বসন্তকালের পঞ্চমী তিথিতে কণ্বমুনির আশ্রম জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় । দূরদূরান্ত থেকে গৃহস্থরা আসে । ছেলেমেয়েরা বনভোজন করে । রাজার কুমার ও দরিদ্র ব্রাহ্মণের ছেলে এক সারিতে বসে খায় । কিছু কিশোর শরত্কাল থেকে ব্রহ্মচর্যাশ্রম আরম্ভ করবে এই আশ্রমেই । তাদের বাবা-মা'রা ঘুরে ঘুরে আশ্রমের সমস্ত ব্যবস্থা দেখে নেন । বিকেলে আশ্রম বালক-বালিকারা গান, বাজনা, নৃত্য ও নাটকের অনুষ্ঠান করে । বসন্তপঞ্চমীর এই তিথি সমস্ত বছরের বিদ্যাভ্যাস উদ্যাপনের বার্ষিকী দিবস ।
অন্যবারের মত এবারও সহস্রাধিক অতিথি সমাগত । ঋষিকন্যারা ব্যস্ত হয়ে ফুল ও আলপনা দিয়ে আশ্রমটিকে সাজাচ্ছে । কুঞ্জদ্বারগুলি শ্বেতচন্দন দিয়ে শোভিত করা হয়েছে । প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে ঋষিকুমার শার্ঙ্গরব ও শারদ্বত অতিথিদের অভ্যর্থনা করছিল । অবশ্য তাদের আরেকটা কাজ হল দেখে নেওয়া যেন কেউ অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে আশ্রমে না প্রবেশ করে । কণ্বমুনির আশ্রমে হিংসার কোন স্থান নেই । সেখানে অস্ত্রের প্রবেশ নিষিদ্ধ ।
একজন লম্বা ও শীর্ণ বাবা তাঁর দুটি মেয়েকে নিয়ে আশ্রমে ঢুকছিলেন । মেয়েদুটির বয়স দশ ও বারো । তারাও ঋষিকন্যাদের মত বল্কল পরেছে । তাদের বাবার গায়ে হালকা হলুদ উত্তরীয় ও ধুতি । উত্তরীয়র ফাঁক দিয়ে উপবীত দেখা যাচ্ছে। একটি নিরীহ ব্রাহ্মণ পরিবার। সন্দেহের কিছু নেই দেখে শার্ঙ্গরব ও শারদ্বত তাদের প্রবেশ করার অনুমতি দিল ।
একটু পরে ঢুকল তেরো-চৌদ্দ বছর বয়সের এক তরুণ রাজকুমার । তার গায়ের রঙ খুব ফর্সা । একটু মেদবহুল চেহারা । সে পরেছে সোনার সুতো দিয়ে কারুকাজ করা পাগড়ি এবং রাজপোষাক । তার সঙ্গে এসেছে ছ'জন বন্ধু এবং দুটি ভৃত্য । খানিকক্ষণ কথাবার্তার পর শার্ঙ্গরব তাদেরও ঢুকতে দিল ।
রাজকুমারের দল আশ্রমে ঢোকামাত্র পাশের কুঞ্জবন থেকে হলুদ উত্তরীয় পরা বাবা ও তার দুই মেয়ে বেরিয়ে তাদের পিছু নিয়েছিল । একটু পরে রাজকুমার ও তার সঙ্গীরা বেড়াতে বেড়াতে আশ্রমের পার্শ্ববর্তী উপবনে প্রবেশ করে ।
আশ্রমের ঠিক কেন্দ্রে তপোবন । সেখানে একটা বড় জায়গা তকতকে করে পরিষ্কার করা হয়েছে । ফুল, পাতা আর রঙিন পাথর দিয়ে সাজানো হয়েছে একটা বেদী । ঋষিকন্যারা বেদীর উপর বসে সঙ্গীত অনুশীলন করছিল । একটু দূরে পাশাপাশি দুটি আসনে বসে কণ্ব ও গৌতমী সেই অনুশীলন দেখছিলেন । হঠাৎ আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে একটি মেয়েলি গলার চিত্কার ভেসে আসে । কণ্ব ও গৌতমী সভয়ে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন । ঋষিকন্যারা গান বন্ধ করে চেয়ে রইল ত্রস্তভাবে । উপবন থেকে উদ্ভ্রান্তের মত বেরিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে দেখা গেল কিছু বালক-বালিকাকে । উপস্থিত শারদ্বত ও শার্ঙ্গরব ছুটে এল বেদীর কাছে ।
কণ্ব জিজ্ঞেস করলেন - কী হয়েছে ? সব কুশল তো ?
শারদ্বত কিছু বলতে গিয়ে পারল না । গুরুতর উত্তেজনায় তার বাকরোধ হয়েছে । তখন শার্ঙ্গরব বলল - অনর্থ ঘটে গেছে গুরুদেব । আশ্রমে রক্তপাত !
উত্সবের পুণ্য তিথিতে এই অশুভ সংবাদ শুনে সমবেত ঋষিকন্যাদের মুখ থেকে একটা ভয়ের শব্দ নির্গত হয়েছে । মনে হল কেউ কেউ মুর্ছিত হয়ে পড়বে । কণ্ব নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন - কী করে ? কোথায় ?
শারদ্বত আঙুল দিকে উপবনের দিকে ইঙ্গিত করল । সেখান থেকে প্রহরী ঋষিকুমাররা রাজকুমার ও তার সঙ্গীদের বন্দী করে আনছে । রাজকুমারের হাতে তখনও একটা ছোট ধনুক । মুখে বিদ্রোহের ভাব ।
শারদ্বত বলল - আমাদের ভীষণ ভুল হয়ে গেছে । রাজপোষাকের মধ্যে অস্ত্রটা লুকোনো ছিল । দেখতে পাইনি ।
কণ্ব বললেন - সর্বনাশ ! কার লেগেছে ? জীবিত আছে তো ? নাকি মৃত ?
শার্ঙ্গরব বলল - আহত হয়েছে আশ্রমের একটি পালিতা হরিণী । এখনও জীবিত আছে । কিন্তু কতক্ষণ থাকবে বলা যায় না ।
দূর থেকে শোনা গেল রাজার কুমাররা বিদ্রুপের হাসি হাসছে । তাদের একজন চেঁচিয়ে বলল - ওরে রোগা ঋষির প্যাংলা ছেলেমেয়ের দল, কে কোথায় আছিস ছুটে আয় ! আজ মাংস পাবি, মাংস ।
কণ্ব ও গৌতমী যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উপবনে প্রবেশ করে একটি মর্মান্তিক দৃশ্য দেখতে পেলেন । সকলের প্রিয় একটি পালিতা হরিণী বুকে তীরবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে আছে । আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু যে অবধারিত তাতে কোন সন্দেহ নেই । অত্যধিক রক্তপাতের ফলে তার চোখ ঘোলাটে হয়ে গেছে । জিভ শুষ্ক । সেই অবস্থাতেই সে তার ছানাকে চেটে আদর করবার চেষ্টা করছে । হরিণ শিশুটি একবার করে মায়ের কাছে আসছে এবং ভীষণ ভয় পেয়ে আবার ছুটে খানিকটা দূরে চলে যাচ্ছে । তার অস্থির দৌড়োদৌড়ির মধ্যে ঠিক সেই ব্যাকুলতাই প্রকাশ পাচ্ছে যা মায়ের ব্যথায় কাতর মানুষের শিশুর মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় ।
কণ্ব ও গৌতমী শোকে মোহ্যমান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন । তাঁদের কিছু করার বা বলার সামর্থ্য রইল না । শারদ্বত এগিয়ে যাচ্ছিল হরিণীটিকে তুলবার জন্য । কণ্ব এক হাত তুলে কেবল নিরস্ত করলেন তাকে । তারপর সবাইকে নিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে এলেন উপবন থেকে ।
উপবন ফাঁকা হয়ে যেতেই একটা অশ্বত্থ গাছের পিছন থেকে বেরিয়ে এল সেই লম্বা ও শীর্ণ ব্রাহ্মণ ও তাঁর দুই মেয়ে । আশ্চর্যের বিষয় মানুষটির পরিচ্ছদ এখন সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে । উত্তরীয়, ধুতি ও উপবীতের বদলে তাঁর পরনে একটা কমলা রঙের পোষাক । পায়ে অদ্ভুত ধরনের জুতো । ছোট মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন - কমল, ভিডিও শীল্ডটা চালু করো এবার ।
মেয়েরাও ততক্ষণে বল্কল ছেড়ে কমলা সুট পরে নিয়েছে । তাদের মধ্যে যে ছোট সে একটা কাঁচের পিরামিড বের করে মাটিতে রাখল । তত্ক্ষণাৎ তার মধ্যে থেকে তড়িত্-চৌম্বকীয় বলক্ষেত্র বেরিয়ে দশ মিটার ব্যাসার্ধের একটা গোল শীল্ড তৈরি করেছিল । এর বাইরে থেকে কেউ উপবনে এলে আধঘন্টা আগে রেকর্ড করা একটা ফাঁকা জমির দৃশ্যই দেখতে পাবে । শীল্ডের ভিতর এখন যা হচ্ছে তা বাইরের লোকেদের কাছে অদৃশ্য ।
মেয়েদের বাবা বড় মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন - টাইম এসকালেটরটা চালাও, কাজল । বড় মেয়েটি কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির মতো যন্ত্রে কি একটা সময় সেট করে কিছু বোতাম টিপে দিল । মেয়েদের বাবা হরিণী আর তার শিশুকে ছুঁয়ে রইলেন । হঠাৎ একটা আলোর ঝলকানি দেখা গেল এবং সঙ্গে সঙ্গেই পুরো দলটা উপবন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল ।
॥২॥
দলটাকে এরপর দেখা গেল বাইশ শতাব্দীর একটি টাইম ট্র্যাভেল ল্যাবরেটরিতে । উজ্জ্বলভাবে আলোকিত ডায়াসে পাঁচজন প্রাণীর অবয়ব স্পষ্ট হতেই ল্যাবরেটরির অন্য মানুষরা হাততালি দিয়ে ওঠে । কাজল ও কমল প্রথমে ডায়াস থেকে ছোট ছোট লাফ দিয়ে নেমে এল নিচে । বড়জনের কোলে বসে নামল অবাক হরিণ শিশুটি । কাজল-কমলের বাবা মুমূর্ষু হরিণীকে কোলে নিয়ে নেমে এলেন সবার পরে ।
ল্যাবরেটরি থেকে কমলা পোষাক পরা দুজন সার্জেন এগিয়ে এসে হরিণীর গা থেকে সাবধানে খুলে নিলেন তীরটা । তারপর আর সময় নষ্ট না করে দ্রুত একটা অটোমেটিক সার্জিকাল হিলার যন্ত্রের গহ্বরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল হরিণীকে । হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের মাধ্যমে দেখা গেল কোনো হাই প্রেশারের তরল পদার্থে ভিতরের ক্ষতগুলো ধুয়ে যাচ্ছে । সেই সঙ্গে নতুন দেহকোষ একটি একটি করে সঠিক জায়গায় বসিয়ে দিচ্ছিল মাইক্রো-কম্পিউটার । সব মিলিয়ে মিনিট পঁচিশ লাগল হরিণীর সুস্থ হয়ে বেরোতে ।
বাইরে কাজল ও কমল নামে মেয়েদুটি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল । হরিণী হিলার যন্ত্র থেকে বেরোতেই তারা শিশুটিকে ছেড়ে দেয় । শিশুটি লাফাতে লাফাতে মায়ের কাছে গিয়ে তার পায়ে গা ঘষতে লাগল । কমল বলল - বাবা, আমরা এদের পুষব না ?
কমলের বাবা বললেন - ওরা নিজেদের ঘরেই তো ভালো ছিল । তোরা যখন ইচ্ছে গিয়ে দেখে আসবি ।
কমল বলল - ওদের যদি আবার কেউ মারে ?
সার্জেনদের একজন এগিয়ে এসে বললেন - চিন্তা নেই । টাইম অ্যালম্যানাকে ওদের ইতিহাস ভালো করে দেখে নিয়েছি । আর কোনো ফাঁড়া ছিল না ।
কাজল বলল - আচ্ছা তখনকার মানুষ এত নিষ্ঠুর ছিল কেন ?
সার্জেন বললেন - নিষ্ঠুরতা একটা এমন জিনিস যা নিজের মধ্যে থাকলে চোখে পড়ে না । অন্যেরটাই চোখে পড়ে । অ্যালম্যানাকটা দেখলে বুঝতে পারবে যে সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাস হল এক এক করে নিষ্ঠুরতার রিচুয়ালগুলো ত্যাগ করার ইতিহাস । এই ক'দিন আগেও জাত, ধর্ম, বা বর্ণ আলাদা বলে মানুষ অন্য মানুষকে নিজের সমবেদনা থেকে বঞ্চিত করেছে । একুশ শতাব্দীর শেষের দিকে সেগুলো আস্তে আস্তে চলে যায় । তারপর পৃথিবীর অন্যান্য বুদ্ধিমান প্রাণীও মানুষের সমবেদনার আওতায় চলে আসে । এখন আমরা কোনো তৃতীয় লেভেলের বুদ্ধিমান প্রাণীর অনিষ্ট করার কথা ভাবতেই পারি না । কিন্তু মনে রেখো সভ্যতার অগ্রগতি এখানেই থেমে যাবে না । তোমাদের ছেলেমেয়েদের দয়া-মায়া হয়ত আরো বেশি হবে । তারা হয়্তো তোমাদেরও ভাববে নিষ্ঠুর ।
টাইম ট্রাভেল ল্যাবরেটরির এসকালেটরটা যখন রি-সেট করা হচ্ছিল তখন সার্জেনরা কাজল-কমলের বাবাকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন - আমাদের প্রথম এক্সপেরিমেন্ট সফল হল ডক্টর সেন । তবে এই সবে শুরু । পুরো টাইম অ্যালম্যানাক পড়ে আছে আমাদের সামনে রিপেয়ারের অপেক্ষায় ।
ডক্টর সেন একটু হাসলেন । এসকালেটরটা চালু হওয়া মাত্র কাজল, কমল ও দুটি হরিণকে নিয়ে তিনি অদৃশ্য হলেন ডায়াস থেকে ।
॥৩॥
শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী । অপরাহ্ন । সরস্বতী নদীর তীরে বসেছিলেন ঋষি কণ্ব । গতকাল একটা অভাবনীয় কাণ্ড ঘটে গেছে । এক অবাধ্য রাজকুমার শকুন্তলার প্রিয় হরিণীকে তীরবিদ্ধ করে মেরে ফেলেছিল । এই আকস্মিক ধাক্কায় কণ্ব ও গৌতমীর মনে হয়েছিল যেন নির্মল উত্সবের দিনটি একেবারে কলুষিত । আশ্রমের বালক-বালিকারা ঘটনার মর্মান্তিকতায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু অভাবনীয়ভাবে কিছুক্ষণ পরেই হরিণীকে তার শিশুর সঙ্গে উপবন থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায় । সবাই ছুটে গিয়ে দেখে তার ক্ষত একেবারে সেরে গেছে । একটু দাগ রয়ে গেছে শুধু । সে হৃষ্টমনে শিশুটিকে চাটছে - যেন কিছুই হয়নি ।
এই অভূতপূর্ব ঘটনায় সকলেই চমত্কৃত । কেউ কেউ বললেন - কণ্ব-গৌতমীর পুণ্যের ফলেই হরিণীর পুনর্জন্ম হয়েছে । কেউ কেউ বললেন - দেবতাদের আশীর্বাদ । এর পর নতুন উদ্যমে ও হর্ষোল্লাসে আশ্রমের বার্ষিক উত্সব উদ্যাপিত হয় ।
সরস্বতীর জলে নেমে দুই হাত ডুবিয়ে কণ্ব তর্পণ করলেন । মন্ত্র উচ্চারণ করে ধন্যবাদ জানালেন সেই দেবতাকে যিনি এই আশ্চর্য আনন্দের কাণ্ডটি ঘটালেন তাঁর আশ্রমে । অনির্বচনীয় এক প্রফুল্লতায় ভরে যাচ্ছিল তাঁর চিত্ত ।
তিনি মনে মনে বললেন - দেবতাদের প্রয়োজন কী ? এমন দিন আসুক না যখন পৃথিবীর সব ছেলেমেয়ে হবে আমাদের আশ্রমের ছেলেমেয়েদের মত । স্নেহের বন্ধন অনুভব করে বিশ্বের যে-সমস্ত প্রাণী, তাদের শিশুদের নিষ্পাপ চোখে যেন কখনো বিষাদের ছায়া পড়তে না দেয় সেই অমৃতের সন্তান ।