• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ২৭ | আগস্ট ২০০২ | রম্যরচনা
    Share
  • স্বপ্নধূসর : দোলনচাঁপা চক্রবর্তী

    প্রায় চোদ্দ বছর পর গ্রামে এসেছি । অনেক কিছুই বদলেছে । তবু কেন জানি ভেবেছিলাম কাতর ঠিক তেমনি আছে । কাতর ! একটা অদ্ভুত নাম । কিন্তু, আমার কাছে সে শুধু একটা নাম নয় । সে চোদ্দ বছর আগে আমার দেওয়া কথা, যা বালি হয়ে মিশে গেছে নদীর চড়ায় । এসে থেকেই কাতরের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছাটাকে বয়ে বেড়াচ্ছিলাম । আজ রাঙাদিদার মুখে সব কথা জানতে পারলাম । বছর দশেক আগে । কংসাবতীতে তখন ভরা শ্রাবণের ঢেউ রোজই আশেপাশের জমিজমা একটু একটু করে খেয়ে চলেছে । সমস্ত দিন পাড় ভাঙার শব্দ ওঠে ঝুপঝাপ । সকালবেলা যে মাটিটা কচি দুর্বাঘাস নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল নদীর পারে, সেটাই সন্ধ্যাবেলা নদীর বুকে ঘোলা জল হয়ে যাচ্ছে । সময় থাকতে থাকতেই মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে দূরে সরে যাচ্ছে । এমনি একদিন, কাতররাও তাদের ঘরসংসারের টুকিটাকি নিয়ে বার হয়েছিল পাঁচ ক্রোশ দূরে কোনো আত্মীয়ের বাড়ি আশ্রয় নেবে বলে । মোষগুলোকে আগেই পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল সে বাড়িতে শুধু একটা বাছুর ছাড়া । সেটা কাতরকে ছাড়া কোথাও যেতে চাইত না । আগের রাত্রেই উদ্দাম বৃষ্টিতে পথঘাটে কোথ্থাও একফোঁটা জল রাখার জায়গা নেই । গোড়ালি ডোবানো জল । আর দেরি করা ঠিক হবে না ভেবে ভোর ভোরই বেরিয়েছিল ওরা । আধা পথ পার হয়ে স্কুলবাড়িটার কাছাকাছি মোটে পৌঁছেছে, ধানক্ষেতের ওপার থেকে নদীর বুকভাঙা জল ছুটে আসতে লাগল । সে নাকি এক অদ্ভুত দৃশ্য ! মোটা মেঘের বালাপোষ ছিঁড়ে সূর্য উঠেছে ! উজ্জ্বল রোদমাখা দিন, পাখিরা অল্প অল্প ওড়াউড়ি করছে এ-গাছ থেকে ও-গাছে । মেঘ ত্রক্রমশ আকাশমণির ডালের মধ্যিখান থেকে ইউক্যালিপটাসের পাতার ফাঁকের ভেতর সরে সরে লুকোচুরি খেলছে সূর্যের সঙ্গে । দু'-একটা জলঢোঁড়া আর চুনোপঁংউটির দল এঁংএকবেঁকে স্থির জলকে নড়িয়ে দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে কোথাও । হঠাৎ তুমুল শব্দ করে নদীর কাছাকাছি অঞ্চলে বড় দীঘির ধারের একটা নারকেল গাছ উল্টে পড়তেই ছবিটা ওলোটপালোট হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে । আশেপাশের ধানজমি ভাসিয়ে নদী উল্টানো ঢেউ ছুটে আসতে লাগল । সামনে স্কুলবাড়িটা থাকায় কাতরের বাড়ির সকলে ছুটল সেই দিকেই আপাতত বাঁচার আশায় । ওদিকে, কাতর ধরবার আগেই বাছুরটা ভয় পেয়ে ছুট মেরেছে উল্টোদিকে । পিছন পিছন কাতরও । বাছুরটাকে কোনোমতে কব্জা করে স্কুলবাড়িতে ঢোকানোর পর পরই জল এসে যায় সেখানে । বাছুর কোলে নিয়ে উপরে উঠতে উঠতে কেষ্টখুড়ো শুধু দেখেছিল একটা ভীষণ জলের তোড় স্কুলবাড়ির নিচতলাটা গিলে ফেলল । তারপর আর কেউ কোথ্থাও নেই । ওই প্রবল অবস্থার মধ্যে তিনদিন বেহুঁশ হয়ে ছিল খুড়ো । এখনও সেরে ওঠেনি । এত বছর পরেও ঘুমের মধ্যে কাতরের নাম ধরে চেঁচায়, আর সমস্ত দিন এক্কেবারে চুপচাপ থাকে, কারুর সঙ্গে একটা কথাও না । এইভাবেই বাঁচবে বাকি দিনগুলি যদি আরো অনেকদিন বাঁচতে পারে এই যন্ত্রণার বোঝা বুকে চেপে । কেউ জানে না আমি ছাড়া যে, এবার শুধু হারিয়ে যাওয়া ছোটোবেলার হারানো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার একটা লুকানো ইচ্ছা নিয়ে গ্রামে এসেছিলাম । কাতরের এই মর্মান্তিক পরিণতির কথা শুনে সোনাডহরির প্রতি সমস্ত আকর্ষণ এক নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে গেল । কেন কেউ আমায় কখনো বলেনি ? অথচ বললেই বা কি করতে পারতাম ! তবু, এখানে আর এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছা করছে না । আজ বিকেলের ট্রেনেই ফিরে যাব কলকাতা । শেষ একটু সময় কাটিয়ে যাব বলে কংসাবতীর তীরে এসে বসেছি । সকালে রোদ উঠেছিল বেশ জোর, কিন্তু, এখন মেঘে ঢেকে আছে চারপাশ । ভ্যাপসা গরম হতে পারত । কিন্তু, নদীর বুক থেকে উঠে পাতলা ফিনফিনে একটা হাওয়া উড়ে বেড়াচ্ছে চারপাশে । ফলে গরমটা একটু কমই লাগছে । একটা বাচ্চা ছেলে একপাল মোষ নিয়ে নদীতে নেমেছে । মোষগুলো গলা অবধি ডুবিয়ে মুখটা অল্প উপরে তুলে রেখেছে । মাঝেমধ্যেই বাচ্চাটা এক-একটা মোষের গা ডলে দিচ্ছে । এক্ষুণি ওরা উঠবে না । গরমের সময় ওরা অনেকক্ষণ ধরে নদীতে গা ডুবিয়ে থাকে । এই মোষের দল, বাচ্চা ছেলেটা, রাঙা বালি, নদীর জল -- এই সবই ফিরে ফিরে মনে করিয়ে দিচ্ছে আর একটা মুখ । সেই মুখটা কেবলই শিকড় ছেঁড়া শালুকফুলের মতো ভেসে যাচ্ছে দূর থেকে দূরে, কিছুতেই ছুঁংএত পারছি না তাকে । আমি যে সাঁতার জানি না ।




    দূর্গাপুজাটা এবার ভিজে যেতে যেতে বেঁচে গেছে । যা বৃষ্টি হচ্ছিল মহালয়া থেকে ! টুবলুদা' আর ওর ক্লাবের অন্য দাদাদের দুশ্চিন্তা দেখে মৌলি একবারও ভাবতে পারেনি যে এবার কলকাতা থেকে ঠাকুর আনা যাবে । অন্যান্যবার বর্ধমান থেকেই ঠাকুর আসে । এবারই টুবলুদা'দের শখ হয়েছে যে কলকাতার ঠাকুর আনবে । সেইমত কাছেপিঠের সমস্ত গ্রামে গ্রামে ঘুরে চাঁদা তুলে একটু ভালো প্যাণ্ডেল করা, আরো ভালো করে ভোগের ব্যবস্থা ইত্যাদি সবই হয়েছে ; শেষে কিনা এই ! তারমধ্যে এবার নতুন দুই-একটা ভঁংউইফোঁড় ক্লাবও পুজার ব্যবস্থা করেছে বলে খবর । সুতরাং, এখানকার কুমোরপাড়ার কড়িদাদুর কাছেও বাড়তি ঠাকুর পাওয়ার কোন উপায়ই নেই । টুবলুদা'র প্রাণের বন্ধু বাঙালদা' অবশ্য সেদিন জামগাছে হেলান দিয়ে উদাস মুখে মেঘের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে অন্য কথা বলেছিল । -"অন্য পূজা হৈতাসে দেইখ্যা নয় রে পোলাপানের দল ! কইলকাত্তায় অর্ডার দিসি দেইখ্যা বুইড়া খেইপ্যা গিয়াই আমাগো ঠাকুর দিব না, দেইখ্যা নিস ।" তা এতশত কথায় "পোলাপানেদের" মন খারাপ হবারই কথা । রাঙাদিদা অবশ্য বেজায় খুশি । কলকাতার ঠাকুর আনার ব্যাপারে প্রথম থেকেই তাঁর ঘোরতর আপত্তি ছিল,- "ক্যান, আমাগো কড়ির ঠাকুর কি কৈর্যা হঠাৎ খারাপ হৈয়্যা গেল শুনি ? কথায় কয় না, গাঁইয়া যোগী ভিখ চাইয়া চাইয়া পায় না ! এই হইসে দেখি সেই দশা । তোগো কি ভালো হইতে পারে ? হৈবনা, হৈবনা, লেইখ্যা নে, দেখস নি গরীবের কথা বাসি হৈলেই মিষ্ট হয়, তার আগে কক্ষনো হয় না ।"

    সবুজ দল সংঘ, অর্থাৎ টুবলুদা'রা যথারীতি গরীবের কথায় বিশেষ কর্ণপাত না করে কলকাতায় মৌলিদের বাড়িতে পূজার ঠিক আগেটায় দরকারি কেনাকাটার নাম করে বেড়াতে গিয়েছিল এবং সেইসঙ্গে অর্ডার দেবার কাজটাও সেরে এসেছিল । আসার আগে মা-বাবাকে বারবার বলেছিল, তাহলে কিন্তু এবার পূজায় তোমরা দেশে যাচ্ছ পিসি, না গেলে কিন্তু আর কক্ষণো আসব না । আর মৌলিকে কোলে তুলে একমুঠি লজেন্স দিয়ে গাল টিপে নামিয়ে, বাবা-মা'র আড়ালে বলেছিল, পিসি না নিয়ে যেতে চাইলে কিন্তু খুব কান্নাকাটি করবি মৌপাই । টুবলুদা' আদর করে মৌলিকে মৌপাই বলে ডাকে ।

    তা, কান্নাকাটি করেনি মৌলি আসার জন্য । কলকাতায় পূজার আনন্দ ছেড়েছুড়ে আসতেই বরং তার তেমন ইচ্ছা ছিল না । মা'ই জোর করে নিয়ে এলেন, বললেন, "কক্ষণো গ্রামের পূজা দেখনি, দেখবে চল কত মজা হয় -" মা'র কথাতেই তো মৌলি এসেছিল । কিন্তু, এসে থেকে বৃষ্টি, বৃষ্টি ; ঘরের বাইরে এক পা রাখলেই মা চেঁচিয়ে ওঠেন, "ভিজতে তোমায় বারণ করেছি না ? কথা শোন না কেন বলতো ?" সারাদিন যে ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে না, সেটা মা কিছুতেই বুঝতে চান না । এমনকী বাবা একবার বলতে গেছিলেন, "একটু ভিজলে আর এমন কি ক্ষতি হবে ? আমরা কি ছোটোবেলায় কম ভিজেছি ?" কিন্তু, মা'কে টলাতে পারেননি । "আমাদের মতো ছাপোষা, রোগে-ভোগা টাইপের হলে ওর চলবে ?" বলে চেঁচিয়ে উঠে মা থামিয়ে দিয়েছেন বাবাকে । মা যে কি সব বলেন ! বাবা কি রোগে-ভোগা লোক ? দিব্যি সকাল সন্ধ্যা ফিটফাট হয়ে অফিস যান, মাঝেমধ্যে একটু হাঁচি-কাশি ছাড়া তো তাঁর আর কখনো কিচ্ছু হতে দেখেনি মৌলি । কিন্তু, মা সেসব বুঝবেন না । গ্রামে মৌলির বয়সী যে সব ছেলেমেয়েরা আছে, ওরাও কেউ মিশতে চায় না কেন যেন । মৌলি একটু এগিয়ে গেলেই দূর থেকে মুচকি হেসে পালিয়ে যায় । আর আসে না । টুবলুদা'র দুই বছরের ছোটো বোন টুনুদিও কেবল ঘাড় দুলিয়ে হেসে হেসে গল্প করবে বাদলকাকুর ছোটো ছেলে টাকুর সঙ্গে । টাকুকে একদম দেখতে পারে না মৌলি । তাকে দেখলেই টাকু কেবল দাঁত বের করে বলবে "কি খুকী, কেমন লাগছে এখানে?" শুনলেই গা জ্বলে যায় মৌলির । সে কি খুকী ? তাছাড়া, বাঙালদা একদিন টুনুদি'কে বলছিল, "টাকুটা মেয়েদের মতো পান খায়, বিড়ি খেলেও না হয় বুঝতাম ; ওর সঙ্গে তুই কেন মিশতে যাস রে টুনু ? আর কাউকে দেখতে পাস না, না ?" "আর কাউকে দেখে আমার দরকার নেই"-- বলে ঘাড় ঘুরিয়ে চলে গিয়েছিল টুনুদি' । তারপর থেকেই মৌলির ধারণাটা আরো পাকা হয়েছিল যে টাকু ছেলেটা একদম ভালো না । তবে টুনুদি'কে তার অল্পস্বল্প ভালো লাগে, কিন্তু, টুনুদিটা এত্ত গাল টেপে যে গাল ব্যথা হয়ে যায় । তাছাড়া টুনুদি যে অনেক বড় ! অগত্যা, বৃষ্টি একটু ধরলে মৌলি একা একাই ঘুরে বেড়ায় ঘরের এদিক-সেদিক । এই প্রথম গ্রামে আসা ; তেমন কিছু তো চেনেনি এখনো । তাছাড়া, যা বড় বড় পুকুর এক-একটা, দেখলেই ভয় করে । কাঁসাই কিংবা কংসাবতী নদীও তো বাড়ির কাছেই । মৌলির খুব ইচ্ছা নদী দেখতে যাবে, কিন্তু, বড়রা যেতে দিলে তো । টুবলুদা'রা তো ওই বৃষ্টির মধ্যেই মাছ ধরতে যায় নদীতে । কই, ওদের তো কেউ কিছু বলে না । বাবাও গেছেন দু'-একদিন । মা'র জন্যই মৌলিকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেননি । তা এ-হেন বিচ্ছিরি অবস্থার মধ্যে পড়ে থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে গেছিল মৌলি । হঠাৎ চতুর্থীর দিন ভোরে, টুবলুদা'র প্রবল চিত্কারে ঘুম ভেঙে উঠে দেখে আকাশ আলো করে সূর্য উঠেছে, মাঠঘাট আলোয় আলো, কোথ্থাও বৃষ্টির ছিঁংএটØংএংআঁটা নেই ।

    তার পর তো শুরু হয়ে গেল ঢাকের বাদ্যি আর শোরগোল । টুবলুদা'রা অল্প কিছু মুখে দিয়েই 'দুগ্গা' বলে বেরিয়ে পড়ল ঠাকুর আনতে । পঞ্চমীর ভোরে প্যাণ্ডেলে ঠাকুর নামিয়ে দিয়ে টুবলুদা', আর বাঙালদা' স্নান করে খেয়ে তিনঘন্টা টেনে ঘুম । তারপর উঠে আবার দৌড়, দৌড় ! মা'-মামিমারা সন্ধ্যাবেলা দল বেঁধে গেলেন সোনামুখীতে । সেখানে নাকি ভালো কাপড়ের দোকান আছে । বাড়ি ভর্তি সকলের জন্য কাপড় এল । মৌলির জন্য মা' কলকাতা থেকেই সুন্দর জামা কিনে এনেছিলেন । সোনামুখী থেকে আবার রাঙাদিদা, মামিমা সক্কলে জামা কিনে দিলেন মৌলিকে । পুজার ক'দিন রোজ একটা করে নতুন জামা পরা যাবে -- তার মজা কি কম ? কিন্তু, তাও কেমন একা একা লাগে মৌলির । মা তো সব সময় থাকেন মামিমার সঙ্গে । এবার আবার পূজায় যত সন্দেশ লাগবে, তার অর্ধেকটা তৈরি হচ্ছে এ বাড়িতে । রাঙাদিদার নাকি কি মানত ছিল, সেজন্য দুপুরের মধ্যেই যাবতীয় রান্নাবান্না সেরে খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে, রান্নাঘর ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে সেখানে চলছে দুধ জ্বাল দিয়ে দিয়ে ঘন করে তা থেকে ছানা তৈরি, চিনির রস জ্বাল দেওয়া -- এই সব নানারকম কাজ । ছানাটাকে যখন দিদিমা বিশাল একটুকরো সাদা রঙের ন্যাকড়া মতন কাপড়ে ফেলে বেঁধে জানলার পাশের ওই উঁচু ডাণ্ডাটা থেকে ঝুলিয়ে দেন, আর সেটা থেকে টুপ টুপ করে জল পড়ে নীচের বাটিটাতে, সেটা দেখতে বেশ মজা লাগে । তা এই সব করতে সময় লাগে না ? সুতরাং পঞ্চমীর সকাল থেকেই মা'র আর দেখা নেই । আর বাবা হয় মামু নয় টুবলুদা'দের সঙ্গে ঘুরে কাজে ব্যস্ত । মৌলির কথা ভাবার সময় কোথায় কারুর ? তাছাড়া মা বহু বছর পরে গ্রামে এসেছেন, অনেক চেনাশোনা । সবার সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে । ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যাবেলা ঠাকুর দেখে মৌলি প্যাণ্ডেলে বসে বসে ভাবছে । কেমন সুন্দর ঠাকুর । দুর্গামায়ের মুখটা একেবারে চকচক করছে , আর মাথার তাজটা ? ইস কি সুন্দর । হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন কাঁধে টোকা মারল । মুখ ঘুরিয়ে দেখে, ওমা, এ তো সেই ছেলেটাই । সক্কালবেলা করে গরুর দুধ নিয়ে আসে কেষ্টকাকু, তার সঙ্গে রোজ আসে এই পুঁচকে ছেলেটা । অবাক হয়ে গিয়ে মৌলির মুখের চেহারাটা বোধহয় "কি চাই তোর" গোছের হয়ে থাকবে । ছেলেটাই বলল, "এই, তু আমার সঙ্গে খেলবি ?" তুমি-টুমি না, এক্কেবারে তুই !
    -- তুই রোজ দুধ দিতে আসিস না ? কেষ্টকাকুর সঙ্গে ?
    -- ঊ তো আমার খুড়া বটে । ইখন থিকে ঘর চিনে না রাইখলে ঊ কাজটা কইরব কিমন কুরে ? তুবে উ কাজটা কুরতে আমার মন যায় না ।
    -- তবে করিস কেন ?
    -- করি না তো , খেইলে বেড়াই । তু খেলবি?
    -- এই সন্ধ্যাবেলা কি খেলব ?
    -- তা বটে । কাল সুকালে আসব তব্যা, ইখন যাই ।
    -- তোর নাম কি বললি না তো?
    -- কাতর ।
    -- এ আবার কি নাম ?
    -- আমার জন্মের সময় মা'টা ব্যথা পাইয়ে মইরেই গেল বুলে আমার ওই নাম হইছে গো । তুর নামটা কি বটে ?
    -- মৌলি ।
    -- মুলি ; ভালো নাম বটে ।
    -- মুলি না, মৌলি । মুলি তো হিন্দীতে মুলোকে বলে । আমাদের হিন্দী পড়ায় না ? আমি জানি তো । আমি কি মুলো ?
    -- হিন্দী আবার কি বটে ? তু মুলো হবি কেনে ? আমি তো মুলি বলিচু । ইখন আসি, কাল তুর লিগে একটা
    জিনিষ আইনে দিব । কথা শেষ হতে না হতে পাঁই পাঁই করে দৌড়ে পালিয়ে গেল কাতর ।

    সপ্তমীর দিন সকালে স্নান সেরে সেজেগুজে মৌলি বসে আছে তো আছেই, কাতর আর আসে না । একটু পরে এল কেষ্ট কাকু দুধ নিয়ে । দৌড়ে গেছে মৌলি । "কাকু, কাতর কোথায় ?"
    -- ঊর তো জ্বর হৈছে মাগো । ধূম জ্বর বটে । আজ উইঠতে পারব্যাক নাই গো ।"
    উঠতে পারবে না, তাহলে যে খেলবে বলেছিল ? জ্বর হওয়া খারাপ, মৌলি জানে । খুব কষ্ট হয় । তাহলে সে আজ সারাদিন কি করবে ? বাড়ির উঠানের এক পাশে দুটো বিশাল বেলগাছ । কত্ত বড় বড় বেল হয় । রাঙাদিদা যেদিন আঁকশি দিয়ে পাতা পাড়তে পারে না, সেদিন টুবলুদা' গাছে চড়ে পাতা পেড়ে আনে । তারই একটার ছায়ায় বসল মৌলি । অল্প অল্প হাওয়া দিচ্ছে , ঝকঝকে রোদ । খুব খেলতে ইচ্ছা করছে । কিন্তু কার সঙ্গে খেলবে ? দুটো শালিক প্রায় তার সামনে এসে দানা খঁংউটছে আর কিচকিচ করছে । রান্নাঘরের পাশে রঙ্গন Øংউলের গাছটা ফুলে বোঝাই । লাল ফুলগুলো হাওয়ায় দুলছে আর টুপটাপ করে এক একটা ফুল পড়ে যাচ্ছে মাঝেমধ্যে । বেলগাছের পাশেই খিড়কির দরজা । সেটা একটু দুলতে দুলতে খুলেই গেল । কাতর না ? হঁযা, তাই তো !
    -- ওমা তুই কোথ্থেকে এলি ? তোর না জ্বর ?

    কাতর মুখে আঙুল দিয়ে ইশারায় চুপ করতে বলে রান্নাঘর দেখাল । ওখান থেকে এই জায়গাটা দেখা যায় । তারপর ইশারায় ডাকল । মৌলিও টুপ টুপ টুপ করে পা ফেলে দিব্যি বাইরে এবং পড়বি তো পড় টুবলুদা'র সামনে । পূজার বেলপাতা পাড়তে এসেছে ।
    -- অ্যাই, তোরা কোথায় যাচ্ছিস রে ?
    -- খেলতে যাচ্ছি টুবলুদা' ।
    -- পিসিমণিকে বলেছিস ?
    -- মা'কে বললে মা যেতে দেবে না । কাঁদো কাঁদো মুখ মৌলির ।
    -- আচ্ছা যা, বিকেল বিকেল Øংইরিস কিন্তু । পিসিমণিকে আমি ম্যানেজ দেব ।

    সেই মৌলির গ্রাম দেখার শুরু । তারপর সারা ছুটি যে কোথা দিয়ে কেটে গেল -- । মৌলিকে সাঁতারও শেখাবে বলেছিল কাতর । কিন্তু সেটা আর হয়নি । ক'দিনের বৃষ্টিতে কাঁসাই নদীর তখন বুকভরা জল । ওই জ্বর নিয়েই একটা বড় কলকে ফুলের গাছের একেবারে মগডালটায় উঠে ঝুপ্পুস করে নদীতে লাØংইয়ে পড়ল কাতর । বলে কিনা, নদীতে না স্নান করলে নাকি ওর জ্বর সারে না ! তারপর ডুব সাঁতার দিয়ে এক্কেবারে ওপারে ।
    -- ডুব তো মারলি, এখন শুকাবি কি করে ?
    -- উই মন্দির দেখছু না ? গামছাটা উয়ার মেঝাতে টুকু রাইখ্যে দিলেই শুকায়ে দিব্যাক । আঙুল দিয়ে মন্দির দেখায় সে । মন্দিরে পৌঁছে তো মৌলি অবাক । এ কেমন মন্দির ! অজস্র ঝুরিঅলা বিরাট একটা বটগাছের নীচে বড় বড় বোলডার পাথরে ঘেরা একটা ছোট্ট জায়গা । তার মধ্যে একটা কালো পাথর বসানো । তাতে তেল, সিঁদুর লেগে লাল টকটকে হয়ে রয়েছে । গামছা মেলে দিয়েই ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকে দেয় কাতর । দেখাদেখি মৌলিও । বাইরে মাথাফাটা রোদ । অথচ গাছের নীচে কি ঠাণ্ডা ! চারপাশে লাল-হলুদে মেশা এক রকম ছোট্ট ফলের মতো কি জিনিষ ছড়িয়ে আছে ।
    -- ঊটা বটফল । খাব্যাক লাই ?

    মুখের কাছে একমুঠো বটফল ধরে কাতর । একটা মুখে দিয়ে একটু খেয়ে ফেলে দেয় মৌলি । কেমন একটা স্বাদ । খুব ভালো লাগার মতো তো নয় । কিন্তু তাই কি তৃপ্তিতে খেয়ে চলেছে কাতর । ওর মুখ দেখে কে বলবে ওটা রসগোল্লা নয় ! খেয়েদেয়ে উঠে গামছাটা কোমরে বেঁধে নিয়ে মৌলির হাত ধরে ফের হাঁটা লাগাল সে । বিকেল নামছে । মৌলিকে সন্ধ্যার আগেই ঘরে পৌঁছে দিয়ে তবে তার ছুটি । একদিন তো মোষের পিঠেও চড়িয়েছিল । ওদের বাড়ির মোষগুলোকে চরাতে নিয়ে আসত কাতর । লাল মাটির পথ, দু'পাশে সরু সরু লম্বাটে মতো টিলা উঠে গেছে , কোনোটা ছোটো, কোনোটা আবার বেশ বড়, পাথুরেও । সেগুলো সবই লাল । এমন লাল মাটি আগে দেখেনি মৌলি । মনে হয় যেন এক শিশি আলতা পড়ে ভেঙেছে পথের ওপর, আর তাইতেই লাল হয়ে গিয়েছে পুরো পথটা । ওই পথ দিয়েই কালো কালো বিরাট বড় বড় মোষের দলকে চরিয়ে নিয়ে এসেছিল কাতর । সে নিজে বসেছিল একটা মোষের পিঠে । খালি গা, মাথায় একটা ছোট্ট ফেট্টি বাঁধা কাতরকে ওই অত্ত বড় বাঁকানো শিংঅলা মোষের ওপর আরো ছোট্ট দেখাচ্ছিল । মোষগুলোকে নদীর ধারে ছেড়ে দিয়ে মৌলির কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল কাতর ।
    -- ওদের তুই সামলাস কি করে ? লাঠি কই তোর ?
    -- উয়াদের সামাল দিতে লাঠি লাগব্যাক কেনে গো ? আস আমার সঙ্গে , বলে মৌলির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছিল সে মোষের দলটার কাছে ।
    -- উয়াদের চোখ দেখিচু ? মানুষের মতো বট্যাক । লাইগলে পরে উয়ারাও কাঁন্দে গো । কথা বুলতে পারে নাই বুইলে উয়াদের মাইরতে লাইগবে, ইটা কিমন কথা গো ? এই বাঁশি দেখচু ? এই বাজায়ে উয়াদের সঙ্গে কথা বলি গো । উয়ারা এই বাঁশির কথা বুঝে । বাঁশিতে সুর দিল কাতর । সে কি মনকেমন করা সুর । মৌলি তো কেঁদেই ফেলেছিল সেদিন । কাতরের চোখেও জল ।
    -- তুই কান্দলি কেনে ?
    -- ধ্যাৎ আমি কাঁদব কেন ? তুই তো কাঁদছিস ।
    -- মায়ের লেগে বড় মন টাইনছে । মা তো লাই । ইয়ারাই আমার সব । ঈটা আমার মা বটেক । একটা বিরাট বড় মোষ কাতরের খুব কাছাকাছি এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল, আর মাঝে মাঝেই গলা তুলে একবার দেখে নিচ্ছিল তাকে । সেটার গলা ধরে খানিক ঝোলাঝুলি করে লাফ দিয়ে তার পিঠে উঠে গেল সে ।
    -- তু আবার কুবে আসবি ?
    -- পরের বছর গরমের ছুটিতে ।
    -- ঠিক বটেক ? তুবে তু ঈ বাঁশিট লে ।
    -- হঁ রে । বলে হাত বাড়িয়ে বাঁশিটা নিয়েই মৌলি হেসে গড়াগড়ি । হাসল কাতরও । তারপর ডাকল মৌলিকে ।
    -- ঈ রুকম উয়ার গলা ধুরে উঠ না ?

    বার পাঁচেক চেষ্টা করার পর হাল ছেড়ে দিল মৌলি । না:, এই রকম করে সে পারবে না । ততক্ষণে জামাকাপড় একেবারে ধুলোমাখা ভূত । মোষটা হঠাৎ কি বুঝল কে জানে । বিশাল নাকটা মৌলির মুখের একেবারে কাছে এনে ফোঁস করে একটা নি:শ্বাস ছেড়ে একবার কান নেড়ে দিয়ে ধুপ করে বসে পড়ল মাটিতে । তখন কাতর মৌলিকে মোষটার পিঠে চাপিয়ে তারপর নিজে চেপে বসল তার পিঠে । বসে মোষটার পেটে দু'বার চাপড় মারতেই উঠে পড়ল সে । হেলতে দুলতে চলল নদীর ধার বরাবর । মাঝে মাঝে হাঁটা থামিয়ে খানিক গাছের কিংবা জংলা ঝোপের পাতা চিবিয়ে নেয়, একটু শিং নাড়ে, আবার চলে । এই রকম অনেকক্ষণ চলেছিল সেদিন । তারপর প্রায়দিনই মৌলিকে মোষের পিঠে চড়াত সে । দুপুরে মা-মামিমারা খাওয়া শেষে বিছানায় একটু গড়িয়ে পড়লেই খিড়কির দরজা দিয়ে মৌলি সোজা বাইরে । টুবলুদা'টাও এই সময়টায় ব্যস্ত থাকে ঘুড়ি বানাতে । রান্নাঘরে গিয়ে খুটুর-খাটুর; কোথায় দিদিমার পুরনো আচারের বয়াম রাখা আছে, একদিন খঁংউজে নিয়ে এসে উঠানের বাইরে আছাড় মেরে সেটা ভেঙে হামানদিস্তায় গুঁংএড়া গঁংউড়ো করে ফেলল ; ওটা দিয়ে নাকি ঘুড়ির জন্য খুব ভালো মাঞ্জা হবে । টুনুদি দেখতে পেলে ঠিক লাগাত । কিন্তু, সে তো তখন বাগানে টাকুটার সঙ্গে গল্পে ব্যস্ত । ততদিনে মৌলি বুঝে গেছে যে এই মোষের পিঠে চড়া, কাতরের সঙ্গে খেলে বেড়ানো, নদীর পারে ঘোরা, কিংবা টুবলুদা'র ঘুড়িতে মাঞ্জা দেওয়ার জন্য বয়াম চুরি, টুনুদি'দের গল্পগাছা -- এই সব কিছু বড়দের চোখে ঘুম নেমে আসা, এই রকম নেশা ধরানো গরম দুপুরেই হতে পারে, অন্য সময় নয় ।

    সোনাডহরি স্টেশনটা বেশ ছোটো । ট্রেনও এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না । আজকে গরমও প্রচণ্ড । সেইসঙ্গে গরম হাওয়া । হাওয়ার ঝাপটায় শুকনো লাল মাটির কণা উড়ছে বালির মতো ; গাঢ় হলুদ রোদ আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে । জানলায় গাল ঠেকিয়ে প্রাণপণে বাইরে দেখছিল মৌলি । এক্ষুণি ট্রেন ছাড়বে, হুইসল বেজেছে গার্ডের । এখনো হয়তো দৌড়তে দৌড়তে চলে আসবে কাতর । এসে হয়তো বলবে, "তু দজ্জায় দাঁড়াইয়ে ছিলি নাই কেনে ?" কিন্তু, না, এল না সে । ট্রেন বেরিয়ে এল প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে । কাঁসাই নদীর ওপর দিয়ে পার হচ্ছে এখন । আজকে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না; মন্দির, বটগাছ, মোষের দল, কিংবা উঁচু উঁচু লাল পাহাড়--- কিচ্ছু না । বাঁশিটা হাতে শক্ত করে ধরে বসে থাকে মৌলি । ফর্সা টুকটুকে গাল বেয়ে জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে । একফোঁটা জল লোহার জানলা গলে টুপ করে নীচে নেমে আসে । সোনাডহরির লালমাটি খঁংউড়ে বয়ে চলা কংসাবতীর হাঁটুভাঙা জলে সেই ফোঁটাটা মিশে যায় চিরদিনের মতো ।
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments