• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ২৭ | আগস্ট ২০০২ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • যেখানে মানুষ মেলে : বিকাশ চক্রবর্তী

    শীতকালের সাথে রিক্ততা ও রুক্ষতার যে একটা গভীর সম্পর্ক আছে, ছোটোবেলায় রচনা লেখার সময় থেকেই তা শুনে আসছি । এটা তো এক চোখে দেখা বর্ণনা । কিন্তু অন্য চোখে যে দেখা যায়, সমস্ত কিছুরই যে আরেকটা দিক আছে, রিক্ততার বিপরীততে পূর্ণতার বহতা স্রোত, সেটা বুঝতে জীবনের অনেকগুলো শীত পার হয়ে গেছে ।

    দুর্গাপুজো, কালিপুজো আর ভাইফোঁটার পালা শেষ করে হিমের রাতগুলো ত্রক্রমশ গাঢ়তর হতে থাকে । গ্রামবাংলার মাঠে মাঠে ফসল তোলার কাজ শেষ হয় । অভাবগ্রস্ত, পরিশ্রমী মানুষরা সাময়িক হলেও কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখে, আনন্দ করতে চায় । বাঁকুড়া - বীরভূম - পুরুলিয়ায় রুক্ষ মাটির জার-লাগা মানুষগুলো হৃদয়ের রসে ভরপুর হয়ে ওঠে । কেউ করে টুসু গান - চলে সারা পৌষ মাস ধরে । আবার নানা প্রান্তে আয়োজন হয় মেলার । বছরের অন্য সময়ে বিশেষ টের পাওয়া যায় না মেলার অস্তিত্ব, কিন্তু শীতের শুরু থেকেই আস্তে আস্তে জমে ওঠে । প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ্য নির্মলকুমার বসু মেলাকে দেখেছিলেন গ্রামবাংলার আর্থনীতিক সংগঠনের দিক থেকে, আঞ্চলিক পর্যায়ে যার উপযোগিতা ছিল প্রশ্নাতীত । বর্তমানে কেন্দ্রীয় বাজারের যুগেও মেলা কমেনি, বরং সংযোজন হয়েছে যদিও তার চরিত্র পালটেছে ।

    মেলা - যেখানে মানুষ আসে, মেলামেশা করে । শীত পড়তেই শহুরে মনটা নিজের অজান্তেই মেলামুখী হয়ে ওঠে ।

    পৌষমাসের সংক্রান্তি । একদিকে সাগরমেলায় কয়েকদিনের জন্য গড়ে ওঠে সারা ভারতের ক্ষুদ্র সংস্করণ । নানা বর্ণে, নানা বৈচিত্র্যের মানুষ ছুটে আসে মকরস্নানে পাপস্খালনের বিশ্বাসে ।


    জয়দেব-পদ্মাবতীর মন্দির, কেন্দুলি
    ঠিক ওইদিনই শুরু হয় বীরভূমের কেন্দুবিল্বতে অজয় নদের তীরে জয়দেবের মেলা - বাংলার বাউলদের সর্ববৃহৎ বাত্সরিক মিলনমেলা । কথিত আছে, মকর সংক্রান্তির দিন গঙ্গা নাকি উজানে এসে অজয়ের সাথে মেশে । এখানেও অবগাহন করেন অসংখ্য পুণ্যার্থী ।

    দ্বাদশ শতকের কবি জয়দেব ও পদ্মাবতীর স্মৃতিবিজড়িত এই বাউল মেলা । তাঁদের নামেই জয়ধ্বনি দিয়েই মেলার শুরু ও শেষ । এবারেও গিয়েছিলাম জয়দেবের মেলায় ।

    মেলায় ঢুকতেই দেখা আশানন্দন টেতরাজের সাথে - বীরভূমের মাটির মানুষ, বাউলদের বিষয়ে চলমান বিশ্বকোষ । এই মেলা ওর কাছে তিনদিনের বাড়ি । ওঁর লেখা গান বাউলদের মুখে মুখে ফেরে - 'দেশবিদেশের মানুষ গো যাও এ-বীরভূম ঘুরে ।' আশাদাকে মেলায় দেখতে না পেলে যেন কোথায় একটা বড় ফাঁক থেকে যায় ।

    এরকম কোনো ভালবাসার মানুষকেই তো বাউল খুঁজে বেড়ায় । তাকে সে বলে 'মনের মানুষ', 'অধর মানুষ', 'সোনার মানুষ', আরো কত কি । সপ্তদশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি (উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে ১৬২৫-১৬৫০) থেকে বাউলের পথ চলা, অন্বেষণের শুরু, যদিও দার্শনিক বিচারে আরো আগে থেকে চর্যাপদের মধ্যে নিহিত আছে তার উত্স । আজও তার খোঁজ চলছে । জনৈক বাউল বললেন, 'এই খোঁজাতেই তো আনন্দ । পেয়ে গেলে তো আর আমি থাকবো না, লোপ পেয়ে যাবো ।' আসলে বাউলসাধনা কোনো ক্ষণিকের সাধনা নয়, এর শুরু আছে কিন্তু শেষ জানা নেই । লালনের পদে আছে - 'কথা কয়রে/ দেখা দেয় না ।/ নড়ে চড়ে হাতের কাছে / খুঁজলে জনম-ভর মেলে না ।'

    !-- %[ ছবি :৫; গ্রামীণ বাউল মেলায় শহরায়নের ছাপ]

    --
    গ্রামীণ বাউল-মেলায় শহরায়নের ছাপ
    'মনের মানুষ' কে ? তাকে পাওয়াই যায় কোথায় ? বাউলের উত্তর খুব স্পষ্ট ও সোজা - 'তাকে কেমন দেখতে তা তো জানি না, তবে তিনি থাকেন দেহের মধ্যেই ।' উত্তরটা সোজা বলেই বোঝা শক্ত । বাউলের দর্শন তার আত্মোপলব্ধির দর্শন । 'আমি কে ?' এই প্রশ্নের উত্তর জানতেই সে সারাজীবন ছুটে বেড়াচ্ছে । নিজেকে জানলে তবেই ধরা যাবে 'মনের মানুষ' কে । 'ক্ষ্যাপা তোর আপন খবর না জেনে তুই যাবি কোথায় ।' জানার পদ্ধতিতেই বিরাট ব্যবধান তৈরি হয়েছিল বিদ্যমান সমাজদর্শন ও বাউলদর্শনের মধ্যে । অনুমান-নির্ভর অলৌকিকতার পরিবর্তে বাউলরা গ্রহণ করেছিলেন 'বর্তমান'-কে অর্থাৎ নিজের দেহসাধনার আলোয় আলোকিত করেছিলেন আত্মতত্ত্ব উপলব্ধির পথকে । মানুষের দেহের মধ্যে 'আত্মা'কেই বাউল বলেছেন তার 'মনের মানুষ', যা দেহসাধনার বিশেষ স্তরে সাধকমনের বিমূর্ত উপলব্ধি । সাধনা-অর্জিত স্নায়বিক নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ায় সাধক-সাধিকার মিলনজাত আনন্দানুভূতির মধ্যে আরাধ্যের অন্বেষণ ও প্রাপ্তি । দেহ ও মনের এক বিচিত্র রসায়নের জটিল ফসল এই উপলব্ধি । কতদিনে পৌঁছানো যায় উপলব্ধির এই জগতে ? কোনো ঠিক নেই । একমাত্র গুরুই জানেন । শিষ্য-শিষ্যার সাফল্য, ব্যর্থতার তিনি শ্রেষ্ঠ একক বিচারক । তাই গুরু ধরে দীক্ষা-শিক্ষা না পেলে সাধনজগতে প্রবেশাধিকারই মিলবে না । গুরুপদে সমর্পিত-প্রাণ এক বাউল বন্ধু বললেন, 'সাধনার চারটে স্তর ধরে আগে তো আটচল্লিশ বছর খাটালি, তারপর যদি কিছু হয় ।'

    প্রতিবারের মতো এবারেও এসে উঠলাম খান্দরা আশ্রমে । আমার ঘনিষ্ঠতম দেবদাস বাউল এখানেই থাকেন । পেয়েও গেলাম । সন্ধের মুখ থেকে ধীরে ধীরে জমতে লাগল ভিড় । গৌরচন্দ্রিকা দিয়ে শুরু হলো আসর । নক্ষত্র দাসের গলায় শোনা গেল সেই বিখ্যাত গান - 'ক্ষিতি অপ্য তেজ মরুৎ ব্যোমে দিয়েছ মিলন করি/ কি চমত্কার মানবদেহ গুরু তৈয়ারি ।' মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নিখুঁত বর্ণনা ! সাধক পদকর্তারা যে কতরকমভাবে বিশ্লেষণ করেছেন মানুষের দেহকে ! সৃষ্টির জগৎ তাদের কাছে অজানা ছিল না, বরং তারা বিশ্বাস করতেন যে দেহভাণ্ডেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অবস্থান । তাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কিছুর তুলনা দেহ বা শারীরবৃত্তের বিভিন্ন কার্যকলাপের সাথে । শিহালাই আশ্রমের বৈদ্যনাথ দাসের গলায় শুনেছি অনন্ত গোঁসাই-এর গান - 'কে বানালে এমন ঘর / ধন্য কারিকর ।'

    মেলাতে তো একজায়গায় বসে থাকলে চলে না । বাউলের যেমন পথে ঘোরা, অনুরাগী মানুষও তেমনি এক আখড়া থেকে অন্য আখড়ায় খুঁজে বেড়ায় ভাল গান, যা মনকে টানে, অন্য হৃদয়কে কাছে আনে । এমনই এক আখড়া তমালতলায় । এখানে অবশ্য শহুরে ভিড় বরাবরই একটু বেশি । তবুও এখানে সবাই আসে, কারণ ভাল গান হয় । আশ্রমের অধিকর্তা সুধীরবাবা দেহ রেখেছেন প্রায় বছর দুই । তাঁর ছবি সামনে রেখে গান চলছে - 'বৃন্দাবনের পথে যাবো, মন, পথ দেখাবে কে ?' পবনদাসের গান ও নৃত্যভঙ্গিমা আবিষ্ট করে তোলে শ্রোতাদের । এই বৃন্দাবনের কোনো ভৌগোলিক অবস্থান নেই, তা রয়েছে গায়কেরই অন্বিষ্ট মনের ভেতর । সাধনার চাবিকাঠি না নিয়ে কারোরই প্রবেশাধিকার নেই তাতে ।

    শিবশম্ভূ দাসের সাক্ষাত্কার নিচ্ছেন লেখক
    মনে পড়ছে, কয়েকবছর আগে এখানেই সাক্ষাত্কারের সময় ইলামবাজারের শিবশম্ভু দাস শুনিয়েছিলেন - 'গুরুর ভজন বড় ল্যাঠা ।'



    --

    ত্রক্রমশ রাত গাঢ় হয় । খোলা জায়গায় হিমের প্রকোপ বাড়ে । কালো অন্ধকার ও কুয়াশা মিলেমিশে এক বেষ্টনী তৈরি করে অজয়ের বুকে, যার মধ্যে দিয়ে দৃষ্টি ওপারে যেতে পারে না । নদীর বুক চিরে তৈরি সুরকি-ঢালা রাস্তা দিয়ে তখনও লোকের স্রোত এসে ঢুকেছে মেলায় ; চলেও যাচ্ছে ওপারে । বাঁধ ধরে এগিয়ে যাই যেদিকে মেলা বাড়ছে ।

    শিবকালি আশ্রম । এখানেই আসেন ধর্মদাস বৈরাগী - বয়স চল্লিশ পার হয়ে গেছে । 'গুরু এবার একজন সঙ্গিনী দিয়েছেন' - লাজুক হাসি ধর্মদাসের, সঙ্গিনীর মুখে রক্তিমাভা । একটানা আড়াই ঘন্টা গান শুনেছি ধর্মদাসের গলায় । টেপরেকর্ডার বার করলাম কিছু গান ধরে রাখবো বলে । দেহতত্ত্বের গান - 'সহজ মানুষ লীলা,/ ভরত, দেখলো রেবা নদীতটে'; 'সহজ পথে হোঁচট লাগে/ ওরে মন কানা,' 'সেথা প্রাণ হরণ করে/ রাখ নজর হরিদ্বারে' - একের পর এক । খেয়াল নেই কখন মাঝরাত পেরিয়ে গেছে । ধর্মদাস বসলেন, আমরা উঠলাম ।

    এবারে মনোহর ক্ষ্যাপার আখড়ায় । মেলার মূল রাস্তাটা এখানে বড় বেশি সরু হয়ে গেছে । ভিড়ের চাপে দমবন্ধ হবার অবস্থা । বাঁকুড়া খয়েরবনীর সনাতন দাস এসেছেন গুরু-আশ্রমে । বেশ লম্বা গান ধরেছেন - নিত্যক্ষ্যাপার গান - 'আছে মানুষ মানুষেতে,/ যে পারে মানুষ দেখিতে চিনিতে ।/ মান - হুঁশ হয়ে মানুষ ল'য়ে/ ফিরছেন সদাই তিনি হুঁশেতে ।' বেশ কয়েকটা গানের পর ছেলে বিশ্বনাথের সাথে ধরলেন ঝুমুর সুরে - `রাখিতে নারিলি প্রেমজল কাঁচা হাঁড়িতে ।' অনবদ্য নাচ পিতা-পুত্রের । বিশ্বনাথ গান ধরলেন ভাটিয়ালি সুরে - 'বাউল বাউল কর তোমার / বাউল গাইবে কে/ বড় দুখ পাইয়ারে বাংলার/ বাউল মৈর্যাছে ।' কথা ও সুরের বিষণ্ণতা পরতে পরতে ছুঁয়ে যায় নির্বাক শ্রোতাদের ।

    বাউল গানের নিজস্ব সুর বলে কিছু আছে কি ? বোধহয় না । বেশিরভাগ লোকসংগীতই আঞ্চলিকতায় চিহ্নিত । কিন্তু বাউলগান বাংলার সমস্ত প্রান্তেই শোনা যায় । বর্ণহিন্দু সমাজের অনুশাসনের বিরুদ্ধে এক সার্বিক ভাব-বিদ্রোহ করেছিলেন বাউলরা । তাঁরা পরিচালিত হন এক কেন্দ্রীয় জীবনদর্শনের দ্বারা, যদিও গুরুঘর ভেদে আচার-আচরণের কিছু পার্থক্য ঘটে থাকে । অঞ্চল অনুযায়ী সুরের কাঠামোয় অবশ্যই কিছু বৈচিত্র্য তৈরি হয়ে গেছে - নদীয়ার বাউলগানে কীর্তনের ছোঁয়া, উত্তরবঙ্গের বাউলরা ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া গানের কাঠামোটা ব্যবহার করেন, পুরুলিয়ায় ঝুমুর, বীরভূমের রুক্ষ প্রান্তরে সুরটা যেন ভেসে বেড়ায় - কিছুটা ছাড়া ছাড়া ভাব । অনায়াস দক্ষতায় সনাতন দাস সুরটাকে ভাসিয়ে ছেড়ে দেন, আবার নিখুঁত ছন্দে হাত বাড়িয়ে শূন্য থেকে যেন সুরটা ধরে ফেলেন । এই ঘরানার বয়োজ্যেষ্ঠ শিল্পী বোধহয় তিনিই ।

    রাত ফিকে হয়ে আসে । ঘন কুয়াশার মধ্যে থেকে ভোরের আলো ফুটতে থাকে । আসরের গান থেমে যায় । ইতিমধ্যেই মেলার মানুষ, বাউল-বৈরাগীরা নেমে পড়েছেন অজয়ের জলে । মেলাতে দুটো বিপরীতমুখী স্রোতের যাওয়া-আসা - রাতজাগা ক্লান্ত চোখের মানুষরা ফিরে যাচ্ছেন, আর নতুন সতেজ মানুষের দল মেলায় আসছে । বাজার বসে গেছে - এত মানুষের আহার্যের সংস্থান তো চাই । প্রয়োজনেরও তো শেষ নেই - জানালা - দরজা, চাষের হাল, মাছধরার জাল, বাসনপত্র, প্রসাধনসামগ্রী, খাবারের দোকান, বিনোদন - কী নেই মেলায় । গোটা সমাজটাকে ছোটো করে এনে বসানো হয়েছে কয়েকদিনের জন্যে । জন্মমৃত্যুর ঘটনাও বাদ পড়ে না । দীক্ষা নিয়ে ব্রাত্যজনের নবজন্ম হচ্ছে, সমাজ-সংসারকে অগ্রাহ্য করে 'জীয়ন্তে মরা'র সাধনায় ব্রতী হচ্ছে । কতজনকে নিয়ে আসা হচ্ছে কদমখণ্ডীর শ্মশানে দাহ করার জন্য । হাসিকান্না, আনন্দ-বিষাদের মধ্যে চলছে জীবনের উত্সব, উদাসীনের নতুন করে বাঁচার চেষ্টা । লালনের কথায়, 'মরে যদি বাঁচতে পারো ।' কথাটাতে হেঁয়ালি রয়েছে - একদিকে সাধারণ মানবজীবনের পরিসমাপ্তি, অন্যদিকে সাধকজীবনের সূচনা, যা মানুষকে জাগতিক তুচ্ছতার উর্দ্ধে নিয়ে যেতে পারে বলে বিশ্বাস ।

    একটু বেলা বাড়তে মেলার সঙ্গী শান্তিবাবু নিয়ে গেলেন বৈরাগীতলায় । দীর্ঘদিন এপথে ঘুরছেন শান্তিবাবু - বাউলের অনেক আনাচে-কানাচে ওঁর যাতায়াত । বৈরাগীতলায় যারা আসন পাতেন, কোনো আসরে গাইতে দেখি না তাদের, অনুষ্ঠানে চুক্তিবদ্ধ হবার তাগিদ নেই এদের । সকাল সকাল স্নান সেরে, তিলক-সেবা করে এরা বসে রয়েছেন । সঙ্গিনীরাও আছেন । কোন এক মোহান্তর সমাধিবেদীতে ভোগরাগ দিচ্ছেন একজন বয়স্ক বৈরাগী ।

    !-- %[ ছবি :৪; বাউল সাধনায় সঙ্গিনীর ভূমিকা অসীম]

    --

    বাউল সাধনায় সঙ্গিনীর ভূমিকা অসীম
    একটু ফাঁক খুঁজে নিয়ে একজন প্রবীণ বৈরাগীকে শান্তিবাবু জিজ্ঞেস করলেন সাধনার গোপন প্রশ্ন - 'বিন্দু রক্ষা কি সম্ভব?' একেবারে সোজা সরল অপ্রত্যাশিত উত্তর - 'যে পারে তার কাছে সম্ভব । আর যে পারে না, তার অসম্ভব ।' আমাদের অনুসন্ধিত্সু মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাখ্যা করে বৈরাগী বললেন - 'কেউ কেউ তো পিছলে যায় । একবার হৃদয়ে স্থির হলে আর ভুল হয় না - প্রাকটিকাল বিদ্যা শিখলে কেউ ভোলে না । নিত্যচিন্তা ও চর্চায় জীয়ন্ত রাখতে হবে । কালচার না করলে ভুল তো হতেই পারে ।' বাউলরা ধারক সঙ্গমে (ঙধঠঞণ্ণয ওংযংশণ্ণধঞণ্ণয) শিক্ষালাভ করেন গুরু-নির্দেশিত পথে । বীর্যস্তম্ভনজনিত দৈহিক ও মানসিক আনন্দানুভূতির মধ্যে চরম প্রাপ্তি বলে তাদের বিশ্বাস ।

    এরপর সঙ্গী হলাম দেবদাস বাউলের । উদারহৃদয় মানুষটি অকুন্ঠভাবে সাহায্য করেছেন আমার কাজে । নিয়ে গেলেন মাধুরী দাসীর 'আনন্দ আশ্রমে ।' জিজ্ঞেস করলাম সদানন্দ গোঁসাই-এর কথা । মাধুরী হাসতে হাসতে বললেন - 'গোঁসাই পার হয়ে গেছেন ।' বুঝলাম গোঁসাই চলে গেছেন অন্য কোথাও, হয়তো বা অন্য কোনো সঙ্গিনীর সাথে । প্রত্যয়ের সাথে আবারও বললেন - 'আমিই এখন আশ্রমের দেখাশোনা করছি ।' এরকম ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি, নির্বিকারচিত্ততা, একি আমাদের পক্ষে সম্ভব ? জীবনে চলার পথই এদের কাছে একমাত্র বাস্তব । আর বাস্তব তো সবক্ষেত্রেই কঠিন, তবে যেভাবে যে নিতে পারেন ।

    আশ্রমে গুরুমা এসেছেন । মাধুরীর কথায়, গুরুমার বয়স একশ পার হয়ে গেছে । শীর্ণ, ছোটো হয়ে যাওয়া শরীর, কিন্তু চোখের দৃষ্টি এখনও প্রখর । গান শোনাবার বায়না ধরলাম । এবারে পালটা প্রশ্ন, - 'তুমি বাবা এখানে এসেছো কেন ?' গবেষণার কাজে ঘুরতে ঘুরতে অবশ্যই একটা ভালোলাগা তৈরি হয়ে গেছে গত পনেরো বছরে । সেটুকুই বললাম - 'ভালো লাগে ।' একটু হেসে হাতে খঞ্জনি নিয়ে গান ধরলেন - 'কৃষ্ণপ্রেমের রসিক যে জন,/ তারে দেখলে যায় চেনা ।/ ও তার নয়ন দুটি ছলছল/ মৃদুহাসি বদনখানা । ।' আবেগ বড়ো তাড়াতাড়ি সংক্রমিত হয় । একটা খুব দামি জিনিষ সংগ্রহের ঝুলিতে ভরে নিলাম ।

    মেলায় এলাম অথচ অমিত গুপ্ত-র দেখা এখনও পেলাম না, এ যেন অঘটন । একটা কথা চালু আছে মেলায়, মনের মতো করে খুঁজলে ঠিক পাওয়া যায় । সত্যিই পাওয়া গেল 'মামুর দোকানে ।' অমিতবাবু কয়েকজন সঙ্গী সহ দোকানে গরম আলুর বোমা ও চা সেবা করছেন । দীর্ঘদিন উনি বাউল সঙ্গ করেছেন, অনেক বড় সাধকের সান্নিধ্যে এসেছেন । বাউলের সর্বনাশা নেশা ওর পেশাকে ছাপিয়ে গেছে । ওঁর একটা প্রকাশিত বই আছে - বাংলার লোকজীবনে বাউল । প্রতিবছর জয়দেবের মেলায় নিষ্ঠাভরে দীর্ঘদিন প্রকাশ করে আসছেন শকুন্তলা পত্রিকা । তত্ত্বতালাশ, শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর আবার মেলার কেন্দ্রস্থল খান্দরা আশ্রমে । বেলা একটা । সবজায়গাতেই স্নানখাওয়া, বিশ্রামের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে । এবারে সত্যি কালকূটের কথা মনে পড়ল - ভিতরের 'মহাপ্রাণীটি' অশান্ত হয়ে উঠেছে, তাকে শান্ত করা দরকার । খান্দরা আশ্রমে সাধুসেবা শুরু হয়ে গেছে । দেবদাস অপেক্ষা করছেন আমার জন্য । আন্তরিকতার উষ্ণতা মিশে গেছে রন্ধনে ও পরিবেশনে । চেনা-অচেনা মানুষের জন্য উন্মুক্ত দ্বার, অতিথি আপ্যায়নের জন্য এত ব্যয়বহুল আয়োজন এখনও নিষ্ঠাভরে করে যান কিছু মানুষ । বিশ্বগ্রাসী উদারনীতিবাদ এসে থমকে যায় মানুষের প্রতি মানুষের সপ্রেম ভালবাসা মানসিক প্রসারতা ও ঔদার্যের কাছে । বারেবারেই মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠছে গত রাতে শোনা নিত্যক্ষ্যাপার গান - 'যদি মানুষ হতে খোঁজ,/ তবে মানুষ, মানুষ ভজ,/ ক্ষ্যাপা নিত্য বলে নিত্য পূজ,/ এই মানুষের চরণেতে ।'



    জয়দেব-পদ্মাবতীর মন্দির, কেন্দুলি
    এবার ফেরার পালা । চব্বিশ ঘন্টা ধরে পেশা ও শহুরে জীবনের মাধ্যাকর্ষণমুক্ত হয়ে ভাবের জগতে ভারশূন্য অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম এক আখড়া থেকে অন্য আখড়ায়; নানা মানুষের মিলনের মহামেলায় । মধ্যবিত্ত মন তো বেশিক্ষণ ভারশূন্য অবস্থায় থাকতে পরে না । দোলাচলটা তার এক ও অদ্বিতীয় প্রকৃতি । বোলপুরের বাস ছাড়ি ছাড়ি করে ছাড়ে না । ওই যে বাসের পেছনে লেখা রয়েছে - 'মানুষ আপন টাকা পর, যত পারিস মানুষ ধর ।' - ভাবের জগতে অর্থকরী সম্পর্কের কৌশলী অনুপ্রবেশ; পরস্পরবিরোধী ভাবের বিচিত্র রসায়ণ । এই সেই দূরত্ব - অপহরণকারী যান, মানুষকে নিয়ে আসছে ভাবের রাজ্যে, আবার ফিরিয়ে নিচ্ছে অ-ভাবের সাম্রাজ্যে । বাসের ভেতর ভর্তি হয়ে গেছে, এ যাত্রার মতো মানুষ ধরায় বিরতি । মেলাকে পেছনে রেখে সত্যিই বাস ছেড়ে দিল ।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments