বয়স হয়েছিল ৮৮ । রাধা বিশ্বনাথন, যিনি তাঁর স্বামীর প্রথম পক্ষের কন্যা ও তাঁর দীর্ঘদিনের কন্ঠ-সহযোগিনী, অসুস্থতার কারণে গান ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন । গান-সম্রাজ্ঞীর জীবন থেকে গানই চলে গেলে আর বাকি কী থাকে । স্বামী সদাশিবম্ ১৯৯৭ সালে পরলোক গমন করবার পর নিজেকে প্রায় সরিয়ে নিয়েছিলেন অন্তরালে । ততদিনে কল্কি গার্ডেনস এর প্রাসাদোপম বাড়ি ছেড়ে ছোট ভাড়া বাড়িতে চলে গিয়েছেন এম এস । সারাজীবন সম্মান ও অর্থ পেয়েছেন অজস্র । অর্থের সিংহভাগই চলে গিয়েছে দানে । ভারতরত্ন যখন পেলেন (১৯৯৮) তখন যে মানুষটি থাকলে সবচেয়ে খুশি হতেন সেই চিরসখা সদাশিবম পরলোকে । ভাই শক্তিভেলও পরলোকে । কে জানে, এম এস মনে মনে সেই ছোট্ট কুঞ্জম্মা হয়ে গিয়ে মা-বাবাকে খুঁজছিলেন কি না--শরীরও চলছিল না । তাঁর বিখ্যাত সেই নীল সিল্ক শাড়ি (যা এম এস-নীল বলেই জানত তাঁর অনুরাগীজন) ও হীরের কানফুল-নাকছাবির পিছনে যে নিবিড় অনাসক্তি ছিল তা নিয়েই যেন এম এস এর প্রস্থান ।
এম এস-এর জন্ম এক সাঙ্গীতিক পরিমণ্ডলে, তাঁর মা, সন্মুগবাদিভু একজন প্রতিষ্ঠিত বীণাবাদিকা ছিলেন, দিদিমাও বেহালাবাদিকা, ভাই-বোনেরা কেউ বেহালায়, কেউ মৃদঙ্গমে পারদর্শী । কিন্তু গত শতকের প্রথম দিকেও গান-বাজনার সাথে যুক্ত মানুষদের, বিশেষত মহিলাদের সামাজিক অবস্থান মোটেই গৌরবজনক ছিল না । মেয়েদের শিক্ষার প্রতিও তেমন জোর দেওয়া হত না । সেই অবস্থান থেকে বিশুদ্ধ প্রতিভার জোরে তিনি কর্ণাটকী সঙ্গীতে পুরুষ-প্রধান জগতে নিজের স্থান করে নেন, ১৯৬৭ তে সঙ্গীত কলানিধি পুরস্কার তাঁকে তাঁর গুরু সেম্মানগুড়ি আয়ারের মত প্রায় লিভিং লিজেণ্ড করে তোলে । তাঁর পিছন পিছন আরো কজন মহিলা শিল্পী এসে এই সঙ্গীতে স্ছত্ং-ঢছযঞঠধত্র -এ নীরব কিন্তু জোরদার আঘাত হানলেন, যেমন এম এল বসন্তকুমারী কিংবা ডি কে পট্টাম্মল । ঠিক সে-অর্থে ফেমিনিস্ট না হয়েও তাঁর কাজে নারীর আপন ভাগ্য জয় করে নেবার অঙ্গীকার যেন রয়েছে কোথাও । তাছাড়া, পণ্ডিত রবিশংকর যেমন হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের সাথে প্রতীচ্যের পরিচয় করিয়ে দিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন, তেমনি শুভলক্ষ্মীর হাত ধরে কর্ণাটকী সঙ্গীত প্রথম প্রতীচ্যের শ্রদ্ধা অর্জন করে নিল, শুনেছি এম এস ও সদাশিবম দুজনেই চিন্তিত ছিলেন পাশ্চাত্যের শ্রোতারা কিভাবে নেবেন এই ভেবে । কিন্তু দেখা যায় যে, কোথাও কোথাও অনুষ্ঠানের পরে বিমুগ্ধ শ্রোতৃবৃন্দ তাঁকে তাঁর গাড়ি অবধি অনুসরণ করেছে ।
দেশের বোদ্ধা শ্রোতা ও আমজনতার উচ্ছ্বাসের ব্যাখ্যা করা কঠিন নয়, কিন্তু কর্ণাটকী সঙ্গীতের সাথে অ-পরিচিত ও অ-দীক্ষিত শ্রোতার দল তাঁর গায়ন থেকে কি পেয়েছিলেন বুঝতে হলে হেলেন কেলার কে উদ্ধৃত করতে হয়,
কিন্তু এই মূল্যায়নের ফলে, বোদ্ধা সমালোচকরা এম এস এর প্রতি কি একটু অবিচার করে ফেলেননি ? ভক্তি-ভক্তি করে আমরা তাঁর কঠোর সাধনা, অধ্যবসায়, শৈলীর বুদ্ধিমত্তা, গান-নির্বাচন ও সর্বোপরি তাঁর বিশুদ্ধ স্বরপ্রয়োগের দক্ষতা লক্ষ করতে ভুলে যাইনি ? আমরা সবাই তাঁকে একজন
মৃদঙ্গবাদক দক্ষিণামূর্তি পিল্লাইকে কর্ণাটকী সঙ্গীতের
এইযে রাগভাব প্রতিষ্ঠা করার দক্ষতা, তা তাঁর সচেতন গায়কি-নির্মিতির অন্তর্গত । পরিণত বয়সেও গান গাইতে বসে প্রথমেই সেই রাগের সোজা-সাপটা কিছু ফ্রেজ গেয়ে শ্রোতাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া, যে আজকে কি গাওয়া হচ্ছে, এটা একদম তাঁর স্বাক্ষরিত শৈলী ।
তাঁর গায়কির প্রধান উপাদান কি ? আমার মনে হয় এই প্রশ্নটি আরেকটু পিছিয়ে গিয়ে এইভাবে করা যায়- সঙ্গীতের প্রধান উপাদান কী ? সুর ও লয়, তাই তো ?
এম এস-এর সুরঋদ্ধ কন্ঠের জাদুর কথা সাধারণ শ্রোতা থেকে উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁ সাহেব পর্যন্ত উল্লেখ করেছেন, খাঁ সাহেব তো এম এস-কে স্বরলক্ষ্মী শুভলক্ষ্মী বলতেন ।
শুভলক্ষ্মী তাঁর ছোটবেলার একটি অভ্যাসের কথা বলেছেন, তানপুরার ছেড় একবার শুনে নিয়ে গান শুরু করতেন, তারপর তানপুরা ছাড়া বন্ধ করে দিতেন । আবার আধঘন্টা বাদে তানপুরার সাথে মিলিয়ে নিয়ে দেখতেন বে-সুরো হয়ে গেছে কি না । ধীরে ধীরে এই সময়ান্তরাল বাড়াতে বাড়াতে পরে কয়েক ঘন্টা পরেও দেখা যেত স্বরস্থান তিলমাত্র বিচলিত হচ্ছে না । সারা দিন এই ভাবে অন্যসব কাজ করতে করতেই ষড়জ-পঞ্চম গুনগুন করতে থাকতেন ।
একে শ্রুতি-শুদ্ধম বলে বর্ণনা করেছেন তিনি ।
তাছাড়া, জটিল ও বক্র গতির রাগ গাইবার সময়েও তাঁর ভঙ্গিমার সারল্য শ্রোতাকে সেই জটিলতা-রহিত আনন্দের আস্বাদ দিত । পান্তুবরালি-র অন্তর গ ঠিক কোন শ্রুতির ওপর অবস্থিত তা জেনে শ্রোতা কি করবে ছাই, সে তখন সেই শুদ্ধ ও খোলা আওয়াজের আনন্দে অবগাহন করছে । ব্যাপারটাকে অনেকটা পাখির উড়ানের সাথে তুলনা করা যেতে পারে । পাখির উড়ান মানে তার ডানার হাড় ও মাংসপেশির জটিল নড়া-চড়া, কিন্তু সেই বিপুল আয়াস যদি পালকের আবরণে না ঢেকে পরিশ্রমটা একদম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হত, তবে তা এত মনোহারি হত কি ?
আমাদের উত্তর-ভারতীয় সঙ্গীতের বন্দিশের শতকরা আশি-নব্বই ভাগই বৃজভাষায় রচিত । কর্ণাটকী সঙ্গীতের বন্দিশ তেলেগু, তামিল মালয়ালম তো বটেই, কন্নড় ও সংস্কৃত ভাষায়ও রয়েছে । তাছাড়া বন্দিশও নেহাত দুই-চার লাইনের হয় না, তিন-চার তুকের পর্যন্ত হয় ।
এম এস এর অতি বড় সমালোচকও স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে এ-বিষয়ে এম এস এর মাপের, যাকে বলে, ভার্সাটাইল গায়িকা মেলা ভার । প্রাচীন ও সমকালীন বিদ্বানদের রচনা মিলিয়ে এম এস এর বন্দিশের ভাণ্ডারটি কম ছিল না । একই রাগের একাধিক রচয়িতার বন্দিশ গেয়ে ভক্তিরসেরও একাধিক ভাব প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন । আর সবকটি ভাষায়, যাকে বলে নিখুঁত উপস্থাপনা ।
উচ্চারণবিধি রপ্ত করবার জন্য এম এস এর নিষ্ঠা উঠতি গায়ক-গায়িকাদেরও লজ্জা দেবে । আন্নামাচার্য কৃতিগুলির রেকর্ডিং এর জন্য তেলেগুভাষার পণ্ডিতের কাছে উচ্চারণের তালিম নেন । দীর্ঘ রচনাগুলি, বলাই বাহুল্য, তিনি আগাগোড়া মুখস্থ করে গেয়েছিলেন, খাতা দেখে নয় । পঞ্চদশ শতকের এই সন্ত-কবির রচনা জনপ্রিয় করবার পিছনে এম এস এর অবদান নেহাত কম নয় ।
তাঁর বিদ্যার দিকটি উপলব্ধি করা সম্ভব হয় যখন জানতে পারি যে মেলকর্তা রাগগুলির উপর ৭২-টি রচনা যন্ত্রস্থ করবার মত দুরূহ কাজটি তিনি যে-বয়সে হাতে নেন
সে-বয়সে অনেকে অবসর গ্রহণের কথা ভাবেন । সংস্কৃতে রচিত এই কৃতিগুলি ভবিষ্যত প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জন্য যাবচ্চন্দ্রদিবাকর পথ-প্রদর্শক হয়ে থাকবে ।
শুভলক্ষ্মীর আরেকটি বৈশিষ্ট্য তাঁর বিষয় নির্বাচন । `মীরা' ছবিতে অভূতপূর্ব সাড়া পাবার পরই তিনি পুরোপুরি শাস্ত্রীয় ও ভক্তিমূলক গায়নে মনোনিবেশ করার সিদ্ধান্ত নেন । অনেকে এটা তাঁর স্বামী, তুখোড় সাংবাদিক, গান্ধিবাদী শ্রীসদাশিবমের প্রভাব বলে মনে করেন ।
এর আগে এম এস কিছু পদম্ রচনা গাইতেন, এগুলো তিনি বালা সরস্বতী ও টি
বৃন্দার কাছ থেকে পেয়েছিলেন, কিন্তু পদম মূলত ভরতনাট্যমে ব্যবহৃত হয়, সুতরাং এইসব রচনা সম্ভবত আদিরসাত্মক ছিল । হয়ত এতে খুব একটা স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন না `মীরা'-র গায়িকা । যাইহোক, এগুলো তিনি পরে আর কখনো গাননি । শ্রোতা হিসেবে তাতে আমাদের একটু আফশোস হয় বৈকি । বৈচিত্র্য আনবার জন্য সুব্রহ্মণ্য ভারতী-র দেশাত্মবোধক রচনা বা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বন্দে মাতরম্ গাওয়ার জন্য তাঁকে সদাশিবম অনুপ্রাণিত করেছিলেন । এছাড়া মীরা-সুরদাস এঁদের রচনা তো গাইতেনই । এই পর্যায়ের সমস্ত সঙ্গীত-কাচেরির পরিকল্পনা তাঁরা দুজনে মিলে করতেন । একেবারে কার পরে কি গাওয়া হবে, এইভাবে । স্কুলের শিক্ষা শেষ না-করা এম এস বিষয় নির্বাচনে যে কুশলতা লাভ করেন তা রীতিমত বিস্ময়কর । তাঁর গায়নে এই আকাদেমীয় পালিশ এক বিশিষ্টতা এনে দেয় । ১৯৪০ সালে সদাশিবমের সাথে বিবাহ অনেকদিক থেকেই তাঁর জীবনে একটি টার্নিং পয়েন্ট ।
আমার মনে আছে ১৯৮১ তে শান্তিনিকেতনে দেশিকোত্তম উপাধি নিতে এসে আকাশবাণীকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে তিনি রবীন্দ্রনাথের `আমার মল্লিকাবনে' ও রামপ্রসাদী মজলো `আমার মন ভ্রমরা' গেয়েছিলেন ।
এম এস এর যেসব গান আমার ব্যক্তিগতভাবে খুব প্রিয় তার মধ্যে `দেবী ব্রোভা' (চিন্তামণি), `রাম নান্নু ব্রোভারা' (হরিকাম্ভোজি), `কান্দু কান্দু' পড়ে । তাঁর সমঝদার শ্রোতারা `চাক্কানি রাজা' (খরহরপ্রিয়া) বা `শ্রীসুব্রহ্মণ্যায় নমস্তে'-র (কাম্ভোজি) কথা বলেন । তাঁর একটি পল্লবী শুনে আল্লাতুর ভাইয়েরা বলেছিলেন,
আমার বাড়ির খুব কাছে মুম্বাই আই আই টির পওয়াই পরিসর । সেখানে ১৯৭৫ সালে একটি জীর্ণ মন্দিরের সংস্কারের জন্য একটি চ্যারিটি অনুষ্ঠান করেন এম এস । সেই সময়ে এম এস এখানে একটি বকুল-চারা রোপণ করেন । এই সেদিন ফুল ও
সুগন্ধে আকীর্ণ মন্দির-প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে মনে হল, এই গাছটি যেন এম এস এর জীবনের প্রতীকী তাত্পর্য বহন করছে । রবীন্দ্রনাথের গান মনে পড়ে - `কত যে গিরি কত যে নদীতীরে, বেড়ালে বহি ছোটো এ বাঁশিটিরে' । এম এসও সানন্দে ওই ছোট বাঁশিটির মত কখনো পরমাচার্যের বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের বাণী কখনো মীরা-সুরদাসের লেখনীতে ভারত-আত্মার বাণী বহন করে বেড়িয়েছেন, তাঁর নিজের কথায়,
অসামান্য মানুষ, অসাধারণ জীবন, ও অভাবনীয় সঙ্গীত ।
(পরবাস, অক্টোবর, ২০০৫)