- আর বোল না নতুন বৌ, বাবা বলল, এমনি এমনি তো এতবড় হলি, যেটুকু জমি আছে তার চাষবাস কে দেখবে ? চোখ ছিল না, সেও তো কাঠখড় পুড়িয়ে যুদ্ধু করে হোল । বাপের কাজে আর কবে লাগবি বাপ ? পুরুতের সাকরেদ হয়ে .... ।
- থাক থাক আর ফিরিস্তি দিতে হবে না । মুখটা শুকিয়ে গেছে । খাওয়া হয়নি তো ? যা হাত মুখ ধুয়ে আয় ।
পকা ভাবে দিন কেমন বদলে যায় । আগে এক বাড়ীর খাওয়া জুটত । তাও থাকলে তবে । এখন দু জায়গায় । দু বাড়ীর ছেলে হওয়ার সুখ সইলে হয় । কয়েক বছর আগেও যখন ঝড়ে ঘরের টালি উড়ে গেল, বাবা বোধহয় কপালে হাত রেখে উঠোনে বসে কাঁদছিল । নাকি বুকে হাত রেখে । খুব জোরে জোরে কাঁদছিল । উদ্দেশ্য - যদি তার দু:খে কেউ কিছু চাল ডাল দেয় । ছেলে মেয়েগুলো খেয়ে বাঁচবে । বাবার কান্না শুনে দু-একজনের হাসির আওয়াজও কানে লেগেছিল পকার । সেই কান্নার আওয়াজে একটা অক্ষমতার মায়া ছিল । যা একজন বিরক্ত হয়েও উপেক্ষা করতে পারে না । নতুন বৌও সেদিন কিছু চাল ডাল পাঠিয়ে দিয়েছিল । সেও পকার কথা মাথায় রেখেই বোধহয় । মা খিচুড়ি রেঁধে খাইয়েছিল চার ছেলে মেয়েকে । বাবা মার জন্য কিছু অবশিষ্ট ছিল কিনা পকার তা দেখার সুযোগ ছিল না । জিগ্যেস করাতে মা অবশ্য হ্যাঁ-ই বলেছিল । তবে আজ পকার বিশ্ব দেখার সুযোগ । দু বাড়ীরই ছেলে সে । হাত মুখ ধুয়ে পকা খেতে বসল নতুন বৌ এর বাড়া ভাত নিয়ে ।
- একটু তুলে নাও । পকার গলায় বিলাসি আওয়াজ ।
- ঐ কটা ভাত আবার কি তুলব ?
- নাগো, পুমাও চিড়ে গুড় বেধে দিয়েছিল মাঠে যাবার আগে । দুবার লাঙল দিয়েই খিদে পেল । সব খেয়ে নিলাম । এখন আর অত খিদে নেই ।
পকার আসল মা-ই এখন পুমা । পুরোনো মাকে সে ঐ নামে ডাকে । পুমাই ঠিক করেছে ডাকটা । নতুন বৌ নতুন মায়ের মত । পুমার কথামত পকা এসব জেনে নিয়েছে । এক ছেলের ভার একটু হালকা হলে সংসারের সুবিধে, তাই নিজের মা তার ভাগ বিলিয়েছে ।
পুমা বলেছে, দুবেলা দুবাড়ী তাকে খেতে হবে । ছেলে না খেলে মায়ের শান্তি হয় না । যতবারই ঝড় বন্যা এই গ্রামের ওপর দিয়ে গেছে, ততবারই আকাল হয়েছে । নাকাল হয়েছে মায়েরা । খাওয়া জোটেনি ছেলেপুলেদের । সন্তানরা অভুক্ত তাই মায়েদের পেট শুকিয়েছে যত, মন শুকিয়েছে তার অনেক বেশী । যে দু-এক ঘর থেকে খাবার জুটত, সেসব পরিবারে লোক কম । নতুন বৌ তার নিজের ছেলে তপাকে বলত, ওদের কিছু দিয়ে আয় । সঙ্গে সঙ্গেই তপা ডেচকি বাজিয়ে এটা ওটা নিয়ে ডাক পাড়ত । গুলতির টিপের মত করেই পছন্দের বন্ধুটিকে আগে ডাকত । পকাদা ছিল তার পছন্দের শীর্ষ তালিকায় । বেছে বেছে বড় নাড়ু, মোয়া পকা পেত । যাদের চোখ ছিল তারা অনেক সময় বলত, আমাকে বড়টা দিলে না । তপা ঠোঁটে আঙুল রেখে চোখ বড় করে বুঝিয়ে দিত, খবরদার ওসব বোল না । অন্যরা ওঅমনি চোখে চোখে অন্যায় স্বীকার করে নিত । পকা সেসব কিছুই টের পেত না ।
মেদিনীপুরের এই গ্রামটি বড়ই ঝঞ্ঝাক্লিস্ট । পকা ছাদ ছাড়া বাঁচা দায় । তপাদের পাকা বাড়ী । জায়গা জমিও ভালো । শান্তি মুখুজ্জ্যে ব্রাহ্মনত্বের পুরো ফায়দা তুলেছে । এ গ্রামে পুরোহিত বলতে ঐ একটি নাম । অন্নপ্রাশন থেকে শ্রাদ্ধ পর্যন্ত একটা জীবনের সমস্ত মন্ত্রই তার কন্ঠস্থ । পুজো আর্চায় বই দেখেন না । লোকে বলে পন্ডিত । সারা গ্রামেই তার যজমান । মুখুজ্জ্যে বাড়ী যেন লক্ষ্মী স্বরস্বতী দুজনেরই আসল মামাবাড়ী ।
বিধুদাস ভাগচাষী । একসময় মূলধন বলতে ছিল শরীরটা । তারই দৌলতে চার ছেলে মেয়ের বাপ । পকাই বড় । সঞ্চয় বলতে একটুকরো জমিতে একটা কুঁড়েঘর । তাও ফি বছর ঝড়ের তান্ডবে ঘর সারাইয়ের দেনা লেগেই আছে । পেট ভরাতে মাথা হেঁট । বাড়াবাড়ি সমস্যায় দু এক পাইট যোগাড় হয়ে যায় । খালিপেটে তা গিলে গিলে এখন সে হাড় গিলগিলে । একদিনের লাঙল চালানোর ধকল সামলাতে হয় পাল্টা একদিনের ঘুমে । এই দিনটাই বিধুর ভাল কাটে । ঘুম ভাঙলেই পাঁচজনের চার জোড়া চোখ । ভাগ্যিস পকাটা অন্ধ । নয়তো আরো একজোড়া চোখের করুণ শাসন সইতে হোত তাকে ।
- খেতে দেওয়ার মুরদ নেই, বছর বছর বাপ হওয়ার শখ আছে । বিধুর বউ চিল্লোয় । শিরায় তখনো ঝিমুনি । এগুলো মরেও না । বিধুর মনে আলগা একটা গোপন ইচ্ছে উঁকি দিয়ে আবার মিলিয়ে যায় । ফি বছর ঝড়ের মত এরাও এসে জুটেছিল । এখন কারুর এগারো তো কারুর বারো । ঐ পকাই শুধু বেশ কিছুদিন একা ছিল । পন্ডিতের কথায় নাড়ী না কাটলে আজ আর ঘরে জায়গা হোত না । ভাবতে ভাবতে খালিপেটেও দাঁত বেরিয়ে যায় বিধুর । সামনের দড়িতে ঝোলানো গামছাটা বিছানায় শুয়ে আগের মত পা দিয়ে টানতে গিয়ে বোঝে মূলধন শেষ । যে শরীরের ভয়ে আশেপাশের কিছু মানুষ তাকে সমীহ করত, তার ছিটে ফোঁটাও আজ নেই । মরা বিধুর সংসারে কতগুলো জ্যান্ত পেটের জ্বালা তাকে রোজ জ্বালিয়ে মারছে । হাতে ভর দিয়ে, পা সোজা করে মাটিতে পাতা বিছানা ছেড়ে সে উঠে দাঁড়াল । তারপর দু হাত দিয়ে গামছাটা টেনে কোমরে বেঁধে টলতে টলতে বেরিয়ে পড়ল ।
পকার মাথায় বুদ্ধি আছে । ওর বন্ধুরা ছাড়াও আরো পাঁচজন তাই বলে । ভালো ভালো কথা জানে । মনেও নাকি দয়ামায়া আছে । তপার চেয়ে সে বয়সে বেশ বড় । তবু ওদের সম্পর্ক বন্ধুর মত ! চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখার স্বাভাবিক নিয়মের ঘাটতি এবং সে কারনে জন্মানো করুণা থেকেই তপা ওকে ছোটর মত দ্যাখে । পকাও তা মেনে নিয়েছে । গুলতি টিপ করে তপা ওকে বর্ণনা দেয় । জড়ো না জীবিত জেনে নিয়ে পকা সেটা লাগা বা না লাগার প্রার্থনা জানায় । পকার প্রার্থনা মিলে যায় । সেদিন তপার মিথ্যে বলায় একটা চড়াই মরল । সেই থেকে পকা ওর কাছে আর জানতে চায় না । বলে, যাতে খুশি লাগ/ জ্যান্ত হলে ভাগ । এমনি করে বুলবুলিটা ফসকে গেল । তপা রেগে গিয়ে বলল, তোকে আর সঙ্গে আনব না ।
- তোরই তো ভাল হোল । ঐ সুন্দর পাখিটা তুই আবার দেখতে পাবি । আমি কি পারব ? কথাটা প্রথমে তপার কানে লাগল । তারপর মনেও । এইভাবে দুজনের সারাদিন কাটে । মুখুজ্জ্যে বাড়ীর চারপাশে দুই বন্ধুর অবিরাম আনাগোনা । একসময় পকার আস্তানা হোল মুখুজ্জ্যে বাড়ী ।
নতুন বৌ যখন বিয়ের পর ঘাটালে এল, তখন তার বয়স কম । দিন কাটত এবাড়ী ওবাড়ী ঘুরে । মুখুজ্জ্যে সারাদিনই পুজো আর যজমানি নিয়ে ব্যস্ত । তার ওপর স্কুলের মাস্টারির খাতায় নামটাও তোলা ছিল । ছোট্ট বউটার সময় কাটে না । একলা বাড়ীতে কতই বা মন লাগে ! একটা বেড়াল ছানা মিউমিউ করে এদিক ওদিক ঘুরে তবু কিছুটা প্রাণের জানান দিত । আর সঙ্গী হোল পাশের বাড়ীর ছোট্ট ছেলেটা । সবার `নতুন বৌ' পকার কাছে `নুটুন'। নুটুন বৌ নুটুন বৌ করে সারাক্ষণ তাকে মাতিয়ে রাখত । বয়স্করা মসকরা করে । নতুন বৌকে বলত, এই হোল তোর আসল বর । একলা ঘরে ফুটফুটে ছেলেটাকে আদর করতে গিয়ে নতুন বৌ আড়ালে জিগ্যেস করত, আমি তোর কে হই রে ? ওমনি গালে গাল ঠেকিয়ে সে চেঁচায় - নু-টু-ন বৌ । এক হাতে মুখ চেপে, কাছে টেনে নতুন বৌ কানে কানে বলে, এত জোরে বলতে নেই । বউকে চুপিচুপি ডাকতে হয়, তাও জানো না বোকাছেলে ! এ ভাবেই নতুন বৌ-এর মনের গভীরে জায়গা তৈরি হতে থাকে পকার । বাপের বাড়ী যাওয়ার আগেও তার অনুমতি নিতে হয় । ফিরে এলে সবার সামনেই কোলে উঠে ছোটবরটি আদর করতে থাকে । পাশাপাশি ছ সাত ঘরের মাঝখানে উঠোনের মত খালি জায়গায় দাঁড়িয়ে অনেকেই এ নিয়ে তামাশা করে । সেই সব টিপ্পনিতে নতুন বৌ- এর মুখ আরো লাল হয়ে ওঠে ।
তিনকুলে কেউ নেই মুখুজ্জ্যের । দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ও পার বাংলার মায়া ছেড়ে আসতে হয়েছিল । হিন্দু মুসলমানদের কাটাকাটিতে বাপ মা দুজনেই কাটা গেল । বাড়ী ছেড়ে পালাতে পালাতে এই গ্রাম । মাইতিবাবুর চোদ্দ বিঘে জমির গায়ে ছোট্ট শিবমন্দিরে পুজো করতে করতে আজ গ্রামের পুরোহিত । কত যজমান । তাদের চাল, কলা, ধুতি-শাড়ী নিতে নিতেই সংসারের সাধ জাগল । সে কথা এক যজমানের কানে যেতেই তোড়জোড় শুরু । সংযমী ব্রাহ্মনের স্বাস্থ্য আসল বয়স ঢেকে রেখেছিল । দেখতে মানানসই হলেও বয়সে নতুন বৌ ছিল অনেক ছোট । বিয়ের পর নিজের বলতে এই একজনের জন্য মুখুজ্জ্যে রাতদিন পরিশ্রম শুরু করল । টাকা না থাকলে কত কষ্ট তা সে জানে । এরপর সংসারে নতুন যে আসবে তারও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে । সব মিলিয়ে কাজের ঘন্টা গেল বেড়ে । নতুন বৌ আপত্তি করে । পন্ডিতের মত হোল, শরীর থাকতে খেটে নিলে পরে বসে খাওয়া যাবে । তাই পুরোহিতের পুরো দিনই প্রায় বাইরে কাটে । সারাদিনের ছোটাছুটি সংসারের জন্যেই । নতুন বৌও একা একা থাকার কষ্ট ভোগ করে । কারুর শরীর কারুর মন দুয়ে মিলেই সংসারের মঙ্গল । এর মধ্যে জীবন যেটুকু বাড়তি রস চায়, তার রসদ যোগায় ঐ একরত্তি পকা । স্বামীর সানিধ্য সন্ধের পর । নানান কথায় মুখুজ্জ্যের যেটুকু পরিচয় পায়, তাতে নতুন বৌ এর ভক্তি বা মায়াই হয় বেশী । খাটতে খাটতে লোকটা প্রাণপাত করে আর বলে, আর চিন্তা নেই । ছেলে হলে তাকে সব বুঝিয়ে দেব । খুব বড় কোন যজমানের কাজ না থাকলে বেরুব না । নতুন বৌ নিজের পেটের দিকে তাকায় আর ভাবে, ছেলে না হলে লোকটা হয়ত রাতেও খেটে মরবে ।
তপার জন্মের কয়েকবছর বাদেই পকার সাথে নিজের ছেলেকে বড় হয়ে উঠতে দেখে পন্ডিত একদিন আফসোসের স্বরে বলল, বিধু যদি ব্রাহ্মণ হোত তাহলে দুজনের পৈতে একসাথে দিয়ে, কাজগুলো বুঝিয়ে দিয়ে একটু নিশ্চিন্ত হতাম । তবে ব্রাহ্মণের সাকরেদ হতে ব্রাহ্মণ হওয়ার দরকার হয় না । পন্ডিতের ইচ্ছেই শাস্ত্রের বিধান । তাছাড়া কানা ছেলের জন্য সহানুভূতির একটু বা.দতি দর কষাকষি চলতেই পারে । হোলও তাই । দু-একজন যজমান আপত্তি তুলে থেমে গেল । একচেটিয়া ব্যবসার মজাই আলাদা । খদ্দেরের পছন্দ অপছন্দ অত ভাবার দরকার হয় না । এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী তপা এবং পকা দুজনেই মুখুজ্জ্যের সাথে যজমানিতে বেরোতে লাগল । গ্রামে ওদের পরিচয় হোল ভাইএর । মুখুজ্জ্যের মুখে শুনে শুনে পকার অনেক মন্ত্রই এখন মুখস্থ । দৃষ্টির অভাবে তেমন কিছু সাহায্য করতে পারে না বলে বড় কাজে তপার খাটনি বাড়ে ।
চক্ষুদানের রেওয়াজ বাড়ছে শহরে । বিজ্ঞাপনের স্লোগান আর ছবি দেখিয়ে মানুষকে মহৎ করার চেষ্টার ত্রুটি নেই । মৃত্যুর পর চোখ দুটো পুড়িয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু দান করা যায় না । এমন ভাবনার সংখ্যাভুক্ত এখনো শতকরা নব্বই । অবশ্য কেউ কেউ আবার পাত্র হিসেবে বিশেষ কাউকে এই দানে আগ্রহী । শহর থেকে বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত কিছু লোক সমাজ সেবার উদ্দেশ্যে এই গ্রামে এসেছে চক্ষুদান প্রচারে । অনেক বাড়ী ঘুরে বোঝা গেল, এরকম আবেদন বড়ই অমানবিক । একজন মানুষের শরীর থেকে শেষ সময় তার চোখ দুটো উপড়ে নেওয়ার প্রস্তাব খুবই গর্হিত । অথচ শহুরে লোকদের কথাবার্তায় যুক্তির ধার এতই বেশি যে তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার সময় রূঢ়তাই একমাত্র পথ । প্রচার দলের সবাই যখন বেশ হতাশ । সেইসময় জয়ের উল্লাসে দুজন এসে জানাল, আজ এই গ্রামের একজন প্রথম ফর্মে সই করেছেন । কে এই ব্যক্তি ? জানা গেল, তিনি এই গ্রামের পুরোহিত মুখুজ্জ্যে মশাই । ওনারই পাশের বাড়ীর পকা বলে একটি ছেলেকে চোখ দুটো দান করেছেন ।
তপা এবং পকার একজনের বারো অন্যজনের কুড়ি বছরের মাথায় পন্ডিতমশাই যে গত হবেন সে কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি । স্বাত্বিক বলে বেশীদিন পৃথিবীতে টিকে থাকার একচেটিয়া অধিকার থাকে না । তাই তাকে গ্রামের একচেটিয়া যজমানি ব্যবসা ছেড়ে চলে যেতে হলো । মৃত্যুর পর তার সই করা কাগজটা নতুন বৌ বিধূর হাতে দিয়ে অন্ধ ছেলের ্যস্থা করতে বলেছিল । কাগজটা নেড়েচেড়ে সদরে ছুটল বিধু । অনেকদিনের বাসিন্দা হিসেবে তার জানাশুনো অনেক । কিন্তু পন্ডিতের চোখে ছেলের দৃষ্টি ফেরাতে নিজের জানও বাজি রাখতে হয়েছিল তাকে । গ্রামের লোকেরা দু ভাগে বিভক্ত হোল । একদলের মতে এ হয় না । আর একদল মৃত মানুষের ইচ্ছে পূরণের পক্ষে । এই দুদলের মধ্যে মারাত্মক কিছু ঘটতে ঘটতেও পকা কিভাবে যে চোখ দুটো পেল, সে কথা গ্রামের সবাই জানে । এই ফিরে পাওয়া নজরের নজরানা দিতেই পকাকে দুবাড়ীর ছেলে হতে হল । পুমার কথায়, যদিও এ তার সোনায় সোহাগা, সোহাগের নুটুন বৌ যে সুন্দর পকা তা আগেই জানত । কি একটা গন্ধ ভাসত নাকের সামনে । সুন্দর মানুষের গন্ধ । চোখ পেয়ে সেই রূপ আরো বেশী চোখে লাগল তার । এদিকে পন্ডিতের কাছ থেকে পাওয়া পকার চোখের দিকে তাকিয়ে নুটুন বৌ ডাকটা একবার শুনতে ইচ্ছে করল তপার মার । নতুন বৌ যেন পকার মধ্যে এখন অর্দ্ধেক পন্ডিতকে দেখতে পায় ।
পকার নিজের মা অর্থাৎ পুমা ওকে বুঝিয়েছে নতুন বৌ এখন নতুন মায়ের মত । সে আর বেশী কথা কি ! বৌরা সবাই একসময় স্বামীকে মার নজরে দ্যাখে । শাসন করে । ভালমন্দ বোঝায় । মাতৃত্ব মেয়েদের জন্মের সাথে মিশে থাকে । রামকৃষ্ণ সারদাকে মায়ের রূপে দেখেছিলেন, কে না জানে । আবার কৃষ্ণ প্রেমে রাধাও বয়সের ধার ধারেনি । রাতদুপুরে এসব কথা মনে করে নতুন বৌ মনে মনে পাপের ভাগি হয়, কেন যে এমন হয় বোঝা দায় । পকা যখন ঐ চোখ দুটো দিয়ে নতুন বৌকে দ্যাখে, কি এক লজ্জা ভর করে । আবার মনে হয়, ছদ্মবেশে পন্ডিত ওর পরীক্ষা নিচ্ছে । পালিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না । আত্মা যদি সর্বজ্ঞানী হয় তো এতদিনে সে নিশ্চই ধরা পড়ে গেছে । সেদিনটাই সবচেয়ে বেশী ধরা পড়ার কথা, যেদিন পকা তার নতুন বৌকে বলল, এখনো কি তুমি আমার নতুন বৌ ? কবেই তো পুরনো হয়ে গেছ । শুধু বৌ বলে ডাকলে হয় না ? সমস্ত শরীর জুড়ে সে এক ভয়ানক ঝড় । ঝড় ঝঞ্ঝায় রপ্ত এ অঞ্চলের আর কারুর মনে এমন তান্ডব হয়েছে কিনা বলা শক্ত । পন্ডিতমশাই তো সোহাগ করে তো `বৌ' বলেই ডাকত । তার ছোট বরকে নিয়ে প্রতিবেশীদের ঠাট্টা পন্ডিতের কানেও পৌঁছেছিল । কথায় কথায় একদিন খাটাখাটনি কমিয়ে বিশ্রামের কথা তুলতেই সে বৌ কে বলেছিল, তোমার তো আরো একটা বর আছে । আমি গেলে সে দেখবেখন । পকার বয়স অনেক কম ছিল বলেই সে কথায় কোন অভিমান ছিল না । কিন্তু নারী পুরুষের শুধু শরীরের ফারাকই যে বয়সের ফারাক ঘুচিয়ে দিতে পারে, দেবতার পুজো করা পন্ডিতের তা বোধহয় জানা ছিল না ।
নতুন বৌ এর বাপের বাড়ীতে যে কাজের বৌটি ছিল সে একটি ছেলের সাথে থাকত । নাম বৃন্দাবন । পেশায় রাজমিস্ত্রি । একদল বলত সে ছেলের মত । অন্যদের মত অন্যরকম । একটু যেন নোংরা নোংরা । বউটির বর তাকে নিত না । বৃন্দাবন ছিল তার একই গাঁয়ের ছেলে । একদিন কাজ করতে গিয়ে বৃন্দাবন দোতলা থেকে পড়ে গেল । ভিড়ের মধ্যে মৃত বৃন্দাবনের বুকের ওপর শুয়ে সে কি কান্না কাজের বউটির । কিছুদিন সে কাজে এল না । তারপর যেদিন এল, সবাই তার দিকে চেয়ে অবাক । বিধবার বেশে থমথমে মুখ নিয়ে রান্নাঘর থেকে বাসন এনে কলতলায় বসল । নতুন বৌ এর বয়স তখন অল্প হলেও এ ঘটনায় তার মনটা বেশ নাড়া খেয়েছিল ।
নতুন বৌ এর বাপের বাড়ীতে পড়াশুনোর চল ছিল । আত্মীয় পরিজনদের সাথে সদ্ভাব ছিল । ভালমন্দ দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠার মধ্যে যে অভিজ্ঞতার সুযোগ থাকে তা থেকেই মানুষ নিজের ভাবনা চিন্তার নতুন পথ পায় । নতুন বৌও সেই পথের পথিক । মানুষের গুন দেখলে তাকে ভালোবেসে ফেলে । পকার মধ্যে দয়া মায়া বন্ধুত্ব এইসব মানবিক গুনগুলো একটু বেশী মাত্রায় আছে । ওর বাবার ঠিক উল্টো । লোকে বলে আমড়া গাছে আম.দাই হয় । মানুষ নামের গাছে সব ফলে । নতুন বৌ ছোটবেলায় সেই যে অন্ধ ছেলেটাকে নিয়ে একটা সিনেমা দেখেছিল পকা অনেকটা সেরকম ।
বিয়ের পর ঘাটালে যখন এল তখন পকা শুধু এদিক ওদিক ছুটে বেড়াত । একটা নিখুঁত ছেলে । ছ মাসের টাইফয়েডে দুটো চোখ গেল । এক জায়গায় বসে বসে কেমন শান্ত হয়ে উঠল । আর তখনই বোধহয় একটু একটু করে ওর জীবনবোধ তৈরি হতে শুরু করেছিল । সেসব পুরোনো কথা । পকা এখন একজন সুস্থ জোয়ান ছেলে । মনের উদরতায় সবাই ওর কাছের । তপাকে যেন নিজের থেকেও বেশী ভালোবাসে । গতকাল এই শীতের মধ্যে একটু অকাল বৃষ্টি হোল । তপার সাথে খেয়ে রাতে নিজের বাড়ী যেতে পারল না, পকাদের বাড়ী চার পাঁচ ঘর পরে । ছোট্ট জায়গার ভেতর এঘর থেকে ওঘর, ওঘর থেকে সেঘরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ওর পুমার কাছে খবরটা পৌঁছে গেল । মাত্র দুটো লেপের বড়টা পকা আর তপা নিয়ে শুল । ছোটটা নিয়ে নতুন বৌ পাশের ঘরে । একটু একটু জ্বর ছিল নতুন বৌ এর । মাঝরাতে উঠে নতুন বৌ দেখল বড় লেপটা দুভাঁজ করে তার গায়ে চাপানো । আর ছোট লেপটা দিয়ে তপাকে মুড়িয়ে নিজে একটা চাদর টেনে শুয়ে আছে পকা । কান্ড দেখে ছেলের পাশে শোয়া পকার মাথায় হাত বোলাতেও দ্বিধা হোল তার । ঘুমন্ত পকা যেন উদার এবং শান্ত যৌবনের এক প্রতিনিধি । যে তার স্বামীর চোখ দিয়ে তাকে দ্যাখে । লোকের চোখে ছেলের মত । ওপরওয়ালার কি মতি ! নতুন বৌ মনে মনে ভাবে কি পরীক্ষায় যে ফেললে । হঠাৎ দেওয়ালের গায়ে আঁটা ছবিটা হাওয়ায় নড়ে উঠল । সেদিকে তাকিয়ে সারা গায়ে কাঁটা দিল নতুন বৌ এর । ভয়ে ভয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল সে । মাথার ভেতর কে যেন শুধু মন্ত্র উচ্চারন করে চলেছে - নারীত্বের সবচেয়ে বড় সম্মান মায়ের, বড় কর্তব্য বিশ্বাসের । তুমিও তাদেরই প্রতিনিধি হও । ছবির সামনে গিয়ে সে পন্ডিতের পায়ে হাত রাখল । একটা কর্কশ শব্দে চারিদিক কাঁপিয়ে বাজ পড়ল কোথাও । চমকে উঠতেই পন্ডিতের ছবিটা কখন তার বুকের ওপর এসে আছড়ে পড়ল । বাইরে বৃষ্টি তীব্র হোল আরও । ছবিটা বুকে জড়িয়ে নতুন বৌ তার পাশের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল সজোরে । সেই আওয়াজের সঙ্গে আরো একটা বাজ পড়ার শব্দ মিশে গেল ।