“For both poet and reader, Solveig von Schoultz’s poetry is an exercise in the sharpening of vision, sincerity and smiling wisdom engendered by a lifetime of experience.” —বো কার্পেলানগত শতাব্দীর প্রায় পুরোটা জুড়ে সোলভেইগ ভন শুল্ৎস্-এর জীবন—তাঁর মধ্যে সাহিত্যচর্চাই চলেছে সাত দশকের বেশি; কেবলমাত্র সেই কারণেই তাঁকে বলা যেতে পারে ফিনল্যান্ডের সাহিত্য সম্রাজ্ঞী। পঞ্চাশটির বেশি গ্রন্থ—কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য। তাঁর লেখা কাহিনী অবলম্বনে রচিত হয়েছে চলচ্চিত্র; তাঁর লেখা নাটক অভিনীত হয় মঞ্চে, বেতারে ও টেলিভিশনে। তাঁর প্রকাশভঙ্গি অন্তরঙ্গ ও আন্তরিক; দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি থেকেই তাঁর সাহিত্যের রসদ—তবে তার মধ্যেই নিহিত থাকে বৃহৎ এবং মহতের আভাস। তাঁর গল্প ও কবিতা অনেকবার অনূদিত হয়েছে পশ্চিম ও পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় এবং সম্প্রতি গুজরাতি ও চিনে ভাষাতেও। যতদূর জানি, বাংলা ভাষায় এই তাঁর প্রথম আবির্ভাব।
ফিনল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলের সুইডিশভাষী পর্ভো শহরে সোলভেইগ ভন শুল্ৎস্ এর জন্ম ১৯০৭ সালে। রাজধানী হেলসিংকির তিরিশ মাইল দূরে এই মধ্যযুগীয়, ঐতিহাসিক শহর। আট ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবচেয়ে ছোট। বাবা অ্যালবার্ট সেগারস্ট্রেল সেই শহরে ধর্মতত্ত্বের শিক্ষক; মা হানা নামকরা শিল্পী এবং অংকনশিক্ষিকা। কলেজের পাঠ শেষ করে তিনি হেলসিংকি শহরের লাগুস্কা বিদ্যালয়ে শিক্ষিকার চাকুরি নেন। এখানে কাজ করতে করতেই ডিপ্লোম্যাট স্তেন ভন শুল্ৎসের সঙ্গে পরিচয় এবং ১৯৩০ সালে বিবাহ। দুই কন্যা উরসুলা আর বারবারার জন্ম যথাক্রমে ১৯৩৪ ও ১৯৩৬ সালে—তাদের শৈশব ও বড় হওয়া তাঁর কবিতা ও গল্পের বিষয়বস্তু। ১৯৬১ সালে তিনি দ্বিতীয় বার বিবাহ করেন সঙ্গীতের অধ্যাপক এরিক বার্গম্যান (১৯১১-২০০৬)-কে। এরিক তাঁর অনেকগুলি কবিতায় সুর দিয়ে সফল ও জনপ্রিয় সংগীত রচনা করেছেন।
সোলভেইগ-এর সাহিত্যচর্চার শুরু স্কুলে পড়ার সময় থেকেই; কলেজ এবং শিক্ষিকাজীবনে তা চলতে থাকে সমান তালে। কমবয়েস থেকেই তাঁর অনুরাগ শিশুসাহিত্যে। বিয়ে করে নতুন সংসার পাতার পরেও শিথিল হয়নি তাঁর সাহিত্যনিষ্ঠা—বিয়ের দু-বছর পরে ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম গ্রন্থ—শিশু ও কিশোর পাঠ্য—“পেট্রা এবং রূপালি বানর”। দুটি সন্তানের জন্ম দেওয়া ও লালনপালনের ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকে একটি আধা-আত্মজৈবনিক উপন্যাস রচনাকর্ম—‘ডিসেম্বর’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৭ সালে। ফিনল্যান্ডের শিক্ষিত অথচ রক্ষণশীল পরিবারে সাত ভাইবোনের সঙ্গে একটি প্রতিভাময়, শান্ত অথচ দ্রুতপরিণত বালিকার (অকালপক্ক বললে হয়ত শুনতে খারাপ লাগবে) বড় হয়ে ওঠার কাহিনী। বালিকা ও কিশোরী কালের নানান ঘটনা তাঁর মানসপটে জ্বলজ্বল করবে বহুকাল এবং তার তাড়নায় পরবর্তীকালে রচিত হবে আরো দুটি আত্মখননের উপন্যাস—“আন্সা এবং বিবেক” (প্রকাশ—১৯৫৪) এবং “যেখানে তুমি দাঁড়িয়ে” (প্রকাশ—১৯৭৩)। এই পরের দুটি উপন্যাসে দগদগে রূপে প্রকাশিত তাঁর বয়ঃসন্ধি-জাগরুক স্বপ্নের মতন জীবন্ত, উজ্জ্বল, প্রখর—অসাধারণ প্রাণোচ্ছ্বল তার বর্ণনা; তাৎক্ষণিক অনুভূতি ও ভাবনার ভারে ক্লিষ্ট হলেও সুপাঠ্য সাহিত্য। দুই কন্যার জন্ম ও শৈশব সোলভেইগের আর একটি মহৎ গ্রন্থের উপাদান—১৯৪২ সালে প্রকাশিত “সাতটি দিন” উপন্যাসের; ছয়-সাত দশক পরেও গ্রন্থটি জনপ্রিয়—দুই কন্যার জীবনের প্রথম সাত বছর এই গ্রন্থের উপজীব্য। তার বর্ণনা স্নেহসিক; বিশদ এবং অনুপুঙ্খ, শিশু মনস্তত্ত্বের এবং সন্তানপালনবিদ্যার একটি কালজয়ী ক্ল্যাসিক। ১৯৭০-এর দশাব্দে তিনি আরেকটি দীর্ঘ প্রজেক্ট হাতে নেন তাঁর মা হানা-কে ঘিরে। “হানার আলেখ্য” নামের আত্মজৈবনিক উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে। বইটি লিখতে শুরু করার সময়ই সোলভেইগের বয়েস সত্তরের কাছাকাছি। নিজের মায়ের শেষজীবন, বার্ধক্য এবং মৃত্যুর কথা লিখতে গিয়ে বার বার চলে এসেছে লেখকের প্রৌঢ়ত্বের কথা। পশ্চিমের দেশগুলিতে যৌবনের জয়জয়কার—জরা সেখানে নিন্দনীয়; একাকী ও গৌরবহীন। গ্রন্থটি একদিকে মা-মেয়ের সম্পর্কের ঘাত-প্রতিঘাত বিষয়ক আবার অন্যদিকে বিংশ শতাব্দীতে ফিনল্যান্ডের নারীর ইতিহাস। আত্মজৈবনিক এই চারটি কথাসাহিত্যের গ্রন্থ রচনা করেই ফিনল্যান্ড-সুইডিশ ভাষার সাহিত্যের ইতিহাযসে তাঁর স্থায়ী আসন।
|| ২ ||
এবার সোলভেইগের সবচেয়ে প্রিয় বিষয়—কবিতার কথায় আসি। বিশাল ক্যানভাসে লেখা আত্মজৈবনিক ও ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য লিখে তাঁর উত্তর ইয়োরোপ জুড়ে জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি। অথচ তিনি রক্তে-মাংসে, অস্থি-মজ্জায় এক আপাদমাথা কবি। কবিতা লিখেছেনও তিনি প্রচুর—অর্ধশতাব্দী ধরে নানান প্রবন্ধে ও অসংখ্য সাক্ষাতকারে তিনি জানিয়েছেন—কবিতা তাঁর প্রথম প্রেম এবং দ্বিতীয় প্রেম ছোটগল্প। কবিতায় তিনি নারীসুলভ অনুভূতিগুলি প্রকাশ করেছেন তাঁর অনবদ্য শৈলিতে—পৃথিবী, সূর্য, সমুদ্রের ঢেউ, বৃক্ষরাজি তাঁর কাব্যভাবনায়, তাঁর সৃষ্টিশীলতার এবং সময়ের অগ্রগতির প্রতীক। গদ্যের জগতেও তাঁর দেখার চোখটি বিশুদ্ধ কবির—ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নির্যাসটুকু ছেঁকে নিয়ে প্রতীক ও উপমার মাধ্যমে তার আবেগহীন বহিঃপ্রকাশ। দৈনন্দিন ঘটনা ও কাজকর্মের মধ্যেও তিনি খুঁজে নেন কবিতার বীজ। এক একটি কবিতা তাঁর কাছে এক বিন্দু বৃষ্টির জল, যার মধ্যে তিনি দেখতে পান মানব অস্ত্বিত্বের পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন। ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “আমার প্রহর”—সেখানে তুমুল শীতের অকথ্য অনাচারের পর বসন্ত এলে মানুষ ও প্রকৃতির মুক্তি। এই সংকলনের একটি জনপ্রিয় কবিতার নাম ‘মূক বৃক্ষদল”—নতুন বসন্তের উষ্ণতায় নতুন পাতা গজালে বার্চ গাছ খুশি, অজস্র ফুল ফুটেছে চেরিগাছে, কিন্তু স্মৃতিমুখর আপেল গাছটি ভুলতে পারে না গত শীতের ভয়াবহতার কথা—
“দুঃস্বপ্নের মতো ঠান্ডা, অন্তহীন শৈত্যের প্রবাহ
কনকনে অন্ধকার সজোরে জড়ায় তাকে রাতে
শ্বাসরুদ্ধ করে তার অভিভূত, আচ্ছন্ন হৃদয়।”
প্রথম গ্রন্থ থেকেই তাঁর কবিতায় প্রকৃতি সুন্দর, ভয়ংকর, সতেজ এবং মুখর। ইঙ্গমার বার্গম্যানের চলচ্চিত্রের মতন সেখানে সাদা আর কালো রঙের প্রাধান্য হলেও দৃশ্যগত আবেদনের অভাব নেই।
দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “আনন্দকে সরিয়ে রেখে”-র প্রকাশ ১৯৪৩। তার দুবছর পরে “কান্নার প্রতিধ্বনি”। প্রকৃতি নব নব রূপে তার বাসনা-কামনা সমেত উপস্থিত। তার সঙ্গে সঙ্গে রইল বিশুদ্ধ প্রেমের অভিব্যক্তি এবং বেশ কিছু মাতৃত্ব বিষয়ক কবিতা। কিন্তু পরিবেশের রূঢ় বাস্তবকেও ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
১৯৩৯ সালে ইয়োরোপ জুড়ে শুরু হয়েছে যুদ্ধ। সেই বছরের তিরিশে নভেম্বর নানা ছলছুতোয় সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণ করল ফিনল্যান্ড—একুশটি ডিভিশান, সাড়ে চার লক্ষ সৈন্য (দেশটির লোকসংখ্যা তখন ৩৫ লক্ষ)। প্রচণ্ড বোমাবর্ষণে হেলসিংকি শহরটি ধ্বংস হবার উপক্রম। কবির সমকালীন কবিতায় সেই বিষাদের দীর্ঘ ছায়া।
সোলভেইগের সৌন্দর্যপিপাসু কবিসত্তা যুদ্ধ শেষ হবার পরে ফিরে এল নতুন রূপে। “নিশীথের তৃণভূমি” (প্রকাশ ১৯৪৯) কাব্যগ্রন্থের একটি বহুপঠিত কবিতা “অল্ডার গাছের জন্যে বিলাপ”—প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর পূর্বের দৃঢ় বন্ধন তখন আরো জোরালো। কোনো কোনো গাছ তার ক্ষণস্থায়ী জীবন নিয়েই সুখী—বসন্তে তারা গজায়, আনন্দে কাটায় গ্রীষ্ম, আবার হেমন্ত এলে ঠান্ডায় মরে যায়। আবার অন্য গাছের জীবন কয়েক শতাব্দীর—কিন্তু দুজনেই নিজ নিজ জীবন নিয়ে তৃপ্ত; মানুষের জীবনেও ক্ষণস্থায়ী ও চিরন্তনের টানাপড়েন; তাদের পক্ষে কি সম্ভব একে অন্যের কথা বুঝতে পারা?
“মহীরুহ কী করে বুঝবে লতাকে?
যার জীবন মাত্র কয়েক মাসের।”
পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ “সবকিছু ঘটে এখন” (প্রকাশ ১৯৫২) এবং ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ “জাল” (প্রকাশ ১৯৫৬) পর্যন্ত চলেছে সেই একই থিমের অনুবর্তন, তবে প্রকাশভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে। বোবা গাছ, প্রাজ্ঞ গাছ, কুঠারের ঘায়ে পতিত গাছ সবাই ফিরে এসেছে নতুনভাবে, ফুটে উঠেছে তাদের অন্তর্নিহিত দার্শনিক দীপ্তি। গাছ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেও গতিশীল জীবনের প্রতীক। পাপ ও পুণ্যের নিরিখে গড়া মানুষের জীবনগাছ ও জীবনশক্তি টানে পৃথিবী এবং পাতাল থেকে। পরের দুটি কবিতা সংকলনের নাম “অবনত করো দীপ” (প্রকাশ ১৯৬৩) এবং “খেরো খাতা” (প্রকাশ ১৯৬৮)। বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কবি শব্দের ব্যবহারে মিতব্যয়ী, গতিশীলতা কমছে কবিতার, বাড়ছে গভীরতা। সমুদ্রের ঝোড়ো হাওয়া এসে আলিঙ্গন করে যে নারীকে, তার পরিণত মুখে এমন বলিরেখা, তার চুম্বনের স্বাদ এখন নোনতা।
নবম (“চারজন বংশীবাদক”, প্রকাশ ১৯৭৫) এবং দশম “বৃক্ষের আড়ালে সমুদ্রের গান”(প্রকাশ ১৯৮০) কাব্যগ্রন্থেও চলেছে কবির সংযত মিতকথন; তাঁর অনুভূতিগুলি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণতর, তাতে বয়েসের কোনো ছাপ নেই। গাছ ও পাখিদের কোনো নাম নেই সেখানে, তাদের প্রভাব না থাকলেও অস্তিত্ব রয়ছে, গুরুত্বপূর্ণ না হলেও অনুপ্রাণিত করল দুই বিখ্যাত শিল্পীর শিল্পকর্ম—প্রথম জন জার্মান চিত্রশিল্প ও স্থপতিনী ক্যাথি স্মিট কলউইৎস (১৮৬৭-১৯৪৫), সমাজতন্ত্রী এবং শান্তিবাদী, যাঁর শিল্পে ও স্থাপত্যে একই সঙ্গে প্রকৃতি অপরূপ এবং যুদ্ধের পাশাপাশি বিদ্যমান; এবং ফিনল্যান্ডের চিত্রশিল্পী হেলেন স্কার্ফবেক (১৯৬২-১৯৪৬), যাঁর স্টিল লাইফের বিষণ্ন একাকীত্ব এখনও মানুষেকে ভাবায়। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত “কপিকল” কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতা এই দুজন মহান শিল্পীর শিল্পভাবনায় জারিত। গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে কলউইৎসের অংকিত একটি আত্মপ্রতিকৃতি। পরম আন্তরিকতার সঙ্গে সারগর্ভ দার্শনিকতা মিশেছে এই গ্রন্থের কবিতাগুলিতে। কবির বয়েস তখন আশির দোরগোড়ায়।
জীবিতকালে আরও তিনটি কাব্যগ্রন্থ হয়েছিল তাঁর—১৯৮৯ সালে “সময় মাপার একটি উপায়”; ১৯৯৪ সালে “প্রজাপতির সঙ্গে কথোপকথন”, ১৯৯৭ সালে তাঁর অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত কবিতাগুলি সংকলিত হয় “পুণ্য অশান্তি” নামক গ্রন্থে। এই পনেরোটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও তাঁর রয়েছে ন’টি ছোটগল্পের সংকলন।
১৯৮০-এর দশাব্দে সোলভেইগের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ শুরু করেন ডেন ব্রিটিশ কবি ও প্রাবন্ধিক অ্যান বর্ন। কবির প্রথম বারোটি কাব্যগ্রন্থ থেকে নির্বাচিত কবিতার ইংরেজি অনুবাদ সংকলিত হয় “তুষার এবং গ্রীষ্মগুলি” নামক গ্রন্থে; প্রকাশ ১৯৮৯ সাল, প্রকাশক ফরেস্ট বুকস—আর্থিক অনুদান দিয়েছিলেন ইউনেসকো। একই সঙ্গে প্রকাশিত হয় তাঁর একটি গল্পগ্রন্থ—“হৃদয়কর্ম: নির্বাচিত ছোটগল্প”; গল্পগুলির ইংরেজি অনুবাদ করেন মারলেইন ডিলার্গি এবং জোন টেট। দু দশক পরে আজ দুটি গ্রন্থই দূষ্প্রাপ্য। আমি প্রথম গ্রন্থটি থেকে আমার প্রিয় কিছু কবিতা পছন্দমত বেছে নিয়ে তাদের বাংলা অনুবাদ করেছি। আশা রাখি কবির বৈচিত্র্যময় সাহিত্যজীবনের একটা ছবি ফুটে উঠবে সেই অনুবাদগুলি থেকে।
(নভেম্বর ২০০৯)
মূক বৃক্ষদল / সোলভেইগ ভন শুল্ৎস্ (১৯০৭-১৯৯৬)
লবঙ্গ, ওষধিবৃক্ষ—পদপ্রান্তে বার্তা ফিসফাস,
বার্চ ভুলে গেছে কবে শীতের কঠোর রাত্রিগুলি,
নবীন পত্রের প্রেমে; অবহেলাভরে চেরিগাছ
ঝরায় পাপড়ি সাদা, পথচারীদের ন্যস্ত কেশে;
আপেল বৃক্ষের মনে অতীতের তিক্ত-কষা স্মৃতি
ছড়ানো শাখার পুঞ্জে অন্ধকার—উৎকর্ণ, জটিল।
কচিকাঁচা ঘাসেদের নির্বধ গুঞ্জন কানে এলে
বৃক্ষেরা অগ্রাহ্য করে, তৃণ দল খারাপ সময়
কাটিয়েছে শীতঘুমে। নব নব পত্রের কাকলি
তাদের অবোধ কানে প্রবেশ করে না বেহিসাবী,
বৃক্ষের মহার্ঘ দান ফুলগুলি মনে মনে জানে
গ্রীষ্মের করুণা দিয়ে তাদের জীবন সাবলীল।
পথ রুদ্ধ করে রাখে আপেলের ক্রুদ্ধ শাখাগুলি,
অন্ধ, হাতড়ায় তারা: দূরে দ্যাখে নীলাভ তুষার,
মৃদুমন্দ হাওয়া দিলে কাঁপে, মনে পড়ে যায়
শীত দুঃস্বপ্নের মতো ঠান্ডা, অন্তহীন শৈত্যের প্রবাহ,
কনকনে অন্ধকার সজোরে জড়ায় তাকে রাতে
শ্বাসরুদ্ধ করে তার অভিভূত, আচ্ছন্ন হৃদয়।
যে শিকড় ভালো জানে তুষারের অমোঘ প্রকোপ
গ্রীষ্মেও যায় না তারা, কোঁচকানো বৃক্ষের বাকলে
নতুন পত্রের আশা-অপেক্ষায় শীতল হৃদয়?
কে তাকে সান্ত্বনা দেবে? বৃক্ষের অবশ শাখাগুলি:
কে শোনে তাদের ধ্বনি, তাদের স্তম্ভিত কথামালা?
মনে আছে? মনে আছে? মেলে ধরতে জানো পাপড়িগুলি?
(The Mute Trees)
শেষ হল দগ্ধ দিনটিও
হাতের লন্ঠন, নীল দ্যুতি
অ্যাশফল্টে দপদপে ছায়া
ভাঙা গৃহ, নিবিড় শূন্যতা।
পায়ের তলায় ভাঙে কাচ
অন্ধ জানালার চোখ থেকে
পা ফেলতে ভয় লাগে যদি
কান্না, আর্তনাদ জেগে ওঠে।
রাস্তাগুলি অনেকক্ষণ মৃত
রক্তপাতে দেয়াল মলিন;
যেখানে শিশুরা খেলে রোজ
সেখানে জখম, হাহাকার।
ধোঁয়া ওঠে, ছড়ায় বাতাসে
তিক্ত কটূ গন্ধ ভাসমান।
লন্ঠনের নিকটে জানালা
বোবা শূন্য মুখের ব্যাদান।
পর্দাময় ঝুলকালি, ধুলো
নিশীথ হাওয়ায় ওড়াউড়ি;
কৃষ্ণকায় ডানা মেলে পাখি
অন্ধকারে, ক্লান্ত গৃহহীন।
টীকা—এই দিনটিতে সোভিয়েত রাশিয়ার লালফৌজ ফিনল্যান্ড আক্রমণ করে। সারাদিনের বোমাবর্ষণে বিধ্বস্ত হেলসিংকি শহরের বিবরণ।
প্রেমিক-প্রেমিকা / সোলভেইগ ভন শুল্ৎস্ (১৯০৭-১৯৯৬)
|| ১ ||
যখন আমার হাতে হাত বোলাও তুমি
ধীর, অভ্যন্তর, নিরুচ্চার, ডান এবং বাঁহাত—
গাছ গজায় আমার অন্তরে, বন্দী পাখির ঝাঁক উড়ে যায়।
যখন তুমি গ্রহণ করো আমার ওষ্ঠ, ডুবে যাও তার গভীরে,
দ্রুত ডানা ঝাপটায় আমার আঁখিপল্লব:
ছেড়ে দাও, মুক্তি দাও আমায়। আমি মুক্ত হতে চাই।
যখন তুমি চুমু খাও আমার স্তনে
কলিরা কাঁপে, ফুল হয়, ত্বক খুঁজে পায় কন্ঠস্বর:
আশ্লেষে চেঁচিয়ে উঠি আমি, নীরব চিৎকার।
|| ২ ||
চারপাশে ধরার বাতাসে মৃদু মর্মর
শিকারি হাঁটে মন্থর অথচ দৃপ্ত গতি,
তার সঙ্গী কুকুরটির নিরানন্দ আর্তনাদ,
অজানা গ্রহ থেকে তীর ছোটে—
এবং সব কিছু ছাপিয়ে কৃষ্ণ ঝড়ের গর্জন।
নক্ষত্রের শয্যায় টানটান শুয়ে আমরা
নক্ষত্রের শয্যা, আমরা নির্ভয়।
যতক্ষণ আমার উষ্ণতামথিত নিঃশ্বাস পড়ে তোমার কাঁধে,
আর তোমার হাতের শান্তি-বিশ্রাম আমার উরুখিলানে,
যতক্ষণ আমরা চোখ বুজে মনোবার্তা শুনতে থাকি,
প্রবেশ করি একে অন্যের ভিতর, পুরনো কামনা ও স্মৃতি সমেত,
যতক্ষণ আমাদের মিলিত হাসি অন্ধকারের পানে বয়,
যতক্ষণ আমরা বাঁধা থাকি উজ্জ্বল বিশ্বাসে,
কোনো সন্তাপ স্পর্শ করে না আমাদের।
(The Lovers)
হঠাৎ আলোর ঝলক বন্যার মতন
তার ঘাগরা বেয়ে ওপরে ওঠে
ছড়িয়ে যায় তনুর অন্ধকার গভীরে।
নারী ত্বরিতে ঘাগরা খুলে ফেললে,
সাদা সাদা পপিফুল হয়ে
তারা ওড়ে বিছানার ওপরে শূন্যে।
পুরুষটি ধরতে যায় তাদের
মুখ ডোবায় তাদের শান্ত ও
আত্মসমর্পণময় অস্তিত্বে।
এদিকে তার ভুলে যাওয়া নারীটি
নগ্ন দাঁড়িয়ে
শয্যার পাশে।
(Dream)
চোখবাঁধা বলদ মন্থরগতি হাঁটে,
কপিকল ঘোরে শ্লথগতি, ক্রমাগত
বানায় প্রহর, কিন্তু সেটা অদৃশ্য
এবং প্রকৃতপক্ষে তার
খুন করার অনুমতি নেই।
(The Waterwheel)
তুমি আর আমি
এই তুমি আর আমি
মানে আমরা।
এ সম্পর্ক চিরস্থায়ী।
কখনও তার বস্তুরূপ বা ওজন
আমি দেখতে পারি হাতে নিয়ে
উষ্ণ অথচ দৃঢ়, চোখে দেখার জন্যে,
ভাগ করে নিই তাকে
যা রুটি আর নুনের মতই
অপরিহার্য।
(This You and Me)
নভেম্বর / সোলভেইগ ভন শুল্ৎস্, ফিনল্যান্ড (১৯০৭-১৯৯৬)
জীবন আর মরণের ছাড়াছাড়ি হল একটু আগে।
মরণ হাঁটতে গেল
কালো পাতা ছড়ানো বনভূমিতে
জীবন বাড়ি ফিরে গেল
শিকড়ের কাছাকাছি ঘুমোতে
মাঠে ঘাটে স্বস্তির নিঃশ্বাস
আর অন্তহীন প্রশান্তি
অন্ধকার আর বিশ্রাম। শেষ পর্যন্ত।
(November / Solveig Von Schoultz)
নিকট
সমুদ্রে ভাঁটা নামলে
কুয়োর জল তলিয়ে যায় নীচে
সমুদ্রে জোয়ার এলে
কুয়োর জল থই থই বাড়ে
মানবমনে বেঁচে থাকার ইচ্ছেও
ওঠে আর নামে—
নিকটে যারা থাকে তাদের স্রোতগুলি
একে অন্যের সঙ্গে মেলে।
(Close)
জ্বলন্ত কাচ
বসন্তে যেমন
তুমি সূর্যকে বন্দী রাখো জ্বলন্ত কাচে;
দেখতে পাও উত্তাপ কমে আসে
আর কালো হয় আকাশজোড়া কাগজ,
একটা ছোট্ট আলোর বিন্দু
জ্বলে তার গায়ে,
ঠিক তেমনই হতাশা
স্তব্ধতার গায়ে গর্ত খুঁড়ে আগুন জ্বালে।
(The Burning Glass)
তিন বোন / সোলভেইগ ভন শুল্ৎস্ (১৯০৭-১৯৯৬)
শিশুকে কোলে নেবার জন্যে মেয়েটি নুয়ে দাঁড়ালে
তার কেশদাম ছড়ায় মুখের ওপর;
এবং তার অভ্যন্তরে এক শীর্ণকায় বৃদ্ধা
শুকনো, উজ্জ্বল চোখ
তবে অশক্ত, নড়বড়ে—
তিনি নিচু হয়ে মেঝে থেকে তোলেন তাঁর উলবোনা;
এবং তাঁরও অভ্যন্তরে এক বালিকা
ঝুঁকে পড়ে কোমল দু হাতে
তুললো তার প্রিয় ডলপুতুল।
এরা তিন বোন
কিন্তু কেউ কাউকে চোখে দেখবে না কোনদিন।
(Three Sisters)
কথোপকথন
চল্লিশ বছরের সহবাস তাদের
আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাষা কঠিন ও দুর্বোধ্য
প্রথম প্রথম অল্প হলেও কিছু কথা বলতো তারা
এখন কেবল ঘাড় নেড়েই সন্তুষ্ট
শয্যায় এবং গৃহে।
চল্লিশ বছরের দৈনন্দিন অসহনীয় ব্যবহারে
তাদের মুখ পাথরের মতন অভিব্যক্তিহীন।
কখনও কখনও হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ায়
তর্জমাকারী;
এক বেড়াল অথবা অসামান্য এক সূর্যাস্ত।
তারা অস্থির হয়ে শোনে
বলতে চেষ্টা করে কিছু
কিন্তু বোবা হয়ে যায় মুখ ফোটার আগেই।
(Conversation)