবে? কিন্তু এক্ষেত্রে ছোটো বড়োর তফাত আছেই...’(‘সঙ্গীতচিন্তা’)অর্থাৎ উনি নিজের মতামত আর একটু বিশদে জানালেন, এবং দেখা গেল, একজন composer হিসেবে উনি ওনার গানের ব্যাপারে রক্ষণশীল, কিন্তু গোঁড়া নন। কারণ উনি নিজেই একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পী বলেই। ওনার গানের স্বাতন্ত্র বজায় রাখতে ইনি প্রচন্ড আগ্রহী, কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও স্বীকার করছেন, হয়ত কিছুটা বাধ্য হয়ে যে, যেহেতু ওনার বেশির ভাগ গানই মূলে হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভিতের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, এবং সেই সঙ্গীতের ব্যাকরণ অনুযায়ী রাগবিস্তার শাস্ত্রসম্মত সুতরাং সেই গান গাইবার সময় কোন শিল্পী কিছুটা সুরবিহার করতেই পারেন। তবে এই স্বাধীনতা রবীন্দ্রনাথ সবাই কে দিতে রাজি ছিলেন না। সঙ্গত কারণেই।

    কিন্তু, রবীন্দ্রনাথের গান তো শুধুই রাগসঙ্গীত নয়। সেখানে কথা ও সুরের সমান সমান অধিকার। কথার প্রসঙ্গে যদি আসি, তাহলে দেখব রবীন্দ্রনাথ কথা ও সুরকে সমান অধিকার দিতে চেয়েছেন। অতএব, সুরের বিস্তার করতে গিয়ে বা তান করতে গিয়ে যদি কথা মার খায় তাহলে সেটা মেনে নেওয়া মুশকিল। গানে কথা ও সুরের সমানাধিকারের কথা উনি বার বার বলেছেন। বাংলাগানের বৈশিষ্ট নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে, লখনৌ ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক ও হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের বিশিষ্ট পন্ডিত ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতে বলছেন, ‘বাংলায় নতুন যুগের নতুন গান সৃষ্টি হতে থাকবে ভাষায় সুর মিলিয়ে। সেই সুরকে খর্ব করা চলবে না তার গৌরব কথার গৌরবের চেয়ে হীন হবে না। সংসারে স্ত্রী-পুরুষের সমান অধিকারে দাম্পত্যের যে পরিপূর্ণ উৎকর্ষ ঘটে, বাংলা সঙ্গীতে তাই হওয়া চাই।এই মিলনসাধনে ধ্রূবপদ্ধতির হিন্দুস্থানী সংগীতের সহায়তা আমাদের নিতে হবে, আর অনিন্দনীয় কাব্যমহিমা তাকে দীপ্তিশালী করবে।’(‘সুর ও সঙ্গতি’) অর্থাৎ কথা ও সুরের সমানাধিকার। শেষ পর্যন্ত উনি নিজের গানের গায়ন সম্বন্ধে বলেছেন (প্রফুল্লকুমার মহালনবীশকে লেখা একটি চিঠিতে)‘বুলাবাবু, তোমার কাছে সানুনয় অনুরোধ – এঁদের একটু দরদ দিয়ে, একটু রস দিয়ে গান শিখিয়ো – এইটেই আমার গানের বিশেষত্ব । তার উপরে তোমরা যদি স্টিম রোলার চালিয়ে দাও, আমার গান চেপ্টা হয়ে যাবে। আমার গানে যাতে একটু রস থাকে, তান থাকে, দরদ থাকে ও মীড় থাকে, তার চেষ্টা তুমি কোরো’।(‘সঙ্গীত চিন্তা’) রাগসঙ্গীত ছাড়া, রবীন্দ্রনাথ কিছু পাশ্চাত্ত্য গানের সুর নিয়ে সরাসরি তাতে কথা বসিয়েছেন । যেমন ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’, বা ‘পুরানো সেই দিনের কথা’, ‘কতবার ভেবেছিনু’ ইত্যাদি সবশুদ্ধু বারোটি গান। এখানে বোধহয় প্রকাশিত স্বরলিপি-র (যদি একটির বেশি চালু থাকে তবে সবকটিই)বাইরে যাওয়া চলে না। এছাড়া রয়েছে বাংলা লোকসঙ্গীতের বিশেষতঃ বাউল ও কীর্তনের সুর। যা তিনি বহু গানে ব্যবহার করেছেন । যেমন, ‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গা মাটির পথ’, বা ‘ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায়’, ‘গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে’ ইত্যাদি। এখানে সুরবিহার সম্ভব কিনা সেটা তর্ক সাপেক্ষ।

    আর এসবের বাইরে, যা রবীন্দ্রনাথের অনন্য সৃষ্টি, যে গানগুলিকে কোন শ্রেণীতে ফেলা যায় না, যা স্পষ্টতই তাঁর নিজস্ব ভাবনার ফসল, তেমন গান, যথা ‘পরবাসী এসো ঘরে’, ‘বাজিল কাহার বীণা’, ‘মম চিত্তে, নিতি নৃত্যে’ বা ‘যদি তারে নাই চিনি গো’ এরকম আরো বেশ কিছু গান - এই গানগুলি পুরোপুরি composition–এর মর্যাদা দাবি করে। এবং সে ক্ষেত্রে আমার মত সাধারণ শ্রোতার মনে হয় যে শিল্পীকে স্রষ্টার দাবি মেনে নিয়ে নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখে (expression এর ক্ষেত্রে) স্বরলিপির প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে। কারণ এইগুলি একেবারে রবীন্দ্রনাথের নিজের সৃষ্টি।

    কথা ও সুর ছেড়ে যদি ছন্দের প্রসঙ্গে আসি তাহলে দেখি যে সেখানেও তাঁর গানের ভিন্ন ভিন্ন রূপ চোখে পড়ে। যেমন রবি ঠাকুরের বেশ কিছু গান মুক্তছন্দে গাওয়া হয় আজকাল। সর্বমান্য শিল্পীরাই গেয়েছেন। রবীন্দ্রভারতীর এককালীন স্বরলিপি অধিক্ষক শ্রী সুভাষ চৌধুরি একটি তালিকা করেছেন প্রায় ৮৯-টি গানের যাদের স্বরলিপি তাল বা নির্দিষ্ট মাত্রা নিবদ্ধ কিন্তু তা মুক্তছন্দে গাওয়া প্রচলিত। এমন কী, ‘এ পরবাসে’ গানটি যা আমরা মুক্তছন্দে অনেকের কন্ঠে শুনেছি, সেটি মালতী ঘোষাল তাল ও ছন্দে নিবদ্ধ করে গেয়ে রেকর্ড করেছেন। লয় নিয়েও সংশয় কাটে না। কিন্তু এরপরও প্রশ্ন থেকে যায়। যে প্রশ্ন সত্যজিৎ রায় তুলেছেন। সেটি গানের orchestration বিষয়ে । সত্যজিৎ রায় লিখেছেন, ‘আরেকটা জিনিস যেটা স্বরলিপিতে পাওয়া যাবে না সেটা হল গানের সংগতের নির্দেশ। সঙ্গত সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কোথাও কিছু বলে যান নি। এখানে সুরকারের একটা বড় দায়িত্ব তিনি পালন করেন নি।’(‘রবীন্দ্রসঙ্গীতে ভাববার কথা’) মোটামুটি ভাবে ওনার গানে ছড় টানা তারের যন্ত্রের বা টঙ্কারে বাজানো তারের যন্ত্রের যথা সারেঙ্গী, এস্রাজ, সেতার, দোতারা ইত্যাদি এবং তবলা, পাখোয়াজ ও খোলের মত তালবাদ্যর ব্যবহার দেখা যায় প্রথম দিকের গানের রেকর্ডগুলিতে। সেটা সম্ভবতঃ এই কারণে যে, এই যন্ত্রগুলি তখন সঙ্গীতজগতে বেশি চালু ছিল। অথচ এই নিয়েও গন্ডগোল কম হয়নি। বিশ্বভারতী music board, স্বয়ং দেবব্রত বিশ্বাসের মত শিল্পীর গানের রেকর্ড না-মঞ্জুর করেছেন কারণ উনি “এসেছিলে তবু আসো নাই” এবং “মেঘ বলেছে যাব যাব” গান-দুটি কিছু আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে musical interlude ও echo chamber ব্যবহার করে গেয়েছিলেন। প্রথম গানটি বাতিল হওয়ার কারণ হিসেবে চিঠিতে লেখা ছিল, “In spite of repeated requests to control and restrict uncalled for composed musical interludes, the same have been applied freely making the production awfully jarring and distorted”. এবং দ্বিতীয় গানটি বাতিল হওয়ার কারণ হিসেবে লেখা ছিল, “Awfully melodramatic voice productions. Echo-Chamber which seems to have been used have utterly spoiled the fine note combinations in the song.” একথাতে বিশেষ কিছুই পরিষ্কার হয় না। কারণ, কোন জাতীয় interlude গ্রহণযোগ্য বা কোন গায়ন melodramatic সেটা বোঝার মাপ কাঠিটি ঠিক কি ছিল? তা কিন্তু একেবারেই স্পষ্ট নয়। রবীন্দ্রনাথ তো এ ব্যাপারে কোন স্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে যান নি! পরে অবশ্য দেবব্রতর সেই গান অনুমোদন পায়। কিন্তু একাধিক বার এই খবরদারির ফলে দেবব্রতর মত শিল্পী রবীন্দ্র সঙ্গীত রেকর্ড করাই বন্ধ করে দিলেন! এখন তো রবীন্দ্র সঙ্গীতে অজস্র ধরনের arrangement করা হয়ে থাকে অনেক ধরনের যন্ত্রের সহযোগে এবং লম্বা লম্বা interlude–এর ব্যবহার করেন খ্যাতনামা শিল্পীরাই এবং অনেক শিল্পীর উচ্চারণ, গলা কাঁপানো এবং সোজা কথায় ক্যামেরার সামনে আদিখ্যেতা দেখলে বিরক্তি ছাড়া অন্য কোন ভাব মনে আসে না।

    তাহলে মোদ্দা কথা যা দাঁড়ালো, তা হল এই যে, রবীন্দ্রসঙ্গীত কোন অক্ষয়-অব্যয় ধ্রুব স্বরলিপি সমষ্টি নয়। এই সমস্ত দেখেশুনে আমার মত সাধারণ শ্রোতার মনে হয় যে রবীন্দ্রনাথই এদেশে প্রথম, যিনি হয়ত তাঁর গানের একটি সুস্পষ্ট রূপ দিতে চেয়েছিলেন য়ুরোপীয় আদর্শের অনুসরণে নির্দিষ্ট সুর, তাল ও লয় বেঁধে দিয়ে। কিন্তু গান রচনার ক্ষেত্রে সেটা পুরোপুরি সম্ভব হয়নি যেহেতু উনি গানের সুরের, তালের এবং লয়ের ভিত্তিটা মূলতঃ এদেশের গান থেকেই নিয়েছিলেন, যার ধরনটাই স্বাধীনতাকামী। তবে কাব্যের অংশে রবীন্দ্রনাথ অনেক বেশী স্বতন্ত্র ছিলেন প্রথম থেকেই এবং সুরের ক্ষেত্রেও আস্তে আস্তে প্রচলিত ধারাকে অতিক্রম করে নিজস্ব একটি রূপ দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাঁর গানের অবিকৃত রূপ শুধুমাত্র স্বরলিপি ধরে মিলবে না। আমাদের রাস্তাটা দেখাবেন রবীন্দ্রসংগীতের প্রথমদিকের শিল্পীরা। তাঁদের গাওয়া গানগুলিকেই আমাদের আদর্শ ভেবে এগোতে হবে। যেখানে সেটা সম্ভব নয়, সেখানে স্বরলিপিকে মূল হিসেবে ধরে, রবীন্দ্র ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে, তাঁর ভাব, ভাষা এবং বাংলা উচ্চারণ বিধির সম্বন্ধে সচেতন থেকে খোলা গলায় স্পষ্ট উচ্চারণে (অর্থাৎ crooning না করে, চিবিয়ে বা ঠোঁট টিপে উচ্চারণ না করে) গাইতে হবে। রবীন্দ্র সংগীতকে কোন committee বসিয়ে বাঁচানো যাবে না। কোন প্রতিষ্ঠান তার ব্যবসায়িক আয়োজনেও তাকে বাঁধতে পারবে না। তার ঐতিহ্যকে আমাদেরই বাঁচিয়ে রাখতে হবে, ভালবেসে, যত্ন নিয়ে। তাই ‘রবি বাবুর গান’ ভালবেসে গান। সচেতন হয়ে গান। অনুভব করে গান।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments