পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ।
মনেই হয় না গতকাল রাতের সে দুর্যোগের ঘনঘটা সমস্ত পরিবেশকে কেমন ভীতিবিহ্বল করে তুলেছিল । পাহাড়ের অঙ্গে অঙ্গে বৈধব্যের রূপ । নিরাভরণ শুভ্রতা ।
গতরাতের সে কুটিলতার অবসান । শান্ত হয়ে গেছে প্রকৃতির আস্ফালন আর দম্ভ । শুচি-শুভ্র নতুন প্রভাত ।
সকালের ঝলমলে রোদ এসে পড়েছে তাঁবুর মাথায় -- রোদের তাপে জমা বরফ কেমন গলে গলে জল হয়ে নীচে ঝরে পড়ছিল । চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখি । চোখে পড়ে অদূরে কুণ্ডের উপরিভাগ বরফের লেপের তলায় । অপরিসর, নিস্তরঙ্গ জল তাই তার মাথায় পড়েছে বরফের ঘন আস্তরণ । শীতের সময় নিত্য বরফপাতে এ স্তর কঠিন পাথর হয়ে যায় ।
-"অমরদা তৈরি হয়ে নিন ।" তরুণের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পাই । লজ্জিত হই । প্রস্তুতি নেবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ি । তাঁবু খোলার পর্ব শুরু হয়েছে । বরফ ঝেড়ে পরিষ্কার করে তাঁবু খুলতে তাই দেরি হচ্ছিল । কুন্দনের সঙ্গে কুলিরাও হাত লাগিয়েছে তাতে । চা, দুধ কর্নফ্লেকসের বিতরণ পর্ব আরম্ভ হয়েছিল যথারীতি । প্রাত্যহিক একই অবতারণা । নতুন করে সংসার সাজিয়ে বসা, আবার ভেঙে ফেলা সবকিছু । যাযাবরী বৃত্তির আনুষ্ঠানিক সূচি ।
বিমলবাবু কোন এক কুলিকে জিজ্ঞাসা করে জেনেছেন আজ থেকেই নাকি রীতিমত তকলিফের পথ । শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত । কথাটা কানে এসেছিল । বিমলবাবু সুধাংশুকে বলেছিলেন । পাহাড়ের উচ্চতায় পথের অবস্থা যে খারাপ হয়, বা যে কোন মুহুর্তে খারাপ হয়ে যেতে পারে এটাতো খুবই সত্যি এবং স্বাভাবিকও । তাই তাঁর একথার খুব একটা গুরুত্ব দিই না মনে মনে । প্রকাশ্যেও কিছু বলিনি ।
প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের, খুঁটিনাটির কিছু পড়ে রইল কিনা শেষ পর্বে একবার দেখে নিয়ে যখন তরুণ যাবার উদ্যোগ শুরু করছিল তখন সামনের পাহাড়ের দিকে চাইতেই চোখে পড়লো কয়েকজন কুলি পাহাড়ের মাথার কাছে গিয়ে পৌঁছেছে । চমকে উঠি ! মনে মনে ভাবি, এ কী পথ ? হেঁটে হেঁটে যাওয়া না বানরের মত পাথর বেয়ে বেয়ে ওঠা ! পাহাড়ের উচ্চতায় পথের এ অবস্থা তো হবেই, পরক্ষনেই মনে হয় । ভয় পাই না । রবীনকে অনুসরণ করি । গত রাতের পড়া বরফ এদিক ওদিক জমে জমে আছে । পাথরের খাঁজে-খন্দে । কোথাও আবার রোদে গলে গিয়ে জল হয়ে ঝরছে এখনও । কোথাও গলা জলের ধারা নেমে যাচ্ছে নীচে পাথরের ফাঁক ফোকর দিয়ে । কুণ্ডের মুখ থেকে পথের শুরু । উত্তরের পাহাড়ের গা ধরে ওপরে উঠে গেছে খাড়াই হয়ে । প্রথম প্রথম কয়েকধাপ হেঁটে কিছুটা ওপরে উঠে এলাম । এরপর হাঁটার অবস্থা আর থাকল না । কেননা পাহাড়ের গায়ের যা অবস্থা তাতে হেঁটে এগোনো আর সম্ভব নয় । চার হাত-পায় পাথর আঁকড়ে ধরে ওপরে উঠতে হবে । খুবই বিপজ্জনক ; পরিশ্রমসাধ্য কাজ । রবীন তার স্বভাবসিদ্ধ গতিতে হেঁটে উঠছে দেখলাম । ভরসা পাই । আমিও অপেক্ষা করি না । তাকে অনুসরণ করি । আজকের পথের কী হাল হতে পারে সে ধারণা তো আছেই তাই বুদ্ধি করে স্যাক আর পিঠে বাঁধিনি । কুন্দন সিংকে দিয়ে দিয়েছি । একটা নিশ্চিন্ত ভাব অনুভব করি প্রতি মুহুর্তেই ।
বোল্ডারের গায়ে বোল্ডার লেগে আছে । তৈরি হয়ে আছে একটু ফাঁক । সেই ফাঁকে পা রেখে আরও এক ধাপ করে ওপরে উঠি । সারা পথের মোটামুটি অবস্থা এই । রবীন অনেকটা ওপরে উঠে গেছে । আমিও সমানে তাকে অনুসরণ করে চলেছি । তবে এক সঙ্গে তাকে সামলাতে পারছি না । দমের কষ্ট হয় । তাই মাঝেমধ্যে পাথরের ওপর দাঁড়াই । জিরিয়ে নিই খানিকক্ষণ ।
কুলিদের আর দেখা যাচ্ছে না । রাজাকেও না । তারা ওপরে আরও উঠছে না পৌঁছে গেছে মাথায় এখান থেকে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না । নীচের দিকে চাইতেই চমকে উঠি ! বিমলবাবুকে নিয়ে তরুণ নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হল । হাত তো তিনি ধরেইছেন তবু পা ফেলার একটা ইতস্ততা ও জড়তা এখনও তাঁর যায়নি । পার্থ, নীলাদ্রিকে নিয়ে কুন্দন আমাদের প্রায় ধরেই ফেলেছে ।
|
যতই ওপরে উঠছি ততই বিস্ময়ের ঢল নামছে দু'চোখে । মনে হচ্ছে যেন নতুন কোনও এক পাহাড়ি রাজত্বে এসে হাজির হতে চলেছি । চতুর্দিকে ছোট বড় পাহাড়ের মালা । কত রকমের কত আকারের শিখরমণ্ডলী । অবাক হয়ে দেখি । কোন পাহাড়--কী তার নাম, কত তার উচ্চতা কিছুই জানি না ।
কুলিরা যে ওপরে উঠে গেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই । কেননা পাহাড়ের মাথার কাছেই এসে পৌঁছেছি বলে মনে হল । রবীনকেও আর দেখতে পাচ্ছি না । সেও তাহলে ওপরে পৌঁছে গেছে । এখান থেকে নীচে গতকালের ক্যাম্পিং গ্রাউণ্ড স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল । পাশেই জলের কুণ্ড । সবুজ ঘাস । বরফ গলে গলে অনেক পরিষ্কার হয়ে গেছে । পাহাড়ের মাথার শেষ অংশে ওঠা একটু সহজ বলেই মনে হল । কিছু কিছু ধাপের মত পেলাম পাথরের গায় । গুজরদের পায়ে পায়ে তৈরি হয়েছে এই পথের রেখা । সে-রেখার অস্তিত্ব কোথাও সামান্য আবার কোথাও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে । তখন নতুনভাবে পথ তৈরি করে চলতে হয় ।
পাহাড়ের মাথায় উঠে এলাম । এও তো দেখছি সেই রিজেরই আকৃতি । ওপারে আবার পথ নেমে গেছে । খাদের গা ধরে শুরু হয়েছে বোল্ডারের সমুদ্র । বোল্ডারের ঢেউ উঠেছে নেমেছে দিগন্তের কিনারা ধরে, কোথায় কে জানে ? মনে মনে ভাবি এই বোল্ডারের মাথা ভেঙ্গেই তো যেতে হবে এবং এটাই আমাদের আজকের পথ । মনে মনে শিউরে উঠি !
এক এক করে সবাই ওপরে উঠে আসছে সুধাংশু এসেছে, স্বপন এসেছে । কুন্দনের সঙ্গে এসেছে নীলাদ্রি পার্থও । আসেনি শুধু বিমলবাবু আর তরুণ । এখনও ওরা পাহাড় বেয়ে উঠছে । শরীরের সামর্থের কথা বিবেচনা করার অবকাশ দেয় না অনেক সময় ভ্রমণের উত্সাহে জোয়ার এলে । বিমলবাবুর ক্ষেত্রে তাইই হয়েছে । তিনি ভেবেছিলেন মামুলি পাহাড়ের চড়াই-উত্রাই পথ হবে, তাই ভেঙে ভেঙে যাওয়া, আগে তিনি যেভাবে পাহাড় পরিক্রমা করেছিলেন । কিন্তু এ-পর্যায়ের পথের বিকৃতি সত্যিই তাঁর কল্পনার বাইরে ছিল । তাই তিনি হঠকারিতার পথে যাননি । সাহায্যের প্রত্যাশী হয়েছিলেন । ভালই করেছেন । কারণ তিনি খুব ভাল ভাবেই জানতেন, পাহাড় অবিবেচকদের কোন দিনই ক্ষমা করে না ।
সেদিন বিমলবাবু শেষপর্যন্ত উঠে এলেন পাহাড়ের মাথায় । বেহাল, বিপর্যস্ত অবস্থা । শরীর, মন । কিন্তু ভেঙে পড়েননি । তরুণও ক্লান্ত, বেহাল । কিন্তু তার মুখে কোনও বিকৃতি দেখিনি । সেই শান্ত হাসিটি তখনও মিশেছিল মুখে ।
|
গ্লুকোজ মেশানো জলের বোতল রবীন সকলকে দিয়েছিল এক এক করে । টফি, লজেন্সের প্যাকেটও । ঘন্টাদেড়েকের দমবন্ধ করা বুকফাটানো যে চড়াই ভেঙে আমরা ধারাল এক রিজের মাথায় উঠে এসেছিলাম সে জায়গার নাম রায়মূলা পাস । ১৫,০০০ ফুট উঁচুতে । কুন্দন সিং বলে এরপর শুধু বোল্ডার ভেঙে ভেঙে সারাদিন নাকি যেতে হবে । আমি দেখে আগে যা ভেবেছিলাম তাই ।
বেলা বাড়ছিল আস্তে আস্তে । দুপুরের আবহাওয়ার অনিশ্চয়তার কথা ভেবে দেরি করি না আর । এক এক করে সবাই নেমে পড়ি রিজের মাথা থেকে । সামনেই বোল্ডারের বিশাল প্রান্তর । পাথরের চাঙড়ের পর চাঙড় । ঠাসাঠাসি, গাদাগাদি । বোল্ডারের এঢাল নেমে গেছে নীচে কোথায় কে জানে ? কুলিরা বোল্ডার টপকে টপকে চলছিল সার দিয়ে । কখনও পাথরের মাথায় উঠছে কখনও নেমে যাচ্ছে কিন্তু পথের সমতা ঠিক রেখে চলছিল । এতটুকু ভুলভ্রান্তি হচ্ছিল না, লক্ষ করলাম । এটাই কিন্তু আসল দেখার ব্যাপার । তা নাহলে বোল্ডার বেয়ে হয় অনেক ওপরে উঠে যেতে হবে, নাহলে নেমে যেতে হবে অনেক নীচে । দুর্গতির আর শেষ থাকবে না । এটাই বিশেষভাবে খেয়াল করে বোল্ডার ভেঙে চলতে হয় ।
চলছিলামও তাই কুলিদের পথ অনুসরণ করে । কিন্তু অসুবিধা হয় কুলিরা যখন নজরের বাইরে চলে যায় । তাদের গতির সঙ্গে সমান তালে তাল মেলাতে আমরা পারি না । পিছিয়ে পড়ি । তাই পথ ভুল হবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে । ভুল হলও তাই । চাঁঙড় ভাঙতে ভাঙতে নেমে পড়েছিলাম অনেকটা । কুলিদের ওপরে দেখতে পেয়েই ভুল ভাঙলো আমার । আবার ওপরে উঠতে শুরু করি ।
এত পাথরের চাঙড়ও ছিল পাহাড়ে ! যেদিকেই চাই শুধু পাথর আর পাথর ! ছোট বড় নানা আকারের অজস্র বোল্ডার । চাপ চাপ, ঠেসে আছে ।
মনে হয়, অতীতের কোন একসময় হয়ত এখানে ছিল বিশাল এক পাহাড় মাথা উঁচু করে । তারপর হল একদিন সেখানে আকস্মিক বিরাট এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় । ওলট পালট হয়ে গেল সব । পাহাড়ের গায়ে নামলো বিশাল এক ধস । চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল পাহাড় । খান খান হয়ে ভেঙে পড়লো পাথরের চাঙড় । ভরাট হয়ে গেল বিরাট প্রান্তর বোল্ডারে বোল্ডারে । নাকি একদিন জায়গাটা ছিল গভীর হিমবাহ, যার চাপে গুঁড়িয়ে গেছে নীচের পাথর, আর বয়ে বয়ে এনেছে আরো অনেক চাঙড় নানা জায়গা থেকে ? কে জানে ?
দম ফুরিয়ে আসে । পাথরের মাথায় দাঁড়াই । দম নিই বুক ভরে । আবার যাওয়া শুরু করি । একটার পর একটা বোল্ডার ধরি সেটা পার হয়ে ধরি আর একটা । একঘেয়েমির শেষ । নতুনত্ব কিছু নেই । ভাল লাগে না ।
কতক্ষণ যে এভাবে চলেছি জানি না । সূর্য মাথার ওপর এসে পৌঁছেছে । সামনের দিকে চেয়ে দেখি অন্তহীন বোল্ডারের ঢাল এগিয়ে গেছে দূরে -- আরও দূরে, অনি:শেষ, কোথায় কে জানে ?
রবীন, রাজা আমাকে ফেলে চলে গেল । পিছন ফিরে চাই । অনেক দূরে দেখি পাথরের ওপর তরুণ, বিমলবাবু দাঁড়িয়ে । দলের বাকিরা কে কোথায় বুঝতে পারি না ।
আকাশে মেঘ আর রোদের খেলা । দূরের পাহাড়ের গায়ে কখনও রোদের মাখামাখি, আবার কখনও মেঘের দীর্ঘ ছায়া । আবার বোল্ডার ভাঙতে শুরু করি । পাহাড়ি পথের অনেক কথা মনে আসে । নেপাল মুক্তিনাথের পথে জুমসুমে উদার বিস্তৃতি কালীগণ্ডকীর বুকে । নারায়ণ-শিলার অবস্থান ক্ষেত্র । নদীর বুকে অজস্র শিলার সমাবেশ । কত সুন্দর লেগেছিল পায়ে পায়ে সে-শিলার স্তর ভেঙে যেতে । আবার গাড়োয়াল হিমালয়ে রূপকুণ্ড পেরিয়ে শিলা সমুদ্রের বুক ধরে নন্দাকিনী নদীর তীর বরাবর রাশি রাশি পাথর ভাঙা । সেও ছিল সুন্দর সমতার মধ্যে । আবার কুমায়ুনে ছোটকৈলাস যাবার পথে জলিংকং উপত্যকায় বোল্ডার ভাঙা সেও ছিল সাধ্যের মধ্যে । কিন্তু এ-পথের অন্তহীন বোল্ডারের দুর্গমতায় সত্যি হতাশ হতে হয় । যেমন কষ্টকর তেমন শঙ্কাজনক ।
পাথরের এক জায়গায় এক ফাটলের মুখে আলগা পাথর ছিল একখানা । ঠিক বুঝতে পারিনি । পা ফেলতেই পাথর সমেত সমস্ত পাখানা ফাটলের মধ্যে ঢুকে গেল । বসে পড়ি । পা তুলতে পারি না । নীলাদ্রি আর পার্থকে নিয়ে কুন্দন সিং এসে পড়েছিল তাই রক্ষে । কুন্দন অমাকে টেনে তুলেছিল । তা নাহলে কতক্ষণ এই অবস্থায় বসে থাকতে হত কে জানে ?
কুলিরা এক জায়গায় বিশ্রাম করতে বসেছে । রাজা ও রবীনকে ওখানে দেখলাম । আর সকলে তাহলে পিছনে পড়ে আছে । আসতে দেরি হবেই । বোল্ডার ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে আসা খুব সহজসাধ্য কাজ নয় ।
"এ জন্যেই মনে হয় এপথে কেউ আসে না, অমরদা" -- রবীন বোল্ডারের গায় হেলান দিয়ে বলে ওঠে ।
"সত্যিই তাই । এদিকের পরিচয় নেই ট্রেকার্স মহলে ।" আমিও একমত ।
"থাকবে কি করে বলুন তো, না আছে পথ, না আছে ক্যাম্পিংগ্রাউণ্ড, না পাওয়া যায় ভাল গাইড, কুলি । কী ভরসায় আসবে ?" রাজা যোগ দেয় । রবীনের বোতল থেকে জিওলিন মেশানো জল একঢোক খেয়ে বলি, "পথের প্রচার হয় মানুষজন আসলে গেলে, অর্থাৎ আকর্ষণ, সুযোগ সুবিধা কিছু থাকলে সকলে আসে । এপথের কী আকর্ষণ আছে বল ? না আছে কোনও দেব-দেবীর মঠ-মন্দির, তীর্থ বলে পরিচিতি কিছু নেই । আবার কোনও প্রাকৃতিক দর্শনীয় বস্তুও নেই, যেমন ধর উষ্ণ প্রস্রবণ, জলন্ত আগুনের শিখা, জলপ্রপাত, বড় ঝরনা, বিশাল বরফের পাহাড়চূড়ো কীসের টানে মানুষ আসবে এদিকে ? তবে হ্যাঁ, আছে, আকর্ষণ অবশ্যই আছে, যারা নতুনের পরিচয় পেতে চায়, যারা পাহাড়কে ভালবাসে, দেখতে চায় পাহাড়ের গভীর অন্দরমহলের রূপ, অলংকরণ, তাদের কাছে নিশ্চয়ই আছে এ-পথের আকর্ষণ ।"
কুন্দনের পাশে নীলাদ্রি ও পার্থ বসে ছিল একখানা পাথরের ওপর । ওদের দেখে নীলাদ্রিকে বলি, "কী নীলাদ্রি, পাহাড় লাগছে কেমন ?" সেও সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, "ভাল, তবে বড্ড কষ্ট ।" -- "কষ্ট তো হবেই, পাহাড় কী আর আরাম কেদারা ? তবে হ্যাঁ কষ্ট করলে তুমি যা তোমার দুচোখ ভরে দেখে নেবে বাড়ি বসে থাকলে সেটা আর পাবে না । একাবারে ফাঁকে পড়ে থাকবে ।"
--"সত্যি অমরদা, পাহাড়ের মধ্যে যে এতকিছু থাকতে পারে এ আমি জানতাম না । শুধু দার্জিলিং গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে এসেছি । দারুণ ভাল লেগেছিল ।" নীলাদ্রি বলে ওঠে ।
-- "হ্যাঁ, শুধু দার্জিলিং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার এক রূপ দেখে এসেছ, আবার যদি তুমি যেতে কালিম্পঙ, লাভা লোলেগাঁও, সেখান থেকে তাকে আর এক রূপে দেখতে । আবার যদি সিকিমে যেতে সেখানে তাকে অন্য আর এক রূপে দেখতে পেতে । এই ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় গেলে পাহাড়ের রূপ তোমার চোখে পড়বে বিভিন্ন । তাই নানা জায়গায় যেতে হয় পাহাড়ের নানা নতুন রূপ দেখতে ।" বুঝিয়ে বলি তাকে ।
বিমলবাবুর হাত ধরে তরুণ শেষকালে এসে পৌঁছলো । রবীন সঙ্গে সঙ্গে জলের বোতল তাঁর হাতে দেয় । বিমলবাবু শুধু একবার আমার মুখের দিকে চেয়ে দেখলেন । কিছু বললেন না । বুঝলাম, বলার মত অবস্থা এখন তাঁর নয় । উঠে দাঁড়িয়ে আমার বসা পাথরে তাঁকে বসতে দিই । তিনি বসে পড়েন ।
ছবি তুলতে দেরি হচ্ছিল । তাই সুধাংশুর আসতেও দেরি হল । নাহলে অনেক আগেই সে ও স্বপন এসে পৌঁছতো ।
মূর্তিরাম বার বার পশ্চিমের এক পাহাড়ের দিকে তাকাচ্ছিল । কুন্দন সিংয়ের সঙ্গে কী সব কথাবার্তাও হল । ঠিক বুঝলাম না । শুধু চোখে পড়লো ওদের আঙ্গুল আর হাত তোলাতুলি । তারপরই সে বলে উঠলো, "বাঁ দিকে যে ধসা বোল্ডার নেমে গেছে ওই বোল্ডার ধরেই নামতে হবে ।" এবার বুঝলাম, পথের হদিশ করছিল সে এতক্ষণ । মনে মনে ভাবি, এসব অঞ্চলে একবার পথভ্রষ্ট হলে বা দিক ভুল হলে, কী অবস্থা না হবে । এখন তবু দিনের আলো আছে, যখন এ আলোটুকু মুছে যাবে আস্তে আস্তে তখন আলো নেই, জল নেই, তাঁবু ফেলবার ঠাঁইটুকু পর্যন্ত নেই, তখন তো সব কিছুই মুছে যাবে চোখের ওপর থেকে ! খোলা আকাশের তলায়, হাড় হিম হওয়া ঠাণ্ডায়, আবহাওয়ার অনিশ্চয়তায় এ-পাথরের রাজত্বে সারারাত ! চিন্তা করা যায় না ।
বোল্ডারের ঢাল বাঁদিকে মোড় নিয়েছে । সামনে পড়ে রইল বিশাল পাথুরে প্রান্তর । সেদিক থেকে আমরা সরে এলাম । এই ঢাল নেমে গেছে খাদের সীমায় । ওপর থেকে দেখা যাচ্ছিল পাথর চোঁয়ানো ঝরনার জল বয়ে যাচ্ছে নীচে ।
কুলিরা এগিয়ে চলেছে । পেছনে আমরা । এদিকেও পাথরের শেষ নেই । সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে পাহাড়ের মাথায় । পাহাড়ের দীর্ঘ ছায়া দুলছিল পাথরের চাঙড়ের ওপর । সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম । কষ্ট, ক্লান্তিতে ধুঁকছিলাম । জানি না কখন পথের শেষ হবে । বোল্ডারের পর বোল্ডার আসছিল । তাই বেয়ে বেয়ে ওঠা, আবার নামা । তারপর আবার পরের বোল্ডারে পা রাখা, আবার নামা । সারাদিনই চলছিল এই একই ক্লান্তিকর কাজ । বিরক্তির শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছিলাম । ঘন্টাদেড়েক পরে এই একঘেয়েমির ইতি ঘটলো মূর্তিরামের হঠাৎ ইঙ্গিত পেয়ে । কুলিরা দাঁড়িয়ে পড়েছিল । কীসব কথাবার্তা তাদের সঙ্গে হল মূর্তিরামের । তারপর দেখলাম কুলিরা পাথরের গা ধরে নীচে নামতে শুরু করেছে ।
আজকের পথের এই পরিবর্তনে মনে মনে ভগবানকে সেসময় ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম কিনা মনে নেই, তবে যে একটা সুখপ্রদ স্বস্তি পেয়েছিলাম সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত । সারাদিনের এই কষ্টকর একঘেয়েমির হাত থেকে নিস্তার পেয়েছিলাম । রাজা, রবীন, পার্থ ওরাও নেমে পড়েছে দেখলাম কুলিদের পেছন পেছন । তরুণ, বিমলবাবুর এখনও দেখা নেই । তাঁর দুরবস্থার কথা ভেবে সত্যিই কষ্ট হচ্ছিল । পাহাড়ে-পর্বতে ঘোরাঘুরি করেছেন অনেক কিন্তু এরকম দুর্গম পথের মুখোমুখি হননি তিনি কোনও দিন ।
নামতে শুরু করি । দিনের আলো কমে আসছিল একটু একটু করে চারদিকে । পাথরের খাঁজে খাঁজে অন্ধকার বাসা বাঁধছিল । নীচের দিকে চোখ পড়ে । অতল খাদ । মনে হচ্ছিল ধোঁয়ার মত অন্ধকার যেন কুণ্ডলী পাকিয়ে ওপরে উঠে আসছে । শ্রান্ত, ক্লান্ত, অবসন্ন দেহমন, পা টেনে টেনে নামতেও বেশ অসুবিধা হচ্ছিল । তবু নামতে হবে । পাথর ধরে ধরে নীচে পা ফেলি, আবার পাথর ধরি । কতক্ষণ এভাবে নেমেছি জানি না, তবে একসময় মনে হল আর নামার বাকি কিছু নেই । সমতল মত ফাঁকা বেশ খানিকটা জায়গা । গিরিখাতের মত । টুকরো টুকরো পাথরে বোঝাই জায়গা । তার ফাঁকে ফাঁকে বরফ জমে আছে । পড়ন্ত রোদে চিক চিক করছিল ।
বরফের ওপর পড়ে থাকা এক পাথরের ওপর বসে পড়ি । উঠতে এক পা-ও আর ইচ্ছে করে না । মনে হল পা দু'খানা যেন ভারি বিশ মন হয়ে গেছে ।
তরুণ বিমলবাবুকে নামাচ্ছিল হাত ধরে ধরে । তার পেছনে কুন্দন সিং ও মূর্তিরাম । গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে সুধাংশু, স্বপন এখনও পাহাড়ের মাথায় ঘোরাঘুরি করছে । কখন নামবে কে জানে ?
কুলিদের দেখাসাক্ষাত পেলাম না নীচে । ওরা আরও এগিয়ে গেছে । নজর করতেই চোখে পড়ে সামনের এক পাহাড়ের গা ধরে ওরা উঠে যাচ্ছে । মনে হল তাদের পেছনে রাজা, রবীন ও পার্থ । জলের ঝোরার মৃদু শব্দ কানে আসছিল ঝুম ঝুম করে ।
-- "টেন্ট আজ ওখানেই পড়বে ।" নামতে নামতে হাঁক পাড়ে তরুণ । -- "সে কি !" "পাহাড়ের মাথায় তাঁবু ফেলার ভাল জায়গা আছে বাবুজী ।" মূর্তিরাম পাহাড় থেকে নামতে নামতে চিত্কার করে ওঠে । --"থাকুক, আর এক পাও নয় । তাঁবু আজ ওখানেই পড়বে ।" উত্তেজিত তরুণ আবার বলে ওঠে ।
--"বেঘোরে মারা পড়তে হবে বাবুজী । ওখানে পাথরের তলায় শুধু বরফ । রাতে যদি আবার বরফ পড়ে ।" কুন্দন সিং আর্তনাদ করে ওঠে ।
--"হোক বরফ, মারা পড়ি পড়বো । তাঁবু খাটাও ওখানে ।" তরুণের মরিয়া গলা ।
--"কুলিরা এগিয়ে গেছে, বাবুজী ।" হতভম্বের মত বলে ওঠে মূর্তিরাম ।
--"যাক এগিয়ে । ওদের ফিরতে বল । তোমরা ভেবেছ কী ? আমরা মানুষ নই ?" তরুণের ক্ষুব্ধ দৃঢ় কন্ঠ ।
এর পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত । কুন্দন সিং নীলাদ্রির হাত ছেড়ে ছুটলো পাহাড়ের দিকে কুলিদের ফিরিয়ে আনতে, তাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে ।
সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল । টর্চের আলোয় তরুণ তাঁবু ফেলার জায়গা খুঁজছিল গিরিখাতের মধ্যে । সমতল ছেড়ে একটু ওপরে উঠতেই নজরে পড়ে শীর্ণ এক ঝরনা । পাথরের টুকরোর ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে ঝির ঝির করে । কিছুটা বয়ে গিয়ে হঠাৎ নীচে নেমে গেছে । পাথরের টুকরোর নীচে মনে হল বরফ জমে আছে এখানে ওখানে ।
|
কুলিরা ফিরে এসেছে । তরুণই তদারকি করে তাঁবু খাটাচ্ছিল । ঝরনার ঠিক পাশে একটু ওপরে বড় বড় পাথরের টুকরো হাতে হাতে নিয়ে কুলিরা সাজাচ্ছিল ঠিক বেদির মত করে । তলায় পুরো বরফের আস্তরণ । তিনখানা তাঁবু পড়েছিল পাশাপাশি সার দিয়ে । প্লাস্টিকের ওপর ক্যারিমেট বিছিয়ে তার ওপর বিছানা । মনে হল আজকের রাত্রিযাপন হবে বরফের শয্যায় । আবার যদি বরফ পড়ে রাতে তাহলে তো সোনায় সোহাগা -- বরফের মধ্যে সমাধিস্থ হয়ে যাব নি:সন্দেহে ।
বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না বেশিক্ষণ । ঠাণ্ডায় সারা দেহ কুঁকড়ে যাচ্ছিল । অসম্ভব একটা ঠাণ্ডা উঠছিল নীচে থেকে । সহ্য করা যায় না । রবীন তাঁবুর মধ্যে বাতি জ্বালাতে জ্বালাতে বলে ওঠে, "পাহাড়ের ওপর তাঁবু ফেললে ভাল হত না অমরদা ? আর একটু কষ্ট করলে হয়ত সেটা সম্ভব হত ।"
--"অসম্ভব রবীন, বিমলবাবুকে নিয়ে তরুণ সারাদিনের অবস্থায় শেষপর্যায়ে এসে পৌঁছেছিল । সবাই পারলেও বিমলবাবু আর পারতেন না । শেষকালে কিছু যদি একটা ..... । কথাটা শেষ করি না । কম্বলখানা টেনে নিয়ে শুয়ে পড়ি ।
বাইরে প্লাস্টিক সিট খাটাবার যথেষ্ট জায়গা থাকলেও বরফ সরিয়ে, পাথর সাজিয়ে, সমান করে আর সম্ভব হয়নি বলে তাঁবুর মধ্যে রান্নার উদ্যোগ শুরু হয়েছিল । এত কষ্ট, এত পরিশ্রমের পরও কফিপর্বের অনুষ্ঠান যথারীতি ঘটিয়েছিল স্বপন ও রাজা । ভুলচুক এতটুকু হয়নি । তরুণও সমানে সাহায্য করেছিল স্বপনকে ।
কফির সঙ্গে ডালমুট আর চানাচুর । সত্যিকথা বলতে কি এত অস্বাভাবিকতার মধ্যে সেদিনের সে হিমশীতল সান্ধ্যপর্ব মনে করে রাখবার মত উপভোগ্য হয়েছিল । সুধাংশু তার ক্যামেরাতে সমস্ত অনুষ্ঠানপর্ব ধরে রেখে দিয়েছিল । সেদিন ছিল সত্যিকারের এক স্মরণীয় সন্ধ্যা ।
রাতের খাবার তৈরি হয়েছিল যেমন রোজই হয় । কুলিরাও রান্না এ-তাঁবুতেই করে নিয়েছিল । রেশনের অবস্থা কেমন কে জানে । শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছবে জানা নেই । কুন্দন সিং আর স্বপনই বলতে পারবে কুবেরের ভাণ্ডারের খবর কী ।
কুলির দল চলে গিয়েছে দেখলাম কিছুদূরে পাহাড়ের গায়, ওপর অঞ্চলে । সেখানেই তারা প্লাস্টিক খাটিয়ে নিয়েছে রাতের আশ্রয়ের জন্যে । সত্যিই এই বরফের ওপর থাকা তাদের পক্ষে একরকম অসম্ভব । কিছুই তো নেই ওদের বিছানাপত্র পাতবার মত । কিছু চট, বস্তা, প্লাস্টিক ছাড়া । এই হিমশীতল রাজ্যে যদিও ওদের জন্ম, বৃদ্ধি, মৃত্যু সবই হয় তবুও বাঁচার ক্ষেত্রে যেটুকু ওদের অপরিহার্য সেটুকু তো তাদের চাই । তাই এত কষ্ট, এত অসৌষ্ঠবের মধ্যেও তারা তাদের প্রয়োজনীয় অবস্থান নির্বিঘ্ন করতে চেয়েছে ।
তাঁবু ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসি । মনে হল এখানে যেন মৃত্যুর হিমশীতলতা । আকাশ পরিষ্কার নয় । ভাঙ্গা ভাঙ্গা মেঘ ছড়িয়ে রয়েছে তার গায় । নিস্তব্ধ চারদিক । শুধু ঝরনার একটানা সুর কানে আসে । মনে হল এত স্তব্ধতার মাঝে সে যেন তাল ভঙ্গ করে চলেছে । আকাশছোঁয়া বরফের পাহাড়ের শৃঙ্গমুখ হতে জন্ম হয়েছে তার তারপর পাহাড়ের গা ধরে লুকিয়ে চুরিয়ে নেমে এসেছে নীচে । কলকল, ছলছল ঢেউয়ের সুর তুলে পাথরের অলিগলি দিয়ে সে পালিয়ে এসেছে আরও নীচে দিশেহারা গতি নিয়ে । এরপর একদিন চলার ছন্দে আসবে তার উদ্দাম উদ্বেলতা, ধুয়ে মুছে নিয়ে যাবে তার পথের সকল বাধা, মিলনের প্রয়াসে সে সাড়া দেবে নদীর আকুল আহ্বানে । একদিন সে নদী লীন হবে মহাসাগরের বুকে । তার জন্ম হবে সার্থক । মানুষের জীবনই কী এই ? সেও কী ছোটে জীবনের ছন্দের গতি নিয়ে মহামিলনের আহ্বানে মহাপ্রাপ্তির আশায় ? জীবনের সার্থকতায় ? হয়ত হবে ।
মনে হল রাত অনেক হয়েছে । দেরি করি না । ফিরে আসি তাঁবুতে ।
তাঁবুর মধ্যে ঝুলন্ত তাপমানযন্ত্রর পারদস্তম্ভের অবস্থান সঠিকভাবে দেখে বাইরে বেরিয়ে আসি পরের দিন সকালে । পারদস্তম্ভ নেমে এসে দাঁড়িয়েছে (-)৫ ডিগ্রিতে । মাঝরাতে বরফ পড়েছিল । তবে মারাত্মক নয় । তাই টের পাইনি । পাতলা বরফের স্তর জমে আছে তাঁবুর মাথায় । বরফ জমে আছে ঝরনার কিনারায় নুড়িনাড়া পাথরের টুকরোর ওপর । বরফের ছোট ছোট ডেলা ভেসে যাচ্ছিল ঝরনার জলে ।
কুলিদের সাড়া শব্দ নেই । ওরা কী এখনও ঘুমচ্ছে ? হয়ত হবে । গত দিনের প্রচণ্ড পরিশ্রম । দোষ দেওয়া যায় না । আমাদের তাঁবুতে ঘুম ভেঙেছিল সবাইয়ের যথারীতি । সাজ সাজ ভাবও দেখলাম সবাইয়ের । তরুণ জাগিয়ে দিয়েছিল সকলকে । আজ সিংকা পাস অভিযান । তত্পরতার পারদ যেন একটু বেশি রকম উঠেছে আজ । কুলিদের দেখতে না পেয়ে রাজা, রবীনরা তাঁবু খোলার কাজে হাত লাগিয়েছিল । সকালের ব্রেকফাস্ট আজ অন্যরকম । গরম হরলিক্স গ্লাসে গ্লাসে । সেইসঙ্গে বিস্কুট । তরুণের নির্দেশ মত । হৈ-হৈ করে সকলে তরুণের জয়ধ্বনি দিয়েছিলাম ।
ধোয়া মোছা পরিষ্কার আকাশ । গাঢ় নীলের আভাস তার গায় । রোদ এসে পড়েছে গিরিখাতের এধার ওধার । জমে থাকা বরফ থেকে ধোঁয়া বার হচ্ছিল সব সময় । গ্লেসিয়ার জোন । ঠাণ্ডার একটা ঝাঁঝ বার হচ্ছিল নীচে থেকে ।
কুলিদের দল কখন যে বেরিয়ে পড়লো বুঝতে পারিনি । ওরা যেখানে কাল রাতে ছিল সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করেছে । নীচে আমাদের এখানে আর আসেনি । সামনের পাহাড়ের দিকে চাইতেই চোখে পড়ে ওদের । আমরাও আর বসে থাকি না । উঠে পড়ি একে একে ।
রাজা, রবীন ওরাই দলের মহড়া নিয়েছিল । আমরা ওদের অনুসরণ করি । সামনের পাহাড়ের মাথায় উঠতে খুব একটা অসুবিধে হয়নি । সহজ কাজ ছিল । পাহাড়ের রিজ ধরে এগিয়ে যাওয়া । বেশ খানিকটা সেপথে এলাম । এরপর রিজ শেষ হল । পাহাড় থেকে নামার পালা । নামার পর সামনের পাহাড়ের মাথার দিকে চেয়ে চোখ দাঁড়িয়ে গেল । ঐ পাহাড়ের মাথায় নাকি সিংকা পাস । আমাদের ঈপ্সিত সিংকা অতিক্রম করে হিমাচল প্রদেশে প্রবেশ করা । কি হবে জানি না ।
কুলিরা দেরি করে না । তারা খারাপ মৌসম হবার সম্ভাবনার আগেই পাহাড়ের মাথায় উঠতে চায় । তাদের যুক্তিকে এতটুকু অবহেলা করা চলে না । আমরাও বাধ্য হই তাদের অনুগামী হতে ।
বিশ্রীরকম বোল্ডার জমে আছে চলার মুখে । ওঠা যেমন অসুবিধাজনক তেমনই কষ্টকর । সমস্ত উত্সাহ আর মনের জোর এক করে উঠতে শুরু করি । পুরোপুরি রক ক্লাইম্বিংয়ের ব্যাপার । চার হাত পায় ওঠা ছাড়া গত্যন্তর নেই । প্রথমেই দেখে নিতে হচ্ছে পাথরের চাঙড়ের চরিত্র কী । এরপর খুঁজে নিতে হচ্ছে পাথরের গায়ে ওঠার সুবিধাজনক পথ । তারপর কোন জায়গা ধরে প্রথম পা ফেলা চলে । এসব সুযোগ না পেলে মাথার রক্ত যেন গরম হয়ে ওঠে । কিংকর্তব্য বিমূঢ়ের মত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় । অথচ সময়ও নেই । উঠতেই হবে । সেইসময়েই করতে হয় হঠকারিতা । যদি ভালয় ভালয় ওঠা গেল তো ভাল, নইলে ঘটে দুর্ঘটনা । পাহাড়ে এ ঘটনা কত যে ঘটে যারা পাহাড়ে না এসেছে তারা ছাড়া কেউ বুঝতে পারবে না । অথচ বোলেও বোঝানো যাবে না কারুকে ।
|
বোল্ডার বেয়ে বেয়ে উঠছিলাম । কখনও বুক দিয়ে বেয়ে বেয়ে কখনও চার হাত পায় । আমার ট্রেকিং জীবনে এত কষ্টকর পাহাড় অভিযাত্রা আর হয়নি বলেই মনে হল ।
বিমলবাবুর কথা ভাবছিলাম । তরুণের কি অশেষ দুর্গতি হচ্ছে তাও মনে আসছিল । আসলে এমন চরিত্রের পাহাড় যে হবে এ আমরা কল্পনাও করিনি । তাই মনে হয় কেউই এপথে আগে আসেনি ।
একটার পর একটা হাম্প আসছিল । তাই ভেঙে ভেঙে ওঠা । এরপর আসে আবার হাম্প । তারও প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে । এ যেন আপোষহীন এক সংগ্রাম । হাম্পের পর হাম্প পার হয়ে এক জায়গায় এসে দাঁড়ালাম একটু বিশ্রাম নিতে । ওপরের দিকে চাই । বোঝা পিঠে কুলিদের দেখাচ্ছিল ঠিক যেন পুতুলের মত । পাথর টপকে টপকে তারা ওপরে উঠে যাচ্ছে কেমন অবলীলায় । কি সুন্দর তাদের গতির ছন্দ । পায়ে চলার কাজ যেন নিঁখুত । এতটুকু ভুলত্রুটি নেই । অথচ কী বা তারা পাচ্ছে ? সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর সামান্য কিছু পারিশ্রমিক । সংসারের তপ্ত খোলায় পড়তে না পড়তেই তা মুহূর্তেই ধরে যায় ।
পাহাড়ের নীচের জমাট বাঁধা বোল্ডারের তুলনায় ওপরে বোল্ডারের চাপ অনেক কম বলেই মনে হল । কিন্তু পাহাড়ের খাড়াই ঢাল দেখে শিউরে উঠি ! এবার বোধহয় সাধ্যে আমার কুলোবে না । তবু মরণপণ চেষ্টা করতে কসুর করি না । বুঝতে পারি না এ প্রতিদ্বন্দিতায় জিতবো কিনা । অনেক কসরৎ করে ঘন্টাখানেক ধরে প্রচণ্ড পরিশ্রমের ফলশ্রুতি কিন্তু পেয়েছিলাম শেষ পর্যন্ত । পাহাড়ের সামনের এক রিজের মাথায় এসে উপস্থিত হই । এই অংশকে রিজ বললে ভুল বলা হবে, বরং বলা চলে ঝুলন্ত এক পাথরখণ্ড যা পাহাড়ের গা থেকে বেরিয়ে এসেছে ।
পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে যাই । মনে হল, নতুন এক রাজ্যে এসে পৌঁছেছি । সামনের টানা রিজের ওপারে হিমাচলের অনেকগুলো বরফশৃঙ্গ একসঙ্গে ঝলমলিয়ে ওঠে চোখের ওপর । রিজের সারা মাথাটা সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা । সামনে পেছনে দুপাশে যেদিকেই চাইছি শুধু অসংখ্য ছোটবড় শৃঙ্গ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে । কারো মাথা বরফে মোড়া আবার কারো বরফশূন্য । একছড়া সাদা-কালো শৃঙ্গমালা যেন গাঁথা হয়ে আছে আকাশের নীচে । এক দৃষ্টে চেয়ে থাকি অনেকক্ষণ ।
রিজের ওপর হঠাৎ নজর দিতেই মনে হল কুলিরা নজরছাড়া হয়ে গেছে । তবে কী ওরা পৌঁছে গেলো মাথায় ? হয়ত হবে । রাজা, রবীনের চিত্কার শুনতে পাচ্ছি নীচে দাঁড়িয়ে । ছটফট করি বাকি অংশটুকু উঠতে । কিন্তু না, অসম্ভব খাড়াই ঢাল । সাহস হচ্ছিল না পাথরের গায় পা দিতে । চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি । ভয় পাচ্ছিলাম । -- "সিংকা কল তো আ গিয়া বাবুসাব । উঠিয়ে উঠিয়ে জলদি উঠিয়ে উপর ।" কুন্দন সিংয়ের গলা পাচ্ছি নীচে থেকে । ওরা এসে পড়েছে । যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সে এমনই যে ওপর থেকে নীচে কিছুই দেখা যায় না । শুধু কথাগুলো শুনতে পাই ।
--"পারছি না কুন্দন সিংজী, ভীষণ খাড়াই । জলদি এসো ।" চিত্কার করে বলি ।
শেষপর্যন্ত তারই সহায়তায় রিজের মাথায় সেদিন উঠেছিলাম । মানচিত্রের সেই হিজিবিজি রেখাঙ্কনের সেই ছোট বিন্দুতে এসে পৌঁছেছি । উত্তর পশ্চিম গাড়োয়াল হিমালয়ের মানচিত্রের গায়ে আঁকা সেই ছোট্ট একটি বিন্দু সিংকা পাস । সারা বিস্তৃতি জুড়ে ধবধবে বরফ । যেদিকে চাই বরফের পাতা বিছানা । কোথাও উঠেছে কোথাও নেমেছে ঢেউয়ের মত । কোথাও রাশি রাশি পাথরের টুকরো ঢিবির মত জমে আছে বরফের আস্তরণে । আবার অনেক পাথরের ঢিবির মাথা জেগে আছে বরফশূন্য অবস্থায় ।
|
এক এক করে সকলে এসে পৌঁছলো রিজের মাথায় । বিমলবাবুকে টেনে তুলেছিল তরুণ ও মূর্তিরাম । অসম্ভব পরিশ্রম ও বিপদের ঝুঁকি নিয়ে তাদের একাজ করতে হয়েছে, তরুণের মুখে যা শুনলাম । জানি কি দু:সহ কাজ পাহাড়ের এই মারাত্মক বিপজ্জনক দেওয়ালে ওঠা আবার তার ওপর কাউকে হাতধরে ওপরে নিয়ে আসা । অসীম ধৈর্য ও কষ্টসহিষ্ণু না হলে একাজ কেউ করতে পারে না । মনে মনে তরুণকে অশেষ ধন্যবাদ দিই ।
বিমলবাবুর মুখের দিকে চাইতে পারছিলাম না । তবুও কষ্ট কিছু হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি মুখ ক্লান্তিতে বিকৃত করে বললেন, "আমি ভাবতে পারিনি পায়েহাঁটা পথ এমন হতে পারে । আমার তো মনে হয় এ-পথ রক ক্লাইম্বিংয়ের । সেসবের ব্যবস্থা আমাদের কোথায় ?" কথাটা বিমলবাবু যা বলেছেন একাবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না তবে পায়েহাঁটা পাহাড়ের সব পথই তো পিণ্ডারীর মত `ট্রেকার্স প্যারাডাইস' হয় না । এক এক জায়গার এক এক রূপ । অনেকের কাছে খুব একটা অস্বস্তিকর নয় আবার অনেকের কাছে রীতিমত অগম্য ।
ছেলেদের আনন্দের সীমা নেই । বিশেষ করে রাজা, রবীন, পার্থের । বরফের ওপর রাজা পার্থের হাত ধরাধরি করে নাচ শুরু হল । সুধাংশুর গলায় রবীন্দ্র সঙ্গীত সে মুহূর্তটুকুকে একাবারে সুরময় করে তুলেছিল ।
বরফের গাদার মধ্যে এসে পড়লাম আমরা । প্রায় হাঁটু-ডোবা বরফ ঠেলে ঠেলে এগিয়ে যাই রিজের চড়াই অংশের দিকে । মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে বড় বড় পাথরের ঢিবি । জেগে আছে বরফের ওপর মাথা তুলে । পায়ের তলায় বরফের শুধু মচমচ শব্দ । বরফ মাড়িয়ে মাড়িয়ে সামনের চড়াই ভাঙি । চোখের ওপর হঠাৎ ঝলমলিয়ে ওঠে সিংকা পাসের মাথা । মনে হল যেন স্ফটিকের একখানা সিংহাসন পাতা রয়েছে সেখানে । দুধসাদা বরফে ঢাকা চারদিক । নীল আকাশের নীচে সোনার রোদের ফেনা বসে যাচ্ছিল তার গায় । বরফের হাল্কা ঢাল কোথায় নেমে গেছে নীচে কোথাও উঠেছে । মাঝে মাঝে নজরে পড়ছে বরফের ছোটবড় কুণ্ড বা ডিপ্রেসান । বড় সুন্দর লাগছিল সারা পরিবেশটা ।
|
সিংকার সবচেয়ে উঁচু জায়গায় এসে দাঁড়ালাম আমরা । দূরে চেয়ে দেখি, সামনে গাড়োয়ালের অঙ্গভূমি, পিছনে হিমাচলের সীমারেখা । তারই সন্ধিস্থলে সবাই আমরা দাঁড়িয়ে । ঘড়িতে তখন বেলা এগারোটা । মনে মনে কেমন একটা গর্ব অনুভব করি । এত কষ্ট, এত পরিশ্রমের পর এই সাফল্য এতো আমার একার নয়, এতো সকলের । সকলেই এর অংশীদার । জানি না সংস্থাগত কোনও পদযাত্রীর পায়ের স্পর্শ এখানে ইতিপূর্বে ঘটেছে কিনা-- তবু ভেবেছি এ যাত্রাপথ আমাদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন এবং আমরাই সম্ভবত এপথে প্রথম । তরুণ লাঠির আগায় দলের পতাকা পুঁতে দেয় বরফের মধ্যে । সংস্থার ফেসটুন সবাই হাতে হাতে ধরাধরি করে দাঁড়াই । সুধাংশু, রবীনের ক্যামেরার সাটার টেপার শব্দ ওঠে মুহূর্মুহূ । রাজা শুকনো ব্রহ্মকমল পকেট থেকে বার করে ছড়িয়ে দেয় । স্বপন ধূপ জ্বালিয়ে দেয় এক গোছা । টফি, লজেন্স ছড়িয়ে দিল নীলাদ্রি । মূর্তিরাম, কুন্দন সিংয়ের কথামত পাঁচটি কয়েন মুদ্রা বরফের মধ্যে রেখে দিয়ে আসা হল ।
শিখর বিজয়ের আনুষ্ঠানিক পর্বের পর রাজা ও রবীনের আবার নৃত্যপর্ব শুরু হল । রাজা বরফের বিশাল ঢালে শুয়ে পড়ে কেমন সড়সড় করে নেমে যায় অনেকখানি । রবীন তাল তাল বরফ তুলে নিয়ে বল তৈরি করে ছোঁড়াছুড়ি শুরু করে । শীর্ষবিজয়ের আনন্দে এত কষ্টের পরও চোখে জল এসেছিল ।
এবার নামার পালা ওপারে । হিমাচল প্রদেশের অংশে । অপেক্ষা করার কোনও উপায় নেই । আকাশের ওপর কোনও ভরসাও নেই । যেকোন মুহূর্তে যেকোন ঘটনা ঘটতে পারে । রিজের শেষাংশ থেকে পাহাড়ের দেওয়াল ধরে নেমে যেতে হবে ওপ্রান্তে হিমাচলের মাটিতে । মূর্তিরাম তাড়া দিচ্ছিল । কুলিরা উঠে পড়লো এক এক করে । আমরা পাসের শীর্ষাংশ থেকে নেমে আসি । বরফ ভেঙে ভেঙে পাসের শেষপ্রান্তে । ওপারে দিগন্তের গায় কিন্নর কৈলাসের চালচিত্রখানা জ্বল জ্বল করছিল । দেখে চোখ ঝলসে ওঠে । একটু দাঁড়িয়ে দেখার সামান্যতম অবকাশটুকু নেই । তরুণ, মূর্তিরাম এদের অস্থিরতায় আমরাও সন্ত্রস্ত হয়ে উঠি ।
রিজের শেষপ্রান্তে এসে পাহাড়ের এপ্রান্তের ঢাল দেখে নিশ্চুপ হয়ে যাই । কপালের শিরাগুলো দপদপ করে ওঠে । পাহাড়ের এ দিকের দেওয়াল ধরে নীচে নামতে হবে । ৮০ডিগ্রী - ৮৫ডিগ্রী মত ঢাল । কীভাবে নামা সম্ভব ? মুখের দিকে পরস্পর শুধু চেয়ে থাকি । কুলিরাও দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে ।
মূর্তিরাম কেবলই রিজের ধার ধরে ছোটাছুটি করছিল । খুঁজে খুঁজে সে দেখছিল ঢালের কোন অংশ দিয়ে নেমে যাওয়া সহজ হবে । এরপর কুলিদের সঙ্গে করে সে ঘুরে ঘুরে দেখে বেড়ালো সব । রোপের কথা তুললো বিমলবাবু । কিন্তু রোপের সাজসরঞ্জাম কোথায় ? সে তো কিছুই নেই । নাইলনের কয়েকগাছা দড়ি শুধু পড়ে আছে পিট্টুর মধ্যে । সব থেকে বড় কথা রোপিং করার ট্রেনিংও কারো জানা নেই । তার পদ্ধতি, কৌশল ও সবার অজ্ঞাত ।
বেলা বেড়ে চলেছে । সেই সঙ্গে অস্থিরতাও । মূর্তিরাম কুলিদের নিয়ে কত কীসব পরামর্শ করে । এরপর দেখা গেল একজন বেশ স্বাস্থ্যবান যুবক কুলি পাহাড়ের কিনারায় এসে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করেছে । পাহাড়ের গায় বেরিয়ে আসা পাথরের অংশ ধরে ধরে একসময় নীচে সে নেমে পড়লো । ওপর থেকে আমরা আনন্দে হৈ হৈ করে চিত্কার করে উঠি হাততালি দিয়ে । এরপর আর দেরি হয়নি । আর একজন কুলিও পাহাড়ের দেওয়াল ধরে নামতে শুরু করে । খানিক পরে নীচে থেকে দু'জন কুলির কান ফাটানো চিত্কার ওপরে আসে । তারা জানায় আরও পশ্চিমে সকলে যেন সরে যায় । ওখানে ঢাল অনেক বেশি । নামা কিছুটা সহজ হবে ।
কুলির নির্দেশ মত আমরা সকলে মালপত্র নিয়ে রিজের পশ্চিম দিকে আরও সরে যাই কিছুটা । রাজা ও রবীন প্রথমেই নেমে পড়লো । পাহাড়ের গায়ে ঝুলন্ত বার হওয়া পাথর ধরে ধরে ওরা নেমে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি । ওদের চিত্কার কানে আসতেই বুঝতে অসুবিধা হয় না ওরা পৌঁছে গেছে নীচে । আমিও রিজের কিনারায় এগিয়ে যাই । তরুণ চিত্কার করে বলে ওঠে, "অমরদা একা নামবেন না, একজন কুলি সঙ্গে নেন ।" তরুণের চিত্কারে থতমত খেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি । শেষে সেই এসে একজন কুলিকে আমার সঙ্গে দেয় । কুলির কথা মত তার এক হাত শক্ত করে ধরে আমিও পাথরের ঢালে পা দিই । রুক্ষ পাথর । পাহাড়ের গা যেন ক্ষতবিক্ষত । তারই গা থেকে মাঝে মাঝে বার হওয়া পাথর ঝুলছিল ঠিক জিভের মত । এক হাতে কুলিকে ধরি অন্য হাতে পাথর ধরি । মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে নামা । একটু অসাবধানতায় যেকোনও মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে । দম যেন বন্ধ হয়ে আসে । কুলি কেবলই বলছিল, "বাবুজী, পাহাড়ের দিকে শরীরের চাপ রাখুন । এবার সামনের পাথর ধরুন, নীচের পাথরে পা রাখুন । ধীরে ধীরে, জলদি মৎ করুন ।" আমি নিশ্চুপ । কথাগুলো যেন মাথায় ঢুকছিল না । কেবলই ভাবছিলাম পাথর যদি খসে পড়ে পায়ের তলার । এযেন মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত ! আমার মাথার ওপর কুলি আর তার হাত ধরে ঠিক ঝুলন্ত অবস্থায় নামছিলাম । সারা শরীরের রক্ত মনে হল যেন মাথায় এসে উঠেছে । কতক্ষণ এভাবে কেটেছিল জানি না কুলির কথায় সম্বিৎ ফিরে পাই, --"হাত ছাড়ুন বাবুজী, নীচে এসে গেছেন ।" মনে হল স্বপ্নের ঘোরে আচ্ছন্ন ছিলাম এতক্ষণ । এরপরই হল হঠাৎ যেন স্বপ্নভঙ্গ !
চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি নীচে । পায়ের তলায়ও দেখছি বরফ । পাহাড়ের গা ধরে ধরে নেমে এল স্বপন, সুধাংশু, পার্থ । কুন্দনের হাত ধরে নিলাদ্রীও । মূর্তিরাম আর তরুণ বিমলবাবুকে নামিয়ে এনেছিল ।
নীচে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে পাহাড়ের এপিঠের দেওয়ালের দিকে চেয়ে থাকি । রুক্ষ, ক্ষত-বিক্ষত পাহাড়ের গা । যেন হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে । চারশো ফুটের মত উঁচু হবে । দেখলেই কেমন একটা ভয়ঙ্কর বীভত্স ভাব মনের মধ্যে জেগে ওঠে ।
নেমে আসার জয়োল্লাস বড় কম হয়নি সেদিন । রাজাতো বিমলবাবুকে কাঁধে তুলে নাচতে শুরু করেছিল । সম্ভাব্য একটা দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়ানো যে সম্ভব হয়েছে তার জন্যে কুলিদের ও তরুণকে মনে মনে অভিনন্দন না জানিয়ে পারিনি ।
রোদের চিহ্ন নেই গিরিগহ্বরের মধ্যে । দুপাশের পাহাড় মাথা তুলেছে আকাশ ছুঁয়ে । রোদের প্রবেশ যে এখানে নিষিদ্ধ তা বেশ বোঝা গেল জায়গাটা দেখেই । কেমন অন্ধকার, ভিজে ভিজে স্যাঁত্সেঁতে ।
সিংকা শিখর জয়ের আনন্দে মন দশ হাত হয়ে গেছে । এবার উর্দ্ধমুখী হয়ে ছুটেছি । কিন্তু ছুটবো কোথায় ? সামনে বিশাল বরফের খাত । তার ওপর জমাট বরফের স্তর । তাই ভেঙে পথ করে যাওয়া । মধ্যে মধ্যে বরফের ফাটল হাঁ করে আছে । বীভত্স ক্রিভাস । একটু অসাবধানতায় দুর্ঘটনা ঘটা বিচিত্র নয় । সমস্ত জায়গা জুড়ে হিমবাহ অঞ্চল । দেখে দেখে পা ফেলে চলি । পাহাড়ের অলিগলি দিয়ে যেটুকু রোদ চুঁইয়ে এসে পড়েছিল সেখানে বরফ গলে গলে যাচ্ছিল । ধোঁয়াও বার হচ্ছিল সব সময় সেখান থেকে । অসম্ভব কনকনে ঠাণ্ডা মতন জায়গাটা ।
এগিয়ে চলি । সারা অঞ্চল জুড়ে বরফ আর বরফ । এরপর এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছলাম সে যেন এক বরফের মাঠ । ধূ ধূ করছে । মনে হল সাদা দুধের সর পড়েছে সারা মাঠে । বিস্তৃর্ণ বরফ ভূমির নাম `বাঙ্গিবামক' । এই বরফের রাজ্য পার হলেই নাকি মিলবে ঘাসের রাজ্যপাট । মূর্তিরাম বলেছিল ।
নরম বরফের ওপর সরু পায়ে চলা পথ তৈরি হয়েছে কুলিদের পায়ে পায়ে । তাই ধরে এগিয়ে চলা । বরফের যেন শেষ নেই । এক সময় চলতে চলতে চোখে পড়লো মাঠ ঢালু হয়ে নীচে নেমে গেছে । দুপাশের আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ও দূরে সরে গেছে । সামনে এসেছে বিশাল প্রশস্ত বিস্তৃতি ।
বিকালের হাল্কা হলুদ রোদ এসে পড়েছে বরফের ওপর । ক্লান্তিতে যদিও পা আর চলছিল না তবুও চলার গতিতে স্বচ্ছন্দ এসেছিল । একসময় বরফের সীমা শেষ হল । ভাবলাম কষ্টেরও বুঝি এবার শেষ হল । কিন্তু হায় ! কপাল মন্দ । কষ্টের শেষ বুঝি নেই এই হিমালয়ের পাহাড়ে প্রান্তরে । আবার শুরু হল সেই বোল্ডার । সেই রুক্ষ, অমসৃণ কয়লার মত কালো পাথরের চাঙড় । হাম্পের পর হাম্প । আবার অতিক্রম করা । ভেঙে ভেঙে চলা একের পর এক চাঙড় । অসম্ভব কষ্টকর কাজ । কেবল ওঠানামা । একঘেয়েমির একশেষ ।
একসময় পাথুরে বোল্ডারের চড়াই শেষ হয়ে আসছে বলে মনে হল । গড়িয়ে যাওয়া ঢাল ধরে নামতে থাকি । ঘন সবুজ টুকরো টুকরো ঘাসের মাঠ চোখে পড়তে শুরু করে । হঠাৎ সবুজের এ বর্ণালীতে চোখ জুড়িয়ে যায় । গত দুদিনে পাথরের অসহ্য রুক্ষতায় চোখ দুটো শুকিয়ে গিয়েছিল । এখন সবুজের নরম প্রলেপে চোখ দুটো মাখামাখি হয়ে গেল । সারা মনে আসে কেমন এক প্রশান্তির অনুভূতি !
পাহাড়ের মাথার বরফগলা জল নেমে এসেছে নীচে । নানা শাখায়, নানা ধারায় জাল বিস্তার করে বয়ে যাচ্ছে । মাটি ভিজে যাচ্ছিল । কাদাও হয়ে গেছে কোথাও কোথাও । তবুও চলতে ভাল লাগছিল । একটা স্নিগ্ধ আমেজ এসে মিশেছে এখানের পরিমণ্ডলে ।
পথের ধারে কেমন অদ্ভুত গোলাকার এক পাহাড় চোখে পড়লো । নীচে নাকি আছে তার বরফের স্তর । হিমবাহ । তারই তলা দিয়ে বরফগলা জল ঝরনা হয়ে নেমে আসছে নীচে । এই জলধারা মিলেমিশে একাকার হয়ে নালার রূপ নিয়ে আরও নীচে নেমে এসে উপত্যকার মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে । নাম তার শোনেগরাণ নালা । শোনেগরাণ উপত্যকা থেকে নালার এই নামকরণ হয়েছে । মূর্তিরাম এসব গল্প করে বলতে বলতে চলে । শোনেগরাণ নালা একসময় গড়াতে গড়াতে গিয়ে মিশেছে হিমাচলের বসপা নদীতে ।
শোনেগরাণ উপত্যকাকে বুগিয়ালও বলা চলে । তবে সুপিন উপত্যকার মত অত ঘন লম্বা ঘাসের মাঠ নয় এ-উপত্যকা । গাঢ় সবুজ কচি ঘাসে ভরা মাঠ । ঘাস খুবই ছোট ছোট । ভেড়ার পাল দল দল চরে বেড়াচ্ছে । মাঝে মধ্যে দু'চার খানা ঝুপড়িও চোখে পড়লো । মেষপালকদের ।
সন্ধ্যার আমেজ । ঘাসের মাঠে একটু বসে বিশ্রাম নিতে ভীষণ ভাল লাগছিল । বসেও ছিলাম । তরুণ সকলকে জানিয়ে দিল কেরোসিনের ভাঁড়ার শূন্য । তাই রান্নার কাঠ যেখানে মিলবে সেখানেই পড়বে আজ তাঁবু । কাঠ না পেলে উনোন জ্বলবে না । অতএব আজ সারারাত অভূক্ত থাকতে হবে ।
কুলিদের দেখাসাক্ষাত নেই । তারা কোথায় কে জানে ? কত দূরই বা হাঁটতে হবে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না । এদিকে বনজঙ্গলই বা কোথায় ? কাঠও বা মিলবে কি করে ?
|
শোনেগরাণ উপত্যকার মধ্যে দিয়ে চলেছি । ফালি ফালি ঘাসের মাঠ পথের দুপাশে । মাঠ ঢালু হয়ে নেমে গেছে শোনেগরাণ নালার ধার পর্যন্ত । সুন্দর তাঁবু ফেলা যায় যেকোনও জায়গায় । পাথরের টুকরো সাজিয়ে মাঠের এখানে ওখানে বৃত্ত তৈরি করে রেখেছে গুজররা । ওদের নিজের নিজের ঝুপড়ি বানাবার স্থান নির্বাচন করে রাখা । সেখানে অন্য কেউ আর ঝুপড়ি বানাতে পারবে না । জায়গা দখল নেওয়া আর কি ।
সূর্য অস্ত গেছে । সন্ধ্যা হয় হয় । মাঠ ভেঙে যেতে যেতে কেবলই চোখের ওপর দুলছিল কিন্নর কৈলাসের চালচিত্রখানা । সূর্যাস্তের রক্তিম আভায় লাল হয়ে উঠেছে স্ফটিকশুভ্র শিখর ।
একপাল ভেড়া তখনও চরে বেড়াচ্ছিল মাঠে । গলায় চামড়ার বগলোশ পরা দুটো বিরাট আকারের কুকুরও ঘোরাঘুরি করছিল সেই দলে । পাহারাদারের কাজ করছিল । মাঠের বাঁক পার হতেই হঠাৎ চোখে পড়ে দূরে ব্যাঙের ছাতার মতো পরপর কয়েকটা সাদা ধবধবে তাঁবু খাটান রয়েছে । অবাক হয়ে যাই । ভাবি, এ জনবিরল প্রান্তে তাঁবু ফেললো কারা ? কাছে আসি । জানি, জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইণ্ডিয়ার এক পার্টি হিমবাহ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ এখানে নিতে এসেছিলেন । আজই দুপুরে তাঁরা ফিরে গেছেন নীচে মাস্তারা গ্রামের বেসক্যাম্পে । দলের ডিরেক্টর ও অন্যান্য প্রশিক্ষকমণ্ডলীও । তাই অনেকগুলো তাঁবু এখন খালি পড়ে আছে এখানে । দলের এক জিওলজিষ্ট পাঞ্জাবী ভদ্রলোক খুব অভ্যর্থনা, আপ্যায়ন করলেন আমাদের । তিনি আমাদের আসার ঘটনা শুনে অবাক হয়ে গেলেন । বললেন রোপিং না করে কী করে এলেন ওপথে ? খুবই রিস্ক নিয়েছেন । ভাল করেননি । অত্যন্ত মারাত্মক পথ । তাঁর আপ্যায়নের তুলনা ছিল না । আমাদের তাঁবু খাটাতে বারণ করলেন, বললেন, এসব ফাঁকা তাঁবুতে বেশ থাকতে পারবেন । কেরোসিন তেল ফুরিয়ে গেছে শুনে এক জারিকেন ভর্তি তেল দিলেন আমাদের । বললেন, ধীরেসুস্থে এখানে রান্নাবান্না করুন । কাল আমাদের ডিরেক্টর সাহেবের সঙ্গে দেখা হবেই আপনাদের মাস্তারা বেস ক্যাম্পে । খুব ভাল লোক তিনি । আপনাদের এই রক এক্সপিডিশন আর সেইসঙ্গে ভিলেজ সার্ভের কথা শুনলে তিনি খুবই খুশি হবেন ।
কয়েক বোঝা শুকনো গাছের ডালপালা ভেঙে নিয়ে এসে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল কুলিরা । সন্ধ্যার অন্ধকার নামছিল চারদিকের পাহাড়ের মাথা ঘিরে । ক্যাম্পে পেট্রোম্যাক্স জ্বালা হয়েছিল ইতিমধ্যেই । সরকারি ব্যবস্থাপনা । এদের কেতাই আলাদা ।
বিমলবাবু এসেই তাঁবুতে ঢুকে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন । বেচারা ভদ্রলোক আসা ইস্তক শারীরিক দিক থেকে কাবু হয়ে পড়েছিলেন । সুকৃতি একটাই । বিঘ্ন ঘটাননি তিনি পথে । বিবেচনাশীল মানুষ তিনি ।
রেশনের অবস্থা যে সঙ্গীন হয়ে এসেছে স্বপনের মুখ দেখে তা বুঝতে পারি । চাল, ডালই এখন তলানিতে এসে পৌঁছেছে । স্বপনের সঠিক হিসাবেই যে এতদিন ঠিকঠিক চলেছে সে শুধু তার এ-ব্যাপারে দক্ষতার জন্যে । নাহলে ইতিমধ্যেই পেটে দড়ি বাঁধতে হত ।
কফি, ডালমুট আর চানাচুর দিয়ে পাঞ্জাবী ভদ্রলোককে আপ্যায়ন করা হল সান্ধ্য মজলিশে । ভদ্রলোক অভিভূত হয়েছিলেন । কথায় কথায় এসব অঞ্চলের কথা তুললেন । এসব জায়গা হল গ্লেসিয়াল জোন । হিমালয়ের অন্ত:পুরে হিমবাহের বর্তমান অবস্থা কেমন তা পরীক্ষানিরীক্ষা করার জন্যে আমাদের নানা প্রান্তে যেতে আসতে হয় । এবং সমীক্ষা করতে হয় । হিমবাহ সমন্ধে এই বিভাগের শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় । হিমবাহের উত্পত্তি, গতি, বয়স, আকার, অবস্থান, ঘনত্ব, স্থায়িত্ব এইসব বিষয়ে অনেক কিছু জানবার ও শেখবার আছে নানা পরীক্ষার মাধ্যমে । এই সব প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে আমাদের হিমালয়ের নানা অঞ্চলে যেতে হয়, ক্যাম্প করতে হয় । সঙ্গে শিক্ষার্থীরা থাকেন । রহস্যময় হিমালয়ের অনেক রহস্যের কথা ভদ্রলোক সে রাতে বলেছিলেন । এসব কাজে কত বিপদ ও দুর্ঘটনার মুখে পড়েছিলেন সেসবেরও অনেক কাহিনী শোনালেন তিনি ।
রাত হয়ে আসছিল । ভদ্রলোক আমাদের কাছ থেকে বিদায় চেয়ে নিয়ে তাঁর ক্যাম্পে গিয়ে ঢোকেন । তরুণ, মূর্তিরাম হিসাবনিকাশে বসেছে । সাংলায় আগামীকাল যাওয়া । কুলিদের মজুরিপর্ব চোকাতে হবে সেখানে, সেই সঙ্গে বিদায় পর্বও । তাই তাদের হিসাবের অঙ্ক কষা হচ্ছিল ।
রাতের ভোজনপর্ব প্রস্তুত সেকথা জানিয়ে গেল স্বপন । আমরাও প্রস্তুত সেকথা সানন্দে জানাই । স্বাদহীন, উপকরণহীন থালাভর্তি সিদ্ধ চাল ডালের শুধুই সরলীকরণ, আমরা নি:শেষ করেছিলাম তৃপ্তির সঙ্গে । কোনও খেদ ছিল না মনে । উপাদেয় সেবস্তুর দুর্লভতা এখানে যে কত তার কড়ায়ক্রান্তির হিসাবনিকাশ আমরা করতে পারি না । এবং তা সে করবো কোন সূত্র ধরে ? শুধু নিশ্চিন্ত হওয়া মুখটি মুছে ।
তাঁবুর অভাব নেই । হাত-পা ছড়িয়ে শোবার আশায় যে যার মত ঢুকে পড়েছিল তাঁবুতে । বিশাল বিশাল তাঁবু । এসব ক্ষেত্রে সরকারী বিধি, ব্যবস্থাপনা কত পরিপাটি । এসব প্রকল্প উদ্যোগ, পরিকল্পনার অর্থনৈতিক দিক ও বহর বেশ চোখে পড়বার মত ।
সারা শরীর গরম র্যাপারে ঢেকে বাইরে এসে দাঁড়াই । চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছিল চারদিক । সুদূর দিগন্ত -- নির্জন, শান্ত, উদাস । ঘুমিয়ে পড়েছে প্রকৃতি । নিমগ্ন নির্লিপ্ততায় । অনন্ত অবকাশ তার । জেগে আছি । ভাল লাগছিল এই নির্জনতা এই নৈ:শব্দ । চেয়ে থাকি দূরে । আকাশের নীচে সারি সারি পাহাড় । মনে হয় যেন দৈত্যদলের মিছিল । নি:শব্দ রাত । শুধু কানে আসে শোনেগরাণ নদীর অশান্ত জল কল্লোল ।
রাত গভীরে নামে । তাঁবুতে ফিরে আসি ।
[ক্রমশ:]
(পরবাস, ডিসেম্বর, ২০০৪)