• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৫ | মে ২০০৫ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • সিংকা পেরিয়ে কিন্নরে : অমরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

    ॥ ৯ ॥


    শোনেগরাণ উপত্যকায় সেদিনের রাত নির্বিঘ্নে কেটেছিল ।
    নিশ্চিন্ত, নি:শঙ্ক মন হয়েছিল পালকের মত হাল্কা । তাই মনে হয় ঘুমের কোনও ব্যাঘাত ঘটেনি রাতে ।

    আজ হিমাচলের বসপা উপত্যকায় যাব । ওখানেই হবে আমাদের যাত্রার শেষ । এতদিনের অজানা দুর্ভাবনার, কষ্টের হবে পরিসমাপ্তি ।

    জিওলজিস্ট পাঞ্জাবী ভদ্রলোক সকালে আমাদের চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন । সানন্দে সকলে সে-আমন্ত্রণ রক্ষা করেছিলাম । তিনি বারবার আমাদের বললেন, আমরা যেন গ্লেসিওলজি ডিভিসনের ডিরেকটর মি: ডি. এম. কে. পুরির সঙ্গে দেখা করি মাস্তারা গ্রামের বেসক্যাম্পে । তিনি আমাদের পেলে ভারি খুশি হবেন । আমরা তাঁকে আশ্বস্থ করি । বলি, অবশ্যই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করবো ।

    তাঁবু খোলার পাট আজ ছিল না । সকালের চা-পর্ব থেকে স্বপনও অব্যাহতি পেয়েছিল । মালপত্রের ভাঁড়ারও কমে এসেছে । তাই আজ বার হতে খুব একটা দেরি হয়নি ।

    তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন দীর্ঘদেহী পাঞ্জাবী ভদ্রলোক । হাত দু'খানা ধরে বিদায় নিয়ে এসেছিলাম তাঁর কাছ থেকে । যাত্রাপথ শুভ হোক ইঙ্গিত জানিয়ে তিনি বারবার হাত নেড়ে আমাদের বিদায় জানালেন ।

    পাহাড়ের মাথায় সূর্য । সকালের রোদে নরম স্নিগ্ধতা । উপত্যকার বুক চিরে শাড়ির পাড়ের মত সরু পথ । ভেড়া, ছাগল, গুজরদের পায়ে পায়ে তৈরি । পথ কখন লাফিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছিল আবার কখনও নীচে নেমে যাচ্ছিল পাহাড়ি পথের স্বাভাবিক চরিত্রের মত । পথের পাশেই দুর্বার শোনেগরাণ নালা । জলের একটানা সুর সব সময়ই কানে বাজছিল । রাস্তার পাশে ছোটখাট ঝোপঝাড় । এতক্ষণ পর্যন্ত ছিল রুক্ষ পাথরের রাজত্ব । ঘাসের সবুজ মাঠ অনেক আগেই শেষ ।

    পথের দূরত্বের পরিমাপ করতে পারি না । শুধু সময়ের কাঁটা মিলিয়ে মিলিয়ে অনুমান করে নিই । চলার ছন্দে আজ এসেছে সাবলীল গতি । গতকালের বিমলবাবুকে আজ যেন চেনাই যায় না । তাঁর দু'পায়ের বেড়ি কে যেন আজ খুলে দিয়েছে । ভয়ে, আতঙ্কে শুকিয়ে যাওয়া এতটুকু মুখ আজ প্রশান্তিতে মাখা । নীলাদ্রিরও তাই । তারও পায়ে গতির উন্মাদনা । ভাল লাগছিল দেখতে ।

    পেছনে ফেলে এসেছি অনেক পথ । বেলাও বেড়ে চলেছে । বড় বড় গাছপালার মাথা চোখে পড়ছে ত্রক্রমশই । কাছে আসি । বন-জঙ্গলের ঘনত্ব বেড়ে যায় । সেই সঙ্গে বেড়ে যায় জায়গার পরিসর ও বিস্তৃতি ।

    পাইনের জঙ্গল শুরু হল । অতি প্রাচীন বনস্পতি । গায়ে গায়ে জটলা করে দাঁড়িয়ে । গাছের তলা ঘন অন্ধকার । রোদের প্রবেশ অধিকার নেই । ঝরা পাইন পাতায় আচ্ছন্ন বনভূমি । পায়ের তলায় লাগে কেমন এক নরম অনুভূতি । মাড়িয়ে মাড়িয়ে চলি ।

    পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে মস্ত এক পাথরখণ্ড । দুপাশ দিয়ে যাবার উপায় নেই । পাথরের মধ্যে দিয়েই পথ । সঙ্কীর্ণ টানেল বা সুড়ঙ্গ । ভিতরে ঢুকতে কেমন একটু ভয় ভয় করে প্রথমটা । তবুও ঢুকে পড়ি । ছোট্ট সুড়ঙ্গ, দীর্ঘ নয় । সুড়ঙ্গের এ-মুখ থেকে গাছপালার গভীরতা আরও বাড়তে থাকে । হাজারো পাখির কলরব । নিস্তব্ধ বনভূমির ঘুম ভাঙাচ্ছিল ওরা । কিছুক্ষণ চলার পর বন কমে আসে । তারপরই দেখা যায় বিশাল এক প্রান্তর জুড়ে খুবই প্রাচীন পাইন গাছের সমাবেশ । দেখে মনে হল, যেন পরিচ্ছন্ন, সাজানো এক পাইন কুঞ্জ । চোখ জুড়িয়ে যায় । শন শন করে একটা শব্দ সারাক্ষণ কানে আসছিল । হাওয়ায় পাইন পাতার সুর উঠছিল । বনের তলা ছায়া-ছায়া । চলতে চলতে রবীনের গলা পাই, "মাস্তারাং গ্রামে আমরা পৌঁছেছি ।" সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠি, "কি করে বুঝলে ?" রবীন হাত তুলে দেখায় অদূরে পাইনগাছের তলায় অনেকখানি জায়গা জুড়ে বেশ বড় বড় কয়েকটা তাঁবু খাটানো রয়েছে দুধসাদা রঙের । বেসক্যাম্প তাহলে এখানে পড়েছে ।

    ক্যাম্পের সামনে আসতেই চোখে পড়ে বিরাট এক ফেস্টুন । দড়ি দিয়ে গাছের সঙ্গে বাঁধা । তাতে লেখা : মশছঠত্রঠত্রভ ঙছস্‌ংঋ ষ্ণত্ছযযঠধত্ধভষ্‌ ঈঠটঠযঠধত্র ব্ধশঞচ্‌ংশত্র ওংভঠধত্র ষ্ণংঅ.ঝ. ত্ণ্ণবূত্রধগ. ট্রেনিং ক্যাম্পের সামনে খানকতক ফোল্ডিং চেয়ার পাতা । তাতে কয়েকজন, মনে হল অফিসার পর্যায়ের ভদ্রলোক বসে পরস্পর কথাবার্তা বলছিলেন । এই অবস্থায় আমাদের বিরাট দলবল দেখেই তাঁরা যেন চমকে উঠলেন ! চেয়ার ছেড়ে সঙ্গে সঙ্গে উঠে প্রবীণ অফিসার ভদ্রলোক আমাদের সকলের সঙ্গে হাতে হাত মেলালেন । আর-এক অফিসার ভদ্রলোক ক্যাম্পের ভিতর থেকে আরও কয়েকখানা চেয়ার টেনে এনে পেতে দিয়ে বসতে বললেন । প্রবীণ অফিসার ভদ্রলোক কোথা থেকে এই সব দলবল নিয়ে প্রশ্ন করতেই তরুণ বলে ওঠে, "হিম-আলয় মাউন্টেনিয়ারিং, ট্রেকিং অ্যাণ্ড ট্যুরিজম ক্লাব"; গরলগাছা, হুগলি ড্রিস্ট্রিক্ট, ওয়েস্ট বেঙ্গল-এর এক এক্সপ্লোরেশন ক্লাব । আমরা সবাই তার মেম্বার । গতকাল বেলা এগারোটায় আমরা হর-কি-দুন রেঞ্জের ১৬,৩০০' ফুট অলটিট্যুডের সিংকা পাস ত্রক্রশ করে আসছি । শোনেগরাণ ভ্যালিতে আপনাদের ট্রেনিং ক্যাম্পে গতকাল রাত কাটাই । আজ সেখান থেকেই আসছি ।" সঙ্গে সঙ্গে আমিও বলে উঠি, "জিওলজিস্ট পাঞ্জাবী ভদ্রলোক আমাদের খুবই আদর, আপ্যায়ন করেছেন ।"

    প্রবীণ অফিসার ভদ্রলোক নিজেদের পরিচয়ের পালা শেষ করে বলে ওঠেন, "সিংকা পাস, হর-কি-দুন রেঞ্জের । বোরাসু, খিমলোগা, নালগার -- সব পাসই এ রেঞ্জের । দারুণ টাফ ! দারুণ টাফ ! কনগ্রেচুলেশন, ধন্যবাদ জানাই । অসংখ্য অভিনন্দন জানাই আপনাদের ।" আমাকে আর বিমলবাবুকে দেখেই ভদ্রলোক তো অবাক -- "ইন্‌ দিস এজ ! এঁরা উঠলেন কী করে এই বয়সে ?" বিমলবাবু তাঁর দীর্ঘ দিনের পাহাড়যাত্রার নানা অভিজ্ঞতার কথা বলেন কিছু কিছু । আমার পায়ে পায়ে ন'বার অমরনাথ, রূপকুণ্ড, মুক্তিনাথ, অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্প, ছোট কৈলাসের কথা শুনে অবাঙালি অফিসার হতবাক ! অস্ফুট কন্ঠে বলে ওঠেন, "এত ট্রেক করেছেন ?" ঘাড় নেড়ে একটু হেসে জানাই, হ্যাঁ । আমার আর বিমলবাবুর দু'হাত ধরে অফিসার ভদ্রলোক অসংখ্য ধন্যবাদ জানালেন ।

    এরপর ক্যাম্পের কিচেন-ঘর থেকে এল ট্রে-ভর্তি আলু-পকৌড়া, বিস্কুট, কফি । আমরাও অভিভূত হই আপ্যায়নে । বাঙালি জিওলজিস্ট মি: মুখার্জী এরপর বললেন, "আমরা এখানে ক্যাম্প করতে এসেছি ভারতীয় বহু শিক্ষার্থীদের -- বধত্ররুণ্ণবঞঠত্রভ ছ যধণ্ণত্ররুছঞঠধত্র ঙধণ্ণশযং ঠত্র ষ্ণত্ছবঠধত্ধভষ্‌ । হিমালয়ের হিমবলয়ে হিমবাহ সম্বন্ধে বহু তথ্যমূলক জ্ঞাতব্য বিষয়ে শিক্ষাদান করা হয় । কয়েকদিন ধরে বহু ট্রেনার শোনেগরাণ ভ্যালির `বাঙ্গি' গ্লেসিয়ারে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে গেল ।"

    অনেক আলাপ আলোচনার পর আমরা বিদায় চেয়ে নিই । ডিরেকটর মি: পুরি আমাদের বার বার অভিনন্দন জানালেন । আমাদের পর্বতাভিযানের সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করে তিনি হাত নেড়ে আমাদের বিদায় জানালেন ।

    বসপা নদী - যেন আপনবেগে পাগলপারা
    (ছবি : রবীন ধাড়া)
    /মঈ?
    বেসক্যাম্প ছেড়ে এলাম । পাইন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ । আমরা এগোতে থাকি । ছায়াভরা গাছের তলা । পাতার ফাঁক দিয়ে কোথাও কোথাও রোদ লুকিয়ে চুরিয়ে এসে পড়েছিল মাটিতে । আলোছায়ায় মাখামাখি । প্রচণ্ড জলগর্জন কানে আসছিল । আগে পাচ্ছিলাম অল্প অল্প । এখন মনে হল কানের কাছে । এগিয়ে গিয়ে দেখি । জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নজরে এল ভীমগর্জনে নেমে আসছে এক পার্বত্য নদী । বসপা -- হিমাচলের অন্যতম নামকরা নদী । নদীর ধার ধরেই পথ । নদীর খাদের গায় বসেছে অজস্র জঙ্গল, ঝোপঝাড় । তাই সবসময় নদীর জলধারা ভাল ভাবে চোখে পড়ে না । পথের পাশেই পাহাড়ের পাঁচিল উঠেছে । পাহাড়ের গায় ভেড়ার পাল চরে বেড়ায় । নীচে পথের ধারে চুপ করে বসেছিল ছোট্ট এক পাহাড়ি মেয়ে রাখালিনী । রুক্ষ একমাথা চুল । হাওয়ায় চুল লুটিয়ে পড়েছে মুখের ওপর । আপেলের মত রাঙা টুকটুকে মুখ, শুকিয়ে গেছে । এবড়ো খেবড়ো পাথুরে পথ । এক ভাবে হেঁটে চলা ।

    পথ এবার বাঁক নিয়েছে নদীর গা ধরে । অজগরি ঢংয়ে । নদীও বাঁক নিয়েছে । অজস্র বোল্ডারে ঠাসা । তারই মধ্যে দিয়ে প্রচণ্ড জলস্রোত পাগলের মত ছুটে চলেছে নীচে । বিশাল নদী বসপা । নেমে এসেছে উপত্যকার বুক চিরে ।

    বসপা উপত্যকা । হিমাচলের এক রূপতীর্থ । পাইনের সবুজ আঁচলের ছায়ায় মুখ ঢাকা যেন এক রূপসী । নদীর জলের সুরবাহারে তার নিত্য ঘুম ভাঙে । ঝরনার ঝুমুর নৃত্য তার দুটি পায় । ফুলের মালঞ্চ বসে রোজ তার বুকে । প্রজাপতিরা ডানা মেলে সেখানে তাদের রামধনু রঙের রঙ ছড়ায় । জ্যোত্স্নারাতে জোনাকিরা আলোর রংমশাল জ্বালে তার দুটি চোখের তারায় ।

    কুলিরা নদীর গা ধরে নেমে যাচ্ছিল । পথের দু'পাশে চোখে পড়ে আপেলের বাগান । অজস্র ফলে আছে গাছে । লাল টুকটুকে । হিমাচলের আপেল তুলনাহীন । সাংলার আপেল বাজার সেরা । দামও খুব । রাজা বাগানে ঢুকে পকেট বোঝাই করে আপেল ছিঁড়ে এনেছিল । গাছের তলায় পড়েও আছে দেখলাম ছোট বড় অনেক । ঝাঁকড়ামাথা আখরোট গাছও নজরে পড়ছিল খুব । আমড়ার মত ফল । এখনও কাঁচা । প্রচুর ফলে । গাছের ডাল যেন ভেঙে পড়ে । পাকলে পাড়া হয় । শুকিয়ে বাজারে আসে বস্তা বস্তা বিক্রির জন্যে । এখানের মানুষদের একটা মস্ত রুজি-রোজগার এইসব চাষে । যেসব বছরে অতিরিক্ত বরফ পড়ে সে-সময় গাছের ফলফুলের সমূহ ক্ষতি হয় । ফলে এখানের মানুষদের মোটা একটা আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায় । মানুষদের দুরবস্থার শেষ থাকে না তখন ।

    সাংলার প্রতিবেশী গ্রাম
    (ছবি : রবীন ধাড়া)
    দূর থেকে দেখে মনে হল নদীর ওপর ঝুলন্ত ব্রিজ । কুন্দন সিং দেখেই বলে ওঠে, "রকসাম এসে গেছি বাবুজী ।" বসপার ওপারে রকসাম গ্রাম । খুবই প্রাচীণ । পাহাড়ের গায় থাক থাক ঘরবাড়ি । কাঠ, পাথরের । নদীর এপার থেকে দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট ।

    ব্রিজ পার হই সকলে । নীচে খরস্রোতা নদী । ব্রিজের ঢালু মুখ রাস্তায় এসে উঠেছে । একটু এগোলে চোখে পড়ে বাসস্ট্যাণ্ড । সাংলা যাবার বাস এখান থেকেই পাওয়া যাবে ।

    ভরন্ত বিকেল । তবু রোদে এসেছে আলসেমি । শীত শীত করে । বসপার তীরে এসে দাঁড়াই । একদৃষ্টে চেয়ে দেখি তার স্রোতের লহর । ভেঙে ভেঙে পড়ছে পাথরের গায় । এগিয়ে যাচ্ছে, আবার ভেঙে পড়ছে পাথরে । দিনরাত এ ভাঙাভাঙির খেলা চলছে তার বুকে । কতদিন ধরে কে জানে ?

    বাসের শব্দ কানে আসে । তৈরি হই সবাই । মালপত্র কুলিরা বাসের মাথায় তুলে দিয়ে বাসে উঠে পড়ে । অনেকদিন পরে বাস যাত্রা । অনেকদিনের বিচ্ছিন্নতা । তাই কেমন একটু লাগে ! বসপার ধার ধরে বাস ছুটেছে । শুধু চেয়ে থাকি নদীর খেয়ালিপনার দিকে । কখনও সোজা বইছে, কখন বাঁক নিয়েছে । সাংলায় কখন এসেছে বাস বুঝতেই পারিনি । বিমলবাবুর ডাকে উঠে পড়ি । রুকস্যাক পিঠে বেঁধে নেমে আসি ।

    পাহাড়ের পায়ের তলায় সাংলা গ্রাম - যেন ঘুমের ঘোরে
    (ছবি : রবীন ধাড়া)
    সাংলা । এ-অঞ্চলের নামকরা জায়গা । পথে নামতেই সুন্দর ছিমছাম গেস্ট-হাউসখানা প্রথম নজর কাড়লো । সুন্দর রাত কাটাবার জায়গা, দেখেই মনে হল । সামনে দু'ধার বাঁধা, চওড়া নুড়ি পাথর ছড়ানো রাস্তা । সোজা গিয়ে মিশেছে গেস্টহাউসের দোরগোড়ায় । পথের দু'পাশে যত্ন করে তৈরি করা হয়েছে ফুলের বাগান । গাছপালা সাজানো গোছানো । তখনও ভাবিনি এখানে আমাদের থাকা হবে না । জেনেছিলাম পরে তরুণের কাছ থেকে । সমস্ত নাকি `হাউসফুল' । গ্রীষ্মের সিজন, পর পর সব তারিখ নাকি বুক করা হয়ে আছে । বাইরের অতিথিদের ভিড় নাকি সবসময় এখানে লেগেই থাকে । বিশেষত গরমকালে ও পুজোর মাসে । ভ্রমণের মরসুমে ।

    বাসরাস্তার একটু নীচে পরপর কয়েকখানা দোকান দেখলাম পাশাপাশি । সামনে বেঞ্চ পাতা । কুলিরা দলবেঁধে বসেছিল সেখানে । মূর্তিরাম, কুন্দন সিংও । তরুণের কাছ থেকে মূর্তিরামের সব পাড়াওয়ের মজুরি কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নেওয়া আগেই হয়েছিল । শুধু বাকি সকলের এবার বখশিস দেওয়ার পালা । সব কুলিকেই দু'শো করে টাকা আমরা বকশিস দিয়েছিলাম । শুধু কুন্দন সিংকে আলাদা করে আমি দু'শো টাকা দিয়েছিলাম জুতো কেনার জন্যে । কেননা ওর জুতোর যে হাল, চোখে দেখা যায় না ।

    তরুণ চায়ের কথা বলে দেয় দোকানে । সেইসঙ্গে বিস্কুটও । বিদায় নেবার পালা এবার । কুন্দনের দুটো হাত ধরে সেদিন বিদায় দিয়েছিলাম বিষন্ন মুখে । কুন্দন বলেছিল, "আবার নীচলা পাঁও গাঁয়ে আসবেন বাবুজী, দেখা হবে ।" উত্তরে বলেছিলাম, "আবার আসতে পারবো কিনা জানি না, তবে তোমাকে আমি ভুলব না ।" ছলছল চোখে মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে গাড়োয়ালি যুবক । মূর্তিরামকে তরুণ যা বলেছিল তাও আমি শুনেছি । "সত্ভাবে চলাফেরা করতে চেষ্টা কর । মানুষকে ঠকিও না । তাহলে ভাল হবে ।" মূর্তিরামের কথাগুলো কানে গিয়েছিল কিনা জানি না, তবে দেখলাম, মাথা নীচু করে দোকান ছেড়ে চলে গেল । শুনলাম, আগামী কাল সকালের বাসে ওরা সিমলায় চলে যাবে ।

    দোকান ছেড়ে রাস্তার ওপর এসে উঠি । সন্ধ্যার ছায়া নামছিল সারা গ্রামের মাথায় । রাতের আস্তানা এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি । কার কাছ থেকে খবর পেয়ে তরুণ আমাদের সকলকে নিয়ে এসে উঠলো একটা গাছপালা ঘেরা বাগান বাড়িতে । বাসরাস্তা ধরে বেশ কিছুটা পথ ঘুরে আসতে হয় নীচে । সাংলা গ্রামের উপান্ত । পাহাড়ের গায় ঘরবাড়ি, দোকান । মানুষজন ।

    বাড়িখানা বেশ মনে ধরেছিল । পাথরের গাঁথুনি, পাঁচিল-টানা চারপাশ । পাঁচিলের কোলে আপেল, মুসাম্বির গাছ । সেইসঙ্গে নানা জাতের ফুলেরও গাছ । মাঝখানে ছোট্ট সবুজ ঘাসের একফালি উঠোন । বাড়ির সামনে বারান্দা । দুখানা ঘর । কিন্তু লোক নেই, জন নেই । ঘরের দোরে তালা ঝুলছে । একটু অবাক হই । বাড়ির মালিক অনুপস্থিত । বসে পড়ি বারান্দায় মালিকের আসার পথ চেয়ে ।

    এরপর যা শুনলাম, তাতে হতাশ হতে হল রীতিমত । মালিক তার ব্যবসার কী কাজে গেছে সিমলায় আজ সকালে । কবে ফিরবে জানা নেই ।

    ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আবার ফিরে এলাম গেস্টহাউসের সামনে -- রাস্তায় । এদিক ওদিক করি । রবীন ও তরুণ গিয়েছে এখানের এক ক্লাবরুমে ফরেস্ট রেস্টহাউসের সন্ধানে । ওরা ফিরে এল ভাল খবর নিয়েই । ফরেস্ট রেস্টহাউস খালি পড়ে আছে । ওখানেই থাকা যাবে । নিশ্চিন্ত হলাম ।

    সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই । দোকানের সব খুপরিতে আলো জ্বলে উঠেছে । দূরে পাহাড়ের গায় ঘর বাড়িতেও আলোর বিন্দু চোখে পড়ে । দেখে মনে হল, যেন আলোর কুঁড়ি দিয়ে গাঁথা মালা । রবীনের পরামর্শ মত সবাই মালপত্র কিছু কিছু ভাগ করে নিই । রেশনের অবশিষ্ট বিশেষ কিছুই আর ছিল না । থাকার মধ্যে শুধু তাঁবু ও তার সাজপাটের দুটো পিট্টু । রবীন ও রাজা দুজনে তার দায়িত্ব নিয়েছিল । কিচেনের সাজ-সরঞ্জাম সবাই ভাগাভাগি করে নিই ।

    আমরা উঠে পড়ি ফরেস্ট রেস্টহাউসের পথে । পথ নাকি বেশ দূর । বসপা নদীর ওপারে । ব্রিজ পার হতে হবে । চড়াইয়ের মাথায় পাহাড়ের গায় । রবীনকে অনুসরণ করি । ক্লাবঘরের সামনে এসে রবীন দাঁড়ায় সকলের জন্যে । পথ এখান থেকে নেমে গেছে গ্রামের মধ্যে দিয়ে নদীর কিনারা পর্যন্ত । দোতলা ক্লাবঘর । আলো-অন্ধকারে মাখামাখি । ভাল দেখা যায় না । টিম টিম করে আলো জ্বলছে দুপাশের গৃহস্থের বাড়িতে । ছাগল ভেড়ার খোঁয়াড় বাড়ির উঠোনে । নর্দমা নেমে গেছে নীচে । তার পাশ দিয়ে আমরাও নেমে যাচ্ছি নীচে । পথ বাঁদিকে বাঁক নেয় । বেড়াঘেরা ছোট ছোট শাকসব্জির বাগান বাড়ির সামনে । ধামসা বা ঢোলের শব্দ আসছিল কানে । সেই সঙ্গে ঝাঁঝরের আওয়াজ । অদ্ভুত পুরুষালি কন্ঠে কি সব প্রার্থনা মন্ত্রের সুর ভেসে আসছিল কানে । মনে হল বৌদ্ধ গুম্ফা কাছে কোথাও আছে ।

    পথ আরও নেমে যাচ্ছিল । নির্জন পাহাড়ি গ্রাম্য পথ । চাঁদ উঠেছিল ম্লান । পাতলা কুয়াশার ঘেরাটোপ চারদিকে মাথার ওপর । তাই ভাল করে সব কিছু চোখে পড়ছিল না ।

    জলের গর্জন কানে আসে । মনে হল একসঙ্গে অনেকগুলো যেন মেশিন চলছে । বসপা নদীর ধারে এসে পৌঁছেছি । সামনে বিশাল কাঠের ঝুলন্ত পুল দেখা যাচ্ছে । নীচে কিছুই দেখা যায় না । গাঢ় অন্ধকার ।

    পুল পার হলাম । জোত্স্নার ম্লান আলোয় মনে হল ওপরে বেশ ভাঙাচোরা পথ ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠে গেছে । এপথের মাথায় নাকি বন বিশ্রামভবন । পথের দুপাশে গাছপালা, ঝোপঝাড় । মানুষজন নেই । নিশ্চুপ, নির্জন । চড়াইয়ের মাথায় মনে হল পথ দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে । ডান দিকের পথে পড়বে রেস্ট হাউস । বাঁদিকে মনে হল অনেকখানি জায়গা নিয়ে কোন সংস্থার ঘর ।

    ডানদিকের পথ ধরি সকলে । একটু এগিয়ে গিয়ে পড়লো রেস্টহাউসের প্রবেশ ফটক । লোহার গেটের মুখে লোহার জোড়া পাল্লা । ভিতরে ঢুকতেই প্রথমে পেলাম গেটের মুখে একরাশ বোগেনভিলার সহাস্য অভ্যর্থনা । খুঁটির ওপর মাচাতে লতিয়ে উঠেছে সযত্নে । পাথরের নুংই ড় বিছানো পথ রেস্টহাউসের সিঁড়িতে গিয়ে মিশেছে । সামনে বিশাল ফুলের বাগান । নানা জতের ফুলে ছেয়ে আছে বলেই মনে হল । পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চারপাশ । মনোরম পরিবেশ । বাড়িখানার চারধারে চওড়া বারান্দা । সেখানে এসে উঠলাম সবাই ।

    সাংলার বন বিশ্রামভবন - যেন স্বপ্ননীড়
    (ছবি : রবীন ধাড়া)
    তরুণ আর রবীন চলে গিয়েছিল চৌকিদারের খোঁজে । মনে হল ফুলবাগানের ওপাশে তার ঘর । একটু বাদেই বয়সে বেশ প্রবীণ ঢোলাঢালা কোট গায়ে, মাথায় হনুমান টুপি-পরা চৌকিদারকে সঙ্গে নিয়ে ওরা ফিরে এল । সৌভাগ্য আমাদের বলতেই হবে । আজই সকালে এক পরিবার দুদিন এখানে থেকে সিমলায় চলে গেছেন । ঘর তাই খালি পড়ে আছে । অসুবিধা হবে না থাকবার ।

    একরাশ চাবি নিয়ে চৌকিদার আমাদের ঘর খুলে দিল । দু'খানা ঘর আমরা নিলাম । পাশাপাশি । ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুম, পায়খানা আছে । বারান্দায় রান্না করা যাবে । জল আছে অফুরন্ত । কিছুই অসুবিধা হবে না ।

    মোটামুটি ওদের ঘর সাজিয়ে নিয়েছিল রাজা, পার্থ, স্বপনেরা । অন্য ঘরে আমি, তরুণ, বিমলবাবু । হাতেহাতে কোনরকমে প্লাস্টিক ক্যারিমেট পেতে নিয়ে বিছানা করে নিই । বিমলবাবুর বিছানাশ্রয়ী হতে মুহূর্তমাত্র সময় লাগে না ।

    টর্চ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসি । রেস্টহাউসের এদিকেও টানা বারান্দা । বারান্দার একধারে স্বপন, পার্থরা চা তৈরির সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে গুছিয়ে বসেছিল । রেশনের ভাঁড়ারে বিশেষ কিছু উপকরণ আর নেই । মেরেপিটে আজ রাতটা চলতে পারে ।

    সকলের ইচ্ছে একটা দিন এখানে থেকে যাওয়া । বিশেষ করে বিমলবাবুর । তরুণকে বারবার একথা তিনি বলেছেন । তরুণ ইত:স্তত করেছিল রেশনের করুণ অবস্থা দেখে । রবীন আশ্বস্থ করেছিল চৌকিদারের কাছে চাল, ডাল, আলু, শাকসব্জি সব পাওয়া যাবে । যা দাম হবে দিয়ে দিলেই হল ।

    চিনিহীন লিকার চা । টিনে বিস্কুটের তলানি । চা-পর্ব মিটে গেল ঐভাবেই । বাইরে একটু বেরিয়ে পড়েছিলাম । টর্চের আলোয় বুঝলাম রেস্টহাউসের এ দিকটা পিছন । এখানেও চারধারে ফুলের গাছ, ফলের গাছ লাগানো হয়েছে । সবুজ ঘাসে ঢাকা এদিকের উঠোনও । তার মধ্যে দিয়ে নুড়ি বিছানো পথ । পথ ধরে এগিয়ে যাই । কানে আসে জলের কলগুঞ্জন । বসপার কিনারা । পথ গিয়ে মিশেছে মনে হল সুন্দর এক মঞ্চে । গোলাকার পাথরে গাঁথা মঞ্চ । মাথায় কাঠের গোল ছাতার মত ছাওন । সিলিংয়ের চারধারে কাঠের ওপর নকসার কাজ করা ঝুলন্ত জাফরি । নীচে পাথরের শক্ত মেঝের ওপর চারপাশে পাতা কাঠের হেলান দেওয়া বেঞ্চ । বেশ মজবুত । বিশ্রাম ও সময় কাটানোর অতি পরিপাটি ব্যবস্থা । মনে হল একটু বসি এখানে । বসে বসে একান্ত নিবিড় ভাবে বসপা নদীর রূপ দেখি চাঁদের আলোয় । এখান থেকে তার রুপোলি জলের ধারা দেখা যাচ্ছিল । চোখে পড়ে তার গতির উন্মাদনা, অন্তরের উচ্ছাস, উদ্বেলতা । নিজের খেয়ালেই সে যেন দিশেহারা । মনে হচ্ছিল কেবলই, পাথরের অলিগলি বেয়ে দুরন্ত মেয়ের মত সে ছুটে পালিয়ে চলেছে যেন কোন অজানার উদ্দেশ্যে । দিনরাত তার একই সুর, একই কলতান । ছেদ নেই, শেষ নেই । হিমালয়ের কোন এক গোপন তুষার গহ্বরে জন্ম হয়েছে তার । তারপর কিসের আকুলতায় সে নেমে এসেছে নীচে । শীর্ণ দেহে তার এল একদিন যৌবনের মত্ততা, উচ্ছাস, আনন্দ । তাই সে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি । কার যেন দুর্বার আকর্ষণে সে পাগল হয়ে ছুটে চলেছে ।

    চাঁদের আলোয় নজরে আসে মাথার ওপর পাইনের সবুজ কুঞ্জ । সেখানে অজস্র শাখায় পাতায় নিবিড় জড়াজড়ি । তার মধ্যে চোখে পড়ে জোনাকির দীপালি উত্সব । এ উত্সব হয়ত চলবে সারা রাত । এ উত্সব চলে হয়ত নিত্য । কিন্তু এ উত্সবের অংশীদার কে হবে ? কে দেখবে দুটি নিথর চোখে জোনাকির সে আলোর অঞ্জলি দান । ভেবে পাই না ।

    নির্জন রাত । আকাশের সপ্তর্ষিমণ্ডলের ঋষিরা এখন ধ্যানস্থ । দুধসাদা জ্যোত্স্নায় রেস্টহাউসের পিছনে সবুজ ঘাসের মাঠটুকু ভেসে যাচ্ছিল । ভাল লাগে রাতের এ মাদকতা, তার নৈ:শব্দ, তার নি:সঙ্গতা । রাতের এ পরিবেশ, যেন প্রশান্তিতে মাখামাখি ।

    বেঞ্চ ছেড়ে উঠে পড়ি । আবার পায়ে পায়ে ফিরে আসি রেস্ট হাউসে । সকলের খাওয়া হয়ে গেছে । তখনও আলো জ্বলছিল হাউসের চারদিকে । ঢাকা দেওয়া খাবার । খেয়ে নিই । নি:শব্দে ঘরে এসে ঢুকি ।

    পরের দিন সকাল ।

    চৌকিদারের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল । দোর খুলতেই দেখি চায়ের কেটলি আর পলিপ্যাকে ভর্তি করে আখরোট নিয়ে এসেছে । স্বপন চায়ের কথা বলে দিয়েছিল । আজ দুবেলার খাবারও সে করে দেবে ।

    আজ সারাদিন থাকবো এখানে । তাই বেলা করি না । চা খেয়েই বেরিয়ে পড়ি । সুধাংশু, স্বপন, রবীনেরা বেরিয়ে পড়েছিল আগে । পার্থ যেতে পারেনি । শরীর ওর ভাল নয় । কী সব গায়ে ওর বেরিয়েছে লাল ফুসকুড়ির মত । বিমলবাবু ও নীলাদ্রি বসপার ধারে বিশ্রামকুঞ্জের দিকে গেছে । তরুণ সকাল থেকেই ডুবে বসে আছে ফাইলপত্র আর একগাদা কাগজপত্রের মধ্যে হিসাবনিকাশ নিয়ে ।

    বসপার ধার ধরেই পথ । ব্রিজের এপারে । ওপারে গ্রাম । পথ কখনও ওপরে উঠছে, কখনও নামছে । নদীর ধার ঝোপ ঝাড়ে ভর্তি । পথের ডানদিকে পাহাড়ের ঢালু দেওয়াল । পাইন গাছের সারি তার গা লাগোয়া । এগিয়ে গেছে বরাবর । একলা হেঁটে হেঁটে চলেছি । নির্জন পথ । নীচে বসপা গভীর গর্জনে বয়ে চলেছে । দূরে নদীর ওপারে কিন্নর কৈলাসের মাথায় রুপোর মুকুট ঝলমলিয়ে উঠছিল সবসময় চোখে ।

    কিন্নর কৈলাস - ধ্যানস্তব্ধ গিরিতাপস
    (ছবি : মুন্না ঘোষ)
    অনেক দূর হেঁটে এসেছি । চুপ করে বসে পড়ি পথের ধারে পড়ে থাকা এক পাথরের ওপর । চেয়ে চেয়ে দেখি ধ্যানস্তব্ধ গিরিতাপসের বিভূতি অঙ্গের দিকে । শ্বেতশুভ্র উত্তরীয় কন্ঠলগ্ন । হিমচন্দনে আঁকা কপালে ত্রিপুণ্ডক । নিমিলিত নয়নে প্রশান্তির ছায়া । রোদের কিরণে উজ্জ্বল, জ্যোতির্ময় । রূপের পূজারীরা আসে, দু'চোখ ভরে সে রূপ দেখে, হৃদয়ের অঞ্জলি নিবেদন করে চলে যায় । যুগ যুগ ধরে চলে আসছে । আজও আসে পাহাড়পথিকের দল তাদের শ্রদ্ধা উত্সর্গ করতে । শেষে পথ চলার অভিজ্ঞতার ঝুলিটি পূর্ণ করে নিয়ে যায় তারা ।

    বেলা বাড়ে । উঠে পড়ি । আবার সেই পথ । ফিরে আসি রেস্ট হাউসে ।

    হৈ-চৈ শুরু হয়েছে চৌকিদারকে নিয়ে খাবার সময় । ভাত, রাজমার তরকারি ডিমভাজা আর সেইসঙ্গে আপেলের আচার । রাজকীয় খাবারের তালিকা । কিন্তু ডিম ভাজার দাবি ওঠে রাজা ও রবীনের গলায় । চৌকিদার রান্নাঘরে কয়েকটা ডিম রেখে দিয়েছিল, সে ডিম সব তাদের ভেজে দিতে হবে । চৌকিদার বলেছিল, বাবুজী সিমলা থেকে ডিমের চালান এখনো আসেনি, অন্য গেস্ট এলে এরপর আমি তাদের খাওয়াব কি ? রাজা নাছোড়বান্দা । শেষ পর্যন্ত অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজাকে শান্ত করানো হয় ।

    জমজমাট তাসের আসর বসেছিল ছেলেদের ঘরে । তারই চিত্কার, চেঁচামেচিতে কান ঝালাপালা হবার উপক্রম । বিশ্রাম নেব কি ? বিমলবাবু তিতিবিরক্ত হয়ে বাইরের বারান্দায় গিয়ে বসে থাকেন । তরুণ দিব্বি দিবানিদ্রায় মগ্ন ।

    একটু বিকাল বিকাল বেরিয়ে পড়েছিলাম সেদিন সাংলার প্রতিবেশীদের ঘরবাড়ি, পথঘাট দেখতে, সেই সঙ্গে গ্রামের বৌদ্ধগুম্ফাও । ব্রিজ পার হয়ে এপারে আসি । দু'চার জন স্থানীয় মানুষের সঙ্গে দেখা হয় । ঘাসের বোঝা পিঠে বেঁধে দুই রমণী আসছিল ব্রিজের ওপর দিয়ে । হাতে হাঁসুলি । ওরা নদীর ওপার থেকে ঘাস কেটে আনছিল । টান টান জোব্বা পরা । পরিশ্রমে গলদঘর্ম । ব্রিজের মুখ থেকে চড়াই পথ ওপরে উঠে গেছে গ্রামে যাবার । রাস্তার পাশে পাশে গ্রামবাসীদের বাড়িঘর । পাইনকাঠের তক্তার দেওয়াল । মাথায় টিনের চালা । কারও বা পাথর দিয়ে গাঁথা বাড়ি । বাড়ির সামনে, পাশে শাক-সব্জির ক্ষেত । লাউ কুমড়োর মাচা । মুসাম্বি, আড়ু, আপেলের গাছ । একগাছ করে লেবু, আপেল ফলে আছে । ফলের ভারে ডাল যেন ভেঙে পড়েছে ।

    কিন্নরী মা ও ছেলে
    (ছবি : মুন্না ঘোষ)
    পাড়ার মধ্যে এসে ঢুকি । বাড়ির উঠোনে ছাগল, ভেড়ার খোঁয়াড় । নোংরা অপরিচ্ছন্ন । চোখে পড়ে পাথর বসানো ছোট ছোট খামার । খামার ভর্তি যবের আঁঠি, রাজমার ডাল আর সোয়াবিন গাছ শুকনো হচ্ছে । কোনও কোনও খামারে মেয়েরা ডাল, কড়াই ঝাড়াইবাছাই করছিল । ওরা এসব ফসল সারাবছর যত্ন করে সংগ্রহ করে ঘরে তুলে রাখে । বিশেষ করে শীতের মরশুমে এ তাদের খোরাক । ঘরবাড়ির অলিগলি দিয়ে পৌঁছলাম গ্রামের বৌদ্ধগুম্ফায় । পাথর বসানো অনেকখানি ফাঁকা চত্বর নিয়ে গুম্ফার পরিধি । তার চারধারে পরপর সব ঘর । এ সবই নাকি গুম্ফার এক্তিয়ারে । কোন কোন ঘরে বৌদ্ধ উপাসকেরা থাকেন । কোন ঘর ভাঁড়ার হিসেবে ব্যবহার হয় । ঘরের বারান্দায় দেখলাম বহু চামড়ার বাজনা ও তার সাজ-সরঞ্জাম জড়ো হয়ে পড়ে আছে । দামামা, ধামসা, মাদল, ঢোল, নাকড়া, ঝাঁঝর, বাঁশী, করতাল ইত্যাদি । অদ্ভুত সব গড়ন আর আকারের । পুজোর সময় বাজানো হয় । বিরাট আকারের ভেড়ার শিং একজোড়া টাঙানো রয়েছে ঘরের দেওয়ালে । বীভত্স দেখতে সব মুখোশও টাঙানো রয়েছে । মন্দিরের দালান বেশ প্রশস্ত । পাথরের লম্বা লম্বা সিঁড়ি সামনে । মন্দিরে প্রবেশদরজার মাথায় রঙিন কাপড়ের ঝালর । বেদির ওপর সাজানো বাতিদান । জলের ছোট ছোট বাটি সারবন্দি । তার সামনে বুদ্ধের ধ্যানস্থ মূর্তি । নিমীলিত নয়ন । বিশাল বিশাল পিলসুজের ওপর বড় বড় বাতি লাগানো । মোটা মোটা ধূপ জ্বলছিল ধূপদানে । কেমন এক বিচিত্র গন্ধ সারা ঘরে । এগন্ধ আমি বহু গুম্ফায় এর আগেও পেয়েছি । এখানের গাছ-গাছড়া, মূল, কন্দ, পাতা থেকে তৈরি ধূপেরই বোধহয় এই একই বিচিত্র গন্ধ । চর্বির প্রদীপ জ্বলছিল সারি সারি বেদির ওপর । বৈশাখ মাসে বৌদ্ধপূর্ণিমা তিথিতে গুম্ফায় পুজো উত্সব হয় । সেইসময় গ্রামের মানুষ উত্সবে মেতে ওঠে । চত্বরে মেলা বসে । এখানের তৈরি নানা শিল্প উপকরণ, হাতের কাজ মেলায় আসে । শস্য, ফসল বেচা কেনা হয় । আত্মীয় স্বজন, কুটুম্ব, বন্ধু-বান্ধব বাড়ি বাড়ি আসবে । আনাগোনা করবে । নাচ, গান, বাজনার সুরে তালে জমজমাট হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গন । এরপর খাওয়া-দাওয়া, পানভোজন সে তো আছেই ।

    সন্ধ্যা হয়ে আসছিল । বাড়িঘরে আলো জ্বলে উঠেছে । গুম্ফার চত্বর ছেড়ে আস্তে আস্তে নেমে আসি পথে । আঁকাবাঁকা ঢালু পথ নেমে এসেছে ব্রিজের মুখে । একপাল ভেড়া ব্রিজ পার হয়ে আসছিল । সেইসঙ্গে সারা দিনের কর্মক্লান্ত রাখাল ছেলেও । এদের জীবনের প্রাত্যহিকতার বৈচিত্র, এযেন চিরকালই একই সুরে বাঁধা ।

    রেস্টহাউসের ফুলবাগানের রাস্তায় এসে পা দিই । বাগানের কোনে চৌকিদারের ঘর । আলো জ্বলছিল । সেই সঙ্গে গল্পগুজবও বেশ চলছিল বলে মনে হল । এগিয়ে গিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিই । ছেলেরা জমায়েৎ হয়েছে সেখানে । চাপাটি তৈরি হচ্ছে দেখলাম । চৌকিদার এখানে সংসার পেতে বসেছে । স্ত্রী ও ছোট ছোট দুটি মেয়ে । সরল, নিরীহ মানুষ । হিমাচলের ছিত্কুলে বাড়ি । রোজ যাতায়াত করা সম্ভব নয় বলেই সংসার তুলে এখানে এনেছে । কর্মস্থল যখন এখানে তখন এছাড়া আর উপায় কী ?

    সে রাতে চাপাটি আর স্কোয়াশের তরকারি । শেষে ফলের মিক্সড আচার । স্বপন বলেছিল, এটাই নাকি অবশিষ্ট ছিল শেষ টিন । রেশন পুরোপুরি নি:শেষ হয়ে গেছে । কতদিন ধরে কত সংগ্রহ ! বিরাট পরিবার । দশ-বার দিন ধরে এখনও যে কিছু খুঁদকুড়ো আছে সেটাই আশ্চর্য !

    আগামি কাল ফিরে যাব সিমলায় । আবার চোখে পড়বে শহরের সেই আভিজাত্য ও তার বনেদিয়ানা । কানে আসবে মাতাল শহরের প্রগলভতা, সেই সঙ্গে কলরব । ভাল লাগে না । তাই আবার একা একা চলে যাই বসপার ধারে সেই পাইনের নির্জনতায়, নিভৃত বিশ্রামমঞ্চে । এখানে এসে বসতে বেশ ভাল লাগে । নির্জন স্তব্ধতার ঘুম ভাঙাচ্ছে সব সময়ই নদীর কলগীতি । তার বিরাম বিহীন সুরগুঞ্জন । চুলি, পাইন, সিলভার ওক আরও কতনা গাছের সমাবেশ হয়েছে নদীর কিনারায় । ঘন জঙ্গলে রাত জাগা কোন পাখির ডাক - হয়ত কানে আসবে । হয়ত সেই সঙ্গে কোনও নিরীহ বন্য প্রাণীর অন্তিম আর্তনাদ । আবার কোনও হিংস্র প্রাণীর গভীর গর্জনও । হতেও পারে । কিছুই বিচিত্র নয় এখানে । চাঁদ উঠছে । জ্যৈষ্ঠের শেষ । রাতের আকাশে ভাঙা ভাঙা মেঘের সঞ্চালন । তারই মধ্যে দিয়ে চোখে পড়ে অস্পষ্ট নক্ষত্রমণ্ডলীর মিছিল । বসপার ওপারে ধ্যানমৌনী কৈলাস । তারও ছায়া দোলে নদীর জলে ম্লান জ্যোত্স্নায় । সারা গ্রামখানা যেন ঘুমিয়ে পড়েছে নদীর ওপারে । নির্বাক প্রকৃতির কোলে ।

    ফিরে আসি বনবাংলোয় ।

    ॥১০ ॥


    সংসার পাতা আর সংসার তোলা । এ যেন প্রাত্যহিকতায় এসে দাঁড়িয়েছিল । আজও সংসার তোলা হচ্ছে আর এক জায়গায় পাতা হবে বলে । সকাল থেকে শুধু তারই তত্পরতা চোখে পড়ছে । চৌকিদারের দেনাপাওনা সবই মিটিয়ে দিয়েছে তরুণ । মালপত্র সবই বাঁধাছাঁদা । শুধু বেরিয়ে পড়ার অপেক্ষা ।

    চৌকিদারের দুটি ছোট মেয়ে গেটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে । তাদের হাতে লজেন্সের দুটো প্যাকেট দিয়ে এসেছিলাম । খুশি খুশি ভরা মুখ । ওরা সমানে সেখানে দাঁড়িয়েছিল যতক্ষণ না আমরা নীচে নেমে এলাম ওদের দৃষ্টির বাইরে । এরপর বসপার ব্রিজ পার হয়ে গ্রামের মাথায় বাসস্ট্যাণ্ডে এসে হাজির হই । সিমলার বাস এখান থেকেই যাবে ।

    বসপা ও শতদ্রু নদী - মিলনের আবেগে আত্মহারা
    (ছবি : মুন্না ঘোষ)
    সকালের চা-পর্ব এখানের দোকানেই সারা হল । আধুনিকতার ছোপ লেগেছে দোকানে । হিন্দি সিনেমাতারকাদের মস্ত মস্ত জীবন্ত ছবি সারা ঘর জুড়ে টাঙানো । হিন্দি ফিল্মের ক্যাসেট বাজছিল দোকানে । চাল, ডাল, আটা, চিনি, চা, কেরোসিন তো আছেই দোকানে, সেই সঙ্গে জামা-কাপড়, প্যান্ট, জুতো, ছাতা ও মনোহারি সামগ্রীর সমাবেশ ঘটেছে । সেলুনের দোকান রয়েছে দেখলাম একটা । চায়ের দোকানের সামনের পাতা বেঞ্চে স্থানীয় মানুষজন বসে চা খায়, গল্পগুজব করে, বিড়ি টানে । মোটা মোটা কম্বলের আলখাল্লা আর টুপি মাথায় ।

    বাস এসে পড়ে । মালপত্র বাসের মাথায় তোলা হয় । সকলে বাসে উঠে পড়ি । সকালের বাস । ভিড় খুব বেশি নেই । স্থানীয় মানুষজন কিছু আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে । শুনলাম, কল্পা থেকে ভিড় বেশি হবে ।

    হিমাচল সরকারের বাস । কতদিন পরে বাসে আবার উঠে বসেছি । অবাক অবাক লাগছিল বৈকি । বিমলবাবু রীতিমত খুশি । টান টান হয়ে সিট দখল করে বসেছিলেন । ফিরে চলেছেন ভালোয় ভালোয় সিমলায় । শহর কলকাতায় আগাগোড়াই মানুষ । ছেলেদের নাকি বলেই রেখেছেন সিমলায় গিয়ে নাম করা এক রেস্টুরেন্টে পার্টি দেবেন ।

    বসপার ধার ধরেই বাস চলেছে । হেলেদুলে ঘড় ঘড় শব্দ তুলে । রকছাম ফেলে চলে এসেছি । তরুণের ইচ্ছে ছিল এই যাত্রায় সকলকে নিয়ে ছিত্কুল, এদিকের সুন্দর পাহাড়ি শহর বেড়িয়ে যাবে, কিন্তু পার্থের অসুস্থতায় বিশেষ করে সুধাংশুর অমতে যাওয়া বাতিল হয়েছিল । সাংলা থেকে ছিত্কুল খুবই কাছে । মাত্র ২৫ কিংই. । জীপ চলে ওপথে । রূপের সাজঘরে মনের মত করে তাকে সাজিয়েছে প্রকৃতি । অরণ্যসম্ভারে, ফুলে ফলে, ফসলে ছিত্কুল সমৃদ্ধ শ্রীমণ্ডিত । বসপার জলধারা তার গা ছুঁয়ে নেমে এসেছে । ১২১ হেকটর জমির আয়তন নিয়ে গ্রামের এলাকা । ৭০-৭১ টি মাত্র ঘর ওখানে । ৪৫০-৫০০ জন লোকসংখ্যা গ্রামের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সুধাংশুকে বলি । পরিচালন ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট এসব ওদিকে আছে, তাই গ্রামের সার্ভেওয়ার্ক অনেক আগেই হয়ে গেছে কিন্তু আমরা সুপিন উপত্যকার যেসব গ্রাম-অঞ্চল সার্ভে করে এলাম সেসব দিকে তো কিছুই নেই । ওখানে গ্রামের জাগ্রত দেবী মালাজী কালিকা । দেবীমূর্তি মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত । আশপাশ বাইরে থেকে বহু মানুষ ওখানে আসেন দেবীদর্শনে পুজো দিতে । ওখানের বাড়িঘর সবই কাঠের, বেশির ভাগই দোতলা ।

    কল্পা শহর - আভিজাত্যে ঝলমল করছে
    (ছবি : শিপ্রা বন্দোপাধ্যায়)
    বাস এসে পৌঁছলো কল্পায় । কিন্নরের সদর দপ্তরে । সিমলা থেকে শুরু কিন্নরের পথ । ১৯২৭ সালে এই পথ `হিন্দুস্থান-তিব্বত' রোড নামে শুরু হলেও চিন-ভারত যুদ্ধের আগে পর্যন্ত খুব একটা মর্যাদা পায়নি । পরে যুদ্ধের সময় এর গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায় । তখন সামরিক প্রয়োজনে অম্বালা থেকে সীমান্ত গ্রাম কিউরিক পর্যন্ত প্রায় ৫০০ কিংই. দীর্ঘ পথ তৈরি হয় খুব মজবুত করে । এখন জাতীয় সড়ক
    ব্ণ -২২ হিসাবে এর পরিচিতি ।

    কল্পা থেকে সিমলার দূরত্ব ২৭৪ কি.ংইম./১৭০ মাইল । শতদ্রু সবসময়ই এখানে চোখের ওপর ভাসছে । রাস্তার কখনও ডানদিকে কখনও বাঁদিকে । নদীর কলগুঞ্জন সব সময়ই কানে আসে । কল্পা, কিন্নরের চোখ জুড়োনো এক উপত্যকা । লম্বায় তিন মাইলের মত আর চওড়ায় মাইলখানেক । এর আগের নাম ছিল চিনি । চিন-ভারত যুদ্ধের পর এর নাম বদল হয়ে `কল্পা' হয় । সবুজের সর পড়েছে সারা উপত্যকার বুকে । চুলি, পাইন, দেওদার, ওক, আখরোট গাছের ছড়াছড়ি । আপেল, আঙুর, খোবানির বাগান সারা উপত্যকায় । ফুল ও ফলের ঐশ্বর্যে বুক তার ভরা ।

    নীলিমার চালচিত্রে অভ্রমেদুর কিন্নর কৈলাস,
    (ছবি : মুন্না ঘোষ)
    উপত্যকার দিগন্তজোড়া আসন পাতা ধ্যানস্থ কিন্নর কৈলাসের । স্ফটিককান্তি ধূর্জটির শান্ত নিমীলিত নয়ন । ছোট সদর শহর গড়ে উঠেছে এখানে । ঘরবাড়ি, দোকান-বাজার, সরকারি অফিস, স্কুল, হাসপাতাল, ডাকঘর সবই আছে । এখান থেকে ৩ কিংই. দূরে কোটি গ্রাম । দেবী চণ্ডীর মন্দির আছে সেখানে । বেশ আধুনিক সাজসজ্জা, সম্ভারে সাজানো গ্রাম । ফল সংরক্ষণের কারখানা, ব্যাঙ্ক, ডাকঘর সবই তৈরি হয়েছে । ১৪ কিংই. দূরে বাসে যাওয়া যায় নতুন গড়ে ওঠা সুন্দর গ্রাম `পিও' । সময় করে বেড়াতে খুবই ভাল লাগে ।

    বাস থেকে নেমেই একপ্রস্থ চা, জিলিপি জলযোগ হল । কতদিন পরে এ জলযোগ ! এরপরই সবাই ঢুকলাম রাস্তার ধারে এক হোটেলে । চাউল, রাজমা, আলুপনির, টক দই । সেইসঙ্গে একটু চিনি । সে-বেলার মত নিশ্চিন্ত ।

    বাস হর্ন দিচ্ছে । উঠে পড়ি সবাই । এরপর দীর্ঘ পাহাড়ি পথ । দীর্ঘ পরিক্রমণ । সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই । বাস এসে পৌঁছলো সিমলায় । সময় নিল খুব । প্রায় দশ-বারো ঘন্টার মত । সিমলা কালীবাড়ির ধর্মশালায় সে-রাতের মত হল সবাইয়ের আস্তানা ।

    রাত হয়েছিল । মন্দির চত্বরে আসি । রাতের সিমলা । মাথার ওপর নির্মল আকাশ । নক্ষত্রগুলো দপদপ করছিল । মন্দিরে আরতি অনেকক্ষণ আগেই শেষ হয়েছিল । প্রায় নির্জন হয়ে এসেছে মন্দিরপ্রাঙ্গন । চীরগাছের নীচে পাতা একখানা বেঞ্চে এসে বসি । বেশ ঠাণ্ডা তখনো । পাহাড়ের গায় হেলান দিয়ে রয়েছে সারা শহর । গ্রীষ্মকালীন অবসর বিনোদনের শহর শাসককূলের । অতীত ইতিহাসের বহু ঘটনার সাক্ষ্যভূমি এই সিমলা । চেয়ে থাকি দূরে যেখানে চলেছে আলোর উত্সব মহলে মহলে । রাত গভীরে নেমে আসছিল । ক্লান্তিতে অবসন্ন সারা দেহ মন । উঠে আসি ধর্মশালার ডর্মিটরিতে ।

    ॥ ১১ ॥


    সিমলা কালীমন্দির
    (ছবি : রবীন ধাড়া)
    পরের দিন খুব ভোর বেলায় ঘুম ভেঙেছিল কালীমন্দিরের মঙ্গল আরতির ঘন্টার ধ্বনিতে । বেরিয়ে এসেছিলাম বাইরে, মন্দির চত্বরে । রেলিংয়ের ধারে এসে দাঁড়াই । সারা শহর তখনও ঘুমে আচ্ছন্ন । শুধু শহরের গায় লেগে থাকা জলন্ত আলোর বিন্দুগুলো জেগে আছে সারা রাত ধরে । ভোরের স্নিগ্ধ শীতল হাওয়ায় শীত শীত করছিল । দু'চার জন বাঙালি, অবাঙালি পূণ্যার্থী দেবী দর্শনে এসেছিলেন, দর্শনান্তে একে একে চলেও গেলেন ।

    পূবের আকাশ রাঙা হয়ে উঠেছে । দূরে পাহাড়ের মাথায় দেওদার গাছের মাথাগুলো হাওয়ায় দুলছিল । তারই ফাঁকে সূর্যোদয় হবে । সারা শহরের ঘুম ভাঙবে । আবার জেগে উঠবে মানুষজন । চেতনার হবে পূর্ণজন্ম । সময় ও গতির বৃত্ত ধরে দিন যাবে, মাস যাবে, বছর ঘুরবে । বসে বসে ভাবছিলাম । এরই মধ্যে হবে কত পরিবর্তন, কত নতুন ঘটনার হবে জন্ম ।

    সকাল হয়ে গেছে । ফিরে আসি ধর্মশালায় । চায়ের আসর বসেছে । বিমলবাবুই আসরের উদ্যোক্তা ও মধ্যমণি । তিনি যত্ন করে আনিয়েছেন চা, রুটি, মাখন, বিস্কুট । আজ রাতে হোটেলে তিনি দেবেন ডিনারপার্টি । তাঁর জয়জয়কার পড়ে গেছে ।

    আজ সারাদিনই এখানে থাকা । বিশ্রাম নেওয়া । ঘোরাঘুরি, হৈ হৈ করা । আগামী কাল বাড়ি ফেরা । তরুণের ছকেবাঁধা প্রোগাম অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে ।

    মন্দিরকমিটির তত্ত্বাবধানে ভোজনশালায় দুপুরের খাওয়াদাওয়ায় সেদিন বাড়ির রান্নার স্বাদ অনেক দিন পরে পেলাম । গরম ভাত, সুক্ত, ঘন্ট, ডাল, ডালনা, ভাজা, চাটনি, দই, মিষ্টি । নিরামিষ আহার । বড় ভালো লাগলো । পুরোপুরি বাঙালি ভোজন ।

    সিমলা শহর
    (ছবি : মুন্না ঘোষ)
    সেদিন বিকেলে দল বেঁধে হল সিমলার `ম্যল' চত্বর ঘোরাঘুরি আর সেইসঙ্গে প্রায় আট হাজার ফুটের মাথায় যক্ষপর্বত আরোহণ । ম্যল থেকে পথ ধাপে ধাপে ওপরে উঠে গেছে । পথ সুন্দর, যত্ন করে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় দেখলেই বোঝা যায় । পথের পাশে পাকা কংক্রীট জমান বেঞ্চ বিশ্রামের জন্য । পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ । অনেক পদযাত্রী উঠছেন, নেমে আসছেন । পাহাড়ের মাথা থেকে সারা সিমলা শহরকে সুন্দর ভাবে দেখা যায় । দেখলেই মনে হয় যেন কোনও চিত্রকরের হাতে আঁকা এক রঙিন ছবি । পাহাড়ের আর এক অংশে দাঁড়ালে চোখে পড়ে দূরে গাড়োয়াল সীমার হিমালয় অঞ্চলের অনেক নামকরা পাহাড়ের শিখরাবলী । তুষারশুভ্র, অভ্রমেদুর । পাহাড়ের মাথায় আছে বহু প্রাচীণ এক হনুমান মন্দির । এছাড়া বহু বাড়িঘর, দোকান পসার সুন্দর সুন্দর হোটেল, রেস্টুরেন্ট । টি স্টলে ঢুকে চা খেলাম সবাই । এরপর নেমে আসি ম্যলে ।

    সন্ধ্যার মুখ । সিমলার সন্ধ্যার ম্যল সত্যিই দেখবার মত । এইসময় সারা চত্বরটুকু যেন রমরমিয়ে ওঠে । অজস্র মানুষের আনাগোনা, নানা বর্ণের সাজপোশাকের ঘটা, অগাধ পণ্যদ্রব্যের সম্ভার, বেচাকেনা । এছাড়া ম্যল জুড়ে রয়েছে বহু দোকানপাট, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বার, নাচঘর, থিয়েটার হল । আলোর ঝরনায় যেন স্নান করছে সমস্ত পরিসরটুকু । নানা বর্ণের, নানা জাতির, নানা মানুষের এমন বর্ণাঢ্য মেলায় চোখ দুটি রঙিন হয়ে ওঠে । দুশো বছরেরও আগে বিদেশি ইংরেজ সরকারের হাতে গড়া এই সিমলা শহর । পরিপাটি করে সাজানো গোছানো ।

    বিমলবাবুর সিংকাপাস জয়ের কল্যাণে তাঁরই বদান্যতায় সেদিন রাতে হয়েছিল আমাদের সকলকে নিয়ে এক ডিনারপার্টি এখানের এক অভিজাত হোটেলে । আমরা তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করেছিলাম মনে মনে ।

    পরের দিন বাড়ি ফেরার কথা ভেবে আমরা আর দেরি করিনি । সকাল সকাল ধর্মশালায় ফিরে এসেছিলাম । অঙ্ক শেষের পালা শুরু হল সকাল থেকেই । আজ বাড়ি ফেরার পর্ব । সাজো সাজো রব কিছু ছিল না, ভাঁটাই পড়েছিল বলতে হবে । তবুও থেকে যায় কিছু কাজ । এটা সেটা, সাজ-সরঞ্জাম গুছিয়ে নিতে হয় । তাও নেওয়া হল । ছোট্ট চা-পর্বের পর সবাই বেরিয়ে এসেছিলাম ডর্মিটরি ছেড়ে । গ্রীষ্মের সিমলা । তবুও শীত জড়ানো ছ্যাঁকছ্যাঁকে সকাল । রোদ উঠেছিল, নিরুত্তাপ । তাই রোদ পোয়ানোর ঘটা চোখে পড়ে পথের ধারে স্থানীয় মানুষজনের ।

    সিমলা রেল স্টেশনে এসে হাজির হই । সিমলা-কালকা ট্রয় ট্রেন । কতদিনের পুরনো । ব্রিটিশ আমলে তৈরি । রেললাইন পাতার পরিকল্পনা করেছিলেন বড়লাট লর্ড কার্জন ১৯৪০ সালে । সিমলা-কালকা লাইন দিল্লীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল । ভারতের দীর্ঘতম ট্রয় ট্রেন পথ । ৯৬ কিংই. লম্বা । ৬ ঘন্টা লাগে পৌঁছতে কালকায় । পাহাড়, উপত্যকা, টানেলের মধ্যে দিয়ে লাইন ছুটেছে । কালকা থেকে ৩৭ কিংই. দূরে বরফ টানেল বা সুড়ঙ্গ । এ পথের দীর্ঘতম সুড়ঙ্গ । এক কিলো মিটারের মত দৈর্ঘ । রেললাইন অজস্র সুড়ঙ্গ, পাহাড়ি চত্বর, উপত্যকার সবুজ ছুঁয়ে, বনজঙ্গল, গাছপালার তোরণের মধ্যে দিয়ে অজগরি ঢংয়ে এগিয়ে গেছে । ভারি সুন্দর লাগে দেখতে । আরও ভাল লাগে গাড়িতে চড়ে যেতে ।

    সিমলা-কালকা রেলপথের অন্ধগুহা
    (ছবি : মুন্না ঘোষ)
    প্লাটফরমের এক কোনায় ছোট্ট ঝুড়িতে করে ছোট ছোট কয়েকটা কাঁচা আপেল নিয়ে বসেছিল স্থানীয় ছোট্ট একটা মেয়ে । রোগা রোগা গড়ন, ময়লা রঙ, একমাথা ঝাঁকড়া রুক্ষ চুল । ছেঁড়া ময়লা ফ্রক পরণে । খরিদ্দার তার কেউই হয়নি । করুণ চোখে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়েছিল । যদি আমি কিনি । কিনেও ছিলাম । দাম বলতে পাঁচ টাকা বলেছিল । একখানা দশটাকার নোট তার হাতে গুঁজে দিয়ে ট্রেনের কামরায় এসে উঠে বসি । ট্রেন ছাড়তে খুব বেশি দেরি ছিল না । মেয়েটি আপেলের ঝুড়ি আমার হাতে তুলে দিয়ে আনন্দে ছুটতে শুরু করলো পাশের দোকানে টাকাটা ভাঙাতে । পাঁচ টাকা আমাকে ফেরৎ দিতে হবে । যখন সে টাকা নিয়ে ছুটতে ছুটতে এল তখন ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে । আমার কামরার দিকে সে হাত তুলে প্রাণপনে ছুটে আসছিল । কিন্তু ততক্ষণ আমি তার নাগালের বাইরে চলে এসেছি ।

    জানালা দিয়ে দেখছিলাম তার সেই হতাশ হওয়া উদভ্রান্ত দুটি চোখ । টাকা না দিতে পারার একটা লজ্জা, অপরাধ মনে হয় মনটাকে তার ঘিরে ধরেছিল । চুপ করে দাঁড়িয়েছিল প্লাটফরমে আমার জানালার দিকে চেয়ে । মুখের ওপর পড়া সেই রুক্ষ চুলগুলো তার তখনও হাওয়ায় উড়ছিল । আমি দূর থেকে আরও দূরে চলে আসছিলাম । এরপর গাড়ির গতির সঙ্গে আমাদের ব্যবধানও অনেকখানি বেড়ে গেল । তারপর আর দেখতে পাইনি । জানালা থেকে আস্তে আস্তে চোখ সরিয়ে নিই ।



    [শেষ]


    (পরবাস, মে, ২০০৫)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments